ইসলামী রাজনীতি, অর্থনীতি, নারী অধিকার ও দ্বীন শিক্ষা প্রসঙ্গে আকরাম নদভী
গত ২২ জুলাই ২০২০ তারিখে ড. আকরাম নদভীর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন ড. ইয়াসির ক্বাদী। সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে তিনি ইয়াসির ক্বাদীর প্রশ্নের জবাব দেন। সাক্ষাৎকারটির গুরুত্ব অনুধাবন করে সিএসসিএসের পাঠকদের জন্য এটি অনুবাদ করেছেন ইফতেখারুল ইসলাম ইফাত ও মাসউদুল আলম।
***
ইয়াসির ক্বাদী: পশ্চিমা জগতের অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন একজন আলেম আজ আমাদের সাথে যোগ দেওয়ায় সম্মানিতবোধ করছি। তাঁর নিকট থেকে আমি প্রতিনিয়তই উপকৃত হয়ে থাকি। তিনি হলেন শায়খ ড. মোহাম্মদ আকরাম নদভী। ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিশ্বখ্যাত এই আলেম নাদওয়াতুল উলামা (লখনৌ, ইন্ডিয়া) থেকে ইসলামী জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় গভীর বুৎপত্তি লাভ করেন। তারপর লখনৌ ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি ইসলামী সাহিত্যে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। বহু বছর তিনি স্বনামধন্য ‘অক্সফোর্ড সেন্টার ফর ইসলামিক স্টাডিজে’ গবেষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বিভিন্ন বিষয়ে উর্দু, ফারসী, আরবী ও ইংরেজিতে তিনি লিখে থাকেন। এর মধ্যে আছে অনুবাদ, দুর্লভ আরবী পাঠ্য এবং বিভিন্ন ইসলামী বিধি-বিধানের অরিজিনাল মনোগ্রাফ। গত কয়েক বছর ধরে ‘আল-মুহাদ্দিসাত’ শিরোনামের ৫৩ খণ্ডের একটি বিশাল প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছেন, যেখানে তিনি ইতিহাসের প্রায় সকল নারী মুহাদ্দিসের জীবনী সংকলন করেছেন। ইসলামের বিভিন্ন বিধিবিধান, নারী হাদীস বর্ণনাকারীদের উপর মনোগ্রাফ ও ইমাম আবু হানিফার উপর বই লিখেছেন। এছাড়া তিনি তাঁর নিজ শিক্ষক সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভীর উপর একটি বিশালাকার গ্রন্থ রচনা করেছেন। উল্লেখ্য, সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী ছিলেন গত শতাব্দীর অন্যতম শীর্ষ আলেম। আকরাম নদভী সৌদি আরব, মিসর, ভারত, তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ফিলিস্তিনসহ মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বক্তৃতা দিয়েছেন। তাঁর বর্তমান আবাস ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে।
হাদীস চর্চার সাথে নারী অধিকারের ইতিবাচক সম্পর্ক
ইয়াসির ক্বাদী: আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহ। আমাদের প্রোগ্রামে আপনাকে স্বাগত।
আকরাম নদভী: ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ।
ইয়াসির ক্বাদী: শায়খ, আমি সরাসরি প্রথম প্রশ্নে চলে যাচ্ছি। ‘আল-মুহাদ্দিসাত’ নামে ৫৩ খণ্ডের এক বিশাল প্রজেক্ট নিয়ে আপনি কাজ করেছেন। আমাদের একটু বলুন, এ ব্যাপারে আপনি কীভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন? বইটির কাজ বর্তমানে কোন পর্যায়ে রয়েছে? আর এই গবেষণাটি করতে গিয়ে শিখেছেন এমন দুয়েকটি ছোটখাটো ইন্টারেস্টিং বিষয় আমাদের সাথে শেয়ার করুন।
আকরাম নদভী: ২০১০ সালে বইটির কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। তারপর থেকে আমি অন্যান্য কাজে যুক্ত আছি। বইটা অনেক বড় হওয়ায় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান খুঁজে পেতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ, অবশেষে জেদ্দার ‘দারুল-মিনহা’ বইটি প্রকাশ করছে। সবগুলো খণ্ডের পৃষ্ঠাসজ্জার কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। ইনশাআল্লাহ, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে বইটির সবগুলো খণ্ড প্রকাশিত হবে।
যে ব্যাপারটি আমাকে এই কাজে অনুপ্রাণিত করেছে সেটি ১৯৯৭/৯৮ সালের ঘটনা। ইসলামে নারীর অবস্থান নিয়ে ইংল্যান্ডের ‘দ্যা টাইমস’ পত্রিকায় প্রকাশিত কয়েকটি নিবন্ধ পড়েছিলাম। সেগুলো ছিলো খুবই নেতিবাচক ধাঁচের। ইসলাম নারীর প্রতি অবিচার করে, বিশেষত জ্ঞানার্জন ও বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যাপারে ইসলাম নারীদেরকে উৎসাহিত করে না— এমনসব অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছিলো।
অথচ আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এর বিপরীত। হাদীস নিয়ে অধ্যয়নকালে এমন অসংখ্য নারীর পরিচয় আমি পেয়েছি, যারা হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং হাদীস শিক্ষা দিয়েছেন। আমার মনে হলো, আমি এই নারীদের জীবনী সংকলন করতে পারি। তাহলে এটি অন্তত ইসলামের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগের একটি জবাব হয়ে থাকবে। পাশাপাশি মুসলিম নারীরাও এ থেকে ইসলামী জ্ঞানার্জনের জন্য অনুপ্রেরণা লাভ করতে পারবে।
তারপর আমি যখন গবেষণা কার্যক্রমের গভীরে যেতে থাকলাম, তখন প্রচুর তথ্য পেতে থাকলাম। এই গবেষণার জন্য সিরিয়া, তুরস্ক, ইন্ডিয়াসহ বিভিন্ন স্থান থেকে শত শত বই ও পাণ্ডুলিপি দেখতে লাগলাম। জ্ঞানের জগতে যে এত এত মুসলিম নারীর অবদান আছে তা দেখে আমি সত্যিই তাজ্জব বনে গিয়েছিলাম।
মনে পড়ে, এই বিষয়ের উপর কাতার ইউনিভার্সিটিতে একটা লেকচার দিতে ২০০৭/০৮ সালের দিকে কাতারে গিয়েছিলাম। সেখানে আমার শায়খ ইউসুফ আল-কারযাভীর সাথে দেখা করি। তিনি আমাকে তাঁর মসজিদে একটি বক্তব্য দিতে বললেন। যাহোক, তিনি আমার কাছে বইটির অগ্রগতির ব্যাপারে জানতে চাইলেন। আমি বললাম, এ বিষয়ে এত বেশি তথ্য পাওয়া গেছে যে তা শেষ করতে আরো অনেক সময় লাগবে। তিনি আমাকে বইটি দ্রুত শেষ করার তাগাদা দিলেন। ফলে আমি বইটির কাজ শেষ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। পরে কাতার ইউনিভার্সিটিতে লেকচার দেওয়ার সময় আমি উল্লেখ করি যে শায়খ কারযাভী কাজটি দ্রুত শেষ করার তাগাদা দিয়েছেন। সেখানে উপস্থিত একজন তখন মন্তব্য করে বসলো, ‘এটাও নারীদের বিরুদ্ধে পুরুষদের একটা ষড়যন্ত্র’!
[আরো পড়ুন: মুসলিম নারী স্কলারদের বিস্মৃত ইতিহাস]
যাইহোক, হাদীস বর্ণনা করেছেন, শিখেছেন ও দারস দিয়েছেন, এমন নারীদের সংখ্যা দেখে আমি বিস্মিত হয়ে যাই। সংখ্যাটা যে এত বড় হবে আমি ধারণাও করিনি— প্রায় ১০ হাজার! যত নারী হাদীসবেত্তার তথ্য আমি পেয়েছি, তার সবগুলো বইয়ে সংকলন করেছি। যাতে এ বিষয়ে যে কেউ সহজেই তথ্য পেয়ে যায়।
নারীরা নামাযের জন্য মসজিদে যেতে পারবে কিনা— ইন্ডিয়ায় গেলে আমি এখনো এই প্রশ্নটির সম্মুখীন হই। এতসব বইপত্র ঘেঁটে আমি যা বুঝতে পেরেছি তা হলো ইসলামের ইতিহাসে কখনোই এই প্রশ্নটি প্রাসঙ্গিক ছিলো না। আমি এমন নারীদেরও পরিচয় পেয়েছি যারা হাতিমে বসে হাদীসের দারস দিতেন। হাতিম মূলত কাবা ঘরেরই অংশ।[1] আর সেই যুগের বড় বড় আলেমরা তাদের এইসব ক্লাসে অংশ নিতেন। হাতিম তথা কাবার চেয়ে পবিত্র কোনো স্থান কি আর আছে?
আরও কয়েকজন নারী মুহাদ্দিসের তথ্য পেয়েছি যারা মসজিদে নববীতে বসে হাদীস চর্চা করতেন। নবীর হাদীস শিক্ষা দেওয়ার জন্য নবীর মসজিদের চেয়ে উত্তম স্থান আর কী হতে পারে! এই ধরনের নারী মুহাদ্দিসগণের মধ্যে একজন হলেন ফাতিমা আল-বাতায়াহিয়্যাহ (রাহীমাল্লাহু তায়ালা)। তিনি ৭১১ হিজরী সনে মৃত্যুবরণ করেন। তৎকালীন বিশ্বে তিনিই সর্বোচ্চ ইসনাদ[2] সহকারে হাদীস বর্ণনা করতেন। ৬৩০ হিজরী সনে তিনি দামেস্কে আবু আব্দিল্লাহ হুসাইন ইবনুল বার আয-যাবীদীর নিকট হতে সহীহ বুখারী অধ্যয়ন সম্পন্ন করেন। হজ শেষে মদীনায় গেলে সেখানকার লোকেরা তাঁকে সহীহ বুখারী ও অন্যান্য গ্রন্থ শিক্ষা দিতে অনুরোধ করেন। মসজিদে নববীতে যারা তাঁর ক্লাসে অংশগ্রহণ করতেন তাদের মধ্যে ছিলেন বড় বড় আলেম ও বিচারকবৃন্দ। মুহাদ্দিস ফাতিমার ব্যাপারে যারা লিখে গেছেন তারা এটিও উল্লেখ করেছেন যে তিনি কখনো কখনো নবীজির (সা) কবরের পাশে বসে হাদীসের দারস দিতেন। শুধু তাই নয়, তিনি রাসূলের (সা) কবরের মাথার দিকটায় বসতেন এবং বার্ধক্যজনিত ক্লান্তির কারণে প্রায়ই কবরের দেয়ালে হেলান দিতেন। তাঁর কাছ থেকে যারা পাঠ নিতেন, তাদের প্রত্যেককে তিনি নিজ হাতে ইজাযত লিখে দিতেন।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, মসজিদে হারাম ও মসজিদে নববীর মতো সবচেয়ে পবিত্র দুটি স্থানে বসে নারীরা শিক্ষা প্রদান করতেন। তৃতীয় পবিত্র স্থান মসজিদে আকসাতেও উম্মে দারদার সময় অনেক নারী শিক্ষকতা করতেন। সাইয়েদা আল-মারানিয়া তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি সপ্তম শতাব্দীর মানুষ। বাইতুল আকসায় তাঁর ক্লাসে যারা পাঠ নিতো তাদের সংখ্যাটা বেশ বড়। তিনি যাদের ইজাযত দিয়েছেন তাঁদের নামের তালিকা পাওয়া যায়। আমি গুণে দেখেছি, সেই তালিকায় ৩৯৬ জনের নাম রয়েছে। এই তালিকা প্রণয়নকারী উল্লেখ করেছেন, তিনি যাদেরকে ইজাযত দিয়েছিলেন তাদের সবার নাম সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।
একইভাবে বিভিন্ন নথিপত্র থেকে সিরিয়া ও মিশরের বড় বড় মসজিদ (যেমন: দামেস্কের জামে বনু উমাইয়া) ও মাদ্রাসার খোঁজ পেয়েছি, যেগুলোতে নারীরা শিক্ষাগ্রহণের পাশাপাশি শিক্ষকতাও করতেন। অথচ এখন হচ্ছে এর উল্টোটা।
আমি একবার আল-কারভীনে[3] বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। এটি মূলত একটি মসজিদ ও শিক্ষাকেন্দ্র, যেটি একজন নারীর অনুদানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। তা সত্ত্বেও দীর্ঘদিন সেখানে নারীদেরকে পড়ালেখা করার অনুমোদন দেওয়া হয়নি। নারীরা যেখানে মসজিদ তৈরি করেছে, শিক্ষকতা করেছে; সেখানে এখন এই অবস্থা!
ইসলামের অনেক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ মূলত নারীদের মাধ্যমে সংরক্ষিত হয়েছে। যেমন: ইমাম তাবারানী কর্তৃক সংকলিত আল-মু’জামুল কবীর ও আল-মু’জামুস সগীরের ২৫ খণ্ড। ফাতিমা আল-জুযদানিয়্যাহ, ফাতিমা আল-আন্দালুসিয়্যাহদের মতো অসংখ্য নারী হাদীসের এসব সংকলন সংরক্ষণ করেছেন। তাদের অবদানের ফলে এগুলো এখন আমাদের নাগালে রয়েছে।
[আরো পড়ুন: রিক্লেইমিং দ্যা মস্ক]
ইয়াসির ক্বাদী: এখন কেন আমরা নারীদের মধ্যে এ রকম পাণ্ডিত্য দেখতে পাই না? এর কারণ কী উপনিবেশবাদ, পুরুষদের ষড়যন্ত্র, নাকি অন্য কিছু? আপনার মতে আসল কারণটা কী?
আকরাম নদভী: এর পেছনে উপনিবেশবাদ বা এ ধরনের কিছু দায়ী বলে আমি মনে করি না। আমার ধারণায় প্রকৃতপক্ষে যা ঘটেছে তা হলো: মুসলিম সমাজে যতদিন রাসূলের (সা) হাদীসের শিক্ষাসমূহ শক্তিশালী ছিলো, ততদিন পর্যন্ত নারীদেরকে সম্মান করা হতো এবং শিক্ষাগ্রহণের জন্য তারা মসজিদ-মাদ্রাসায় যেতে পারতো। কিন্তু যখন সমাজে ফিলসফি এবং ফিকাহর চর্চা প্রাধান্য পেয়ে গেলো, তখন নারীরা নিরুৎসাহিত হতে থাকলো। যেমন: অ্যারিস্টটল ছিলেন ফিলসফির বড় পণ্ডিত। তাঁকে আমি সম্মান করি, নিঃসন্দেহে তিনি অনেক বড় মাপের ব্যক্তিত্ব ছিলেন। কিন্তু তিনিও অন্যদের মতো মনে করতেন, নারীরা পুরষদের চেয়ে হীন। তারা শিক্ষা-দীক্ষার যোগ্য নয়। এমনকি তিনি মনে করতেন, নারীরা হীন হওয়ার অন্যতম কারণ পুরুষদের তুলনায় তাদের দাঁতের সংখ্যা কম। তাঁর দুজন স্ত্রী ছিল। তাদের দাঁতগুলো গুণে দেখলেও তো তাঁর এই ভুল ধারণা ভেঙে যেতো।
অমুসলিমরা তো বটেই, মুসলিম দার্শনিকরাও শিক্ষা অর্জনে নারীদেরকে কখনো উদ্বুদ্ধ করেনি। আমার বইয়ে মুহাদ্দিস, মুফাসসির, ফকীহ পরিবার তথা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী থেকে উঠে আসা নারীদের কথা জানতে পারবেন। কিন্তু ফিলসফি চর্চা হয়, এমন পরিবার থেকে আসা কোনো নারীর সন্ধান আমি পাইনি। রাসূলের (সা) যুগের প্রায় হাজার বছর পর ফিলসফি মোটাদাগে মাদ্রাসা কারিকুলামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। তারপর থেকে নারীরা ইনফেরিয়র হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। ফলে মাদ্রাসায় গিয়ে তাদের শিক্ষাগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হয়। অবশ্য একই সময়কালে যেসব স্থানে হাদীসের অব্যাহত ছিলো, সেখানে নারীরা শিক্ষাগ্রহণে উদ্বুদ্ধ ছিলো। এর একটা উদাহরণ হলো ইন্ডিয়া। সেখানেও নারীরা পিছিয়ে গিয়েছিলো। তারপর শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী হেজাজে গিয়ে হাদীসের উপর পড়াশোনা করে ইন্ডিয়ায় ফিরে গিয়ে ব্যাপকভাবে হাদীস চর্চা শুরু করেন। যার ফলে আবারো নারীরা শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে যেতে পেরেছিলো। পরবর্তীতে সেখানে অনেক নারী মুহাদ্দিস তৈরি হয়েছে। একই কথা সিরিয়ার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সেখানেও দীর্ঘসময় পর্যন্ত হাদীসের চর্চা ছিলো না। তারপর ষষ্ঠ শতাব্দীতে ইবনে আসাদের মতো কিছু আলেমের কয়েক শতকের ধারাবাহিক চেষ্টার পর সিরিয়া হাদীস চর্চার কেন্দ্রে পরিণত হয়।
আমার পর্যবেক্ষণে, সমগ্র মানব ইতিহাসে কেবল মহানবীই (সা) প্রকৃতপক্ষে নারীদের যথাযথ মর্যাদা নিশ্চিত করেছিলেন। নারী অধিকারের পক্ষে অনেকেই কথাবার্তা বলে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনিই এটি বাস্তবায়ন করতে পেরেছিলেন। আপনি যদি তাঁর জীবনী অধ্যয়ন করেন, তাহলে নারীদের প্রতি আপনার সম্মানবোধ বৃদ্ধি পাবে এবং মহানবীর (সা) পদাঙ্ক অনুসরণ করার অনুপ্রেরণা পাবেন।
নারীবাদ প্রসঙ্গে
ইয়াসির ক্বাদী: আমরা জানি নারীদের মর্যাদা, জ্ঞানার্জন, মসজিদে নামাজ আদায় ইত্যাদির পক্ষে আপনি সোচ্চার। কিন্তু আধুনিক নারীবাদী আন্দোলনের ব্যাপারে আপনার অবস্থান কী? আপনি কি নিজেকে নারীবাদী মনে করেন? নাকি এর কোনো কোনো দিকের ব্যাপারে আপনার সমালোচনা আছে?
আকরাম নদভী: সত্যি বলতে কি, নারীবাদের উপর আমি একটা বই লিখছি। কেউ কেউ তো আমাকে নারীবাদী মনে করে। যদিও আমি তা নই। মানুষ না বুঝেই তড়িঘড়ি করে আরেকজনের উপর তকমা লাগাতে চায়। তারা বুঝতে চায় না যে আমি নির্দিষ্ট কোনো ঘরানার লোক নই। তারা আমার লেকচারের কোনো অংশের সাথে যদি হানাফী, আশয়ারী, মাতুরিদী বা অন্য কোনো ঘরানার মিল পেয়ে যায়, তাহলে আমাকে সেই ঘরানার বলে ধরে নেয়। অথচ আমি তেমনটা নই। আমি শুধু নারীদের সেই অধিকারের পক্ষে কথা বলি, যেটুকু কোরআন-সুন্নাহ তাদেরকে দিয়েছে, ইসলামের প্রথম দিকে ব্যাপারগুলো যে রকম ছিলো। নারী অধিকারের পক্ষে আমি যেসব কথা বলি, সেগুলো মোটেও নতুন কিছু নয়। এগুলোর সবই বইপত্রে বলা আছে।
শুধু মুসলিম সমাজ নয়, সকল সমাজেই নারীরা দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত হওয়ার প্রতিক্রিয়া হিসেবে মূলত নারীবাদের উৎপত্তি। নারীবাদী আন্দোলনের কিছু বিষয়ের সাথে আমি হয়তো একমত। নিদেনপক্ষে নারীদের প্রতি অবিচার দূর করার প্রসঙ্গে তো একমত হওয়াই যায়। কারণ, দৃঢ়তার সাথে সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য যারা কাজ করে ইসলাম তাদেরকে সমর্থন করে। সুতরাং, যারাই কোনো ন্যায়ের কথা বলবে, তাদেরকে আমরা সমর্থন করবো। তবে নারীবাদের কিছু দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে আমি একমত নই। এর একটি কারণ হলো তাদের এসব দৃষ্টিভঙ্গি খোদ নারীদের জন্যই ক্ষতিকর।
নারীবাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, নারীবাদ নারীদের নারীত্বকে কোনো মূল্য দেয় না। তারা চায় নারীরা পুরুষের মতো হয়ে ওঠুক।
আমাদেরকে বুঝতে হবে যে কেন আল্লাহ তায়ালা দুটি পৃথক শ্রেণী হিসেবে নারী ও পুরুষ সৃষ্টি করেছেন। তিনি তো চাইলে নারী অথবা পুরুষ তথা যে কোনো একটি শ্রেণী সৃষ্টি করতে পারতেন। ইসলামে পরিবার ও সন্তান প্রতিপালন প্রসঙ্গে নারী-পুরুষের মাঝে পার্থক্য রয়েছে। নারীসত্তার মূল হলো মাতৃত্ব। অথচ এখন মাতৃত্বকে মূল্যায়ন করা হয় না। আল্লাহর গুণাবলীর উদাহরণ দিতে গিয়ে আমি সবসময় বলি, আল্লাহর দয়া ও রহমতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হলো একজন মা। নারীদের এই অসাধারণ দিকটি নারীবাদে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাদের দৃষ্টিতে মা হওয়াটা নারীর জন্য এক প্রকার সমস্যাই বটে। মা হওয়াটাকে যেখানে সম্মানের চোখে দেখা উচিত, নারীবাদ সেখানে একে অসম্মানের চোখে দেখে। এই কারণে নারীবাদকে আমি সমর্থন করি না। এমনিতে নীতিগতভাবে নারীসহ সমাজের যে কেউ যদি ন্যায়ের পক্ষে, প্রাপ্য অধিকারের পক্ষে কথা বলে; তাহলে আমরা তা সমর্থন করি।
সংখ্যালঘু সমাজ ও রাষ্ট্রে মুসলমানদের রাজনৈতিক ভূমিকা
ইয়াসির ক্বাদী: পাশ্চাত্যে বসবাসকারী মুসলিমদের লক্ষ্য কী হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন? নিছক খেয়ে-পরে বেঁচে থাকা? এখানকার বিদ্যমান নৈতিকতা ও সামাজিক ইস্যুগুলোর বিকল্প তুলে ধরা? নাকি রাজনৈতিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্যও থাকা প্রয়োজন?
আকরাম নদভী: এ প্রসঙ্গে আমি দুটি বিষয়ের উপর জোর দিতে চাই। প্রথম কথা হলো, মুসলিমরা অন্য কোনো জাতির মতো নয়। তারা হলো এই দুনিয়াতে আল্লাহর প্রতিনিধি। তাদের দায়িত্ব হলো মূলত নিজেকে এবং মানবজাতিকে জাহান্নাম থেকে রক্ষার চেষ্টা করা। মানুষ হলো দাস এবং আল্লাহ হলেন মনিব বা প্রভু। দাসের সাথে মনিবের সম্পর্ক হলো, দাস মাত্রই তার মনিবের ইবাদত করতে বাধ্য। ভোগের পরিবর্তে দুনিয়ার নেয়ামতসমূহকে তাঁর ইবাদত করার সুবিধার্থে ব্যবহার করার পেছনে এটিই হলো যুক্তি। এই বিষয়টি মানবজাতিকে স্মরণ করিয়ে দেওয়াই মুসলমানদের মূল দায়িত্ব। কিন্তু এটি করতে গিয়ে লোকজনের উপর জোর খাটানো যাবে না। ইসলাম গ্রহণ করা বা না করার ব্যাপারে প্রত্যেকের পূর্ণ স্বাধীনতা আছে। মানুষ হিসেবে সবার সাথে আমাদের মিলেমিশে বসবাস করতে হবে। তারাও মানুষ, আমরাও মানুষ। আমরা যেখানেই বাস করি না কেন; সেখানকার সমৃদ্ধি, শান্তি ও শৃঙ্খলার উন্নয়নে যথাসম্ভব ভূমিকা পালন করা মুসলিম হিসেবে আমাদের অন্যতম দায়িত্ব।
ইউসুফ (আ) যখন মিশরে আসলেন, তখন তিনি নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী সেখানকার মানুষ ও রাষ্ট্রের কল্যাণ সাধনে সচেষ্ট ছিলেন। অন্যায়ভাবে দীর্ঘদিন কারাবন্দী থাকার পরও তিনি তাদের ক্ষতি করার কথা ভাবেননি। তাঁর প্রতি কৃত অন্যায় ভুলে গিয়ে তিনি সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছিলেন।
[আরো পড়ুন: রাজনীতির সাথে মুসলমানদের সম্পর্ক]
পাশ্চাত্যে বসবাসকারী মুসলমানরা নিঃসন্দেহে ইসলামের প্রতিনিধি। কিন্তু একইসাথে তারা পাশ্চাত্য সমাজেরও অংশ। ফলে সমাজের সমৃদ্ধি, শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা তাদের দায়িত্ব। কিন্তু বাস্তবে মুসলমানরা এসব বিষয় গুলিয়ে ফেলে। তারা রাজনীতি করতে গিয়ে দেশের রাজনীতিকে ‘ইসলামী রাজনীতিতে’ পরিণত করার চেষ্টা করে।
মুসলমানদেরকে বরং শান্তি, শৃঙ্খলা ও সমৃদ্ধ সমাজ গঠন; শিক্ষাক্ষেত্রের উন্নয়ন, সমাজের বয়স্ক মানুষদের কল্যাণে কাজ করতে হবে। এক কথায় সমাজের যে কারো যে কোনো সমস্যায় এগিয়ে আসতে হবে। মুসলিমরা যদি ইসলাম ও মুসলিমদের সাথে সম্পর্কিত বিষয় ছাড়া বাকি সব ক্ষেত্রে নীরব ভূমিকা পালন করে, তাহলে এই রাজনীতি কখনোই সফল হবে না। কারণ, সমাজ দাঁড়িয়ে আছে জাতীয়তাবাদের উপর, যা মূলত নির্দিষ্ট ভূমি ও সেখানে বসবাসকারী মানুষের সাথে সম্পর্কিত। তাই এটি রাজনীতির ভিত্তি হওয়া উচিত। ধর্মের উপর ভিত্তি করে পরিচালিত যে কোনো রাজনীতি ব্যর্থ হতে বাধ্য।
অনেক মুসলমান এই বিষয়টি উপলব্ধি করে না। মুসলমানদেরকে বুঝতে হবে যে তারা সমাজের সমগ্র নয়, বরং অংশ। ফলে সর্বসাধারণে স্বার্থের বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে অন্যদেরকে সাথে নিয়ে কাজ করতে হবে। আর কোনো কিছু সমাজের জন্য ক্ষতিকর মনে হলে স্পষ্টভাবে বলতে হবে— এই এই কারণে এটি সমাজের জন্য ক্ষতিকর, তাই আমরা এর পক্ষে নই। ‘ইসলামে সুদ হারাম, তাই আমরা এটি সমর্থন করি না’— স্রেফ এভাবে বলবেন না। এভাবে বলার মাধ্যমে লোকজনের মনে এই ধারণাই বদ্ধমূল করে দিচ্ছেন যে আপনি রাজনীতিকে ধর্মীয় বিষয়ে পরিণত করতে চাচ্ছেন। তাই অপ্রয়োজনে ধর্মীয় শব্দ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা দরকার। বরং সুদ কেন সমাজের জন্য ক্ষতিকর, সুদবিহীন অর্থব্যবস্থার মাধ্যমে সমাজ কীভাবে আরো বেশি সমৃদ্ধ হতে পারে, পারস্পরিক সহযোগিতা ও ভালোবাসার মাধ্যমে কীভাবে উপকৃত হওয়া সম্ভব, সেগুলো ব্যাখ্যা করুন। মুসলমানদেরকে আসলে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। আমরা বাস্তবে অনেক বেশি অলস। আমরা শুধু অন্যদের কাছ থেকে আইডিয়া ধার করে সেগুলোর ‘ইসলামীকরণ’ করতে চাই। এটি কখনোই টেকসই কোনো পদ্ধতি নয়। আমাদের নিজেদেরকে নতুন আইডিয়া বের করতে হবে।
বর্তমান বাস্তবতায় মুসলিম দেশগুলোর জন্য সেক্যুলারিজমকে গ্রহণ করে নেয়াই সবচেয়ে ভালো
ইয়াসির ক্বাদী: এটা তো গেলো মুসলিম সংখ্যালঘুদের করণীয় প্রসঙ্গে। কিন্তু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে আমরা দেখি— সেখানকার নানান ধারার ইসলামী আন্দোলনগুলো প্রথমত একটি রাজনৈতিক ভিত তৈরি করতে চায়। তারা রাজনৈতিক ইসলাম তথা ইসলামী মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এ বিষয়ে তো আপনি বেশ কয়েকটা লেকচার দিয়েছেন। রাষ্ট্রক্ষমতা লাভ করাকে যারা সংস্কারের পূর্বশর্ত মনে করে, তাদের ব্যাপারে আপনার মতামত কী?
আকরাম নদভী: আমি মনে করি, কোনো রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থা সেখানকার সামাজিক মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। যেমন: বৃটিশ রাজনীতি গড়ে ওঠবে বৃটিশ মূল্যবোধের ভিত্তিতে। অন্যদিকে, ইসলামের মূল্যবোধ হলো মূলত ঈমান। কিন্তু মুসলিম দেশগুলোতে এই মূল্যবোধ বলতে গেলে নেই, কিংবা থাকলেও ততটা শক্তিশালী নয়। ঈমানী মূল্যবোধগুলো সামাজিকভাবে পূর্ণ সক্রিয় হওয়ার আগেই যদি আপনি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলাম নিয়ে আসেন, তখন সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হবে। এর মাধ্যমে মুসলমানরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়বে। এক দল চাইবে ইসলাম প্রতিষ্ঠা হোক, আরেক দল তা চাইবে না। এই পরিস্থিতি সৃষ্টির কারণ হলো, সমাজে ইসলামী মূল্যবোধগুলোর চর্চা নেই।
[আরো পড়ুন: ইসলামী শরীয়াহ বাস্তবায়নে ক্রমধারার অপরিহার্যতা]
ইসলামী রাজনীতি নিয়ে আমি দীর্ঘদিন ধরে পাঠদান করি। এ সংক্রান্ত আমার কথাবার্তার সারসংক্ষেপ শুনে লোকেরা চমকে ওঠে। আমার মতে, বর্তমান বাস্তবতায় মুসলিম দেশগুলোর জন্য সেক্যুলারিজমকে গ্রহণ করে নেয়াই সবচেয়ে ভালো। কারণ, প্রকৃত সেক্যুলার রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারলে প্রত্যেক নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ তৈরি হবে। এতে করে ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মগুলোও সমান সুযোগ পাবে। ফলে মুসলমানরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে। এই ধরনের স্বাধীনতা এখন মুসলিম দেশগুলোতে নেই। যেসব মুসলিম দেশে এখন সেক্যুলারিজম আছে, সেগুলো সত্যিকার অর্থে সেক্যুলার নয়, বরং এন্টি-সেক্যুলার। তারা স্বাধীনতা দেওয়ার পরিবর্তে স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে। ‘সেক্যুলারিজম’ পরিভাষাটা ব্যবহার করলেও তারা প্রকৃত সেক্যুলার নয়।
মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে যদি ইউরোপ বা আমেরিকার মতো করে সেক্যুলারিজম থাকতো, তাহলে মুসলমানরাই বেশি উপকৃত হতো। পাকিস্তানের কথাই ধরুন। পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী ছিলো? ব্রিটিশদের কবল থেকে মুক্ত হওয়া, খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা। তখনকার লেখাজোখা পড়লে দেখতে পাবেন, লোকেরা কী পরিমাণ ব্রিটিশবিরোধী ছিলো। কিন্তু এখন যদি পাকিস্তানের লোকদের বলেন, আপনাকে ইংল্যান্ডে বসবাসের সুযোগ দেওয়া হবে, তাহলে কেউ পাকিস্তানে থাকতে চাইবে না। তাদের পূর্বপুরুষরা ব্রিটিশদের নিকট থেকে স্বাধীনতা অর্জন করতে যেখানে সর্বপ্রকার ত্যাগ স্বীকার করেছিলো, সেখানে তাদের নাতিপুতিরা ইংল্যান্ডে এসে স্যাটেল হওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে কেন? কারণ, লোকেরা আসলে ‘ইসলাম’ চায় না। তারা সমাজে শান্তি, শৃঙ্খলা ও সমৃদ্ধি চায়, নিজেদের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে চায়। আপনার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য তারা প্রস্তুত নয়। তাই তাদের চাওয়াগুলো নিশ্চিত না করে কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে চাইলে আপনি ব্যর্থ হবেন।
তাই মুসলিম দেশগুলোর জনগণের এসব চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা আগে করতে হবে। তারপর আপনি যদি কঠোর পরিশ্রম করতে পারেন, তাহলে ভবিষ্যতে হয়তো কোনো পরিবর্তন আসতে পারে।
[আরো পড়ুন: সেক্যুলারিজম, ধর্ম ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক]
ইয়াসির ক্বাদী: আমি বিনয়ের সাথে কথাটা পুনরায় বলতে চাই। সংলঘু মুসলমানদের করণীয় সম্পর্কে আপনার মতামতটি বোধগম্য। কিন্তু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের ব্যাপারে আপনি যা বললেন, তাতে কেউ আপনাকে জিজ্ঞেস করতেই পারে, শরীয়তের নৈতিক বন্ধন থেকে দেশের বিদ্যমান আইন-কানুনগুলোর বিচ্ছেদ ঘটানো কীভাবে সম্ভব? উদাহরণ হিসেবে মদ্যপান, এলকোহল ইত্যাদির কথা বলা যায়। মুসলিম দেশগুলোতে এসব আইনের মূলসূত্র নিঃসন্দেহে শরীয়াহ। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?
আকরাম নদভী: একটু আগে আমি বলেছি, ইসলামের ভিত্তি হলো ইসলামী মূল্যবোধ। মুসলিম দেশগুলোতে এখন সেই মূল্যবোধগুলো নেই। যখন আপনি শরীয়তের আইনগুলো কার্যকর করতে যাবেন, তখন আসলে কী ঘটবে? সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হবে। যা বাস্তবে লোকজনের জন্য ক্ষতিকর হবে। বিপ্লব-প্রতিবিপ্লব সংঘঠিত হবে। একের পর এক শাসক আসবে-যাবে। স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় মানুষ কয়েক যুগ পিছিয়ে পড়বে।
তাহলে লোকজনের জন্য প্রথমে দরকার হলো যথাযথ স্বাধীনতা, যাতে করে লোকেরা ইসলাম শিখতে পারে, ইসলাম সম্পর্কে স্টাডি করতে পারে। তারপর ভবিষ্যতে লোকেরা ভালো ঈমানদার হিসেবে গড়ে উঠলে তখন হয়তো তারা রাষ্ট্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চাইবে। সেটা ঠিক আছে। কিন্তু বর্তমানে লোকেরা তো সেটা চাচ্ছে না। জিয়াউল হককে (পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট) তো চিনেন। আর্মি অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় তিনি ভাবতেন, ক্ষমতায় আসতে পারলে ইসলাম কায়েম করবেন। পরে ক্ষমতা লাভের পর এক বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, “আর্মিতে থাকার সময় মনে করতাম, মূল দ্বন্দ্ব হলো ইসলাম ও কুফরের মধ্যে। এখন ক্ষমতায় এসে ইসলামকে নিয়ে আসতে চাচ্ছি। কিন্তু দেখছি দ্বন্দ্বটা আসলে এক ইসলামের সাথে আরও সত্তুর রকম ইসলামের!”
তাহলে আপনার সামনে কোনো পথ খোলা নেই আসলে। ১০/২০ জন লোক নিয়ে তো আপনি কিছু করতে পারবেন না। মিশরে প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছিলো? ক্যামব্রিজে আমি একটি বক্তৃতায় বলেছিলাম, এখনই রাজনীতিতে আসতে চাওয়া মুসলিম ব্রাদারহুডের কাজ নয়। তাদের এখনো রাজনীতি থেকে দূরত্ব বজায় রাখার নীতি মেনে চলা উচিত। সামাজিক ও শিক্ষাক্ষেত্রের সংস্কার নিয়েই তাদের থাকা উচিত। রাজনীতিতে আসার জন্য তাদের আরো অপেক্ষা করা প্রয়োজন। বিদ্যমান সমাজ তাদেরকে রাজনীতির ময়দানে দেখতে এখনো প্রস্তুত নয়। কিন্তু লোকেরা দেখলো, তারা ফ্রন্ট লাইনে চলে এসে বিপ্লবের নেতৃত্ব গ্রহণ করলো। ব্রাদারহুড বুঝতে পারেনি যে মুক্তি লাভের জন্য ব্রাদারহুডকে মেনে নিলেও তাদের আর্দশ লোকেরা চায় না।
ইয়াসির ক্বাদী: ঐতিহাসিকভাবে এমনটি কখনোই সম্ভব হয়নি এবং সাধারণ লোকদের ঈমানের স্তর কোনো সময় এতটা উপরে ছিলো না। তাহলে কেন আপনি এই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন, সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট জবাব দেবেন কি?
আকরাম নদভী: হ্যাঁ; কারণ, এটি করতে গেলে সমাজে অস্থিরতা তৈরি হবে। সোজা কথায়, আপনি মানুষের উপর এমন কোনো আইন চাপিয়ে দিতে পারেন না, যা তারা চায় না। লোকেরা এ ধরনের আইনের জন্য প্রস্তুত নয়। আপনি জানেন, পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের পেছনে লড়াই-সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এই পর্যায়গুলো অতিক্রম না করা পর্যন্ত আমাদের জন্যও সেই সময়টা আসবে না। লোকজন ইসলাম চায় না। হয়তোবা তারা নামের ইসলাম চায়। তবে ইসলামের বিস্তারিত বিষয়গুলো কেউ চায় না।
ইসলামিক ফাইন্যান্সের সমস্যা
ইয়াসির ক্বাদী: আমি জানি আপনার আগ্রহের একটি বিষয় হলো ইসলামিক ফাইন্যান্স। এ বিষয়ের উপর আপনি প্রায়ই কথা বলে থাকেন। ইসলামিক ফাইন্যান্স নিয়ে আপনার কিছু সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। আমাদের শ্রোতাদের জন্য এ ব্যাপারে সংক্ষেপে যদি বলতেন। এর পাশাপাশি, আমেরিকা বা ইংল্যান্ডে বাড়িঘর বানানোর জন্য মুসলমানদের লোন নেয়াসহ আনুষঙ্গিক ব্যাপারগুলোকে আপনি কীভাবে দেখেন?
আকরাম নদভী: বর্তমানে বিশ্বব্যবস্থা যেভাবে চলছে, তাতে সমাজকে সম্পূর্ণভাবে ইসলামী সমাজ হিসেবে গড়ে তুলা প্রায় অসম্ভব। ইসলামিক ফাইন্যান্স হলো ইসলামী অর্থনীতির একটি অংশ। আর ইসলামী অর্থনীতির ভিত্তি হলো ইসলামী মূল্যবোধভিত্তিক সমাজ। ফিকাহর গ্রন্থগুলো পর্যালোচনা করলে আমরা স্পষ্টতই বুঝতে পারি, ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তি হলো পারস্পরিক সহযোগিতা। মুদারাবা, মুশারাকা, ইজারা, মুরাবাহা, ইসতিসনা ইত্যাদি যাবতীয় পদ্ধতি সমাজের দুর্বল ও গরীব মানুষের সুবিধার জন্য করা হয়েছে।
অন্যদিকে, পাশ্চাত্য অর্থব্যবস্থার মূল ধারণাই হলো প্রতিযোগিতা। এদিক থেকে দুটি অর্থব্যবস্থা দুই রকম। এখন পাশ্চাত্য অর্থব্যবস্থার মধ্যে যদি আপনি ইসলামকে নিয়ে আসতে চান, তাহলে তা কখনোই খাপ খাবে না। পরিতাপের বিষয় হলো, আমরা ইসলামী সমাজ গড়ে তুলতে চাই না, ইসলামী রাষ্ট্র চাই না, ইসলামী অর্থনীতি চাই না, আমরা শুধু ইসলামী ফাইন্যান্স চাই! পাশ্চাত্য থেকে আইডিয়া নিয়ে এর সাথে কিছু ইসলামী পরিভাষা জুড়ে দিয়ে ইসলামীকরণ করে ফেলা হচ্ছে! এসব কাজে যুক্ত কাউকে কাউকে জিজ্ঞেস করে জবাব পেয়েছি, এর মাধ্যমে ৭০/৮০ ভাগ ইসলাম তো হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, বাকি ২০ ভাগের কথা কেউ বলে না।
লোকেরা শুধু কিছু ইসলামী পরিভাষা ব্যবহার করছে। বাস্তবে ইসলামী ব্যাংক আর প্রচলিত ব্যাংকগুলোর মাঝে পার্থক্য নেই। উভয় ব্যবস্থার প্রফেশনাল এথিকসের বেঞ্চমার্ক একই রকম। এ কারণেই পাশ্চাত্যের ব্যাংকগুলো ইসলামিক ব্যাংকিং শাখা চালু করেছে। তারা কেন ইসলামের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠলো? কারণ, তাদের কাছে উভয় ব্যবস্থার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তাদের দৃষ্টিতে, প্রচলিত ইসলামিক ফাইন্যান্স পুঁজিবাদেরই একটি প্রশাখা (offshoot) মাত্র।
এ কারণেই পাকিস্তানের গরীব অঞ্চলগুলোতে আপনি কোনো ইসলামী ব্যাংক খুঁজে পাবেন না, এগুলোর অবস্থান স্বচ্ছল অঞ্চলগুলোতে। মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রোডলারের আনুকূল্য পাওয়ার পর থেকেই কেবল ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থা ফুলেফেঁপে উঠতে পেরেছে। এটি মূলত পেট্রোডলার মালিকদের আইডিয়া। এটি ধনীদেরকে আরো ধনী করে তুলেছে। মুবারাহা, ইজারা, মুজারা’আ, ইসতিসনাসহ ফিকাহের মাঝে যত ব্যতিক্রমী নিয়ম আছে, সেগুলো সব সমাজের অসহায় ও গরীব মানুষের জন্য। এর বাইরে এসবের ব্যবহার হারাম হওয়া উচিত। কিন্তু এখন এই পরিভাষাগুলো ব্যবহার করে ধনীদেরকে আরো ধনী বানানো হচ্ছে। গরীবদের জন্য এগুলো কোনো কাজে আসছে না। এটাই হলো বাস্তবতা।
আমার মতামত হলো, আমরা যদি সত্যিকার অর্থেই ইসলামিক ফাইন্যান্স চাই, তাহলে কেবল দুটি রাস্তা রয়েছে: হয় মুশারাকা, নয়তো মুদারাবা। এর বাইরে বাকি যা চালু আছে সবই বিভিন্ন রকম সূক্ষ্ম ছলচাতুরী। সত্য কথা হলো, ইসলামিক ফাইন্যান্স বলতে কোনো কিছুর অস্তিত্ব এখন মোটেও নেই। যা আছে বলে দাবি করা হয়, সেগুলো মূলত ছলচাতুরী। লোকেরা গভীরভাবে তলিয়ে দেখলেই ব্যাপারটা বুঝতে পারবে।
[আরো পড়ুন: ইসলামিক ফাইন্যান্স: কল্পকথা বনাম বাস্তবতা]
ইয়াসির ক্বাদী: অবস্থা যদি এমনটা হয়ে থাকে, তাহলে গৃহঋণ বা অন্যান্য ব্যাংকিং কার্যক্রমের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের করণীয় কী?
আকরাম নদভী: আমরা জানি, অগত্যা পরিস্থিতিতে হারাম বিষয়ও হালাল হতে পারে। ইসলামী আইনের প্রেক্ষাপট খেয়াল করলে আপনি দেখবেন, নবীজির (সা) যুগে যতক্ষণ পর্যন্ত মুসলমানদের মাঝে কোনো একটি বিধান পালনের সক্ষমতা তৈরি হয়নি, ততক্ষণ তা আবশ্যক করা হয়নি। বিধানটি পালনের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হওয়ার পরই কেবল তা কার্যকর হয়েছে। সময়ের পরিক্রমায় বাস্তবতা হলো, পাশ্চাত্যে বাড়ি কেনার জন্য মুসলমানদের জন্য বিকল্প কোনো পথ খোলা নেই। ‘ইসলামিক ফাইন্যান্স’ অনেক বেশি ব্যয়বহুল এবং সেবার মানও খারাপ। আর প্রচলিত পদ্ধতিতে সবচেয়ে ভালো উপায় হলো মর্টগেজ নেয়া।
লোকেরা আমাকে শুধু মর্টগেজ সম্পর্কে প্রশ্ন করে। আমি তাদেরকে বলি, আপনারা কি গাড়ি কেনেন না? অনেকের তো ৩/৪টা করে গাড়ি আছে। গাড়ি কেনার জন্য তো ইনস্যুরেন্স থাকা লাগে। প্রচলিত ইনস্যুরেন্স মূলত হারাম। সেটা কেন তাহলে মেনে নেন? লোকেরা তখন জবাব দেয়, সেটা তো দরকারী। আমি বলি, বাড়ি তো গাড়ির চেয়েও বেশি দরকারী। কিস্তির সব টাকা পরিশোধ করতে পারলে একদিন আপনি বাড়িটির মালিক হয়ে যাবেন। আপনার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সেখানে থাকতে পারবে। আর নয়তো আজকে এখানে, কালকে সেখানে ভাড়া বাসায় থাকতে হবে। বাড়ির মালিক যে কোনো সময় বাসা ছাড়ার নোটিশ দিয়ে দিতে পারে। তাই পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে প্রচলিত মর্টগেজের মাধ্যমে মুসলমানরা বাড়ি কিনতে পারবে বলে আমি মনে করি।
ইয়াসির ক্বাদী: তবে ভাড়া দেওয়া বা মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে এ ধরনের বাড়ি ক্রয় জায়েজ হবে না। তাই না?
আকরাম নদভী: হ্যাঁ, ব্যবসা করার জন্য তো নানা পথ খোলা আছে। তাই আমি ব্যবসার জন্য সুদের ব্যবহারকে সাধারণত অনুমোদন করবো না।
সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তির দ্বীন শিক্ষার উপায়
ইয়াসির ক্বাদী: সর্বশেষ যেই প্রশ্নটা করতে চাই তা হলো, পাশ্চাত্যের মুসলমানদের জ্ঞানার্জনের উপায় প্রসঙ্গে আপনার উপদেশ কী? কোন বিষয়গুলোর উপর জোর দেওয়া দরকার, সেই বিষয়গুলো আয়ত্ব করতে কীভাবে অধ্যয়ন করা উচিত— এসব বিষয়ে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ কী হতে পারে?
আকরাম নদভী: এক্ষেত্রে দুই ধরনের মানুষ পাওয়া যাবে। প্রথমত: ইতোমধ্যে যাদের বয়স বেশি হয়ে গেছে, যাদের পক্ষে নতুন করে ভাষা শেখার সুযোগ নেই। তাদের জন্য আমার পরামর্শ হলো, তাদের উচিত অন্তত কোরআন পড়া। সমস্যা হলো, লোকেরা কোরআনকে পবিত্র ঐশীগ্রন্থ বিবেচনা করে সম্মানার্থে ছুঁয়েও দেখে না। অথচ এটি প্রায়োগিক ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়েছে। তাই লোকদেরকে কোরআনের কাছে ফিরে আসতে হবে। তাহলে মুসলিম সমাজে বিদ্যমান বিভিন্ন মতপার্থক্য অনেকটা কমে আসবে। হেদায়েত লাভের জন্য কোরআনই হচ্ছে একমাত্র উপায়। আপনি যদি আরবী ভাষা না জানেন বা নতুন করে শেখার সুযোগ না থাকে, তাহলে আমার পরামর্শ হলো— কোরআনের একটি ভালো অনুবাদ পড়ুন। প্রথমবার পড়ে আপনি হয়তো ভালো করে বুঝবেন না। এটাই স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার, এমনকি তৃতীয়বার পড়ুন। উত্তরাধিকার সম্পত্তির বিধান এবং এ জাতীয় কিছু কিছু আয়াত বুঝার জন্য হয়তো আপনাকে বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। কিন্তু এর বাইরে জান্নাত-জাহান্নামের আলোচনা, দান ও সদকা করার গুরুত্ব, প্রতিবেশীকে সাহায্য করা, মানুষের উপকার করা, নারীদেরকে সম্মান করা ইত্যাদি অনেক বিষয় আছে, যেগুলোর ব্যাপারে কোরআনের কথাবার্তা অত্যন্ত স্পষ্ট। যে কেউ এসব আয়াত পড়ে বুঝতে পারবে। ফলে আরবী ভাষা না জানলেও চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। অনুবাদ পড়েও আপনি কোরআনের শিক্ষা নিতে পারেন।
দ্বিতীয়ত: যারা বয়সে তরুণ এবং যারা এই দ্বীনকে গভীরভাবে জানতে আগ্রহী, তাদেরকে আমি আরবী ভাষার শেখার পেছনে সময় দিতে বলবো। মানুষ তো দুনিয়াবী স্বার্থেও নানা ভাষা শেখে। আর ইসলাম তো আপনার ধর্ম। তাই ২/৩ বছর সময় দিয়ে ভালো করে আরবী ভাষা শিখুন। এর ফলে আপনি কোরআন, হাদীস, ফিকাহ ও ইসলামের ইতিহাসের বইগুলো সরাসরি আরবী ভাষায় পড়তে পারবেন। মূল ভাষায় দ্বীনের জ্ঞান অর্জনের সুযোগ নিশ্চয় বেশি উপকারী। জ্ঞানের মূল উৎস থেকে সরাসরি পড়তে পারলে আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন কোনটা ভালো। আর নয়তো আপনাকে অন্যদের ব্যাখ্যার ওপর নির্ভর করতে হবে।
লোকেরা তাকলীদ করাকে পছন্দ করে। কিন্তু কোরআন-সুন্নাহর মাঝে তাকলীদের কথা কখনো বলা হয়নি। ইসলামে বলা হয়েছে ইত্তেবার কথা। তাকলীদ হলো না জেনে, না বুঝে অন্ধভাবে অনুসরণ করা। আর ইত্তেবা হলো জেনে-বুঝে কারো কথা মানা। মানুষের জন্য তাকলীদ নয়, ইত্তেবা হলো মানানসই। স্বভাবতই সবাই সব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হবে না। কিন্তু আমার তো একটি মন আছে। ফলে কোন প্রক্রিয়ায় একজন বিশেষজ্ঞ একটি সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন, সেটুকু অন্ততপক্ষে আমার বুঝতে পারার কথা। এ কারণেই ইমাম আবু হানিফা এবং ইমাম আবু ইউসুফ উভয়েই বলেছেন, ‘লোকেরা যদি কোনো বিষয়ে আমাদের দলীল ও যুক্তিগুলো না বোঝে তাহলে সে বিষয়ে আমাদের মতামত তাদের অনুসরণ করা উচিত হবে না।’ ইমাম আবু হানিফা বলতেন, ‘এই বিষয়ে আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি, কেউ যদি এরচেয়ে ভালো সমাধান দিতে পারে তাহলে আমার পরিবর্তে তাকেই অনুসরণ করুন।’
প্রকৃতপক্ষে এই কাজটাই আমাদেরকে করতে হবে। কাউকে অন্ধভাবে অনুসরণের পরিবর্তে তার বক্তব্যকে বুঝার চেষ্টা করতে হবে। একজন ফকীহ সাধারণত একটি নির্দিষ্ট পরিস্থিতি বা অবস্থার আলোকে ফতোয়া দেন। কিন্তু আপনার সমকালীন পরিবেশ ও প্রেক্ষাপট তো ইতোমধ্যে পরিবর্তন হয়ে গেছে। হতে পারে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে প্রদত্ত ফতোয়াটি আপনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
এ জন্য মূল উৎসের দিকে লোকদের ফিরে আসা প্রয়োজন। এবং এর জন্য সর্বোত্তম পথ হলো আরবী ভাষার উপর দখল থাকা, যেহেতু এটি কোরআন-সুন্নাহর ভাষা। অনুবাদ পড়লে আপনি সবসময় সঠিক ব্যাখ্যাটি করতে পারবেন না। আর আরবী জানলে ইসলাম সম্পর্কে আপনার বুঝাপড়া আরো বেশি শানিত হবে এবং আত্মবিশ্বাসও বাড়বে।
ইয়াসির ক্বাদী: আপনার সাথে চমৎকার একটা সময় কাটলো। ভবিষ্যতে এ রকম আরো কয়েকটি সাক্ষাৎকার আপনার কাছ থেকে নেবো ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তায়ালা আপনার ঈমান, তাকওয়া ও উপকারী জ্ঞান বাড়িয়ে দিন। আপনার জীবন, সম্পদ, স্বাস্থ্য এবং পরিবারকে তিনি বরকতময় করে দিন। মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে সঠিক পথে রাখুন এবং এর মাধ্যমে অন্যদেরকেও সঠিক পথ দান করুন। সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন। আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ।
আকরাম নদভী: ওয়া আলাইকুম আসসালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ।
টিকা-টিপ্পনী:
[1] বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় রাসূলের (সা) নবুয়ত লাভের পাঁচ বছর আগে কাবা ঘর পুননির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কাবার উত্তরাংশ তথা হাতিমের অংশ নির্মাণের দায়িত্ব ছিলো আদি বিন কাব বিন লুওয়াই গোত্রের। কিন্তু পূর্ব শর্তানুযায়ী হালাল অর্থের ঘাটতি থাকায় তারা এটুকু নির্মাণে ব্যর্থ হয়। ফলে ইবরাহীম (আ) কর্তৃক নির্মিত কাবার ওই অংশটুকু হাতিম বা পরিত্যক্ত হিসেবে পরিচিতি পায়। মক্কা বিজয়ের পর হাতিমসহ কাবা পুনর্নিমাণ করার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মক্কার নওমুসলিম নেতাদের প্রতিক্রিয়ার আশংকায় মহানবী (সা) এ থেকে বিরত থাকেন। — অনুবাদক
[2] যে সূত্র ও বর্ণনা পরম্পরায় হাদীসটি সর্বশেষ বর্ণনাকারী পর্যন্ত পৌঁছেছে তাকে সনদ বা ইসনাদ বলা হয়। — অনুবাদক
[3] ফাতিমা আল-ফিহরী নামের একজন নারী ৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে মরক্কোর ফেজ শহরে কারভীন মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন। মুসলিম সমাজে অতীতে মসজিদ নিছক নামাজ আদায়ের স্থানই ছিলো না; বরং একইসাথে তা শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহৃত হতো। এই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় আল-কারভীনও প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বর্তমানে এটিকে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে রূপান্তর করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এখন অব্দি চালু থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। — অনুবাদক