ইসলামী শরীয়াহ বাস্তবায়নে ক্রমধারার অপরিহার্যতা

[চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহকর্মীর সাথে গত ১০ নভেম্বর, ২০১০ তারিখে এসই-২৮ নং বাসায় বিকেল বেলা ইসলামী শরীয়াহ বাস্তবায়নে ক্রমধারার অপরিহার্যতা প্রসঙ্গে আলাপ করছিলাম। কথা বলার সময় ডিজিটাল ভয়েস রেকর্ডার অন করে রেখেছিলাম। বহুবার নিজেই রেকর্ডটা শুনেছি। সাধ্যমত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ আলেমদের সাথে এ বিষয়ে কথা বলেছি। এরপরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের প্রফেসর ড. আ.ক.ম. আবদুল কাদেরের সাথে কয়েক দফায় দীর্ঘ আলাপ করেছি। এক পর্যায়ে তিনি প্রতিপাদ্য বিষয়ের সমর্থনে মুহাম্মদ আল গাযালীর ‘কাইফা নাতাআমালু মায়াল কোরআন’ বইটা হতে আমাকে ঘন্টাখানেক পড়ে শোনান। ভাবলাম নেটেও অন্যদের সাথে বিষয়টা শেয়ার করি। লেখাটি ইতোপূর্বে সোনার বাংলাদেশ ব্লগে প্রকাশিত হয়েছিল। মন্তব্যসহ মূল লেখাটি পড়তে ভিজিট করুন এই লিংকে। আলোচনাটির সারসংক্ষেপ পাবেন এখানে।]

*****

কনসেপ্ট অব গ্রাজুয়্যলিটি হলো একটি সহজ কিন্তু গভীরভাবে তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তর। এটি একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও তাত্ত্বিক বিষয়। আমি এই প্রশ্নের এক ধরনের জবাব দিয়েছি এবং যে কেউ এর কোনো সম্ভাব্য ও যুক্তিসংগত উত্তর দিতে পারে।

‘আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে তোমাদের জন্য সম্পূর্ণ করে দিয়েছি এবং আমার নিয়ামত তোমাদের প্রতি পূর্ণ করেছি, আর ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে কবুল করে নিয়েছি।’ [সূরা মায়েদা: ৩]

বিদায় হজ্বের সময়ে পবিত্র কোরআনের এই আয়াত নাযিল হওয়ার পূর্বে দ্বীন বা জীবনাদর্শ হিসেবে ইসলাম কি কমপ্লিট ছিল না? ‘… আজ পরিপূর্ণ করা হলো …’ এর মানে এই নয় কি যে বিষয়টি ইতোপূর্বে কমপ্লিট ছিল না?

যদি তাই হয়, অর্থাৎ তৎপূর্বে তা পূর্ণ বা কমপ্লিট না হয়ে থাকে তাহলে এর প্রাথমিক পর্যায়ে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাঁরা কি ‘অ-পূর্ণ ইসলামের’ উপর মৃত্যুবরণ করেছেন? যদি বলা হয়, তাঁদের ঈমান-ইসলাম সবই পরিপূর্ণ ছিল তাহলে today it has been completed বলতে কি বোঝানো হয়েছে? আর যদি বলা হয়, তাঁদের ইসলাম পূর্ণ ছিল অথচ তখনও ইসলামী বিধি-বিধান প্রবর্তন সমাপ্ত বা সুসম্পন্ন হয় নাই! তাঁরা তাঁদের সময়কালে যতটুকু পেয়েছিলেন তা তৎপরবর্তীর তুলনায় ইনকমপ্লিট ছিল। বিধি-বিধানের দিক থেকে তাঁদের সময়ে যতটুকু ইসলাম ছিল সেটা কি তাঁদের জন্যে বিশেষভাবে কমপ্লিট ছিল? নাকি সব সময়ের জন্যেও কমপ্লিট ছিল?

ধরা যাক, কোনো একজন আমল করার সুযোগ পেয়েছেন শতকরা ৫০ ভাগ বিধি-বিধানের। বাদবাকি ৫০ ভাগের উপর আমল করার সুযোগ পাননি। এখন ঐ ৫০ ভাগকে তাঁর জন্য ১০০ ভাগ হিসেবে ধরে নেওয়া হচ্ছে? নাকি ঐ ৫০ ভাগ এবং পরবর্তী ১০০ ভাগ এই দুইটারই সমান মর্যাদা? হতে পারে তাঁরা যতটুকু পেয়েছেন, ধরুন তা শতকরা ৫০ ভাগ, তার বাইরের অপর অংশটুকু তাঁদের জন্যে একটা বিশেষ ফেভার হিসেবে exemption করা হয়েছে। যদি তা exemption না হয় তাহলে বলতে হবে যে আসলে দুটোই মূলত একই। শুধু প্রায়োগিক বিধি-বিধানের দিক থেকে কোনোটাকে কম expand করা হয়েছে, আর কোনোটাকে more expand হয়েছে। কোনো ইলাস্টিককে যেমন আমরা ৫ সেন্টিমিটার লম্বা করতে পারি, আবার সেটিকে সর্বোচ্চ ১০ সেন্টিমিটারও লম্বা করতে পারি। উভয় অবস্থাতেই সেটি একই রাবার হিসেবে থাকছে। তাই না?

তাহলে which Islam is the complete Islam?

আমরা দেখি ইসলামের তিনটা মেজর পর্যায় রয়েছে:

(১) প্রথম ১৩ বছরে মক্কার যে ইসলাম তা ছিল মূলত কনসেপচুয়্যল এবং বিধিবিধানের দিক থেকে almost the same।

(২) মদিনার প্রথম পিরিয়ডে বিস্তারিত বিধিবিধানের প্রবর্তন মোটামুটি শুরু হয়েছে এবং

(৩) মাদানী যুগের শেষের দিকে তা কমপ্লিট হয়েছে।

বিধিবিধানের দিক থেকে এই তিনটা পর্যায় স্পষ্টতই তিন প্রকারের। যারা মক্কী বা প্রাথমিক মাদানী যুগে মৃত্যুবরণ করেছেন, তাঁরা তো পরবর্তী সময়ে প্রবর্তিত অনেকগুলো বিধি-বিধানের উপর আমল করার সুযোগই পাননি। তৎসত্ত্বেও তাঁদের ঈমান ও ইসলাম যদি কমপ্লিটই থাকে তাহলে তাঁরা কি কোনো বিশেষ ছাড় বা exemption পেয়েছেন? অবশ্য এমন কোনো কথা কুরআন ও হাদিসের কোথাও নাই যে ঈমান, ইসলাম বা ইসলামের কোনো দিক থেকে উনাদের জন্য কোনো বিশেষ ছাড় ছিল।

তাহলে, ইসলাম জিনিসটা কী? রেফারেন্সের দিক থেকে দেখলে এটাকে একটা কনসেপ্ট দিয়েই সমন্বয় করতে হবে। ‘…আল ইয়াওমা আকমালতু লাকুম দ্বী-নাকুম …’ – এই আয়াতসহ কোরআনের সংশ্লিষ্ট আয়াতসমূহে বলা হয়েছে দ্বীন হলো ইসলাম। হাদীসে জিবরাইলে বলা হয়েছে ইসলাম হলো কালেমা, নামাজ, রোজা, যাকাত, হজ্ব – এই পাঁচটা বিষয়ের সমষ্টি। সূরা আশ শূরার ১৩নং আয়াতে বলা হয়েছে,

‘তিনি তোমাদের জন্য দ্বীনের সেই নিয়ম-বিধান নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন যার হুকুম তিনি নূহকে দিয়েছিলেন। আর যা এখন তোমার প্রতি আমরা অহীর সাহায্যে পাঠিয়েছি। আর যার হিদায়াত আমরা ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে দিয়েছিলাম – এই তাকীদ সহকারে যে, কায়েম কর এই দ্বীনকে এবং ইহাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেও না।’

তাহলে দেখা যাচ্ছে মানুষের দ্বীন বা জীবনব্যবস্থা বরাবর একই ছিল। তাই বলা যায়, history of Islam is the history of mankind । দুনিয়াতে আল্লাহ তায়ালা মানুষ পাঠানোর সাথে সাথে একটা জীবনবিধানও পাঠিয়েছেন। ইসলাম এই নামটা হযরত ইব্রাহীম (আ) দিয়েছেন – এই যা।

আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রাথমিক পর্যায়ের সাহাবীদের ক্ষেত্রে exemption-এর তত্ত্বটা খাটে না। কোরআন-হাদীসে এমন কোনো রেফারেন্স নেই। বরঞ্চ সবগুলো রেফারেন্স হচ্ছে এই মর্মে যে সবার একই মানদণ্ডে বিচার করা হবে। কাউকে বিশেষ কোনো সুবিধা বা রেয়াত দেয়া হবে না। রাসূল (সা) তাঁর ফুফু সাফিয়াকে (রা), তাঁর কন্যা ফাতিমাকে (রা) নাজাতের জন্য বেশি বেশি আমল করার কথা বলেছেন।

ইসলামের দুইটা দিক। একটা হলো এর কনসেপ্চুয়্যাল দিক, আর একটা হলো এর বাস্তবায়নের দিক। কনসেপ্টটা হলো all the same এবং total। এর মধ্যে কোনো বেশ-কম করা যাবে না। কনসেপ্টে কোনো ধরনের কম্প্রোমাইজের প্রস্তাবে রাসূল (সা) দ্বিমত পোষণ করে বলেছেন ‘আমার এক হাতে চাঁদ ও এক হাতে সূর্য এনে দিলেও আমি তোমাদের (সমঝোতার) প্রস্তাব মেনে নিবো না।’ তাই, সূরা কাফেরুনে যে সিঙ্গুলারিটির কথা বলা হয়েছে সেটি নিতান্তই কনসেপ্চুয়্যাল ইসলাম সম্পর্কিত।

অতএব, দ্বীন হিসেবে ইসলাম সর্বদাই সিঙ্গুলার। আর শরীয়াহ হিসেবে ইসলাম প্লুরাল ও ডাইভারসিফাইড। যদিও এই ডাইভারসিফিকেশনের মধ্যে একটা ইউনিফিকেশান আছে, বাউন্ডারি আছে। মদীনা সনদ স্বাক্ষরের অব্যবহিত পরে তৎকালীন ইয়াসরিব শহরে যে শাসন-কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা লাভ করে, সেটা কি ইসলামী রাষ্ট্র ছিল না? অথচ, ফতেহ মক্কার পরে যে ইসলামী রাষ্ট্র, সেটার চরিত্র আর রূপের সাথে প্রথম হিজরীর তৎকালীন ইয়াসরিব নগরীর সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার পার্থক্য অনেক। মনে করা হয়, Islamic state is a single entity, either it is established or it is not। আমার বিবেচনায়, ইসলামী সমাজ বা রাষ্ট্র কোনো single entity নয়। এর বিভিন্ন পর্যায় আছে। রাসূল (সা) বিদায় হজ্বে বলেছেন, আমি কী আমার দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি? সাহাবীরা বলেছেন, হ্যাঁ, আপনি পেরেছেন।

পলিটিক্যাল সায়েন্সে যেটাকে ইউটোপিয়া বলা হয়, ইসলামী রাষ্ট্র কি বাস্তবায়ন-অনুপযোগী ও কল্পনাপ্রসূত এমন এক ঐশ্বরিক আদর্শ রাষ্ট্র? এক কথায়, ইসলামী রাষ্ট্র কি একটা ইউটোপিয়া? বিষয়টা ব্যাখ্যাসাপেক্ষ। ইসলামিক ইউটোপিয়া মানে সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নতির সর্বোচ্চ ধাপ, যেটিতে আমরা পৌঁছার ও থাকার চেষ্টা করবো। আমরা যদি এ ধরনের কোনো রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে একে টেকসই অবস্থায় নিয়ে যেতে পারি তবুও মৌলিক গুণগত দিক থেকে সেটি তৎকালীন মদীনায় গড়ে উঠা রাষ্ট্রের মতো হবে না। কারণ, সেই রাষ্ট্রের প্রধান ছিলেন একজন নবী, মোহাম্মদ (সা), সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও সর্বশ্রেষ্ঠ স্টেটসম্যান। এই অর্থে কখনোই যেহেতু আমরা সেই মানের একটা আদর্শ ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করতে পারব না, তাই বর্তমান প্রেক্ষিতে একে এক ধরনের ইউটোপিয়া বলা যায়, যদিও সেটিকেই স্ট্যান্ডার্ড ধরে আমাদের এগুতে হবে।

বাস্তবায়নের ক্রমধারাকে (gradual implementation) আমরা যদি special sanction হিসেবে না ধরি, তাহলে আল্লাহর রাসূল (সা) যেভাবে তৎকালীন আরবে ইসলাম কায়েম করেছেন আমরাও আমাদের স্ব স্ব সমাজ ও দেশে সেভাবে ইসলাম কায়েমের চেষ্টা করব। এই সহজ কথাটার একটা ব্যাপক তাৎপর্য আছে। বিধি-বিধানের দিক থেকে মদীনার আদর্শ রাষ্ট্রকে পর্যায়ক্রমে গড়ে তোলা হয়েছে। যখনই নতুন কোনো বিধান দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট পূর্ববর্তী বিধানটা রহিত হয়ে গেছে। উপরের সর্বোচ্চ লেভেলে যেতে হলে আমাদেরকে মাঝখানের পথ পাড়ি দিয়েই যেতে হবে। প্রাইমারি, সেকেন্ডারি, ইন্টারমিডিয়েট ও ফাইনাল – যতগুলো পর্যায় আছে বা ছিল, এই সবগুলোকে একই ধারাবাহিকতায় পাড়ি দিয়ে উপরের লেভেলে পৌঁছতে হবে। সরাসরি জাম্প করা যাবে না।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, ইসলাম কায়েমের একটা হলো ডিডাক্টিভ মেথড আর একটা হলো ইনডাক্টিভ মেথড। রাসূল (সা) যেখানে রেখে গেছেন সেখান থেকে কোরআন-হাদীস পুরোপুরি তথা অখণ্ডভাবে আমরা পেয়েছি। আমরা কি প্রথমেই সর্বশেষটি দিয়ে শুরু করব? আমরা যদি শুরুতেই সর্বোচ্চ পর্যায়ের বিধানকে আমল করার কথা বলি তাহলে ক্যাপাসিটির বাইরে হওয়ার কারণে আমাদেরকে কিছু জিনিস ফেলে দিতে হবে। ফেলে দেওয়ার সময় হতে পারে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটা ফেলে দেয়া হয়েছে আর কম গুরুত্বপূর্ণগুলোকে তুলে নেয়া হয়েছে। আর যদি মনে করা হয়, আমরা সাধ্য মোতাবেক বহন করব। তখন যত কমই পারি না কেন যেটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেটাকেই আমরা প্রথমে কাঁধে তুলে নেব এবং ক্যাপাসিটি বৃদ্ধির সাথে সাথে পুরো বোঝাটাই একদিন আপহোল্ড করে নিতে পারবো। একটা পাকা দালানের কাঠামো যেভাবে গড়ে ওঠে সেভাবেই যে কোনো সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করতে হয়, হোক তা অ-ইসলামী বা ইসলামী। আল্লাহ রাসূলও (সা) তা-ই করেছেন। নয় কি?

ইসলাম প্রতিষ্ঠার ক্রমধারা (gradual implementation of Islam) অবলম্বন করা যদি রাসূলের (সা) জন্য কোনো special sanction না হয়ে থাকে, তাহলে এখন কেন আমরা সেটা বাদ দিব? আর যদি রাসূলের (সা) জন্য গ্রাজুয়ালিটির বিষয়টি কোনো special sanction বা privilege হওয়ার দাবি করা হয় তাহলে নিচের বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে:

নবীদেরকে আমরা যদি শিক্ষক মনে করি এবং আমাদেরকে যদি ছাত্র হিসেবে মনে করি, তাহলে দেখা যাচ্ছে সবচেয়ে ভাল শিক্ষককে [মুহাম্মদ(সা)] তাঁর সেরা ছাত্রদের [সাহাবীগণ] বোঝানো ও শেখানোর জন্য ক্রমধারা অবলম্বন করতে হয়েছে। আমরা তথা পরবর্তীদের কোনো শিক্ষক নাই অথচ ছাত্র হিসেবে আমরা অতি নিম্নমানের! এমতাবস্থায় ক্রমধারার এই সুবিধা আমাদের জন্য কেন প্রযোজ্য হবে না? আমরা এখন যে সমাজে বাস করছি এই সমাজটা যদি আন্দোলনের একটা উচ্চতর স্তরে না থেকে একটা নিম্নতর ধাপে থাকে, তাহলে উচ্চতর ধাপের জন্য যা প্রযোজ্য সেসব বিধি-বিধানকে যদি আমরা সরাসরি বাধ্যতামূলক মনে করে প্রয়োগের চেষ্টা করি তাহলে একটা category mistake সংঘটিত হবে, যাতে সমাজে বিশৃংখলার সৃষ্টি হবে। যা ফিতনা ছাড়া আর কিছু হতে পারে না।

গ্রাজুয়ালিটিকেও আমরা মেকানিক্যালি গ্রহণ বা implement করতে পারবো না। সেটাকে যথাসম্ভব র‍্যাশনালাইজ করতে হবে। সাহাবীরা এমনকি জানতেনও না যে পরবর্তী পদক্ষেপটা কী হবে! তাঁরা মানসিকভাবে ক্রমাগতভাবে তৈরি হচ্ছিলেন বটে। এক পর্যায়ে ওহীর সূত্রে রাসূল (সা) যা কিছু বলেছেন, তাঁরা তা মেনে নিয়েছেন। বিদ্যমান পরিবেশ ও জনমানসকে যথাসম্ভব প্রস্তুুত করেই কোনো নতুন বিধান দেয়া হয়েছে। আমরা পুরো জিনিসটাকে একসাথে পেয়ে গেছি। এতে আমাদের সুবিধা হয়েছে, আমরা জানি যে আল্টিমেটলি ব্যাপারটা কী বা চূড়ান্ত বিধিটা কী? অসুবিধাটা হয়েছে এই, মনে করা হচ্ছে এ সবগুলো একইসাথে বা এর চূড়ান্ত স্তরটিই শুধুমাত্র আমাদের জন্য সর্বাবস্থায় অবলিগ্যাটরি ।

আমরা একটা মিশ্র সমাজে (mixed society) বাস করছি। দারুল কুফর ও দারুল ইসলামের একটা মাঝামাঝি অবস্থায় আমরা বসবাস করছি। এখানে হায়ার লেভেলের কোনো কোনো বিষয় আমরা সহজেই করতে পারছি। যেমন আমরা জুমার নামাজ পড়তে পারছি। কিন্তু ঐ লেভেলের জন্য প্রযোজ্য অন্যান্য কোনো কোনো বিধি আমরা মানতে পারছি না। যেমন আমরা ‘হদ’ [দণ্ডবিধি] কায়েম করতে পারছি না। যদি সাব্যস্ত করা হয়, আমরা মক্কী যুগে আছি তাহলে আমরা কি জুমা বাদ দিব? যাকাত বাদ দিব? হিজাব বাদ দিব? আমরা কি সুদ গ্রহণ করব?

বিষয়টি এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, মিশ্র সমাজের ধারণাকে যদি আমরা গ্রহণ করে নেই তাহলে ব্যাপারটা এই দাঁড়ায় যে, রুখসত [সর্বনিম্ন অনুমোদিত সীমা] এবং আজীমত [সর্বোচ্চ মান]-এর ধারণাকে সামনে রেখে যেখানে আমাদের পক্ষে সম্ভব, যে বিষয়ে আমাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে অনুমোদিত ক্ষমতা আছে যেখানে আমরা শরীয়াহর সেই হুকুমটাকেই আমল করবো যা উচ্চতর ধাপের। আমাদের লক্ষ্য হলো যথাসম্ভব উচ্চতর ধাপে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে উন্নীত করা। শর্ত হলো সম্ভাব্য সকল উপায়ে উক্ত উন্নততর আইনকে মেনে নেয়ার জন্য সমাজকে তৈরি করা। এতে সামাজিক বিশৃংখলা সৃষ্টির আশংকা থাকে না। সামাজিক কর্তৃপক্ষ যেসব উন্নততর বিধানকে অনুমোদন করে না, সেগুলোর প্রযোজ্যতাকে আমরা নীতিগতভাবে স্বীকার করব, কিন্তু সেগুলোর বাস্তবায়নকে স্থগিত রাখবো। ব্যক্তিগতভাবে মক্কীযুগে এবং প্রাথমিক মাদানী যুগে যেসব ইসলামী বিধি-বিধান বলবৎ ছিল যেমন নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদি বিষয়গুলোকে সর্বদা মেনে চলব। ব্যক্তিগত পরিমণ্ডলে ও আওতার মধ্যে আমরা আজিমতকে অনুসরণ করব। কিন্তু অন্যদের জন্য, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আইন হিসেবে প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে আমরা রুখসাতকে অনুমোদন করব। এ ক্ষেত্রে আমরা সর্বনিম্ন সীমাকে অনুমোদন করলেও মূল স্ট্রাকচারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নিয়মগুলোকে যুক্তিসংগত হিসেবে উপস্থাপন করা ও ক্রমান্বয়ে তা বাস্তবায়ন করার জন্য সর্বাত্মকভাবে সচেষ্ট থাকবো। এই লক্ষ্যে বিদ্যমান সমাজব্যবস্থাকে আমরা যথাসম্ভব তৈরি বা buildup করার চেষ্টা করবো। এক কথায় যাকে ইসলামী আন্দোলন বলা হয়ে থাকে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এখন আমরা কোন পর্যায়ে আছি? এ প্রশ্নের উত্তর নির্ণয়ের আগে ধর্ম ও ইসলাম নিয়ে কিছু বলা প্রয়োজন মনে করছি। ব্যক্তিজীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু ধর্মীয় বিষয় ও বৈশিষ্ট্য অন্তর্গত ও অপরিহার্যভাবে ইসলামের মধ্যে আছে বটে, যাকে আমরা ইবাদত বলি। তৎসত্ত্বেও ইসলামের অপর বৃহৎ অংশ, যাকে ফিকাহর ভাষায় বলা হয় মুয়ামালাত, তা ধর্মীয় চরিত্রের নয়; পুরোপুরিই বৈষয়িক। বিশেষ করে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়াদিতে ইসলামের বিধি-বিধানসমূহের সাথে ধর্ম বলতে যা বুঝানো হয় তার মিল নাই। আল্লাহ তায়ালা ইবাদতের জন্য মানুষ সৃষ্টি করেননি। এজন্য ফেরেশতারা যথেষ্ট ছিল। শুধু এ পৃথিবীকে নয়, পুরো বিশ্ব পরিচালনায় তাঁর প্রতিনিধিত্ব করার জন্য আল্লাহ তায়ালা মানুষ সৃষ্টি করেছেন। এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইসলামকে এই দৃষ্টিকোণ হতে দেখে না।

তারা মনে করে, ইসলাম অন্যতম একটা ধর্ম মাত্র। হতে পারে তা উন্নততর বা শ্রেষ্ঠ ধর্ম। ইসলামকে বুঝা বা সত্যিকারের মুসলিম হওয়ার জন্য যে বিষয়গুলো জানা দরকার, তার ন্যুনতম জ্ঞানও আমাদের দেশের জনসাধারণের মধ্যে নাই। তারা ইলাহ পরিভাষাটির অর্থ বোঝে না, রব শব্দের অর্থ বোঝে না। তারা কালেমা উচ্চারণ করে ঠিক মতো, কিন্তু এর মর্মার্থ বা কনসিকোয়েন্স সম্পর্কে কোনো ধারণাই রাখে না। মক্কার কাফের-মুশরিকেরা কালেমার যে implication পরিষ্কারভাবে বুঝতে পেরেছিল, আমাদের এখানে শিক্ষিত লোকেরাও সেগুলো বুঝে না। কালেমাকে তারা পবিত্র একটা মন্ত্র মনে করে। এর প্রায়োগিক জিনিসগুলো বোঝে না। তারা উলীল আমর সম্পর্কে শুনে নাই, বোঝে না। ইবাদত সম্পর্কে কিছু ধারণা রাখলেও সমগুরুত্বপূর্ণ ‘তাগুত’ শব্দটি আদৌ শোনেনি!? নরম মাটির উপরে যদি একটা স্ট্রাকচার করতে হয় তাহলে প্রথমে ভালোভাবে পাইলিং করতে হবে। সুফী-দরবেশ দ্বারা ইসলাম প্রচার হলেও এদেশে কখনো ইসলামী রাষ্ট্র ছিল না। তাই এদেশের মানুষকে ভালো করে একটা তত্ত্ব হিসেবে ইসলাম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান দিতে হবে, বোঝাতে হবে। কনসেপ্ট হিসেবে ইসলাম সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার হওয়ার পর তাঁদের সামনে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এজেন্ডা নিয়ে আসতে হবে।

ইসলাম নিয়ে যারা কাজ করেন, ইসলামিক মুভমেন্ট হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেন, তাদের মধ্যেও অনেক সমস্যা আছে। এরা মনে করেন, তারা নিজেরা সবকিছু ভালো করেই বোঝেন। তাদের দৃষ্টিতে একমাত্র সমস্যা হলো অন্যদেরকে বোঝানো, অধিকাংশ (?) মানুষকে কনভিন্স করে ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠা! অথচ, ইসলামী অনেক কনসেপ্ট ও আন্ডারস্ট্যান্ডিং নিয়ে তাদের নিজেদের মধ্যেই গভীর মতানৈক্য রয়েছে। প্রতিষ্ঠাতা তাত্ত্বিকের বুলি কপচানোর বাইরে নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করা হয় না বিধায় বাহ্যত মনে হয়, কোনো সমস্যা নাই! কোনো কোনো সেক্টরে তারা কোনো কাজই করেনি। ইসলাম তাদের কাছে এক সর্বরোগহরি বড়ি (panacea), কোনোমতে খেতে ও খাওয়াতে পারলেই কেল্লা ফতে! এরই ফলশ্রুতিতে তারা কোনো কোনো ক্ষেত্রে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে বাদ দিয়ে শাখা-প্রশাখা নিয়ে ইনভলভ হয়েছেন ও হচ্ছেন। প্রায়োগিক বিষয়ে যে ধরনের আন্ডারস্ট্যান্ডিং থাকা দরকার, তা প্রায়ই লক্ষ্য করা যায় না। ইসলামিক সংগঠনগুলোতে intellectual bankruptcy বা বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াপনা বলতে যা বোঝায় সেই জিনিসটা লক্ষ্যণীয় মাত্রায় বিদ্যমান! প্রচলিত ও জনপ্রিয় ধর্মীয় ভাবধারার মতো ইসলামী আন্দোলনের সংগঠনসমূহেও স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তির চর্চাকে যথাসম্ভব নিরুৎসাহিত করা হয়! ভাবখানা এমন, ক্ষমতা পেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে! এই হলো রাজনৈতিক ইসলাপন্থীদের স্বনির্মিত গোলক-ধাঁধাঁ!

এ বিষয়ে আর একটা পর্যবেক্ষণ হচ্ছে ইসলামিস্টরা সাধারণত এ দেশকে, দেশীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে, দেশের মানুষকে আপন মনে করে না, own করে না। জনবিচ্ছিন্নতাকেও তারা খারাপ বা ক্ষতিকর মনে করে না। বরং এই স্বাতন্ত্র্যকে তারা উপভোগ করেন! ইসলামপন্থীদের মনোভাব হলো, তারা সাধারণ (পাপী!) মানুষের (পরকালীন) মুক্তি বা নাজাতের মহান দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন। এ ধরনের মানস গঠনের কারণে তাঁরা সবসময়ে সুপেরিয়রিটি কমপ্লেক্সিটিতে ভোগেন ও এক ধরনের আত্মতুষ্টি অনুভব করেন। ফলে তারা মানুষের কাছে যখন যান তখন নিজেদেরকে বিশেষ মর্যাদাবান মনে করেন এবং মানুষও তাদেরকে (পারলৌকিক বিবেচনায়) এক ধরনের বিশেষ ধর্মীয় মর্যাদা দিয়ে থাকে। মিউচুয়্যাল এক্সক্লুশানের ভিত্তিতে এ ধরনের একটা সেক্যুলার ফরমেট এখানে কম-বেশি প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। এই ধারণা থেকে বের হয়ে এসে সঠিকভাবে ইসলামকে বুঝতে চাইলে deductive approach of understanding Islam-এর ভুল পন্থা হতে সরে আসতে হবে। মনে করা হচ্ছে, ইসলামের কোনো একটি বিধান কৌশলে বা জোর করে চাপিয়ে দিতে পারলে কিছু না কিছু ইসলাম তো কায়েম করা গেল! ইসলামকে একটা জীবনদৃষ্টি বা আদর্শ হিসেবে না দেখে বিধি-বিধানের একটা আঁটি বা সমষ্টি হিসেবে দেখাই হচ্ছে এই ভ্রান্ত ও প্রান্তিক মানসিকতার কারণ।

ইসলামের দুটি দিক, একটা হলো Islam in its core of beliefs and personal practices। যেমন কালেমা, নামাজ, রোজা ইত্যাদি ন্যূনতম বিষয়গুলো। অন্যটা হচ্ছে এর implementary aspects that are socio-cultural-economic-politically concerned। এগুলোর বাস্তবায়ন, উন্নয়ন ও প্রেক্ষিত ক্রমধারায় অগ্রসরমান। এসব বিষয়ে স্থানিক ও কালিক পরিক্রমায় উদ্ভূত সমস্যা ও উপযোগী সমাধান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা কোনো কালবিশেষের নিরিখে কনক্লুসিভলি বলা সম্ভব নয়। সুন্নাহভিত্তিক মূলনীতির আলোকে এসব বিষয়ে যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।

প্লাটোর আদর্শ রাষ্ট্র সত্যিকারের আদর্শ রাষ্ট্র নয় এবং কখনো কোনো দেশে দার্শনিক-রাজা ছিল না। এই দৃষ্টিতে মদীনার সমাজ-রাষ্ট্র একটি বাস্তব সমাজ-রাষ্ট্র, প্লাটোনিক ইউটোপিয়া মাত্র নয়। একজন রাসূলের নেতৃত্বে একটা রাষ্ট্র সংগত কারণেই আমরা কখনো কায়েমে করতে পারবো না। এ দৃষ্টিতে মদীনার তৎকালীন রাষ্ট্র ব্যবস্থা এখন আমাদের জন্য একটা কল্পরূপ বা ইউটোপিয়া বটে! ইসলামী রাষ্ট্রের শেষ বলে কোনো কিছু নেই। এমনও দেখা গেছে যে, কোনো সাহাবী ইসলাম গ্রহণ করার পর মারা গেছেন। কোনো আমল করার সুযোগ পাননি। তাহলে ওনাকে কি বিশেষ রেয়াত দেয়া হবে, না তাঁর জন্য যা প্রযোজ্য বা সম্ভাব্য ছিল কেবলমাত্র তার ভিত্তিতেই তাঁর বিচার করা হবে? ইসলামকে যেহেতু আমরা মূলত একটা কনসেপ্ট হিসেবে মনে করছি, যেহেতু তিনি কনসেপ্টটাকে পুরোপুরিই গ্রহণ করেছেন, অর্থাৎ ঈমান এনেছেন তাহলে তাঁর ইসলাম পরিপূর্ণ ছিল বলে ধরে নেয়া হবে। আমরা কাফেরের যে সংজ্ঞাটা দিই সেটি হলো– ব্যক্তি জেনে-বুঝে ইসলামকে গ্রহণ করা থেকে বিরত থেকেছে, প্রত্যাখ্যান করেছে।

মিশ্র সমাজের কনসেপ্ট অনুসারে আমরা যে সমাজে আছি, দেখা গেল কোনো দিক থেকে তা প্রাথমিক পর্যায়ের, আবার অন্য কোনো দিক থেকে তা মাধ্যমিক পর্যায়ের, অথবা অগ্রসর পর্যায়ের। তাহলে আমরা কোন course of action-কে ওভারঅল ফলো করব? আমাদের পক্ষে যেসব বিধিবিধান মেনে চলা সম্ভব হচ্ছে সেসব আমরা মেনে চলবো। বিদ্যমান সামাজিক-রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে থেকে যেখানে আমাদের যেটা করা সম্ভব সেটি করবো, আপাতত ততটুকুই প্রযোজ্য মনে করব। যেটি করতে পারছি না সেটি করার অনুমোদন দেয়ার জন্য সমাজ ও রাষ্ট্রকে প্রভাবিত, পরিচালিত ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে (গণতান্ত্রিক অথবা অন্য কোনো সম্ভাব্য উপায়ে) বাধ্য করবো। এ কাজে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা ও যৌক্তিকতাকে সর্বদা মেনে চলতে হবে। বুঝতে হবে, সমাজের মূলধারার সম্পৃক্ততাই হলো জিহাদ ও ফিতনার মাপকাঠি।

সমাজের মূলধারার সম্পৃক্ততা থাকা বা না থাকাই নির্ধারণ করবে গৃহীত কোনো বিশেষ কর্মধারা জিহাদ নাকি ফিতনা? জিহাদ ফরজ, ফিতনা হারাম। ব্যক্তিবিশেষ, একা একা জিহাদ করতে পারে না। দলবিশেষও জিহাদ করতে পারে না। এমনকি তা ইক্বামতে দ্বীনের কোনো সংগঠন হলেও! বৈধ প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক জিহাদ ঘোষণা ও পরিচালনা বাধ্যতামূলক। এ ধরনের কর্তৃপক্ষের অনুপস্থিতিতে প্রত্যেকের আত্মরক্ষার অধিকার সর্বদাই বলবৎ থাকে। এ ধরনের আত্মরক্ষামূলক ও ব্যক্তিগত প্রতিরোধে কেউ মারা গেলে প্রতিরোধকারী শহীদি মর্যাদা লাভ করবেন। যদিও এই সংঘর্ষ জিহাদ হিসেবে গণ্য হবে না। যেভাবে কোনো দুর্ঘটনায়, দুরারোগ্য ব্যাধিতে বা সন্তান প্রসবের সময় কেউ মৃত্যুবরণ করলে শহীদি মর্যাদা লাভ করবেন।

নেকাব সংক্রান্ত বিতর্কের মূল প্রতিপাদ্য হলো পর্দার চূড়ান্ত স্তরে নারীদের মুখ ঢাকা ফরজ করা হয়েছে কি না। প্রথম মুসলিম হযরত খাদিজাসহ (রা) প্রাথমিক যুগের মুসলিম নারীদের সম্পর্কে আমরা যদি ভাবি, চিন্তা করি তাহলে আমরা তাঁদেরকে সেভাবে পাবো না, যেভাবে মাদানী জিন্দেগীর মধ্যবর্তী সময়ের পর থেকে মুসলিম মহিলাদের দেখা গেছে। খাদিজা (রা) আর আয়িশা (রা) এক নন। এটি বুঝতে হবে। আমাদেরকে আগে খাদিজা (রা) হতে হবে। প্রথমেই আয়িশা (রা) হওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। প্রচলিত আরবীয় সংস্কৃতির কারণে তাঁরা কখনো মুখ ঢেকেছেন কিনা সেটি নিয়ে সীরাতগ্রন্থসমূহে কোনো আলোচনা নাই। তাই মুখ ঢেকে হোক বা না ঢেকে হোক অর্থাৎ হিজাবের কোনো প্রসঙ্গ ছাড়াই তাঁদের ঈমান, ইসলাম ও ইসলামী জিন্দেগী পূর্ণ ছিল। নয় কি? তাহলে কি তাঁদেরকে কোনো বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছে? অথচ, কোরআন ও হাদীসের প্রচুর বর্ণনা হতে আমরা জানি, প্রাথমিক যুগে ইসলাম গ্রহণকারী নারী-পুরুষরা ছিলেন তৎপরবর্তীদের চেয়ে অনেক বেশি উন্নতমানের।

রাসূল (সা) সর্বশেষে যা করতে বলেছেন তা হলো আমাদের জন্য উন্নততর আদর্শ ও মান – এটি হলো একটা ধারণা। আর রাসূল (সা) সর্বশেষে যা করতে বলেছেন আমাদের জন্য সেটি একমাত্র করণীয় – এটি হলো সম্পূর্ণ পৃথক আরেকটি ধারণা। এ দুটো কথার ইমপ্লিকেশনের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে।

সাহাবীরা মনে করতেন, ঘুমিয়ে গেলে রোজা কায়েম হয়ে যায়। তৎসত্ত্বেও মানবীয় প্রবৃত্তির কারণে তাঁরা স্ত্রীদের সাথে সম্পর্ক করতেন। এরপর তাঁরা অপরাধ প্রবণতায় ভুগতেন। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা কোরআনের আয়াত নাযিল করে জানালেন, ফজর পর্যন্ত তাঁদের জন্য অবকাশ আছে। এ ধরনের ভুল বুঝাবুঝি এখনও ব্যাপকভাবে হচ্ছে। কোনো বিষয়ে মনে করা হচ্ছে, ফাইনালি যা করতে বলা হয়েছে সেটিই আমাদের একমাত্র করণীয়। কিন্তু সেটি বাস্তবে করা সম্ভব হচ্ছে না। তাহলে কী করা যায়? আমাদের এখন কী হবে? এহেন জটিল পরিস্থিতিতে সব অদ্ভূত সমন্বয়, সোজা কথায় গোঁজামিলগুলো দেয়া হয়, বিভিন্ন রকমের প্রান্তিকতা গড়ে উঠে। নমনীয়তার প্রান্তিকতা ও কঠোরতার প্রান্তিকতা। কোনো কোনো বুনিয়াদী বিষয়ে (যেমন– শাসন-কর্তৃত্ব সম্পর্কিত) নমনীয়তা ও আপসকামিতার নীতি অবলম্বন করা হয়। অথচ কোনো কোনো অ-বুনিয়াদী বিষয়ে (যেমন– পোশাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদি) পূর্ণতার দাবি ও কঠোরতা অবলম্বন করা হয়। এসবই অনাকাঙ্খিত প্রান্তিকতার লক্ষণ।

এই তালগোলে ব্যাপারের পুরোটাই ঘটছে conceptual ambiguity and inconsistency-র কারণে। যদি মনে করা হয়, আজকের দিনের মধ্যে আমাদেরকে ১০০ মাইল হেঁটে যেতে হবে যা আদৌ আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তখন আমরা কী করব? হতাশ হয়ে হাঁটতে হাঁটতে হয়তবা ৫/১০ মাইল হেঁটে বসে পড়বো, নতুবা হতাশ হয়ে বসে থাকবো, অথবা ভিন্ন কোনো সহজ পথে হাঁটার চেষ্টা করবো। আর যদি মনে করা হয়, এই ১০০ মাইলের মধ্যে ১০টা মনযিল রয়েছে, তাহলে প্রত্যেক যাত্রী সর্বোচ্চ গতিতে অগ্রসর হবে। ধারণা করা যায়, সবাই যার যার মতো করে কোনো এক সময় গন্তব্যে পৌঁছবে। একেক জন ব্যক্তির একেক অবস্থা, একেকটা সমাজের একেক অবস্থা, একেকটা এলাকারও একেক অবস্থা। বিশ্ব-আদর্শ হিসেবে ইসলাম, মোর স্পেসিফিক্যালি ইসলামী শরীয়াহ, একেক দেশে একেকভাবে প্রাধান্য ও প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। ইসলাম প্রতিষ্ঠার এই ক্রমধারা ও বৈচিত্র্যকে নির্ধারণ করতে হবে, বুঝতে ও বোঝাতে হবে, বাস্তবসম্মতভাবে জনসমাজকে আশ্বস্ত করতে হবে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গড়ে উঠা বিদ্যমান ধর্মীয় কাঠামোর সাথে এটি বিরোধপূর্ণ হওয়ায় বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করতে হবে।

যদি মনে করা হয়, রসূল (সা) চূড়ান্ত পর্যায়ে আমাদের যেটা আদেশ দিয়েছেন সেটা থেকে তৎপূর্ববর্তী কোনো স্তরে ফিরে যাওয়ার সুযোগ আমাদের নাই, তাহলে হযরত আয়েশার (রা) মদ সংক্রান্ত প্রসিদ্ধ হাদীসটির কথা বলতে হয়। তিনি বলেছেন, ‘প্রথম অবতীর্ণ আয়াতেই যদি বলা হতো– তোমরা মদ পান করো না; তাহলে তাঁরা অবশ্যই বলতো– আমরা কখনোই মদ্যপান ত্যাগ করবো না।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস নং- ৪৭০৭)

আমরা জানি, মোট চার ধাপে মদ নিষিদ্ধ করা হয়। সাহাবীদের জন্য যদি ক্রমধারা দরকারী হয়, অন্যদের জন্য তা হবে না কেন? ব্যক্তি গঠনের জন্য ক্রমধারাকে অনুমোদন করা হলে সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের জন্য সেটি কার্যকর হবে না কেন? অর্গানিক থিওরি অনুসারে ব্যক্তি বিশেষের মতো সমাজেরও একটা স্বতন্ত্র সত্তা রয়েছে। তাই না?

সূরা আলে ইমরানের ৭নং আয়াত অনুসারে কোরআনের আয়াতসমূহ দুই ধরনের: দ্ব্যর্থহীন ও দ্ব্যর্থবোধক আয়াত। হেদায়াতের জন্য দ্ব্যর্থহীন আয়াতসমূহই যথেষ্ট। সুস্পষ্ট আয়াতগুলোর মধ্যকার বিরোধ নিরসনে প্রচলিত পদ্ধতি হলো নাসেখ ও মানসূখের ধারণা। এই পদ্ধতি বা ধারণা একদিক থেকে সঠিক আবার অন্যদিক থেকে ভুল। সমাজ গঠনের ধাপ নির্ণয়ে আমাদেরকে অবশ্যই নাযিলের ধারাবাহিকতা অনুসরণ করতে হবে। কোনো অগ্রসর সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে আমরা অতিক্রম করে আসা কোনো প্রাথমিক স্তরের বিধি-বিধানকে অনুমোদন করতে পারি না। সংশ্লিষ্ট সমাজ বা রাষ্ট্র যদি তৃতীয় স্তরে থাকে সেখানে দ্বিতীয় স্তরের বিষয়াদি কার্যকর থাকার প্রশ্নই উঠে না। কিন্তু যে সমাজ বা রাষ্ট্র বা জনপদ এখনো প্রাথমিক স্তর হতে উত্তরণ লাভ করতে পারে নাই সেখানে নাসেখ-মানসূখের কথা বলে অ-প্রযোজ্য উচ্চতর বা সর্বোচ্চ ধাপ বাস্তবায়নের চেষ্টা করা ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়ার মতো পণ্ডশ্রম নয় কি?

আমাদের এখানকার ইসলামী সংগঠনগুলো পপুলিস্ট! তারা মনে করে, যদি এই এই বিষয়ে অপ্রচলিত কিন্তু সত্য কথাগুলো প্রকাশ্যে বলা হয় তাহলে মানুষ ভুল বুঝবে। অতএব সত্য কথা বলা যাবে না! হক এবং হেকমতের মধ্যে যদি সামঞ্জস্যবিধান করা না যায়, তাহলে বাস্তবে গিয়ে সব বরবাদ হয়ে যাবে। হকের দিক থেকে হবে এক ধরনের বরবাদী, আর হেকমতের দিক থেকে হবে অন্য ধরনের বরবাদী। হক হওয়া আর হক কায়েম হওয়া বা করা – এক জিনিস নয়। আল্লাহর রাসূল (সা) জানতেন, এরা হলো মুনাফিক। তৎসত্ত্বেও তিনি তাদের বিরুদ্ধে কোনো তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেননি। আল্লাহ তায়লা জানেন, তিনি কী কী বিষয় আরোপ করবেন, কী কী বিষয় নিষিদ্ধ করবেন। মানুষের মননশীলতায় ও বিদ্যমান সামাজিক ব্যবস্থায় গ্রহণযোগ্যতা (receptiveness) সৃষ্টি হওয়ার আগ পর্যন্ত কী করা হবে, তা তিনি প্রকাশ (নাযিল) করেননি।

হেকমত অবলম্বন না করার পরিণতি হলো চরমপন্থা অবলম্বন করা। ফিতনাকে জিহাদ মনে করা! আবার সবসময়ে হেকমতকে প্রাধান্য দেয়া হলো হীন আপসকামিতা, যাকে আমরা অ্যাপোলোজেটিক ট্রেন্ড বলে থাকি। কোনো কোনো শুভাকাঙ্খী আমাকে বলেছেন, আপনি যে কাজ করছেন তাতে ‘ইসলাম’ নাম নেয়ার দরকার কী? যেমন Center for Social & Cultural Studies (CSCS) নামে যা কিছু করা হয়েছে, তা সবই ইসলামের পক্ষে গেছে। ফোরামের নামের সাথে ‘ইসলাম’ না লাগানোতে কোনো সমস্যা হয়েছি কি? কথিত এই ‘ক্যাপসুল ফর্মূলা’ অনুসরণ করে আমরা অনেক কিছু করতে পারি বটে; কিন্তু আমরা যে মুসলিম, ইসলাম যে আমাদের জীবনাদর্শ, অপরাপর জীবনাদর্শগুলোকে যে আমরা বাতিল মনে করি – একে কি আমরা শেষ পর্যন্ত গোপন করতে পারি? অতি হেকমতের সবচেয়ে বড় বিপদ হলো, মূল বিষয়টাকেই [the basic claim] নেগোশিয়েট করে ফেলা! রাসূল (সা) এ ধরনের কোনো নেগোশিয়েট করেননি বলে তাঁকে জন্মভূমি ছেড়ে হিজরত করতে হয়েছিল!

হক এবং হেকমতের মধ্যকার ভারসাম্যকে বুঝতে হবে, মানতে হবে। একজন সহকর্মী আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি ক্লাসের মধ্যে ইসলামের কথা বলেন?’ আমি বললাম, ‘একেবারেই কদাচিৎ ও নিতান্তই প্রসঙ্গক্রমে।’ তিনি আমাকে বার বার এ বিষয়ে তাগাদা দিয়ে বলছিলেন, ‘আমাদের উচিত এই সুযোগে কিছু দাওয়াতী কাজ করা। তাহলে দশজনে জানলো এবং ইসলামের কিছু প্রচার-প্রসার হলো।’ তখন আমি বললাম, ‘ভাই, ইসলাম এমন কোনো ঔষধ না যে কৌশলে খাইয়ে দিলেই হলো!’ কোনোমতে মুসলমান হিসেবে নাম লেখানোর মাধ্যমে আদমশুমারী অনুসারে মুসলমানের সংখ্যা যতই বাড়ুক না কেন, তাতে সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষতিবৃদ্ধি করা ছাড়া আর কোনো ফললাভ হবে না। এসব অ-বুঝ মুসলিমরা খালেস নিয়তে অ-ইসলামকেই লালন করবে এবং সত্যিকারের ইসলাম ও ইসলামপন্থীদেরকে সওয়াবের নিয়তে (?) সর্বশক্তি দিয়ে বিরোধিতা করবে।

ইসলাম গ্রহণ করতে হবে এর দায়-দায়িত্বকে মেনে নিয়ে। একটা all out intellectual exercise এর the only rational outcome বা conclusion হবে spelling of the kalma-e-tayyaba। এমন নয় যে কোনোমতে একে বুঝিয়ে দেয়া হলো অথবা লোকেরা সাময়িক কোনো বিদ্যমান পারিপার্শ্বিকতার কারণে ইসলাম গ্রহণ করে নিলো। এভাবে অধিকাংশ লোক ইসলাম মেনে নিলে কি ইসলামী সমাজ অটোমেটিক্যালি কায়েম হয়ে যাবে?! মদীনার অধিকাংশ লোকেরা কি শুরুতে ইসলাম গ্রহণ করে নিয়েছিলো? না, নেয়নি। মুসলিম জনসংখ্যা এক দশমাংশও ছিলো না। মদীনা সনদ স্বাক্ষরের সময় রাসূল (সা) ছিলেন মাইনরিটি লিডার। যোগ্যতার কারণে তাঁকে সবাই নেতা মেনে নিয়েছিলো। ইসলামাইজেশন বলতে আমি সিস্টেম ম্যানেজমেন্টকেই বুঝি।

হক ও হেকমতের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। কীভাবে এটি সম্ভব? আমাদের প্রত্যেকের বিবেক আছে। Our conscience will say that. আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ফাআলহামা-হা ফুজু-রাহা ওয়া তাক্বওয়াহা।

এ ধরনের আরো লেখা