নারী অধিকার প্রসঙ্গে শরীয়াহর নির্দেশ বনাম নির্দেশনা

সাধারণভাবে মনে করা হয় কোরআন শরীফে স্পষ্ট ভাষায় বর্ণিত হুকুম-আহকামগুলো মুসলমানদের জন্য ফরজ হবে। কোরআনের মতো স্পষ্টভাবে বর্ণিত হাদীসও ফরজ বা ওয়াজিব হবে বলে মনে করা হয়। এক অর্থে এটি সত্য হলেও বিষয়টি ব্যাখ্যার দাবি রাখে। উভয় ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট হুকুম আহকামের অপরিহার্যতা থাকা সত্ত্বেও তা ‘নির্দেশ’ অর্থে ব্যবহৃত না হয়ে ‘নির্দেশনা’ অর্থেও আমলযোগ্য হতে পারে। এ নিবন্ধে সমসাময়িক কতিপয় বিষয়ে কোরআন ও হাদীসের সংশ্লিষ্ট সুস্পষ্ট বর্ণনাগুলোকে নির্দেশ ও নির্দেশনার পার্থক্যের আলোকে ব্যাখ্যা করে ইসলামী শরীয়াহর অন্তর্গত ভাবধারাকে অনুধাবনের চেষ্টা করা হয়েছে।

[ডাউনলোড করুন: পাওয়ারপয়েন্ট | সারসংক্ষেপ]

*****

কুরআনের আয়াতসমূহের শ্রেণীবিভাগ

সূরা আলে ইমরানের ৭নং আয়াত অনুসারে কুরআনের আয়াতসমূহ দুই শ্রেণীর। যথা: (১) আয়াতে মুহকাম বা দ্ব্যর্থহীন আয়াত এবং (২) আয়াতে মুতাশাবিহ বা দ্ব্যর্থবোধক আয়াত। উক্ত আয়াতে বলা হয়েছে যে, মুহকাম আয়াতসমূহই ‘উম্মুল কুরআন’ তথা কুরআনের ভিত্তি। অর্থাৎ মানবসমাজের অনুসরণের (হেদায়াত) জন্য পবিত্র কুরআনের দ্ব্যর্থহীন আয়াতসমূহ যথেষ্ট। বাদবাকী দ্ব্যর্থবোধক (রূপক) আয়াতগুলোর ওপর শুধুমাত্র বিশ্বাস পোষণ করাই যথেষ্ট। সেগুলোর গুঢ় তাৎপর্য অনুসন্ধান প্রচেষ্টাকে ‘ফিতনা’ বা বিপর্যয়ের কারণ হিসাবে বলা হয়েছে। কেননা উক্ত আয়াতে বর্ণিত হয়েছে যে, কুরআনের মুতাশাবিহ আয়তগুলোর প্রকৃত অর্থ আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।

নির্দেশ ও নির্দেশনা

উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে মনে হতে পারে যে, পবিত্র কুরআনের মুহকাম আয়াতসমূহ ফরয তথা অবশ্য পালনীয়। এটি সত্য হলেও ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। যেমন, কুরআনের সূরা বাকারার ৪৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তোমরা রুকুকারীদের সাথে রুকু কর’। এটি নিঃসন্দেহে একটি মুহকাম আয়াত। আয়াতের বক্তব্য অনুসারে একাকী নামাজ পড়ার কোনো বিধান থাকার কথা নয়। অথচ নারীদের একাকী নামাজ পড়ার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে এবং পুরুষদের প্রয়োজনে একাকী নামাজ পড়ার অনুমোদন দেয়া হয়েছে।

সূরা আহযাবের ৩৩ নং আয়াতে নারীদের লক্ষ করে বলা হয়েছে, ‘তোমরা গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করো’। অথচ মোহাম্মদ (সা) এবং তৎপরবর্তী খলিফাদের সময়ে নারীরা সকল কাজে অংশগ্রহণ করেছে। হযরত সাহল ইবন সাদ (রা) জনৈক নারীর বিষয়ে উল্লেখ করেন, যিনি নিজের কৃষি জমিতে গাজরের চাষ করতেন এবং এক প্রকারের খাবার তৈরি করতেন। জুমার নামাজ শেষে তিনি মসজিদে নববীর সামনে সাহাবীদেরকে তা দিয়ে আপ্যায়ন করতেন (সহীহ আল-বুখারী, ১ম খণ্ড)। এ ধরনের অন্য একটি ঘটনা সহীহ মুসলিমের প্রথম খণ্ডে হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহর (রা) সূত্রে বর্ণিত  হয়েছে। যাতে দেখা যায়, রাসূল (সা) একজন ইদ্দত পালনরত নারীকে জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করার জন্যে কৃষি কাজের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের অনুমতি দিয়েছেন।

এভাবে দেখা যায়, কুরআনের নির্দেশ মাত্রই কাঠামোগতভাবে অবশ্য পালনীয় নির্দেশ বা order নয়। আবার তা ‘নির্দেশ নয়’– এমনও নয়। বরং কুরআনের নামাজ কায়েম করো, যাকাত আদায় করো ইত্যাদি ধরনের নির্দেশসমূহ প্রত্যক্ষভাবে ও পূর্ণ আঙ্গিকে পালনীয়। অপরদিকে ‘তোমরা রুকুকারীদের সাথে রুকু করো’ এবং এ ধরনের বাহ্যত নির্দেশমূলক কিছু কিছু আয়াত মূলত নির্দেশনামূলক (directive)। কুরআনের কোন্ আয়াত প্রত্যক্ষ নির্দেশমূলক ও কোন্ আয়াত নির্দেশনামূলক তা নির্ণয় করার জন্য সুন্নাতে রাসূলুল্লাহকে (সা) বিবেচনা করতে হবে।

মূলনীতি ও মডেল

পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে যে, ‘আমি জ্বীন ও মানুষকে আমার ইবাদত ভিন্ন অন্য কোনো কারণে সৃষ্টি করি নাই’। সে হিসেবে একজন মুসলমান ঈমানের বিপরীত নয় এমন যে কোনো কর্মে লিপ্ত হওয়া মানেই ইবাদতে শামিল থাকা। এ দৃষ্টিতে হাদীস শরীফে প্রাকৃতিক কর্মসমূহকেও সওয়াবের কাজ বলা হয়েছে। নামাজ, রোজা, হজ্ব ইত্যাদিকে ‘হক্কুল্লাহ’ বা আল্লাহর হক্ব বলা হয়েছে। এগুলো সাধারণত ইবাদত হিসাবে পরিচিত। অন্যদিকে বৃহত্তর অর্থে ইবাদত হিসাবে গণ্য যে সমস্ত কাজ ‘হক্কুল ইবাদ’ বা সমাজ-সংশ্লিষ্ট সেগুলো ফিকাহর ভাষায় ‘মুয়ামালাত’ হিসাবে চিহ্নিত।

ইবাদতের বিষয়গুলোতে মূলনীতি বা তত্ত্ব ও কাঠামো বা মডেল– এতদুভয়ই হুবহু পালনীয়। কিন্তু মুয়ামালাতের ক্ষেত্রে মূলনীতিই মুখ্য হিসেবে বিবেচ্য। প্রস্তাবিত কাঠামো বা মডেল হলো অনুসরণীয় মূলনীতিকে ব্যাখ্যার প্রয়োজনে উপস্থাপিত। কিছু কিছু মডেলকে তৎকালীন সময়ের প্রেক্ষিতে বিবেচনা করতে হবে। ইসলামে যেসব সামাজিক বিধি-বিধানকে ফরজ করা হয়েছে তার উদ্দেশ্য হলো প্রথম মুখ্য বিবেচনা, সংশ্লিষ্ট কাজের নির্ধারিত চৌহদ্দি হলো দ্বিতীয় মুখ্য বিবেচনা। এতদুভয়ই সম্মিলিতভাবে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের মূলনীতি, তত্ত্ব বা তাত্ত্বিক কাঠামো হিসেবে বিবেচিত। মডেল বলতে আমরা যা বুঝি তা যুগোপযোগিতা সাপেক্ষে পরিবর্তনযোগ্য।

পূর্ব-নির্ধারণ বনাম বিচার বিবেচনার স্বাধীনতা

বিশ্লেষণ পদ্ধতি, বিবেচনাবোধ, চিন্তার কাঠামো, মূল্যবোধ কিম্বা স্বাধীনতার যে কোনো ধারণাই কোনো না কোনোভাবে ‘নিয়ন্ত্রিত’ কিম্বা ‘সীমায়িত’। এই অর্থে স্বাধীনতার শর্ত হলো মৌলিক কিছু ‘পূর্ব-নির্ধারণ’ (pre-determination)। যার উৎস হিসেবে কেউ ‘প্রকৃতি’কে মানুক বা ঈশ্বরকে মানুক, তাতে মূল বিষয়ের কোনো হেরফের হয় না। প্রকৃতির বিষয়গুলোকে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের মাধ্যমে যাচাই করা যায়। একইভাবে ইসলামের দিক থেকে আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক পূর্ব-নির্ধারিত বিষয়গুলোর মধ্যকার সমাজ-সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর উপযোগিতাও পর্যবেক্ষণ এবং যৌক্তিকতা দিয়ে প্রতিপাদন করা সম্ভব।

ইসলামে কিছু বিষয়কে গাইডলাইন হিসেবে ফিক্সড করে দেয়া হয়েছে। তবে মুয়ামালাতের বিষয়গুলোর প্রয়োগযোগ্যতার বিষয়ে বিচার বিবেচনার এতো বেশি প্রয়োজন রয়েছে যে, এর সাথে কথিত ‘পূর্ণ’ স্বাধীনতার কোনো ফারাক নাই। বিভিন্ন বিষয়ে মতবিরোধপূর্ণ বিষয়গুলোকে ইসলামের প্রস্তাবনা ও উপস্থাপনাগত দুর্বলতা মনে করা হলে, তা ভুল বিবেচনা হবে। এমনকি একই বিষয়কে সম্পূর্ণ বিপরীতভাবে বিবেচনা করা সত্ত্বেও উভয় সিদ্ধান্ত ও কর্মধারাই সঠিক হতে পারে। বনু কুরায়যার ঘটনা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

আল-কোরআনের হেদায়েতকে মেনে চলার বিষয়ে এতক্ষণ ধরে আলোচিত চিন্তার ধারাকে (line of thought) মাথায় রাখলে আপাত দ্বন্দ্বপূর্ণ বিষয়গুলোর সহজ সমাধান হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে এ রকম দুটি ইস্যু নিয়ে আলোচনা করা হলো:

মুসলিম নারীরা কি জিন্স প্যান্ট পরতে পারবে?

গতকাল একজন সহকর্মী বললেন, তিনি শুনেছেন- নারীরা জিন্সের প্যান্ট পরতে পারবে না। এ বিষয়ে তিনি আমার মতামত জানতে চাইলেন। উনাকে এ বিষয়ে আমি যে মতামত দিয়েছি, সংক্ষেপে তা নিম্নরূপ –

সাম্প্রদায়িকতাকে নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি ইসলাম সকল ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও জাতির পরিচয় ও নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। সে কারণে অন্য দ্বীনের অনুসারীদের ধর্মীয় বা জাতিগত পরিচয় বহন করে এমন পোশাক পরিধান করা মুসলিম জাতির জন্য নিষিদ্ধ। পুরুষের পোশাক পরা নারীদের জন্য যেমন নিষিদ্ধ তেমনি নারীদের পোশাক পরা পুরুষদের জন্য নিষিদ্ধ। কিছু পোশাক আছে যা নারী-পুরুষ উভয়ই পরিধান করে। কমন প্যাটার্নের এসব পোশাক নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই পরতে পারবে। প্রশ্ন হলো, কোন্ কোন্ পোশাক নারী ও পুরুষ জন্য কমন প্যাটার্ন?

দেশ, কাল, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, পরিবেশ ও মন-মানসিকতা ভেদে এই কমন প্যাটার্নের হেরফের হওয়াটা নিতান্তই স্বাভাবিক। তাই, পোশাক বিশেষ সম্পর্কে সাদা-কালো বাইনারিতে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলে দেয়া সম্ভব নয়। অবশ্য প্রত্যেক এলাকাতেই কিছু কিছু পোশাক একেবারেই নির্ধারিত। যেমন, বাংলাদেশে শাড়ি, পেটিকোট, ব্লাউজ নারীদের পোশাক। সালোয়ার, শেমিজ, কামিজও নারীদের পোশাক। পাজামা-পাঞ্জাবী পুরুষদের পোশাক। লুঙ্গি পুরুষদের পোশাক। দেখুন, পাজামা আর সালোয়ার শুধু নামেই পৃথক। কামিজ আর পাঞ্জাবীতেও আদতে পার্থক্য নাই। আমাদের বাঙালি সমাজে মেয়েদের জিন্সের প্যান্ট পরা যতটা বেমানান, লুংগি পরা তারচেয়ে কম বেমানান নয়। অথচ লুংগি, তাও সেলাইবিহীন, ছিল রাসূল (সা) ও তাঁর সহধর্মিণীসহ তদানীন্তন আরবদের অন্যতম কমন পোশাক।

তাহলে বুঝতেই পারছেন, জিন্সের প্যান্ট সম্পর্কে উক্ত সহকর্মীকে আমি কী বলেছি। আমার মতে, পাতলা কাপড়ের সালোয়ার পরার চেয়ে আটোসাটো নয় এমন জিন্সের প্যান্ট নারীর ইসলামসম্মত পোশাক হিসাবে ভালো (better)।

শাসনকার্যে নারীর অংশগ্রহণের বিষয়ে ইসলাম: নিষেধাজ্ঞার ব্যাখ্যা

সাধারণভাবে ধারণা করা হয় ‘ইসলামী রাষ্ট্রে’ নারীরা রাষ্ট্রপ্রধান হতে পারবে না। একটা হাদীসকে এর দলীল হিসেবে পেশ করা হয়। আজকের আলোচনা হতে বুঝা যাবে, এই প্রচলিত ধারণাটি ব্যাখ্যাসাপেক্ষ ও এক অর্থে ভুল।

বৈশিষ্ট্যগতভাবে ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ নানা ধাপের হতে পারে। উল্লেখ্য, কোনো রাষ্ট্রকে ইসলাম মোতাবেক হতে হলে নামে বা সাংবিধানিক ঘোষণায় ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ ঘোষণা থাকাটা আদৌ কোনো জরুরি শর্ত নয়। ধর্ম ও রাজনীতি ইসলামে অভিন্ন নয়, বিপরীতও নয়; বরং এক সমন্বিত ব্যবস্থার মধ্যে এ দু’টি বিষয় স্ব স্ব অবস্থানে অন্তর্ভুক্ত।

আমরা জানি, নারীদেরকে গঠনগত কারণে নামাজের জামায়াতে পেছনে অবস্থানের কথা বলা হয়েছে। সে হিসেবে ঈদ ও জুমার নামাজে ইমামতির দায়িত্ব পালনের বিষয়টি ধর্মীয় দিক থেকে কেবলমাত্র পুরুষের ওপর অর্পিত। তাই, ইসলামী মতাদর্শভিত্তিক কোনো রাষ্ট্রে রাষ্ট্রপ্রধান কর্তৃক ধর্মীয় দায়িত্ব পালনের বিষয়ে নারীর সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যদিও কোনো রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান কোনো বিশেষ দায়িত্বপালনের জন্য অন্য কাউকে ক্ষমতা অর্পণ করতে পারেন।  নারীদেরকে সাধারণত (in general) অন্তর্মুখী রাখার যে দৃষ্টিভঙ্গী ইসলামী শরিয়ায় দৃশ্যমান, প্রাকৃতিক কর্ম বিভাজনের দিকে তাকালে তা যুক্তিসংগত।  তা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে যোগ্যতা থাকা সাপেক্ষে নামাজের ইমামতি ছাড়া সকল বিষয়ে নারীদের অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বদানের অনুমোদন ইসলামে বিদ্যমান। প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারী নেতৃত্বের বিপক্ষে উপস্থাপিত কোরআনের আয়াত ও হাদীসগুলোকে আক্ষরিকভাবে অনুসরণযোগ্য নির্দেশ হিসেবে দাবি করাটা গ্রহণযোগ্য নয়। সেগুলো মূলত নির্দেশনামূলক (guidance)।

সাবার রাণী ও পারস্যের সম্রাজ্ঞী

কোরআন শরীফে ইয়েমানের দ্বীপ রাষ্ট্র সাবা’র রাণী বিলকিসের প্রসংগটি ইতিবাচক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলছেন, “বিলকিস বলল, হে পরিষদবর্গ! আমাকে আমার কাজে পরামর্শ দিন। আপনাদের উপস্থিতি ব্যতিরেকে আমি কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি না। তারা বলল, আমারা শক্তিশালী এবং কঠোর যোদ্ধা। এখন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা আপনারই। …‍‍‍‌‌‌‌‌’ পাঠক, লক্ষ করুন, সূরা নামল, সূরা সাবা ও সূরা হুদের একাধিক বর্ণনায় রাণী বিলকিসের শাসনযোগ্যতা সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা সাক্ষ্য দিচ্ছেন!

অপরদিকে তৎকালীন পারস্যবাসী বাদশাহ কিসরার মৃত্যুর পর তার কন্যাকে সিংহাসনে বসানোর প্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ (সা) বলছেন “যে জাতি তাদের শাসনকার্যে কোনো নারীকে নিযুক্ত করে, সে জাতি কখনো সফলকাম হবে না।‌‌‍‍‍’ বুখারী শরীফে উল্লেখিত এই হাদীসের ওপর ভিত্তি করে শাসনকার্যে নারীর নিযুক্তিকে হারাম বলা হচ্ছে। এমতাবস্থায় সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উক্ত নিষেধাজ্ঞামূলক হাদীসের সাথে কোরআনের অনুমোদনমূলক বর্ণনাকে সমন্বয় করতে হবে।

শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা হিসেবে রাজতন্ত্র

রাসূলুল্লাহ (সা) এর সংশ্লিষ্ট হাদীসে শাসনকার্যে নারীর নিযুক্তিকে ‘নিষিদ্ধ’ করার বিষয়টি শাসনপদ্ধতি হিসেবে রাজতন্ত্রের প্রেক্ষিতে বলা হয়েছে। রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় রাজার পুত্র রাজা হয়। এটি ব্যবস্থাটির মূল অবয়ব। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা সত্ত্বেও, বিশেষ করে তৎকালীন যুগে, রাজার পুত্রসন্তান না থাকায় রাজার সন্তান হিসেবে কন্যাকে সিংহাসনে বসানোর ঘটনাটি রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রতি তাদের দৃঢ় অঙ্গীকারের প্রমাণ। ইসলামে রাজা বা শাসকের পুত্র হওয়াকে শাসনতান্ত্রিক বৈধতার কোনো প্রকারের শর্ত বা গুণ হিসেবে স্বীকার করা হয় নাই।

তাই হতে পারে, তৎকালীন পারস্যে রাজকুমারীর ক্ষমতা গ্রহণকে রাজতান্ত্রিকতার পক্ষে একটি সুদৃঢ় ব্যবস্থা (more committed) হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। যার ফলে এই ধরনের ক্ষমতা গ্রহণকে নাকচ করার মাধ্যমে প্রচলিত মূল রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। এমন নয় যে, পারস্যবাসী একজন পুরুষকে রাজা হিসেবে গ্রহণ করলে তাদের শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা তথা রাজতন্ত্র আংশিক বা সম্পূর্ণ বা অধিকতর বৈধতা লাভ করতো। তাই পুরো ব্যাপারটিকে এই ধারায় ব্যাখ্যা ও বিবেচনা করাই সংগত।

শাসনতান্ত্রিক বৈধতা বনাম উপযুক্ততা

এরপরও কেউ যদি বাহ্যত নারীর শাসন-ক্ষমতার বৈধতার বিরোধী এই হাদীসের উপর নিঃশর্ত আমল করতে চান, তাঁকে রাণী বিলকিসের ঘটনাকে কেনো আল্লাহ তায়ালা ইতিবাচকভাবে বর্ণনা করলেন, তারও একটা গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে হবে। লক্ষ করুন, কোরআনে উল্লেখিত রাণী বিলকিসের উদাহরণ ও পারস্য সম্রাট কিসরার কন্যার ক্ষমতা গ্রহণের উদাহরণ– উভয় ক্ষেত্রেই শাসনব্যবস্থা ছিলো রাজতান্ত্রিক। রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে নাকচ করা সত্ত্বেও রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতাপ্রাপ্ত রাণী বিলকিসের শাসনযোগ্যতাকে ইতিবাচকভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ইরানী সম্রাজ্ঞীর ঘটনাকে দেখা হয়েছে শাসনতান্ত্রিক বৈধতার (legitimacy) দৃষ্টিকোণ হতে। আর সাবার রাণীর ঘটনাকে দেখা হয়েছে শাসনতান্ত্রিক উপযুক্ততার (competency) দৃষ্টিকোণ হতে।

উল্লেখ্য, ইসলামী আইনশাস্ত্র বা ফিকাহ’র মতে, ক্ষমতা গ্রহণের পদ্ধতিগত অবৈধতা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট ‘অবৈধ’ শাসক বা রাজার অপরাপর আইনসংগত কার্যাবলি বৈধ হিসাবে গণ্য হবে। এমনকি তার অধীনে জিহাদের মতো উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দিক হতে গুরুত্বপূর্ণ আমলও বৈধ হতে পারে। লক্ষ করুন, কারবালাতে অবরুদ্ধ হওয়ার পরে হযরত হুসাইন (রা) যে তিনটি বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছিলেন তার একটি ছিল, তাঁকে সীমান্ত অঞ্চলে গিয়ে জিহাদে রত হওয়ার সুযোগ দেয়া। লক্ষ করুন, ইমাম হুসাইন (রা) শাসনতান্ত্রিক বৈধতার দিক থেকে ইয়াযিদকে চ্যালেঞ্জ করলেও তার অধীনে পরিচালিত জিহাদে অংশগ্রহণকে জায়েয মনে করেছেন। সাবার রাণীর পরিষদবর্গ যোদ্ধা হিসেবে আত্মপ্রত্যয়ী হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে রাণী বিলকিস তাদের ওপর রাজত্ব করেছেন। স্পষ্টত, রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্য শারীরিক যোগ্যতাকে এখানে শর্ত করা হয়নি।

আয়িশার (রা) যুদ্ধ পরিচালনা

একই ধরনের ঘটনা আমরা হযরত আয়িশার (রা) নেতৃত্বে সংঘটিত উষ্ট্রের যুদ্ধের ক্ষেত্রে লক্ষ করি। উক্ত যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য উম্মুল মুমিনীন আয়িশা (রা) সারাজীবন অনুশোচনা করেছেন, এটি সত্য। কিন্তু এ সম্পর্কে যা বাড়িয়ে বলা হচ্ছে তা হলো, ঘরের বাহির হওয়ার জন্য, সোজা কথায় পর্দা লংঘনের মতো পরিস্থিতিতে জড়িয়ে যাওয়ার জন্য ও নারী নেতৃত্ব নিষিদ্ধ জেনেও যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য তিনি অনুশোচনা করেছেন! এসব মনগড়া ‘ওয়াজের’ পক্ষে কোনো দলীল নাই। বরং সত্যটা হচ্ছে তৎকালীন খলিফা হযরত উসমানের (রা) হত্যাকাণ্ডের মতো চরম নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতিতে তাঁর নেতৃত্বে মুসলমানদের মধ্যে একটি যুদ্ধ সংঘটিত হওয়া ও তাতে যথেষ্ট প্রাণহানি ঘটার কারণে তিনি স্বাভাবিকভাবেই ভীষণ মর্মাহত ছিলেন। হযরত আয়িশার (রা) পক্ষে ‘জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত দশজন’ (আশারায়ে মুবাশশিরা) পর্যায়ের তিনজন সাহাবীসহ হজ্বফেরত বিপুল সংখ্যক সাহাবী ছিলেন। অপরদিকে, হযরত আলীর (রা) পক্ষ হতেও নারী হিসেবে তাঁর ঘরের বাহির হওয়া ও যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়াকে অবৈধ বিবেচনা করে কোনো বক্তব্য (ফতোয়া) প্রদান করা হয়নি।

সামাজিক কর্মবিভাজন পরিকল্পনা

পুরুষ ও নারী– উভয়ের মানবিক ও আইনগত মর্যাদা সমান হওয়া সত্ত্বেও ইসলাম চেয়েছে নারীরা সামগ্রিকভাবে (overall) অন্তর্মুখী হোক। সামাজিক কর্মবিভাজন তত্ত্বের এই প্রস্তাবনার ধরন প্রাকৃতিক জগতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ (consistent with natural world)। বহির্মুখী ও মোকাবিলাধর্মী কাজে তাদেরকে সামগ্রিকভাবে নিরুৎসাহিত করা হলেও নিষিদ্ধ করা হয়নি। এই দৃশ্যত নিরুৎসাহিতকরণও ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। দেখুন, গৃহাভ্যন্তরে নামাজ আদায়কে অধিকতর সওয়াবের কাজ বলা সত্ত্বেও নারী সাহাবীরা ব্যাপকহারে মসজিদে গমন করতেন। রাসূলও (সা) তাদের মসজিদে যাওয়ার অধিকারে কোনো প্রকারের বাধা সৃষ্টি না করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেছেন। তাহলে, নাউযুবিল্লাহ, রাসূল (সা) কি পরষ্পরবিরোধী কথা বলেছেন? কিম্বা, ব্যাপক সংখ্যক মহিলা সাহাবী কি, আল্লাহ মাফ করুক, নামাজের নামে বাইরে ঘুরাফিরা করার জন্য বেপরোয়া ছিলেন? অথচ রাসূলের (সা) অনুসরণের ব্যাপারে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে তাঁর সাহাবীরাই হচ্ছেন সর্বোত্তম আদর্শ।

বাইরের কাজে নিরুৎসাহমূলক নিষেধাজ্ঞার যুক্তি

সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় কাজে নারীদের অংশগ্রহণের ‘বিপক্ষে’ কোরআন-হাদীসের যে সব সূত্রকে দলীল হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, সেগুলোর মূল বর্ণনাতেই কোনো না কোনো যুক্তি উপস্থাপন করে এক প্রকারের নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ এই নিষেধাজ্ঞা চূড়ান্ত ও শর্তহীন নয়। ফলে, যোগ্যতা থাকা সাপেক্ষে নারীদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণ তাদের সংশ্লিষ্ট সীমাবদ্ধতাগুলো বিবেচনা সাপেক্ষে অনুমোদনযোগ্য।

সূরা নিসার ৬৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে, “পুরুষেরা নারীদের ওপর কর্তৃত্বশীল। এ জন্য যে, আল্লাহ একের ওপর অন্যকে বৈশিষ্ট্য দান করেছেন এবং এ জন্য যে, তারা তাদের অর্থ ব্যয় করে”। স্পষ্টত এখানে পারিবারিক ব্যবস্থাপনার কথা বলা হয়েছে।

সূরা বাকারার ২৮২ নং আয়াতে বলা হয়েছে, “দু’জন সাক্ষী কর, তোমাদের পুরুষদের মধ্য থেকে। যদি দু’জন পুরুষ না হয়, তবে একজন পুরুষ ও দু’জন মহিলা। ঐ সাক্ষীদের মধ্য থেকে যাদেরকে তোমরা পছন্দ কর– যাতে একজন যদি ভুলে যায়, তবে একজন অন্যজনকে স্মরণ করিয়ে দেয়”। মৃত্যুদণ্ডের শাস্তিযোগ্য ফৌজদারী অপরাধের ক্ষেত্রে একাধিক নারী সাক্ষী থাকা যেখানে সম্ভব সেখানকার জন্য এটি প্রযোজ্য। এখানে দু’জন নারী সাক্ষীকে একজন পুরুষ সাক্ষীর সমতুল্য বিবেচনার কারণ আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে। এই দৃষ্টিতে আয়াতটি স্ব-ব্যাখ্যাত (self-explanatory)।

নারী বিচারক নিয়োগের বিষয়ে ফকীহদের মতবিরোধ

আমাদের স্মরণে রাখতে হবে, এসব নিষেধাজ্ঞামূলক আয়াত ও হাদীসের ব্যাখ্যা নিয়ে ইমামগণের মধ্যে ব্যাপক মতপার্থক্য হয়েছে। যেমন, বিচারক নিয়োগের জন্য ইমাম মালিক, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম আহমদ পুরুষ হওয়াকে শর্ত হিসেবে উল্লেখ করলেও ইমাম আবু হানীফা হদ্দ ও কিসাস ব্যতীত সব ধরনের বিচারকার্যে নারীদের দায়িত্ব প্রদান বৈধ বলেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি সাবার রাণী বিলকিসের ঘটনাকে দলিল হিসাবে বিবেচনা করেছেন। ইমাম ইবনু হাযম আয-যাহিরীর মতে, হুদুদ ও কিসাসসহ সাধারণভাবে সকল বিষয়ে মহিলাদেরকে বিচারক নিযুক্ত করা বৈধ।

কঠোরতাকে বর্জন করে সহজতরকে গ্রহণ করা

কোনো বিষয়ে মতবিরোধের ক্ষেত্রে সাধারণ মুসলমানদের জন্য সহজতর ফতোয়াকে অনুসরণ করার সুযোগ থাকা উচিত। কারণ আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,

“আল্লাহ চান তোমাদের জন্য সহজ করতে, আল্লাহ চান না তোমাদের জন্য কঠিন করতে”। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘সহজ করো, কঠিন করো না; সুসংবাদ দাও, ঘৃণা সৃষ্টি করো না’।

হযরত আয়িশা (রা) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) সব সময়ে সহজতর বিকল্পকেই (option) গ্রহণ করতেন। ইতোমধ্যেই বলা হয়েছে, রাসূলের (সা) অনুসরণের ব্যাপারে তাঁর সাহাবীরাই হচ্ছেন সর্বোত্তম আদর্শ। নারীদের গৃহাভ্যন্তরে অবস্থানই যদি আদর্শ হয় তাহলে হযরত উমর (রা) কর্তৃক আশ-শিফা নামক এক মহিলাকে বাজার তদারকির (market supervisor) দায়িত্ব প্রদানের ব্যাখ্যা কী হতে পারে?

সামাজিক নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা

ইতোমধ্যেই বলা হয়েছে, গঠনগত প্রাকৃতিক অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যতাভিত্তিক সামাজিক কর্ম বিভাজনের নিরিখে নারীদের মোটের-উপরে (grossly) অন্তর্মুখী থাকাটাই ইসলামের প্রাধান্যনীতি। এ কারণে সামগ্রিকভাবে (holistically) সমাজের চাকায় ইসলামী শরিয়ত কিছু নিয়ন্ত্রণমূলক নিরাপত্তা ব্যবস্থা সংযোজন করেছে। উত্তরাধিকার বন্টনের কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমানাধিকার না থাকাসহ উপরে উল্লেখিত বিষয়াদিকে এরই আলোকে বুঝতে হবে। বলাবাহুল্য, এসব ‘নিয়ন্ত্রণমূলক’ ব্যবস্থাকে নির্দেশ হিসেবে নয়, বরং নির্দেশনা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। যেমন, একজন নারী উত্তরাধিকার বন্টনের যে সব ক্ষেত্রে পুরুষের অর্ধেক পাবেন, তা শুধুমাত্র প্রাপ্যতা দাবির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ভাই চাইলেও বোনকে সমান বা বেশি বা পুরোটা দিতে পারবে না, এমনটা নয়। বেশি দেওয়াটা বরং ‘মারুফ’ (better) হিসাবে উৎসাহিত করা হয়েছে।

নেতৃত্বের মানদণ্ড

কোরআন ও হাদীসের নির্দেশ ও নির্দেশনার পার্থক্য বুঝার জন্য আমরা দাসের শাসক হওয়া ও কুরাইশদের মধ্য হতে নেতৃত্ব বাছাই সংক্রান্ত হাদীসগুলোর সহযোগিতা নিতে পারি। সহীহ হাদীসে বলা হয়েছে যে, নাক কাটা হাবশী দাসকেও যদি তোমাদের আমীর করা হয়, তাঁকেও পূর্ণ আনুগত্য করতে হবে। আযাদকৃত বা পূর্বতন দাসদের নানাবিধ নেতৃত্বের উদাহরণ আমরা ইসলামের প্রাথমিক যুগে দেখলেও কোনো দাসের পক্ষে আমীর হওয়া সম্ভব ছিল না। কারণ, সে মালিকের হুকুমের অধীন। আনুগত্যের ওপর গুরুত্বারোপের দৃষ্টিতে না দেখলে এই হাদীসকে সমন্বয় করা সম্ভব নয়।

অপর এক হাদীসে বলা হয়েছে, তোমরা কুরাইশদের মধ্য থেকে নেতৃত্বকে গ্রহণ করো। এর মাধ্যমে নেতৃত্বের তৎকালীন সর্বজন স্বীকৃত মানকে (standard) বুঝানো (mean) হয়েছে। এই হাদীসকেও আক্ষরিক নির্দেশ অর্থে বুঝার সুযোগ নাই। কেননা, আমরা জানি, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রকৃত যোগ্যতার অতিরিক্ত কোনো প্রকারের বংশগত, গোত্রীয় বা জাতিগত বৈশিষ্ট্যকে ইসলাম আদৌ কোনো ‘যোগ্যতা’ হিসাবে গণ্য করে না। বরং এ ধরনের কৌলিন্য বিবেচনাকে জাহেলিয়াত (অজ্ঞতাসুলভ) মনে করা হয়।

বাহ্যিক অর্থ বনাম নির্দেশিত অর্থ

সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কাউকে বুঝাতে ব্যর্থ হলে বিস্ময় প্রকাশ ও বিষয়টির গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য আমরা সাধারণত এভাবে কথা বলি, ‘এ কথা পাগলেও বুঝে’ বা ‘বিষয়টা এতো সহজ যে, একটা শিশুও বুঝে’। যদিও আমরা জানি, যে আদৌ বুঝে না তাকে পাগল বলে। কিম্বা একটা শিশু কখনোই বুঝবে না। এ ধরনের বাগধারাগুলোকে বাহ্যিক গঠনে (syntax) প্রকাশিত অর্থের পরিবর্তে নির্দেশিত গুঢ়ার্থে (semantic) বুঝতে হবে। নির্দেশ ও নির্দেশনার এই পার্থক্যকে খেয়াল রাখলে ‘আপাত সাংঘর্ষিক’ অনেক বিষয় ইসলামের দিক থেকে বুঝতে পারা আমাদের জন্য সহজ হয়ে যাবে।

‘ইসলাম ও নারী’

এই প্রবন্ধে নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়ে ইসলামের অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয় নাই। এটি ধরে নেয়া হয়েছে যে, বিজ্ঞ পাঠক এ সম্পর্কে মোটামুটি ওয়াকিবহাল। শুধুমাত্র কয়েকটি বিষয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ‘নারী অধিকার বিরোধী’ ইসলামপন্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেই আলোচনার এই পর্বটি সমাপ্ত করছি। জিহাদের দায়িত্বপালনের অপরিহার্যতা থেকে গঠনগত কারণে নারীদের অব্যাহতি দেয়া সত্ত্বেও ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও অন্যায় প্রতিরোধের যে ফরজিয়াত (অপরিহার্যতা) তা কি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের ওপর সমভাবে প্রযোজ্য নয়? ‘ইসলামের দৃষ্টিতে নারী’ – এ ধরনের শিরোনামের আলাপ-আলোচনা এক ধরনের লৈঙ্গিক সংবেদনশীলতার (gender sensitivity) কারণে ইসলামের দিক থেকে অনাকাংখিত বটে। এ জাতীয় শিরোনামের আলোচনাগুলোকে ‘পুরুষদের ইসলামে’ নারীদের জন্য অনুমোদনযোগ্য space-এর ‘পর্যাপ্ততা’ নিয়ে সান্তনামূলক কথাবার্তা হিসেবে মনে করার সুযোগ রয়েছে। অবশ্য ঐতিহাসিকভাবে তৎকালীন আরব সমাজ তো বটেই, বর্তমানেও নারী-বিরূপ সামাজিক অসঙ্গতিসমূহকে তুলে ধরতে গিয়ে ‘ইসলামে নারীর অধিকার’ ধরনের আলোচনাগুলো গ্রহণযোগ্য বা প্রাসঙ্গিক হতে পারে।

‘হে মানব জাতি, তোমাদের রবকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে একজন মানুষ থেকে সৃষ্টি করেছেন, তা থেকেই তার জোড়া সৃষ্টি করেছেন এবং এ দুজন থেকে বহু পুরুষ ও নারী দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছেন। ওই আল্লাহকে ভয় কর, যার দোহাই দিয়ে তোমরা একে অপর থেকে নিজেদের অধিকার দাবি করে থাক। নিশ্চিত জেনে রাখ, আল্লাহ তোমাদের ওপর সার্বক্ষণিক দৃষ্টি রাখেন’।

সূরা নিসার প্রথম এই আয়াতটি স্মরণে রাখলে বক্ষমান প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয়ের সহজতর অনুধাবন ও সঠিক বিশ্লেষণ সম্ভবপর হতে পারে।

এ ধরনের আরো লেখা