আর্টিকেল রিভিউর জবাব: মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে ইসলাম ও রাষ্ট্রের সর্ম্পক বিশ্লেষণ
সম্প্রতি ‘মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে ইসলাম ও রাষ্ট্রের সর্ম্পক বিশ্লেষণ’ শিরোনামে সিএসসিএসে আমার একটি আর্টিকেল প্রকাশিত হয়েছে। জাহিদ রাজন এর চমৎকার একটি রিভিউ দিয়েছেন। এ জন্য লেখককে ধন্যবাদ। রিভিউতে লেখক ইসলাম ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক বিশ্লেষণের প্রস্তাবিত স্কেলটিকে মুসলিম প্রধান দেশগুলোর অতীত ইতিহাস ও ভবিষ্যতের কর্মপন্থার সাথে সম্পর্কিত করার প্রয়াস চালানোর আহবান জানিয়েছেন। পাশাপাশি বর্তমানের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বাস্তব প্রশ্ন তুলে ধরেছেন। এই রিভিউ’র প্রেক্ষিতে প্রস্তাবিত স্কেলটির ব্যাপারে কিছু ক্লারিফিকেশন দেয়াসহ লেখকের প্রশ্নগুলোর জবাব দেয়ার প্রয়াস চালাবো।
কিছু ক্লারিফিকেশন:
১. প্রস্তাবিত স্কেলটিকে শুধুই আধুনিক রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কিত হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। ইসলামের ইতিহাসের বিভিন্ন প্রকার ঐতিহাসিক রাষ্ট্রীয় মডেল (খিলাফত, সালতানাত, নবাবী রাজ্য ইত্যাদি) কিংবা ভবিষ্যতের যে কোনো প্রকার রাষ্ট্রীয় মডেলের আলোচনা আপাতত আলোচনা বহির্ভূত থাকাই উচিত।
২. আলোচনার সুবিধার্থে বর্তমান স্কেলকে আপাততভাবে একটি নাম দেয়া যাক, ‘ইসলাম ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক সূচক’ (relational index of state & Islam) । এই সূচকে সময়ের পরিক্রমায় মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে রাজনৈতিক, সামাজিক পরিবর্তনসহ রাষ্ট্রের চরিত্র বদল হওয়ার ফলে রাষ্ট্রের বিবর্তনকে বিবেচনা করে -৬ থেকে +৬ পর্যন্ত স্কোরিং করা হয়েছে। অন্যান্য সূচকের সাথে এই সূচকের নীতিগত পার্থক্য রয়েছে। যেমন, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ব্যবহৃত দূর্নীতি সূচকের স্কোরিংয়ে মূলনীতি হিসেবে ধরে নেয়া হয়, দুর্নীতি খারাপ বিষয়। তাই এই খারাপের স্কোরিং করা হয়। অন্যদিকে ‘ইসলাম ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক সূচকে’ প্রথমেই কোনো কিছুকে ভালো-খারাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। ভালো-খারাপ নির্ধারণের দায়িত্ব বরং স্কোরিং ব্যবহারকারীর উপর ছেড়ে দেয়া হয়।
সূচকে একজন ইসলামপন্থীর বিবেচনায় ‘-৬’ যেমন ‘নাস্তিক রাষ্ট্র’ এবং ইসলামী ধারণায় তা রাষ্ট্রের সর্বনিম্ন পর্যায়, ঠিক একজন নাস্তিকের বিবেচনায় ‘-৬’হলো রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়। স্কেলটিকে উল্টো করে স্কোরিং করেও একজন নাস্তিক তার বিবেচনায় সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাষ্ট্র থেকে ‘ইসলামী রাষ্ট্র’কে সর্বনিম্ন স্কোরিংয়ের রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করতে পারে। মূল পয়েন্ট হলো, মাইনাস মানেই খারাপ নয়, প্লাস মানেই ভালো নয়, পারসেপশন হলো বিবেচনার মূল বিষয়।
একটি রাষ্ট্র ‘নাস্তিক রাষ্ট্র’ হিসেবে ভালো নাকি ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ হিসেবে ভালো, তার নির্ধারণ সূচকের মাধ্যমে হবে না, বরং সেই রাষ্ট্রের প্রত্যেক জনগণের নিজস্ব বিবেচনার বিষয় হিসেবে বিবেচিত হওয়াই উত্তম। সূচক শুধু তাদের মতের প্রতিফলনটিকেই প্রকাশ করবে।
৩. ‘ইসলাম ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক সূচক’ প্রস্তাবনাটি যে লেখা দ্বারা অনুপ্রাণিত সেখানে বলা হয়েছে, “স্বয়ং রাসূল (সা) মদীনায় যে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তারও বিভিন্ন ধাপ বা পর্যায় ছিলো। মদীনা রাষ্ট্রের প্রাথমিক পর্যায়ে সে সব আইন কার্যকর ছিলো না, যেগুলো শেষ দিকে চালু হয়েছিলো। এই বিবর্তন প্রক্রিয়ায় মদীনা রাষ্ট্র তার প্রাথমিক সময়কালে ইসলামী ছিলো না, এমনটা কিন্তু নয়। বরং সর্বাবস্থায়ই তা ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে ছিলো। তবে পার্থক্যটা হলো গুণগত।”
বর্তমানে ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ হিসেবে বিবেচিত রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে নানাবিধ ধর্মীয়, আইনী, রাজনৈতিক, সামাজিক সমস্যা থাকতেই পারে। তার মানে এই নয়, এই রাষ্ট্রকে জোর করে স্কোরিং বাড়িয়ে দিতে হবে কিংবা কমিয়ে দিতে হবে। ইসলামী রাষ্ট্রের স্কোর ‘+৬’ দেয়া হয়েছে, কারণ ইসলামী রাষ্ট্রে ইসলামের রাষ্ট্রীয় ধারণাকে সাংবিধানিকভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। এবং সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরীর মাধ্যমে ইসলামী মূল্যবোধ ও শরীয়াহর বিধিবিধানকে রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধ ও রাষ্ট্রীয় প্রকৃতির সাথে সমন্নয়ের প্রচেষ্টা করা হয়েছে ও চলছে।
সোশালিস্ট দেশের মডেল হিসেবে সুইডেনকে সচরাচর বিবেচনা করা হয়। তার মানে কিন্তু কখনোই এই নয়, সুইডেনের অর্থনৈতিক, সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক ব্যবস্থার সবকিছুই সর্বোত্তম।
রিভিউ লেখকের উত্থাপিত প্রশ্নের ব্যাখ্যা:
১. ব্যক্তি স্বাধীনতা, হিজাব ও ইরান: আধুনিক ব্যক্তি স্বাধীনতা একটি প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়। ফ্রান্সে যখন হিজাব নিষিদ্ধ করা হয়, কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের আলাদা আলাদা স্টেটে শরীয়াহ আইন বিরোধী আইন পাশ করা হয়, তখন কিন্তু আধুনিক ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রশ্নকে প্রাধান্য দেয়া হয় না। ‘আমারও রয়েছে হিজাব পরিধানের কিংবা শরীয়াহ পালনের অধিকার’- এই যুক্তিকে বিবেচনা করা হয় না, বরং ‘তোমার ব্যক্তিগত ধর্ম পালন আমাদের সমাজের বেশিরভাগের জন্য সমস্যা, তাই তা নিষিদ্ধ থাকাই উত্তম’- এই যুক্তিই প্রাধান্য পায়।
ইরানে হিজাবের ব্যাপারে কড়াকড়ি রয়েছে বটে, কিন্তু তা মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলো থেকে অনেক কম। অধিকন্তু ইরানে নারী শিক্ষার হার মধ্যপ্রাচ্যের যে কোনো দেশ থেকেই বেশি, এমনকি বাংলাদেশের মত হিজাবে সহনশীল অথবা বিরোধী দেশ থেকেও। শিক্ষা, রাজনীতি, মিলিটারি থেকে শুরু করে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সবক্ষেত্রেই নারীর অবাধ অধিকার ও সুযোগ রয়েছে।
হিজাবকে ‘হিজাব’ মনে না করে পোশাক হিসেবে বিবেচনা করাই ভালো। আমাদের দেশেও কিন্তু নারীর ব্যক্তি স্বাধীনতায় যে কোনো ধরনের পোশাকের ব্যাপারে বিধিনিষেধ রয়েছে। কিছুদিন আগেই পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশে পোশাকের ব্যাপারে আইন করা হয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলোতেও ইসলামী পোশাকের নামে পোশাকের বিষয়েই বিধিনিষেধের আলোচনা চলছে।
আসল বিষয় হলো, আধুনিক ব্যক্তি স্বাধীনতার ধারণায় নারীর পোশাক পরিধানের সীমা নির্ধারণ একটি ইসলামী কিংবা ইরানী সমস্যা নয়, বরং আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর বৈশ্বিক সমস্যা।
আর ইরানে মদ, জুয়া সংক্রান্ত আইনে সাধারণ মানুষের অনুমোদন আছে কিন্তু হিজাবের ব্যাপারে নাই- এই রকম দাবি কতটুকু যৌক্তিক?
২. থিওলজিক্যাল স্টেট, আয়াতুল্লাহ ও ইরান: ইসলামী রাষ্ট্রের ধারণার বিকাশ যেহেতু ইসলামী উৎস থেকেই হয়েছে, তাই ইসলামের ভিতরের চলমান সম্প্রদায়ের প্রভাব এর মধ্যে থাকা অযৌক্তিক কিছু নয়। সুন্নী ইসলামের রাষ্ট্র ধারণায় থিওলজিক্যাল স্টেটকে নাকচ করা হয়েছে, কিন্তু শিয়া ইসলামের রাষ্ট্র ধারণায় শিয়া ইমামতের আইডিয়াকে ইসলামী রাষ্ট্রে সংযুক্ত করা হয়েছে। তাই আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান একে থিওলজিক্যাল রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করলেও বাস্তবে তা নয়।
ইরানে জনগণের কাছে জবাবদিহি করার মত প্রতিষ্ঠানগুলো প্রেসিডেন্টসহ রাজনৈতিক ও নির্বাহী প্রতিষ্ঠানগুলোর অধীনে থাকে। আয়াতুল্লাহ রাষ্ট্রপ্রধানও নন; বরং রাষ্ট্রের প্রতীকী কর্ণধার, অনেকটা যুক্তরাজ্যের রাজপরিবারের মত।
আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান দিয়ে তুলনা করলে সুন্নি আর শিয়া ইসলামী রাষ্ট্রের ধারণাগত পার্থক্য অনেকটা যুক্তরাষ্ট্র আর যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রব্যবস্থার মত। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতীকী কর্ণধার বলতে কেউ নেই, আর যুক্তরাজ্যে রাজপরিবার রাষ্ট্রের প্রতীকী কর্ণধার।
প্রেসিডেন্ট আহমেদিনেজাদ ইরানের আয়াতুল্লাহর বিরুদ্ধে ছিলেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে এর বিরুদ্ধে প্রচারণাও চালিয়েছিলেন। তারপরেও তাঁর পক্ষ নেয়া আয়াতুল্লাহর কোনো মানে হয় না। ভোট জালিয়াতি কখনোই কাম্য নয়। ভোটের ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। অভিযোগকারীদের অভিযোগ করা ত্রুটিপূর্ণ ভোটের হিসাব বাদ দিলেও ভোটেরপরিসংখ্যানে যিনি এগিয়ে ছিলেন আয়াতুল্লাহ তাকেই অনুমোদন দিয়েছেন মাত্র, যদিও সে প্রার্থী ব্যক্তিগতভাবে আয়াতুল্লাহর বিরোধী।
“আয়াতুল্লাহর যে কোনো স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জনগণ কোনো ধরনের অসন্তোষ প্রকাশ করতে পারে না। … জনগণের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনে সরকারী বাহিনী ব্যাপক অত্যাচার নির্যাতন চালিয়েছে।”
জনগণ অসন্তোষ প্রকাশ করতে না পারলে কিভাবে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করে? স্ববিরোধী হয়ে গেলো না?
৩. বাংলাদেশ বনাম মালদ্বীপ: মালদ্বীপ খুবই ছোট রাষ্ট্র, উদাহরণ হিসেবেও তাই দুর্বল। তাছাড়া মালদ্বীপের রাষ্ট্রব্যবস্থা ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা আর নিজস্ব ঐতিহাসিক কারণে অনেকটাই ব্যতিক্রম। রাষ্ট্রের শুরুতেই মালদ্বীপে কোনো অমুসলিম ছিল না। নাগরিকত্বের ধারণা সেই সময় থেকেই নেয়া হয়েছে, রাষ্ট্রধর্ম হবে সবার যা ধর্ম। আর অন্য ধর্মের কেউ নাগরিক হতে পারবে না। তারমানে অন্য ধর্ম মুখ্য ইস্যু নয় বরং মালদ্বীপের জাতীয়তার প্রশ্নই মুখ্য।
বাংলাদেশের সাথে শুধু রাষ্ট্রের ধর্ম প্রচার-প্রসারে ইসলামকে প্রাধান্য দেয়ার বিষয়টি কমন বিধায় মালদ্বীপকে একই স্কোরে রাখা হয়েছে।
৪. আমীর শাসিত/রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও মানবাধিকার: যৌক্তিক প্রশ্ন। এই ধরনের দেশগুলোতে ইসলাম প্রশ্নে রাষ্ট্র ও সমাজের একটি বড় ধরনের বোঝাপড়া হয়ে গিয়েছে ইতোমধ্যে। রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারণার ভিত্তিমূল অনেকটা সমাজের ভিতরে প্রোথিত। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা অনেক বেশি। আরব জাগরণে তিউনেশিয়ায় বেন আলীকে চলে যেতে হলেও জর্ডানের বাদশাহ কিন্তু টিকে আছে। তাই স্কোরে বর্তমান জর্ডানকে ‘+৫’ এ স্থান দেয়া হলেও বেন আলীর তিউনেশিয়াকে ‘-৫’ এ স্থান না দিয়ে ‘-৩’ এ স্থান দেয়া যায়। আর ‘+/-’ এর বিষয়টা আগে ব্যাখ্যা করেছি, ইসলামীকরণে জর্ডানের ভূমিকা বেন আলীর তিউনেশিয়া থেকে বেশি ছিল বিধায় জর্ডানের ক্ষেত্রে ‘+’ দেয়া হয়েছে।
৫. আরব জাগরণ, মিশর ও তিউনেশিয়া: এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করাই উত্তম, তাই পরবর্তীতে আরেক ধাপে আলোচনা হতে পারে।