আন নাহদার দ্বিতীয় পর্যায়ে উত্তরণ

এডিটর’স নোট: আরব বসন্তের সূতিকাগার তিউনিশিয়ার ইসলামপন্থী দল আন নাহদা। সম্প্রতি দলটি নিজেদের ধ্যানধারণার কিছু মৌলিক পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন এক সম্ভাবনার পথ দেখাচ্ছে। দলটির এই পরিবর্তন নিয়ে সংবাদ সংস্থা আল জাজিরার সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘আল জাজিরা সেন্টার ফর স্টাডিজ’ Tunisia: Ennahda’s ‘Second Founding শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেনদটির লেখক লারবি সাদিকী কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক। ইসলামপন্থার নয়া গতিপথ সম্পর্কে বুঝাপড়ার অংশ হিসেবে সিএসসিএস-এর পাঠকদের জন্য প্রতিবেদনটি অনুবাদ করেছেন আইয়ুব আলী।

*****

সারসংক্ষেপ

আন নাহদার পূর্বসূরী ‘ইসলামিক টেনডেন্সি মুভমেন্ট’ ১৯৮১ সালে আলোর মুখ দেখে। তিউনিশিয়ায় ফরাসীপ্রেমী শাসক বুরগিবার আমলের শেষের দিকে এ দলটির এজেন্ডা ছিলো দেশের ইসলামী পরিচয়কে সমুন্নত রাখা। যথাসম্ভব ইসলামী আইনের অনুসরণ করা, ইসলামী পরিচয়কে সমুন্নত রাখা এবং রাষ্ট্র, সমাজ, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও নৈতিকতার ক্ষেত্রে ইসলাম নির্দেশিত পন্থার বিকাশের লক্ষ্যে কাজ করা বলতে মুসলিম ব্রাদারহুডের তৎপরতাকেই সাধারণত বুঝায়। এই অর্থে ব্রাদারহুডের সাথে এ দলটির লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের তেমন পার্থক্য ছিল না। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত আন নাহদার  দশম কংগ্রেসটি রাজনৈতিক ইতিহাসের খেরোখাতায় ‘দ্বিতীয় পর্যায়’ হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আন নাহদা তার অতীত অবস্থানকে অতিক্রম করে গিয়েছে। তবে রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় কার্যক্রমকে আলাদা করার পর তারা কীভাবে সামনে এগুবে, তা এখনো অস্পষ্ট। যাইহোক, আন নাহদা একটি উত্তরাদর্শিক পর্যায়ে (post-ideology phase) প্রবেশ করেছে। এটি সম্ভবত ইসলামপন্থার এক ধরনের ‘উত্তরাধুনিক’ পরিবর্তনের সূচনা। সত্যিই কি তাই?

*****

ভূমিকা

আন্দোলনের ঐতিহাসিক নেতৃবৃন্দের উপর আন নাহদার দশম কংগ্রেস পুনরায় আস্থা স্থাপন করেছে। দলটির নেতৃবৃন্দ ইসলামপন্থার যে ‘তিউনিশীয় মডেল’ আত্মস্থ করছেন – কিংবা অন্য কোনো কিছু ­– তার উপরও তারা আস্থা স্থাপন করেছে। যাইহোক, দলটি প্রচণ্ড ঝুঁকিতে আছে এবং সামনের প্রতিটি পদক্ষেপে চ্যালেঞ্জ ওত পেতে আছে। সংগঠন নাকি আদর্শ – এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে মরক্কো থেকে শুরু করে মিশর পর্যন্ত ইসলামপন্থীদের অভ্যন্তরীণ বিভাজনের পাশাপাশি একইভাবে সেক্যুলারদের মধ্যকার বিভাজনের এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ বর্তমানের এই সময়। এমতাবস্থায়, তিউনিশিয়ার ইসলামপন্থীরা মতাদর্শিক লড়াইয়ের চেয়ে ক্ষমতা অর্জনের লড়াইকে প্রাধান্য দিচ্ছে বলে মনে হয়। অর্থাৎ, পলিসিই মুখ্য, আদর্শ গৌণ ব্যাপার।

ইমাম হাসান আল বান্না, সাইয়েদ কুতুব, হাসান আল তুরাবি এবং ইমাম খোমেনী ও মুহাম্মদ হোসেন ফজলুল্লাহ (উভয়েই শিয়াদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা) প্রমুখ শীর্ষস্থানীয় তাত্ত্বিকগণ তাদের লেখায় ইসলামকে ধর্ম ও রাজনীতির সমন্বয় (দ্বীন ওয়া দাওলাহ) হিসেবে ইসলামের যে তাত্ত্বিক কাঠামো দাঁড় করিয়েছিলেন, আন নাহদা কি একে ‘হত্যা’ করলো? ইসলাম ও রাজনীতির অবিচ্ছেদ্যতা একটি স্বতঃসিদ্ধ ধারণা হিসেবে প্রায় শতাব্দীকাল ধরে প্রতিষ্ঠিত। তিউনিশিয়ার ইসলামপন্থীরা এই ধারণাকে পুনর্বিবেচনা করছে বলে মনে হয়। এর আগে তাদের সমমনা মরক্কো ও তুরস্কের ইসলামপন্থীরাও এমনটি করেছে।

ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যকার যাবতীয় জটিলতার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির পর ২০১৬ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত দশম কংগ্রেসে আন নাহদা এ সংক্রান্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আন্দোলনটির ৩৬ বছরের ইতিহাসে সম্ভবত এটি একটি টার্নিং পয়েন্ট। এ ব্যপারটিকেই আন নাহদার ‘দ্বিতীয় পর্যায়’ হিসেবে বলা হচ্ছে। এটা শুধু পরিকল্পিত কৌশল মাত্র নয়, সামাজিক বাস্তবতাও চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে। নিচে এ সম্পর্কে আলোচনা করবো।

আধুনিক রাজনৈতিক ইসলাম ও বাস্তব জ্ঞানের গুরুত্ব: কেন ‘দ্বিতীয় পর্যায়’? তিনটি মুখ্য পর্যবেক্ষণ

(১) ধর্ম থেকে রাজনীতিকে পৃথকভাবে বিবেচনা করা, আরো সঠিকভাবে বললে, রাজনীতির উপর ধর্মের প্রভাবকে কমিয়ে আনা হলো মরক্কো ও তিউনিশিয়ার ইসলামপন্থীদের সাম্প্রতিক প্রবণতা। এটি এক অর্থে রাজনৈতিক ইসলামের ব্যর্থতা বটে। তারা আরব-ইসলামী পরিমণ্ডলে রাজনীতি ও সামাজিক বাস্তবতাকে মোকাবেলা করতে গিয়ে নিজেদের তাত্ত্বিক ধ্যানধারণা ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে সফল হতে পারেনি। যদিও এ ক্ষেত্রে দুয়েকটি ব্যতিক্রম রয়েছে। যেমন, তুরস্ক ও মালয়েশিয়া। দেশ দুটি খুব ভালো উদাহরণ না হলেও একেবারে মন্দও নয়।

(২) ইসলামপন্থীদের হাতে ধর্ম ও রাজনীতির এই বিভাজন তাদের আসল প্যারাডাইমকে দুর্বল করবে। তত্ত্বের চেয়ে বাস্তবতাকে গুরুত্ব দেয়ার বিষয়ে রাজনৈতিক ইসলামের এই নতুন ধারাটি অভিজ্ঞতার উপরই বেশি জোর দিয়ে নতুন তত্ত্ব নির্মাণের সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলছে। সম্ভবত রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও রাজনৈতিক ইসলাম এই ব্যাপারটা (ধর্ম ও রাজনীতির বিভাজন) মেনে চলবে। এর ফলে ধর্ম হিসেবে ইসলামের তাত্ত্বিক সম্ভাবনাকে গভীরভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব হবে। এই নতুন তত্ত্ব গ্রহণ করলে ইসলামপন্থীদের রাজনৈতিক সংগঠনগুলো নিজেদের মধ্যে বাস্তব জ্ঞানের সমন্বয় ঘটাতে পারবে। এই ‘বৈপরিত্বের’ সমাধান করা আরব রাজনীতির জন্য বিরাট একটি চ্যালেঞ্জ। ইসলামী গণতন্ত্র বা শাসনব্যবস্থার অপরিহার্য ব্যাপার হিসেবে কোনো আদর্শ অবস্থাকে দাবি করা বেশ সহজ কাজ। যেমন, ইসলামপন্থী অনেক তাত্ত্বিক সামাজিক ন্যায়বিচার বা ইসলামের নৈতিক ভিত্তির শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলে থাকেন। কিন্তু বাস্তবে এগুলোকে অপরিহার্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।

(৩) ধর্ম ও রাজনীতির পৃথকীকরণের সাম্প্রতিক প্রবণতা সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরির শুভ সূচনা করতে পারে। কোনো কিছুকে ইসলামের দৃষ্টিতে ভুলশুদ্ধ নির্ধারণের বিষয়ে প্রবল উৎসাহী কিছু মানুষ স্বঘোষিত ব্যাখ্যাদাতা বনে গেছেন। কেউই নিজেকে সর্বোচ্চ নৈতিকতাসম্পন্ন দাবি করার অধিকার রাখেন না এবং পাবলিক স্ফিয়ারে ধর্মের ভূমিকা কী হবে কিংবা হবে না, তা ঠিক করে দিতে পারেন না।

তিউনিশীয় প্রেক্ষাপট

ইসলামপন্থা নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে না। জন এসপজিটো, জন ভল[1] থেকে শুরু করে খালেদ আবু আল ফজলের[2] মতো স্কলারগণ ইতোমধ্যে একে স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার হিসেবে দেখিয়েছেন। বরং এ সময়কার ইস্যু হচ্ছে মুসলিম বিশ্বে সক্রিয় বিভিন্ন ধারার ইসলামপন্থা অনুসৃত ডগমার পুনর্মূল্যায়ন, কৌশলগত পরিবর্তন বিশ্লেষণ কিংবা পুরো বিষয়টির সূক্ষ্ম নিরীক্ষণ। ডেল অ্যাইকেলম্যান এবং জেমস পিসকাটরি মনে করেন, “মুসলিম রাজনীতি মূলত ধর্মীয় প্রতীকের ব্যাখ্যা এবং এগুলো প্রচার প্রসারের কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত।” তাই বলা যায়, মুসলিম বিশ্বে বিদ্যমান ধর্মীয় ও জাগতিক ব্যাপারের মধ্যকার সদা পরিবর্তনশীল পারস্পরিক সম্পর্কের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণই হলো ‘মুসলিম রাজনীতি’।

আরেকটু এগিয়ে তারা মতামত দেন, মুসলিম রাজনীতির চরিত্র ও সংগঠন ব্যবস্থা মিলে যে বক্তব্য তৈরি হয়েছে, অবশ্যই তা ‘পুনর্বিবেচনা’ করতে হবে। মুসলিম বিশ্বে এখন এক ধরনের আত্ম-উপলব্ধির বহিঃপ্রকাশ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এটি মুসলিম সম্প্রদায়কে কিছু মৌলিক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। মোটাদাগে বলা যায়, মুসলিম বিশ্বে শিক্ষার ব্যাপক প্রসার এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্প্রসারণের ফল হলো এ ধরনের উপলব্ধি।[3] রাজনীতি, ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রকৃত তাৎপর্য কী, তা নিয়ে আরব বসন্তের অন্যান্য দেশগুলোর মতো তিউনিশিয়ার লোকজনের চিন্তার পালেও হাওয়া লেগেছে। এটা বহুত্ববাদ, জনগণের অংশগ্রহণ এবং স্বাধীনতার বহিঃপ্রকাশ।

যুগের চাহিদার আলোকেই রাজনৈতিক ইসলাম কিংবা ইসলামপন্থা নিজেকে নতুন করে গড়ে তুলছে। তিউনিশিয়ার ইসলামপন্থীরাও এর ব্যতিক্রম নয়। বর্তমানে ইসলামপন্থীরা কী ধরনের চিন্তাভাবনা করছে, বিশেষত মরক্কোর ইসলামপন্থীদের রেফারেন্স টেনে, সে সম্পর্কে আভি স্পিজেল তার সাম্প্রতিক বই ‘ইয়ং মুসলিমে’ কিছু পয়েন্ট তুলে ধরেছেন।[4] ‘মুসলিম রাজনীতির’ বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে অ্যাইকেলম্যান ও পিসকাটরির বই থেকে কিছু উদ্ধৃতি দিয়ে স্পিজেল, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের এক্টিভিস্টদের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে কার্যকর হয়ে ওঠা একটি পন্থা হিসেবে রাজনৈতিক ইসলামকে বিবেচনা করেছেন। ইসলামপন্থার এ দিকটি নিয়ে খুব কমই গবেষণা হয়েছে।

ইসলামপন্থার বিবর্তন প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ দুটি পয়েন্ট উল্লেখ করেছেন:

১. ইসলামপন্থীদের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাহ্যিক ফ্যাক্টরগুলোর চেয়ে নিজেদের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির ভূমিকা বেশি। তিউনিশিয়ার চেয়ে মরক্কোতে এটি বেশি লক্ষ্যণীয়। মরক্কোর ইসলামপন্থা অনেক বেশি বৈচিত্র্যপূর্ণ। রাজতান্ত্রিক এই দেশটির জনপরিমণ্ডলে প্রভাব তৈরি করতে ক্ষমতাসীন ইসলামপন্থীরাসহ নানা ধরনের ইসলামপন্থীদের মধ্যে পারস্পরিক প্রতিযোগিতা চলছে। অন্যদিকে তিউনিশিয়ায়, রাষ্ট্রের সাথে আন নাহদার সম্পর্কের ধরনই দলটির অভিমুখ নির্ণয়ে ভূমিকা রেখেছে। মরক্কোতে যা ঘটেনি বলে স্পিজেল মনে করেন। তিউনিশিয়ার ইসলামী ঐতিহ্য ও পরিচয়কে উপড়ে ফেলে বুরগিবার নেতৃত্বে এক ধরনের সেক্যুলার জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র ও জাতি গঠনের প্রচেষ্টার কারণে ইসলামপন্থীরা এর বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে। এ বিষয়ে আন নাহদার বক্তব্য হলো, আত্মপরিচয়ের প্রশ্নে তিউনিশিয়ার জনগণ এখন আর বিভক্ত নয়। আগের নীতি থেকে আন নাহদার সরে আসার পেছনে আনসার আল শরীয়ার[5] উগ্র কর্মকাণ্ডের (তিন বছর আগের তুলনায় গ্রুপটি এখন বেশ দুর্বল) ভূমিকা কতটুকু, তা অবশ্য স্পষ্ট নয়।

২. অদূর ভবিষ্যতে মরক্কোর জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টিও (ফরাসীতে সংক্ষেপে দলটি PJD নামেই পরিচিত) সামাজিক-রাজনৈতিক কাজ (সিয়াসাহ) এবং ধর্মীয়-দাওয়াতী কাজের (দাওয়াহ) মধ্যে পৃথকীকরণের ব্যাপারটি ভেবে দেখতে পারে। আব্দুল আলী হামেদীনের দেওয়া উদাহরণের প্রসঙ্গ টেনে ধর্মীয় আন্দোলন (হারাকাত) ও রাজনৈতিক দলের (হিজব) মাঝে কী ধরনের বাস্তব পার্থক্য রয়েছে, স্পিজেল তা সুস্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন।[6] বর্তমানে আন নাহদা এ পথেই এগুচ্ছে।

ইসলামপন্থা সম্পর্কে নতুন অনুসিদ্ধান্ত আন নাহদাকে তিউনিশিয়ার গণতান্ত্রিক সংস্কার পরবর্তী সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে আরো বেশি সুযোগ করে দিয়েছে। আন নাহদা এখন দেশটির সদ্য গড়ে ওঠা ‘পাবলিক স্ফেয়ারের’ অন্যতম অংশীদার। রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কাজকে দুটি পৃথক ধারায় আলাদা করলেও গণমুখী ইসলামপন্থা এ দুটির মাঝে এক ধরনের সমন্বয় করে চলছে। এর পাশাপাশি নাগরিকদের ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ, ক্ষমতার প্রতিযোগিতা, ২০১১ সাল থেকে জোটগতভাবে ক্ষমতার অভিজ্ঞতা এবং দলে পেশাদারিত্ব তৈরির লক্ষ্যে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণের মতো ব্যাপারগুলো তো রয়েছেই।

তিউনিশিয়ার রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাবশালী হিসেবে সম্প্রতি পরিচিত হয়ে ওঠার পরও আন নাহদা দেশটির শক্তিশালী বামপন্থী ও সেক্যুলার শক্তির সাথে একত্রে কাজ করছে। সংলাপ ও ছাড় দেওয়া – উভয় অর্থেই আন নাহদা তাদের সাথে এনগেজ হয়েছে। এরমধ্যে ২০১১ সালে জোটগতভাবে ও বর্তমানে সেক্যুলারদের সাথে যৌথভাবে সরকার গঠন উল্লেখযোগ্য। মসজিদ শুধু ইবাদতের স্থান – এই ঘোষিত রাষ্ট্রীয় নীতিকে আন নাহদা ইতিবাচকভাবে মেনে নিয়েছে। ইমামদেরকে নতুন করে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং দায়িত্ব পালনে পেশাদারিত্ব তৈরির লক্ষ্যে বর্তমান রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনাকেও তারা সমর্থন করেছে। বিশেষত তরুণ প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে পড়া ধর্মীয় উগ্রপন্থা এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের লড়াইয়ের প্রস্তুতির প্রেক্ষিতে এটা হয়তো আন নাহদার আত্মরক্ষামূলক কৌশলও হতে পারে।[7] ইসলাম নিয়ে সক্রিয় মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন ব্যক্তি বা দল নিজেদেরকে ISIL-এর মতো গোষ্ঠীর বিরোধী হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে। আন নাহদাও এর ব্যতিক্রম নয়। এটি ‘মধ্যপন্থী’ বনাম ‘উগ্রপন্থীদের’ দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ।

ইসলামের অপরিবর্তনীয় (আস সাবিত) ও পরিবর্তনীয় (আল মুতাগাইয়ির) নীতিকে বিবেচনায় নিলে আন নাহদা কর্তৃক রাষ্ট্রীয় বাস্তবতাকে মেনে নেয়ার ব্যাপারটি বুঝা যাবে। রাজনীতি হচ্ছে সদা পরিবর্তনশীল ব্যাপার। এক্ষেত্রে জনকল্যাণ তথা মাকাসিদই বিবেচ্য বলে আমি মনে করি। তিউনিশীয় প্রেক্ষাপটে, সেখানকার আবশ্যকতা ও প্রয়োজনীয়তাই আন নাহদার এই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে প্রভাব রেখেছে।

তিউনিশিয়ার অভ্যন্তরীণ অবস্থার প্রেক্ষিতে অর্থাৎ, সমালোচকরা যে ধরনের সন্দেহ করছে তার জবাবই সম্ভবত আন নাহদা দিচ্ছে। সমালোচকদের সন্দেহ, দলটি তার গোপন ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এজেন্ডাকে আড়াল করছে। তারা একবার ক্ষমতায় যেতে পারলেই স্বৈরতন্ত্র কায়েম করবে। আন নাহদা তিউনিশিয়ার রাজনৈতিক আত্মপরিচয়ের ব্যাপারে শ্রদ্ধাশীল নয় – লিবারেল ও সেক্যুলাররা যেন এমন সমালোচনা করতে না পারে, তাই আগে থেকেই দলটি পরিবর্তনের পথে হেঁটেছে। আন নাহদা এখন দাবি করতে পারে যে, তারা আত্মপরিচয়ের রাজনীতিতে পরিবর্তন এনেছে।

২০১৬ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত দশম কংগ্রেসের ঘোষণা অনুযায়ী আন নাহদাকে নতুন পরিচয়ে পরিচিত করার পরিকল্পনাকে সংক্ষেপে এভাবে তুলে ধরা যায়:

আন নাহদা একটি সিভিল স্টেট (দাওলাহ মাদানিয়্যাহ) প্রতিষ্ঠায় সংকল্পবদ্ধ। এটি ইসলামপন্থীদের আগের অবস্থান – শরীয়াহ (ইসলামী আইন ব্যবস্থা) হবে রাষ্ট্রীয় আইন – থেকে সরে আসা। যেমন, ইমাম হাসান আল বান্না এই লক্ষ্যে কাজ করেছেন।

দলটি জাতীয় রাজনীতির খেলোয়াড় হিসেবে নিজের পরিচয় ঠিক করে নিয়েছে, অর্থাৎ ক্ষমতার অন্যান্য দাবিদার ও প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর সাথে রাজনৈতিক ময়দানে তারা কাজ করবে। এর মাধ্যমে তারা ইসলামপন্থার পুনর্জাগরণবাদী ধারা থেকে বেরিয়ে এসেছে। ‘ইসলামই হচ্ছে সমাধান’ – মুসলিম ব্রাদারহুডের এই পুরনো দাবির কার্যকারিতা আর থাকলো না, যদিও আন নাহদা নিজেদের শ্লোগান হিসেবে এটি আসলে ব্যবহার করেনি।

আন নাহদা ইসলামপন্থাকে নিছক আদর্শ হিসেবে না দেখে কমবেশি এক ধরনের ‘রাজনৈতিক নৈতিকতা’ হিসেবে বিবেচনা করেছে, ক্ষমতার লড়াইয়ে যা চূড়ান্ত রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা দিবে। এই দিক থেকে বলতে গেলে আন নাহদা উত্তরাদর্শিক পর্যায়ের দিকে এগুচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে একে এক ধরনের ‘আদর্শের সমাপ্তি’ মুহূর্তও বলা যায়।

আন নাহদা বাজার অর্থনীতিকে গ্রহণ করে নিয়েছে। পুঁজিবাদ নিয়ে পূর্বেকার ইসলামপন্থীদের (এ ব্যাপারে সাইয়্যেদ কুতুব সবচেয়ে সোচ্চার ছিলেন। ইসলামের সামাজিক ন্যায়বিচার ছিল তার রাজনৈতিক চিন্তার মুখ্য বিষয়) মাঝে যেসব আপত্তি ছিলো, আন নাহদা তা থেকে সরে এসেছে। বিপ্লবের পর আন নাহদা সামাজিক ন্যায়বিচারকে গ্রহণ করে নিয়েছে।

সমাজের ৯৯ ভাগ মানুষই যেখানে সুন্নী মুসলমান, সেখানে সামাজিক পর্যায়ে মানুষকে নৈতিকতা শিক্ষা দেওয়ার কাজ থেকে আন নাহদা ইস্তফা নিয়েছে। এর মাধ্যমে নতুন করে পেশাদারিত্বের ছবক নেয়া এ রাজনৈতিক দলটি দাওয়াতী কার্যক্রম থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। একইসাথে ধর্মীয় বিষয় ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে কর্তৃত্বশীল ভূমিকা ও তা বাস্তবায়ন করার প্রচেষ্টা থেকেও সরে আসছে।

মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো আন্দোলনগুলোকে যে সকল মৌলিক দাবির (যেমন– কোরআন আমাদের সংবিধান, জিহাদ আমাদের পথ) আলোকে চিহ্নিত করা যায়, আন নাহদা সেগুলো থেকে আলাদা। গুণগত (আদর্শিক) কিংবা ব্যবহারিক (রাজনৈতিক) কোনো অর্থেই আন নাহদাকে এসব আন্দোলনের সাথে মেলানো যায় না।

গণমুখীনতা

আলজেরিয়া, মিশর, লেবানন, মরক্কো এবং সুদানের ইসলামপন্থী দলগুলোর মতো আন নাহদাও ‘সমাজের সাথে খাপ খাইয়ে চলার’ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অতীতে ইসলামপন্থীরা ক্ষমতা বলয় থেকে দূরে থাকলেও বর্তমানে তারা সত্যিকারের ক্ষমতার মুখোমুখি হচ্ছে।[8] তাই তাদের পলিসি ও রাজনৈতিক আচরণের সংস্কার নিছক কৌশলগত বা স্বল্পস্থায়ী ব্যাপার নাও হতে পারে। আন নাহদা ২০১৪ সালের সংসদীয় নির্বাচনের মতো সব সময় বিজয়ী হিসেবে না থাকলেও নির্দিষ্ট ভোটার, সদস্য ও শুভাকাঙ্খী থাকায় রাজনীতির মাঠে নিজেদের দৃশ্যমানতা ও প্রাধান্য বজায় থাকে। এ সময়ের মধ্যে দলটি যথেষ্ট সম্মান, মর্যাদা ও খ্যাতি অর্জন করেছে। তারা জানে সমাজের সাথে কীভাবে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়। বিপ্লবের আগে দলটি স্বৈরশাসকের সকল প্রকার নির্যাতন ও নিবর্তনমূলক আচরণের শিকার হয়েছিল। এখন দলটির রাজনৈতিক ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটেছে। এর ফলে তারা বৈধভাবে কর্মকাণ্ড চালানো, রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্বীকৃতি লাভ, আইনী গ্রহণযোগ্যতাসহ যৌথভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ অর্জন করেছে।

রাজনৈতিক ময়দানের একটি পক্ষ হিসেবে আন নাহদা এখন ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতা, কার্যকর রাজনৈতিক কৌশল এবং সক্রিয় পাবলিক পলিসি প্লাটফর্ম তৈরির মাধ্যমে নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধি নিয়ে ব্যস্ত। মতামর্শ তাদের গাইডিং ফোর্স হিসেবেই এখন সীমাবদ্ধ। যদিও দলটির অনেক সদস্য এবং বিশ্বব্যাপী ইসলামপন্থী সমাজের কাছে ধর্ম ও রাজনীতির এই বিভাজন এক ধরনের ধর্মচ্যুতিমূলক ব্যাপার বলে মনে হতে পারে।

ক্ষমতার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ক্ষমতা অর্জনের জন্য কীভাবে নমনীয় ভূমিকা পালন করতে হয়, মিশরে মুসলিম ব্রাদারহুড তা দেখিয়েছে। এগুলো সমাজের সাথে খাপ খাইয়ে চলার প্রথম দিকের উদাহরণ। মূলত আরব বসন্তের পর অধিকাংশ দেশে মুসলিম ব্রাদারহুড এক ধরনের পৃথকীকরণ করতে বাধ্য হয়েছে। মিশরীয় ব্রাদারহুড ‘ফ্রিডম এন্ড জাস্টিস পার্টি’ নামে একটি দল প্রতিষ্ঠা করেছে। কেউ ব্রাদারহুডের সদস্য হোক বা না হোক, সবার জন্যই দলটিতে যোগদানের সুযোগ রাখা হয়েছে। অন্তত তাত্ত্বিকভাবে হলেও দলটি সিভিল স্টেট ও রাজনৈতিক বহুত্ববাদকে মেনে নিয়েছে।

খাপ খাইয়ে নিতে পারাটা এক ধরনের সক্ষমতা। ক্রমাগত ঠেকে ঠেকে শেখার মাধ্যমে যথাসময়ে বহুত্ববাদ, স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক উত্তরণের দাবিগুলো বুঝতে পারাটা একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। এটাই রাজনীতির কৌশল। সুস্পষ্ট বক্তব্য, আইনসম্মত ও গণতান্ত্রিক কৌশল অবলম্বন, অভিন্ন মূল্যবোধ এবং বহুদলীয় স্বার্থকে গুরুত্ব দেয়ার জন্য পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার একটা কমন জায়গা খুঁজে বের করাই হলো খাপ খাইয়ে চলার মূলকথা। এভাবেই হয়তো তিউনিশিয়ার ইসলামপন্থীরা বাস্তবিক অর্থেই ‘ইসলামী গণতন্ত্র’ (সমালোচকরা অবশ্য একে একটি পরস্পরবিরোধী ব্যাপার হিসেবে দাবি করে থাকে) প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে পারে।[9] বাস্তবতা হলো, তথাকথিত ‘আরব লিবারেলরা’ নিজেরাই বিভাজনে লিপ্ত এবং তাদের নিজেদের সংস্কার প্রক্রিয়াও খুবই মন্থর।[10] তাদের এই অবস্থা সম্ভবত ইসলামপন্থীদেরকে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকে পড়ার সুযোগ করে দেবে।

ধর্ম ও রাজনীতির পৃথকীকরণের ফলে বিভিন্ন ইস্যুতে আরো বেশি সংশ্লিষ্ট হতে পারার মাধ্যমে সমাজের সাথে খাপ খাইয়ে চলার যে নীতি, তা কি সমাজে উগ্রপন্থার জন্ম দেবে, নাকি উগ্রপন্থা রোধ করবে – এটি অবশ্য তর্কসাপেক্ষ ব্যাপার। এটা ঠিক যে, অন্যান্য অনেক আরব রাষ্ট্রের মতো তিউনিশিয়ার রাজনীতিতেও ধর্মের একটি ভূমিকা থাকার দাবিকে অগ্রাহ্য করা অসম্ভব। ইসলামপন্থার একটি শক্তিশালী স্তম্ভকে ছেড়ে দেয়াকে কেউ কেউ পিছু হঠা হিসেবে বিবেচনা করতে পারে। এমনটা হলে, এর পরিণতিতে উগ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হতে পারে।[11] যাইহোক, কাণ্ডজ্ঞান থেকেই বলা যায়, সমাজের সাথে মানিয়ে চলার এই নীতি উগ্রপন্থা নয়, বরং মধ্যপন্থার অনুসরণ ও মতাদর্শকে কম গুরুত্ব দেয়াকেই নির্দেশ করে।

‘নয়া আন নাহদা’?

যে ‘ইসলামপন্থা’ আন নাহদার অপরিহার্য ড্রকট্রিন, মৌলিক পরিচয়, সেই ইসলামপন্থাকে তারা কি পরিত্যাগ করছে? ১৯৭০ দশকের শেষ দিকে দলটি ‘ইসলামিক টেনডেন্সি মুভমেন্ট’ নামে যাত্রা শুরু করেছিল। তখন থেকে আত্মপরিচয়ের রাজনীতি, আরো স্পষ্টভাবে বললে, রাজনীতি, সমাজ ও অর্থনীতি সম্পর্কে মৌল প্রস্তাবনা হিসেবে ইসলামের ধারণাগুলোকে প্রমোট করতে থাকে। আন্দোলনটির ঘোষিত পলিসি, কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনা এবং রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা – সবকিছুই তাদের আত্মপরিচয়ের রাজনীতিকে স্পষ্ট করে তোলে।

নির্বাসন, কারাভোগ, নিষেধাজ্ঞাসহ অনেক ত্যাগের বিনিময়ে দলটিকে বর্তমান অবস্থান ও সমর্থন লাভ করতে হয়েছে। হাবিব বুরগিবা ও তার উত্তরসুরী পতিত স্বৈরশাসক জাইন আল আবেদীন বেন আলী উভয়ের শাসনামলেই দলটিকে এসব নির্যাতন সইতে হয়েছে। বেন আলীর সময়ে দলটি দেশের রাজনীতিতে অবস্থান তৈরি করে নেয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। ১৯৮০-র দশকের শেষ দিকে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দলটি ভোটারদের সমর্থন লাভের আগাম আভাসও দিয়েছে। এর প্রেক্ষিতে তৎকালীন স্বৈরশাসক রাজনৈতিক সহাবস্থানের নীতি থেকে সরে এসে দলটির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও দমনমূলক তৎপরতা শুরু করে। বেন আলীর পুলিশ বাহিনীর হাতে আন নাহদা যত নির্যাতন সয়েছে, তিউনিশিয়ার ইতিহাসে আর কোনো রাজনৈতিক দলকে এতো নির্যাতন সইতে হয়নি।

‘নয়া আন নাহদার’ তিন দিনব্যাপী ঐতিহাসিক কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। অত্যন্ত চমৎকার বিতর্ক হয়েছে সেখানে। আমি নিজে উপস্থিত থেকেও কিছু অংশ শুনেছি। মাঝেমধ্যে উত্তপ্ত বিতর্ক হলেও তা সহনশীল পর্যায়ে ছিল। এই কংগ্রেসে আন নাহদাকে একটি জাতীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে নতুন করে দাঁড় করানো হয়েছে। ইসলাম হলো ‘নয়া আন নাহদার’ প্রেরণা (frame of reference)। আর গণতন্ত্র হলো রাজনৈতিক পদ্ধতি। কংগ্রেস শেষে ‘নয়া আন নাহদা’ তাই ধর্মীয় কাজ (দাওয়াহ) ও রাজনৈতিক তৎপরতার (আস সিয়াসাহ) মধ্যে পার্থক্য বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ব্যক্ত করেছে।

একটি নতুন গণমুখী ইসলামপন্থার স্বার্থে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে গড়ে তোলা ভিশনকে ত্যাগ করতে হয়েছে। নতুন আন নাহদা একটি সিভিল স্টেট ধারণার কাছাকাছিই শুধু নয়, বরং তুরস্কের একেপি মডেলেরও কাছাকাছি এবং মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুড তথা ‘ইখওয়ানী’ মডেলকে ছাড়িয়ে গেছে। উল্লেখ্য, একেপি রাজনীতির ক্ষেত্রে মতাদর্শকে ন্যূনতম মাত্রায় বিবেচনায় রাখে। আর ঐতিহাসিকভাবেই ব্রাদারহুডের আকাঙ্খা হলো রাজনীতিকে ইসলামীকরণ করা।

এ কারণেই কংগ্রেসে দলটির প্রেসিডেন্ট শায়খ রশিদ ঘানুশী একটি নতুন ডিসকোর্স তুলে ধরেন। তিনি বাজার ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উপর জোর দেন। অন্যদিকে আত্মপরিচয়ের রাজনীতি (সিয়াসাহ আল হুয়িয়্যাহ) পরিত্যাগের ঘোষণা দেন, গত ত্রিশ বছর ধরে যা তার অন্যতম মৌলিক চিন্তা ছিল।

এর পেছনে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত তিনটি বিষয় কাজ করেছে বলে আমার ধারণা।

প্রথমত, তিউনিশিয়ার মতো একটি ‘ডিপ স্টেটে’ কাজ করার উপযোগী হিসেবে আন নাহদাকে গড়ে তোলা।

তিউনিশিয়ায় এখনো বুরগিবার ফরাসীপন্থী রাজনৈতিক কাঠামোর ছাপ রয়ে গেছে। অর্থাৎ, দেশটি ঐহিত্যগতভাবে সেক্যুলার। দেশটির সমাজও সেভাবেই গড়ে ওঠেছে। সেখানকার সমাজ এক জটিল আত্মপরিচয়কে ধারণ করে আছে। তারা ইসলামকে সম্মান করলেও রাজনীতিসহ যে কোনো সামষ্টিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে অবাধ নাগরিক অংশগ্রহণ চায়। দিন শেষে আন নাহদাও বিচক্ষণতা ও দক্ষতার সাথে ব্যাপারটি খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছে। ৩৫-৪০ শতাংশ ভোটারের সমর্থনপ্রাপ্ত একটি প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তারা ‘তিউনিশীয়করণকে’ নিজেদের পরিচয়ের জন্য বেছে নিয়েছে।

দ্বিতীয়ত, দলের মাঝে পেশাদারিত্ব আনা।

যে কোনো দূরদর্শী রাজনৈতিক দলের জন্যই এটি প্রযোজ্য। তাই ধর্ম ও রাজনীতির পৃথকীকরণ ঘটিয়ে গৃহীত নতুন পরিচয় রক্ষার মাধ্যমে আন নাহদা একটি পরিপূর্ণ গণমুখী রাজনৈতিক দল হয়ে ওঠার পথে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ পার করছে। কংগ্রেসে উত্থাপিত সকল সংশোধনী পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে গৃহীত হয়েছে। এ থেকে বুঝা যায়, কংগ্রেসের আগে টানা কয়েক মাস ধরে দলের অভ্যন্তরে চলা বিতর্কগুলোর ফলাফল সংস্কারপন্থীদের পুরোপুরি অনুকূলে এসেছে। এই সংশোধনীতে শুরা কাউন্সিলকে আরো বেশি ক্ষমতা প্রদানের বিষয়টিও রয়েছে। প্রসঙ্গত, শুরা কাউন্সিলের ১০০ জন সদস্য কনফারেন্সেই সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন। এরা আরো ৫০ জনকে মনোনীত করেন। আন নাহদার নেতৃত্বে গঠিত ত্রিপক্ষীয় সরকার ২০১৪ সালের শুরুতে দেশকে একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান উপহার দিয়েছিল। এই অভিজ্ঞতা দলটিকে অত্যন্ত মূল্যবান সক্ষমতা এনে দিয়েছে, যা আত্মপোলব্ধি, সংস্কার ও পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে তারা কাজে লাগিয়েছে।

তৃতীয়ত, ‘বিভাজনের’ হাত ধরে গণতন্ত্রায়ণ।

যে কোনো অভিজ্ঞ রাজনৈতিক দলের এটি একটি দারুণ বৈশিষ্ট্য। গত ২২ মে সকালে আন নাহদার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি চমকপ্রদ বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে তিনজন নেতা সেদিন বিতর্কমঞ্চে আসেন। দলকে কীভাবে সংগঠিত করা, নেতৃত্ব দেয়া ও পরিচালনা করা উচিত – সে ব্যাপারে তারা প্রত্যেকে নিজ নিজ মতামতের পক্ষে নানা যুক্তিতর্ক তুলে ধরেন (এরচেয়ে বিস্তারিত জানানোর সুযোগ আমার নেই)। বিপ্লবের আগে এ রকম কোনো কিছু অকল্পনীয় ছিল। আন নাহদার এ ধরনের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র চর্চা এক প্রকার দলীয় কোন্দলের জন্ম দিয়েছে। দলের নীতিনির্ধারকদের হাতে থাকা বিপুল ক্ষমতার লাগাম টেনে ধরতে এ ধরনের মতবিরোধ সময়ের ব্যবধানে কাজে লাগে। আরব বিশ্বের সেক্যুলার দলগুলোর মতোই ইসলামপন্থী দলগুলোও দলীয় কাঠামোর গণতান্ত্রিক পরিবর্তন এবং অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র চর্চাকে ঠেকিয়ে রাখতে চায়। এই দৃষ্টিতে, বিভাজনকে অবশ্যই গণতন্ত্রয়ানের ক্ষেত্রে ­– অন্তত দীর্ঘমেয়াদে হলেও – একটি পদক্ষেপ হিসেবে দেখা উচিত।

হাসান আল বান্নার ইসলামপন্থার পরিসমাপ্তি?

আরব বসন্তের পর রাজনৈতিক ইসলাম তথা ইসলামী আন্দোলনের অচলাবস্থা, সংকট ও ভাঙ্গনের যে ছায়া দেখা যাচ্ছে, এর জন্য দৃশ্যত কোন কারণটি সবচেয়ে বড় বলে মনে হয়? সেটা হলো ‘ইসলামিক প্রজেক্ট’ নিয়ে এক ধরনের কনফিউশন। হাসান আল বান্নার সময় থেকেই এই কনফিউশন ছিল। মুসলিম ব্রাদারহুড নামে বান্না (১৯৪৯ সালে আততায়ীর হাতে নিহত) সামাজিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক আদর্শসম্পন্ন সংগঠনের একটি মডেল প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলেন। যাইহোক, মিশর থেকে শুরু করে করে তিউনিশিয়া পর্যন্ত এই কনফিউশনই পরিলক্ষিত হচ্ছে।

নৈতিক দৃষ্টিতে, আদর্শবাদীদের আশার আলো এখনো ফিকে হয়ে যায়নি। এখনো লক্ষ লক্ষ প্রান্তিক মানুষের জীবনে তা আলো ছড়াচ্ছে। বান্না এবং তার পরবর্তী সময়ে সাইয়েদ কুতুব (বিখ্যাত মিশরীয় তাত্ত্বিক ও স্কলার, ১৯৬৬ সালে জামাল নাসের তাকে ফাঁসি দেন) থেকে শুরু করে মাওলানা আবুল আলা মওদূদী (ইন্দো-পাক বংশোদ্ভূত শীর্ষস্থানীয় স্কলার, মৃত্যু: ১৯৭৯) পর্যন্ত সমমনা উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বগণ ‘ইসলামী শাসনব্যবস্থার’ সমর্থনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তাদের দৃষ্টিতে ইসলাম এমন একটি ব্যাপার, যা অতীত উপনিবেশের অধীন মানুষের কণ্ঠস্বরই শুধু নয়; দমনপীড়ন, পাশ্চাত্যকরণ, সেক্যুলারাইজেশন ও নৈতিক অবক্ষয় মোকাবেলার উপায়ও বটে। রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি ও নৈতিকতার ইঙ্গ-মার্কিন মডেলের সমাপ্তি ঘটানোর উপায়ও ইসলাম।

সাইয়েদ আবুল হাসান নদভীর বিখ্যাত ‘ইসলাম ও বিশ্ব’[12] বইয়ের জন্য লিখিত ছোট্ট কিন্তু অসাধারণ ভূমিকায় সাইয়েদ কুতুব ইসলাম সম্পর্কে লেখকের এই চিন্তাকে সমর্থন করেছেন – ইসলাম হলো ‘কুসংস্কার’, ‘দাসত্ব’ এবং ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ‘জুলুমবাজি’ থেকে মুক্তির উপায়। সাইয়েদ কুতুবের বক্তব্য হচ্ছে, বিশ্বাস, জ্ঞান, ভ্রাতৃত্ববোধ, ন্যায় এবং আত্মবিশ্বাসের আলো ছড়িয়ে ইসলাম মানুষের জীবনকে মহিমান্বিত করে তোলে। এগুলো হচ্ছে সেই জীবনসঞ্চারী মূল্যবোধ, যা একটি ‘ন্যায়সংগত, সুষম ও ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠা করার জন্য মানুষের অন্তনির্হিত সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।[13]

একটি ‘ন্যায়’ ও ‘ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যাওয়াই ইসলামের চূড়ান্ত লক্ষ্য। সামাজিক ন্যায়বিচারের মতো ন্যায় ও ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থাই কেবল আল্লাহ ও মানুষ, দুনিয়া ও পরকাল, মুসলিম ও অমুসলিম, সমাজ ও ব্যক্তি, তত্ত্ব ও বাস্তবতা প্রভৃতি আপাত দ্বান্দ্বিক সমস্যার সমাধান করতে পারে।

সাইয়েদ কুতুব তার উপরোক্ত কথাগুলো শুধু ধর্ম ও রাষ্ট্রব্যবস্থা (দ্বীন ওয়া দাওলাহ) হিসেবে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বের প্রসঙ্গেই বলেননি। বরং কোনো বিষয়ে গুরুত্বারোপ করতে গিয়ে কিংবা দুনিয়াবী নেতৃত্ব প্রসঙ্গেও তিনি এই কথার বাইরে যাননি। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, যেহেতু ইসলাম ‘স্বকীয় বিশেষ বৈশিষ্ট্যের আলোকে জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের কথা বলে, তাই এগুলোর মধ্যে ‘কল্যাণ’ রয়েছে।[14] অন্যদের অনুসারণ নয়, বরং মুসলিমদের নেতৃত্বের মাধ্যমেই একটি ন্যায় ও ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ বা রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে – এ ব্যাপারে তার মনে কোনো সন্দেহ ছিল না। নেতৃত্বকে ইসলামের একটি সহজাত ব্যাপার হিসেবেই তিনি বিবেচনা করেছেন। তিনি বরং জোর দিয়ে আরো বলেছেন, যখন কোনো দায়িত্ব (তথা নেতৃত্ব) কাঁধে থাকে, তখনই কেবল ইসলামের স্পিরিট ‘যাচাই’ ও ‘পরীক্ষা’ করা যায়। তার মতে, ইসলাম শুরু থেকেই এভাবে ‘মানুষের জীবনের নেতৃত্ব দিতে এসেছে। অধীনস্ত হয়ে থাকা ইসলামের পক্ষে অসম্ভব।’[15]

তবে এই পরিস্থিতি বোধহয় এখন আর নেই। মুসলমানরা এখন আন্তর্জাতিক অর্থব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত। তারা এমন এক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সাথে যুক্ত, যা তাদের হাতে গড়া নয়। ইদানিং তারা ধর্ম ও রাজনীতির পৃথকীকরণের দৃষ্টিভঙ্গিকে গ্রহণ করে নিচ্ছে। সব মিলিয়ে ‘অনুগামী’ না হয়ে আর উপায় থাকছে না।

‘পাশ্চাত্যের’ সাথে মতাদর্শিক দূরত্ব, ঔপনিবেশিক দখলদারিত্ব, মুসলিম আত্মপরিচয়সহ যেসব ইস্যু সাইয়েদ কুতুবের চিন্তাজগতকে আজ থেকে অর্ধশতক আগে প্রভাবিত করেছিল,[16] বর্তমানকালের ইসলামপন্থী তাত্ত্বিকদের বিবেচনায় সেগুলো আর তত বড় বিষয় বলে মনে হচ্ছে না। সাইয়েদ কুতুব পুঁজিবাদ ও কমিউনিজম দুটোকেই ইসলামের তুলনায় নিম্নমানের মনে করতেন।[17] তার মতে, এ দুটোই বস্তুবাদ থেকে উদ্ভূত। তাই এ দুটির কোনোটি (যেমন– কমিউনিজম) ন্যায়বিচারকে প্রাধান্য দিয়ে থাকলেও যাবতীয় আধ্যাত্মিক ব্যাপারকে পুরোপুরি বাতিল করে দেয়।

এমতাবস্থায় সহজাত পরিবর্তনের অংশ হিসেবে ইসলামপন্থা এখন বিরোধিতা ও সমঝোতা, গ্রহণ ও বর্জনের মাঝে এক ধরনের ভারসাম্য বজায় রেখে চলছে। ইসলামপন্থা স্থান ও কালের দাবি পূরণ করছে। যেমন–

১. আত্মসচেতনতা বৃদ্ধি ও ঔপনিবেশিকতাবাদ মোকাবেলার জন্য গঠনমূলক নৈতিকতা অর্জনের একটি উপায় হিসেবে ইসলামকে কাজে লাগানো হয়েছিল।

২. একসময় সেক্যুলার রাজনীতিতে অংশগ্রহণকে একপ্রকার ‘ধর্মদ্রোহিতা’ হিসেবে মনে করা হতো। তাই ইসলামপন্থা ছিল সেক্যুলারাইজেশন মোকাবেলার একটি মাধ্যম।

৩. জাতীয়তাবাদী-সেক্যুলার অভিজাত শ্রেণী ও রাষ্ট্রের সাথে মতবিরোধ প্রসঙ্গে ইসলামের পুনর্জাগরণবাদী (সাহওয়াহ ইসলামিয়্যাহ) আন্দোলনগুলো আত্মপরিচয়ের প্রশ্নকে প্রধান ইস্যু আকারে উপস্থাপন করে।

৪. রাষ্ট্র, সমাজ, নৈতিকতা ও জ্ঞানের ইসলামীকরণ – পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত এই বিষয়গুলোর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ইসলামপন্থার একটি নতুন রূপ দাঁড়িয়েছে, কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে (মিশরে ব্রাদারহুড ও মরক্কোতে পিজেডি এটি করেছে) এবং শুরাকে গণতন্ত্রের সাথে তুলনা করে সেক্যুলার রাষ্ট্রে এনগেজ হওয়াকে সমর্থন করা হচ্ছে।

৫. ইসলামপন্থা ও বিপ্লব হাতে হাত ধরে এগিয়ে চলছে, এবং ইসলামপন্থী প্রতিরোধ আন্দোলনের উত্থান ঘটেছে।

৬. ওহাবী সালাফীদের বিস্তৃতির ফলে মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র ইসলামের আক্ষরিক ব্যাখ্যা ছড়িয়ে পড়ছে।

৭. সালাফীদের মধ্যে বিভাজন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ও চরমপন্থী সালাফিজমের উত্থান ঘটছে।

৮. মিশর, জর্ডান, সুদান প্রভৃতি দেশের মধ্যপন্থী ইসলামপন্থার মাঝে বিভাজন ঘটছে। ফলে ইতোপূর্বে বাতিল করে দেয়া অবস্থানকে (যেমন– ধর্ম ও রাজনীতির পৃথকীকরণ) গ্রহণ করে নিয়ে ইসলামপন্থার ‘যৌক্তিকীকরণ’ করা হচ্ছে।

রাজনৈতিক ইসলাম ও মতাদর্শের কী পরিসমাপ্তি ঘটছে?

‘পরিবর্তনের ডামাডোলে রাজনৈতিক ইসলামের সমাপ্তি ঘটেছে’ কথাটি এখনো দৃঢ়তার সাথে বলা যাচ্ছে না। কারণ, সবার আগে কে কীভাবে রাজনৈতিক ইসলামকে সংজ্ঞায়িত করছে, তার উপর এটি নির্ভর করছে। বর্তমান অবস্থায় একজন গোড়া আদর্শবাদী ব্যক্তি নিশ্চিতভাবেই মনে করবে, রাজনৈতিক ইসলামের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। কিন্তু আদর্শ ও এর চর্চার ক্ষেত্রে মধ্যপন্থী কেউ এমনটি মনে করবে না। সকল ঘরানা থেকেই ইসলামপন্থীরা ওঠে আসছে। তারা কেউই অপরিবর্তনীয় অবস্থানে নেই। তারা এককেন্দ্রিকও নয়।

আমি নিজে একজন তিউনিশীয় হিসেবে এক নয়া গণতান্ত্রিক রাজনীতির একনিষ্ঠ সমর্থক। যদিও আমি বুরগিবা প্রবর্তিত সেক্যুলারিজমের অব্যাহত উপস্থিতিকে অস্বীকার করি না। কারণ, এর প্রভাব এখনো বিদ্যমান। সেটাই এখন তিউনিশিয়াকে নতুন করে গড়ে তুলছে, এমনকি তিউনিশিয়ার ইসলামপন্থীদেরকেও।

অনেক তিউনিশীয়, এমনকি আন নাহদার সদস্য ও সমর্থকদের অনেকের মনেই একটি প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে: তবে কি বুরগিবাই সঠিক ছিলেন? আন নাহদাকে এই প্রশ্নটি বিবেচনায় নিতে হবে। এটা ঠিক যে, অসংখ্য নির্যাতন, শাহাদাত, নির্বাসন ও নানা ধরনের বিয়োগান্তক দুঃখ-কষ্ট সওয়ার পর এই ইস্যুতে সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থান গ্রহণ করা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। এতো ত্যাগ কী তাহলে  বৃথা গেল? ইসলাম ও রাজনীতির সহাবস্থানকে একটি স্বাভাবিক ব্যাপার হিসেবে বিবেচনা করার যে প্রকৃত ভিশন, যা তাদের দৃঢ় আস্থা কিংবা অনিবার্যতার উৎস, তা কী আন নাহদা পরিত্যাগ করছে? যে কোনো সময়ের জন্যই এই প্রশ্নগুলো গুরুত্বপূর্ণ।

রেফারেন্স

[1] John L. Esposito & John O. Voll, Islam and Democracy (New York: Oxford University Press, 1996).

[2] Abou El Fadl, Khaled et al., Islam and the Challenge of Democracy (Princeton & Oxford: Princeton University Press, 2004).

[3] Dale Eickelman and James Piscatori, Muslim Politics (Princeton, N.J.: Princeton University Press, 1996).

[4] Avi Max Spiegel, Young Islam: The New Politics of Religion in Morocco and the Arab World (Princeton, N.J.: Princeton University Press, 2015), pp. 177-178.

[5] Aaron Y. Zelin, “Tunisia: Uncovering Ansar Al-Sharia,” a policy analysis paper from The Washington Institute for Near East Policy, 25 October 2013, http://www.washingtoninstitute.org/policy-analysis/view/tunisia-uncovering-ansar-al-sharia, Retrieved: 20/02/2016.

[6] Ibid., p. 178.

[7] Rachid Khechana, “The thorns in the side of Tunisia’s young democratic process,” paper from the Aspen Institute, 25/04/2016, in: https://www.aspeninstitute.it/aspenia-online/article/thorns-side-tunisias-young-democratic-process, Retrieved: 26/05/2016.

[8] Emmanuel Sivan, “Why Radical Muslims Aren’t Taking Over Governments,” Middle East Review of International Affairs, Vol. 2, No. 2 (1998).

[9] Gudrun Krämer, “Islamist Notions of Democracy,” Middle East Report, No. 183 (1993), pp. 2-8.

[10] Jon Alterman, “The False Promise of Arab Liberals,” Policy Review (June/July 2004).

[11] Michael Georgy & Tom Perry, “Special report: As Brotherhood retreats, risks of extremism increase,” Reuters, 28 October 2013, In: www.reuters.com/article/2013/10/28/us-egypt-brotherhood-special-report-idUSBRE99R0DU20131028, Retrieved: 21/03/2015.

[12] Sayyid Qutb, “Foreword” in Sayyed Abul Hasan Ali Al-Nadwi, Islam and the World: The Rise and Decline of Muslims and its Effect on Mankind (Leicester: UK Islamic Academy), p. vii.

[13] Ibid., p. vii.

[14] Ibid.

[15] Ibid.

[16] Sayed Khatab, The Political Thought of Sayyid Qutb: The Theory of Jahiliyyah (London: Routledge, 2006).

[17] Sayyid Qutb, Al-Adalah Al-Ijtima’iyyah fi Al-Islam [Social Justice in Islam] (Cairo: Makatab Masr, 1949). See also, Sayyid Qutb, Ma’rakat Al-Islam wa Al-Ra’smaliyyah [The Battle of Islam and Capitalism] (Cairo: Dar Al-Shuruq, 1975).

লারবি সাদিকী
লারবি সাদিকী
তিউনিশীয় লেখক, রাজনীতিবিজ্ঞানী এবং কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। আরব বিশ্বের গণতন্ত্রায়ন, হিউম্যান রাইটস, ইসলামী সভ্যতা ও পাশ্চাত্যের মধ্যকার সংলাপ ইত্যাদি তাঁর লেখালেখির মূল বিষয়।

সাম্প্রতিক

এ ধরনের আরো নিবন্ধ