কারযাভীর ‘অ্যাপ্রোচিং দ্যা সুন্নাহ’র সারসংক্ষেপ
এডিটর’স নোট: ‘কাইফা নাতা’আমালু মা’আসসুন্নাহ আন-নবুওয়্যাহ’ (সুন্নতে নববীকে কীভাবে বুঝতে হবে) সমকালীন শীর্ষ ইসলামী গবেষক ড. ইউসুফ আল কারযাভীর অন্যতম মৌলিক একটি বই। ২০০৬ সালে ‘Approaching the Sunnah: Comprehension and Controversy’ (সুন্নাহ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি: সমন্বয় ও বিরোধ) শিরোনামে এর ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। ইংরেজি অনুবাদ থেকে বইটির সারসংক্ষেপ করেছেন কানিজ ফাতিমা।
*****
Approaching the Sunnah: Comprehension and Controversy
লেখক: ইউসুফ আল-কারযাভী
ইংরেজি অনুবাদ: জামিল কোরেশি
প্রকাশক: ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থ্যট
প্রকাশকাল: ২০০৬
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ২১৫
মূল্য: ১৯.৯৫ ইউএস ডলার
প্রাপ্তিস্থান: বিআইআইটি
বাড়ি # ০৪, সড়ক # ০২,
সেক্টর # ০৯, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০
*****
সুন্নাহর উপর ড. ইউসুফ আল কারযাভী বর্তমান বিশ্বের প্রথম সারির একজন স্কলার। তাঁর লেখা Approaching the Sunnah: Comprehension and Controversy সুন্নাহ বোঝার জন্য একটি অপরিহার্য বই। তিনি এ বইয়ে সুন্নাহকে সঠিকভাবে স্টাডি করার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন।
এখনকার সময়ের জন্য বইটি একটি সময়োপযোগী সংযোজন। কারণ বর্তমান সময়ে উম্মাহ সুন্নাহ নিয়ে নানা রকম বিভ্রান্তি ও বিতর্কে নিয়োজিত ও বিভক্ত। এ সংক্রান্ত জ্ঞানের অপরিসীম অভাব, কঠিন ভুল বুঝাবুঝি, ভুল ব্যাখ্যা ও ভুল উপস্থাপন, prejudice (পর্যাপ্ত জ্ঞান অর্জনের পূর্বেই সংস্কারের ভিত্তিতে পছন্দ-অপছন্দ বা মতামত নির্ধারণ) উম্মাহকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করেছে। ফলে এ সময়ে এমন একটি বই সুন্নাহর ব্যাপারে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গী লাভের জন্য একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ পাঠ্যে পরিণত হয়েছে।
অনেকে বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে সুন্নাহর যথার্থতাকে অস্বীকার করার প্রয়াস পান। কিন্তু ইসলামে সুন্নাহর অবস্থান ও গুরুত্ব অপরিসীম। এটাই কোরআনের একমাত্র গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা এবং ইসলামী শরীয়াহর দ্বিতীয় উৎস। কোরআন সুস্পষ্টভাবে রাসূল (সা)-এর আনুগত্যকে বিশ্বাসীদের জন্য বাধ্যতামূলক করেছে এবং একে বিশ্বাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ করেছে। কাজেই সুন্নাহর যথার্থতাকে যেমন একদিকে এড়িয়ে যাওয়া অনাকঙ্খিত তেমনিভাবে সুন্নাহকে সঠিক ও সামগ্রিক্ভাবে না বুঝে এর ভাসাভাসা জ্ঞানও সমাজের জন্য একটি বড় সমস্যার কারণ। এই বইয়ে সুন্নাহ বিষয়ক এসব মৌলিক সমস্যাকে তুলে ধরা হয়েছে।
বইটি তিনটি অধ্যায়ে বিভক্ত:
প্রথম অধ্যায়: সুন্নাহর কতিপয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। যেমন, universality (সার্বজনীনতা), coherence (সামঞ্জস্যতা), compassionate realism (সদয় দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে বাস্তবতা অনুধাবন), moderation (মধ্যম পন্থা), এবং humility (বিনয়)।
দ্বিতীয় অধ্যায়: ইসলামী আইন শাস্ত্র বা নৈতিক বিধান তৈরীতে সুন্নাহর মানদণ্ড ও সুন্নাহকে ব্যবহারের পন্থা/পদ্ধতি (standards and procedures) নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
তৃতীয় অধ্যায়: সুন্নাহ বোঝার ক্ষেত্রে মুসলিম সমাজে যে প্রচলিত ভুলগুলো করা হয় তা বিস্তারিত উদাহরণসহ বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন, হাদীসের পরিপেক্ষিত না জেনে শুধুমাত্র হাদীসের টেক্সট জানা, হাদীসের আইনগত দিক ও নৈতিক দিক (moral instruction) দু’টির পার্থক্য না বোঝা বা গুলিয়ে ফেলা, কোনটি উদ্দেশ্য আর কোনটি উদ্দেশ্য হাসিলের মাধ্যম (means and ends) তা বুঝতে না পারা, কথার ভাবার্থ আর আক্ষরিক অর্থের পার্থক্য না বোঝা (figurative and literal meaning) ইত্যাদি।
সবশেষে এ সমস্যাগুলো থেকে উত্তরণের পথ নিয়ে বইটিতে আলোচনা করা হয়েছে।
পুরো বইটির মধ্যে তৃতীয় চ্যাপ্টারটি খুবই গুরুত্বের দাবিদার। ইসলাম যারা বুঝতে চান বা ইসলামের জন্য কাজ করতে চান তাদের জন্য বইয়ের এ অংশটি পড়ে নেয়া খুবই জরুরী যাতে করে তারা ইসলামের এই গুরুত্বপূর্ণ উৎস তথা সুন্নাহকে বোঝার নিয়মাবলী সম্পর্কে অবগত হতে পারেন।
সুন্নাহর বিশেষ বৈশিষ্ট্যসমূহ:
১. সুন্নাহর সমগ্রতা ও ব্যাপকতা। সুন্নাহর ব্যাপ্তি একদিকে যেমন vertically জীবনের শুরু থেকে শেষ অবধি তেমনি আবার horizontally এটি জীবনের সব বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে। সাথে সাথে সুন্নাহর গভীরতা মানুষের চিন্তা ও ইচ্ছা পর্যন্ত বিস্তৃত। অর্থাৎ সুন্নাহর ব্যাপ্তি মানুষের জীবনের সকল অধ্যায় ওবিষয়কে নিয়ে।
২. সুন্নাহর দ্বিতীয় বৈশিষ্ট হলো এর ভারসাম্যপূর্ণ, মধ্যমপন্থী ও পরিমিত দৃষ্টিভঙ্গী। এটি জীবনের প্রতিটি বিষয়কে ভারসাম্যপূর্ণ করে। জীবনের কোনো একটি বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে অন্য বিষয়কে অবহেলা করে না। ইসলাম জীবনকে একক ইউনিট হিসাবে দেখে; জীবনের কাজকে দুনিয়াবী (secular) ও ধর্মীয় (religious)-এরূপ দুই ভাগে ভাগ করে না। আর ইসলামের এই গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্টটি সুন্নাহ থেকেই পরিস্কার হয়ে উঠেছে। জীবনের প্রতি ইসলামের এই অখণ্ড দৃষ্টিভঙ্গী সুন্নাহ থেকেই বিস্তারিতভাবে বোঝা যায়।
৩. সুন্নাহর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট হলো এটা সামগ্রিক, বাস্তববাদী এবং সহজ। সুন্নাহ মানুষকে একদিকে যেমন ফেরেশতা হিসাবে দেখে না তেমনি জন্মগত পাপী হিসাবেও দেখে না। সুন্নাহ জীবনকে সহজ ও সুবিধাজনক (convenient) করতে চায়। রাসূল (সা) বলেছেন, ‘প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ আমাকে এজন্য পাঠাননি যে, আমি সবকিছুকে কঠিন বা কষ্টকর করব; বরং তিনি আমাকে পাঠিয়েছেন শিক্ষক হিসাবে এবং সহজতা আনয়নের জন্য, মানুষের জীবনকে সহজ করার জন্য।’ [পৃষ্ঠা- ৯]
ইউসুফ আল-কারযাভী উম্মাহর বিভিন্ন দিক ও বিষয় নিয়ে প্রচুর লিখেছেন। শিক্ষা, সংস্কৃতি, দাওয়া, বিচার ব্যবস্থা- সব দিকেই তিনি লিখেছেন। এই বইটিতে তিনি যে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছেন তা হলো মুসলমানদের চিন্তা প্রক্রিয়ার সমস্যা (crisis in thought process)। একেই তিনি বর্তমান সময়ে মুসলমানদের সব থেকে বড় সমস্যা বলে চিহ্নিত করেছেন। লেখকের মতে, সুন্নাহ বোঝার ক্ষেত্রে (insight into the Sunnah) এবং বাস্তব জীবনে এর ব্যবহারের ক্ষেত্রে মুসলিমদের চিন্তার সীমাবদ্ধতা এর একটি বড় প্রমাণ। [পৃষ্ঠা-১১]
এই পরিস্থিতিতে মুসলমানদের জন্য এটা শেখা অতীব গুরুত্বপূর্ণ যে, কিভাবে সুন্নাহকে বুঝতে হয় এবং কিভাবে জীবনের বাস্তবক্ষেত্রে এর ব্যবহার করতে হয়।
লেখক সুন্নাহর ক্ষেত্রে তিন ধরনের চ্যালেঞ্জকে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। তিনি রাসূল (সা)-এর একটি হাদীসের মাধ্যমে বিষয়টি সম্পর্কে পাঠকদের সাবধান করেছেন।রাসূল (সা) বলেছেন, ‘প্রত্যেক প্রজন্ম থেকে একজন ন্যায় পরায়ণ ও সত্য সন্ধানীর (just and upright) আবির্ভাব ঘটবে যিনি সুন্নাহর সঠিক জ্ঞানকে তুলে ধরবেন এবং উগ্রপন্থীদের কৃত ক্ষতি, মিথ্যা মিশ্রিতকারীদের বিচ্যুতি ও অজ্ঞ মানুষদের ব্যাখ্যা থেকে সুন্নাহকে মুক্ত রাখবেন।’
এই হাদিসে সুন্নাহের চ্যালেঞ্জ হিসাবে তিনটি গ্রুপের কৃত ক্ষতিকে দেখানো হয়েছে,
১. Extremists: এরা সুন্নাহর ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি, কঠোর ও প্রান্তিক দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করে এবং সুন্নাহর উদ্দেশ্য থেকে একে সরিয়ে ফেলে ও ক্ষতি সাধন করে। সাধারণ দৃষ্টিতে এদের এক অংশকে সুন্নাহর অভিভাবক মনে হয়। কিন্তু বাস্তবে বাড়াবাড়ির কারণে এরা সুন্নাহর মূল স্পিরিট থেকে সরে পরে। অন্য প্রান্তে, বিপরীতধর্মী উগ্রপন্থীরা পুরো সুন্নাহকেই অস্বীকার করে।
২. Falsifier: এরা সুন্নাহর সাথে মিথ্যা মিশ্রিত করে, মিথ্যা হাদীস তৈরি ও প্রচার করে।
৩. Ignorant: এখানে অজ্ঞ বলতে একেবারেই হাদীস সম্পর্কে জানে না এমন গোষ্ঠিকে বোঝানো হয়নি। বরং বোঝানো হয়েছে একদল হাদীসের ব্যাখ্যাদাতা শ্রেণী যারা যথেষ্ট লেখাপড়া ও গবেষণা ছাড়াই সীমিত সংখ্যক হাদীস জেনেই এর ব্যাখ্যা দেয়; আর এসব ব্যাখ্যা দিয়ে তারা সুন্নাহর ক্ষতি করে ফেলে। তাদের স্বল্প জানা থেকে যে খণ্ডিত ব্যাখ্যা আসে তা সুন্নাহকে তার প্রকৃত স্পিরিট থেকে দূরে নিয়ে যায়। (হাদীস পাঠ, মুখস্থ করা আর হাদীসের গবেষণাভিত্তিক জ্ঞান- এ দু’য়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।)
সুন্নাহর বিশেষ বৈশিষ্টগুলো আলোচনার পর লেখক সুন্নাহ বাস্তবায়নের কিছু মৌলিক নীতি (fundamental principles for the application of the Sunnah) আলোচনা করেছেন, যাতে মুসলমানরা নিজস্ব জ্ঞানের মাধ্যমে উগ্রপন্থীদের বাড়াবাড়ি, মিথ্যা মিশ্রিতকারীদের বিচ্যুতি আর অজ্ঞতাপূর্ণ ব্যাখ্যাগুলোর ক্ষতি থেকে মুক্ত থাকতে পারে।
সুন্নাহ বোঝা ও বাস্তবায়নের (application) মূলনীতি:
প্রথমত, সনদ ও মতনের ভিত্তিতে হাদীসের শুদ্ধতা যাচাই করতে হবে। Scientific methodology অনুসারে এই যাচাইয়ের কাজ করতে হবে। হাদীসের সনদ বা বর্ণনাকারীদের পরম্পরা যাচাই যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনিভাবে হাদীসের মতন বা টেক্সট যাচাইও গুরুত্বপূর্ণ।
দ্বিতীয়ত, রাসূল (সা)-এর কথা শুধু আক্ষরিক অর্থে নয় বরং ভাষার সামগ্রিক ভাবের মাধ্যমে বুঝতে হবে। তাই হাদীসের সঠিক অর্থ বুঝার জন্য ওই সময়ের পারিপার্শ্বিকতা (circumstances), ইসলামের সামগ্রিক উদ্দেশ্য (the totality of the purposes of Islam), হাদীসের সামগ্রিক উদ্দেশ্য (the general intent of hadith), আইন সংক্রান্ত ও সাধারণ (legislative and non-legislative) হাদীসের পার্থক্য- এসব বিষয় বুঝতে হবে ও বিবেচনায় আনতে হবে। [পৃষ্ঠা-২০]
তৃতীয়ত, কোনো হাদীস আরো শক্তিশালী কোনো টেক্সটের সঙ্গে সাংঘর্ষিকহলে সেক্ষেত্রে সঠিক পদ্ধতির মাধ্যমে সেই হাদীসের অর্থ গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, কোনো হাদীসের অর্থ এমন হবে না যাতে এর থেকে শক্তিশালী কোনো টেক্সট যেমন কোরআনের আয়াত, অধিক সূত্রসমৃদ্ধ ও যাচাই-বাছাইয়ে অধিকতর প্রমাণসিদ্ধ হাদীস, ইসলামের মৌলিক নীতির সঙ্গে অধিক সঙ্গতিপূর্ণ হাদীস বা ইসলামী শরীয়াহর উদ্দেশ্যের সঙ্গে অধিক সামঞ্জস্যশীল হাদীস ইত্যাদির সঙ্গে বিরোধ ঘটে।
লেখক এই পর্যায়ে আইন বিষয়ক ও নির্দেশনামূলক হাদীস (Legislative Sunnah and Guidance Sunnah), এই দুই ক্ষেত্রেই এর শুদ্ধতা প্রমাণিত হওয়ার উপর জোর দেন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে দেখা যায়, অনেক মুসলিম আইন বিষয়ক হাদীসের শুদ্ধতার ব্যাপারে সচেতন থাকলেও নির্দেশনামূলক হাদীসের শুদ্ধতা যাচাইয়ের প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন না। আর এ জন্য প্রায়শ দেখা যায়, দাওয়াহ সংক্রান্ত বইগুলো (যা অন্তরকে নরম করে, আবেগকে উদ্বেলিত করে) এবং সুফিবাদ সংক্রান্ত বইগুলো মিথ্যা ও সন্দেহপূর্ণ হাদীসে ভরপুর। আবার এটাও দেখা যায়, অনেক মানুষ ভালোর জন্য বা মানুষের ভালো হবে এমন মনে করে জেনে শুনে মিথ্যা হাদীস তৈরি করে বা হাদীসকে বাড়িয়ে বলে। এ ধরনের মানসিকতাকে লেখক উদ্বেগপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি মনে করেন, এমন মিথ্যা হাদীস তৈরি এমন মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ, যেখানে লোকেরা মনে করে আল্লাহ ধর্মকে পরিপূর্ণ করেননি বা করতে পারেননি; কাজেই এক্ষেত্রে আল্লাহকে সাহায্য করা তাদের জন্য দরকারী হয়ে পড়েছে। এটা এক ধরনের খেয়ালী, দাম্ভিকতা ও অহংকারী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ।