ইসলামী আইন হিসেবে হুদুদের প্রয়োগযোগ্যতা
এডিটর’স নোট: ইসলামী আইন, এমনকি শরীয়াহ বলতে অনেকে শুধু হুদুদকে বুঝে থাকেন। এই ভুল ধারণা দূর করতে প্রফেসর ড. মোহাম্মদ হাশিম কামালীর এই সাক্ষাৎকারটি বেশ কাজে দেবে। ২০১১ সালের ৩ অক্টোবর ‘মালয়েশিয়ান অবজারভার’ টিভির ‘লেট’স টক’ অনুষ্ঠানে ইসলামী আইন ও হুদুদের ধারণা, প্রয়োগ ও বাস্তবতা ইত্যাদি নিয়ে তিনি বিস্তারিত কথা বলেন। সিএসসিএস-এর পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন আইয়ুব আলী।
*****
মুহাম্মদ ইউনুস: প্রিয় দর্শক! ‘মব টিভি’র এই অনুষ্ঠানে আমাদের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ। ‘লেটস টক’ অনুষ্ঠানের উপস্থাপক হিসেবে আপনাদের সাথে আছি আমি জাহাবেরদীন মুহাম্মদ ইউনুস।
এই মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হলো, মালয়েশিয়ায় ইসলামী আইনের পরিধি আরো বাড়ানোর দরকার আছে কিনা? বিদ্যমান চুক্তি আইন, দণ্ডবিধি, সড়ক পরিবহন আইন প্রভৃতি ইসলামী আইন কি যথেষ্ট নয়? এগুলো কি ইসলামী আইন নয়?
আমরা দেখি, মালয়েশিয়ার প্রতিটি নির্বাচনী প্রচারণায় হুদুদ আইনের বিষয়টি রাজনৈতিক আলোচনার প্রধান বিষয়ে পরিণত হয়। একে অনেক বেশি রাজনৈতিকীকরণ করে ফেলা হয়েছে। যার ফলে মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে মালয়েশিয়ার নাগরিকরা সামগ্রিকভাবে বিষয়টি নিয়ে কনফিউজড। অথচ, হুদুদ আইন কোনো রাজনৈতিক ইস্যু নয়। এটি একটি আইনী ব্যাপার। আরো স্পষ্ট করে বললে, ইসলামী আইনী ব্যাপার।
এসব বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য আজকে আমাদের সাথে রয়েছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামী স্কলার প্রফেসর ড. মুহাম্মদ হাশিম কামালী। ইসলামী আইন ও আইনশাস্ত্র (ফিকাহ) নিয়ে তিনি অনেকগুলো বই লিখেছেন। বর্তমানে তিনি ‘ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব অ্যাডভান্সড ইসলামিক স্টাডিজের’ চেয়ারম্যান এবং সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
আজকের অনুষ্ঠানে আপনাকে স্বাগতম, প্রফেসর।
হাশিম কামালী: ধন্যবাদ।
মুহাম্মদ ইউনুস: প্রায় বছর তিনেক আগে আপনার লেখা ‘Islamic Law in Malaysia: Issues and Developments’ বইটি এখন আমার হাতে রয়েছে। এখানে পুরো একটি চ্যাপ্টার জুড়ে আপনি হুদুদ আইনের উপর বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। দর্শকদের জানার জন্য আপনি কি বলবেন, হুদুদ আইন আসলে কী?
হাশিম কামালী: হুদুদ আইন হচ্ছে এমন আইন, যেগুলো কোরআন ও সুন্নাহর মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট। বিশেষ করে যেসব অপরাধের শাস্তি কোরআনে সুনির্দিষ্ট বলা আছে, সেগুলো হুদুদ আইনের আওতাভুক্ত। অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে সুন্নাহ থেকেও দৃষ্টান্ত নেয়া হয়। যদিও হুদুদের মতো বড় ধরনের শাস্তি নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোরআনের নির্দেশই সর্বোচ্চ।
মুহাম্মদ ইউনুস: হুদুদ আইনের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী? আমরা আসলে জানতে চাই, হুদুদ আইনের প্রকৃত উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য একে কি একটি দেশের ‘ল অব দ্যা ল্যান্ড’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতেই হবে?
হাশিম কামালী: যে কোনো ফৌজদারী আইনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। শাস্তি প্রদানের আরেকটি উদ্দেশ্য নিশ্চয় অপরাধ দমন করা। এখন বিধিবদ্ধ আইনী কাঠামোর মাধ্যমেই হুদুদ প্রয়োগ করা জরুরি কিনা তা নির্ভর করে ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষের উপর। ইসলামে রাষ্ট্রীয় আইন (সিয়াসাহ শরীয়াহ) প্রণয়নের ব্যাপারে শাসকের সিদ্ধান্ত বা মতামত অনুমোদিত। বিশেষ করে, অপরাধ দমন ও অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনা এবং ন্যায়বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য সর্বোত্তম পদ্ধতি গ্রহণ করার অনুমোদন শাসককে দেয়া হয়েছে।
মুহাম্মদ ইউনুস: সিয়াসাহ শরীয়াহ নিয়ে আপনার কথাগুলো খুবই ইন্টারেস্টিং। কারণ আপনার মতে, অপরাধ দমনের জন্য সম্ভাব্য সর্বোত্তম পন্থা গ্রহণের স্বাধীনতা শাসক কিংবা সরকারের রয়েছে। কিন্তু প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণরূপে এর বিপরীত। প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, হুদুদ আইন সমাজে, বিশেষত মুসলিম সমাজে, বাস্তবায়ন করা আবশ্যক। কারণ, যে কোনো মুসলিম সমাজের উপর হুদুদ আইন বাধ্যতামূলক বলে অনেকের ধারণা। এ ব্যাপারে …
হাশিম কামালী: হ্যাঁ, হুদুদ প্রয়োগ শরীয়াহ বাস্তবায়নের একটি শর্ত। কিন্তু হুদুদ প্রয়োগের সর্বোত্তম উপায়টা কী? হুদুদ প্রয়োগের ভিন্ন ভিন্ন উপায় আছে। একটি হলো, নিছক বাস্তবায়ন করার জন্যই হুদুদ প্রয়োগ করা। এটা হলো এ সংক্রান্ত নির্দেশনাগুলোকে আক্ষরিক অর্থে বিবেচনা করার ফল। আরেকটা পদ্ধতি হলো ন্যায়বিচারের উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে হুদুদ কার্যকর করা। এখন, সরকার কিংবা ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব হচ্ছে সর্বোত্তম উপায়টি খুঁজে বের করা। আইন, পলিসি ডকুমেন্টস কিংবা অন্য কোনো মানদণ্ডের আলোকে হুদুদ বাস্তবায়নের সর্বোত্তম উপায়টি ঠিক করে নেয়ার অনুমোদন ইসলামে রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে মৌলিক শর্ত হলো অপরাধের শাস্তি এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটি নিশ্চিত করা। এ দুটি বিষয় নিশ্চিত করার জন্যই কোরআন সুনির্দিষ্ট কয়েকটি শাস্তির বিধান তথা হুদুদ নির্ধারণ করে দিয়েছে।
মুহাম্মদ ইউনুস: তারমানে আপনার মতে, এখানে দুটি পরস্পরবিরোধী বিষয় রয়েছে। একটি হচ্ছে নিছক বাস্তবায়নের জন্যই হুদুদ বাস্তবায়ন করা। অপরটি হলো ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও অপরাধ দমনের উদ্দেশ্যে বাস্তবায়ন করা, যা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে তো দ্বিতীয়টি প্রথমটিকে খারিজ করে দেয়।
হাশিম কামালী: ঠিক বলেছেন। মালয়েশিয়ার সাধারণ মানুষের কাছে হুদুদকে যেভাবে চিত্রিত করা হয়, আমি তার সমালোচনা করি। হুদুদকে অনেক বেশি রাজনৈতিকীকরণ করে ফেলা হয়েছে, যা একটু আগে আপনিও বলেছেন। হুদুদের প্রকৃত উদ্দেশ্য জনগণের কাছে তুলে ধরার পরিবর্তে এটিকে দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে।
শাব্দিক অর্থের দিক থেকেই হুদুদের আওতাধীন হলো স্বল্পসংখ্যক ও সুনির্দিষ্ট কিছু শাস্তি। শরীয়াহ ও ফিকাহর আলোচনায় যথেষ্ট সাবধানতার সাথে এইসব শাস্তির প্রক্রিয়াগুলো নির্ধারণ করা হয়েছে। এরমধ্যে কিছু কিছু শাস্তির উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজকে নৈতিকতার সর্বোচ্চ শিখরে নিয়ে যাওয়া। উদাহরণ হিসেবে ব্যভিচারের শাস্তির কথা বলা যায়। এই অপরাধের শাস্তি হিসেবে কোরআনে ১০০ বেত্রাঘাতের কথা বলা হয়েছে। তবে এটি কার্যকরের পূর্বশর্ত হলো— এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে, এমন চারজন সাক্ষীকে সাক্ষ্য দিতে হবে। কেউ যদি একেবারে মার্কেটপ্লেসের মতো উন্মুক্ত কোনো স্থানে এ ধরনের কাজ না করে থাকে, তাহলে তো চারজন প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া খুবই কঠিন ব্যাপার!
কোরআনে এ ধরনের কঠিন শর্তারোপ থেকে বুঝা যায়, হুদুদ প্রয়োগ করার জন্যই হুদুদের বিধান নয়। সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে হুদুদের কথা বলা হয়েছে বটে। তবে আরো নমনীয় শাস্তি প্রয়োগের কথাও বলা হয়েছে। একে বলা হয় ‘তাজীর’। হুদুদ প্রয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় সকল পূর্বশর্ত যথাযথভাবে পূরণ করা না গেলে আরেক ধাপ নিচের শাস্তি তাজীর প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে। আমি মনে করি, দণ্ডবিধিসহ মালয়েশিয়ায় প্রচলিত যেসব আইনের কথা একটু আগে আপনি বলেছেন, সেগুলো তাজীরের অন্তর্ভুক্ত।
মুহাম্মদ ইউনুস: আপনার কথার সারমর্ম হলো, রাষ্ট্রীয় আইনের (সিয়াসাহ শরীয়াহ) ক্ষেত্রে ন্যায়বিচারের বাহ্যিক কাঠামোর চেয়ে ন্যায়বিচারের অন্তর্গত প্রেরণা প্রতিষ্ঠা করাই হলো ইসলামের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য। সেক্ষেত্রে আপনি বলতে চাচ্ছেন, চুরি, প্রতারণা ও আত্মসাৎসহ বিভিন্ন অপরাধের জন্য যেসব দণ্ডবিধি রয়েছে, সেসব যদি ন্যায়বিচারের ইসলামী মূলনীতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ থাকে, তাহলে এগুলোকে তাজীর হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করা যাবে?
হাশিম কামালী: হ্যাঁ। আমি মনে করি তাজীর একটি সাধারণ আইন। আপনি যেসব আইনের কথা বলেছেন, সেগুলো মালয়েশিয়ার পার্লামেন্ট ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করেছে। নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তারা এগুলোকে আইনে পরিণত করেছে। ‘উলিল আমর’, অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে এগুলো হয়েছে। ফলে মালয়েশিয়ার আইনকানুন সিয়াসাহ শরীয়াহর আওতার মধ্যেই রয়েছে।
মুহাম্মদ ইউনুস: প্রচলিত দণ্ডবিধি বা চুক্তি আইন ইত্যাদি তো ইসলামী আইন বিশারদগণ (ফকীহ) প্রণয়ন করেননি। এগুলো ‘সিভিল সিস্টেম’ তথা পার্লামেন্টের মাধ্যমে হয়েছে। আমার প্রশ্ন হলো, কোনো আইনকে ‘ইসলামী’ হতে হলে কি তা ফিকাহবিদদের নিকট থেকেই আসতে হবে? নাকি কোরআন ও সুন্নাহর মধ্যে যেসব মূলনীতি পাওয়া যায়, তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়াটাই যথেষ্ট?
হাশিম কামালী: প্রতিটি আইনকে আবশ্যিকভাবে টেক্সট থেকেই আসতে হবে— এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ইসলামের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখবো, শাসক, গভর্নর, খলিফা কিংবা সুলতানগণ যেসব অর্ডিন্যান্স, পলিসি ডকুমেন্টস ও আইন প্রণয়ন করেছেন সেগুলোর পেছনে সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মতো সুনির্দিষ্ট ও গ্রহণযোগ্য উদ্দেশ্য ছিল। এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য গৃহীত যে কোনো পদক্ষেপই শরীয়াহ তথা ইসলামের উদ্দেশ্যের আওতাভুক্ত।
ইবনে কাইয়ুম (রহ.) তাঁর বিখ্যাত ‘সিয়াসাহ আস-শরীয়াহ’ গ্রন্থে তো আসলে এ কথাই বলেছেন। তিনি বলেছেন, সকল আইনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, জনগণের কল্যাণ সাধন, তাদেরকে দুর্নীতি ও ক্ষতিকর কোনো কিছু থেকে দূরে রাখা। এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গৃহীত যে কোনো উপায় কিংবা পদ্ধতিই ইসলাম ও শরীয়াহর অন্তর্ভুক্ত।
মুহাম্মদ ইউনুস: তারমানে, হুদুদ এবং ইসলামী আইনের আইনের বাহ্যিক কাঠামোর চেয়ে এর মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হওয়াটাই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তাই নয় কি?
হাশিম কামালী: আপনি যদি আমাকে এমন প্রক্রিয়ায় হুদুদ প্রয়োগ করতে বলেন, যা স্পষ্টত জুলুম; তাহলে আমি তা করতে রাজী নই। বরং আমি এমন একটা পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করবো, যার মাধ্যমে অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াই করা যায় এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা যায়। বিশেষ করে সমাজের বাস্তবতা যদি এমন হয়, যেমন যুদ্ধাবস্থা ইত্যাদি। মহানবী (সা.) ও খেলাফতে রাশেদার যুগে যুদ্ধাবস্থায় হুদুদ প্রয়োগ স্থগিত রাখা হতো।
মুহাম্মদ ইউনুস: ভেরি ইন্টারেস্টিং!
হাশিম কামালী: হ্যাঁ। স্থগিত রাখার কারণটা বলি। যেমন, একবার এক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে খবর আসলো যে কিছু সৈন্য মদ্যপান করছে। তাদেরকে শাস্তি দেয়া উচিত হবে কি না, তা জানতে চাওয়া হলো। এই জিজ্ঞাসার যে জবাব দেয়া হয়েছিল তার সারকথা হলো, মদ্যপানের শাস্তি কার্যকরের চেয়ে শত্রুপক্ষের নিকট একজন সৈনিকের পরাজিত হওয়াটা ইসলামের জন্য বেশি ক্ষতিকর।
মুহাম্মদ ইউনুস: খুবই ইন্টারেস্টিং! তারমানে অনুশোচনা ও ক্ষমার একটি দিকও রয়েছে। কিন্তু রাজনীতিবিদরা যখন হুদুদ নিয়ে কথা বলেন, তখন তারা অনুশোচনা ও ক্ষমার দিকটি পুরোপুরি এড়িয়ে যান। ফলে সাধারণ মানুষের ধারণা, হুদুদ খুবই কঠোর ও নিষ্ঠুর একটি শাস্তি। এ ব্যাপারে কিছু বলুন, প্লিজ।
হাশিম কামালী: নিশ্চয়। কোরআনের বর্ণনার আলোকেই এটি হুদুদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। ‘Punishment in Islamic Law: An Enquiry into the Hudud Bill of Kelantan’ শিরোনামে আমার লেখা একটি বই ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। বইটিতে আমি কেলান্তান প্রদেশের হুদুদ বিলের উপর একটি পর্যালোচনা করেছি। হুদুদ নিয়ে কোরআনের বর্ণনার সাথে ওই বিলটি মোটেও সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না।
চলুন দেখা যাক অনুশোচনা প্রসঙ্গে কোরআন কী বলেছে। হুদুদ নিয়ে কোরআনে ৪/৫টি আয়াত রয়েছে। অপরাধ ও অপরাধের শাস্তির বিধান একইসাথে সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। তারপর বলা হয়েছে, অপরাধী যদি অনুশোচনা করে এবং নিজেকে সংশোধন করে নেয়, তাহলে আল্লাহও তাকে ক্ষমা করে দেন, তিনিও মানুষের অনুশোচনা শোনেন। এটাই হলো হুদুদ নিয়ে কোরআনের আয়াতগুলোর সাধারণ বৈশিষ্ট্য। যেখানেই খুঁজেন, এ ধরনের কথাই কোরআনে পাবেন।
এখানে আমার একটি প্রশ্ন আছে। হুদুদ সম্পর্কিত কোরআনের এই দৃষ্টিভঙ্গির বাস্তব প্রতিফলন কোথায়? আমাদের আইনশাস্ত্রের পুরো ইতিহাস ঘাটলে আমরা দেখবো, হুদুদকে আমরা একটি নির্ধারিত ও বাধ্যতামূলক শাস্তি হিসেবে বিবেচনা করেছি। অথচ কোরআনকে একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির জায়গা থেকে দেখলে বুঝা যাবে, অনুশোচনা, সংশোধন ও ক্ষমার সুযোগ সেখানে আছে। কিন্তু হুদুদ আইনের ক্ষেত্রে কোরআনের এই প্রশস্ততাকে বিবেচনা করা হয়নি। প্রচলিত আইন অনুযায়ী, অপরাধ প্রমাণ হওয়ার পর যথাসম্ভব দ্রুততার সাথে হদ প্রয়োগ করা হয়। এক্ষেত্রে বিচারকের সতর্কতাকে উপেক্ষা করা হয়। হুদুদ সম্পর্কে কোরআনে আমি যা পেয়েছে, তার সাথে এটি সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
মুহাম্মদ ইউনুস: এসব নিয়ে আসলে সমাজে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত রয়েছে। দেশের সিভিল আইন তথা দণ্ডবিধি পর্যালোচনা করলে আপনি দেখতে পাবেন, তাতে কোনো অপরাধের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন শাস্তির বিধান রাখা আছে। এর পাশাপাশি বিচারককেও নিজস্ব বিবেচনা প্রয়োগ করে শাস্তি নির্ধারণের এখতিয়ার দেয়া হয়। উদাহরণ হিসেবে চুরির কথাই বলা যাক। অপরাধী অন্যায়টি প্রথমবারের মতো করে থাকলে, কিংবা অপরাধী অল্পবয়স্ক হলে বিচারক নিজস্ব বিবেচনায় রায় দিতে পারেন।
কিন্তু সবচেয়ে ভালো হচ্ছে আপনি যেটা বলেছেন, অর্থাৎ ন্যায়বিচারের এইসব মূলনীতি ও ধারণাসমূহ কোরআনে ইতোমধ্যেই বলা আছে। কোরআনে একদিকে কঠোর শাস্তির কথা যেমন বলা হয়েছে, অন্যদিকে ক্ষমার কথাও বলা হয়েছে। তাহলে আপনার উপসংহার হলো, নিজস্ব বিচার-বিবেচনা প্রয়োগ করে অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী রায় নির্ধারণের সুযোগ কোরআনে আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে দিয়েছেন। তাই তো?
হাশিম কামালী: ‘হদ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে সর্বোচ্চ সীমা। এর নিচের পর্যায়কে ‘তাজীর’ বলা হয়। হদ প্রয়োগের সবগুলো পূর্বশর্ত যদি যথাযথভাবে পূরণ করা যায়, সন্দেহাতীতভাবে যদি অপরাধ প্রমাণ করা যায়, তাহলে তা প্রয়োগ করা যাবে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হদ প্রয়োগের পূর্বশর্তগুলো পূরণ করা অত্যন্ত কঠিন। তখন হদ প্রয়োগ না করে তাজীর প্রয়োগ করতে হয়। শাস্তির যে বিভিন্ন মাত্রা রয়েছে, এ কথাটিই আমরা জোর দিয়ে বলে আসছি। সেক্ষেত্রে হদ হচ্ছে সর্বোচ্চ শাস্তি। আর শাস্তির অন্যান্য পর্যায়গুলোর মধ্যে নমনীয়তা রয়েছে।
মুহাম্মদ ইউনুস: মোটকথা হলো, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং…
হাশিম কামালী: সেটাই। তাজীরের ক্ষেত্রে বিচারকদের নিজস্ব বিবেচনা কাজে লাগিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার স্বাধীনতা রয়েছে। অপরাধীর সার্বিক অবস্থা ও পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনা করে বিচারক তেমন ধরনের শাস্তি নির্ধারণ করতে পারেন, যার মাধ্যমে অপরাধীকে অপরাধকর্ম থেকে বিরত থাকার ব্যাপারটি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।
মুহাম্মদ ইউনুস: হুদুদ নিয়ে আরেকটা অস্পষ্টতা রয়েছে। আপনি সম্ভবত এটি দূর করতে পারবেন। কোরআন পড়ে আমি যা বুঝেছি, চারটি সুনির্দিষ্ট অপরাধের ক্ষেত্রেই শুধু হুদুদের বিধান রয়েছে। ‘Freedom, Justice and Equality in Islam’ এবং ‘Islamic Law in Malaysia: Issues and Developments’ শীর্ষক দুটি বইয়ে আপনিও তা বলেছেন। কিন্তু ফিকহী আলোচনায় ফিকাহবিদরা কোরআনে বর্ণিত এই চারটি অপরাধের বাইরেও অন্যান্য অপরাধকে হুদুদের আওতায় নিয়ে আসছেন। যদি আমার ভুল না হয়ে থাকে, আমি এটি খেয়াল করেছি। প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কেন?
হাশিম কামালী: হ্যাঁ, সত্যিই এমনটি ঘটছে। অথচ কোরআনে যে চারটি নির্দিষ্ট অপরাধের কথা বলা হয়েছে, এরমধ্যে একটি অপরাধের ক্ষেত্রে আবার সন্দেহ রয়েছে যে তা আসলেই হদ প্রয়োগের আওতায় পড়ে কি না। সেই অপরাধটি হচ্ছে মদপান। কোরআনে মদপানকে অপরাধ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে বটে। তবে নির্দিষ্ট কোনো শাস্তির কথা বলা হয়নি।
মুহাম্মদ ইউনুস: সেই চারটি অপরাধ কী কী?
হাশিম কামালী: সেগুলো হচ্ছে চুরি, ব্যভিচার, ব্যভিচারের অপবাদ এবং মদপান। মদপানের ব্যাপারে কোরআনে বলা হয়েছে,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِّنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
“হে ঈমানদার লোকেরা! মদ, জুয়া, বেদী ও ভাগ্য নির্ণয়কারী শর হচ্ছে ঘৃণিত শয়তানের কাজ, অতএব তোমরা তা বর্জন করো, আশা করা যায় তোমরা মুক্তি পেয়ে যাবে।”
[সূরা মায়েদা: ৯০]
মদ, জুয়া ইত্যাদিকে ঘৃণিত কাজ অভিহিত করে এগুলো থেকে দূরে থাকতে বলা হয়েছে। কিন্তু কোনো শাস্তির কথা এখানে বলা হয়নি। কেউ যদি হুদুদের বিধান ভালো করে বুঝে থাকে তাহলে সহজেই সে ধরতে পারবে, মদপানের অপরাধ হুদুদের আওতাধীন নয়। যদিও ফিকাহবিদরা একে হুদুদের আওতাভুক্ত করেছেন। এর কারণ খুঁজতে গেলে দেখা যায়, উমর ইবনে খাত্তাবের (রা.) শাসনামলে মদপানের জন্য চল্লিশটি বেত্রাঘাত নির্ধারণ করা হয়েছিল। যা পরবর্তীতেও…। একে রাষ্ট্রীয় আইন (সিয়াসাহ শরীয়াহ) বলা যায়। কিন্তু এটি হুদুদ নয়। এটি তাজীরের পর্যায়ে পড়ে।
মুহাম্মদ ইউনুস: আচ্ছা, ধর্মত্যাগের ব্যাপারে কী বলবেন? এটি কি হুদুদের আওতাভুক্ত?
হাশিম কামালী: না। এটি হুদুদের আওতাভুক্ত নয়। ইদানীং ধর্মত্যাগ নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হচ্ছে। কিন্তু কোরআনে আপনি দেখবেন, ধর্মত্যাগের ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ২০/২১টি আয়াত রয়েছে। যারা ইসলাম বা ঈমান ত্যাগ করেছে, সেইসব অবিশ্বাসীদের বিপক্ষে কোরআন নিরবচ্ছিন্নভাবে বলে গেছে। কিন্তু কোরআনের কোথাও নির্দিষ্ট কোনো শাস্তির কথা বলা হয়নি।
মুহাম্মদ ইউনুস: কিন্তু এ ব্যাপারে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি হলো— ধর্মত্যাগের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড!
হাশিম কামালী: এ ব্যাপারে একটা হাদীস আছে, যেখানে সিম্পলি বলা হয়েছে, من بدل دينه فاقتلوه (কেউ যদি তার ধর্ম পরিবর্তন করে, তাকে হত্যা করা উচিত)। আমি হাদীসটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করেছি। হাদীসটিতে সুনির্দিষ্ট কোনো বক্তব্য নেই। যেমন, ‘কেউ যদি তার ধর্ম পরিবর্তন করে’ হাদীসের এই বর্ণনা আমলে নিলে বলতে হয়, একজন ইহুদী যদি হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত হয়, তাহলে তাকেও হত্যা করা উচিত! অথচ এ ধরনের উদ্দেশ্য যে হাদীসটির ছিল না, তা সহজেই বোধগম্য। তাছাড়া এটি ‘মুতাওয়াতির’ হাদীস নয়। এটি একটি ‘আহাদ’ হাদীস। মৃত্যুদণ্ড প্রদানের শর্ত পূরণের জন্য এ ধরনের হাদীস যথেষ্ট নয়।
মুহাম্মদ ইউনুস: তাছাড়া কোরআনেও তো ধর্মত্যাগীর জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান নেই…।
হাশিম কামালী: হ্যাঁ, কোরআনেও তা বলা নেই। আসলে উল্লেখিত হাদীসটির ভিন্ন একটি প্রেক্ষাপট রয়েছে। আমি খুব সংক্ষেপে তা বলছি। মহানবীর (সা.) জীবনকালের শেষ ৯/১০ বছরে ছোট-বড় মিলিয়ে ২৬/২৭টি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। সময়টা তখন যুদ্ধের ডামাঢোলের মধ্যেই ছিল। কোনো নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়ার সুযোগ তখন ছিল না। এমতাবস্থায় দেখা গেলো, মদীনার কিছু লোক ইসলাম ত্যাগ করে মক্কায় চলে যাচ্ছে। সেখানে গিয়ে তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দিচ্ছে। ফলে এই ধরনের লোকদেরকে মহানবী (সা.) নিষিদ্ধ করলেন। কারণ, এটা ছিল সুস্পষ্ট রাষ্ট্রদ্রোহিতা।
মুহাম্মদ ইউনুস: হ্যাঁ, এটা তো রাষ্ট্রদ্রোহিতা। তাহলে আপনার কথার সারমর্ম হলো— নিছক ধর্মত্যাগের কারণে মৃত্যুদণ্ডের কোনো বিধান কোরআনে নেই। তবে হাদীসে এটিকে তখনকার প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রদ্রোহিতা বিবেচনা করে মৃত্যুদণ্ডের বিধান দেয়া হয়েছিল।
যাই হোক, আরেকটি শাস্তি নিয়ে লোকদের মাঝে বিভ্রান্তি লক্ষ করা যায়। সেটি হলো যিনা তথা ব্যভিচারের শাস্তি। কোনো বিবাহিত নারী বা পুরুষ ব্যভিচার করলে তাকে পাথর মেরে হত্যা করতে হবে বলে একটা ধারণা প্রচলিত আছে। অনেকেই একে খুব নিষ্ঠুর বলে সমালোচনা করেন। কোরআনে কি এই শাস্তির ব্যাপারে কিছু বলা আছে?
হাশিম কামালী: কোরআনে একটি শাস্তির কথাই বলা আছে। সেটা হচ্ছে ১০০ বেত্রাঘাত। পাথর নিক্ষেপে হত্যা তথা রজমের বিধানটি হাদীসে পাওয়া যায়। মহানবীর (সা.) সময়ে সেটা কার্যকর ছিল। তবে এটা নিয়ে আরো কথা আছে। সূরা নূরে ব্যভিচারের শাস্তির বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। আর এই সূরাটি নাযিল হয়েছে একদম শেষ পর্যায়ে, মহানবীর (সা.) ওফাতের ২/১ বছর আগে।
এই সূরা নাযিলের আগে যিনার অপরাধের জন্য মহানবী (সা.) পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের বিধান প্রয়োগ করেছেন। পাথর নিক্ষেপে হত্যার বিধানটি তাওরাতে বর্ণিত। আর তাওরাত ও বাইবেলের বর্ণনাকে আল্লাহর বিধান হিসেবে কোরআন স্বীকৃতি দিয়েছে। তাই কোরআনে এই অপরাধের শাস্তির বিধান আসার আগ পর্যন্ত তাওরাতকে রেফারেন্স হিসেবে গ্রহণ করা মহানবীর (সা.) জন্য অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু সূরা নূর নাযিলের পর কোরআনের বিধান হিসেবে ১০০ বেত্রাঘাত নির্ধারিত হয়েছে।
মুহাম্মদ ইউনুস: তাহলে পাথর নিক্ষেপের পরিবর্তে ১০০ বেত্রাঘাতই হলো নির্ধারিত শাস্তি?
হাশিম কামালী: হ্যাঁ, তবে মহানবীর (সা.) মৃত্যুর পর খলিফাগণও ব্যভিচারের শাস্তি হিসেবে রজম প্রয়োগ করেছেন কিনা, তা নিয়ে অবশ্য বির্তক রয়েছে। যদিও সহীহ বুখারীতে প্রাসঙ্গিক একটি হাদীস রয়েছে। একবার সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আবু আওফকে (রা.) একজন তাবেয়ী জিজ্ঞেস করলেন, মায়েজ (রা.) এবং গামেদী গোত্রের ওই মহিলার (রা.) ঘটনা কি সূরা নূর নাযিলের আগে ছিল, নাকি পরে ছিল? উল্লেখ্য, তাদেরকে পাথর নিক্ষেপে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছিল। সাহাবী জবাব দিলেন, আমি জানি না। আমি নিশ্চিত নই।
সুতরাং, এখন এ ধরনের বিচারের ক্ষেত্রে পূর্বের বিধানের পরিবর্তে কোরআনে বর্ণিত ১০০ বেত্রাঘাতের শাস্তিই প্রযোজ্য হবে। আমি মনে করি, কোনো বিষয়ে সংশয় দেখা দিলে আমাদেরকে কোরআনের দিকেই ফিরে যেতে হবে। যেহেতু এটি সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য। তাছাড়া এ প্রসঙ্গে মহানবীর (সা.) একটি হাদীসও রয়েছে। তিনি বলেছেন, ادرئوا الحدود بالشبهات (ন্যূনতম সংশয় থাকলেও হুদুদ প্রয়োগ থেকে বিরত থাকো)।
উল্লেখিত মায়েজের (রা.) ঘটনার ক্ষেত্রে যেটা নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে সেটা হলো, ঘটনাটি সূরা নুর নাযিলের আগে নাকি পরে। আরেকটি বিষয় হলো ইজতিহাদ অবলম্বন না করে নিছক আক্ষরিক অর্থে হুদুদ প্রয়োগ করলে একটা সংশয় থেকেই যায়। অথচ কোরআন ও সুন্নাহর দাবি হলো, সমাজ ও সময়ের বাস্তবতার সাথে শরীয়াহ আইনকে সমন্বয় করা। যদিও এই ব্যাপারটি এখন করা হচ্ছে না। কেলান্তান প্রদেশের প্রস্তাবিত হুদুদ আইনের কথাই ধরা যাক। সেখানে ছয়টি শাস্তিকে হুদুদ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে আমার মতে, সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, ধর্মত্যাগ এবং মদপান— এই শাস্তিগুলো হুদুদের আওতায় পড়ে না।
মুহাম্মদ ইউনুস: তারমানে এই হুদুদ বিলটি নিয়ে আরো আলাপ-আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে?
হাশিম কামালী: আমি বলবো, কোনো ধরনের ইজতিহাদ না করে নিছক ফিকাহর বইপত্র ঘেঁটে এই বিলটি প্রস্তুত করা হয়েছে। এ জন্য আমি বলে থাকি, হুদুদ প্রয়োগের যে নানান ধরন ও প্রেক্ষাপট রয়েছে, তার উপর আমাদের নজর ফেরাতে হবে। আমরা সত্যিকার অর্থে ইসলামের দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গির বাস্তবায়ন করতে চাইলে মহানবীর (সা.) সেই নীতি অনুসরণ করতে হবে, যেখানে শাস্তি প্রয়োগের বেলায় ন্যূনতম বিকল্প গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে। অথচ এখন সর্বোচ্চ বিকল্পটাই গ্রহণ করা হচ্ছে!
মুহাম্মদ ইউনুস: আমাদের সময় খুব সংক্ষিপ্ত। তারপরও আপনাকে আরো কিছু প্রশ্ন করতে চাই। হুদুদ আইন কি ঈমানের অঙ্গ? এটি কি আকীদার অংশ? এই অর্থে যে একজন মুসলিম হিসেবে আমাকে এটি প্রতিষ্ঠা করতেই হবে?
হাশিম কামালী: না, তা নয়। ইসলামের মূলভিত্তি হলো এর পাঁচটি স্তম্ভ (আরকান)। আমরা সবাই সেগুলো জানি। তাছাড়া একটি শাস্তির বিষয় কখনো আকীদার অংশ হতে পারে না। হুদুদ ইসলামের কোনো রুকন নয়। এটি ঈমানের অঙ্গও নয়।
তারচেয়েও বড় কথা হলো একটি হাদীসে বলা হয়েছে, কোনো মুসলমানকে যদি শাস্তি থেকে বাঁচিয়ে দেয়ার উপায় থাকে, তাহলে প্রথমে সেই উপায়টি খুঁজে বের করো।
ইসলামের প্রাথমিক যুগের ইতিহাস খেয়াল করলে আপনি দেখতে পাবেন, হুদুদ সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয় নিয়ে মহানবী (সা.) ও সাহাবীদের নিকট কেউ আসলে তিনি বার বার প্রশ্ন করে জানতে চাইতেন, ঘটনার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি পুরোপুরি নিশ্চিত কি না। এমন একটি ঘটনার বর্ণনাও হাদীসে পাওয়া যায়। আমার বইয়ে ঘটনাটি উল্লেখ করেছি। একবার এক ব্যক্তি মহানবীর (সা.) কাছে এসে বললো— আমাকে শাস্তি দিন, কারণ আমি যিনা করেছি। এ ঘটনার জন্য আমার তীব্র অনুশোচনা হচ্ছে। তখন নামাযের সময় হয়ে গিয়েছিল। মহানবীর (সা.) পেছনে দাঁড়িয়ে সবাই নামায আদায় করলেন। নামাযের পর লোকটি মহানবীকে (সা.) আবার বললো— আমি শাস্তি পেতে চাই। জবাবে মহানবী (সা.) বললেন— তুমি কি আমার পেছনে দাঁড়িয়ে নামায পড়োনি? আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।
এ ব্যাপারে এটাই ছিল মহানবীর (সা.) কর্মনীতি। তিনি সবসময় ৩/৪ বার জিজ্ঞেস করতেন— তুমি কি ঘটনার ব্যাপারে নিশ্চিত? তোমার বোধহয় কোনো ভুল হচ্ছে। তুমি হয়তো…। এভাবে ন্যূনতম কোনো সংশয় থাকলেও তিনি হুদুদ প্রয়োগ না করার চেষ্টা করতেন।
মুহাম্মদ ইউনুস: খুবই ইন্টারেস্টিং বিষয়। এটি নিয়ে আমাদের আরো আলোচনার অবকাশ রয়েছে। যাই হোক, হুদুদ নিয়ে চলমান বিতর্কে আমাদের ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান কেমন হওয়া উচিত? এ ব্যাপারে সংক্ষেপে যদি আপনার অভিমত জানাতেন।
হাশিম কামালী: ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো হুদুদকে রাজনৈতিকীকরণ না করা। হুদুদকে বুঝতে হলে প্রথমে কোরআনের মর্মার্থকে সামগ্রিক অর্থে বুঝার চেষ্টা করতে হবে। তারপরেই বুঝা যাবে, হুদুদ প্রকৃতপক্ষে অপরিবর্তনযোগ্য কোনো ব্যাপার নয়। বরং অনুশোচনা ও সংশোধন ইত্যাদিকে বিবেচনায় নিয়ে হুদুদের প্রচলিত ধারণার মধ্যে সংস্কার আনার সুযোগ রয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গিকে হুদুদের তাৎপর্য হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এই দৃষ্টিভঙ্গির মূল কথা হলো, কোরআনের নির্দেশনা মোতাবেকই যে হুদুদ প্রয়োগ করতে হবে, এ ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন নেই। এর পাশাপাশি হুদুদের প্রকৃত উদ্দেশ্য যেন পূরণ করা যায়, সে জন্যই আমাদেরকে সর্বোত্তম পন্থা অবলম্বন করতে হবে। ন্যায়বিচার কিংবা অপরাধ দমন নয়, নিছক হুদুদের জন্যই হুদুদ প্রয়োগ করতে হবে, যেন এটি আকীদার অংশ— এ ধরনের মানসিকতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। কোনো ধরনের শাস্তি বা যন্ত্রণা প্রদানকে ইসলাম কখনোই ঈমানের অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করেনি।
ইসলাম মানুষের জন্য রহমত, দয়া, ক্ষমা, এমনকি এগুলোর চেয়েও বেশি কিছু। আমাদের সমাজ কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে আলেমগণ হুদুদকে যেভাবে বুঝে থাকেন, সে ধরনের শাস্তি আরোপ করা ইসলামের উদ্দেশ্য নয়।