তুর্কি পাবলিক স্পেসে ইসলাম কীভাবে ফিরে আসছে?
১৯২৪ সালের মার্চ মাসের ৩ তারিখ। এক সময়ের বৈশ্বিক সুপার পাওয়ার সাম্রাজ্য থেকে ক্রমে ‘সিক ম্যান অফ ইউরোপ’ হয়ে যাওয়া উসমানীয় খিলাফাতের খলিফা সুলতান আব্দুল মজিদ ২য় সপরিবারে তুরস্ক ছেড়ে যেতে বাধ্য হলেন।
এই অঙ্কের মাধ্যমে যবনিকাপাত ঘটল এমন এক দাউলাহ’র (আধুনিক পরিভাষায় ‘রাষ্ট্র’ পরিভাষার কাছাকাছি); যার কানুন, সামাজিকতা, তামাদ্দুন বা সংস্কৃতি, শাসকের সাথে শাসিতের সম্পর্ক, বিচারকের সাথে বিচারপ্রার্থী বা অপরাধীর সম্পর্ক, অর্থনৈতিক চুক্তি বা উত্তরাধিকার, বাণিজ্য বা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূলনীতি নির্ধারিত হয়ে আসছিল শরীয়াহকে ভিত্তি ধরে। এর মধ্যে অবশ্যই শরীয়াহ থেকে বহু বিচ্যুতি বা ব্যক্তিগত স্খলন ছিল। কিন্তু উসমানীয় খিলাফাতের ৬২৩ বছরের আলো ঝলমলে সুবাসিত শাসনামলে কেউ কখনও শরীয়াহ’র এই সেন্ট্রাল অবস্থান নিয়ে ‘নতুন’ কিছু ভাবারও প্রয়োজনবোধ করেনি। আজকের দিনে তুর্কিতে ‘ইসলাম ফিরে আসা’ বলতে সেই সোয়া ছয়শত বছরের গৌরবের দিকে হাঁটা আর কল্যাণের অভিগমনই বোঝায়। তাই ‘ইসলাম’ ফিরে আসার এই বিরাট কর্মযজ্ঞ কীভাবে হচ্ছে এবং কেন হচ্ছে তা বুঝতে সুবিধা হবে যদি আগে এক নজরে দেখে নেই কীভাবে জনজীবন থেকে ইসলামকে চাল-ডাল আলাদা করার মত করে তাড়ানো হয়েছিল।
কামালের ইউরোপীয়করণ
১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যখন থামল ততক্ষনে উসমানীয় খিলাফাহ দক্ষিণ দিকে ব্রিটিশ, পূর্বে রুশ আর পশ্চিমে গ্রিকদের মাঝে বিলিবন্টন হয়ে গেছে। মধ্যিখানের আনাতোলিয়ান অঞ্চল টিকে গেল মুস্তাফা কামাল পাশা নামের এক সফল উসমানীয় আর্মি অফিসারের নেতৃত্বে। কামাল মনে করতেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের কারণ হচ্ছে ইসলাম। অতীত দুর্ভাগ্যের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করতে হলে ইসলামের সাথেও সম্পর্কচ্ছেদ করতে হবে। যারা পরাজিত করল, কাঙালের মত তাদের সব মৌলিক ধ্যানধারণা ও জীবনাচরণ গ্রহণ করে নিতে হবে। এ যেন ‘কালো মানুষের’ ‘সাদা’ হয়ে ওঠার উদগ্র বাসনা। তাই তিনি উসমানীয় খেলাফতের বহু বিচিত্র জাতিগোষ্ঠীর গৌরব ভুলে একরোখা তুর্কি জাতীয়তাবাদের ঝান্ডা উড়িয়ে দিলেন।
মুস্তাফা কামাল তুর্কি জাতীয়তাবাদের সামরিক কর্মকর্তাদের জড়ো করে কলোনিয়াল শক্তিদের মোকাবিলায় সক্ষম হলেন এবং রিপাবলিক অফ তুর্কি প্রতিষ্ঠা করলেন। কিন্তু প্রথম জাতীয় সাধারণ অ্যাসেম্বলি উসমানীয় খিলাফাতের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে চেয়েছিল। অ্যাসেম্বলি আইন পাশ করেছিল যে, তুর্কির কোনো আইন ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারবে না এবং আইন প্রণয়নের আগে উলামাদের অনাপত্তি নিতে হবে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই কামাল পাশা খলিফা আব্দুল মজিদকে সফট ক্যু’র মাধ্যমে উৎখাত করলেন। ব্যাপারটা সারা মুসলিম জাহানে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া তৈরি করল। ১২৯৯ সাল থেকে চলে আসা মুসলিম জাহান বিস্তৃত উসমানীয় খিলাফাতের সাথে কলোনিয়াল সাম্রাজ্যবাদের তফাতটা হল, এই খিলাফাহ কখনও জোর-জবরদস্তি করে পেরিফেরি থেকে সম্পদ লুট করে কেন্দ্রে পাঠায়নি অথবা কেন্দ্রের শিল্পায়নের সুবিধার্থে সীমান্তে জুলুমের নীলকর এর জন্ম দেয়নি। এই কল্যাণময়ী খিলাফাতের মৃত্যুযাত্রা দেখে মুসলিম মনন ও হৃদয় হুঁহুঁ করে কেঁদে উঠেছিল সেদিন। তাই তো সেদিন এই উপমহাদেশেও আমাদের বাপ-দাদা-পরদাদারা রাস্তায় নেমে এসেছিলেন ‘খিলাফাত আন্দোলনের’ জন্য।
তুর্কি জাতির এত বড় নেয়ামত খিলাফাত কামাল পাশার সহ্য হলো না। তুর্কির ‘অভ্যন্তরীণ’ বিষয়ে ‘বহিরাগত’দের হস্তক্ষেপের ধোঁয়া তুলে খিলাফাতকে পুরোপুরি বিলুপ্ত করে খলিফার পরিবারকে পত্রপাঠ বিদায় দিলেন কামাল।
ইসলাম তাড়ানোর প্রজেক্ট প্রথমে শুরু হয়েছিল ‘ইসলামের উপর থেকে রাজনৈতিক প্রভাব দূর করো’ এই নামে। তুর্কির সবগুলো মাদ্রাসা বন্ধ করা হল। সেক্যুলার ও ‘নন-ডগম্যাটিক’ চিন্তাধারার পড়াশোনা চালু করতে অন্য সকল ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও বন্ধ করা হলো। জাতীয় অ্যাসেম্বলির আইন বিশ্লেষণের জন্য তৈরি শরীয়াহ কাউন্সিল ভেঙ্গে দেওয়া হলো। সুবিশাল ওয়াকফ (ইসলামী দানে পরিচালিত আজীবনের ফাউন্ডেশন) অর্থনীতি গুঁড়িয়ে দেওয়া হল। সুফী খানকাগুলো জোর করে উচ্ছেদ করা হলো। সকল কাজী’র (শরীয়াহ কোর্টের বিচারক) চাকরি বাতিল ও শরীয়াহ কোর্ট বাজেয়াপ্ত করা হলো।
ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ না করার ব্যাপারে পশ্চিমা আলোকায়নের (enlightenment) একটা বড়াই বরাবরই আছে। কিন্তু সেই আলোকায়নের স্বঘোষিত রুহানী সন্তান মুস্তাফা কামাল ব্যক্তিগত জীবনে ইসলাম পালনটা মেনে নিতে পারছিলেন না। তাই তিনি এই কর্মসূচি ঘোষণা করলেন:
- পুরুষদের জন্য ইসলামী অতীত মনে করিয়ে দেয় এমন পোশাক, যেমন ফেজ টুপি বা পাগড়ি, নিষিদ্ধ হলো; পশ্চিমা হ্যাট বাধ্যতামূলক হলো।
- নারীদের গৌরব হিজাব নিয়ে হাসি-তামাশা করা শুরু হলো এবং পাবলিক প্লেসে হিজাব নিষিদ্ধ করা হলো।
- রাসুলুল্লাহ (সা)-এর হিজরত থেকে প্রচলিত হিজরি ক্যালেন্ডার বাতিল করে ‘যীশু খ্রিস্টের’ জন্মের উপর ভিত্তি করে শুরু গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার চালু হলো।
- ১৯৩২ সালে আরবিতে আজান দেওয়া বন্ধ করা হলো এবং তুর্কির হাজার হাজার মসজিদে তুর্কি ভাষায় আজান বাধ্যতামূলক করা হলো।
- শুক্রবারের সাপ্তাহিক ছুটি বাতিল করে শনি-রবিবারের ইউরোপীয় ছুটি চালু হলো।
এই সব কাহিনী বাস্তবায়ন শেষে, জাতীয় অ্যাসেম্বলি শরীয়াহ মেনে চলার যে ঢং শুরুতে করেছিল তাও খোলাখুলিভাবে ঝেড়ে ফেলে দিল এবং কামালের সেক্যুলার দর্শন দিয়ে ইসলামকে প্রতিস্থাপিত করা হলো। কামাল জাতীয়তাবাদকে কত গুরুত্বপূর্ন মনে করতেন আর ইসলামকে কতটা ফালতু মনে করতেন সেটা তার নিজের ভাষায় এ রকম:
“আরবদের ধর্ম (ইসলাম) গ্রহণ করার আগে থেকেই তুর্কিরা একটা মহান জাতি হিসাবে হাজির ছিল। আরবদের ধর্ম গ্রহণ করার পর, এই ধর্ম আরব, ইরানী, মিশরীদের সাথে তুর্কিদের মিলিয়ে একটা একক জাতি বানিয়ে দিতে পারেনি। বরং এই ধর্মটা তুর্কি জাতির বন্ধনকে শিথিল করেছে আর জাতীয় উদ্দীপনাকে করেছে ভোঁতা। এটাই হওয়ার কথা ছিল। কারণ মুহাম্মাদ যে ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেটার উদ্দেশ্যই ছিল অপরাপর জাতির উপর আরবের জাতীয় রাজনীতি চাপিয়ে দেওয়া।” [মুস্তাফা কামাল, সভ্যতার কথা (Medenî Bilgiler)]
কামাল তরুণদের কাছে অতীতকে পাঠ-অনুপোযোগী (unreadable) করে তুললেন। ফার্সি ও উর্দুর মত তুর্কি ভাষাও আরবি হরফেই লেখা হতো। তুর্কি ভাষায় বহু আরবি শব্দের মিশেল ছিল। ফলে তুর্কিরা খুব সহজেই আরবি ভাষার ইসলামী সাহিত্য পড়তে পারতেন। কামাল আরবি হরফ নিষিদ্ধ করে দিলেন। একটা নতুন কমিশন করে দিলেন যাদের একমাত্র কাজ ছিল অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে আরবি ও অন্যান্য ভাষা, যেমন ফার্সি, থেকে আসা শব্দ খুঁজে তা বাদ দিয়ে তুর্কি ভাষাকে ‘বিশুদ্ধ’ করা। ফলে নতুন প্রজন্ম যে ভাষায় শিক্ষা ও দাপ্তরিক কাজে অভ্যস্ত হয়ে উঠলো, তা ঠিক আগের প্রজন্ম থেকে বহুমাত্রায় ভিন্ন। নতুন ল্যাটিন হরফের লেখাই হলো কামাল পাশার কাছে সহনীয়। ফলে তুর্কির ইতিহাস হয়ে দাঁড়ালো কামালের ইতিহাস। এক নতুন জেনারেশন তৈরি হলো, যাদের সাথে শিকড়ের কোনো যোগ নেই। ২০১১ সালের কোনো এক বিকালে ইস্তানবুলের রাস্তায় এক তুর্কি তরুণ আমাকে বলছিল, চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে এমনও সময় গেছে যখন তুর্কি শিশু, কিশোর, যুবা জানত না ওযু বা গোসল কীভাবে করতে হয়। শিক্ষাব্যাবস্থার পরিবর্তনের ফল বোধহয় এমন আশ্চর্যই হয়।
ইসলামী পূনর্জাগরণের সূচনা
কামাল পাশার ইসলাম খেদানো কর্মসূচি একদিকে যখন চলছিল, আরেকদিকে ইসলামের ‘সন্তানরা’ ঠিকই জান দিয়ে ইসলামের পতাকা ধরে মাটি আঁকড়ে দাঁড়িয়েছিলেন। বলা হয়ে থাকে, তুর্কির লোকেরা ইসলাম কী সেটা জানে একজন লোকের কারণে, তিনি বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসী। তিনি পাহাড় থেকে পাহাড়ে ইসলাম সাথে নিয়ে বয়ে বেড়াচ্ছিলেন। আর তাঁর লেখা তাফসীর ‘রিসালায়ে নূর’ তাঁর সহচররা হাতে হাতে ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন ইজমির থেকে গাজিয়েনতেপ, ইস্তানবুল থেকে কায়সারি পর্যন্ত। গ্রামের পাহাড়ে বসে লেখা বই নাড়িয়ে দিচ্ছিল আংকারার তখত।
এই মহান পুরুষের রুহানী সন্তানেরা বার বার চেষ্টা করেছেন ইসলামকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে। ‘৬০ এর দশক থেকে প্রতি দশকে কমপক্ষে একবার করে তাদের সেই চেষ্টাকে ক্যু, ফাঁসি, গণহত্যা, জেল, রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা, সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা ইত্যাদির মাধ্যমে ‘আতাতুর্কে’র ‘সন্তান’রাও রুখে দিয়েছেন। একবার নয়, বারবার এই ঘটনা ঘটেছে। ‘৭০ এর দশকে তুর্কির অবিসংবাদিত ইসলামী ব্যক্তিত্ব নাজিমুদ্দীন এরবাকান শুরু করেন মিল্লি গুরুশ বা ন্যাশনাল ভিশন আন্দোলন। মোটা দাগে এটাই ছিল তুর্কির ইসলামপন্থী আন্দোলন। আজকের এরদোয়ান, গুল, দাউতোগলুসহ সকল ইসলামী নেতা হোজ্জা এরবাকানের প্রত্যক্ষ বা রুহানী ছাত্র। ১৯৯৭ সালে যখন এরবাকানের নির্বাচিত ইসলামপন্থী সরকারকে মাত্র ৮ মাসের মাথায় ক্যু করে উৎখাত করা হলো তখন ইস্তানবুলের সাবেক মেয়র এবং তুখোড় তরুণ ইসলামী নেতা রেচেপ তাইয়েপ এরদোয়ান (অথবা রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান, দীর্ঘস্বর বোঝাতে তুর্কি ভাষায় g ব্যবহৃত হয়) ও আব্দুল্লাহ গুল একটি আপাত মধ্যমপন্থী ধারার রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করলেন। দলের নাম ‘আদালেত ওয়া কালকিনমা পার্টিসি’, ডাকনাম আক পার্টি বা একেপি; ইংরেজিতে জাস্টিস এন্ড ডেভলপমেন্ট পার্টি। একদিকে এই দলের ঘোষিত মূলনীতি ছিল ইসলাম নিরপেক্ষ, অন্যদিকে মূল নেতৃত্ব ছিল ইসলামী তানজীম (সংগঠন) ও তরবিয়্যাতে (প্রশিক্ষণ) ঋদ্ধ কিছু ব্যক্তিত্ব। কাজেই আমরা দেখি, হুলিয়া মাথায় নিয়ে হাই স্ট্যাটাসের আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের বিলাসী চাকরি ছেড়ে এই নতুন বিনির্মাণে এক কাপড়ে চলে আসতে পেরেছিলেন আব্দুল্লাহ গুল এবং আরো অনেকে। ২০০২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বারংবার সব ধরনের স্থানীয় বা জাতীয় নির্বাচনে নিরংকুশভাবে জয়লাভ করে চলেছে এই আক পার্টি।
এরদোয়ানদের কি আসলে কোনো ইসলামী এজেন্ডা আছে?
এত কিছুর পর আসলে প্রশ্নটা নিজেই নিজের জবাব দিতে পারছে (self explanatory)। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে অনেকে মনে করেন এরদোয়ানের কোনো ইসলামী এজেন্ডা নেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে ইসলামী আন্দোলনের এমন কর্মীর সাথে কথা বলেছি, যিনি মনে করেন এরদোয়ান পশ্চিমাদের এজেন্ট। একজন মানুষ আসলে কী বিশ্বাস করেন সেটা অন্তরের ভেতরে ঢুকে বোঝা সম্ভব নয়। বরং মানুষ বাঁচে তার কাজের মধ্য দিয়ে। বৃক্ষ তোমার নাম কী? ফলে পরিচয়। আসুন দেখা যাক এরদোয়ানরা গত ১২ বছরে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আন্তর্জাতিক ও ব্যক্তিজীবনে কী ধরনের সংস্কার নিয়ে এসেছে। এবং সেই সংস্কারগুলো বিবেচনার সময় আমরা খেয়াল করব একজন নিরেট স্বার্থবাদী মানুষ, যার কোনো ইসলামী এজেন্ডা নেই, তার পক্ষে এই ধরনের কাজ করার কী ধরনের প্রনোদনা (incentive) থাকতে পারে।
ইমাম হাতিপ স্কুলের (তুর্কি মাদ্রাসা সিস্টেম, এরদোয়ান নিজেও এই স্কুলের ছাত্র ছিলেন) প্রত্যেক ছাত্র ইদানিং একটা করে ট্যাবলেট কম্পিউটার পায়। সাধারণের তুলনায় এটা অতিরিক্ত একটা সুবিধা। তাদের শিক্ষাদান হয় ডিজিটাল পদ্ধতিতে, অথচ সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা এখনও বড় বড় পাঠ্যবই থেকে বেরুতে পারেনি। ইমাম হাতিপ স্কুলের ক্লাসরুমের ডেকগুলোও ডিজিটাল, আর বাস ভাড়া অন্য স্কুলের তুলনায় অর্ধেক। সাম্প্রতিক একটা নতুন আইনে ইমাম হাতিপ স্কুল থেকে পাশ করা ছেলেমেয়ের জন্য যে কোনো বিষয়ে উচ্চতর পড়াশুনা ও সরকারী চাকরি করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। ইমাম হাতিপ স্কুলের সংখ্যা প্রায় ৯০% বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১২ সাল থেকে স্কুলগুলোতে ইসলামী শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অনেকেই মনে করেন এসব নতুন শিক্ষানীতির প্রভাব পড়বে বছর বিশ পরে নতুন প্রজন্মের উপর। কারণ, এসব ইসলামী শিক্ষা আসলে একটা প্রচন্ড শক্তিশালী আহবান। হৃদয় মনে এর প্রভাব পরারই কথা। সম্প্রতি এরদোয়ান বলেছেন, হাইস্কুলে আরবি হরফ ও আরবি ফার্সি শব্দ মিশ্রিত উসমানীয় তুর্কি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হবে। মুস্তাফা কামালের আরবি হরফ ব্যান করাকে তিনি গর্দানের শাহরগ কেটে ফেলার সাথে তুলনা করে বলেছেন, “ইতিহাস লেখা আছে পূর্বপুরুষের সমাধি পাথরে, তোমরা (তরুণরা) যদি তা পড়তেই না জানো, এর চাইতে বড় দুর্বলতা আর কোনটা হতে পারে?”
আক পার্টির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্পষ্টতই একটা মুসলিম স্বার্থঘেঁষা অ্যাকটিভ ফরেন পলিসি দেখা যাচ্ছে। এরদোয়ান যেমনটা বলেছিলেন নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের এক প্রোগ্রামে, “ফিলিস্তিন ইস্যু, ইরাক ও সিরিয়ার সংকট, ক্রাইমিয়া বা বলকান– এসব কিছুর জন্মই হয়েছে উসমানী খিলাফাতের পতনের পর। তুর্কি এসব কিছুই ভাল বুঝে, অনুধাবন ও বিশ্লেষণের ক্ষমতা রাখে। কারণ এ অঞ্চলের ইতিহাস হচ্ছে আমাদের যৌথ ইতিহাস।”
গাজ্জায় ফ্রিডম ফ্লোটিলা পাঠানো থেকে সোমালিয়া বা আরাকানের মত দূরবর্তী অঞ্চলে ত্রাণ দেওয়া, আফ্রিকায় ২৭ টা নতুন অ্যাম্বেসি খোলা, বাশার আল আসাদের স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে চলমান গণপ্রতিরোধকে সব ধরনের সাহায্য দেওয়া এবং সিরিয়ান রিফিউজিদের জন্য সবচাইতে বড় শরনার্থী শিবির খোলা, কিংবা ইখওয়ানুল মুসলিমুনের নির্বাসিত নেতৃবৃন্দকে জায়গা দেওয়া আর সিসির সামরিক জান্তার সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা, অথবা বাংলাদেশে সিলেক্টিভ মব লিঞ্চং তথা ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি উৎসবের ব্যাপারে আব্দুল্লাহ গুলের তরফে উদ্বেগ জানিয়ে চিঠি লেখা– এসব কিছুকে শুধু একটা তত্ত্ব দিয়েই ব্যাখ্যা করা যায়– ইসলামী ভ্রাতৃত্বের পররাষ্ট্রনীতি। এটা এখন ওপেন সিক্রেট যে, উসমানী খিলাফাতের আদলেই চলছে তুর্কির ফরেন পলিসি। সেজন্য একাডেমিক মহলে এরদোয়ান-গুল-দাউতোগলুদের বলা হয়ে থাকে নিও-ওটোমান বা নয়া উসমানী।
কামালের ইউরোপীয়করণ প্রজেক্টের পর থেকে স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েরা হিজাব পড়তে পারত না। এরদোয়ানের সরকার বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্কুলের উপর থেকে দুই ধাপে এই ব্যান তুলে দিয়েছে। সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপর থেকেও এই ব্যান তুলে নেওয়া হয়েছে। এর আগে সেক্যুলার এলিটরা ইসলামপন্থী অথবা পরহেযগারদের উত্থান রোধে এইসব নানান ফন্দি-ফিকির তৈরি করে রেখেছিল। এরদোয়ান একদিকে মেয়েদের ব্যক্তিস্বাধীনতা অর্থাৎ হিজাব গ্রহণ বা বর্জনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করছেন, অন্যদিকে মেয়েদের অনুরোধ করছেন পরহেযগারী অবলম্বন করতে। তিনি নারীবাদীদের এক বক্তৃতায় বলেছেন, নারী ও পুরুষের ফিতরাত (জন্মগত স্বকীয়তা) আলাদা এবং কখনও তা সমান নয়। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণীদের তিনি নসীহত করেছেন, তাঁরা যেন বিয়ের সময় পাত্র পছন্দে বেশি খুঁতখুঁতে না হয়। এদিকে প্রধানমন্ত্রী দাউতোগলু বলেছেন, পশ্চিমা বিশ্ব যে নারী পুরুষ একাকার করার চেষ্টা করছে সেটার সাইড ইফেক্ট হচ্ছে হতাশা এবং আত্মহত্যার হার বৃদ্ধি। অথচ এইসব দেশের জিডিপি পৃথিবীর সেরা। তিনি বলেছেন, “আমরা কখনও মেনে নেব না যে, একজন পুরুষ যেসব পরিশ্রমসাধ্য কাজ করে একজন গর্ভবতী মহিলাকেও বেঁচে থাকার জন্য সেসব কাজই করতে হবে। কারণ সন্তান জন্ম দেওয়া হচ্ছে একটা আসমানী কাজ যার উপর নির্ভর করে মানব সভ্যতার অস্তিত্ব। আর এটা যিনি করবেন সেই মা’র অধিকার আছে পরিশ্রম থেকে মুক্তির।” ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী বুলেন্ত আরিঞ্জ কিছুদিন আগেই মেয়েদের অনুরোধ করেছেন, তাঁরা যেন নৈতিকতা ও পরহেজগারীর পথই বেছে নেন, পাবলিক ডিসপ্লে হয়ে লাস্যময়ী ‘বস্তু’তে পরিণত না হন।
এরদোয়ানের ঘোষিত শত্রুরা মনে করেন, এরদোয়ান তুর্কিকে বিপ্লবোত্তর ইরান বা তালেবানের আফগানে পরিণত করেননি ঠিকই, তবে কামাল পাশার তুর্কির খোলনলচা অনেকটাই বদলে দিয়েছেন। মুস্তাফা কামাল বলতেন, “আমরা একদল সেক্যুলার দেশপ্রেমিক চাই।” আর এরদোয়ান প্রায়শই বলে থাকেন, “আমরা একটা পরহেজগার প্রজন্ম গড়ে তুলছি” এবং একটা ‘নতুন তুর্কি’ আমাদের গন্তব্য। এরদোয়ানের সমালোচকরা অনেকেই মনে করেন ইসলাম চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে না ঠিকই; কিন্তু পলিসি নির্ধারণের মত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আক পার্টির এক ধরনের রক্ষণশীল ঝোঁক, সামাজিক বিষয়াদিতে সরকারী মদদে নৈতিকতা ছড়ানোর চেষ্টা স্পষ্ট। যেমন ধরা যাক কোনো সিনেমা বা মঞ্চ নাটকে যদি এমন ডায়ালগ থাকে যে, “I want to sleep with you.” খুব সম্ভবত সেই নাটক/সিনেমা তুর্কিতে আর আলোর মুখ দেখবে না। যেসব সরকারী থিয়েটার বা অপেরা হাউজ সরকারী ফান্ড পায় সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ এখন এরদোয়ানের ‘পরহেজগার জেনারেশনে’র হাতে। কাজেই এর একটা পরোক্ষা প্রভাব পড়ছে প্রোডাকশনের উপর। গত বছর মদের উপর সরকার কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। যেকোনো প্রকারের মদের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ এবং গভীর রাতে এর বেচাবিক্রিও নিষিদ্ধ। এখন আর সব জায়গায় মদ বেচাও যাবে না। সরকারী একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এসব কাজের কারণ ব্যাখ্যায় বলেছিলেন, আমরা কেবল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রেগুলেশন যথাযথভাবে মেনে চলার চেষ্টা করছি। এখানেও ইসলামী ঝান্ডা না উড়ানোর সচেতন ও কৌশলী ভূমিকা সহজেই চোখে পড়ে।
এক কথায়, তুর্কির রাস্তায় হাঁটলে আপনার চোখে পড়বে অনেক বেশি হিজাব; মসজিদের সংখ্যাও গেছে অনেক বেড়ে। ইসলামী দাওয়াহ আগের চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী আর মসজিদে লোক আসছে অনেক বেশি। বিখ্যাত তুর্কি সাংবাদিক মুস্তফা আকিউল বলেন, “আগের দিনে একজন আদর্শ তুর্কি ছিলেন তিনিই যিনি পরহেযগার নন, আর এখন এর ঠিক উলটা। আপনি যদি মদখোর হন, একেপির রাজ্যে আপনার খবর আছে, এখানে আপনার জায়গা খুঁজে নিতে কষ্ট করতে হবে। এই লোকগুলা আসলে ধীরে ধীরে পুরো ব্যাপারটার উপরের দিক নিচে আর নিচের দিক উপরে এনে উলটে-পালটে দিচ্ছে।” এখন শুরুর প্রশ্নে ফিরে যাই, এরদোয়ানের কি আসলে কোনো ইসলামী এজেন্ডা আছে? বৃক্ষ তোমার নাম কী? ফলে পরিচয়।
কীভাবে এসব সম্ভব হলো?
এরদোয়ানরা ক্ষমতায় এসে প্রথম বছরগুলোতে কিছু ইন্সটিটিউশান গড়ে তোলায় গভীর মনোযোগ দিয়েছিলেন। জোর-জবরদস্তি করে ক্ষমতায় থাকা কেমালিস্ট দলটির অদ্ভুত অর্থনৈতিক দর্শনের কারণে তুর্কি অর্থনীতি নিজেকে মোটেই মেলে ধরতে পারছিল না। এরদোয়ানদের সাথে যারা আক পার্টি গড়ে তোলায় এগিয়ে এসেছিলেন এদের অনেকেই এসেছিলেন মূলত অর্থনৈতিক দর্শনে মিল থাকার কারণে, ধর্মীয় রক্ষণশীলতার কারণে নয়। এরদোয়ানের পার্টি যে অর্থনৈতিক কর্মসূচি হাজির করেছিল সেটা ছিল উদারনৈতিক পুঁজিতান্ত্রিক বিকাশের জন্য খুবই উপযোগী। এছাড়া একটা ব্যবসায়ী প্রজন্ম এরদোয়ানের কমরেড হয়েছেন যাদের বলা হয়ে থাকে আনাতোলিয়ান টাইগার্স। এরা খুব ঝানু ব্যবসায়ী আর ব্যক্তিগতভাবে পরহেযগার। অর্থনৈতিক উন্নয়ন সবসময় আইনের শাসনের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আক পার্টি প্রশাসনযন্ত্রের উঁচু স্তরে অন্তত একটা গুণগত পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছিলেন যাতে ব্যবসায়ীদের মনে এই আশ্বাস জন্মেছিল যে, এখানে ব্যবসা করলে চাঁদাবাজি আর লাল ফিতার দৌরাত্ম্য সহ্য করতে হবে না। মাত্র ৫-৮ বছরের ব্যবধানে তুর্কি অর্থনীতি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি, অবকাঠামো নির্মাণ, রপ্তানী বহুগুণ বৃদ্ধির এমন সব শক্তিশালী চমক হাজির করা শুরু করে, যেগুলা ছিল যেকোনো অর্থনীতিবিদের জন্য ঈর্ষণীয় একটা সাফল্যের তরিকা বা রেসিপি। জিডিপি গেল অনেক বেড়ে। বিশ্বব্যাংকের ডাটা বলছে, ২০০৫ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ৬ হাজার ডলারের একটু বেশি আর ২০১৩ সালে এটা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ডলারের উপরে। মূলত অর্থনৈতিক শক্তিই হচ্ছে এরদোয়ানদের পায়ের নিচের সেই মাটি যার উপরে শক্তভাবে দাঁড়িয়ে এরদোয়ান তাঁর অন্য এজেন্ডা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
তুর্কি ইসলামপন্থীদের একটা বড় অংশ হচ্ছে ১৯৬০-৯০ এর দশকে গ্রাম থেকে শহরে আসা ইমিগ্রেন্ট জনশক্তি। এই সময়টা তুর্কির নগরায়নের সময়। বলাই বাহুল্য, রাজার নীতি নিয়ন্ত্রণ করে শহর। শহুরে মডার্নিটির ইট পাথরে এই জনগোষ্ঠী গড়হাজির থাকতেন আর ব্যাগে করে নিয়ে এসেছিলেন আনাতোলিয়ান ইসলামের সুগন্ধ। রাজনীতি বা সংস্কৃতি, শিক্ষা বা ব্যবসা এসব কিছুতেই তাঁরা খুঁজেছেন একই ফ্লেভারের কোনো গ্রুপ। এই গ্রুপ একদিকে যেমন ইসলামপন্থীদেরকে রাজনৈতিক সমর্থন দিয়েছে, অন্যদিকে সামাজিক কর্মকাণ্ডে ওয়াকফ ও দান করার আনাতোলিয়ান সংস্কৃতিকে পুরোপুরি জারি রেখেছে। এর ফলে সামাজিক সেবার এক বিরাট নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে। এসব নেটওয়ার্কের অনেকগুলোই বিভিন্ন সুফী খানকা দ্বারা উদ্বুদ্ধ বা জড়িত। কিন্তু হাল আমলের কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এসব সামাজিক সেবার নেটওয়ার্ক সবসময় ইসলামপন্থী আন্দোলনের সহায়ক শক্তি হিসাবেই কাজ করে গেছে। অন্তত জনগণের চোখে ইসলামপন্থী আন্দোলন আর এইসব সামাজিক কর্মসূচি, যা আসলে একটা সমান্তরাল রাষ্ট্রের মতই, সকল বিপদে-আপদে মানুষের কাজে এসেছে, এদের মধ্যে কোনো ফারাক চোখে পড়েনি। এসব নেটওয়ার্কের রয়েছে হাজারো স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং, এনজিও, রাইটার্স গিল্ড, বহু পত্রিকা, বেশ কিছু টিভি চ্যানেল আর প্রকাশনা সংস্থা। এই পুরা কর্মযজ্ঞ ও যন্ত্রই ইসলামীকরণের ইঞ্জিন হিসাবে কাজ করেছে। সমাজের ইসলামীকরণ আগে হয়েছে নিচ থেকে উপরে (bottom up), আর সরকারযন্ত্র উপর থেকে নিচে এই কাজের হালটা শক্ত করে ধরে রেখেছিল। একদিকে সামরিক বাহিনী ও সেক্যুলার এলিটের তৈরি ‘দেরিন দৌলাত’ বা ডিপ স্টেইট প্রতি দশকে ক্যু করে রাজনৈতিকভাবে ইসলামপন্থী আন্দোলনকে বনসাই করে রাখতে চেয়েছে। অন্যদিকে ইসলামপন্থী গ্রুপগুলো সমাজের ইসলামীকরণ প্রক্রিয়াকে বিকেন্দ্রীকরণ করে দিয়েছে। সব ডিম এক ঝুঁড়িতে না রেখে পোর্টফলিও ডাইভার্সিফাই নীতি অনুসরণ করা হয়েছে। সময়মত সবকিছু একই লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যের দিকে ‘ক্লিক’ করেছে। এসব কিছুই সম্ভব হয়েছে অসম্ভব মেধাবী, কৌশলী ও দুনিয়াদারীর বুঝওয়ালা একদল অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতৃত্বের হাতে। স্মরণ করা যেতে পারে, এই লোকগুলো কীভাবে নিয়মিত ইউরোপিয়ান, ইজরাইলী বা আমেরিকান ডিপ্লোম্যাটদের নাকানিচুবানি খাওয়ান।
তুর্কির ইউরোপমুখী অভিগমন একদিকে যেমন বহু খারাপ বিষয়ের আমদানি করেছে, অন্যদিকে কিছু ভাল ইন্সটিটিউশন (প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি অর্থে) বয়ে এনেছে। এর একটা হচ্ছে একটা উদারনৈতিক স্পেস তৈরি করা। এই স্পেস একটা স্বাস্থ্যবান বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশ হাজির করেছে। এই পরিবেশ এক রকমের বুদ্ধিবৃত্তিক সহনশীলতা জন্ম দিয়েছে। কী জানি কেন যেন মনে হয়, বাংলাদেশে একদিকে পশ্চিমাকরণ হচ্ছে আর অন্যের চিন্তা গ্রহণ করা বা নিদেনপক্ষে অন্যের মত শোনার মত সহনশীলতা শূন্যের দিকে যাচ্ছে। এরদোয়ানরা ইইউ’তে তুর্কির একীভূতকরণের যে মুলাটা ঝুলিয়েছিলেন, তা ছিল এই সিভিল স্পেস ব্যবহার করার সুবিধার স্বার্থে। এই এক মুলা ঝুলিয়ে রাজনীতি থেকে সেক্যুলার-মিলিটারি আঁতাতের ‘ডিপ স্টেট’কে একদম ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছেন। কেননা ইউরোপীয় স্ট্যান্ডার্ড দাবি করে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ এবং কিছু অনস্বীকার্য সিভিল রাইটস। মিলিটারি ছিল সেক্ষেত্রে একটা বাঁধা। ইইউ’তে যাওয়ার কথা বলে সেগুলো সহজে দূর করা সম্ভব হয়েছে। জুডিশিয়াল রিফর্মও হয়েছে একই সাথে। এর আগে জুডিশিয়ারির কাজই ছিল অনুবীক্ষণ যন্ত্র নিয়ে দেখা, কোথাও সেক্যুলারিজম এতটুকু ‘দূষিত’ হয়ে গেল কিনা। পরে যখন ইইউ তুর্কিকে নিতে অনাগ্রহ দেখালো, ততদিনে রিফর্ম যা হবার হয়ে গেছে এবং সেক্যুলার এলিট ডিপ স্টেট পরিণত হয়েছে এক দন্তনখবিহীন বাঘে। এসব কিছুর পর দাউতগলু আল জাজিরার সাথে এক সাক্ষাৎকারে যখন বলেছিলেন যে, “এ বছর ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে বেকারত্বের সংখ্যা ছিল এক মিলিয়ন আর তুর্কি এ বছর নতুন চাকরি তৈরি করেছে এক মিলিয়ন। তুর্কি যদি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে থাকত তাহলে ইইউ’তে কোনো বেকারত্বই থাকত না” তখন ব্যাপারটা যথেষ্ট কৌতুককর হয়েছিল সন্দেহ নাই। এখন অনেকে প্রশ্ন তোলেন ইইউ’তে ঢোকার কোনো ইচ্ছা আদৌ আক পার্টির ছিল কিনা। নাকি এটা ছিল স্রেফ নিজেদের এজেন্ডা হাসিল করার একটা উপায় এবং ব্যবহার শেষে এরদোয়ানের দল সেটাকে টিস্যু পেপারের মত ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে।
এর সাথে যোগ হয়েছে একটা নূন্যতম মান পর্যন্ত সার্বজনীন শিক্ষা। বর্তমানে তুর্কি স্ট্যাটিস্টিকাল ইন্সটিটিউটের ডাটা বলছে, সাক্ষরতার হার ৯৮.৭৮%। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে এটা ৫৮% এর কাছাকাছি। শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে আদর্শবাদী কোনো উদ্দেশ্যের দিকে ধাবিত করা যত সহজ অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে সেটা ততটা সহজ নয়। বিশেষত তা আরো কঠিন যদি পেটে ক্ষুধা থাকে। একবেলার ভাল খাবার আর ভোট এইসব দেশে তাৎপর্যের দিক থেকে খুব কমই পার্থক্য বহন করে।
আরেকটা ব্যাপার সম্ভবত তুর্কিদের ক্ষেত্রে খুব সহায়ক ছিল। ইসলামপন্থীরা শুধু উসমানী খিলাফাতের ৬২৩ বছরের গৌরবজ্জ্বল অতীতের দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করে সেদিকে ফিরে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করাই জনসমর্থন মোবিলাইজ করার জন্য অনেক বড় শক্তি ছিল। মুস্তাফা কামাল বই পুস্তক উলটে-পালটে দিয়েছেন, কিন্তু অলি-গলিতে গগনচুম্বী সুউচ্চ মিনারগুলো তো এখনো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছে উসমানী খিলাফাতের গাঁথা আর গৌরব।
তথ্যসূত্র:
১। আক পার্টি অফিসিয়ালদের সাথে লেখকের ব্যক্তিগত ইন্টারভিউ, ইস্তানবুল ২০১১।
২। Turkey’s long game: how 12 years of AKP rule has eroded the secular state
৩। How Atatürk Made Turkey Secular
৪। এরদোগানের তুরস্ক: বিদায়ের পথে সেক্যুলারিজম? পর্ব-১, পর্ব-২
৫। Ebaugh, H. 2009, “The Gülen Movement: A Sociological Analysis of a Civic Movement Rooted in Moderate Islam” Springer.