ধর্ম ও দর্শন: শত্রু শত্রু খেলা
এটা মূলত: কোন এক ব্লগারের পোষ্টে দেয়া মন্তব্য। ধর্মপ্রাণ সেই ব্লগার ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের কোন বিরোধ দেখেন না, কিন্তু দর্শন কোন মতেই ধর্মসম্মত নয়। যদিও এটা প্রতিক্রিয়ামূলক লেখা। তাই পূর্ণাঙ্গ আলোচনা হয়ে উঠে আসে নাই। কিন্তু এতো দীর্ঘ লেখা লিখে নিজের ব্লগে শেয়ার করব না, ভাবতেই কেমন লাগে। সেই মন্তব্যটি কিছুটা সম্পাদনা করে এখানে তুলে দেয়া হলো-
প্রথমতঃ বলা হয়ে থাকে ধর্ম যেমন বিশ্বাস দর্শনও একটা বিশ্বাস। এখন দুটি বিশ্বাস সাংঘর্ষিক, ফলে যিনি ধর্ম করেন দর্শন তার বিপরীত।
বিশ্বাস শব্দটা নিয়ে আমার আপত্তি আছে। ধার্মিকরা প্রায়শ ধর্মকে বিশ্বাস বলে প্রচার করেন। আবার সেই বিশ্বাসকে তারা অপরাপর বিশ্বাসের মতো একইভাবে ব্যাখ্যা করে। এটা মূলত: প্রতিপক্ষ জ্ঞানে। কিন্তু ধর্মের যে বস্তুকে (অধ্যাত্মিকও হতে পারে) তারা বিশ্বাস বলছেন তা কি অপরাপর বিশ্বাসের মতো কোন বস্তু? নাকি এরমধ্যে ফারাক আছে? বিশ্বাসের অন্তর্গত বলে ধর্মকে যদি হাজির করা হয়, তখন তা আপন বৈশিষ্ট্য হারিয়ে গড়পরতা বিষয় হয়ে যায়। ভূতে বিশ্বাস করার মতো ফেরেশতায় বিশ্বাস করা যায় না। একই সাথে ধর্মের যে রেফারেন্স তাতে ধর্মের নিজস্ব স্বাক্ষ্য ছাড়া কাল্পনিক বিশ্বাসের স্থান নাই। তাই ভেদহীন জ্ঞানকান্ডের রেফারেন্সে সব বিশ্বাসকে এক করে তোলা ধর্মকে খন্ডিত করে দেখা।
দ্বিতীয়তঃ ‘বিশ্বাসের পদ্ধতি’র সংজ্ঞায় দেখানো হয়েছে নানা ধরনের পদ্ধতি আছে। যেমন- ধর্মীয় বিশ্বাস, দার্শনিক বিশ্বাস। কিন্তু এই বিশ্বাসের পদ্ধতি আর বিশ্বাস কি এক জিনিস কিনা?
এখন, যদি কাউকে জিজ্ঞেস করা হয়, আপনার জীবন দর্শন কি? এর উত্তর প্রায়শ শুনি ‘মানুষের মতো মানুষ হওয়া’ এই ধরনের কিছু। কিন্তু এর নির্যাস আর পথের খোরাক কি এক জিনিস। এটা কি মতাদর্শ নাকি জীবনে কোন বিষয়টাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। এই দর্শন বলতে যদি একাট্টা কিছু বুঝেন, তাইলে তো মুশকিল। এটা হতে পারে দার্শনিক বিশ্বাস। এটা পদ্ধতির প্রশ্ন মতাদর্শের প্রশ্ন এক নয়। বিজ্ঞানের প্রতি বিশ্বাস এটাও এক ধরনের দার্শনিক বিশ্বাস। কারণ, এই বিশ্বাস চিন্তা করার পদ্ধতির দিক থেকে। চিন্তা কিভাবে প্রশ্নের উত্তর দিতে চায় আর কার বরাতে দিতে চায় সে মামলা। আর একই সূত্র বা সংজ্ঞা দিয়ে সবকিছু ব্যাখ্যা করা যায় এমন তো না। মানবিক জ্ঞানে সীমাবদ্ধতা বিদ্যমান।
এখন এই যে বিশ্বাসের ছড়াছড়ি, তো দর্শন কোন ধরনের বিশ্বাস কিনা। বিশ্বাস যদিও দর্শনে জ্ঞানের সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু আমরা কোন জ্ঞান নিয়ে নিঃসংশয় নই। কিন্তু দর্শনের কোন চিন্তা কিভাবে দাঁড়ায়? আপনি যদি কোন চিন্তা পদ্ধতি ধরে এগিয়ে যান, সেখানে প্রাথমিক কিছু অনুমান থাকে, যেটা দর্শনের ক্ষেত্রে এমনকি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অনিবার্য। কিন্তু এটা অনিবার্য নয় শেষ পর্যন্ত, সেই প্রাথমিক অনুমানে টিকে থাকা। কিন্তু ন্যূনতম অর্থে একে বিশ্বাস বললেও ধর্মকে যারা বিশ্বাস বলে, তাদের সে রকম কোন কর্মপন্থা বা সিদ্ধান্ত কোন দার্শনিক আলোচনায় আসে কি? দর্শনের রিচুয়্যাল কৈ?
ধর্মে সিদ্ধান্ত থাকে। কিন্তু দর্শন যখন সিদ্ধান্ত এসে যায়, তখন তাকে দর্শন বলে না, বিজ্ঞান বা অন্য কোন শাস্ত্র বলে। যেমন- পদার্থবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান ইত্যাদি। সুতরাং, বিশ্বাসের যে ধারণার উপর দাঁড়িয়ে আমরা কথা বলি চিন্তার অন্তনিহিত সঙ্গতিকে তার সাথে এক করা যায় না। এখন একজন দার্শনিক তার একাডেমিক আলোচনা বা যুক্তি-তর্কের বাইরে নিজে কিভাবে জীবন-যাপন করছেন, সেটা অন্য বিবেচনা।
বিশ্বাসের সংজ্ঞায়নের বিষয়টা আশা করছি এখানে চলে এসেছে। ধর্মকে লোকে সেভাবে বিশ্বাস বলে দর্শন তেমন বিশ্বাস নয়। ধর্মের মর্মরূপ ঈমানের সাথে জড়িত। ধর্মকে ঈমান দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা যায়, বিশ্বাস দিয়ে নয়। কারণ ঈমানের সাথে আস্থা আর কর্মের যে সম্পর্ক বিশ্বাসে সেটা নাই। আবার জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবে বিশ্বাস বচন বা প্রোপ্রোজিশন বা প্রিমাইজের ধারণার যুক্ত। এটা লজিক্যাল কনসেপ্টে, সেটার সাথে বাস্তব জীবন-যাপনের নানা ফারাক আছে। কারণ যুক্তির বাস্তবতা আর ঘটমান বাস্তবতা এক নয়। যেমন- গণিত চিন্তাকে পরিচ্ছন্ন করে। কিন্তু গণিতের সব ফলাফল আমার প্রয়োগ করতে পারি না। ধর্মের ধারণাগুলোকে একইভাবে লজিক্যাল আকারে দেখানো যায় না।এমন কি খোদ ধর্মের ঐতিহাসিকতায়।
এবার দেখা যাক দর্শনে ধর্মের আলোচনার ধরণ কি? এটা ধর্মীয় দিক থেকে গ্রহণযোগ্য কিনা? সাধারণ একটা আলোচনা দিয়ে এটা বলা যাক। দর্শনের ঈশ্বর সম্পর্কীয় পক্ষ ও বিপক্ষে যুক্তি আছে। কিন্তু সেই ঈশ্বরের সাথে ধর্মের ঈশ্বরের পার্থক্য আছে। ঈশ্বর নিয়া এরিস্টটলের যুক্তি নানাকালে মানুষকে প্রভাবিত করলেও এটা যৌক্তিক ঈশ্বর।কিন্তু এই যুক্তির অধিবিদ্যিক, বিশ্বতাত্ত্বিক গুরুত্ব আছে। এরিস্টটলের আনমুভড মুভার বা অচালিত চালক ঈশ্বরের ধারণা তার সময়কালের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও যুক্তির (মনে রাখতে হবে নানা দেবতায় বিশ্বাস ছিলো তখনকার গ্রীক ধর্মের ভিত্তি) নিরিখে পাওয়া। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, এটা এরিস্টটল ধর্মীয় বিশ্বাস আকারে প্রকাশ করেছেন। এটা তার চিন্তা পদ্ধতির নিজস্ব গতি। সেই গতির নানাভাবে নানা বাক বদল ঘটেছে।
এখন অনেকে বলছেন ঈশ্বর সম্পর্কীয় দার্শনিক যুক্তিগুলো অনেককে বিভ্রান্ত করেছে। এই বিভ্রান্ত আমার নিজস্ব ধারণা নয়। প্রধানতঃ এই যুক্তিগুলো খৃষ্টান ধর্মে নানা প্রভাব রেখেছে। কিন্তু সেটা পুরাপুরি দার্শনিক বিষয় কি? বরং, ক্ষমতা সম্পর্কের দিক থেকেও। সেদিক থেকে রাজনীতি কিভাবে বুদ্ধিবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে সে আলোচনা-পর্যালোচনার দরকার আছে। দর্শনে ধর্ম দর্শন আছে। আবার দার্শনিক যুক্তি দ্বারা বিকশিত ধর্মতত্ত্ব আছে। তো, ধর্মীয় জীবন-যাপন নিয়ন্ত্রণে যে ধর্মতত্ত্ব তার মধ্যে ধর্মকে যুক্তি সঙ্গত করার চেষ্টা আছে। যেমন- বৈজ্ঞানিক ইসলাম, গণতন্ত্রী ইসলাম। এগুলো যে করতে হয়, এটা কি দর্শন চর্চা না। মোটের উপর, জগত ও জীবন সম্পর্কীয় প্রশ্নগুলো নিয়ে যৌক্তিক, বৌদ্ধিক ও আনুধ্যানিক প্রচেষ্টা হলো দর্শন। আবার দর্শন অন্ধবিশ্বাস, চাপিয়ে দেয়া প্রাতিষ্ঠানিকতা এবং চিন্তার উপর রাজনৈতিক প্রভাবের প্রতিবাদও বটে। এটা মানুষের মৌলিক বৃত্তিও বটে।
মুসলিম ইতিহাসে যেটাকে স্বর্ণযুগ (বাগদাদ, দামেস্ক, স্পেন) বলা হয়, সেই সময়ও নানাভাবে চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চালানো হয়েছে। সেই স্বর্ণযুগ হলো ষড়যন্ত্র আর পাল্টা ষড়যন্ত্রের যুগ। খেয়াল করার বিষয়, এইসব সমৃদ্ধির পতন ঘটেছে স্বাধীন চিন্তার পতন ঘটার সাথে সাথে। সে ধারার সর্বশেষ দার্শনিক ইবনে খলদুন। ষড়যন্ত্র আর পাল্টা ষড়যন্ত্রে তার জীবন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছিলো। সেই সব কিছুই টিকে নাই। টিকে আছে তার চিন্তা।
অনেকের আক্ষেপ মুসলিম দার্শনিকরা এরিস্টটলের চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। কিন্তু মুসলমানরা তো অন্যের বিজ্ঞান বা রাজনীতি বা অর্থনীতি দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছে বা এখনো হচ্ছে। এই প্রভাবের মধ্যে ভালো মন্দ দুই আছে। দোষ শুধু চিন্তা পদ্ধতি অনুসরনে। কিন্ত মানুষের চিন্তার এই সক্রিয়তাকে জোর করে বেধে দেবার যে চিন্তা, তা সাময়িকভাবেই ফলদায়ক। তারপরও আমরা দেখি, ইবনে তাইমিয়া কি অসাধারণভাবে এরিস্টটলের যুক্তিবিদ্যাকে খন্ডন করেন অথবা আল-গাজালীর চিন্তা। তাদেরও আমরা দার্শনিক বলি। এটাই দর্শনের জগত। দার্শনিক বা দর্শন বলতে একাট্টা ধর্মবিরোধিতার যে গন্ধ তা অধর্মের চেয়ে ধর্মের মধ্যে বেশি। এই কারণে দর্শনের সঠিক পর্যালোচনা তৈয়ার হয় নাই, আমাদের দৌড় গাজালী পর্যন্ত। এরপর মুসলমানদের মধ্যে চিন্তার বিকাশ সেই অর্থে ঘটে নাই। আর যারা দর্শনের বিরোধিতা করেন, তারাও মধ্যযুগে তাবু গাড়েন অথবা যাকে মোকাবেলা করা যায় না তাকে ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে পার পাবার চেষ্টা করেন। তো, এখন চলছে ইওরোপীয় বাহ্যিক চাকচিক্যের সাথে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা।
আমি অনেকের মতো মনে করি, চিন্তাকে চিন্তা দিয়ে এইভাবে মোকাবেলা করতে হবে। আপনি যদি কোন কিছুকে ভুল মনে করেন, আপনি সেটা প্রতিরোধ করতে পারেন আলোচনা-পর্যালোচনা দিয়ে, কিন্তু এই করা যাবে না, এই শোনা যাবে না- এটা কোন ধরনের সমাধান না। তাছাড়া জ্ঞানের কোন শাখা সে দর্শন বা বিশেষায়িত কিছু তাকে আলাদা করে দেখার উপায় কি? দর্শন ও বিজ্ঞান সবসময় হাত ধরাধরি করে চলেছে, তেমনি মুসলিম প্রাচ্য বা এখনকার পাশ্চাত্যেও একই কান্ড ঘটছে। সব জ্ঞানই সত্যে পৌঁছতে চায়। এখন চেষ্টা, চিন্তা, প্রেক্ষাপট তাকে কোথায় নিয়ে যাবে- সেটা আলাদা কথা। কিন্তু ধর্মজীবিরা এইসবকে তাদের ধর্মের ষড়যন্ত্র বলে লানত দেয়। সেটা আসলে কি? নিজেদের অক্ষমতার একটা দিকমাত্র।
এই শ্রেণীর ধার্মিকরা মানুষের ইন্দ্রিয় ও বুদ্ধি দিয়ে পাওয়া জ্ঞানের বড় অংশকে ওয়াহীর জ্ঞানের বিপক্ষে মনে করেন। ওয়াহীর জ্ঞান ও অর্জিত জ্ঞানের ধারণা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ওয়াহীর জ্ঞান কি পরীক্ষা করা হয় না। তা নাহলে ধার্মিক ব্যক্তিদের আস্তিক হাবার পক্ষে এতো যুক্তি দিতে দেখা যায় কেন। পবিত্র কুর’আনে কোন কিছু নিয়ে ভেবে দেখতে বলা হয়েছে বা নানা উদাহরণ দেয়া হয়েছে। যদি, যুক্তি-তর্কের দরকার না থাকে সেই আল্লাহতে ঈমানের দাওয়াতের কাজটি শুধু ঈমান দ্বারা কবুল হয়ে যায় না কেন? কেন ধর্মতত্ত্বের উৎপত্তি ঘটে? কেন তাফসিরের দরকার হয়? মানুষ যখন এই ওয়াহীর জ্ঞানকে নিজের জীবন যাপনের ভেতর দিয়ে উপলদ্ধি করে, খুঁজে দেখে তখন সেটা কি তার চিন্তা বুদ্ধি বিবেকের মাধ্যমে অর্জিত নয়। ওয়াহী নিয়ে চিন্তা করলে ওয়াহীর খাটিত্ব নষ্ট হবার ভয় কাজ করে ধার্মিকের মনে। কিন্তু কোন জ্ঞান ব্যক্তির বুদ্ধি-বৃত্তির আয়নার বাইরে থাকে না। যার বুদ্ধিবৃত্তিকে আমরা নিম্নশ্রেনীর বলি, তারও বিশ্বাস করার সামান্যতম বৌদ্ধিক চেষ্টা থাকে। নিরংকুশ মেনে নেয়ার ধারণা কল্পনায় সম্ভব অথবা যিনি এইভাবে মেনে নেন, তার এই বিষয়ে কথা বলার প্রয়োজন হয় না, তার বিদ্বেষের দরকার হয় না। কারণ তার মিলে গেছে।
সেই আলোচনায় মারাত্মক কথাটি ছিলো বিজ্ঞান বস্তুর জ্ঞান দেয় তা-ই ইসলামসম্মত। সেখানে মানদন্ড হলো যে বিজ্ঞান ধর্মের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ তাকে গ্রহণ করবে। নয়তো নয়। যেমন-শক্তির নিত্যতার সূত্র। এটা ধর্মসম্মত নয়। তাই তিনি শক্তির নিত্যতার সুত্র নেবেন না, এটা বাদ অন্য বিজ্ঞানটা নেবেন। এখন খোদ বিজ্ঞান যদি একে অগ্রাহ্য না করে এগুতে না পারে, তাইলে এটাকে বাদ দিয়ে এর উপর প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানের অন্য ফলাফল কিভাবে মেনে নেন? ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক সিদ্ধান্তের উপরে দাঁড়িয়ে থাকা অপর সিদ্ধান্ত আপনার ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে মিলে বলেই আমরা মেনে নেবো। এমনটা অসম্ভব। কিন্তু তা-ই কি ঘটে না? যেভাবে ইসলামি দলগুলো ইউরোপীয় গণতন্ত্র নেয় কিন্তু সেই গণতন্ত্রের হাত ধরাধরি করে থাকা ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ, সম্পত্তি অধিকার, সেক্যুলারিজম নিয়ে তারা চুপ। গালি দেয় কিন্তু গণতন্ত্রের সাথে সেক্যুলারিজমের ইতিহাস মিলিয়ে পড়ে না। তারা গণতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করার কথা ভাবতেও পারে না। বরং, নিজেদের ধর্মকে এইসবের সাথে মিলিয়ে দেখতে ব্যস্ত।
বিজ্ঞানের সৌধ নির্মাণ করে যে নিত্যতার সূত্রের উপর সেই দোষ চাপিয়ে দেয়া দর্শনের উপর। বলা হচ্ছে এটা সায়েন্স না সায়েন্টিফিক ফিলোসফি। দোষ না হয় হলো, কিন্তু বিজ্ঞানের কোন সূত্র প্রমাণের পূর্বে দর্শনের আওতার বাইরে থেকেছে? দর্শন তো প্রমাণ বা অপ্রমাণের দায়িত্ব নেয় না। সে যুক্তি বাতলে দেয় মাত্র। যদিও আমি জানি না শক্তির নিত্যতার সূত্র অনৈসলামিক কিনা। কারণ শক্তির এই রূপান্তরের মীমাংসা ইহকালের ভেতর। ইহকাল ধ্বংসের সাথে কেয়ামতের পর এর কোন প্রাসঙ্গিকতা এই সূত্রে আছে কিনা? এই সূত্রের ভেতর পরকালের কোন ব্যাপার নাই। যেমনি কোন বিজ্ঞানে পরকাল নাই। ধর্মে পরকাল আছে। দর্শনের অনেকের মতের অনেক কিছু ধর্মের সাথে যায় না, এই নিশ্চয়তা সে দেয়ও না। কারণ সেটার দেওয়ার নয়। এমনকি কোন স্বাতন্ত্র্য ধার্মিক ব্যক্তির জীবন যাপনে যা কিছু তার বোধ উপলদ্ধি কর্ম, তার সবই ধর্মের সাথে যায় না। তার মানে এই নয়, যে জীবন পরিত্যক্ত। সে জীবন কি ধার্মিকের জীবন নয়?
বিজ্ঞান বস্তুর কথা বলে তা-ই এটা ইসলাম সম্মত, এই কথার মানে কি? ধর্মীয় স্বীকার্য আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতা, কিতাবের জ্ঞান, রাসূল এর কোনটা বস্তগত মানে দ্বারা দাঁড়িয়ে আছে? আর বস্তুকে ব্যাখ্যা করব অথচ ইন্দ্রিয়কে অস্বীকার করব, এটা কোন ধরনের জ্ঞান বোধগম্য না। ইন্দ্রিয়ই বস্তুর অনুভূতি দেয়। আর যা দেখা তাকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করার মধ্যে ভ্রান্তি আছে।
আমাদের একজন শিক্ষক দর্শন নিয়ে সুন্দর একটা উদাহরণ দেন। দর্শন তো কিছুই বানায় নাই। না পেন্সিল, না মহাকাশযান। তাহলে দর্শনের এতো কদর কেন? তার মতে, দর্শন সেই ভাবনা যেটা বলে দেয় কেন পেন্সিল বানাতে হবে, কেন মহাকাশে যেতে হবে। আর যখন বানানোর কাজটা হয়ে যায় তখন এটা বিজ্ঞান, দর্শন না। যখন আপনি দর্শনকে মোকাবেলা করছেন যুক্তি, বুদ্ধি ও পদ্ধতির সাহায্যে আপনি তো দর্শনই করেন। যেটাকে তিনি বলেন, দর্শন করে দর্শনে বেখবর থাকা। আল্লাহ প্রতিটি সৃষ্টির পেছনে তার কর্ম রেখেছেন। সেটা জানার চেষ্টাই দর্শন।
প্রথম প্রকাশ: ইচ্ছেশূন্য মানুষ