Yusuf Al-Qaradawi: Islam and Modernity

ইউসুফ আল কারযাভী: ইসলাম ও আধুনিকতা

এডিটর’স নোট: সমসাময়িক সময়ে সবচেয়ে প্রভাবশালী ইসলামী স্কলারদের মধ্যে ইউসুফ আল কারযাভী শীর্ষস্থানীয় একজন। কারযাভীকে নিয়ে Yusuf Al-Qaradawi: Islam and Modernity শীর্ষক একটি গবেষণামূলক বই লিখেছেন স্যামুয়েল হেলফন্ট। ২০০৯ সালে তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের মোশে দায়ান সেন্টার থেকে এটি প্রকাশিত হয়। সিএসসিএস-এর পাঠকদের জন্য আমরা বইটির অংশবিশেষের অনুবাদ তুলে ধরছি। অনুবাদ করেছেন আইয়ুব আলী।

*****

ভূমিকা

৯/১১-র পর ইসলাম নিয়ে লেখালেখি করা ভীষণ স্পর্শকাতর ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারো কারো মতে, ইসলাম শান্তির ধর্ম। নিউইয়র্ক, মাদ্রিদ, লন্ডনসহ বিভিন্ন স্থানে হামলাকারী উগ্রপন্থীরা ইসলামকে কলুষিত করেছে। অন্যদের মতে, ইসলাম আসলে একটি সহিংস ধর্ম। যারা শান্তির ধর্ম হিসেবে ইসলামকে উপস্থাপন করছে তারা মূলত আত্মপক্ষ  সমর্থন করছে। মুসলমানদের একপাক্ষিক ইতিহাস ও রক্ষণশীল ধারার আলোকে এই ধরনের বিশ্লেষণগুলো করা হয়। অথচ যে কোনো ধর্মেরই নির্ভরযোগ্য ইতিহাস থাকে। যে কোনো ধর্ম বা বিশ্বাস ব্যবস্থার মতো ইসলামেও ব্যাখ্যার অবকাশ রয়েছে। মুসলিমগণ একই উৎস থেকে ইসলামকে জানলেও স্বীয় বিশ্বাস সম্পর্কে তাদের উপলদ্ধি ভিন্নরকম হয়। এরই আলোকে আলোচ্য গবেষণাটি ইসলামকে বুঝার একটি প্রচেষ্টা মাত্র। ইসলামকে সংজ্ঞায়িত করা এর উদ্দেশ্য নয়। এই দায়িত্ব পাশ্চাত্য, অমুসলিম স্কলার বা অন্য কারো নয়। ইসলামকে সংজ্ঞায়িত করা মুসলমানদেরই দায়িত্ব।

বলা যায়, অমুসলিমদের জন্য সমসাময়িক ইসলামকে বুঝার অনেক পথ খোলা রয়েছে। মুসলিমরা কী বিশ্বাস করে এবং তাদের ধর্মকে কীভাবে পালন করে – তা পর্যবেক্ষণ করা ইসলামকে বুঝার সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি। ইসলামের অনেক ধরনের ব্যাখ্যা থাকায় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে – ইসলামকে বুঝতে কোন ধরনের মুসলিমদের পর্যবেক্ষণ করা উচিত। যদিও ইসলামকে বুঝতে আগ্রহীদের কাছে সব ঘরানার ব্যাখ্যাই মূল্যবান, তবে সবচেয়ে প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় ইসলামী স্কলারদের মতামত দিয়ে শুরু করাই যুক্তিযুক্ত।

বর্তমানে অনেক ইসলামী স্কলার রয়েছেন, যারা বেশ প্রভাবশালী। এদের মাঝে যে কোনো বিবেচনায় অন্যদের চেয়ে এগিয়ে আছেন ইউসুফ আল কারযাভী। International Association of Muslim Scholars প্রতিষ্ঠায় কারযাভী মূখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। European Council on Fatwa and Research-এর প্রেসিডেন্ট হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করছেন।[1] জায়েলস ক্যাপলের মতে, “বিশ্ব জুড়ে খুতবা দেয়ার ক্ষেত্রে কারযাভী আরবী ভাষাভিত্তিক একটি স্বতন্ত্র ধারা তৈরি করেছেন।”[2] Muslim Council of Britain মনে করে, “তিনি বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী স্কলার।”[3] বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্কলারদের অন্যতম হিসেবে কারযাভীর যেমন প্রচুর সমর্থক রয়েছে, তেমনি সমালোচকও রয়েছে।

জন এসপোজিটো ও ক্যারেন আর্মস্ট্রংয়ের মতো সুপরিচিত কয়েকজন পশ্চিমা স্কলার কারযাভীকে মধ্যপন্থা অনুসারী ও সংস্কারপন্থী[4] মনে করলেও অন্যরা ঠিক এর বিপরীত ধারণাই পোষণ করেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০০৪ সালে তেইশটি দেশের প্রায় আড়াই হাজার মুসলিম বুদ্ধিজীবী একটি পিটিশনে স্বাক্ষর করে। সেখানে ‘সন্ত্রাসবাদী ধর্মতাত্ত্বিক’দেরকে বিচারের মুখোমুখী করার জন্যে তারা জাতিসংঘের নিকট আহ্বান জানায়। এই পিটিশনে ইউসুফ আল কারযাভীর নাম রয়েছে এবং তাকে ‘sheiks of death’-এর একজন হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।[5]

২০০৫ সালের দিকে এই বিতর্কটি তু্ঙ্গে উঠে। ‘বৃহত্তর লন্ডন কর্তৃপক্ষ’ কর্তৃক আয়োজিত এক কনফারেন্সে তৎকালীন লন্ডন শহরের মেয়র কেন লিভিংস্টোন কারযাভীকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। এই ঘটনায় ব্রিটিশ মিডিয়া কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখায়। Coalition of Many of London’s Diverse Communities নামের একটি গ্রুপ অভিযোগ করে যে, মেয়র এমন এক ব্যক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন যিনি সন্ত্রাসবাদ, নারীদের খতনা ও স্ত্রী প্রহারের সমর্থক, সমকাম বিরোধী এবং ইহুদী বিদ্বেষী।[6] অবশ্য মেয়র লিভিংস্টোন নিজের সিদ্ধান্তের পক্ষে অটল থাকেন। কারযাভীর প্রতি আরোপিত অভিযোগকে খণ্ডন করতে গিয়ে বলেন – “ইহুদীবিদ্বেষ, সমকামীদের মৃত্যুদণ্ড এবং পারিবারিক নির্যাতনের সমর্থনসহ কারযাভীর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো কাটতি বাড়াতে মিডিয়ার অপ্রপ্রচার ছাড়া কিছুই নয়।” তিনি আরো বলেন, “তাকে সন্ত্রাসবাদের সমর্থক বলা হয়! অথচ বাস্তবতা হচ্ছে যেসব ইসলামী স্কলার আল কায়েদার মতো সন্ত্রাসবাদী গ্রুপগুলোর নিন্দা করেন, তাদের মধ্যে কারযাভী সবচেয়ে স্পষ্টভাষী।[7]

কারযাভীর সমর্থক এবং সমালোচকদের মাঝে কিছু মৌলিক মতপার্থক্য রয়েছে। এই গবেষণায় ক্রমান্বয়ে সেগুলো আলোচনা করা হবে। কোন দৃষ্টিকোণ থেকে কারযাভীকে বিবেচনা করা হচ্ছে, তা-ই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীদের পরিবর্তে ইসলামী স্কলারদের মানদণ্ডে দেখলে তাকে অনেক বেশি মধ্যপন্থী মনে হয়। এরপরও কারযাভীর সমর্থক ও সমালোচকদের মাঝে বিদ্যমান মতবিরোধগুলোর মূলে যে প্রশ্নটি থেকে যায় তা হলো – তাকে কোন মানদণ্ডে বিচার করা হবে? ইসলামী নাকি পশ্চিমা?  কারযাভীকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করার পর আমার দৃষ্টিতে তার অবস্থান পুরোপুরিভাবে পশ্চিমাও নয়, ইসলামীও নয়। বরং আধুনিকতার কাঠামোর মধ্যে একজন ইসলামী স্কলার হিসেবে আমি তাকে বুঝার চেষ্টা করেছি। কারযাভীর রচনাগুলো মূলত আধুনিক ধ্যানধারণায় পরিপূর্ণ। যেমন – গণতন্ত্র ও নারীবাদ। ইসলামের সাথে এগুলোর সম্পর্ক নির্ণয় করা তার কাজের অন্যতম বিষয়। কেউ কেউ বলতে পারেন,এই দৃষ্টিকোণ থেকে তাকে বিচার করা এক ধরনের হেজেমনিক ব্যাপার এবং আমি হয়ত মধ্যপ্রাচ্যের একজন স্কলারের ওপর পশ্চিমা মূল্যবোধ চাপিয়ে দিচ্ছি। হয়তো এটা সত্যি যে, গণতন্ত্রের মতো ধ্যানধারণাগুলোর উৎপত্তি পশ্চিমে। কিন্তু শুধু আমি একাই কারযাভীর ওপর এসব ব্যাপার চাপিয়ে দিচ্ছি না। আধুনিক বিশ্বের আনাচে-কানাচে এসব ধ্যানধারণা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। কারযাভী তার অধিকাংশ কাজের ক্ষেত্রে এসব ধারণাকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছেন।

আধুনিকতার সংজ্ঞায়ন

এই গবেষণার কেন্দ্রে রয়েছে আধুনিকতার ধারণা। তাই পরিভাষাটির একটি বিশদ সংজ্ঞা প্রদান করা প্রয়োজন। আধুনিকতা নিয়ে এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে বিতর্ক চলছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে একটি বিশ্বাস প্রচলিত ছিল যে, পৃথিবী নিরন্তর আধুনিকতার দিকে এগিয়ে চলছে। এই বিশ্বাসের পাশাপাশি আরেকটা প্রচলিত ধারণা ছিল – আধুনিক মানেই ভালো কিছু। ডেরেক হপউড এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন,‍‍‍‌‌‌ “ভিক্টোরিয়ান ইংল্যান্ডে এ ধরনের মতাদর্শে বিশ্বাসীরা ভাবতো – তারা কতো ভালো জীবনযাপন করছে এবং দিনকে দিন এর জৌলুস বাড়ছে। অথচ ইউরোপের বাইরের লোকেরা কত পিছিয়ে…!  তাদের এই বিশ্বাস অনুযায়ী, পিছিয়ে পড়া গতানুগতিক তথা প্রাচ্যের লোকেরা যত বেশি ইউরোপীয় হয়ে উঠতে পারবে, তাদের জন্যে তা তত ভালো।”[8]

বিংশ শতাব্দীতে এসে এই দৃষ্টিভঙ্গি বড় ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখিয়ে দিয়েছে, আধুনিকতা শুধু ঔষধ ও বিদ্যুত নয়, বরং পারমানবিক অস্ত্র এবং গ্যাস চেম্বারও তৈরি করেছে। এই বাস্তবতা আধুনিকতার প্রচলিত ধারণাকে অনেকটা হালকা করে দিয়েছে। তারপরেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এই ধারণা রয়েছে যে, আধুনিকায়ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই বিশ্ব এগিয়ে চলছে এবং এই প্রক্রিয়াটি নিরন্তর ও সর্বজনীন। এই ধারণার উপর ভিত্তি করেই গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে ‘আধুনিকতা তত্ত্ব’ গড়ে ওঠে। এই তত্ত্বের সারকথা হচ্ছে – “আধুনিক ইউরোপে আধুনিকতার সাংস্কৃতিক আবহ ও একগুচ্ছ মৌলিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেছে। এগুলো গড়ে উঠার মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত আধুনিকতাই যে কোনো সমাজের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করবে। আধুনিকতার বিস্তৃতির সাথে সাথে বিশ্বব্যাপী এসবের প্রচলন ঘটবে।”[9]

তারপরও বাস্তবতা হচ্ছে, অনেক সমাজ আধুনিকতার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেলেও আধুনিকতা তত্ত্বের দেয়া এই ধারাকে অনুসরণ করেনি। এস এন আইজেনস্ট্যাড এ ব্যাপারে মনোযোগ আকর্ষণ করে বলেন, “অপশ্চিমা সমাজের অনেক আন্দোলন পাশ্চাত্যবিরোধী, এমনকি আধুনিকতাবিরোধী কোনো কোনো বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেছে। যদিও এসব আন্দোলন স্পষ্টতই আধুনিক।”[10] আইজেনস্ট্যাড খুব সাদামাটাভাবে দাবি করেছেন, “আধুনিকতা আর পাশ্চাত্যকরণ একই ব্যাপার নয়।”[11]

আধুনিকতা তত্ত্বের সেক্যুলারিজমের প্রতি পক্ষপাত ছিল। এই গবেষণার এটাও একটা বিশেষ আগ্রহের বিষয়। এই প্রবণতায় বিশ্বাসী লোকেরা মনে করে, ধর্ম হচ্ছে গতানুগতিক সমাজের ধ্বংসাবশেষ এবং সমাজ আধুনিক হওয়ার সাথে সাথে ধর্ম হারিয়ে যাবে। উদাহরণ হিসেবে রিচার্ড পি মিশেলের গুরুত্বপূর্ণ বই The Society of Muslim Brothers-এর কথা বলা যায়। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে লেখা এই বইটি নিঃসন্দেহে আধুনিকতা তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত। এর ভূমিকায় লেখক দাবি করেছেন, এতদিন মুসলিম ব্রাদারহুড সত্যিকার অর্থে ইন্টারেস্টিং একটি ব্যাপার ছিল। “যেটি এখন মুসলমানদের নিকট ততটা জনপ্রিয় ‘অবস্থানে’ নেই।” এটি আসলে এমন একটি বিষয় ছিল যার সময় এসেছিল এবং চলেও গেছে। তারপর তিনি বললেন, আমাদের আবেগকে ক্ষণিক সময়ের জন্যে অন্য কেউ ব্যবহার করে ফেলে। আমাদের উপলব্ধি হচ্ছে, আরব বিশ্বে জাতীয়তাবাদের মতো অপরিহার্য একটা সেক্যুলার সংস্কার জনপ্রিয়তা পেয়েছে। শুরুর দিকে ব্রাদারহুড যে আবেদন তৈরি করেছিল, তা নিঃশেষ করেই জাতীয়তাবাদের এই সংস্কার থামবে।”[12] প্রায় চল্লিশ বছর আগে মিশেলের এই বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। অথচ অন্যান্য ইসলামী গ্রুপগুলোসহ ব্রাদারহুড সবসময়ের মতো এখনো জনপ্রিয়।

‘আধুনিকতা কী নয়’ – এতক্ষণে তা বুঝা গেছে। কিন্তু ‘আধুনিকতা কী’ সেই প্রশ্নটা এখনো রয়ে গেছে। সমসাময়িক কয়েকজন স্কলার এই প্রশ্নের জবাব পেতে আধুনিকতা তত্ত্বের আগের কিছু তত্ত্বের দিকে নজর দেয়া দরকার বলে মনে করেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী চিন্তাবিদ সম্ভবত জার্মান দার্শনিক ইউগেন হেবারমাস।

হেবারমাস দাবি করেন, আধুনিক ইউরোপের শুরুর দিকে নগরায়ন, শিল্পায়ন, গণশিক্ষা ও এনলাইটেনমেন্ট মিলে আধুনিকতাকে তৈরি করলেও এগুলো স্বয়ং আধুনিকতার মৌলিক কোনো বিষয় নয়। এক্ষেত্রে মানুষ যা মানুষ যা ধারণা করে হেগেলের মতে তা হলো ‘সাবজেক্টিভিটি’। হেগেলের অনুমানকে হেবারমাস এভাবে তুলে ধরেন:

সাবজেক্টিভিটির মূলত চারটি রূপ রয়েছে:

(ক) ব্যক্তি স্বাতন্ত্রতা: আধুনিক বিশ্বে লাগামহীন ব্যক্তি স্বাধীনতা উচ্চ সামাজিক মর্যাদা দাবি করে বসতে পারে (in the modern world, singularity particularized without limit can make good pretenstions);

(খ) সমালোচনা করার অধিকার: আধুনিক বিশ্বের মূলনীতি দাবি করে যে, কেউ যদি কোনো কিছুর স্বীকৃতি দেয় তাহলে এটি তার নিজের কাছে অবশ্যই স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য বলে গণ্য হবে (the principle of the modern world requires that what anyone is to recognize shall reveal itself to him as something entitled to recognition);

(গ) কর্মের স্বাধীনতা: আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী, আমরা যা করি সে ব্যাপারে আমরা দায়বদ্ধ থাকবো।

(ঘ) ভাববাদী দর্শন: হেগেল মনে করতেন, আত্মচেতনার ধারণা দর্শনে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হওয়াটা আধুনিকতার অবদান।[13]

হেবারমাস হেগেলের এই তত্ত্বের ব্যাখ্যা করেছেন, আধুনিকতার মূল কথা হলো ব্যক্তির আত্মসচেতনতা। এটি প্রত্যেক ব্যক্তিকে স্বীয় কল্যাণ সাধনকে লক্ষ্য হিসেবে বেছে নেয়ার কথা বলে।[14] এর বিপরীতে জন্মগতভাবে বা ঐতিহ্য হিসেবে ব্যক্তি যা কিছু পেয়েছে শুধুমাত্র সেসব বিষয়কে অনুসরণ করবে। ফারজিন ভাহদাত তার God and Juggernaut বইয়ে একই কথা বলেছেন। কান্ট এবং হেগেলের দর্শন নিয়ে বিস্তর পড়াশোনার পর তার উপসংহার হচ্ছে,

প্রাক-আধুনিক সমাজে … সমাজ জীবন ও চলাফেরায় ব্যক্তির স্বতন্ত্র পরিচয় ছিল। তবে ব্যক্তির এই স্বাধীনতা ছিল খুবই সীমিত এবং সমাজের অল্পকিছু লোকই এই সুবিধা ভোগ করতো। আধুনিক সমাজে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে সামষ্টিকতা, সমাজ জীবন ও প্রতিষ্ঠানের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়। এর ফলে ব্যক্তি এক ধরনের বিচ্ছিন্নতায় ভোগে।[15]

আধুনিকতার এই ধারণাকে আইজেনস্ট্যাড ‘মাল্টিপল মডার্নিটি’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।[16] আধুনিকতা হতে পারে ধর্মীয় কিংবা সেক্যুলার, পুঁজিবাদী কিংবা সমাজতান্ত্রিক, পশ্চিমা কিংবা পাশ্চাত্যবিরোধী। এক্ষেত্রে এই বুঝজ্ঞান থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ যে, আধুনিক মানুষ অনেকগুলো বিকল্প থেকে যে কোনো একটা বেছে নিতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আধুনিক কায়রোতে জন্মগ্রহণকারী একজন সুন্নী মুসলিম চাইলে সেক্যুলার হতে পারে, কিংবা ইউরোপ বা আমেরিকায় অভিবাসী হয়ে পশ্চিমা জীবনযাপনও করতে পারে। আবার সে চাইলে কায়রোতেই আচারনিষ্ঠ সুন্নী মুসলিম হিসেবে জীবনযাপন করতে পারে। প্রত্যেকটাই তার জন্যে গ্রহণযোগ্য বিকল্প। প্রাক-আধুনিক কায়রোর অধিবাসীদের মধ্যে এভাবে জীবনযাপন পদ্ধতি বেছে নেয়ার প্রচলন ছিল না। তারা জানতোই না যে, জীবনযাপন করার এ ধরনের একাধিক উপায় রয়েছে। নিজের ব্যাপারে ও অন্যের ব্যাপারে এই সচেতনতা মূলত আধুনিকতারই ফল। আধুনিকতার এই বিস্তার  লাভের পেছনে সাক্ষরতা ও শিক্ষার হার বৃদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

এই ব্যাপারগুলোও সচেতনতা বাড়াতে ভূমিকা রাখছে। হেবারমাস একে ‘আধুনিকতার সময় সচেতনতা’ (modernity’s consciousness of time) হিসেবে অভিহিত করেছেন।[17] ব্যক্তিচেতনা নিঃসৃত এই চিন্তার ফলাফল হচ্ছে, সে মনে করে সমসাময়িক যে কোনো পথই তার জন্যে খোলা রয়েছে। এর সারকথা হলো, ব্যক্তি যদি বর্তমানের চেয়ে বেশি সুযোগ পেতে চায় তাহলে তাকে ভবিষ্যতের দিকেই যেতে হবে। এ কারণেই হেবারমাস দাবি করেছেন, “অতীতের সাথে আধুনিক বিশ্বের পার্থক্য হচ্ছে, বর্তমান বিশ্ব নিজেই ভবিষ্যতের দ্বার উন্মুক্ত করে।”[18]

ভাহদাত আরো একধাপ এগিয়ে হেগেলের সাবজেক্টিভিটি তত্ত্বের সার্বজনীন বৈশিষ্ট্যের উপর আলোকপাত করেন।[19] তিনি যুক্তি দেন, যখন একজন ব্যক্তি তার নিজের সাবজেক্টিভিটি বুঝতে পারে তখন সে অনুধাবন করে, অন্যদেরও একই রকম ব্যাপার রয়েছে। কিছুক্ষেত্রে এটা এক ধরনের সার্বজনীন সমতা রক্ষায় ভূমিকা পালন করে। এইভাবে আধুনিকতার একেকটা উপাদান সার্বজনীন সাবজেক্টিভিটির চেতনা হিসেবে বিবেচনা করা যায়।

উপর্যুক্তভাবে সংজ্ঞায়িত আধুনিকতা কীভাবে ইসলাম, বিশেষত কারযাভীকে প্রভাবিত করেছে, তা এই গবেষণার মূল বিষয়। তদুপরী আধুনিকতা একটা ফেনোমনা আকারে কীভাবে পাশ্চাত্যে গড়ে ওঠেছে, তারপর মধ্যপ্রাচ্যকে প্রভাবিত করেছে – এটাও নিরীক্ষা করা দরকার।

দ্বিতীয় অধ্যায়: কারযাভীর দৃষ্টিতে আধুনিকতা

আধুনিকতার ব্যাপক প্রচার ও প্রসারে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, উন্নয়ন ও গণমাধ্যম। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, কারযাভীকে প্রায়ই এসব বিষয় নিয়ে কাজ করতে হয়। ইসলামী জগতে কারযাভী মধ্যপন্থী হিসেবে পরিচিত হওয়ায় প্রথমে তার বিশ্বদৃষ্টি (worldview) সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হবে। একইসাথে ইসলামী মধ্যপন্থা এবং কারযাভীর উপর এর প্রভাব পর্যালোচনা করা হবে।

কারযাভী ও ইসলামী মধ্যপন্থা

ইসলামী জ্ঞানের জগতে বেশ কিছু বিষয়ে কারযাভী তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তবে মধ্যপন্থী চিন্তাধারার (ওয়াসাতিয়া) প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তিনি সবচেয়ে বেশি পরিচিত। স্যাগি পলকা তার পিএইচডি অভিসন্দর্ভের উপর ভিত্তি করে লেখা এক নিবন্ধে এ বিষয়ে বিস্তৃত আলাপ করেছেন। তার মতে, আল কোরআনের সূরা বাকারার ১৪৩ নং আয়াতকে ভিত্তি করে কারযাভীর চিন্তাধারা গড়ে ওঠেছে:

“আমি তোমাদেরকে একটি মধ্যপন্থী জাতি হিসেবে পাঠিয়েছি যাতে করে তোমরা মানবজাতির জন্যে সাক্ষ্যদাতা হও এবং যাতে রসূল তোমাদের জন্য সাক্ষ্যদাতা হন।”

‘একটি মধ্যপন্থী জাতি’র ব্যাখ্যা হতে পারে, খ্রিষ্টানদের চরম বৈরাগ্যবাদ এবং কোনো কোনো নবীকে হত্যা করার ব্যাপারে ইহুদীদের বেপরোয়া ভাব – ইসলামী জাতি ধর্মীয় অর্থে এই দুইয়ের মাঝামাঝি একটা ব্যাপার।

কোরআনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, ‘সাক্ষ্যদাতা’ মানে হচ্ছে রাসূলের প্রতিনিধি হিসেবে প্রত্যেক ব্যক্তি স্বীয় জাতির কাছে আল্লাহর বাণী দৃঢ়তার সাথে প্রচার করা, তারা তা প্রত্যখ্যান করলেও।[20]

মধ্যপন্থী ধারাকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে পলকা সাতটি মূলনীতির কথা বলেছেন:

১। সালাফপন্থা ও তাজদীদ: মধ্যপন্থীরা এ ধারণা পোষণ করেন, “সালাফপন্থা[21] এবং তাজদীদের[22] মধ্যে কিছু যৌক্তিক সমন্বয় রয়েছে।” ইসলামের পূর্বপূরুষদের পথে ফিরে যাওয়াকে সালাফপন্থা এবং সংস্কারকে তাজদীদ হিসেবে সাধারণত বিবেচনা করা হয়। কারযাভী দাবি করেন, এই দুই দৃষ্টিভঙ্গিকে সমন্বয় করে আধুনিক যুগের মুসলিমরা ইসলামী অতীতকে যথাযথভাবে বুঝতে পারলে তাদের মর্যাদা ফিরে পাবে। কারযাভীর নিকট এই পরিভাষা দুটি সুসঙ্গতিপূর্ণ।  তিনি এটিও মনে করেন যে, যারা একপেশে কথা বলছে তারা মূলত সেকেলে ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী (anachronistic)। এর কারণ হলো তারা নতুনত্বকে মেনে নিতে অপারগ।[23]

২। বিশ্বাসের সংকীর্ণতা ও ব্যাপকতা: অন্যান্য রক্ষণশীল চিন্তাবিদগণ ইসলামকে শুধু ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও কতিপয় ধর্মীয় ইবাদতের সমষ্টি মনে করে। তাদের বিপরীতে মধ্যপন্থীরা মনে করে, ইসলাম হচ্ছে জীবনযাপনের সামগ্রিক ব্যবস্থা। সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে – “ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, আইনি ও সাংস্কৃতিক”[24] – ইসলামের এই পাঁচটি ব্যাপারে মধ্যপন্থীরা বিশেষ মনোযোগ প্রদান করে।

৩। বিশ্বাসের অপরর্তনীয় ও পরিবর্তনীয় ক্ষেত্র: “ধর্মের মৌলিক বিশ্বাস এবং পরিবর্তনযোগ্য বিষয়গুলোর মাঝে ভারসাম্য রয়েছে।”[25] ইসলাম যে নৈতিক কাঠামো দিয়েছে, তারমধ্যে থেকেই কোনো নির্দিষ্ট সমস্যার সমাধান সম্ভব। নির্দিষ্ট কোনো ইস্যুর সমাধান করতে ইজতেহাদ বা ইসলামী আইনশাস্ত্রে যুক্তি বা কাণ্ডজ্ঞানের পুনর্জাগরণ ঘটাতে কারযাভী আহ্বান জানিয়েছেন।

৪। মুসলিম আইনের ঐতিহ্য ও স্বগত বৈশিষ্ট্য: এটা তৃতীয় মূলনীতির মতোই। মধ্যপন্থীরা “ধর্মীয় হুকুম ও মুসলিম আইনের মাঝে স্পষ্ট পার্থক্য করেছেন।”[26] তারা অবশ্যই কুরআন ও হাদীসের আদেশ-নিষেধগুলো মেনে চলার পক্ষে, কিন্তু অতীতের স্কলাররা যেভাবে সেগুলোকে প্রয়োগ বা অবলম্বন করেছেন তারা তা গ্রহণ করেননি।

৫। নয়া প্রেক্ষিত বিবেচনা: মধ্যপন্থীরাও অদৃষ্টে বিশ্বাস রাখেন, তবে তারা মানবীয় যুক্তি ও ইতিহাসের শিক্ষার উপর বেশি গুরুত্ব দেন। তারা ঐহিত্য দ্বারা প্রভাবিত হওয়া সত্ত্বেও এর সাথে বিচারবুদ্ধিকে সাংঘর্ষিক মনে করেন না। ২০০৩ সালে প্রদত্ত এক খুতবায় কারযাভী এই পাঁচটি মূলনীতিকে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে:

সংস্কার মানে হচ্ছে জ্ঞানী আলেমদের মাধ্যমে ইজতেহাদের পুনঃপ্রবর্তন। তাই আমরা ইজতেহাদের ডাক দিচ্ছি। পূর্ববর্তীদের মতো করেই চিন্তাভাবনা করা আমাদের উচিত হবে না। কারণ আমাদের সমস্যা, প্রয়োজন এবং সময় – এ সবকিছুই তাদের থেকে আলাদা। যারা কয়েক শতাব্দী আগে মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের ওপর আমরা আমাদের চিন্তার ভার ছেড়ে দিতে পারি না। ইসলামের মহান ইমামগণ ক্ষেত্রবিশেষে তাদের জীবদ্দশায়ই ব্যক্তিগত মতামত পরিবর্তন করেছিলেন। … তাই বর্তমান যুগ, পরিবেশ এবং জীবনের প্রয়োজনে অবশ্যই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পুনর্গঠন করতে হবে। তাই নব্য-রক্ষণশীলরা[27] সংস্কারের নামে যা চাচ্ছে, আমরা তা অগ্রাহ্য করছি।[28]

৬। ক্রমধারার অপরিহার্যতা: মধ্যপন্থীরা আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে ক্রমধারা অবলম্বনকে শ্রেয় মনে করেন। জীবনের সকল দিক সম্পর্কে ইসলাম সঠিক দিকনিদের্শনা প্রদান করতে পারে বলে তারা বিশ্বাস করেন। তবে তারা মনে করেন, “বিদ্যমান যেসব আইন সমাজকে পরিচালনা করছে, তার বিকল্প হিসেবে সমপর্যায়ের ইসলামী আইনের প্রচলন না হওয়া পর্যন্ত সেগুলোকে বাতিল বা স্থগিত করা ঠিক হবে না।”[29]

৭। বিশ্বসভ্যতায় অংশগ্রহণ: “রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো সম্পর্কে যথাসম্ভব সতর্ক থেকে অন্যান্য জাতি ও মানুষ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করাকে”[30] মধ্যপন্থীরা অনুমোদন করে। বাইরের জ্ঞানকে ইসলামের সাথে সমন্বয় সাধনকে কারযাভী শুধু বৈধই মনে করেননি, বরং তিনি একে করণীয় কর্তব্য হিসেবে বিবেচনা করেছেন।  এ প্রসঙ্গে প্রদত্ত এক ফতোয়ায় তিনি লিখেছেন, “মুসলিম জাতি হিসেবে সামগ্রিককভাবে আমাদের অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে অন্যান্যদের ভাষা শেখা। যারা বিজ্ঞান-জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মুসলমানদের দীনতাকে ‘উপভোগ’ করে, বিশেষ করে তাদের ভাষা শেখা বেশি দরকার।”[31]

কারযাভীকে পাশ্চাত্যের চিন্তাধারার প্রতি স্পষ্টত উদার মনোভাবের মনে হলেও তিনি পাশ্চাত্যকরণের কথা বলেছেন – এমনটা মনে করার কোনো সুযোগ নেই। ইতোপূর্বে উল্লেখিত জুমার  খুতবায় তিনি স্পষ্ট বলেছেন, “জাতিকে পাশ্চাত্যকরণ করতে যারা কাজ করছে, তাদের উদ্দেশ্য কখনোই সফল হবে না।  তাদের কেউ কেউ এমনও বলে, প্রাচ্য যদি তাদের নবী-রাসূল ও ধর্মগ্রন্থগুলো ত্যাগ করতে পারে, তাহলেই কেবল উন্নতি সম্ভব!”[32] পরবর্তীতে এক সাক্ষাৎকারে তিনি আরো বলেন,

মধ্যপন্থী হওয়া মানে আমাদের অধিকার, পবিত্র স্থানসমূহ, ইসলামের প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব বা সাংস্কৃতিক পরিচয়কে আমরা বর্জন করবো, ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। মধ্যপন্থা সম্পর্কে এটি একটি ভুল ধারণা। র‍্যাডিক্যাল, চরমপন্থী ও মৌলবাদী ধারা এবং এর বিপরীতে অবজ্ঞা ও লাগামহীনতা – এই দুই ধারা থেকে মুক্ত থাকাই হলো মধ্যপন্থা। কারণ এ দুটি ধারাই জাতির জন্য হুমকিস্বরূপ। আমরা এমন এক ধরনের মধ্যপন্থার কথা বলছি, যা ইসলামের মূলনীতির প্রতি বিশ্বস্ত থাকে, পাশাপাশি পরিবর্তনশীল বিষয়গুলোকেও বিবেচনায় রাখে।[33]

মধ্যপন্থী ধারার এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এটা পরিষ্কার যে, ইসলামের অত্যন্ত যুগোপযোগী কাঠামোর দিকেই কারযাভী মানুষকে আহ্বান করছেন। অনুপ্রেরণা নিতে অতীতকে সন্ধান করলেও তিনি মূলত ইসলাম ধর্মের এমন একটি ধারা তৈরি করতে চাচ্ছেন; যা তার সময়কাল তো বটেই, ভবিষ্যতের জন্যেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হবে। এই মধ্যপন্থী মতাদর্শ কারযাভীর জীবনের সর্বত্র গভীর প্রভাব ফেলেছে। নিঃসন্দেহে গণমাধ্যম সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গিকেও এটি প্রভাবিত করেছে।

গণমাধ্যম

ইসলামী চিন্তাজগতে মধ্যপন্থী ধারার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের পর যে ইস্যুকে কারযাভী সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন সেটা হলো গণমাধ্যম। তিনি তালেবান বা সৌদি আরবের স্কলারদের মতো উগ্রপন্থী নন, তবে সতর্ক। গণমাধ্যম মাত্রই ‘ক্ষতিকর’ – তিনি এমনটা মনে করেন না। বরং অনেকক্ষেত্রেই জনসাধারণের কল্যাণে মিডিয়াকে ব্যবহার করা যায় বলে তিনি মনে করেন। এ বিষয়ে প্রদত্ত এক ফতোয়ায় তিনি বলেছেন:

“টিভি, রেডিও, ম্যাগাজিন এবং সংবাদপত্র বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতে পারে। এই মাধ্যমগুলো ভালো বা মন্দ, আইনসঙ্গত কিংবা আইনবিরুদ্ধ – আমরা এ রকম কোনো সংকীর্ণ অর্থ আরোপ করতে পারি না। এটি নির্ভর করছে এ সকল মাধ্যম কী উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে, প্রচারিত অনুষ্ঠানের মান কেমন, কী তথ্য তুলে ধরছে – এসবের উপর। যেমন, একটি অস্ত্র কেউ আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারে, আবার কেউ কোনো অন্যায় কাজেও ব্যবহার করতে পারে। … সংক্ষেপে আমি বলতে পারি, টিভি এবং অন্যান্য সকল মিডিয়া ভালো-মন্দ এবং ন্যায়-অন্যায় – উভয়ই তুলে ধরতে পারে। এক্ষেত্রে মুসলমানদের কর্তব্য হচ্ছে পরিস্থিতি বুঝে নিজের বিচার-বিবেচনা অনুযায়ী কাজ করা। টেলিভিশনে যখন ভালো কিছু কিংবা ইসলামসম্মত কোনো আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান প্রচার করা হয় তখন কোনো মুসলিম তা দেখতে পারে। অন্যথায় টিভি বন্ধ করে রাখতে পারে।”[34]

তার এ অবস্থানকে যুগান্তকারী কিছু মনে হয় না এবং এটা আসলে তা নয়ও। কারযাভী সমসাময়িক অনেকের আগেই বুঝতে পেরেছিলেন, ইসলাম প্রচারে মিডিয়াকে একটা গুরুত্বপূর্ণ উপায় হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এই উপলব্ধিই কারযাভীকে বিশ্বমঞ্চে তুলে এনেছে। গ্যাডরুইন ক্র্যামারের মতে, “তিনিই প্রথম যিনি মিডিয়ার এই  নতুন ধরনের সাথে জড়িত হয়েছেন। এ কারণেই তার প্রজন্মের স্কলারস-কাম-অ্যাক্টিভিস্টের মধ্য থেকে তিনি ব্যতিক্রম।”[35]

১৯৭০ সালে কাতারে প্রথম বেতার কেন্দ্র খোলা হলে কারযাভী তখনই এর মাধ্যমে ধর্মীয় অনুষ্ঠান প্রচার শুরু করেন। কিছুদিন পর কাতারে টেলিভিশন সম্প্রচার শুরু হলে সেখানেও তিনি একই ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। শুক্রবার ও রমজানে এই টেলিভিশনে সম্প্রচারিত বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে কাতার থেকে আল জাজিরা স্যাটেলাইট টেলিভিশন সম্প্রচার শুরু করে। আর ১৯৯৬ সালেই কারযাভী সেখানে ‘শরীয়াহ ও জীবন’ শীর্ষক একটি সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান শুরু করেন। এই অনুষ্ঠানটিও ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা লাভ করে। নব্বই দশকের শেষ দিকে কারযাভী দুটি ওয়েবসাইট চালু করেন। ১৯৯৭ সালে www.qaradawi.net এবং ১৯৯৯ সালে www.islamonline.net চালু করেন।[36]

এইসব তৎপরতার মাধ্যমে কারযাভী একজন গতানুগতিক ইসলামী স্কলার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে নিজেকে উপস্থাপন করেন। তার মতো প্রাজ্ঞ একজন স্কলারের অনুসারী ছাত্র-শিষ্যদের কোনো সার্কেল নেই (a circle of student followers), যা সচরাচর থাকে।[37] এর বিপরীতে বেট্টিনা গ্রেফ দেখান, একটি ‘বিশ্ব ইসলামী সমাজ’[38] গড়ে তোলার লক্ষ্যে কারযাভী কাজ করছেন। এ জন্য তিনি নিজেকে ‘সারা পৃথিবীর মুসলিমদের নির্ভরযোগ্য একজন ধর্মীয় পণ্ডিত’[39] হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন।

এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গ্যাডরুইন ক্র্যামার দেখিয়েছেন, আধুনিক গণমাধ্যম যুগের আগে আসলে কারযাবী এত প্রভাবশালী ও আধুনিক ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব কিংবা পণ্ডিত হতে পারতেন না।[40] আরো একধাপ এগিয়ে বলা যায়, কারযাভী নিজেই শুধু আধুনিক নন, তার সমর্থক ও শ্রোতারাও আধুনিক। এই নতুন ‘বিশ্ব ইসলামী সমাজে’ কারযাভীর ধর্মীয় মতামতগুলো কার্যকর করতে কোনো নির্দিষ্ট কোনো প্রক্রিয়া (mechanism) নেই। বরং, তিনি তার অনুসারীদেরকে এর বিপরীত দিকেই আহ্বান জানিয়েছেন। ফলে কারযাভীর অনুসারীরা ধর্মকে অনুসরণের ক্ষেত্রকে নিজেদের মতো করে নিয়েছেন। এটি সম্ভব হয়েছে শিক্ষা ও গণমাধ্যমের কল্যাণে, যা আধুনিকতার অন্যতম অনুষঙ্গ। কারযাভী বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন এবং একে কাজে লাগিয়েছেন। কারযাভীর ধর্মীয় মতামতগুলো কার্যকর করার জন্যে এখনো কোনো রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় এগুলো বাস্তবায়নের একমাত্র উপায় হলো – তার অনুসারীরাই এসব মতামতের প্রতিনিধিত্ব করবে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

কারযাভীর মতো আধুনিক ইসলামী চিন্তাবিদদের নিকট বিজ্ঞান অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও প্রশ্নসাপেক্ষ একটি বিষয়। একদিকে বিজ্ঞানকে পাশ কাটিয়ে ইসলামী পুনর্জাগরণ সম্ভব নয়, অন্যদিকে বিজ্ঞান সবসময়ই কোনো না কোনো সমস্যা বা সন্দেহ উপস্থাপন করে। যে ব্যক্তি কোরআনকে নাযিলকৃত চূড়ান্ত সত্য হিসেবে বিশ্বাস করে, এমনকি তার কাছেও। এই দিকটি ইঙ্গিত করে বাসাম তিবি বলেন, “পশ্চিমা বিজ্ঞান দীর্ঘ সময় ধরে কার্টিজিয়ান নীতি অনুসরণ করে চলছে। এই নীতিতে ‘সন্দেহ ও অনুমান’কে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে দেখা হয়।” যাইহোক, “যে সকল বিজ্ঞানী ইসলামী বিশ্বদৃষ্টিকে পুরোপুরি ধারণ করে … তারা এই ‘জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রক্রিয়া’ তথা সন্দেহ ও অনুমানকে এ কারণে প্রত্যাখ্যান করেন যে, ‘পবিত্র কুরআন হচ্ছে পরিপূর্ণ এবং চূড়ান্ত ওহী’।”[41]

আধুনিক ইসলামী চিন্তাবিদরা এই সমস্যাটিকে বিভিন্নভাবে মোকাবেলা করেছেন। তালবী ও শাহরুরের মতো কয়েকজন মুসলিম চিন্তাবিদ এমন একটি ইসলামী পুনর্জাগরণের (enlightenment) কথা বলেছেন, যেখানে ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো পুনর্মূল্যায়ন করা হবে। এই ধারার চিন্তাবিদরা “ধর্মশাস্ত্রবাদকে (scripturalism) অগ্রাহ্য করেন এবং মুসলমানদেরকে ধর্মগ্রন্থের উপর নির্ভরতার (the authority of the text) পরিবর্তে যুক্তিবোধের উপর নির্ভরশীল হওয়ার পরামর্শ দেন।”[42]

অন্যান্য মুসলিমরা এ ব্যাপারে কট্টর মনোভাব পোষণ করেন। সৌদি অর্থায়নে পরিচালিত ওয়াশিংটনভিত্তিক International Institute of Islamic Thought (IIIT) এমনই একটি প্রতিষ্ঠান। এটি ‘বিজ্ঞানের ইসলামীকরণ’ এবং এক ধরনের ‘ইসলামী প্রযুক্তি’ গড়ে তোলার কথা বলে। এই সংস্থাটি “ইসলামের উপর ভিত্তি করে জ্ঞানের পুনর্বিন্যাস করার চেষ্টা করছে। বিদ্যমান জ্ঞানকে বিন্যস্ত করে কোন উপায়ে এই জ্ঞান অর্জিত হলো এবং এগুলো কীভাবে পরস্পর সম্পর্কিত – তা যাচাই করার চেষ্টা করে।”[43] এসব করতে গিয়ে অর্থাৎ ওহীর আলোকে (revealed truth) মহাবিশ্বকে বুঝার চেষ্টা করার মাধ্যমে তারা মূলত বিজ্ঞানের অনেক মৈালিক ধারণার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে।

যারা একটি ইসলামী পুনর্জাগরণ প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন (যেমন, তালবী ও শাহরুর), অথবা যারা বিজ্ঞানের ইসলামীকরণের (IIIT) জন্যে কাজ করছেন – এই দুই পক্ষই মনে করছেন যে, ওহী ও বিজ্ঞানের মধ্যে এক ধরনের সহজাত বিরোধ রয়েছে। সকল মুসলিম চিন্তাবিদ এই ধারণাকে সমর্থন করেন না। প্রখ্যাত পাকিস্তানী চিন্তাবিদ হোসেইন আল সদর মনে করেন, ইসলাম ও বিজ্ঞানের মধ্যে কোনো প্রকার বিরোধ নেই। তার মতে, “ইসলামে জ্ঞানচর্চাই চূড়ান্ত ব্যাপার নয়। বরং জ্ঞানচর্চা হচ্ছে স্রষ্টাকে উপলব্ধি করা এবং মুসলিম সমাজের সমস্যা সমাধানের একটা উপায় মাত্র। … ইসলামী সমাজে বিচার-বিবেচনাবোধ (reason) এবং জ্ঞানচর্চা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তবে এগুলো কোরআনের মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অধীন।”[44]

ইসলাম ও বিজ্ঞান সম্পর্কে সদরের এই অভিমতটি মূলত কারযাভীর অবস্থানের কাছাকাছি। ইসলাম ও বিজ্ঞানের সামঞ্জস্যতার ব্যাপারে যে কোনো সন্দেহ নেই, তা তিনি বিভিন্ন ফতোয়ায় তুলে ধরেছেন। যেমন তিনি লিখেছেন,

ইসলাম বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও গবেষণাকে স্বাগত জানায়। ইসলামের ইতিহাসের কোথাও ইসলাম ও বিজ্ঞানের মাঝে বিরোধের কোনো প্রমান পাওয়া যায় না। প্রকৃতপক্ষে, ইসলামের দৃষ্টিতে, বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় উন্নতি অর্জন করা জাতির জন্যে ফরজে কেফায়া বা সামষ্টিক কর্তব্য। তবে এই অগ্রগতি অবশ্যই ধর্মবিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক হবে না।[45]

আধুনিক বিজ্ঞান নিয়ে তার এ অভিমত মূলত কোরআনের সূরা আন নাহলের ৮ নং আয়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত। সেখানে বলা হয়েছে, “তোমাদের আরোহণের জন্যে এবং শোভার জন্যে তিনি ঘোড়া, খচ্চর ও গাধা সৃষ্টি করেছেন। আর তিনি এমন জিনিস সৃষ্টি করেন যা তোমরা জান না।”

এ আয়াতে, “যা তোমরা জান না” বাক্যাংশ দ্বারা আধুনিক সময়ের “গাড়ি, ট্রেন, বিমান ও মহাকাশযানের”[46] প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে বলে কারযাভী মনে করেন। একইসাথে “বিজ্ঞানের অগ্রগতি”[47]কেও নির্দেশ করা হতে পারে বলে কারযাভী অভিমত ব্যক্ত করেন।

অন্যদিকে, আধুনিক প্রযুক্তি সম্পর্কিত আলোচনায় কারযাভী কোরআনের আক্ষরিক অর্থের চেয়ে মর্মার্থকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। উদাহরণ হিসেবে সূরা আনফালের ৬০ নং আয়াতের উল্লেখ করা যায়, যেখানে বলা হয়েছে, “তাদের (সাথে যুদ্ধের) জন্যে তোমরা যথাসাধ্য সাজ-সরঞ্জাম, শক্তি ও ঘোড়া প্রস্তুত রাখবে এবং এ দিয়ে তোমরা আল্লাহর দুশমন ও তোমাদের দুশমনদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে দেবে।”

এ আয়াতে জিহাদের জন্য ঘোড়া পালনকে উৎসাহিত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে কারযাভীর ভাষ্য হচ্ছে,

এটি এ কারণে যে, তখন ঘোড়া ছিল সামরিক যান। এখন আর এটি প্রাসঙ্গিক নয়। যুগের পরিবর্তনের ফলে নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চল ছাড়া আর কোথাও যুদ্ধক্ষেত্রে ঘোড়া কাজে আসে না। বরং এখনকার যুদ্ধে ট্যাংক, সামরিক যান এবং এ ধরনের উন্নত সব সমরাস্ত্র ব্যবহৃত হয়। আমরা বলতে পারি, এগুলোই বর্তমানকালের ঘোড়া। বর্তমানে যারা এসব যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারে, তারাই এ যুগের অশ্বারোহী।[48]

উদারনৈতিক সংস্কারের পক্ষে তালবী যে ধরনের যুক্তি দিয়েছেন, এক্ষেত্রে কারযাভীর পদ্ধতিটাও অনেকটা তেমন। তালবীর মতো কারযাভীও কোরআনের আয়াতের মূলনীতিকে গ্রহণ করেন এবং বর্তমান আধুনিক বিশ্বে তা প্রয়োগ করেন। এই দৃষ্টিতে জিহাদের জন্যে আধুনিক প্রযুক্তির উদ্ভাবন একটি ভালো কাজ।

তবে এটি মনে রাখা দরকার, কারযাভী নিছক পশ্চিমা প্রযুক্তি আত্মীকরণের চেয়েও বেশি কিছু চান। তিনি চান, মুসলমানরা নিজেরাই এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠুক। এ জন্যে তিনি শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কার চান। গতানুগতিক ইসলামী জ্ঞান অর্জনের জন্যে মুসলিম তরুণদের আধুনিক বিজ্ঞান অধ্যয়ন ছেড়ে দেয়া প্রসঙ্গে কারযাভী একটি ফতোয়া দেন। তিনি বলেন, বিজ্ঞান অধ্যয়ন করা “এমন একটা বিষয় যা এড়িয়ে যাবার কোনো সুযোগ নেই। এরমধ্যে রয়েছে গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নবিজ্ঞান, ভূতত্ত্ববিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, সমুদ্রবিজ্ঞান, মরুবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞানসহ বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা।”[49] তার মতে, অতীতের ইসলামী স্কলারদের ভিন্ন বক্তব্য থাকলেও আধুনিক সময়ের দাবি হচ্ছে, মুসলমানরা নিজেদেরকে সময়োপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। তার বক্তব্য হচ্ছে,

বর্তমানে বিভিন্ন জাতির মধ্যে বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে। প্রত্যেকেই অন্যের চেয়ে এগিয়ে থাকতে চাইছে। একইসাথে, নাগরিকরাও এই প্রতিযোগিতায় অন্যদেরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। কোনো জাতি যদি এসব ব্যাপারে গবেষণা ও গভীর অনুসন্ধান না করতো তাহলে আমরা আজ পরমাণুর বিভাজন, মহাশূন্য অভিযান, কম্পিউটারবিজ্ঞানের বিপ্লব, ইন্টারনেট, তথ্যপ্রযুক্তি, জীববিদ্যা, যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ আরো অনেক ক্ষেত্রে এতসব অগ্রগতি দেখতে পারতাম না। এই সমস্ত অর্জনই আধুনিক যুগকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।[50]

কোনো কোনো ইসলামী মৌলবাদী মনে করতে পারেন যে, কারযাভীর এ আহ্বান শুধু বৈজ্ঞানিক জ্ঞান অর্জনের জন্যে, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহারের জন্য নয়। কিন্তু তিনি বিষয়ের আরো গভীরে গিয়েছেন। তিনি শিক্ষাব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ নতুন কাঠামোর আলোকে গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে তার যুক্তি হলো, “আরব এবং অন্যান্য মুসলিম দেশে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখন পর্যন্ত কোনো কিছু বুঝা বা উপলব্ধি করার চেয়ে অনেক বেশি মুখস্তবিদ্যা নির্ভর।” আর তাই “আমাদেরকে অবশ্যই শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি পরিবর্তন করতে হবে।”[51] এ কথা পরিস্কার যে, কারযাভী এক ধরনের মুক্তচিন্তার কথা বলেছেন। তারপরেও বিজ্ঞান  কী করতে পারবে তা বলে দেয়ার মাধ্যমে এর সীমা নির্ধারণ করে দিচ্ছেন। তার বক্তব্য হচ্ছে, জ্ঞান অবশ্যই “ধর্মবিশ্বাস দ্বারা লালিত এবং কিছু মূলনীতি ও পদ্ধতি দ্বারা পরিচালিত হতে হবে।”[52] এ বক্তব্য আইআইআইটি’র বিজ্ঞানের ইসলামীকরণ ধারণার বিপরীত। জ্ঞান কীভাবে নির্মাণ হচ্ছে তা নিয়ে কারযাভীর তেমন আপত্তি নেই। বরং জ্ঞান কীভাবে ব্যবহৃত হওয়া উচিত, সেটা নিয়ে তিনি কাজ করেছেন। উদাহরণ হিসেবে তার এই বক্তব্য প্রাসঙ্গিক:

“পাশ্চাত্যে ধর্মীয় বিশ্বাস ও জ্ঞানের মধ্যে পৃথকীকরণের কারণে সামরিক ক্ষেত্রে গণবিধ্বংসী পারমাণবিক, রাসায়নিক ও জৈবিক অস্ত্রের উন্নয়নের ফলে সেই জ্ঞান পুরো বিশ্বের জন্যে মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠেছে। এছাড়া ধর্মবিশ্বাসবিচ্ছিন্ন জ্ঞান অনিরাপদ ও অবৈধ মাদকদ্রব্য উৎপাদনেও ভূমিকা রাখছে। আর এগুলো তারাই বাজারজাত করছে, সৃষ্টিকর্তার প্রতি যাদের কোনো ভয় নেই এবং সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির প্রতিও যাদের কোনো মমতা নেই।[53]

এই উদ্ধৃতি থেকেও এটি পরিস্কার, কারযাভী বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ব্যাপারে প্রশ্ন তোলেননি। বরং তিনি বিজ্ঞান ও যুক্তির (reason) পেছনের মূলনীতিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন।[54] বিজ্ঞান কী করতে পারে তা নয়, বরং বিজ্ঞানের কী করা উচিত – সেই মানদণ্ড নির্ধারণের ব্যাপারে তিনি আগ্রহী। যাইহোক, বিজ্ঞান সংক্রান্ত কারযাভীর চিন্তায় একটা তাৎপর্যপূর্ণ ব্যতিক্রম আছে। বিজ্ঞান কোরআনের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক হতে পারে – কারযাভী এমনটা মনে করেন না। তারপরেও বিবর্তন তত্ত্বের মতো বিষয়গুলোতে তিনি সমস্যা দেখতে পান।

আসলে কারযাভী বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মৌলিক নীতিমালা মেনে নিলেও এর ফলাফলকে সবসময় মেনে নিতে নারাজ। ‘পোকেমন’ ভিডিও গেম নিষিদ্ধ করে দেওয়া সংক্রান্ত এক ফতোয়ায় কারযাভী ডারউইনিজমের বিপক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন,

এই কার্টুনে বিদ্যমান উপাদানসমূহ মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসের বিপরীত। এটি পরোক্ষভাবে ডারউইনের বিতর্কিত বিবর্তনবাদকেই সমর্থন করে। এই তত্ত্বের মূল কথা হচ্ছে, প্রতিটি জীবসত্ত্বাই ধারাবাহিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। এর মানে হলো, বিদ্যমান প্রজাতি নতুন পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রেক্ষিতে অভিযোজনের মাধ্যমে নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটায়। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, প্রথমে একটি সরল আকৃতি বিবর্তনের মাধ্যমে একটি বানর প্রজাতিতে উন্নীত হয়। ধারণা করা হয়, এই প্রজাতি মানুষের আকৃতির খুব কাছাকাছি ছিল। তারপর সেখান থেকে ধারাবাহিক বিবর্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়ে মানুষ বর্তমান পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। এই কার্টুনে চিত্রিত পোকামাকড়ের চরিত্রে ডারউইনের তত্ত্ব অর্থাৎ ধারাবাহিক বিবর্তনের বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তার মানে কার্টুনটির মাধ্যমে শিশুদের মনে ধীরে ধীরে এই তত্ত্বটির অনুপ্রবেশ ঘটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।[55]

এখানে এটি পরিষ্কার যে, পূর্বে উল্লেখিত বৈজ্ঞানিক ‘সন্দেহ ও অনুমান’ সংক্রান্ত ধারণাটি এতক্ষণে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেছে। কোরআনের সাথে সাংঘর্ষিক না হওয়া পর্যন্ত কারযাভী এগুলোকে যৌক্তিক প্রক্রিয়া হিসেবে গ্রহণ করেছেন। বির্তন তত্ত্বের বিপক্ষে যুক্তি দেয়ার পাশাপাশি কারযাভী এটা বলাও গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন যে, আধুনিক বিজ্ঞান ঐশ্বরিক সৃষ্টিজগতের মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক কিছু করতে পারে না। ক্লোনিংকে নিষিদ্ধ করে দেওয়া এক ফতোয়ায় কারযাভী ব্যাপারটি স্পষ্ট করেছেন:

এই প্রক্রিয়াটিকে কখনোই এক ধরনের সৃষ্টি কিংবা পুনঃসৃষ্টি হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। বরং এই প্রক্রিয়াটি ক্লোন করার নামে কোনো প্রজাতির ডিম্বকোষের নিউক্লিয়াসকে ধ্বংস করার নামান্তর। এ প্রক্রিয়ায় একই প্রজাতির একটি প্রাণীর দেহকোষ থেকে নিউক্লিয়াসকে পৃথক করা হয়। তারপর এই বিচ্ছিন্ন নিউক্লিয়াসকে ডিম্বকোষে প্রবেশ করানো হয়। নতুন নিউক্লিয়াস নিয়ে গঠিত ডিম্বানু থেকে এমন একটি প্রাণীর উৎপত্তি হয়, যার বংশগতি হুবুহু নিউক্লিয়াস দাতা প্রাণীর অনুরূপ।[56]

ক্লোনিং করা অনুমোদিত কিংবা নিষিদ্ধ কিনা – ফতোয়ার এই অংশটি সে প্রশ্নের জবাব নয়। তবুও ক্লোনিংয়ের প্রসঙ্গ আসলে পরিষ্কারভাবে এটি ব্যাখ্যা করা কারযাভীর জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, ক্লোনিং আদতে কোনো সৃষ্টি নয়। একে সৃষ্টি মনে করলে আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা হিসেবে বলা কোরআনের মূলনীতির সাথে এটি সরাসরি সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে।

এই উদ্বৃতির আরেকটি আকর্ষনীয় দিক হচ্ছে, কোনো ধর্মীয় বিষয় আলোচনা করতে গিয়ে কারযাভী বৈজ্ঞানিক ভাষা ব্যবহার করেছেন। এই উপস্থাপনার ফলে আধুনিক শ্রোতারা কারযাভীর বিজ্ঞান বিষয়ক মতামতের ব্যাপারে আস্থা রাখবেন। কারযাভী জানেন যে, ইসলাম অন্যান্য মতাদর্শগুলোর সাথে প্রতিযোগিতা করছে। যদি তার বক্তব্য সার্বজনীন নীতিমালা অনুযায়ী না হয়, তাহলে আরো বেশি বুদ্ধিবৃত্তিক বক্তব্যসম্পন্ন মতাদর্শের দিকে তার অনুসারীরা ছুটবে। এছাড়া এই ধারায় কোনো আধুনিক বিষয়ে ফতোয়া দিতে গিয়ে কারযাভী অন্যান্য ‘নন-ইসলামিক’ পদ্ধতিও ব্যবহার করেছেন। যেমন, একবার একজন নাইজেরিয়ান আলেম ফতোয়া দিয়েছিলেন, শিশুদের পোলিও টিকা দেওয়া উচিত নয়। তখন কারযাভী তার সাথে দ্বিমত পোষণ করে একটি ফতোয়া দেন। তিনি কুরআনের রেফারেন্স দেওয়ার পাশাপাশি আরো বলেন, এই প্রতিষেধক নিরাপদ কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাথে আলোচনা করেছেন।[57]

বিজ্ঞানকে অবশ্যই একটি নৈতিক কাঠামোর মধ্যে রাখতে হবে –পাশ্চাত্যের যে সকল বুদ্ধিজীবী, বিজ্ঞানী এবং রাজনীতিবিদ এই পয়েন্টে একমত, এ দাবি করার সময় কারযাভী তাদেরকেও উদ্বৃত করেন। জন জেউই, আরনল্ড টয়েনবি, জন স্টেইনবেক, অ্যালেক্সি কাহেল, হ্যানরি লিংক, জন ফস্টার ডালাস, এমনকি প্রেসিডেন্ট উড্রু উইলসনকেও তিনি উদ্বৃত করেছেন।[58] এটি শুধুমাত্র কথার কথা নয়, বরং তারচেয়েও বড় সত্য হচ্ছে, পশ্চিমাদের মতেও তাদের সমাজ ত্রুটিহীন নয়। এসব বিজ্ঞানী, লেখক এবং রাজনীতিবিদদের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি কারযাভীর বক্তব্যকে তার শ্রোতাদের নিকট অধিকতর আকর্ষণীয় করে তুলেছে।

যাইহোক, তারমানে এই নয় যে, কারযাভী তথ্যের আন্তঃসাংস্কৃতিক প্রবাহের সকল দিককে পছন্দ করতেন। বাস্তবে, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ – উভয় অর্থেই তিনি বিশ্বায়নের ঘোর বিরোধী। আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, অতীতে আমরা জাহেলী যুগের রীতিনীতি প্রচলিত হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকতাম। আর এখন আমরা পশ্চিমা সংস্কৃতি নিয়ে বিচলিত। বৈশ্বিক সংস্কৃতি তথা বিশ্বায়নের অজুহাতে পাশ্চাত্য তাদের সংস্কৃতি, মতাদর্শ ও দর্শন আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।[59]

অন্যান্য সংস্কৃতির কোনটা গ্রহণযোগ্য আর কোনটা বর্জনীয়, তা যাচাই করতে কারযাভী ইসলামকে মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করেছেন। পাশ্চাত্যে গড়ে ওঠা কোনো আইডিয়া তার দৃষ্টিতে আধুনিক ইসলামের জন্যে সহায়ক হলে তিনি তা অনুমোদন করেন, অন্যথায় প্রত্যাখ্যান করেন।

উন্নয়ন

পূর্বে উল্লেখিত একটি উদ্ধৃতিতে হোসেইন আল সদর বলেছিলেন, “ইসলামে জ্ঞানচর্চাই চূড়ান্ত ব্যাপার নয়। বরং জ্ঞানচর্চা হচ্ছে স্রষ্টাকে উপলব্ধি করা এবং মুসলিম সমাজের সমস্যা সমাধানের উপায় মাত্র।”[60] কারযাভীও এমনটি মনে করেন। শুধু জ্ঞানচর্চার জন্যে জ্ঞান অর্জনে তিনি আগ্রহী নন। বরং মুসলিম বিশ্বের সমস্যা সমাধানের জন্যে তিনি বিজ্ঞানকে কাজে লাগাতে চান। খুতবায় তিনি নিয়মিত মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কথা বলেন। উদাহরণ হিসেবে একটি জুমার খুতবার কথা বলা যায়, যেখানে তিনি বেদনার সাথে বলেন:

দুর্ভাগ্যবশত আমরা উন্নয়ন করতে পারিনি। আমরা দারিদ্র্য মোকাবেলা করতে পারিনি। আমাদের দারিদ্র্য হার অনেক বেশি। এখনো অনেকে শুকনো রুটি খেয়ে বেঁচে থাকে। এখনো অনেক পরিবার একটা মাত্র কক্ষে বা বেজমেন্টে রাত্রিযাপন করে। আমাদের দেশগুলো কৃষিজমি এবং খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও দারিদ্র্য ঘুচানো যায়নি। চাষাবাদ কিংবা শিল্পায়ন – কোনোটাই আমরা করতে পারিনি। আমাদের দেশগুলো এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। এ দেশগুলোকে তৃতীয় কিংবা চতুর্থ বিশ্বের দেশ হিসাবে গণ্য করা হয়।[61]

শিল্পায়নের অভাব[62] এবং বেকারত্বের উচ্চ হার[63] নিয়ে কারযাভী অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে এ পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব বলে তিনি আশাবাদী। এই ক্ষেত্রগুলোতে ইসলামেরও ভূমিকা রয়েছে বলে তিনি মনে করেন। অন্য একটি খুতবায় তিনি বলেন, “কিছু মানুষ ইসলামকে দোষারোপ করে বলে, এই পশ্চাৎপদতার জন্যে ইসলামই দায়ী। এটি একটি মিথ্যাচার।” তার মতে, উন্নয়নের জন্যে ইসলামের ভূমিকা সহায়ক।[64] মুসলিম বিশ্বকে সহায়তা করাকে কারযাভী নিজের লক্ষ্য হিসেবে ঠিক করেছেন, এই বিবেচনায় যে: “আমরা আমাদের দেশ ও অর্থনীতিকে উন্নত করতে চাই। এমনসব ব্যক্তিকে উন্নত  হিসেবে গড়ে তুলতে চাই, যারা উন্নয়নকে তাদের লক্ষ্য এবং উপায় হিসেবে গ্রহণ করেছেন।”[65]

উন্নয়ন ও আধুনিকায়নকে উৎসাহিত করার জন্যে গতানুগতিক ইসলামের প্রতিবন্ধকতাগুলো সমাধান করতে কারযাভী কাজ করছেন। মুসলিম বিশ্বের উন্নয়নের পথে একটি অন্যতম বাধা ছিল সুদের উপর ইসলামের নিষেধাজ্ঞা। আধুনিক বিশ্বে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি বা করপোরেশন ঋণ নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছে এবং ধীরে ধীরে বিকশিত হয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্যে এ ধরনের ঋণের সুযোগ থাকা অপরিহার্য ব্যাপার। ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রবক্তাদের মধ্যে কারযাভী অন্যতম। এ ধরনের ব্যবস্থায় সুদ গ্রহণ করার ব্যাপারে ব্যাংকের উপর বিধিনিষেধ রয়েছে। এ সংক্রান্ত এক ফতোয়ায় তিনি বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন:

ব্যাংক হিসাবের উপর প্রাপ্ত সুদ অবৈধ তথা হারাম। কারণ এই সুদ হচ্ছে কোনো প্রচেষ্টা বা ব্যবসা ছাড়াই অর্থের প্রবৃদ্ধি। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সুদের যে সমস্ত বকেয়া আছে, তা পরিত্যাগ করো, যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাকো। অতঃপর যদি তোমরা পরিত্যাগ না করো, তবে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সাথে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়ে যাও। কিন্তু যদি তোমরা তওবা করো, তবে তোমরা নিজের মূলধন পেয়ে যাবে। তোমরা কারও প্রতি অত্যাচার করো না এবং কেউ তোমাদের প্রতি অত্যাচার করবে না।” (সূরা বাকারা: ২৭৮-২৭৯) এখানে ‘তওবা’র মানে হচ্ছে, আসল মূলধন ফেরত নিতে পারবে কিন্তু কোনো ধরনের প্রচেষ্টা বা যৌথ বিনিয়োগ ছাড়া অর্জিত অর্থ গ্রহণ থেকে বিরত থাকবে। কারো সম্পদ বন্ধক রাখা এবং এর বিনিময়ে কোনো ধরনের লাভ-ক্ষতির দায় না নিয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ গ্রহণকে ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে। তাই, ইসলাম শুধুমাত্র ঐ ধরনের বিনিয়োগকেই অনুমোদন করে, যেক্ষেত্রে বিনিয়োগকারী বিনিয়োগকৃত অর্থের ঝুঁকি গ্রহণ করে অর্থাৎ লাভ কিংবা ক্ষতি উভয়ের দায় বহন করে। এটিই হচ্ছে ইসলামী বিনিয়োগ ব্যবস্থার পদ্ধতি।[66]

কিছু অতি রক্ষণশীল আলেমের কাছে ইসলামী ব্যাংকিং এখনো বিতর্কিত একটি বিষয়। যেসব মুসলিম আধুনিক জীবনযাপন করতে চান, উক্ত ধরনের মতামতের ফলে তাদের কাছে কারযাভী সবচেয়ে জনপ্রিয় স্কলারদের একজনে পরিণত হয়েছেন। আধুনিক মুসলিমদেরকে ইসলামে অভ্যস্ত করানোর উদ্দেশ্যে কারযাভীর এই প্রচেষ্টা মূলত ইসলামী আইনশাস্ত্রেরই একটি অংশ, যা ‘তাইসীর’ তথা ‘নমনীয়তা’ (যেমন, ইসলামসম্মত জীবনাচারে নমনীয়তা) নামে পরিচিত। এ বিষয়টি কারযাভীর ফতোয়ার অন্যতম ‘স্বাতন্ত্র্যসূচক বৈশিষ্ট্য’ হিসেবে পরিচিত।[67] আধুনিক অবস্থার প্রেক্ষিতে একজন মুসলিম কী করবে বা করতে পারে – এই নমনীয়তার পদ্ধতি অনুযায়ী এসব বিষয় একজন বিচারক বিবেচনায় নিতে পারেন।[68] উল্লেখ করা প্রয়োজন, সুদগ্রহণের নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর প্রচেষ্টা সংক্রান্ত কারযাভীর ব্যাখ্যা সর্বপ্রথম নয়। সুদের উপর বিদ্যমান নিষেধাজ্ঞা এড়াতে ইসলামী স্কলারগণ দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন উপায় খুঁজছেন।[69] যাইহোক, কারযাভীসহ ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার অন্যান্য আধুনিক প্রবক্তরা তাদের অতীত পূর্বসূরীদের সাথে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন। তারা আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার মধ্যে ইসলামী আইনের বিধিবিধান সংযুক্ত করার প্রস্তাবনা দিয়েছেন।

উন্নয়নের সাথে বিজ্ঞান ও যৌক্তিক চিন্তাভাবনার সম্পর্কের কথা বললেও কারযাভী তার কথা এখানেই শেষ করেননি। তিনি প্রায়ই বলে থাকেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে স্বাধীনতার সম্পর্ক রয়েছে। যেমন, তিনি বলেছেন,

জাতি পিছিয়ে আছে … এটি স্বাধীনতার প্রশ্ন। স্বাধীনতা ছাড়া একজন পরাধীন ব্যক্তি কোনোকিছুই করতে পারে না। যতদিন পর্যন্ত আমাদের দেশগুলোতে বলপূর্বক শাসন চলবে, স্বাধীন ব্যক্তিদের ডিটেনশন ক্যাম্প ও জেলখানায় নিক্ষেপ করা হবে, শাসকেরা লাঠি হাতে দেশ শাসন করবে, বিচারকদেরকে একের পর এক গ্রেফতার, কারারুদ্ধ ও অত্যাচার করা হবে এবং রাজনৈতিক দল গঠন ও সংবাদমাধ্যমের উপর নিষেধাজ্ঞা থাকবে; ততদিন পর্যন্ত আমাদের জাতি পশ্চাৎপদতার বেড়াজালে বন্দি থাকবে। স্বাধীন মানুষের নেতৃত্বেই একটি জাতির জন্ম হয়। তারাই জাতির উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। কিন্তু আমরা যদি দাসত্বের শেকলে আবদ্ধ থাকি, তাহলে এই জাতি প্রয়োজনীয় সময়ে কিছুই করতে পারবে না। জাতি সবসময়েই পেছনে পড়ে থাকবে।[70]

অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সংবাদমাধ্যম ও রাজনৈতিক দলের স্বাধীনতার মতো বিষয়গুলোর সম্পর্ক রয়েছে বটে, তবে আরো সূক্ষ্ম কিছু ব্যাপারও (sophisticated reasoning) রয়েছে। যাইহোক, পাশ্চাত্যের লোকজন স্বাধীনতা বলতে যা বুঝে থাকে, কারযাভী ঠিক তা বোঝাননি। স্বাধীনতার গতানুগতিক ইসলামী সংজ্ঞা বেশ জটিল। স্বাধীনতা বলতে এখানে ইসলামী জীবনযাপন করার স্বাধীনতাকেই প্রায় সময় বুঝানো হয়। অন্যদিকে, পাশ্চাত্যে স্বাধীনতা বলতে মূলত ব্যক্তি স্বাধীনতাকে বুঝানো হয়।[71] কারযাভী স্বাধীনতার কোন সংজ্ঞাটি ব্যবহার করেছেন তা এখানে পরিষ্কার নয়। তবে ইসলামী বিশ্বের উন্নয়নকে গুরুত্বপ্রদান করা থেকে বুঝা যায়, তিনি আসলেই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। ভূমিকাতে যেমনটা বলা হয়েছে, কারযাভীর এ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আধুনিকতারই সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য।

উপসংহার

ইসলামী ও পশ্চিমা বিশ্বের অনেক আধুনিক চিন্তাবিদদের মতো কারযাভীও আধুনিকতার সংজ্ঞা নিয়ে ক্রমাগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। ইসলামী বিশ্বের অনেকের মতো তিনিও আধুনিকায়ন ও পাশ্চাত্যকরণের মধ্যে স্পষ্টভাবে পার্থক্য করেছেন। বাসাম তিবি এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, কারযাভীর মতে “আধুনিক সভ্যতা প্রশ্নাতীতভাবেই পশ্চিমা, কিন্তু এটিই একমাত্র কাম্য কিংবা সম্ভাব্য আধুনিক সভ্যতা নয়।”[72] ইসলামী বিশ্বে এক ধরনের বিকল্প আধুনিকতা গড়ে তোলার জন্য কারযাভী গত কয়েক দশক ধরে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। বিজ্ঞানের অগ্রগতির যে বিষয়গুলো ইতিবাচক ও কোরআনের মূলনীতি ও নৈতিকতার অনুকূল সেগুলোকে গ্রহণ এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার অনাকাঙ্খিত বিষয়গুলো বর্জন করে আধুনিকতার এই ধারা গড়ে উঠবে। কারযাভী বিশ্বাস করেন, এর ফলে এক সময় এমন একটি বিকল্প সভ্যতা গড়ে ওঠবে যা মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সবার কাছেই আকর্ষণীয় এবং গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবে।

বাস্তবতার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে কারযাভী দেখতে পান, মুসলিম বিশ্বে আধুনিকতা একটি বাড়তি চ্যালেঞ্জ হিসেবে হাজির হয়েছে। গণমাধ্যম ও আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা ইসলামী বিশ্বে এমনসব নতুন আইডিয়ার জন্ম দিচ্ছে, যা গতানুগতিক ইসলামী ধর্মতত্ত্বের জন্যে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ধরনের কিছু বিতর্কিত বিষয়কে কারযাভী কীভাবে মোকাবেলা করছেন, সামনের অধ্যায়গুলোতে সেগুলো তুলে ধরা হবে।

রেফারেন্স ও নোট:

[1] Bettina Graef, “Yusuf al-Qaradawi and the Foundation of a ‘Global Muslim Authority’,” Qantara Website, (29 April 2005), <http://www.qantara.de/webcom/show_article.php/_c-476/_nr-363/i.html> (accessed 30 July 2007).

[2] Gilles Kepel, Bad Moon Rising: A Chronicle of the Middle East Today, trans. Pascale Ghazaleh (London: Saqi Books, 2003), p. 60.

[3] “Why the Mayor of London will maintain dialogues will all of London’s Faiths and Communities,” (London: Greater London Authority, January 2005), p. 5.

[4] Karen Armstrong, Islam: A Short History (New York: Random House, 2002), pp. 185–6. and John L. Esposito, “Practice and Theory: A response to ‘Islam and the Challenge of Democracy’,” Boston Review, April–May 2003, <http://bostonreview.net/BR28.2/esposito.html> (accessed 30 July 2007).

[5] “Stop Terror Sheikhs, Muslim Academics Demand,” Arab News (Saudi Arabia), 30 October 2004, <http://www.arabnews.com/?page=4&section=0&article=53683&d=30&m=10&y=2004> (accessed 30 July 2007).

[6] “Mayor Livingstone and Sheikh Qaradawi,” A Coalition of Many of London’s Diverse Communities, (9 November 2004), <http://www.londoncommunitycoalition.org/> (accessed 30 July 2007).

[7] “Why the Mayor of London will maintain dialogues will all of London’s Faiths and Communities,” pp. 1–2.

[8] Derek Hopwood, “The Culture of Modernity in Islam and the Middle East,” in John Cooper, Ronald L. Nettler and Mohamed Mahmoud (eds.) Islam and Modernity: Muslim Intellectuals Respond (London: I.B. Tauris. 1998), p. 1.

[9] S. N. Eisenstadt, “Multiple Modernities,” Daedalus 129, No. 1 (Winter 2000), p. 1.

[10] Ibid. p. 1.

[11] Ibid. p. 2.

[12] Richard P. Mitchell, The Society of Muslim Brothers, (Oxford: Oxford University Press, 1993), pp. XXIII–XXIV.

[13] Jürgen Habermas, The Philosophical Discourse of Modernity: Twelve Lectures, trans. Fredrick Lawrence (Cambridge: Polity Press, 1987), p. 17.

[14] Ibid., p. 18.

[15] Farzin Vahdat, God and Juggernaut: Iran’s Intellectual Encounter with Modernity (Syracuse: Syracuse University Press. 2002), p. 19.

[16] Eisenstadt, p. 1.

[17] Habermas, p. 1.

[18] Ibid., p. 6.

[19] Vahdat, P. 1.

[20] Sagi Polka, “The Centrist Stream in Egypt and its Role in the Public Discourse Surrounding the Shaping of the Country’s Cultural Identity,” Middle East Studies, Vol. 39, No. 3 (July 2003), p. 40.

[21] কারযাভীর সালাফী চিন্তা (এই ধারা সাধারণত সংস্কারপন্থী হয়) এবং ‘আধুনিক সালাফী’ ধারার মধ্যে গ্যাডরুইন ক্র্যামার পার্থক্য করেছেন। “আধুনিক সালাফী ধারা বর্ণিত সূত্রের আক্ষরিক অর্থকে গ্রহণ করে এবং যে কোনো ধরনের অভিযোজন ও নতুনত্বকে প্রত্যাখ্যান করে।” G. Kramer, p. 194.

[22] Polka, p. 42.

[23] Ibid.

[24] Ibid.

[25] Ibid.

[26] Ibid., p. 43.

[27] পাশ্চাত্যের বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনকে প্রায়শ নব্য-রক্ষণশীলতা বলে অভিহিত করা হয়। কারযাভী এদিকে ইঙ্গিত করেননি। ইসলামী চিন্তাজগতের যে ধারা রক্ষণশীল চর্চার পুনঃপ্রবর্তন করতে চাচ্ছে, কারযাভী তাদেরকে ইঙ্গিত করেছেন।

[28] BBC Monitoring: Near/Middle East: Round-Up of Friday Sermons 26 Sept 03 (accessed 29 September 2003).

[29] Polka, p. 44.

[30] Ibid.

[31] Yusuf al-Qaradawi, “Learning Language is a Collective Duty,” Islam Online, (22 July 2004), <http://www.islamonline.net/servlet/Satellite?pagename=IslamOnline-English-Ask_Scholar/FatwaE/FatwaE&cid=1119503548814> (accessed 1 July 2007).

[32] BBC Monitoring: Near/Middle East: Round-Up of Friday Sermons 26 Sept 03 (accessed 29 September 2003).

[33] Al-Jazeera Television, “Open Dialogues: Al-Jazeera TV Hosts Cleric al-Qaradawi on ‘Religious Rhetoric,’” (20 November 2004), BBC Monitoring, (accessed 29 November 2004).

[34] Yusuf al-Qaradawi, “Watching TV: Permissible?” Islam Online, (14 January 2004), <http://www.islamonline.net/servlet/Satellite?pagename=IslamOnline-English-Ask_Scholar/FatwaE/FatwaE&cid=1119503544868> (accessed 1 July 2007).

[35] G. Kramer, p. 190.

[36] Ibid., pp. 190-1.

[37] Ibid.,

[38] Bettina Graef, “The International Association of Muslim Scholars: Yusuf al–Qaradawi and the Foundation of a Global Muslim Authority,” ISIM Review 15 (Spring 2005).

[39] Bettina Graef, “How Religion, in the Media, Contributes to the Shaping of Middle Eastern Society,” Unpublished article presented at 5th Annual Media Conference: Religion, Media, and the Middle East, Beirut, 2–5 October 2005 [sent to me by Ms. Graf].

[40] G. Kramer, 193.

[41] Tibi, p. 74.

[42] Ibid., p. 90.

[43] Ibid., p. 89.

[44] Ibid., pp. 74-5.

[45] Yusuf al-Qaradawi, “Cloning and its Dangerous Impacts,” Islam Online (29 December 2002), <http://www.islamonline.net/servlet/Satellite?pagename=IslamOnline-English-Ask_Scholar/FatwaE/FatwaE&cid=1119503544346> (accessed 2 July 2007)

[46] Al-Jazeera Television. “Life and Religion: Islamic Cleric al-Qaradawi Says Internet Part of ‘Contemporary Jihad,’” (3 October 2004) BBC Monitor, (accessed 7 October 2004).

[47] Yusuf al-Qaradawi, “Has Western Civilization Brought any Comfort?” Islam Online, (12 May 2003), <http://www.islamonline.net/servlet/Satellite?pagename=IslamOnline-English-Ask_Scholar/FatwaE/FatwaE&cid=1119503545256> (accessed 2 July 2007).

[48] Yusuf al-Qaradawi. “Raising Horses and Today’s Modern Weapons,” Islam Online, (7 March 2005), <http://www.islamonline.net/servlet/Satellite?pagename=IslamOnline-English-Ask_Scholar/FatwaE/FatwaE&cid=1119503549564 > (accessed July 2007).

[49] Yusuf al-Qaradawi, “Deserting Worldly Sciences for Religious Studies.” Islam Online (4 December 2006), <http://www.islamonline.net/servlet/Satellite?pagename=IslamOnline-English-Ask_Scholar/FatwaE/FatwaE&cid=1119503548870> (accessed 2 July 2007).

[50] Ibid.

[51] Qatar TV, “Live Sermon from Umar Bin-al-Khattab Mosque in Doha,” (28 April 2006), BBC Monitoring: Near/Middle East: Round-Up of Friday Sermons for 28 Apr 06, (accessed 02 May 2006).

[52] Yusuf al-Qaradawi, “Deserting Worldly Sciences for Religious Studies.”

[53] Ibid.

[54] মুরতাদ সংক্রান্ত বিষয়টি চিন্তার স্বাধীনতার ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য বাধা, যা পরবর্তী অধ্যায়ে আলোচনা করা  হবে।

[55] Yusuf al-Qaradawi, “Pokemon Games,” Islam Online, (30 December 2003), <http://www.islamonline.net/servlet/Satellite?pagename=IslamOnline-English-Ask_Scholar/FatwaE/FatwaE&cid=1119503543930> (accessed 5 July 5 2007).

[56] Yusuf al-Qaradawi, “Cloning and its Dangerous Impacts.”

[57] Yusuf al-Qaradawi, “Preventing Child Vaccines: Permissible?” Islam Online, (1 January 2006), <http://www.islamonline.net/servlet/Satellite?pagename=IslamOnline-English-Ask_Scholar/FatwaE/FatwaE&cid=1119503548088> (accessed 3 July 2007).

[58] Yusuf al-Qaradawi, “Has Western Civilization Brought any Comfort?”

[59] Al-Jazeera Television, “Life and Religion: Al-Jazeera Interviews Muslim Scholar on Women’s Rights within Islam, Doha Bomb,” (20 March 2005), BBC Monitoring, (accessed 24 March 2005).

[60] Tibi, pp. 74-5.

[61] Qatar TV, “Live Sermon from Umar Bin-al-Khattab Mosque in Doha,” (5 January 2007), BBC Monitoring: Near/Middle East: Round-Up of Friday Sermons 5 Jan 07, (accessed 8 January 2007).

[62] Qatar TV. “Live Sermon from Umar Bin-al-Khattab Mosque in Doha.” (9 September 2005). BBC Monitoring: Near/Middle East: Round-Up of Friday Sermons 9 Sep 05. (accessed 11 September 2005).

[63] Qatar TV, “Live Sermon from Umar Bin-al-Khattab Mosque in Doha,” (5 January 2007).

[64] Qatar TV, “Live Sermon from Umar Bin-al-Khattab Mosque in Doha,” (15 April 2005), BBC Monitoring: Near/Middle East: Round-Up of Friday Sermons 15 Apr 05, (accessed 19 April 2005).

[65] BBC Monitoring: Near/Middle East: Round-Up of Friday Sermons 1 May 05. (accessed 29 April 2005).

[66] Yusuf al-Qaradawi, “Bank Interest in the Eyes of Shari‘ah,” Islam Online, (18 July 2004), <http://www.islamonline.net/servlet/Satellite?pagename=IslamOnline-English-Ask_Scholar/FatwaE/FatwaE&cid=1119503543118> (accessed 3 July 2007).

[67] Alexandre Caeiro, “The European Council for Fatwa Research,” Paper presented at the Fourth Mediterranean Social and Political Research Meeting, Florence and Montecatini Terme (19–23 March 2003), organized by the Mediterranean Program of the Robert Schuman Centre for Advanced Studies at the European University Institute.

[68] See Yusuf al-Qaradawi, Taysir al-Fiqh li-lMuslim al Mu’asir fi Daw’ al-Qur’an wal-Sunna (Making Fiqh Easy for Contemporary Muslims in the light of Quran and Sunna),” (Beirut: Muasasat al-Risala, 2000).

[69] For an example, see Khalid Abou el-Fadl, “Islamic Law and Muslim Minorities: The Juristic Discourse on Muslim Minorities from the Second/Eighth to the Eleventh/Seventeenth Centuries,” Islamic Law and Society 1, No. 2 (1994), p. 180.

[70] Qatar TV, “Live Sermon from Umar Bin-al-Khattab Mosque in Doha,” (18 April 2006), BBC Monitoring: Near/Middle East: Round-Up of Friday Sermons 18 Apr 06, (accessed 2 May 2006).

[71] Franz Rosenthal, The Muslim Concept of Freedom (Leiden, Netherlands: E.J.Brill, 1960), pp. 5–6. যদিও আমি এখানে শুধু ইসলাম প্রসঙ্গে বলেছি, কিন্তু উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, গতানুগতিক ইহুদী ও খ্রিষ্টান ধর্মীয় সূত্রগুলোতেও স্বাধীনতার এ ধরনের সংজ্ঞাই পাওয়া যায়।

[72] Tibi, p. 75.

এ ধরনের আরো লেখা