'রিক্লেইমিং দ্যা মস্ক' বইয়ের ধারাবাহিক অনুবাদ: পর্ব-৪

মসজিদ ও নারী প্রসঙ্গে সুন্নাহর বক্তব্য কী?

রাসূলের (সা) যুগে বিভিন্ন উপলক্ষ্যে মসজিদে পুরুষদের পাশাপাশি নারীদেরও স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি থাকতো। মহানবীর (সা) সুন্নাহ থেকে এ সম্পর্কিত শতাধিক বর্ণনা পাওয়া যায়। উদাহরণ হিসেবে এখানে মাত্র কয়েকটি বর্ণনা তুলে ধরছি।

একটি কাহিনী দিয়ে শুরু করা যাক। আয়েশার (রা) সূত্রে ইমাম বুখারী এটি বর্ণনা করেছেন। এক আফ্রিকান দাসীর ঘটনা। আরবের একটি গোত্র তাকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছিলো। তারপর ওই নারীকে মসজিদে নববীর ভেতর একটি তাঁবুতে থাকতে দেওয়া হয়। ঘটনাটির তাৎপর্য সহজে বুঝার স্বার্থে পুরো বর্ণনাটি এখানে উদ্ধৃত করছি। আফ্রিকান তরুণীটি বলেন:[1]

“আমি যে গোত্রের দাসী ছিলাম, সেই গোত্রের একটি বাচ্চা মেয়ে মূল্যবান পাথর খচিত একটি লাল চামড়ার স্কার্ফ পরে বাইরে গিয়েছিলো। তারপর সে স্কার্ফটি হয় ভুলে কোথাও রেখেছিলো, নয়তো কোথাও পরে গিয়েছিলো। ওই সময় একটি পাখি সেখান দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলো। মাটিতে স্কার্ফটি দেখে পাখিটি একে গোশতের টুকরা মনে করে ছোঁ মেরে নিয়ে উড়ে চলে যায়। বাচ্চাটির পরিবার স্কার্ফটি খুঁজতে লাগলো। কিন্তু কোথাও না পেয়ে তারা আমাকে চুরির দায়ে অভিযুক্ত করলো। তারপর অশোভনভাবে তারা আমার দেহে তল্লাশী শুরু করলো। তারা এমনকি আমার স্পর্শকাতর স্থানগুলোতেও খুঁজেছে। আল্লাহর কী রহমত! তারা যখন তল্লাশী চালাচ্ছিলো, ঠিক তখনই ওই পাখিটি ফিরে এসে লাল স্কার্ফটি তাদের সামনে ফেলে দিলো। তখন আমি তাদেরকে বললাম, এই তো সেই স্কার্ফ! এর জন্যই তো তোমরা আমাকে দোষ দিচ্ছিলে, অথচ আমি ছিলাম সম্পূর্ণ নির্দোষ।”

আয়েশা (রা) আরো বলেন,

“এ ঘটনার পর ওই পরিবার তরুণীটিকে মুক্ত করে দিলো এবং সাথে সাথেই সে রাসূলের (সা) কাছে এসে ইসলাম গ্রহণ করলো। তারপর মসজিদে নববীর ভেতর নিচু ছাউনি দিয়ে একটি তাঁবু তৈরি করে সেখানেই থাকতে লাগলো। সে আমার কাছে মাঝেমধ্যে আসতো, কথাবার্তা বলতো। প্রত্যেকবারই কথাবার্তার শুরুতে সে নিম্নোক্ত কবিতাটি আমাকে শোনাতো:

‌‘স্কার্ফ হারানোর দিনটি ছিলো আমার রবের আশ্চর্য এক দিন
কাফেরদের হাত থেকে তিনি আমায় মুক্তি দিলেন যেদিন।’”

আয়েশা (রা) বলেন,

“একদিন আমি তার কাছে এই কবিতার পেছনের কাহিনী জানতে চাইলাম। তখন সে আমাকে পুরো ঘটনা খুলে বললো।”

এই ঘটনায় আমরা দেখতে পাচ্ছি, একজন তরুণীর জন্য রাসূলের (সা) সাথে দেখা করা ও কথা বলা কতটা সহজ ও স্বাভাবিক ছিলো। এমনকি কোথাও আশ্রয় না পেলে মসজিদে থাকতেও কারো কোনো অসুবিধা ছিলো না। যাহোক, এই হাদীসের উপর ভিত্তি করে আন্দালুসীয় স্কলার ইবনে হাযম মতামত দিয়েছেন, ঋতুস্রাবের সময়ও নারীদের মসজিদে যেতে কোনো অসুবিধা নেই। এ বিষয়ে পরে আরো বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

মসজিদে নববীতে নারীদের যাতায়াত সংক্রান্ত আরো কিছু হাদীস তুলে ধরা হলো—

আয়েশা (রা) বলেন, “সাদ ইবনে মুয়াজ (রা) খন্দকের যুদ্ধে আহত হয়েছিলেন। … তারপর রাসূল (সা) তাঁর জন্য মসজিদের ভেতর একটা তাঁবু তৈরি করলেন, যাতে তিনি সাদকে (রা) নিয়মিত দেখতে পারেন।”[2]

এই হাদীসটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইবনে হাজার বলেছেন,

“প্রকৃতপক্ষে রাসূল (সা) মসজিদের ভেতর রুফাইদার (রা) তাঁবুতে সাদকে (রা) রাখেন। আহতদের চিকিৎসায় দক্ষতার জন্য রুফাইদা (রা) পরিচিত ছিলেন। তাই রাসূল (সা) বলেছেন— “সাদকে রুফাইদার তাঁবুতে রাখো, যাতে আমি কাছ থেকে তাকে দেখতে পারি।”[3]

রুফাইদা (রা) ছিলেন একজন নারী সাহাবী ও চিকিৎসক। মসজিদে নববীতে তিনি একটি তাঁবু স্থাপন করেছিলেন। এই তাঁবুটি ইসলামের ইতিহাসের সর্বপ্রথম ইমার্জেন্সি ক্লিনিক বা জরুরি হাসপাতাল হিসাবে পরিচিত।

ইমাম মুসলিমের বর্ণনা মতে আশ-শাবী বলেন,

“আমরা ফাতিমা বিনতে কায়েসের কাছে গেলাম। ফাতিমা বললেন, যখন লোকদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা দেওয়া হলো— নামাযের জন্য একত্রিত হয়ে যাও, তখন অন্যদের সাথে আমিও মসজিদে নববীতে উপস্থিত হলাম। এরপর নারীদের জন্য নির্ধারিত সামনের কাতারে দাঁড়ালাম, যা ছিলো পুরুষদের সর্বশেষ কাতারের ঠিক পেছনেই। নামায শেষে মহানবীকে (সা) মিম্বরে বসে বলতে শুনলাম— ‘তামীম দারীর জ্ঞাতি ভাই সমুদ্রে নৌযাত্রা…।’”[4]

ইমাম বুখারীর বর্ণনা মতে আসমা বিনতে আবু বকর (রা) বলেছেন,

“আমি একবার রাসূলের (সা) স্ত্রী আয়েশার (রা) কাছে এসেছিলাম। তখন সূর্যগ্রহণ চলছিলো। আমি দেখলাম, সব মানুষ নামাযে দাঁড়িয়ে আছে। আয়েশাও (রা) নামায পড়ছিলেন। আমি বললাম, লোকদের কী হয়েছে? তিনি আকাশের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, সুবহানাল্লাহ! আমি বললাম, এটা কি কোনো আলামত? তিনি হ্যাঁ সূচক ইঙ্গিত করলেন। তারপর আমি নামাযে দাঁড়িয়ে গেলাম। … নামায শেষ করে রাসূলুল্লাহ (সা) সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি হামদ ও সানা পাঠ করলেন।”[5]

আসমা বিনতে আবু বকর (রা) একই ধরনের আরেকটা ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন,

“রাসূলুল্লাহর (সা) জীবদ্দশায় একবার সূর্যগ্রহণ হয়েছিল। … তারপর আমি এসে মসজিদে প্রবেশ করে দেখতে পেলাম, রাসূলুল্লাহ (সা) নামাযে দাঁড়িয়ে আছেন। আমিও তাঁর সাথে নামাযে শামিল হলাম। কিন্তু তিনি এতো দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকলেন যে আমার বসে পড়তে ইচ্ছা করছিল। ঠিক তখন খেয়াল করলাম, আমার পাশেই একজন দুর্বল মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। তখন মনে মনে বললাম, এই মহিলা তো আমার চেয়েও দুর্বল। কাজেই আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম। তারপর রাসূলুল্লাহ (সা) রুকু করলেন। রুকুতে তিনি দীর্ঘ সময় থাকলেন। তারপর রুকু থেকে ওঠে তিনি দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন। তখন যদি বাইরে থেকে কেউ আসতো, তাহলে তাঁর ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা দেখে ভাবতো, মহানবী (সা) বোধহয় এখনো রুকুই করেননি।”[6]

বুখারী ও অন্যান্য বর্ণনায় রয়েছে, আয়েশা (রা) বলেছেন,

“ঈমানদার নারীগণ চাদরে গা ঢেকে ফজরের নামাযে রাসূলের (সা) সাথে জামায়াতে শরীক হতেন। নামায আদায় শেষে তারা নিজ নিজ ঘরে ফিরে যেতেন।”[7]

মহানবীর (সা) স্ত্রী উম্মে সালামা (রা) বর্ণনা করেন,

“রাসূলের (সা) যুগে নারীরা (সাধারণত) ফরজ নামায শেষে উঠে চলে যেতেন এবং রাসূল (সা) মাঝেমধ্যে পুরুষদের সাথে বসে থাকতেন।”[8]

আসমা বিনতে আবু বকর (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন,

“আমি রাসূলুল্লাহকে (সা) বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে যেসব নারী আল্লাহ তায়ালা ও শেষ দিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে, তারা যেন (সেজদা থেকে) আমাদের মাথা তোলার আগে মাথা না তোলে। তা না হলে নারীরা পুরুষদের লজ্জাস্থান দেখে ফেলবে।”

তারপর আসমা (রা) ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করে বলেন,

“এই নির্দেশনার কারণ হলো, তখন পুরুষদের নিম্নাংশের পোশাক খুব সংক্ষিপ্ত ছিলো। ‘নামিরাহ’ (নিম্নাংশে পরিধানের জন্য ছোট্ট এক টুকরা কাপড়) ছাড়া বাড়তি কোনো পোশাক পরিধানের সক্ষমতা তখন অধিকাংশ পুরুষের ছিলো না।”[9]

আরেকটি বর্ণনায় আসমা বিনতে আবু বকর (রা) বলেছেন,

“আমাদের মধ্য থেকে রাসূল (সা) উঠে দাঁড়ালেন এবং আমাদের উদ্দেশ্যে কথা বলা শুরু করলেন। মৃত ব্যক্তিকে কবরে কী জিজ্ঞেস করা হবে, তিনি যখন সে প্রসঙ্গে বলছিলেন, তখন লোকেরা হট্টগোল করতে লাগলো। ফলে রাসূলের (সা) শেষ কথাটি আমি বুঝতে পারিনি। তারপর লোকেরা চুপ হলে আমার সামনে বসা পুরুষটিকে বললাম, আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন! রাসূল (সা) তাঁর বক্তব্যের শেষে কী বলছিলেন? পুরুষটি জবাব দিলেন, ‘আমাকে ওহীর মাধ্যমে জানানো হয়েছে— তোমরা কবরে যে ধরনের পরীক্ষার সম্মুখীন হবে, সেটা প্রায় দাজ্জালের ফিতনার মতোই।’”[10]

আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত,

“একজন কালো মহিলা মসজিদ ঝাড়ু দিতেন। একদিন তিনি মারা গেলেন। তারপর একদিন রাসূল (সা) মহিলাটি সম্পর্কে জানতে চাইলেন। সাহাবীরা বললেন, তিনি তো মারা গেছেন। তখন রাসূল (সা) বললেন, ‘মহিলাটি মারা যাওয়ার পর তোমরা আমাকে জানাওনি কেন? এখন আমাকে তার কবরে নিয়ে চলো।’ তারপর রাসূল (সা) ওই মহিলার কবরের কাছে এসে তার জন্য জানাজার নামায আদায় করলেন।”[11]

আয়েশা (রা) বর্ণনা করেছেন,

“যখন সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রা) ইন্তেকাল করলেন, তখন রাসূলের (সা) স্ত্রীগণ সংবাদ পাঠালেন— তাঁর লাশের খাটিয়া যেন মসজিদে নিয়ে আসা হয়, যাতে তাঁরা তাঁর জানাজায় শরীক হতে পারেন।”[12]

ইবনে ওমর (রা) থেকে বর্ণিত,

“ওমর ইবনুল খাত্তাবের (রা) স্ত্রী আতিকা বিনতে যায়েদ (রা) ফজর ও এশার নামায মসজিদে জামায়াতের সাথে আদায় করতে অভ্যস্ত ছিলেন। মসজিদের কোনো কোনো মুসল্লী তাঁর কাছে একদিন জানতে চাইলো, ‘আপনি নামায পড়তে আসেন কেন? আপনি তো জানেন, ওমর (রা) এটি পছন্দ করেন না। এতে তিনি ঈর্ষান্বিত বোধ করেন।’ তিনি জবাব দিলেন, ‘তাহলে ওমর (রা) নিজে কেন আমাকে নিষেধ করছেন না?’ তারা বললো, ওমরকে (রা) বাধা দেয় রাসূলের (সা) এই কথাটি— ‘তোমরা নারীদেকে আল্লাহর ঘরে যেতে বারণ করো না।’”[13]

এ হাদীসটির ব্যাখ্যায় ইবনে হাজার বলেছেন, ওমরকে (রা) যখন ছুরিকাঘাত করা হয়েছিলো, তখন আতিকা (রা) তাঁর পেছনেই নামায পড়ছিলেন।[14]

বুখারী ও মুসলিম উভয় গ্রন্থে মহানবীর (সা) স্ত্রী আয়েশা থেকে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন,

“কোনো এক ঈদের দিন রাসূল (সা) আমাকে হাবশীদের খেলা দেখার জন্য ডাকলেন। মসজিদের ভেতর তারা বর্শা চালনায় নিজেদের নৈপুণ্য প্রদর্শন করছিলো। রাসূল (সা) আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি খেলা দেখতে চাও? আমি বললাম: হ্যাঁ। তারপর আমি তাঁর পেছনে দাঁড়ালাম। তিনি এমনভাবে নিচু হয়ে দাঁড়ালেন যেন তাঁর কাঁধে আমার থুতনি রাখতে পারি। আমি তাঁর গালের সাথে গাল লাগিয়ে খেলা দেখতে লাগলাম। এমনকি রাসূল (সা) কয়েকবার দেখা ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করলেও আমি বললাম, ‘আরেকটু অপেক্ষা করেন!’ সত্যি বলতে কি, খেলা দেখার প্রতি আমার খুব একটা আগ্রহ ছিলো না। সেদিন বরং আমি চেয়েছিলাম, বিশেষ করে, নারীরা জানুক— তাঁর সাথে আমার সম্পর্ক কেমন। তাই, তোমরা আনন্দ-উচ্ছ্বাসের প্রতি তরুণীদের আগ্রহকে সুদৃষ্টিতে দেখো।”[15]

এখানে একটি বিষয় বলে রাখা জরুরি। উক্ত হাদীসটির ব্যাখ্যায় কেউ কেউ বলেছেন, এটি রাসূলের (সা) সাথে আয়েশার (রা) বিয়ের অল্প কিছুদিন পরের ঘটনা। তখন তিনি ‘প্রাপ্তবয়স্ক তরুণী’ ছিলেন না। তাঁদের দাবি মতে, তখন তাঁর বয়স ছিলো ৯ বছর। কিন্তু আমার হিসাবে প্রথম হিজরীতে যখন রাসূলের (সা) সাথে আয়েশার (রা) বিয়ে হয়, তখন তাঁর বয়স ছিলো ১৯ বছর। তাঁর বয়সের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন ঐতিহাসিক বর্ণনা থেকে দীর্ঘ অনুসন্ধানের উপর ভিত্তি করে আমি এই হিসাবটা করেছি। এই বইয়ে সে ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই। তারপরও আমার অবস্থানের পক্ষে একটি সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা এখানে তুলে ধরছি। বইটি যেহেতু মসজিদ ও নারী সম্পর্কিত, তাই অন্তত মেথডলজিক্যাল দৃষ্টিকোণ থেকে এই আলোচনাটি এখানে প্রাসঙ্গিক।

দুঃখজনক ব্যাপার হলো, হাদীসের সহীহ সংকলনগুলোতে (বুখারীর হাদীস নং ৩৮৯৪ এবং মুসলিমের হাদীস নং ১৪২২) একটি ভুল বর্ণনা সংকলিত হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, মহানবী (সা) যখন আয়েশার (রা) সাথে বিয়েকে পরিপূর্ণ করেন, তখন তাঁর বয়স ছিলো ৯ বছর। অথচ আয়েশার (রা) বিয়ে যে হিজরতের প্রথম বছরে মদীনায় অনুষ্ঠিত হয়েছিলো, সে বিষয়ে কোনো মতভেদ নেই। এটি ঠিক হলে সঙ্গত কারণেই অন্যান্য সহীহ বর্ণনাগুলো (যেগুলো সহীহ বুখারী ও মুসলিমেও বর্ণিত হয়েছে) ‘৯ বছর বয়স’ সংক্রান্ত বর্ণনার সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়ায়।

উদাহরণ হিসেবে সহীহ বুখারীর ২৭২৪ নং হাদীসের কথা বলা যায়। হাদীসটির বর্ণনা অনুযায়ী, (দ্বিতীয় হিজরীতে সংঘটিত) উহুদ যুদ্ধে মুসলিম সেনাবাহিনীর সাথে আয়েশা (রা) অংশগ্রহণ করেছিলেন। ‘৯ বছর’ সংক্রান্ত হাদীস অনুযায়ী, উহুদ যুদ্ধের সময় আয়েশার (রা) বয়স হওয়ার কথা ১০ বছর। কিন্তু উহুদ যুদ্ধে আয়েশার (রা) যে ধরনের ভূমিকা পালনের কথা হাদীসটিতে বর্ণিত হয়েছে, তাতে তাঁর বয়স ১০ বছর হওয়া যৌক্তিকভাবে অসম্ভব। এছাড়া বয়সের এই দাবি অন্যান্য অসংখ্য হাদীসের সাথেও সাংঘর্ষিক, যেগুলোতে বর্ণিত হয়েছে— ১৫ বছরের কম বয়সী কাউকে যুদ্ধে শরীক হওয়ার অনুমোদন আল্লাহর রাসূল (সা) দেননি।

ইমাম বুখারী নিজেই তাঁর গ্রন্থে (হাদীস নং ২১৭৬) বর্ণনা করেছেন— আয়েশা (রা) তাঁর পিতা আবু বকরের (রা) আবিসিনিয়ায় হিজরত পরিকল্পনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। এটি যে নবুয়তের চতুর্থ বছর অর্থাৎ মদীনায় হিজরতের ৯ বছর আগের ঘটনা, তা সকল বর্ণনা অনুযায়ী প্রমাণিত। মজার ব্যাপার হলো, ‘৯ বছর’ সংক্রান্ত হাদীসটিকে বিবেচনায় নিলে আয়েশা (রা) তখন জন্মলাভই করেননি। প্রত্যক্ষদর্শী হওয়া তো আরো অসম্ভব ব্যাপার।

আরেকটি বর্ণনায় (হাদীস নং ৪৫৯৫) ইমাম বুখারী উল্লেখ করেছেন— সূরা কামার যখন নাযিল হয়, আয়েশা (রা) তখন ‘জারিয়াহ’ (৬ থেকে ৯ বছর বয়সী মেয়েদের বুঝাতে আরবীতে এই পরিভাষাটি ব্যবহৃত হয়) ছিলেন। তিনি তখন মক্কায় খেলাধুলা করতেন। সংশ্লিষ্ট সব বর্ণনা থেকে আমরা জানি, সূরা কামার নাযিল হয়েছিলো নবুয়তের দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ বছরের মধ্যে, অর্থাৎ হিজরতের ৯ থেকে ১১ বছর আগে।

তাহলে স্বয়ং ইমাম বুখারী কর্তৃক বর্ণিত অন্যান্য হাদীস থেকে প্রাপ্ত তথ্যের গাণিতিক হিসাব করে সহজেই বলা যায়, হিজরতের প্রথম বছর, অর্থাৎ আয়েশার (রা) বিয়ের সময় তাঁর বয়স ছিলো ১৫ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে।

ইবনে ইসহাক কর্তৃক অন্য একটি বর্ণনায় দেখা যায়, নবুয়তের প্রথম বছরে ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে আয়েশা (রা) ছিলেন ১৯তম ব্যক্তি। এটি হিজরতের ১৩ বছর আগের ঘটনা। তারমানে তখনই তিনি কমপক্ষে কিশোরী ছিলেন (ইবনে হিশাম, ২৭১ পৃ.)। ইবনে ইসহাক অনেক প্রসিদ্ধ ইমামের নিকট ‘বিশ্বস্ত’ ছিলেন। এদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম সুফিয়ান আস-সাওরী, ইমাম জুহরী, ইমাম শু’বা, ইমাম শাফেয়ী এবং আলী ইবনে মাদানীসহ আরো অনেকে। অবশ্য এটা সত্য, ইবনে ইসহাকের ব্যাপারে ইমাম মালেক এবং হিশাম ইবনে উরওয়া মিথ্যা বর্ণনার অভিযোগ এনেছেন। তবে অন্য অনেক ইমাম তাঁদের সাথে দ্বিমত করেছেন। উল্লেখ্য, সমসাময়িক হওয়া সত্ত্বেও ইবনে ইসহাকের সাথে ইমাম মালেকের কখনো সাক্ষাৎ ঘটেনি।

হিশাম ইবনে উরওয়া হলেন প্রকৃতপক্ষে ‘৯ বছর’ সংক্রান্ত ভুল বর্ণনাটির উৎস। এটি আমার মত। মালিক ইবনে আনাস এবং ইবনে হাজারসহ বেশ কয়েকজন স্কলার হিশাম ইবনে উরওয়ার ব্যাপারে মিথ্যা বর্ণনার (তাদলীস) অভিযোগ এনেছেন। এর পাশাপাশি ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ এবং ইবনে খিরাশসহ অন্যান্যদের মতে, জীবনের শেষদিকে হিশাম ইবনে উরওয়ার স্মৃতিশক্তি লোপ পেয়েছিলো। এছাড়া তৎকালীন উমাইয়া শাসকদের সাথে সুসম্পর্ক থাকাও তাঁর সততার ঘাটতির পরিচয় বহন করে।[16]

হিশাম ইবনে উরওয়ার গুরুতর সমস্যা আমি দেখি আরেকটি বর্ণনায়। সেখানে তিনি বলেছেন, রাসূল (সা) জাদুমন্ত্র দ্বারা আক্রান্ত ছিলেন। লাবিদ ইবনে আসাম নামক মদীনার এক ইহুদী রাসূলকে (সা) জাদুমন্ত্র করেছে— এই দাবির মূলসূত্র হলেন হিশাম (বুখারী, ৪৫৩০)। হিশামের দাবি মতে, রাসূল (সা) মাঝেমধ্যে ‘এমন কাজ করেছেন বলে ভাবতেন, যা তিনি কখনোই করেননি’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

সূরা মায়েদার ৬৭ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা রাসূলকে (সা) ‘মানুষের হাত থেকে রক্ষা করার’ যে প্রতিজ্ঞা করেছেন, সেটিসহ কোরআনের অনেক মূলনীতির সাথে হিশামের এই বর্ণনাটি সাংঘর্ষিক। রাসূল (সা) জাদুগ্রস্ত ছিলেন বলে মক্কার মূর্তিপুজকরা যে দাবি করতো, কোরআন বার বার সেই দাবিকে প্রত্যাখ্যান করেছে (সূরা বনী ইসরাইল: ৪৭ ও ১০১ এবং সূরা ফোরকান: ৮)।

আমার মতে, এই একটি বর্ণনার কারণেই হিশামকে অবিশ্বস্ত বলা যায়। যদিও তার বাবা উরওয়া ইবনে জোবায়ের মদীনার সাতজন প্রসিদ্ধ বিচারকের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। এবং তার দাদা জোবায়ের ইবনে আওয়াম (রা) রাসূলের (সা) একজন প্রসিদ্ধ সাহাবী ছিলেন।

মুসনাদে আহমদে আমরা আরেকটি সহীহ বর্ণনা পাই (হাদীস নং ২৫৮১০), যেখানে বলা হয়েছে, রাসূলের (সা) সাথে বিয়ের আগে জোবায়ের ইবনে মুতয়াম ইবনে আদীর সাথে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য আয়েশার (রা) এনগেজমেন্ট হয়েছিলো। ‘৯ বছর’ সংক্রান্ত হিশামের বর্ণনাটিকে গ্রহণ করলে উক্ত এনগেজমেন্টের সময় আয়েশার (রা) বয়স ছিলো ৬/৭ বছরেরও কম, যা অযৌক্তিক বলে মনে হয়।

আরো একটি ঐতিহাসিক সত্য হলো, আসমা বিনতে আবু বকর (রা) থেকে তাঁর বোন আয়েশা (রা) ১০ বছরের ছোট ছিলেন। নবুয়তের প্রথম বছর আসমা (রা) যখন ইসলাম গ্রহণ করেন, তখন তাঁর বয়স ছিলো ১৭ বছর, (কারো কারো মতে, ২৭ বছর)। এ থেকে বুঝা যায়, নবুয়তের প্রথম বছর অর্থাৎ হিজরতের ১৩ বছর পূর্বে আয়েশার (রা) বয়স ছিলো কমপক্ষে ৭ বছর। অতএব, রাসূলের (সা) সাথে বিয়ের সময় আয়েশার (রা) বয়স ছিলো কমপক্ষে ১৯ বছর।

মোট কথা, আমরা যখন একাধিক ‘বিশ্বস্ত’ বর্ণনাকারীর বর্ণনায় এ ধরনের বৈপরীত্য দেখতে পাবো, তখন আমাদেরকে অবশ্যই বর্ণিত বিষয়বস্তুটিকে পদ্ধতিগতভাবে পর্যালোচনা (নাক্বদুল মতন) করতে হবে। এই বিবেচনায় রাসূলের (সা) সাথে বিয়ের সময় আয়েশার (রা) বয়স ৬, ৭ কিংবা ৯ বছরের পরিবর্তে ১৯ বছর হওয়াটাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত।

এই পর্যালোচনাটির একটি বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কারণ, ইসলামে বিয়ের বয়স সংক্রান্ত ফতোয়া দেওয়ার ক্ষেত্রে এই বর্ণনাটিকে উদ্ধৃত করা হয়। অতীতে তো বটেই, বর্তমানকালেও এ ধরনের ফতোয়া ৯ বছর বয়সী শিশু বিবাহের পথ খুলে দিয়েছে, যা অসংখ্য দুর্বল শিশুর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে একটা কথা বলে রাখা জরুরি মনে করছি। সেটা হলো, পাশ্চাত্য বা প্রাচ্যের কোনো বিশেষ ‘সংস্কৃতি’, কিংবা বিশেষ কোনো আইনগত বা সামাজিক ফেনোমনার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে আমি এই মতামত দিচ্ছি না। বরং বিয়ে সংক্রান্ত হাদীসগুলোর তাৎপর্য (দিরায়েত), ফিকাহর বিধান এবং মাকাসিদে শরীয়াহর উপর ভিত্তি করেই আমি এই মতামত দিচ্ছি। কোরআনের মতে, বিয়ের উদ্দেশ্য হলো ‘পারস্পরিক ভালোবাসা ও সহমর্মিতা’ অর্জন (সূরা রূম: ২১)। কিন্তু ৬ বা ৯ বছরের শিশুকে বিয়ে করে কীভাবে পারস্পরিক ভালোবাসা ও সহমর্মিতা অর্জন করা সম্ভব?

এই বইয়ের বাকি প্রশ্নগুলোর জবাব পেতে হলে মাকাসিদে শরীয়াহ এবং সুন্নাহর সামগ্রিক বুঝাপড়া আমাদের জন্য খুবই প্রয়োজন। পরবর্তী অধ্যায়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করা হবে। সেটি হলো, রাসূলের (সা) যুগে মসজিদে নববীতে যদি নারীদের এ ধরনের যাতায়াত ও অবস্থান থেকে থাকে, তাহলে কীসের ভিত্তিতে কিছু মুসলমান এখন নারীদেরকে মসজিদে প্রবেশে বাধা দিচ্ছে?

[মূল: ড. জাসের আওদা, অনুবাদ: জোবায়ের আল মাহমুদ]

***

অন্যান্য পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

রেফারেন্স ও নোট:

[1] সহীহ বুখারী, ৯৫-৬/১।

[2] সহীহ বুখারী, অভিযান অধ্যায়, ৪১৬/৮ এবং সহীহ মুসলিম, জিহাদ অধ্যায়, ১৬০/৫।

[3] ফাতহুল বারী, ৪১৫/৮।

[4] সহীহ মুসলিম, শাস্তি অধ্যায়, ২০৫/৮।

[5] সহীহ বুখারী, অযু অধ্যায়, ৩০০/১ এবং সহীহ মুসলিম, সূর্যগ্রহণের নামায অধ্যায়, ৩২/৩।

[6] সহীহ মুসলিম, সূর্যগ্রহণের নামায অধ্যায়, ৩২/৩।

[7] সহীহ বুখারী, নামায অধ্যায়, ১৯৫/২ এবং সহীহ মুসলিম, মসজিদ অধ্যায়, ১১৮/২।

[8] সহীহ বুখারী, ১৭৩/১। সম্পাদকের টীকা: রাসূল (সা) ফরজ নামায শেষ করে সাধারণত উঠে হুজরায় চলে যেতেন। তবে মাঝেমধ্যে তিনি সুন্নত-নফল মসজিদেই আদায় করতেন, এরপর সাহাবীদের সাথে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলতেন।

[9] মুসনাদে আহমদ, ৫১১/৪৪।

[10] ‘হট্টগোল করতে লাগলো’ পর্যন্ত বর্ণনার সূত্র সহীহ বুখারী, জানাজা অধ্যায়, ৪৭৯/৩; একই সনদ থেকে হাদীসের বাকিটুকুর সূত্র মুসনাদে নাসাঈ, ২০৭০/৭।

[11] সহীহ বুখারী, অভিযান অধ্যায়, ৪১৬/৮ এবং সহীহ মুসলিম, জিহাদ অধ্যায়, ১৬০/৫।

[12] সহীহ মুসলিম, জানাজা অধ্যায়, ৬৩/৩।

[13] সহীহ বুখারী, নামায অধ্যায়, ৬/২; ইবনে হিব্বান, ৩২৭/১; মুয়াত্তা, ১৯৭/১; বায়হাকী, ১৯৯/৩; ইবনে খুজায়মা, ৯০/৩; ইবনে আবু শায়বা, ১৫৬/২ এবং আবু হোরায়রার সূত্রে আহমদ ৪০৫/১৫।

[14] ফতহুল বারী, ৩৪/৩

[15] সহীহ বুখারী, ৪৪৫ এবং সহীহ মুসলিম, ৮৯২।

[16] বিস্তারিত জানতে দেখুন ইমাম যাহাবী, সিয়ারে আলামুন নুবালা, আর-রিসালাহ, বৈরুত, ২০০১, ৬/৩৪-৪৭।

জাসের আওদা
জাসের আওদাhttp://www.jasserauda.net
মাকাসিদে শরীয়াহর উপর একজন শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ। ‘মাকাসিদ ইনস্টিটিউট গ্লোবাল’ নামক একটি থিংকট্যাংকের প্রেসিডেন্ট। ফিকহ কাউন্সিল অব নর্থ আমেরিকা, দ্য ইউরোপিয়ান কাউন্সিল ফর ফতওয়া এবং ফিকহ একাডেমি অব ইন্ডিয়ার সদস্য। পড়াশোনা করেছেন আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরবর্তীতে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ওয়েলস এবং কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ওয়াটারলু থেকে ইসলামী আইন ও সিস্টেম অ্যানালাইসিসের উপর দুটি পিএইচডি করেছেন। বিভিন্ন দেশের বেশ কটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। আরবী ও ইংরেজিতে প্রায় ২৫টি বইয়ের লেখক।

সাম্প্রতিক

এ ধরনের আরো নিবন্ধ