পাঠ প্রতিক্রিয়া: ইসলামপন্থী রাজনীতির ব্যর্থতা প্রসঙ্গে আহমেত কুরু

[ইসলামপন্থীদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সান ডিয়েগো স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতিবিজ্ঞানের অধ্যাপক আহমেদ টি. কুরুর লেখা একটি আর্টিকেল অনূদিত করে সম্প্রতি আমরা পাবলিশ করেছি। আর্টিকেলটির উপর একটি পর্যালোচনা করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও সিএসসিএস-এর পরিচালক মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক। সাথে ছিলেন সিএসসিএস-এর নির্বাহী পরিচালক মাসউদুল আলম। এই পাঠ প্রতিক্রিয়া মূলত সেই পর্যালোচনার পরিমার্জিত লিখিত রূপ।]

পর্যালোচনাটির ভিডিও দেখুন:

রাজনীতি, ষড়যন্ত্রতত্ত্ব ও ব্লেইম গেইম

আমরা যারা ইসলাম নিয়ে কাজ করছি, ইসলামকে একটা ব্যাকগ্রাউন্ড আইডিওলজি হিসেবে নিয়ে সমাজের মধ্যে একটি সাস্টেইনেবল চেইঞ্জ আনতে চাচ্ছি, তাদের জন্য কিছু বিষয় খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।

ইসলামপন্থীদের দাবি, টয়লেট এটিকেট থেকে পলিটিক্স পর্যন্ত সবকিছুর ব্যাপারে ইসলামের সুনির্দিষ্ট বক্তব্য আছে। অথচ, সমাজ ও রাষ্ট্রের নানান পর্যায়ে ইসলামপন্থীরা টেকসই পরিবর্তন আনতে তাৎপর্যপূর্ণভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এটি অনস্বীকার্য। দৃশ্যমান এই ব্যর্থতার জন্য ইসলামপন্থীরা ইসলামবিরোধী শক্তির ষড়যন্ত্রকে প্রধানত দায়ী করে। ষড়যন্ত্রতত্ত্বের পাশাপাশি হরহামেশাই তারা ব্লেইম গেইমে এনগেইজ হয়।

অথচ আমরা জানি, রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়। এখানে পূর্বনির্ধারিত কোনো কিছু শেষ পর্যন্ত কার্যকর থাকে না। রাজনীতির ময়দানে প্রত্যেক পক্ষই নিজ স্বার্থ উদ্ধারের জন্য কৌশল অবলম্বন করে। রাজনীতি হলো খেলার মতো। খেলার নিয়মগুলো সবার জানা থাকা সত্ত্বেও বুদ্ধি, শক্তি ও কৌশল খাটিয়ে যে খেলতে পারে, সে-ই জয়ী হয়। ক্ষেত্রবিশেষে ভাগ্য একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও যোগ্যতাই কিন্তু এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর।

যারা হেরে যায়, সচরাচর তারা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নানাবিধ অভিযোগ তুলে নিজেদের ব্যর্থতা ও অযোগ্যতাকে ঢাকতে চায়। পরাজিত পক্ষ সাধারণত আত্মসমালোচনা ও আত্মপর্যালোচনায় আগ্রহী হয় না।

এ ধরনের blame game চর্চার প্রবণতা আমরা কমিউনিস্টদের মধ্যেও দেখতে পাই। সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিজমের পতনের জন্য সেখানকার কমিউনিস্টদের তুমুল সমালোচনা করা হচ্ছে– এমন একটা সেমিনারে বিশিষ্ট কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবী প্রফেসর বদরুদ্দীন উমর এক পর্যায়ে বললেন, ‘সোভিয়েত ইউনিয়নে তো সত্যিকারের কমিউনিজম আসেই নাই। তাহলে এটা ব্যর্থ হবে কোত্থেকে?’ এবার বুঝেন …!

ব্যর্থতা ঢাকতে ইসলামপন্থীরাও একই সুরে বলে, ‘অমুক-তমুক জায়গায় বা ওদের ওদের দ্বারা তো ইসলামের সঠিক প্রয়োগ হয় নাই। ব্যর্থ হয়েছে ইসলামের নাম নেয়া কিছু ব্যক্তি, সংগঠন ও রাষ্ট্র। সত্যিকারের ইসলামকে তো অনুসরণই করা হয় নাই। এমতাবস্থায়, আদর্শ হিসেবে ইসলাম ব্যর্থ হয়েছে, এ কথা বলা যাবে না।’

ইসলামপন্থীদের মতাদর্শগত ব্যর্থতার কারণ পর্যালোচনা নিয়ে ডিটেইলস আলোচনা করা দরকার। এ প্রসঙ্গে মূল কথা যা এইখানে বলতে চাচ্ছি, তা হলো–

কালোত্তীর্ণ আদর্শ ও স্থায়ী জীবনবিধান হিসেবে ইসলাম

ইবাদতের বিষয়গুলোকে আল্লাহ তায়ালা যেভাবে বলেছেন, সেগুলো হুবহু সেভাবেই করতে হয় বা হবে। কম করা হলে তা ইবাদতই হবে না। যা যতটুকু যেভাবে করতে বলা হয়েছে তারচেয়ে বেশিকিছু করলে তা বেদাত হিসেবে গণ্য গবে। কিন্তু, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি, যা মানুষের বাস্তব জীবনের সাথে সম্পর্কিত তা কি আমরা যেভাবে বলা আছে সেভাবেই অনুসরণ করবো? এ সব বিষয়ে সবকিছু কি প্রত্যক্ষ ইবাদতের মতো সুনির্দিষ্ট, সুসংবদ্ধ ও বিস্তারিতভাবে বলে দেয়া আছে?

একটা গতিশীল জীবনাদর্শ, যা মানুষের জীবনে যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী বা সহস্রাব্দের পর সহস্রাব্দ পর্যন্ত চলার দাবি করা হয়, সেটা যদি অনমনীয় কাঠামোর হয়, তাহলে স্বভাবতই এটি যুগের পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে না। এক পর্যায়ে ভেঙ্গে পড়বে। পরিবেশ-পরিস্থিতির পরিবর্তনের ফলে এডজাস্ট করতে না পারার কারণে কমিউনিজম যে কারণে ফ্রম উইদিন কলাপ্স করেছে।

মানুষের মধ্যে এক পর্যায়ে এন্টি-এস্টাবলিশমেন্ট সেন্টিমেন্ট গড়ে উঠে। পরিবেশের নতুনত্ব, অর্থনীতির ধরনে পরিবর্তন, সামাজিক কাঠামো, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির পরিবর্তন ইত্যাদি নানা কারণে এটি ঘটে থাকে।

প্রশ্ন উঠতে পারে, সবকিছুরই যদি পরিবর্তন ঘটে, তাহলে দুনিয়ার সব মানুষের জন্য একটা স্থায়ী বা কালোত্তীর্ণ আদর্শ ও জীবনব্যবস্থার প্রস্তাবনা কি স্ববিরোধী নয়?

স্বতঃপরিবর্তন সত্ত্বেও মানুষের জন্য একটা স্থায়ী জীবনদর্শন ও জীবনব্যবস্থা থাকা দরকার। কেননা, যত পরিবর্তনই হোক না কেন, মানুষের বেসিক ফিজিক্যাল, মেন্টাল ও মোরাল এনটিটি বা সত্তার বিশেষ কোনো পরিবর্তন ঘটে না। মানুষ মানুষ হয়েছে এসব স্থায়ী বৈশিষ্ট্যের কারণে। এ কারণে মানুষের জন্য একটা স্থায়ী আদর্শ ও জীবনবিধান থাকাই স্বাভাবিক। এ ধরনের কালোত্তীর্ণ হিসেবে কোনো কিছু যদি প্রস্তাব করা হয়, তাহলে সেটাকে হতে হবে যুগোপযোগী হিসেবে নির্মাণযোগ্য বা customizable।

প্রশ্ন হতে পারে, এই কথাগুলো কি আমি ইসলামের উপর নিজের খেয়াল-খুশি মতো চাপিয়ে দিচ্ছি? প্রজেক্ট করছি? নাকি, আমি যেমনটা বলেছি ইসলাম আদতে তেমনটাই? নাকি, আলেম-ওলামারা যেমনটা বলে, অর্থাৎ প্রচলিত ফিকাহ শাস্ত্রে সবকিছু ঠিকঠাকভাবে বলে দেয়া আছে, জাস্ট সেগুলোকে কায়েম করে দিলেই হলো?

কোনটা ঠিক?

বিষয়টি বুঝার জন্য, এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ অথচ স্পর্শকাতর বিষয়ে একটা সমাধানে আসার জন্য আপনাদেরকে কোরআন-হাদীস পড়তে হবে। বিশেষ করে ইংরেজি শিক্ষিতদের একটা বিরাট সমস্যা হলো, তারা কেন যেন মূল গ্রন্থ হতে ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা করতে অনাগ্রহী। আমি এমন লোক তেমন পাই নাই, ইসলামের উপর যার both intensive and extensive পড়াশোনা আছে। অতীব দুঃখজনক হলেও এটি সত্য, ইসলামপন্থী হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেয় এমন অনেকেরও প্রাইমারি সোর্স হতে ইসলাম সম্পর্কে তেমন পড়াশোনা নাই।

আপনি ইসলামপন্থী হোন বা ইসলামপন্থী না হোন, ইসলাম সম্পর্কিত কোনো কিছুতে এনগেইজ হতে হলে আপনাকে ইসলাম বুঝতে হবে। যদি এই কাজটি আপনি করেন এবং ইসলাম সম্পর্কে খোলামনে করা পড়াশোনার আলোকে শুরুতে যা বলেছি তা বিবেচনা করেন, তাহলে দেখবেন, দীর্ঘ সময় থেকে (ঠিক কতটা সময় থেকে, সেটা ইতিহাসের লোকেরা ভালো বলতে পারবে) ইসলামের একটা ভুল রিপ্রেজেন্টেশন আমাদের সমাজে প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে।

কোন অর্থে সব সমস্যার সমাধান, দিতে পারে আল-কোরআন?

‘ইসলামকে নাও, সব সমাধান পাবা’ – এই কথা দিয়ে ইসলামপন্থীরা বোঝায়, ইসলাম আমাদেরকে মূলনীতি, পদ্ধতি, নকশা ও কাঠামো, সবকিছু একসাথে একটা প্যাকেইজ হিসেবে প্রদান করে। যেমন, অর্থনীতির কথা আসলে ইসলামপন্থীরা মুখস্ত কিছু কথা বলে। এর মধ্যে আছে যাকাতের কথা। তাদের ধারণায়, যাকাত আদায় হয়ে গেলো, ব্যাস, অর্থনীতির বিরাট কাজ হয়ে গেলো! অথচ, যাকাত হলো মূলত একটা কমপালসারি চ্যারিটি ওয়ার্ক। তো …? একটা চ্যারিটি দিয়ে ইকোনোমি কীভাবে কমপ্লিট হয়?

কথার কথা হিসেবে বলছি, আমার পকেটে যে টাকাটা আছে, এটি কোত্থেকে আসে? সমকালীন অর্থব্যবস্থার শরয়ী ভিত্তি কী? আমার যে ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক জীবন, সেটার সাথে যাকাতের কী ভূমিকা আছে? জানি, কথাগুলো বিব্রতকর। খানিকটা ঔদ্ধত্যমূলকও বটে। তৎসত্ত্বেও মনে করছি, এগুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হওয়া উচিত।

যাকাতের সাথে আরেকটা জিনিস নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু কথা বলা উচিত। সেটি হলো ইসলামিক ব্যাংকিং। ব্যাংকিং নিয়ে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় মালয়েশিয়া থেকে পিএইচডি করে এসেছেন এক ভদ্রলোক। আমাদের এক সহকর্মীও একই সময়ে সেখান থেকে ডিগ্রি করেছেন। উনি তাঁকে আমার কাছে নিয়ে এসেছিলেন। আমরা তাঁর সাথে প্রায় দু’তিন ঘণ্টাব্যাপী দীর্ঘ আলোচনা করেছিলাম। সেদিন আমরা যৌথভাবে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলাম। তা হলো, আমাদের দেশের ট্র্যাডিশনাল ব্যাংকগুলোর অধিকাংশেরই কার্যক্রম মোস্টলি ইসলামসম্মত, কিছু কিছু বিষয় ইসলামী শরীয়াহর সাথে সাংঘর্ষিক। এর পাশাপাশি, ইসলামী ব্যাংকের নামে যে ব্যাংকগুলো চলছে, সেগুলোর অধিকাংশ কার্যক্রম ট্র্যাডিশনাল ব্যাংকগুলোর মতোই এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেগুলো অন্যান্য ব্যাংক থেকে আলাদা। সেজন্য এটি ইসলামী ব্যাংক, অতএব এটি আগাগোড়া ইসলামিক; আর ওইটা ট্র্যাডিশনাল ব্যাংক, তাই সেটি আগাগোড়া অনৈসলামিক – প্রচলিত এই পপুলার ধারণা আসলে ভুল।

আমার কথা হলো, সুদ নিষিদ্ধ করা ও যাকাত আদায় করা, এই দুই কাজ করলেই অর্থনৈতিক দায়িত্ব সম্পন্ন হয়ে যায় না। অর্থনীতির প্রয়োজনীয়তা ও পরিসর আরো বিস্তৃত। বর্তমান জমানায় বিশেষ করে এটি জটিলতর।

আমাদের দেশে প্রচলিত আইনগুলো, ইসলামের নামে হোক বা না হোক – শাহ আব্দুল হান্নান সাহেব যেটা বলেন – এগুলোর সিংহভাগই ইসলামী আইনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তারমানে, ইসলামের নামে করা হয়নি বলেই কোনো কিছু ইসলামবিরোধী হবে না।

উদাহরণ হিসেবে যাকাতের কথা বলা যায়। যাকাত আরোপ করা হয়েছে মদীনায়। সংগ্রহ করা হয়েছে মদীনায়। যাকাত সংগ্রহের জন্য প্রথম খলিফা আবু বকর (রা) এমনকি যুদ্ধও করেছেন। অথচ, যাকাতের আয়াত তো নাযিল হয়েছে মক্কায়। বলা হয়েছে, ‘লিয যাকাতি ফা-ইলুন’, তারা যাকাতের পন্থায় কর্মতৎপর হয়। সূরা মুমিনুনের প্রথম দিকে এটি আছে। শতকরা আড়াই ভাগ হিসেবে যাকাত দিতে হবে, এটা হলো যাকাতের বাহ্যিক কাঠামো। ইবাদত হিসেবে এটি অপরিবর্তনীয়। কিন্তু যাকাতের আরেকটা মিনিং বা অবজেক্টিভ হলো চ্যারিটি করার মন-মানসিকতা। যাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থার মূলনীতি হলো, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হতে হবে কল্যাণধর্মী।

তাহলে মানুষের ব্যবহারিক জীবন সম্পর্কিত যে কথাগুলো ইসলামে আছে সেগুলো থেকে নিতে হবে মূলনীতি। যেমন, যুদ্ধের ব্যাপারে যে বিষয়গুলো বলা আছে, সেগুলো দিয়ে তো আপনি একটা যুদ্ধ করতে পারবেন না। আপনাকে আরো অনেক কিছু শিখতে হবে। বর্তমানে মিলিটারি একাডেমিগুলোতে যেগুলো শেখানো হয়।

তাহলে কেউ যদি বলে, ইসলামে সব দেয়া আছে…, সেক্ষেত্রে তাকে দেখিয়ে দিতে হবে, ‘কই, এই এই জিনিসগুলো তো ইসলামে দেয়া নাই।’ ইসলামপন্থীরা দাবি করে, কোরআন হলো সংবিধান। যদি তা-ই হয়, তাহলে তো কোনো দেশে আলাদা করে আর সংবিধান রচনা করতে হবে না। আর সব দেশের সংবিধান যদি হয় কোরআন, তাহলে আলাদা আলাদা দেশ থাকারই বা দরকার কী?

ছোটবেলায় এই শ্লোগানটা কত দিয়েছি: ‘সব সমস্যার সমাধান, দিতে পারে আল কোরআন।’ এখন বুঝি, এটি ছিল আবেগী শ্লোগান। একজন কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মুসলিম হিসাবে এখন মনে করি, আল কোরআন দেয় আমাদেরকে মূলনীতিগত সমাধান। প্রায়োগিক রূপরেখা তৈরির দায়িত্বটি আল্লাহ তায়ালা মানুষের বিবেক-বুদ্ধির ওপর ন্যস্ত করেছেন।

প্রসংগত উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সংবিধান কি বাংলাদেশে কার্যকর সব আইনের সংকলন? না, মোটেও তা নয়। যদিও এটি বাংলাদেশে প্রচলিত সব আইনের ভিত্তি। যেমন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্ট-৭৩-‌এ সবকিছু বলা নাই। যার কারণে সময়ে সময়ে সিনেট-সিন্ডিকেট কর্তৃক প্রয়োজনীয় স্ট্যাটিউট ও অর্ডিন্যান্স প্রণয়ন করা হয়েছে।

অভিন্ন মূলনীতির আলোকে তৈরি করতে হবে বিশেষায়িত মডেল

তাহলে মানুষের ব্যবহারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের মতো প্র্যাক্টিক্যাল বিষয়গুলোর ব্যাপারে ইসলাম যে কথাগুলো বলেছে, আল্লাহর রাসূল (সা) সেগুলোকে যেভাবে বাস্তবায়ন করেছেন, বা তাঁর আগে নবী-রাসূলগণ যেভাবে যা করেছেন, ওই সকল বিষয় বা স্ট্রাকচারগুলোকে সামনে রেখে আমাদেরকে সেসব কর্মকাণ্ডের অন্তর্নিহিত মূলনীতিগুলোকে খুঁজে বের করতে হবে। এই সব মূলনীতিকে সামনে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিলাদ বা জনপদের নৃতাত্ত্বিক গঠন, অর্থনৈতিক অবস্থা, আবহাওয়া, সময়ের বাস্তবতা, আন্তর্জাতিক সম্পর্কব্যবস্থা, বর্তমানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ফ্যাক্টর– প্রযুক্তি এবং  সংশ্লিষ্ট দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে বিবেচনায় রেখে একেকটা দেশের জন্য একেক ধরনের স্ট্রাকচার, ডিজাইন বা মডেল তৈরি করতে হবে। একটা দেশের জন্য কোনো এক সময়ে যে মডেল তৈরি করা হবে, সেটাও চিরস্থায়ী কিছু হবে না।

local specificity’র এই মূলনীতির আলোকে ধরে নেয়া যাক, মাসউদুল আলম একটা মডেল তৈরি করলো, মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক একটা মডেল তৈরি করলো, আপনিও একটা করলেন, সেও একটা করলো। জনগণ ওরটা পছন্দ করেছে। ও ওর মতো করে সংশ্লিষ্ট সেক্টরে নেতৃত্ব দিচ্ছে। কয়দিন পর তাকে কোনো প্রবলেমের কারণে গদিচ্যুত বা প্রত্যাখ্যান করা হলো। যাকে জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে সে কিন্তু দাবি করে নাই, আমার কাজটাই ইসলাম। বরং সে দাবি করেছে, ‘আমার কাজটা ইসলাম দ্বারা ইন্সপায়ার্ড অ্যান্ড গাইডেড।’ প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ বলছে, ‘দেখো, ও যেটা দাবি করেছে, সেটার অমুক অমুক জায়গাতে ঘাটতি হয়েছে, অমুক অমুক জায়গাতে এই এই বিষয়ে বাড়াবাড়ি করা হয়েছে। বরং, আমি যেটা করেছি, সেটাই ভালো। তোমরা আমারটা নাও।’ হতে পারে, জনগণ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকেই পছন্দ করলো এবং তাকে নির্দিষ্ট মেয়াদে ক্ষমতাসীন করলো।

আলোচ্য এই আর্টিকেলে জনাব আহমেত কুরু আলেম সমাজের রাজনৈতিক চিন্তার একটি সীমাবদ্ধতা প্রসেঙ্গ বলেছেন, “the ulema’s political ideas are still based on the medieval understanding of obeying the political ruler as long as he does not publicly leave Islamic faith or refuse to follow sharia. In other words, the ulema’s political ideas have not been updated by integrating modern concepts of separation of powers, checks and balances, opposition, and freedom of speech.”

কথা হলো, শাসকগোষ্ঠী ন্যায়বান হলে তাকে সমর্থন করবো। না হলে…? একটা কথা সালাফী ঘরানা থেকে প্রায়ই বলা হয়, ‘ন্যায়ের আদেশ এবং অন্যায়ের নিষেধ’ শুধুমাত্র শাসকের দায়িত্ব। ন্যায় প্রতিষ্ঠা যদি শাসকেরই দায়িত্ব হয় তাহলে শাসককে এই দায়িত্ব পালনে বাধ্য করার দায়িত্বটা কার?

ইসলামে পলিটিক্যাল ক্যাওস তৈরি না করার কথা বলা হয়েছে, এর মানে এই নয় যে আমরা নির্বিকারবাদী হবো, quietism-কে মেনে নিবো। ফেতনা সৃষ্টি না করা মানে এই নয়, স্বৈরাচারী শাসককে আমরা বৈধতা দিবো। ইসলামপন্থীদের একটা বিরাট অংশ বিভিন্ন সময়ে স্বৈরশাসকদেরকে সমর্থন করেছে কিছু পাওয়ার বিনিময়ে। একসময়ে ওই স্বৈরশাসক তাদের উপরই উল্টা ক্র্যাকডাউন করা শুরু করেছে। তখন জনগণ এদেরকে জালিম শাসকদের দোসর হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে।

আপনি যখন রাজনীতি বা ক্ষমতা সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণা নিয়ে এ-পলিটিক্যাল বা নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকবেন; অথবা রাজনীতির গ্রামার না জেনে রাজনীতি করতে যাবেন, অথবা যথেষ্ট যোগ্যতা অর্জন করার আগেই ক্ষমতা ডিল করতে যাবেন, তখন এক ধরনের পলিটিক্যাল কোয়াইটিজম অথবা জুলুমশাহীর কোলাবরেটরের ভূমিকা পালন অথবা নিজেরাই জুলুমবাজ হয়ে উঠা, এগুলোর কোনো একটা ঘটবেই। উল্টাপাল্টা কিছু একটা ব্যাপার হবেই হবে।

ইসলামপন্থীদের সেক্যুলার মনোগঠন

‘এরা শাসকগোষ্ঠী, তাই এরা শাসন করবে; আর আমরা শুধু মানুষকে নীতি-নৈতিকতার কথা বলবো’ – এটা হচ্ছে একটা সেক্যুলার সেট-আপ। আনফরচুনেটলি, ইসলামপন্থীরা সেক্যুলারিজমের চরম বিরেধিতা করলেও দিনশেষে তারাই কিন্তু এই সেক্যুলার সেট-আপকে প্র্যাকটিস, ফলো ও প্রমোট করে সবচেয়ে বেশি। তাদের কথার ধরন হচ্ছে, ‘এটা শাসকদের দায়িত্ব, আমাদের নয়। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে বলা। ওয়া মা আলাই না, ইল্লাল বালা-গ।’ তাদেরকে দেখা যায় সেক্যুলার স্টেইট ও সেক্যুলার পাওয়ারের কাছে হরহামেশা সাপোর্ট ও প্রটেকশন চাইতে।

আমরা রাসূলের (সা) ছোট্ট একটি হাদীস থেকে এক কথায় সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাই। এই নীতিনির্ধারণী হাদীসটি হতে আমরা সহজেই আমাদের আসল করণীয়টি বুঝতে পারি। তিনি বলেছেন, তোমরা যদি কোনো অন্যায় দেখো, তাহলে সেটাকে বাধা দাও, সেটাকে বন্ধ করে দাও। অন্যায়কারীকে বলপূর্বক অন্যায় কাজ হতে বিরত রাখো। যদি সেটা না পারো, তাহলে সেটার প্রতিবাদ করো। জনমত তৈরি করো। আর যদি সেটাও না পারো, তাহলে মন্দ কাজটিকে সর্বান্তকরণে ঘৃণা করো।

অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই হাদীসটির মর্ম অনুযায়ী, অগত্যা পরিস্থিতিতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়িয়ে, প্রতিবাদ না করেও কেউ দুর্বলতম ঈমানদার হিসেবে টিকে থাকতে পারে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. হাসান মোহাম্মদ স্যার গবেষণা করে দেখিয়েছেন, বাংলাদেশের ইসলামপন্থীরা মূলত নিম্ন-মধ্যবিত্ত লেভেল থেকে আসা মানুষজন। এদের চিন্তাভাবনাও সেরকম মধ্যবিত্ত। সামগ্রিকভাবে তারা সুবিধাবাদী। প্রতিক্রিয়াশীলতা যাদের চূড়ান্ত জিহাদ।

আল্লাহর রাসূল (সা) বলেছেন, ‘তোমরা হাত দিয়ে জুলুম বন্ধ করে দাও।’ তো, হাত দিয়ে বন্ধ করতে হলে তো পাওয়ার লাগবে। সেই পাওয়ার বা ক্ষমতা অর্জন ও প্রয়োগ হতে হবে নিয়মতান্ত্রিক ও রীতিসিদ্ধ উপায়ে। অন্যায় প্রতিরোধের নামে চোরকে ধরে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলা বা তার হাত কেটে দেওয়া ইত্যাদি কেউ করতে পারবেন না। কোরআন-হাদীসে এগুলো নিষেধ করা আছে। ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে, অন্যায়কে বাধা দিতে হবে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই ফিতনা বা বিশৃংখলা তৈরি করা যাবে না। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় শৃংখলাকে টিকিয়ে রাখতে হবে যে কোনো মূল্যে। এমনকি কিছু ‘অপরিহার্য মন্দ’ বা নেসেসারি এভিলকে আপাতত মেনে নিয়ে হলেও।

তারমানে, আপনাকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা অর্জন ও সেটাকে সুসংহত করতে হবে। বর্তমান সময়ে স্বৈরতন্ত্রের পথে না গিয়ে এটি অর্জন করার একমাত্র পথ হচ্ছে রাজনীতি তথা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যথাযথভাবে অংশগ্রহণ করা।

ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ– এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য রাজনীতির অপরিহার্যতা

সুশীল ও নির্বিবাদী আদর্শবাদীগণ, বিশেষ করে ইসলামপন্থীদের বিরাট অংশের পক্ষ থেকে বলা হয়, “ক্ষমতা, রাজনীতি ইত্যাদি নোংরা কাজ। এই অপরিচ্ছন্ন ও নোংরা কাজে লিপ্ত হওয়া আমাদের মতো ভালো (?) মানুষদের জন্য অনুচিত (!)। আমরা শুধু নীতি-নৈতিকতার কথা বলবো। হুইসেল ব্লোয়ার হিসেবে ভূমিকা পালন করবো।” এই ধরনের সেক্যুলার সেটআপ কিন্তু সাহাবীদের মধ্যে ছিলো না। আল্লাহর রাসূলের (সা) যুগে কেউ রাজনীতি-নিরপেক্ষ ছিলো না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তখনকার সময়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরার করার মতো কাজ, অর্থাৎ জল্লাদের কাজ কিন্তু প্রমিন্যান্ট সাহাবীগণের মধ্যকার কেউ একজন সম্পন্ন করতেন। আলাদা কোনো জল্লাদ শ্রেণী ছিলো না।

ইসলামপন্থীরা যখন রাজনৈতিক ময়দানে বক্তব্য দেয় তখন সমকালীন রাজনৈতিক রেটরিক দিয়ে সেগুলো না বলে এক ধরনের সন্ন্যাসবাদী ও নীতিবাদী স্টাইলে কথা বলে। রাজনৈতিক বক্তব্য রাখার গ্রামার যেন তারা বুঝতেই পারে না। যার কারণে তাদের কথাগুলো জনগণের হৃদয়ে সেভাবে রেখাপাত করে না। তাদের কথাগুলো যেন বলার জন্যই বলা। ইস্যুকে হাইলাইট না করে তারা সবকিছুর মধ্যে অযাচিত মাত্রায় আদর্শ ও মূল্যবোধের মুখস্ত বুলি কপচাতে থাকে। এটি মূলত রাজনীতি না বুঝে রাজনীতি করার ফল। অথবা, ধর্মীয় আঙ্গিকে রাজনীতি করার পরিণতি। পলিটিক্যাল ল্যাঙ্গুয়েজ অনুসারে কথা বলতে না পারার কারণে তারা রাজনীতিতে ততটা ভালো করতে পারে না। জনকল্যাণের বৃহত্তর লক্ষ্য অর্জনের চেয়েও পরকালীন নাজাতের চিন্তায় তারা ভারাক্রান্ত (obssessed) হয়ে থাকে।

নিজেদের অযোগ্যতার কারণে তারা জুলুম-নির্যাতনকে আল্লাহর হুকুম হিসেবে মেনে নেয়। অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর কাছ হতে একটুখানি ফেভার পেলেই তাদের পেছনে ছোটে। সনদের নামকাওয়াস্ত স্বীকৃতি পেয়ে ‘রঙ মাখিয়ে সারি সারি শোয়াইয়া রাখা’র ঘটনাকে তারা অনায়াসে ভুলে যায়। বরং তাদের জন্য দোয়া করে। বলে, ‘এরা আমাদেরকে দিছে …। আর কেউই দিতে পারে নাই …।’

ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ সম্পর্কিত আলোচ্য নীতিনির্ধারণী হাদীসটিতে আইন বলবতের ক্ষমতা না থাকলে মুখে বলার জন্য বলা হয়েছে। এটি হতে হবে কার্যকর ভাষায় বলার মতো করে বলা। নিছক বলার জন্য বলা নয়। বরং রীতিসিদ্ধ ও এফেক্টিভ ওয়েতে বলা। কীভাবে বললে এফেক্টিভ হবে সেটি না বুঝেই ইসলামপন্থীরা ‘চিল্লাইয়া মার্কেট পাওয়ার চেষ্টা’ করে। আফসোস …!

কোরআনের সূরা আলে ইমরানের ১০৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে, তোমাদের মধ্যে একটা দল থাকতে হবে যারা মানুষকে কল্যাণের দিকে ডাকবে। সৎ কাজের আদেশ দিবে, অসৎ কাজের নিষেধ করবে। শুধু কল্যাণের দিকে ডাকাটাই যদি ইসলামের মূল কথা হতো, তাহলে পরের ওই ফলোআপ কথাগুলো আসতো না।

অতএব, সত্যিকারের মু’মিন হতে হলে, আল্লাহর হুকুমকে মানতে হবে; আল্লাহর হুকুমকে সমাজ ও রাষ্ট্রে আইন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সেজন্য আপনাকে পলিটিক্যাল পাওয়ার অর্জন করতে হবে। সমকালীন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় কার্যকর পন্থায় অংশগ্রহণ করতে হবে। এসব কথা এখনকার জন্য যেমন সত্য, তখনকার বা যে কোনো সময়ের জন্যও তেমন করে বা সমভাবে সত্য। পলিটিক্যাল সিস্টেম রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, গণতন্ত্র, বা খেলাফততন্ত্র– যেটাই হোক না কেন, সব সিস্টেমের জন্যই রাজনীতির কিছু বিষয় অপরিহার্য। এর অন্যতম হলো এই আন্ডারস্ট্যান্ডিং, ‘পলিটিক্স, ইট’স অল অ্যাবাউট পাওয়ার’। রাজনীতি হলো ক্ষমতার খেলা।

কাজের ধারা বা মডেল হতে হবে নমনীয়, বৈচিত্র্যপূর্ণ ও বহুমুখী

এই কথাগুলোর আসল কথা বা বেসিক পয়েন্ট হলো, পলিটিক্যাল সিস্টেমসহ যে কোনো ধরনের সামাজিক কর্মকাণ্ড বা মুয়ামালাতের ক্ষেত্র্রে মূলনীতির আলোকে ওয়ার্ক প্ল্যান বা মডেল তৈরি করতে হবে। এক সময় আমরা বলতাম, ইসলামী আন্দোলনের একটা বাংলাদেশ মডেল লাগবে। অনেকেই আমাকে বলতেন, ‘আপনি কাজ করেন, যাতে একটা বাংলাদেশ-স্পেসিফিসিটি তৈরি করা যায়। যাতে করে বাংলাদেশের জন্য উপযোগী একটা মডেল তৈরি করা যায়।’

বিচ্ছিন্নভাবে হলেও ইসলামপন্থীদের উচ্চশিক্ষিত লোকজনেরা এখন বাংলাদেশের জন্য একটা মডেল তৈরি করার চেষ্টা করছে। আমি এই ধারণাটিকে রিফর্ম করেছি গত কয়েক বছরে। আমার ধারণা, কোনো দেশের জন্যই একটামাত্র মডেল যথেষ্ট হতে পারে না। ওয়াইড গার্ডেন ফর্মুলা মোতাবেক মডেল হতে হবে অনেকগুলো। মডেল হতে হবে অক্ষিপূঞ্জ বা পুষ্পমঞ্জরীর মতো মাল্টিপল এন্ড ডাইভার্সিফায়েড। একেক ধারার একেকটি মডেল হতে হবে। যেমন করে, বহুদলীয় রাজনীতি মানেই পলিটিক্যাল মাল্টিকালচারালিজম বা প্লুরালিজম।

ইসলামপন্থীদের মনস্তাতাত্ত্বিক গঠনটাই এমন, তারা আসলে বহুদলীয় রাজনীতিকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে না। যদি তা করতো, তাহলে কথার কথা, ‘অমুক তমুক দলকে বা আমাদেরটা ছাড়া অন্য কোনো ইসলামী দলকেও আমরা কাজ করতে দিব না’ এমনটা তারা মনে করতো না। ছাত্রজীবনে আমরা প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামী দলগুলোকে মাঠে নামতে দেই নাই। আমি খুব রিগ্রেট করি এসব নিয়ে। ইসলামপন্থীদের প্রত্যেক গ্রুপই মনে করে, “আমরাই শুধু মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকবো। আর কেউ ডাকলে হবে না। যেহেতু আমরাই সেরা। আমাদেরটাই একমাত্র সহীহ। বাকিগুলো সব গলত।”

সঠিক কারণ অথচ ভুল পরামর্শ

ইসলামপন্থী রাজনীতিবিদ ও আলেম সমাজের সার্বিক ব্যর্থতার প্রেক্ষিতে সমাধান বা করণীয় হিসেবে আলোচ্য নিবন্ধ লেখক বলছেন, “Islam should be re-conceptualized with an emphasis on faith, worship, rights, and ethics, instead of being perceived as a political doctrine.” এবং এর আগের প্যারায় তিনি বলেছেন, “As a religion–in the narrow sense of the term–Islam can contribute …”

এই কথাগুলো এখানে এভাবে আসার কারণ হলো, ইসলামপন্থীদের অবভিয়াস ফেইলিউর। যেমন, মিশরের অবস্থার কথা বলা যায়। মিশর নিয়ে বলতে গেলে মুরসীর মৃত্যু ইত্যাদি নিয়ে কথা আসে। একে কি আপনি রিলিজিয়াস সেন্স থেকে গ্লোরিফাই করবেন, নাকি নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করবেন, সেটা আপনার ব্যাপার।

ওসমানের (রা) মৃত্যু যে শহীদি মৃত্যু সেটা নিয়ে কোনো মুসলমানের মধ্যে কোনো প্রকারের সন্দেহ নেই। কিন্তু ওসমানের রা) নিষ্ক্রিয়তা যে এই রক্তপাতের কারণ হয়েছে, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিকভাবে তিনি যে ফেইল করেছেন, ইট’স অ্যা বিটার ট্রুথ, ইনকনভিনিয়েন্ট ট্রুথ। আলীর (রা) সাথে মুয়াবিয়ার (রা) যুদ্ধে এক রাতেই উভয় পক্ষ মিলে ১০ হাজার লোক মারা গেছে। ধর্মীয় চেতনা দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে কেউ বলতেই পারে, আসলে কারোরই কোনো ভুল ছিলো না। এই রক্তপাতের জন্য কাউকে দায়ী করা হবে না। কিন্তু যে কোনো ইতিহাস পাঠকের দৃষ্টিতে এ ধরনের পজিশন অগ্রহণযোগ্য। অনাকাঙ্ক্ষিত সব ঐতিহাসিক তথ্য নিয়ে বিব্রত নির্বিবাদী (সুবিধাবাদী?) ইসলামপন্থীদের ভাবখানা এমন, পারলে যেন তারা ইতিহাস থেকে এগুলো মুছে দেয়। সাহাবীরা ক্ষমতা নিয়ে মারামারি করেছেন, এটি তারা ভাবতেই পারে না।

মুরসীর মৃত্যুর ঘটনা বা মিশরে দমন-নিপীড়ন যা হয়েছে, সে জন্য মুরসী ও ইখওয়ান অংশত দায়ী। ভিকটিম ব্লেইম করাকে এভয়েড করতে গিয়ে আপনি তো ঐতিহাসিক সত্যকে অস্বীকার করতে পারেন না। উনারা যে সেখান ডিপ স্টেইটগুলোকে, বিশেষ করে আর্মির মতো নেসেসারি এভিলকে প্রপারলি ডিল করতে পারেননি, এটি কি তাদের ব্যর্থতা নয়? দুই তারেক, ড. তারিক সোয়াইদান ও ড. তারিক রমাদান, এমনকি ইয়াসির ক্বাদীও ইখওয়ানকে সতর্ক করে বলেছেন, ‘গো স্লো, গো স্লো। এত তাড়াতাড়ি সংবিধান পরিবর্তন করতে যাবেন না।’ কিন্তু তারা তা শোনেননি। সিম্পল মেজরিটি পেয়ে তারা মনে করেছেন, বিপ্লব বোধহয় সম্পন্ন হয়ে গেছে …!

রশিদ ঘানুশীও তাদেরকে ধীরে চলার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড রিনাউন্ড ইসলামিক স্কলার-থিংকারদের পরামর্শকে অগ্রাহ্য করে তারা শূরার সিদ্ধান্ত মোতাবেক সবকিছু উল্টিয়ে ফেলতে চাইলেন এক বছরের মধ্যে। এবং শেষ পর্যন্ত তারা নিজেরাই উল্টে গেলেন। মিশরে বিপ্লবের নামে হয়েছে হঠকারিতা। শুরার নামে সামষ্টিক নেতৃত্বের ভুল ফর্মূলা অনুসরণের খেরাসত তাদেরকে দিতে হচ্ছে। নিজেদের সাথে সাথে জাতিকেও তারা পিছিয়ে দিয়েছেন অনেকখানি।

রাজনীতি হচ্ছে এক ধরনের খেলা। আপনার রাজনীতিটা ভালো হওয়ার প্রমাণ হলো আপনি সফল হয়েছেন কিনা। রাজনীতিকে ধর্মীয় চেতনায় দেখা এবং ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে রাজনীতি করা – আল্লাহর কাছে প্রতিদান পাবো, আল্লাহ দেখবেন –  এগুলো হচ্ছে পলিটিক্সকে পলিটিক্সের ভাষায়, পলিটিক্সের ফ্লেভারে, পলিটিক্সের নিয়মে ডিল করতে না চাওয়া। আপনি খেলতে নামবেন, আর খেলার নিয়মাবলী না মেনে নিজের মনগড়া নিয়মে যদি খেলেন, তাহলে সেই খেলায় কোনোদিনও জিতবেন না, এটি নিশ্চিত।

সমকালীন বিশ্বব্যবস্থায় রাজনীতি করা, রাষ্ট্র চালানো, সমাজ পরিচালনা, বা বিশ্ব-সভ্যতা গড়ে তোলার জন্য আমাদেরকে আপসকামী বা অ্যাপোলজেটিক হওয়ার দরকার নাই। আমি ময়দান এবং আদর্শবাদ, উভয় দৃষ্টিকোণ হতে পুরো ব্যাপারটাকে বোঝার চেষ্টা করেছি। আমার কাছে মনে হয়েছে, প্রত্যেক যুগের জন্য ইসলাম হলো যুগপযোগী মতাদর্শ। এটি সত্যিকারের বিশ্বদর্শন, চিরন্তন ব্যবস্থা। এই দৃষ্টিতে এটি যুগের অগ্রগামী চিন্তা, যা পরবর্তী যুগেও সমভাবে উপযোগী।

সো, লেটস গো ব্যাক টু প্রফেট মোহাম্মদ (সা), গো ব্যাক টু সাহাবা কমিউনিটি, গো ব্যাক টু খলীফায়ে আজমাইন, সালফে সালেহীন। দেখেন, তাঁরা কী করেছে।

শাদি হামিদ ‘ইসলামিক এক্সেপশনালিজম’ বা অন্য কোথাও বলেছেন, ইসলামপন্থীরা বিরোধী দলের ভূমিকায় যতটা সোচ্চার ও সফল, ক্ষমতা পরিচালনার ব্যাপারে ততটাই ব্যর্থ। তাদের ব্যর্থতাগুলো দেখে তরুণ প্রজন্মের অনেকেই ভাবছে, সমস্যা আসলে ইসলামেরই।

আমার কাছে মনে হয়, “Islam Was Not the Solution: The False Promises of the Islamic Revival” শিরোনামের নিবন্ধে Ahmet T. Kuru কর্তৃক যেসব কারণ উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো ঠিকই আছে। তৎসত্ত্বেও নিবন্ধটির বক্তব্য অর্ধ-সত্য। এখানে আরো ফ্যাক্টর কাজ করছে যা তিনি অন্যত্র উল্লেখ করেছেন কিনা জানি না, কিন্তু এখানে বলেননি। contributing causality নিয়ে খানিকটা বিভ্রান্তির কারণে এমনটি হয়েছে বলে মনে হয়।

ধরা যাক, কোনো একটা কাজ বা ফলাফলের পেছনে চারটি কারণ কাজ করছে: এ, বি, সি, ডি। এখন আমি বললাম– A and B are causes of this. কথাটা আংশিকভাবে সত্য। যেহেতু চারটি কারণের মধ্যে এই দুইটাও আছে। অপরদিক থেকে বিবেচনা করলে কথাটা অংশত অসত্য। কেননা, এতে কন্ট্রিবিউটিং অপর দুইটা কারণকে বিবেচনার বাহিরে রাখা হয়েছে।

তরুণ প্রজন্ম ইসলামের ব্যাপারে বীতশ্রদ্ধ হচ্ছে– এই আহমেত কুরুর এই দাবির ব্যাপারে আমি দুটি কথা বলবো: (১) তারুণ্যের বৈশিষ্ট্য ও (২) সভ্যতাগত প্রাধান্য।

তারুণ্যের বৈশিষ্ট্য

তরুণ প্রজন্ম সবসময় আদর্শের ব্যাপারে একটা প্যারাডক্সে ভোগে। জঙ্গিবাদ থেকে শুরু করে একেবারে সুস্থির চিন্তা, যত ধরনের সঠিক কিংবা ভুল আদর্শবাদিতা, তা সব তরুণরাই চর্চা করেছে যুগে যুগে। এখনো করছে। আবার, পূর্বপুরুষ বা আগের প্রজন্মের, অথবা সমাজের বিদ্যমান মূল্যবোধগুলোকে চ্যালেঞ্জ করা, ভেঙ্গে দেওয়া, বৃত্তের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করা, উল্টাপাল্টা কিছু করা– এগুলো সবসময় তরুণরাই করে। সবসময়ই আগের প্রজন্ম দাবি করেছে, পরের প্রজন্ম যেন রসাতলে যাচ্ছে। বড়দের পক্ষ হতে প্রায়শই দাবি করা হয়, ‘আমরা কত ভালো ছিলাম। এখনকার নবীনরা সব খারাপ হয়ে যাচ্ছে। উচ্ছন্নে যাচ্ছে …!’

সমকালীন বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের কথা যদি আমরা বলি, এই তরুণ প্রজন্ম– যাদেরকে সম্ভাব্য সর্বোতভাবে ব্রেইনওয়াশ করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সময়ে কায়দামতো দেখা গেলো, তারা ব্রেইনওয়াশড হয়ে যায় নাই। এই তরুণরা শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চে যেমন গেছে, এই তরুণ প্রজন্মেরই অপর অংশ মতিঝিলের শাপলাচত্বরে ঈমান-আকীদা সংরক্ষণের জন্য জড়ো হয়েছে। উভয় পক্ষেই তরুণরা অংশগ্রহণ করেছে ব্যাপকভাবে। সুতরাং, তরুণরা যে ধর্ম থেকে দূরে সরে যাচ্ছে বলে গণহারে দায়ী করা হচ্ছে, এটি ঠিক হচ্ছে না।

তরুণরা এক্সপ্লোর করতে চায়। তারা কোনো কিছুকে দেখে, শুনে ও যাচাই করে নিতে চায়। যেহেতু তাদের মধ্যে বড়দের মতো প্রবল আত্মস্বার্থচেতনা কাজ করে না, সেহেতু ভালো কিছুর জন্য তারা অনেক ছুটাছুটি করে। অভিজ্ঞতায় দেখেছি, শেষপর্যন্ত তাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ঐতিহ্যবাহী সামাজিক মূল্যবোধের আঙ্গিকে ফেরত আসে।

সভ্যতাগত প্রাধান্য

আরেকটা আনএড্রেসড বাট মোর ইম্পরটেন্ট ফ্যাক্টর হলো, বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা ও ডমিনেন্ট সিভিলাইজেশন।

বর্তমান সময়ে দুনিয়াটা কারা চালাচ্ছে? এ সময়ের ওয়ার্ল্ড অর্ডারটা কী? ডমিন্যান্ট সিভিলাইজেশন কোনটি? প্রাচ্য সমাজব্যবস্থা বলেন কিংবা ইসলাম, এর কোনোটাই কিন্তু এখন ডমিন্যান্ট সিভিলাইজেশন নয়। আমাদের সভ্যতা বিগত। বর্তমানে আমরা পরাজিত ও সর্বোতভাবে পাশ্চাত্য সভ্যতার অধীনস্থ।

এখান থেকে আমরা কীভাবে ওঠে আসবো, এ ব্যাপারে ইসলামপন্থীদের একটা দৃষ্টিভঙ্গি হলো– ‘বোকো হারাম’, লেট অল অব ওয়েস্ট বি হারাম। পশ্চিমা মানেই খারাপ। তাই এগুলো বাদ। ওয়েস্টে থেকেও অনেকে এসব স্লোগান তোলে, এখান থেকে তো তোলেই। তারা কিন্তু এই স্লোগানগুলো তোলে ওয়েস্টেরই প্রযুক্তি ব্যবহার করে। তারা থাকে ওয়েস্টের সার্ভিলেন্সের আন্ডারে। তারা ঘোরাফেরা করে ওয়েস্টের টাকা পকেটে নিয়ে। বাংলাদেশের টাকা তো ওয়েস্টেরই টাকা। বাংলাদেশ সরকারের টাকা তো স্বর্ণের এগেইনস্টে ছাপানো নয়। ডলারের এগেইনস্টে ছাপানো।

এই অবস্থা থেকে ওঠে আসার জন্য আমার প্রস্তাবনা হলো, প্রত্যেকটা সিভিলাইজেশনের মধ্যে কিছু কমন পজিটিভ উপাদান থাকে। বর্তমান ডমিন্যান্ট ওয়েস্টার্ন সিভিলাইজেশনের কাছেও ইসলামের কিছু উপাদান আছে, যেগুলো তারা তাদের মনে করে প্র্যাকটিস করছে। এবং এ ব্যাপারে ইসলামপন্থীদের একটা দাবি হলো, পাশ্চাত্য বিশ্ব এগুলো আমাদের থেকে নকল করেছে ইত্যাদি। এই দাবিটি অর্ধসত্য।

যাহোক, ইসলামের যে বিষয়গুলো তাদের মধ্যে আছে, সেগুলো তাদের ভাষাতেও যদি গ্রহণ করে নেই, তাহলে অ্যাকচুয়েলি আমরা ইসলামিক ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যেই থাকলাম। তাদের কাছে নাই অথচ আমার কাছে আছে, এমন সিগনিফিকেন্ট কিছুকে যদি আমি এর সাথে যোগ করি, তাহলে তাদের সাথে আমাদের কোয়ালিটেটিভ গ্যাপটা কমে ন্যারো ডাউন হয়ে আসবে।

কথার কথা, ওদের যা কিছু আছে, তা থেকে আমি যদি ৩০ পার্সেন্ট নিতে পারি, আমার মধ্যে বেশি কিছু না থাকলেও তো কিছু না কিছু আছে, যেগুলো ওয়েস্টের কাছে নেই। এটি হতে পারে শতকরা ৫ থেকে ১০ ভাগ। যেমন: আমাদের ট্র্যাডিশনাল ভ্যালু, ফ্যামিলি সিস্টেম ইত্যাদি ইত্যাাদি। আমাদের হিউম্যান রিসোর্সও এর মধ্যে ইনক্লুডেড। তাহলে ওদের ওই কমন ৩০ পার্সেন্টের সাথে আমাদের এক্সক্লুসিভ ১০ পার্সেন্ট যদি যোগ করি, তাহলে মিনিমাম ৬০ পার্সেন্ট কোয়ালিটি নিয়ে সভ্যতাগত প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার জন্য আমার আর মাত্র ২০ পার্সেন্ট কোয়ালিটি অর্জন করতে হবে। বুঝতেই পারছেন, এটি অ্যাপোলজেটিক নয়; বরং পজেটিভ অ্যাপ্রোচ।

এভাবে ওভারঅল ডমিনেন্সি তথা সিভিলাইজেশনাল ডমিন্যান্সি প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া তরুণ প্রজন্মকে কখনোই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।

স্বতন্ত্রভাবে কোনো দেশ কল্যাণ ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে পারে না

রাজনৈতিক প্রাধান্য, সামরিক সক্ষমতা এবং অর্থনৈতিক শক্তিসম্পন্ন একটা সিভিলাইজেশনাল ডমিন্যান্সি যদি আমরা অর্জন করতে না পারি, তাহলে শুধু যুক্তি বা শুধু ধর্মীয় আবেগ দিয়ে জনগণকে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে সনাতনী মূল্যবোধ বা ইসলামের পথে আনা যাবে বা রাখা যাবে বলে আমার মনে হয় না। এমনিতেই তো তরুণদেরকে ধমক দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। আর এখন তরুণরা হচ্ছে অনেক বেশি এনলাইটেনড। তাদের কাছে অনেক বেশি কমিউনিকেটিভ টুলস আছে। যার কারণে তারা এখানে বসেই দেখতে পায় পুরো বিশ্বকে। তারা দেখতে পায় চাকচিক্যের জগৎ, ভোগের জগৎ, মোহের জগৎ, স্টাবলিশমেন্টের জগৎ। দুনিয়া চালাচ্ছে, মানে দুনিয়র তাবৎ এস্টাবলিশমেন্টের সেন্টার হচ্ছে ওয়েস্ট বা এন্টি-ইসলামিক ফোর্স। সেন্টার যদি হয় এন্টি-ইসলামিক তাহলে পেরিফেরির লোকেরা তো ইসলামবিমুখ হবেই।

পানি নিচের দিকে গড়ায়। উপরের দিকে বা স্বাভাবিক স্রোতের বিপরীতে পানিকে প্রবাহিত করতে হলে যথেষ্ট পরিমাণে শক্তি প্রয়োগ করতে হবে। এই শক্তি গায়ের জোর নয়। তরুণদেরকে স্রোতের বিপরীতে নেয়ার জন্য তেমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তাদের মনের খোরাক জোগাতে হবে। তাদেরকে কাছে টানতে হবে। তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। তাদের কাছে নিজেকে আকর্ষণীয় হিসাবে উপস্থাপন করতে হবে। কোয়ান্টিটির দোহাই দেয়ার পরিবর্তে, সোনালী অতীতের কর্মবিমুখ স্মৃতি-কাতরতার পরিবর্তে কম্পিটিটিভনেস ও কোয়ালিটি দিয়ে নিজেদের গড়ে তুলতে হবে। নিজেদেরকে পাওয়ার হাউজ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। জায়ান্ট ম্যাগনেটের মতো শক্তিশালী হতে হবে।

সে-জন্য নির্দিষ্ট কোনো দেশের, নির্দিষ্ট কোনো মডেল বা স্ট্রাকচার বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের দৃশ্যমান অধঃপতনের জন্য দায়ী– এমনটা বলা যায় না। আবার এসব মডেল বা স্ট্রাকচারগুলোর কোনো মৌলিক ত্রুটি নাই, এমনটাও বলা যাবে না। এ ধরনের সভ্যতাগত উত্থান-পতনের আবর্তনে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উভয় দিক থেকে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অনেক ফ্যাক্টর নানাভাবে ক্রিয়াশীল থাকে।

কোনো একটা দেশে একটা ইসলামপন্থী সরকার গঠন করা খুব ইজি একটা কাজ। আর ক্ষমতা থেকে দূরে বসে আমল-আখলাক, নীতি-নৈতিকতার ওয়াজ করে শাসকদেরকে হেদায়েত করা, যা করার জন্য আহমেত কুরু এখানে বলেছেন, সেটার মানে হলো, ইসলামকে একটা পলিটিক্যাল ডকট্রিনের পরিবর্তে একে রিলিজিয়নের ইমেজের মধ্যে ব্যাক করে নিয়ে যাওয়া। সেটা খুব ইজি কাজ। কিন্তু ইসলামকে একটা ডমিন্যান্ট সিভিলাইজেশন হিসেবে যদি আমরা গড়ে তুলতে চাই, তাহলে আমাদেরকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে, ব্যাপকভাবে কাজ করতে হবে। নিছক রেটরিক দিয়ে সভ্যতা গড়ে তোলা বা সভ্যতাগত উন্নয়ন সম্ভবপর হবে না। হওয়ার কথাও নয়।

টেকসই পরিবর্তনের বাস্তব কর্মপন্থা

কান টানলে মাথা আসার মতো এ পর্যায়ে প্রশ্ন হতে পারে, ব্যাপকভাবে কাজ কীভাবে সম্ভব? কী কী কাজ করা হলে ‘ব্যাপকভাবে কাজ করা’ হয়েছে বলা যাবে? এ ব্যাপারে কোনো কোনো ইসলামী সংগঠনের (আমি যেটির সাথে এক সময় ছিলাম সেটি বিশেষ করে) ধারণা হচ্ছে– সবকিছুই যেহেতু দরকার, তাহলে চলো আমরা সবাই সবকিছু করার চেষ্টা করি। অথচ, সবকিছুই করা দরকারের মানে এই নয় যে একটামাত্র সংগঠন থাকবে এবং প্রত্যেকে সব কাজ করার চেষ্টা করবে। কেননা, প্রত্যেকটা ব্যক্তির ঝোঁক-প্রবণতা ও প্রতিভা আলাদা। আবার, জৈব তত্ত্ব বা অর্গানিক থিওরি অনুসারে একেকটা সংগঠনও একেকটা ব্যক্তির মতো। একেকটা সংগঠনেরও একেকটা ফোকাস থাকা জরুরি। বিভিন্ন চরিত্র, মেজাজ ও বৈশিষ্টের লোকগুলোকে একত্রিত করে একটা একক সংগঠন গড়ে তোলা এবং সবাইকে দিয়ে সব ধরনের কাজ আঞ্জাম দিতে চাওয়ার উদাহরণ হলো বিভিন্নমুখী ফোর্সগুলোকে কম্বাইন করে সবদিকে একসাথে যাওয়ার চেষ্টা করার মতো বোকামিপূর্ণ কাজ।

সমাজ পরিবর্তন হতে শুরু করে সভ্যতার উন্নয়ন, এগুলো হিমবাহের প্রবাহের মতো ব্যাপার। গ্লোবাল ওয়ার্মিং চেঞ্জ হওয়ার মতো ধীর গতির ব্যাপার। রাতারাতি গ্লোবাল চেঞ্জ হওয়াটা অসম্ভব। আমরা যদি আমাদের মতো করে গ্লোবাল চেঞ্জ চাই তাহলে করণীয় হলো, বিভিন্ন দিকে ফোকাস করা কাজগুলোকে আইডিওলজির ব্রড বাউন্ডারির মধ্যে একোমোডেইট করা।

সমাজের যে কালচারগুলো চেঞ্জ হয়, এগুলো তো আজ সকালবেলা বা কাল বিকেলবেলায় চেঞ্জ হয় না। ধীরগতিতে চেঞ্জটা হয়। হলে আমরা সেটা বুঝতে পারি। তেমনিভাবে আমরা যারা একটা আদর্শবাদী সমাজ চাচ্ছি, তাদেরকে শো-অফ বাদ দিয়ে প্র্যাকটিক্যালি সাসটেইনেবল এমন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে। আমাদের আদর্শটা যে এফেক্টিভ, ভায়াবল, প্র্যাকটিক্যাল, সাসটেইনেবল; শুধু তাই নয়, এটাই যে বেস্ট সল্যুশন, তা রেফারেন্সনির্ভর গবেষণা দিয়ে কিংবা ধর্মীয় সেক্টরের নিরাপদ অঙ্গনে দাঁড়িয়ে খিস্তিখেঁউড় করে বললে কাজের কাজ কিছু হবে না। শুধু চাওয়া আর কথা দিয়ে ‘চিড়া’ ভিজবে না। আমরা যা বলছি তা সাধ্যের মধ্যে প্র্যাকটিক্যালি বাস্তবায়ন করে দেখাতে হবে।

এটা যখন করা যাবে, তখন মানুষ অটোমেটিক্যালি আপনার-আমার আদর্শের মধ্যে চলে আসবে। আল্লাহর রাসূলও (সা) মক্কায় অনেক প্রচার করেছেন। মদীনাতে যা কিছু তিনি করেছেন, সেগুলো মক্কায় করার সুযোগ পাননি। সেই কাজগুলো করার জন্য মক্কাতেই যদি উনার মিনিমাম ক্যাপাসিটি থাকতো, তাহলে সেখানেই তিনি সেগুলো আমল করতেন। প্র্যাকটিক্যাল ছিলেন বলেই মক্কায় নিহত হয়ে শহীদী মর্যাদা লাভের জন্য বসে না থেকে তিনি উপযুক্ত জায়গা খুঁজেছেন। এক পর্যায়ে মদীনায় হিজরত করেছেন। হিজরত করার আগে তিনি সেখানে হিজরতের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছেন।

পরকালে নাজাত লাভের রিলিজিয়সিটি তথা ধর্মীয় চেতনার মোহ থেকে মুক্ত হয়ে আমরা যদি বাস্তবমুখী হই, সমাজটাকে ভালো করে দেখি, এবং সমাজমুখী চিন্তার আলোকে যদি সীরাতের গ্রন্থগুলো অধ্যয়ন করি, কোরআন-হাদীসকে বুঝতে চাই, তাহলে দেখতে পাবো– Islam actually totally misrepresented by the Islamic organizations, by the Islamic institutions, by the Islamic authorities. It’s unbecoming, but it’s true. It’s tragic …!

এ কথার মানে হলো, ইসলামের কোনো একটা দিককে ওভার-ফোকাস করা হয়েছে। যার কারণে ব্যালেন্সটা নষ্ট হয়ে গেছে।

এবং রিলিজিয়াস লেজিটিমেসির জন্য নিজ দলীয় অবস্থানের পক্ষে কোরআন-হাদীসের অথেন্টিক রেফারেন্সগুলোকে পার্শিয়েলি রিপ্রেজেন্ট করা হয়েছে। অথচ, আমরা জানি, রেফারেন্সের অথেন্টিসিটি যতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলোর কনসিসটেন্সি এন্ড টোটালিটিও ততটা গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম বা যে কোনো আদর্শকে বুঝতে হবে হলিস্টিক্যালি বা সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে।

এজন্য আমাদেরকে পড়াশোনা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, রাজমিস্ত্রিরা দেয়ালের ইট গাঁথার সময় লাটিমের মতো একটি জিনিস দিয়ে ফাউন্ডেশানের সাথে কিছুক্ষণ পর পর মাপে। এই জিনিসটির নাম ওলম। তো, ওলম দিয়ে যাচাই করে নেয়ার মতো আমাদেরকেও সবসময় কোরআন-হাদীসের সামগ্রিকতা দিয়ে আত্মপর্যালোচনা করা অব্যাহত রাখতে হবে।

কথার কথা, আমি একটা নির্দিষ্ট ধারায় চলি, একটা নির্দিষ্ট লাইনে পড়াশোনা করি, এক ধরনের লোকদের সাথে মেলামেশা করি, অথচ আমি চোখকান খোলা রাখার চেষ্টা করি; আমি আসলেই যদি এমন ওপেন-মাইন্ডেড টলারেন্ট পারসন হয়ে থাকি, তাহলে অবশ্যই আমি সঠিক পথে ফিরে আসতে বা চলতে পারবো। কেননা, আমাকে কেউ যদি কোনো বিষয়ে সংশোধনী দেয়, নসীহত করে, সমালোচনা করে, পরামর্শ দেয় কিংবা মতাদর্শগত জায়গা থেকে কোনো কিছু রেফার করে; তাহলে আমি তা ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করে যাচাই করে দেখবো, বুঝার চেষ্টা করবো। সঠিক হলে নিজেকে সংশোধন করে নিব। এভাবে যদি আমরা প্রত্যেকেই খোলামন নিয়ে আদর্শমুখী অথচ বাস্তববাদী হয়ে জীবন চলার চেষ্টা করি, তাহলে নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সঠিক পথে চলার এবং সঠিক বিষয়টা বুঝার তওফিক দান করবেন।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হকhttps://mozammelhq.com
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। ‘সমাজ ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন কেন্দ্র’ এবং ‘মুক্তবুদ্ধি চর্চা কেন্দ্র’-এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। নিজেকে জীবনবাদী সমাজকর্মী হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। সাধারণ মানুষের কাছে দর্শনকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য কাজ করছেন। ‘ফিলোসফি: প্রাথমিক ধারণা’সহ একাধিক গ্রন্থ রচনা ও সম্পাদনা করেছেন।

সাম্প্রতিক

এ ধরনের আরো নিবন্ধ