ইসলামী পুনর্জাগরণের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি

মুসলিম বিশ্বে সম্প্রতি ধার্মিকতা হ্রাস পাচ্ছে বলে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে। ইন্টারেস্টিংলি, এর অন্যতম কারণ হিসেবে গত তিন দশক ধরে চলমান ইসলামী পুনর্জাগরণ আন্দোলনকে দায়ী করে যুক্তরাষ্ট্রের সান ডিয়েগো স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতিবিজ্ঞানের অধ্যাপক আহমেদ টি. কুরু সম্প্রতি একটি নিবন্ধ লেখেন। সেখান থেকে এটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মাসউদুল আলম। নিবন্ধটির একটি পর্যালোচনা করেছেন সিএসসিএস-এর পরিচালক মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক।

***

আরব বিশ্বের ১১টি দেশের ২৫ হাজার লোকের উপর পরিচালিত একটি জরিপের ফলাফলের উপর ভিত্তি করে ২০১৯ সালে বিবিসি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যার শিরোনাম ছিলো “আরবরা কি ধর্ম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে?” তুরস্কে ধর্মভীরুতা ক্রমশ হ্রাস পাওয়া নিয়ে ২০১৮ সালে বিবিসি আরেকটি রিপোর্ট করেছিলো, যার শিরোনাম হচ্ছে– “তরুণ তুর্কিরা ইসলামকে প্রত্যাখ্যান করছে।” তুরস্ক ও অন্যান্য মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজে ধার্মিকতা যে হ্রাস পাচ্ছে, তা অন্যান্য সূত্র থেকেও জানা যায়।

আপাতদৃষ্টিতে স্ববিরোধী মনে হলেও বাস্তবতা হলো, সাম্প্রতিককালে ধার্মিকতা হ্রাস পাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে গত তিন দশক ধরে মুসলিম বিশ্বে চলমান ‘ধর্মীয় পুনর্জাগরণ’! এর ব্যাখ্যা বা কারণ কী হতে পারে?

ইসলামী পুনর্জাগরণের প্রধান দুই এজেন্ট তথা ইসলামপন্থী রাজনীতিবিদ ও আলেম সমাজের কমকাণ্ডের উপর ভিত্তি করে এই প্রশ্নের জবাব আমি দেবো। মানবাধিকার ও মূল্যবোধ সম্পর্কে তারা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা পালনে তারা ব্যর্থ হয়েছেন।

ইসলামপন্থা ও মানবাধিকার

১৯২৩ সালে তুর্কি রিপাবলিক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে ১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লব পর্যন্ত মুসলিম বিশ্বে সেক্যুলারপন্থী শাসনব্যবস্থার প্রাধান্য ছিলো। এই সময়কালে ইসলামপন্থীরা যে বিষয়টির উপর নিয়মিতভাবে কথা বলে গেছে সেটি হলো, সেক্যুলার শাসকগোষ্ঠী রক্ষণশীল মুসলিমসহ নানান দল ও গোষ্ঠীর উপর নিপীড়ন-নির্যাতন চালাচ্ছে। এর মাধ্যমে তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। ইসলামপন্থীরা দাবি করতো, সমাজ ও রাষ্ট্রকে ইসলামীকরণ করতে পারলে এই জুলুমের অবসান ঘটবে এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।

বিগত ত্রিশ বছরে সংখ্যাগরিষ্ঠ বহু মুসলিম দেশে সামাজিক ও রাজনৈতিক, এমনকি আইনগতভাবে নানা মাত্রায় ইসলামাইজেশন ঘটেছে। সেসব দেশের জনপরিসরে ইসলামী ডিসকোর্স ক্রমান্বয়ে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেছে। আইনের একটি উৎস হিসেবে সেসব দেশের সংবিধানে শরীয়াকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। ইরানে এটি ঘটেছে টপ-ডাউন অ্যাপ্রোচে। মিশরে এটি হয়েছে বটম-আপ অ্যাপ্রোচে। তুরস্কে এই ধরনের ইসলামীকরণ হয়েছে উভয় দিক থেকেই। একেক দেশে একেক রকমভাবে ইসলামাইজেশন ঘটার আরো একটি কারণ হলো স্থানীয় পরিবেশ-পরিস্থিতি। যেমন: ইরান ও মিশরে আইনগতভাবে ইসলামাইজেশন ঘটলেও তুরস্কের ক্ষেত্রে তা হয়নি। তুরস্কে আইনগতভাবে ইসলামীকরণের চেয়ে পাবলিক ডিসকোর্স এবং শিক্ষাব্যবস্থাকে ইসলামীকরণ করার ব্যাপারে অধিক মনোযোগ দেয়া হয়েছে।

যেখানে যেভাবেই ইসলামাইজেশন হোক না কেন, অধিকাংশ দেশেই ধর্মদ্রোহিতা বা ব্লাসফেমিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এ কারণে নাস্তিক, অমুসলিম এবং উদারপন্থী মুসলমানদের মতপ্রকাশ ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে। মিশরতুরস্কসহ কোনো কোনো দেশে এমনকি ইসলামী গ্রুপগুলো পর্যন্ত এই আইনের কারণে হয়রানীর শিকার হয়েছে।

বহু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ইসলামপন্থীরা সংখ্যালঘু নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীকে হয়রানী করার সেক্যুলার-জাতীয়তাবাদী পলিসিই অনুসরণ করেছে। এর ফলে তাদের দ্বারা সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। তুরস্কের ইসলামপন্থীরা দাবি করতো, তুর্কি ও কুর্দি উভয় জনগোষ্ঠীর অভিন্ন পরিচয় তথা মুসলিম পরিচয়কে সামনে রেখে তারা কুর্দি সমস্যার সমাধান করতে পারবে। অথচ, এরদোয়ানের ইসলামপন্থী দল একেপির প্রায় দুই দশকের শাসনামলেও কুর্দিদের মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে।

ইসলামপন্থীদের কথা ও কাজের বৈপরীত্যের একটি উদাহরণ হলো লায়লা শাহীনের ঘটনা। ২০০৪ সালে শাহীন তুরস্কের বিরুদ্ধে ইউরোপিয়ান কোর্ট অব হিউম্যান রাইটসে একটি মামলা দায়ের করেন। সেখানে অভিযোগ করা হয়, হিজাব পরিধান করায় ইস্তাম্বুল ইউনিভার্সিটির মেডিকেল স্কুল তাকে ক্যাম্পাসে প্রবেশের অনুমোদন দেয়নি। এ ঘটনার পনের বছর পর শাহীন এখন একেপিতে মানবাধিকার বিষয়ক ডেপুটি চেয়ারপার্সন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলেন তিনি ঘোষণা দিয়েছেন: “তুরস্কে কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নেই।”

মানবাধিকার লঙ্ঘনের পরিণতিতে কোনো ইসলামাইজড সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় শুধু রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীই তৈরি হয় না, ধর্মীয় ভিন্নমতাবলম্বীও গড়ে ওঠে। আরো স্পষ্ট করে বললে, এইসব ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় একটি তরুণ সমাজের উদ্ভব ঘটে যারা ইসলামকে এমন ধরনের ধর্ম মনে করে, যা মানবাধিকারের বিরোধী। অন্তত মানবাধিকারকে প্রমোট করে না।

আলেম সমাজ ও সামাজিক মূল্যবোধ

যুগ যুগ ধরে আলেম সমাজ ও ইসলামপন্থীরা অনৈতিকতা ও দুর্নীতির জন্য সেক্যুলার মতাদর্শ ও দলগুলোকে দোষী করে আসছে। ইসলামীকরণ হওয়ার মাধ্যমে সামাজিক মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতার উন্নয়ন ঘটবে বলে তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

তারা এমন এক ইউটোপিয়ান ইসলামের কথা বলেন, যার স্লোগান হচ্ছে– “Islam is the solution!” তাদের মতে, শৌচকর্মের আদব থেকে রাজনীতি, তথা জীবনের সকল বিষয়ে সমাধান দিতে পারে ইসলাম।

অথচ যেসব দেশে ইসলামাইজেশন ঘটেছে, তাদের বেশিরভাগ দেশেই কর্তৃত্ববাদ ও দুর্নীতির মতো সমস্যা তৈরি হয়েছে। সেসব দেশের স্বৈরাচারী শাসক ও তাদের অনৈতিক কাজকর্মের সমালোচনায় ইসলামপন্থী রাজনীতিবিদদের সাথে আলেম সমাজও অনেক বেশি সোচ্চার ছিলো।

বাস্তবতা হলো, রাজনীতি সম্পর্কে আলেমদের বুঝজ্ঞান এখনো মধ্যযুগীয় চিন্তাভাবনায় আটকে আছে। তাদের মতে, একজন শাসক যতক্ষণ পর্যন্ত প্রকাশ্যে ইসলাম ত্যাগ না করবে কিংবা শরীয়া মানতে অস্বীকার না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তার আনুগত্য করতে হবে। অন্যভাবে বললে, আধুনিক কালের ক্ষমতার পৃথকীকরণ, চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স, বিরোধী দলের কনসেপ্ট ও বাকস্বাধীনতার ধারণাগুলো তাদের রাজনৈতিক চিন্তায় যোগ হয়নি।

উদাহরণ হিসেবে আবারো তুরস্কের কথা বলা যাক। এরদোয়ান ও আলেম সমাজের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারে মূল ভূমিকা পালন করেন তুরস্কের শীর্ষস্থানীয় আলেম খায়ের উদ্দীন কারামান। ২০১৪ থেকে একেপিকে সমর্থন করে কারামান কর্তৃক একের পর এক ফতোয়া প্রদান বিশেষভাবে উল্লেখ্য। এমনকি, একেপি যখন দুর্নীতি ও স্বৈরতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের জন্য সমালোচিত হচ্ছিলো, তখনও তিনি ফতোয়া প্রদান অব্যাহত রাখেন।

সাম্প্রতিককালে বহু মুসলিম, বিশেষত তরুণ প্রজন্ম নিজ দেশের দুর্নীতির ব্যাপারে যেমন ত্যাক্ত-বিরক্ত, তেমনি দুর্নীতিগ্রস্ত শাসকদের পক্ষে সাফাইকারী আলেমদের উপরও অত্যন্ত বিরক্ত। আলেমদের ব্যাপারে এদের সমালোচনা দিনকে দিন ইসলামের সমালোচনার দিকে মোড় নিচ্ছে। কেউ কেউ ভাবতে শুরু করেছে, পাবলিক এথিক্স তৈরিতে ইসলাম ব্যর্থ হয়েছে।

ইসলামকে ‘ধর্ম’ পরিচয়ে ফিরিয়ে নেওয়া উচিত

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর কমিউনিস্টদের কারো কারো দাবি ছিলো– সোভিয়েতের পতন মানে কমিউনিজম ব্যর্থ, এমনটা নয়। তাদের মতে, সত্যিকারের কমিউনিজম সেখানে কখনোই অনুসৃত হয়নি। ইসলামপন্থীদের রাজনৈতিক প্রকল্প ব্যর্থতার মুখোমুখি হওয়ায় অনেক ইসলামপন্থী একইভাবে বলতে শুরু করেছে, তাদের আইডিয়াতে কোনো অসামঞ্জস্যতা নেই। বরং সত্যিকার অর্থে এই আইডিয়াকে অনুসরণ করা হয়নি বলেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

বাস্তবতা হলো, ‘ইসলাম হচ্ছে সকল সমস্যার সমাধান’– সারা দুনিয়াতেই ইসলামপন্থীদের এই প্যারাডাইমের পতন ঘটেছে। মানবাধিকার রক্ষায় ইসলামপন্থীদের ব্যর্থতা এবং পাবলিক এথিক্স প্রমোট করার ক্ষেত্রে আলেম সমাজের ব্যর্থতা এই সংকটের প্রধান দুটি কারণ।

ধর্মের সংকীর্ণ অর্থে ইসলামকে একটি ধর্ম হিসেবে নিলে আধুনিক সমাজে নৈতিকতার উন্নয়নে এটি অবদান রাখতে পারে। যদিও, মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়ন তথা একটি পলিটিক্যাল ডকট্রিন হিসেবে এটি কার্যকর থাকবে না।

সেক্ষেত্রে ইসলামকে একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে বিবেচনার পরিবর্তে ঈমান, ইবাদত, অধিকার ও মূল্যবোধ ইত্যাদি সংবলিত ধর্ম হিসেবে একে পুনরায় কনসেপ্টচুয়ালাইজ করা উচিত। নয়তো মুসলিম তরুণরা আরো বেশি করে ইসলাম থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে।

এ ধরনের আরো লেখা