মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে ইসলাম ও রাষ্ট্রের সর্ম্পক

আর্টিকেল রিভিউ: মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে ইসলাম ও রাষ্ট্রের সর্ম্পক বিশ্লেষণ

এডিটর’স নোট: জনাব শহীদুল হক সম্প্রতি মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে ইসলাম ও রাষ্ট্রের সর্ম্পক বিশ্লেষণ করে সিএসসিএস-এর ওয়েবসাইটে একটি আর্টিকেল লিখেছেন। শহীদুল হকের মতামতটির পর্যালোচনা করেছেন জাহিদ রাজন।

*****

আলোচিত লেখাটিতে একটি নতুন ধারণা দেয়ার চেষ্টা করে হয়েছে। ইসলামপন্থীদের মধ্যে যারা ইসলামী রাষ্ট্রের স্বরূপ ও প্রকৃতি নিয়ে চিন্তা করেন, তাদের জন্য লেখাটি চিন্তার খোরাক যোগাবে বলে মনে করছি। একটি দেশ এই মুহূর্তে এই স্কেলের ঠিক কোথায় অবস্থান করছে, তার পরবর্তী গন্তব্য কি হতে পারে- এসব বিষয়ে ধারণা লাভের জন্য এ ধরনের স্কেল সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। বিশেষ করে ইসলামী রাষ্ট্রের অনুপস্থিতিতে ইসলামী দলগুলোর কর্মপন্থা নির্ধারণ এবং কৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য এ ধরনের স্কেলের ধারণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ইসলামের ইতিহাসকে এই স্কেলের আলোকে পর্যালোচনা করলে ইসলামী খিলাফাতের কোন যুগে রাষ্ট্রের কি বৈশিষ্ট্য ছিল এবং এ স্কেলে তা কত স্কোর অর্জন করেছে, তা বিবেচনা করা যাবে। ফলে এটি বর্তমান সময়ের জন্য আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হবে বলে মনে করছি।

এই ধরনের স্কেলে কোনো দেশকে বিচার করতে গেলে ঠিক কি কি বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে- এর একটি বিস্তারিত স্কেল প্রস্তাব করা গেলে ভালো হতো। এর ফলে যে কোনো নিরপেক্ষ সংস্থা প্রস্তাবিত স্কেলটি ব্যবহার করে প্রতি বছর সূচক দাঁড় করাতে পারবে; ট্র্যান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ যেভাবে প্রতি বছর দুর্নীতি বা মানবাধিকারের সূচক তৈরি করে। সেক্ষেত্রে বিবেচিত বিষয়সমূহকে গুরুত্বের ক্রমানুসারে ভাগ করে ১০০ এককের একটি স্কেল প্রস্তাব করা যেতে পারে বা কমপক্ষে ধারণা দেয়া যেতে পারে।

এ লেখায় ইরানে শরীয়াহ আইন সুপ্রতিষ্ঠিত হিসেবে মন্তব্য করা হয়েছে। নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে সমাজের সাধারণ মানুষের অনুমোদন আছে এ রকম বিষয় (যেমন- মদ/জুয়া/ব্যভিচার নিষিদ্ধ হওয়া) ছাড়াও ইরান শরীয়াহ আইনের অংশ হিসেবে অনেক বিধি-নিষেধ কড়াকড়িভাবে ব্যক্তির উপর আরোপ করে থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে মেয়েদের হিজাব। এসব ক্ষেত্রে এ ধরনের রাষ্ট্রের নাগরিকরা অনেকেই ইসলামী শরীয়াহকে ব্যক্তি স্বাধীনতার সাথে সাংঘর্ষিক মনে করে থাকেন। এ দিক বিবেচনায় ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে ইরান ব্যক্তি স্বাধীনতার আধুনিক ধারনার সাথে নিজেকে মিলিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়েছে বলা যায়।

অন্যদিকে, আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ইরানকে থিওলজিক্যাল স্টেট হিসেবে বিবেচনা করা হয় যেখানে একটি বিশেষ শ্রেণী স্বয়ং আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। দেশটির কাঠামোতে ‘আয়াতুল্লাহ’ সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী এবং তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হিসেবে গন্য করা হয়। এখানে আয়াতুল্লাহ এক ব্যাপক জবাবদিহিতাবিহীন ক্ষমতার অধিকারী এবং তাঁর যে কোনো স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জনগণ কোনো ধরনের অসন্তোষ প্রকাশ করতে পারে না। আধুনিক রাষ্ট্রে নাগরিককে প্রদত্ত বাক স্বাধীনতার ধারণার সাথে এটি সাংঘর্ষিক। ইসলামে শাসকের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মূলনীতিরও এটি বিরোধী। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, মাহমুদ আহমেদিনেজাদের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ব্যাপক ভোট জালিয়াতি হয়েছে। জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে রাষ্ট্র এক্ষেত্রে একজন বিশেষ প্রার্থীর পক্ষ নিয়েছে। একই সাথে, জনগণের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনে সরকারী বাহিনী ব্যাপক অত্যাচার নির্যাতন চালিয়েছে। এমনকি গুম এবং হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে।

তাই ইরানকে কেবল ইসলামী রাষ্ট্র বললে মনে হয়, ইরান বুঝি সকল ক্ষেত্রে ন্যায়-বিচার এবং ইনসাফের মডেল হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। তাই একটি বিশেষ ক্যাটাগরিতে, যেমন- ইসলামী  রাষ্ট্র  ক্যাটাগরিতে, ১০০ তে ইরানের স্কোর কত- এ রকম স্কোরিং করা গেলে আরও ভালোভাবে একটি রাষ্ট্রের ভালো-খারাপ দিকগুলোকে বিবেচনায় আনা যাবে।

একই কথা অন্যান্য ক্যাটাগরিতেও প্রযোজ্য। যেমন- বাংলাদেশ ও মালদ্বীপ এ দুটি দেশ একই ক্যাটাগরিতে অবস্থান করছে। এ থেকে একটা সাধারণ ধারণা পাওয়া গেলেও বিস্তারিত তুলনা করা যায় না। হয়ত এ আর্টিকেলের সংক্ষিপ্ত পরিসরে এর সুযোগও ছিল না। ভবিষ্যতে আলাদা রচনায় বিস্তারিত আকারে একে বিবেচনায় আনা যেতে পারে।

আমীর শাসিত ইসলামী রাষ্ট্র/রাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আছে। এর একটি কারণ হচ্ছে, এই সব দেশের আমীর অপরিসীম ক্ষমতার অধিকারী। শাসনের গুণগত মানের বিবেচনায় এর মান অনেক সময় একনায়ক/স্বৈরশাসনাধীন দেশের কাছাকাছি। সে ক্ষেত্রে এর স্কোর +৫ হওয়া কতটুকু যৌক্তিক?

কোনো রাষ্ট্র যদি এ স্কেলের এক ধাপ থেকে আরেক ধাপে উন্নীত হতে চায় সে ক্ষেত্রে ক্রমধারা অবলম্বন কতটা জরুরি? যেমন- হুসনি মোবারকের পরবর্তী মিশর কিংবা বেন আলী-উত্তর তিউনেশিয়ায় গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মাত্র। অথচ এই একটা কারণেই এই দেশ দুটি এক লাফে স্কেলের কয়েক ধাপ উপরে উঠে এসেছে। যদিও পরবর্তীতে মুরসির শাসন বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। এর একটি কারণ হতে পারে মুরসির সরকার সমাজের অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও মতের জন্য যথেষ্ট জায়গা তৈরি করতে পারেনি। অপরদিকে, তিউনেশিয়ায় আননাহদা পার্টি অন্য সকল দলের সাথে আলোচনা করে একটি গ্রহণযোগ্য সংবিধান প্রনয়নে সমর্থ হয়েছে এবং এতে দেশটিতে রাজনৈতিক প্লুরালিজমের সূচনা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনাকে এ স্কেলের আলোকে কীভাবে ব্যাখা করা যায়?

সব মিলিয়ে এর বিভিন্ন দিকের বিস্তারিত আলোচনা আরও অনেক নতুন দিকের উন্মোচন করবে বলে মনে করছি।

এ ধরনের আরো লেখা