বাংলাদেশে ‘সেক্যুলারিজম’ বিতর্কের সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

এডিটর’স নোট: ২০১০ সালের ৭ এপ্রিল সেক্যুলারিজম নিয়ে প্রফেসর ড. মাহবুব উল্লাহ রেডিও তেহরানে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। তাদের ওয়েবসাইটে সাক্ষাৎকারটির সংক্ষিপ্ত ভাষ্য পাবলিশ করা হয় এবং সাথে সম্পূর্ণ অডিও সংযুক্ত করা হয়। সিএসসিএস-এর পাঠকদের জন্য অডিও থেকে সম্পূর্ণ সাক্ষাৎকারটি অনুলিখন করেছেন মো: হাবিবুর রহমান হাবীব।

প্রশ্ন: সেক্যুলারিজম একটা মতবাদ, এটা আমরা জানি। অনেক আগে থেকে অর্থাৎ ঊনবিংশ শতাব্দির মাঝামাঝি সময়ে এ মতবাদটি এসেছে। বিশ্বের অনেক দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে সেক্যুলারিজমকে গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারও ৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা বলছে। আর সেটা যদি সফলই হয় তাহলে সেক্যুলারিজম প্রতিষ্ঠার কথাটা  স্বাভাবিকভাবেই সামনে চলে আসবে। সেজন্য সেক্যুলারিজম নিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এই সেক্যুলারিজম মতবাদটা আসলে কী? এই মতবাদের বক্তব্যটা কী? এই বিষয়ে আপনি যদি সংক্ষেপে বলেন…।

উত্তর: ধন্যবাদ, আমাকে অত্যন্ত সুন্দর একটা প্রশ্ন করার জন্যে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেক্যুলারিজমকে একটি আদর্শ হিসেবে ১৯৭২ সালের সংবিধানে প্রতিষ্ঠিত  করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ আন্দোলন এবং পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধ এবং একটি জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের যে অর্জন- তার পেছনে আমাদের যে চেতনা কাজ করেছিলো, যে আদর্শ কাজ করেছিলো এবং সে ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশ আন্দোলনের সূচনা হয়েছিলো, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সুতরাং আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে সে আন্দোলনের একটা সম্পর্ক ছিলো।

কিন্তু আমরা অত্যন্ত আশ্চর্যের সাথে লক্ষ্য করলাম যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হিসেবে ৭২-এর সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা তথা সেক্যুলারিজমকে একটি আদর্শ হিসেবে প্রতিস্থাপন করা হয়েছিলো। এ বিষয়ে প্রথমত যে প্রশ্নটি আসে সেটি হচ্ছে, বাংলাদেশের ৮৬ শতাংশ মানুষ ধর্ম বিশ্বাসে মুসলমান। ইসলাম এমন একটি ধর্ম এবং জীবনব্যবস্থা যে, মানুষের সামগ্রিক জীবনব্যবস্থা এর মধ্যে প্রতিফলিত। ইসলামকে যদি জনজীবনে কার্যকর করা যায় তাহলে খুব স্বাভাবিক কারণেই অন্যান্য ধর্মাবলম্বী যারা আছেন তারা নিরাপদ  হবেন, নিশ্চিত  হবেন। তাদের নিরাপত্তার বিধান সেখানে থাকবে। ন্যায়ভিত্তিক অর্থনীতি সেখানে পরিচালিত হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে।

কিন্তু আমরা লক্ষ্য করলাম, এই যে সেক্যুলারিজম প্রতিস্থাপিত করা হলো, এর পেছনে জনগনের কোনো ম্যান্ডেট ছিলো না। কারণ মুক্তিযুদ্ধ যখন সংঘটিত হয়েছিলো, তার আগে ৬ দফার ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭০-এর নির্বাচন করেছিলেন এবং নির্বাচন পরবর্তী পর্যায়ে পাকিস্তানের ‍ক্ষমতাগোষ্ঠী তাঁকে ক্ষমতা না দিয়ে অতর্কিত আক্রমণের ফলে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা ঘটে। সে সময় আওয়ামীলীগের ৬ দফা, ছাত্রলীগের ২১ দফা এবং ১১ দফা- এগুলোর কোনোটিতেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনা হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের কথা ছিলো না। আমি মনে করি, মুক্তিযুদ্ধের সময় আওয়ামীলীগের নেতৃত্বের একটি অংশ তখন ভারতের পশ্চিম বাংলায় অবস্থান করছিলো। তারা তখন পশ্চিম বাংলার বামপন্থী রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন পাকিস্তানের কারাগারে ছিলেন। সেই অবস্থায় সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা- এ দুটো বিষয়কে আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণায় গ্রহণ করা হয়। পরবর্তীতে একটি নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পর ৭২-এর সংবিধানে এগুলোকে প্রতিস্থাপিত করা হয়। কিন্তু আমি মনে করি, জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে জনগণ এ দুটো ধারণাকে গ্রহণ করছে কিনা, তার জন্য রেফারেন্ডাম হওয়া দরকার ছিলো। সেটি করা হয়নি।

আর একটি বিষয় আমি এখানে উল্লেখ করবো, আপনি বলেছেন, সেক্যুলারিজমের ধারণাটি পাশ্চাত্য জগতের দর্শনে উন্মেষ ঘটেছে এবং সেখানে ক্যাথলিসিজম ও প্রোটেস্ট্যাটিজমের একটি ভূমিকা ছিলো। চার্চ যখন জনগণের উপর ধর্ম বিশ্বাসকে চাপিয়ে দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করার চেষ্টা করছিলো তখন সেক্যুলারিজমের আবির্ভাব ঘটে। কিন্তু এখানে একটি প্রশ্ন, ফিলসফিক্যালি যদি আমরা দেখি তাহলে দেখবো, ধর্মনিরপেক্ষতার ইংরেজী প্রতিশব্দ হচ্ছে non-comiunalism। তবে সেক্যুলারিজমের বাংলা যথার্থ প্রতিশব্দ হিসেবে সমাজ বিজ্ঞানে বা দর্শনে যে শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে সেটি হচ্ছে ইহজাগতিকতাবাদ । সেটি হিন্দু হোক, মুসলমান হোক, বৌদ্ধ-খৃস্টান হোক- পৃথিবীর যত ধর্ম বিশ্বাসী মানুষ আছে, তাদের কারো কাছেই ইহজাগতিকতাবাদ (যেটা সেক্যুলারিজমের আসল অর্থ ও দ্যোতনা) হিসেবে সেক্যুলারিজমকে জনগণ  গ্রহণ করতে পারে না, ধর্ম বিশ্বাসী কেউ এটা গ্রহণ করতে পারে না। আবার ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ হিসেবেও তারা সেক্যুলারিজমকে গ্রহণ করতে পারে না। কারণ কোনো ধর্ম বিশ্বাসী ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারেন না।

বাংলাদেশে একটা বিরাট রকমের বিভ্রান্তি আমাদের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে আছে। আমি মনে করি শুধু বিভ্রান্তিই নয়, ইচ্ছা করেই তারা সেক্যুলারিজমের একটা উদ্ভট এবং অগ্রহণযোগ্য ধারণা প্রচার করতে চাচ্ছে, সেটি হলো সেক্যুলারিজম মানে ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদ। তাদের এই বক্তব্যের মধ্যে এক ধরনের ধর্মহীনতার প্রশ্রয় এবং আশ্রয়ও আছে। বাংলাদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, মুসলমান- আমরা সবাই আছি। এখানে প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী এবং ধর্মের প্রতি পরস্পরের ভক্তি,  শ্রদ্ধা ও সহমর্মিতা রয়েছে।  আমাদেরকে প্রকৃত প্রস্তাবে হতে হবে অসাম্প্রদায়িক। সেদিক থেকে আমরা যদি বিবেচনা করি তাহলে অসাম্প্রদায়িকতার যে চেতনা সেটি ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী মুসলমানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উপস্থিত থাকার কথা। তা না হলে তিনি মুসলমানই থাকেন না।

বাংলাদেশে সেক্যুলারিজমকে আসলে একটি রাজনৈতিক প্রপাগান্ডা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। দেশের মধ্যে সেক্যুলারিজমের নামে সত্যিকার অর্থে সাম্প্রদায়িকতাকে প্রচার করা হচ্ছে। এটি আমার ধারণা। আমার মনে হয়, যদি কোনো সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে দেশবাসী বুঝতে সক্ষম হবে যে আসলে সেক্যুলারিজমের কথা যারা  বলছেন তারা ধর্মহীনতা চাচ্ছেন। একই সাথে তারা সাম্প্রদায়িকতাকে সম্প্রসারিত করার  চেষ্টা করছেন।

প্রশ্ন: সেক্যুলারিজমের সাথে ইসলামের কোনো বিরোধ আছে কিনা? অর্থাৎ আমি জানতে চাচ্ছি, মুসলমানদের কি সেক্যুলারিজম গ্রহণ করার কোনো প্রয়োজন আছে?

উত্তর: একজন ধর্ম বিশ্বাসী তিনি যদি মুসলমান হন, তাহলে তো বটেই; প্রকৃত ধর্ম বিশ্বাসী বা ইসলামে বিশ্বাসী কোনো ব্যক্তি সেক্যুলারিজমের যে দ্যোতনা বা cautiousness-এর কথা আমরা বলি সেটি মুসলমান, হিন্দু,  বৌদ্ধ, খৃস্টান কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা। যে কোনো ধর্ম বিশ্বাসীর কাছে তথাকথিত অর্থে যে সেক্যুলারিজম (যাকে রাজনীতিতে ব্যবহার করা হচ্ছে) এবং ইউরোপিয়ান এনলাইটেনমেন্টের মাধ্যমে যে সেক্যুলারিজমের উৎপত্তি ঘটেছে- কোথাও সৃষ্টিকর্তার প্রতি যে বিশ্বাসকে গ্রহণ করা হয়নি। পরজগতের যে ধারণা সেটাও সেক্যুলারিজম গ্রহণ করে না। সেক্যুলারিজম হচ্ছে সর্বার্থে একটা ইহজাগতিক দৃষ্টিকোণ। অর্থাৎ মানুষের আচার-আচরণ, নৈতিকতাবোধ ও ন্যায়বোধ সমস্ত কিছু ইহজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই দেখতে হবে।

পাশ্চাত্যের  যে নৈতিকতাবোধ (আমরা যেটাকে moralism বলি), সেই moralism প্রাচ্যের যে ছয়টি প্রধান ধর্ম, সেগুলো থেকে উৎসারিত। একটি কথা এই প্রসঙ্গে আমি বলতে  চাচ্ছি, West  help in successful to give or develop different philosophy। কিন্তু তারা ধর্মকে জনসমাজে প্রতিষ্ঠা করতে মারাত্মকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। পৃথিবীর ছয়টি প্রধান ধর্ম কিন্তু ওরিয়েন্টাল সোসাইটির, অক্সিডেন্টাল সোসাইটির নয় অর্থাৎ প্রাচ্য সমাজের, পাশ্চাত্য সমাজের নয়।

আপনার প্রশ্নের জবাবে আমি বলবো, যদি অসাম্প্রদায়িকতা অর্থে সেক্যুলারিজমকে ব্যবহার করা হয় তাহলে বাংলাদেশের মুসলমানরা সবচেয়ে বেশি সেক্যুলার। আপনি যদি ভারত এবং বাংলাদেশকে তুলনা করেন, তাহলে উপনিবেশিক আমল থেকে পাকিস্তান আমল পর্যন্ত এবং বর্তমান সময় পর্যন্ত তিনটি historical phase-এ যদি ভাগ করে দেখানো যায়; তাহলে দেখবেন ভারতে যত সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটছে, সে তুলনায় বাংলাদেশে তার পরিমান খুবই কম। দুর্ভাগ্য হচ্ছে এই যে, আমাদের এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিক আছে, যাদের বাংলাদেশের সংস্কৃতি, সাহিত্য, ঐতিহ্য, ইতিহাসের উপর কোনো আকর্ষণই নেই। বরং এসবের উপর এক ধরনের অনীহা ও বিভ্রান্তিকর ধ্যান-ধারণা তারা পোষণ করেন। তারা মনে করেন, আমাদের প্রতিবেশি রাষ্ট্রের যে সংস্কৃতি, ধ্যান-ধারণা, আদর্শ-বিশ্বাস- সেগুলো হচ্ছে প্রগতিশীল ও উন্নয়নকামী। সেগুলোকেই বাংলাদেশের সংস্কৃতি হিসেবে গ্রহণ করার মনোবাঞ্ছা তাদের মধ্যে আমরা লক্ষ্য করছি। এর ফলে গোটা জাতি আজ বিভক্ত।

আমরা লক্ষ্য করছি, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক ধরনের সম্প্রসারণবাদী বুদ্ধিবিত্তিক চর্চা হচ্ছে। আমরা জনজীবন, রাজনীতি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে আমাদের স্বাধীনতা এবং বিজয়ের সত্যিকারের কোনো ইতিবাচক প্রভাব রাখতে সক্ষম হচ্ছি না। রাজনীতি একটা সংহারী মনোভাব ধারণ করছে। অতি সম্প্রতি সরকারী দল এবং বিরোধী দল সংসদে এ সমস্ত বিষয় নিয়ে যে আচরণ করছে, এর সঙ্গে গণতন্ত্রের কোনো সর্ম্পক নেই, সভ্যতা-ভব্যতার কোনো সর্ম্পক নেই। রাজনৈতিক সুস্থ সংস্কৃতি বা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি যেটাকে বলা হয়, তার কোনো লক্ষণ সেখানে নেই।

সুতরাং, আপনি যে প্রশ্নটি করেছেন, অসম্প্রদায়িকতা যদি সেক্যুলারিজম হয় (যদি আমরা সেটি মনে করি), তাহলে বাংলাদেশের সবচাইতে বেশি সেক্যুলার দৃষ্টিভঙ্গী আছে। আর ইহজাগতিকতাবাদ যদি সেক্যুলারিজম হয় (যেটা পাশ্চাত্যে ফিলসফিক্যালি ডেভেলপ করেছে), তাহলে বাংলাদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান, মুসলিম- কেউই সেই সেক্যুলারিজমকে গ্রহণ করতে পারে না।

প্রশ্ন: কিন্তু বাংলাদেশে তো আমরা লক্ষ্য করি, ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থে সকল ধর্মে বিশ্বাসীদের ধর্মীয় স্বাধীনতাকে বোঝানো হয়। ইসলামও তো সে কথাই বলে। তাহলে কি সেক্যুলারিজম আর ইসলাম একই কথা বলছে না?

উত্তর: অবশ্যই আমি আপনার সাথে সম্পূর্ণ একমত; যদি এটা  হয়ে থাকে যে, সেক্যুলারিজম অর্থ হচ্ছে সকল সম্প্রদায়ের  প্রতি সহনশীলতা, সহমর্তিতা এবং রাষ্ট্র সকল ধর্মাবলম্বীর প্রতি একই রীতি-নীতি এবং আইন কার্যকর করবে। সেই দিক থেকে আমি বলবো, এটা বাংলাদেশে অবশ্যই গ্রহণীয় এবং এটা বাংলাদেশে বিদ্যমান। কিন্তু সেক্যুলারিজম বলতে আরো কিছু ডাইমেনশন ডেভেলপ করেছে। যেমন, এখানে বলা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এবং বিপক্ষের শক্তি। আমি আগেই বলেছি, এদেশের ৮৬ শতাংশ মানুষ মুসলমান। তাদের অধিকাংশই দাড়ি রাখেন, টুপি পরেন এবং ইসলামী নিয়ম-কানুনগুলো তারা  পালন করেন। কিন্তু আমাদের এখানে দেখানো হচ্ছে, এই ধরনের যত ব্যক্তিবর্গ আছে, এই ধরনের বিশ্বাস এবং বোধ যাদের আছে- তারা সবাই স্বাধীনতা বিরোধী, স্বাধীনতার চেতনা বিরোধী এবং তারা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি।

কিন্তু আমি যে প্রশ্নটি এ প্রসঙ্গে রাখতে চাই সেটি হচ্ছে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘পাকিস্তান রক্ষিত হলে ইসলাম রক্ষিত হবে’ এ ধরনের বিশ্বাস থেকে একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত কিছু কিছু মানুষ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু তার অর্থ তো এই নয় যে, বাংলাদেশের যে ৩০ লক্ষ মানুষ মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিলো এবং যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলো তাদের মধ্যে মুসলমান ছিলেন না! দাড়ি-টুপি পরা লোকজন ছিলেন না! ইসলামী ঐতিহ্যের যারা অনুসরণ করেন তারা ছিলেন না! বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে  যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের যদি ধর্মভিত্তিক পর্যালোচনা করেন, তাহলে সেখানে মুসলমানের সংখ্যা কতো? অন্য ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা  কতো? ৫২’র একুশে ফেব্রুয়ারিতে যারা শহীদ হয়েছিলেন তারা তো সকলেই মুসলমান ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তিনি তো চিন্তায় এবং চেতনায় বাঙালি মুসলমানই ছিলেন।

এখন যদি মুসলমানিত্বকে বাদ দিয়ে, শুধু বাঙালিত্বকে বাংলাদেশের চেতনা বলা হয়; তাহলে তো বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যৌক্তিকতাই থাকে না। কারণ বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে বাঙালিত্ব আছে এবং একই সাথে মুসলমানিত্বও আছে। আবার পশ্চিম বাংলার মানুষের মধ্যে বাঙালিত্ব আছে এবং একই সঙ্গে ভারতীয়ত্ব এবং হিন্দুত্ব আছে। ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিম বাংলা এক হয়ে যায়নি। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ, ১৯১১ সালের বঙ্গভঙ্গ রদ এবং ১৯৪৭ সালে আবার বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে ভারত এবং পাকিস্তানের জন্ম- এই রাজনীতি যদি  আমরা দেখি, তাহলে দেখবো পশ্চিম বাংলার বাঙালিরা কখনো হিন্দুত্বকে ত্যাগ করেনি, পূর্ব বাংলার বাঙালিরাও কখনো মুসলমানিত্ব ত্যাগ করেনি।

আবার একই সঙ্গে যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, তাহলে  পশ্চিম  বাংলার বাঙালির বাঙালিত্ব আর পূর্ব বাংলা বা আজকের বাংলাদেশের বাঙালির বাঙালিত্ব তো এক নয়। এই দুই বাঙালিত্বের মধ্যে তো অনেক পার্থক্য আছে। বোধ-বিশ্বাসের পার্থক্য আছে, আচার-আচরণের পার্থক্য আছে, খাদ্যদ্রব্য গ্রহণে পার্থক্য আছে, নিয়ম-কানুনের পার্থক্য আছে, ইতিহাস-ঐতিহ্যের পার্থক্য আছে। যে জন্য বাংলাদেশ একটি  জাতি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পশ্চিম বাংলার মধ্যে সেই বোধ নেই বলে তারা বাঙালি হওয়ার পরও ভারতীয় জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী এবং ভারতের একটি  প্রদেশ হিসেবে তারা ভারত রাষ্ট্রের সাথেই আছে। এই সত্যতাকে তো অস্বীকার করা যাবে না।

কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দিয়ে বাংলাদেশ নামক এই জাতিরাষ্ট্রের মানুষদের অস্বীকার করার একটা প্রবণতা রয়েছে। এটা তো অত্যন্ত দুঃখজনক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে তো মুসলমানিত্বের চেতনার কোনো সংঘর্ষ নেই। বাঙালিত্বের চেতনার সাথেও কোনো সংঘর্ষ নেই। এই বাঙালিত্বের চেতনা হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের বাঙালিত্বের চেতনা। পশ্চিম বাংলার মানুষের বাঙালিত্বের চেতনা তো বাংলাদেশের মানুষের বাঙালিত্বের চেতনা নয়। আজকে বাংলা সাহিত্যের প্রধান কেন্দ্র হচ্ছে ঢাকা। যদিও এক সময় বাংলা সাহিত্যের প্রধান কেন্দ্র ছিলো পশ্চিম বাংলা। এইসব প্রশ্ন তো আসবে। সুতরাং আমি মনে করি বাংলাদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান, মুসলমান- আমরা সকলে ঐক্যবদ্ধ আছি। প্রত্যেকের প্রতি প্রত্যেকের সহমর্মিতা আছে।

সর্বশেষ আমি বলবো, বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমানার ভেতরে বসবাসকারী মানুষের যে সংস্কৃতি, সাহিত্য, ইতিহাস চেতনা, অর্থনীতি এবং জাতীয়তাবোধ- এসব বিষয়ে যতদিন পর্যন্ত সম্মিলিতভাবে, অনৈক্যকে পরিহার করে, আমরা একমত পোষণ করতে  না পারব; ততদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব দুর্বল থাকবে। ততদিন পর্যন্ত আমরা জনজীবনে কোনো উন্নয়ন ঘটাতে  পারব না এবং আমাদের যে চলমান বিভ্রান্তি, তা থেকেও মুক্তি মিলবে না।

মাহবুব উল্লাহ
মাহবুব উল্লাহ
প্রফেসর ড. মোহাম্মদ মাহবুব উল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজ বিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতোকত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য ও পরবর্তীতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্বে নিয়োজিত থাকাকালীন ২০১২ সালের ৭ জানুয়ারি এ বরেণ্য শিক্ষাবিদ মৃত্যুবরণ করেন।

সাম্প্রতিক

এ ধরনের আরো নিবন্ধ