‘আল্লাহর সার্বভৌমত্ব’ কথাটার তাৎপর্য

ইসলামী রাজনীতির সাথে জড়িত লোকেরা কুরআনের কয়েকটি বাক্য খুব বেশি ব্যবহার ‎‎করেন। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, এ সকল বাক্য তাদের রাজনৈতিক বক্তব্য ব্যাখ্যা করতে ‎‎সহায়তা করে। এ বাক্যগুলোর মধ্যে কুরআনে ব্যবহৃত ‎إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ‎ বাক্যটি অন্যতম। ‎‎সাধারণত এর অর্থ করা হয়, সার্বভৌমত্বের মালিক আল্লাহ। যে আরবী শব্দের অর্থ ‎‎‎‘সার্বভৌমত্ব’ করা হয় সে শব্দটি হচ্ছে ‘হুকুম’। কেউ কেউ মুলুকিয়াত অর্থেও এ শব্দ ব্যবহার ‎করেন, সুলতানাত ‎ও সিয়াদাত অর্থাৎ কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বের অন্তর্ভুক্ত সবকিছু এর মধ্যে শামিল ‎রয়েছে। ‎

আরবী ‘হুকুম’ একটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ। কুরআনে এ শব্দ ২১০ বার এসেছে। ‎‎অধিকাংশ সময় বিচার-ফায়সালা বুঝাতে তা ব্যবহৃত হয়েছে। অন্যান্য যেসব অর্থে কুরআনে ‎শব্দটি ‎ব্যবহার করা হয়েছে এর মধ্যে রয়েছে নির্ভুল করা, প্রতিষ্ঠা করা, প্রজ্ঞা, নির্দেশ, ‎সিদ্ধান্ত, ‎সুস্পষ্ট, দায়িত্বশীল ইত্যাদি। ‘হুকুম’ কথাটিকে যারা সার্বভৌমত্ব অর্থে ব্যবহার করেন ‎তারা ‎এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, নির্দেশ প্রদান ও শাসন করার ব্যাপারে চূড়ান্ত ক্ষমতার নাম ‎সার্বভৌমত্ব। ‎

যতটুকু জানি, ‘হুকুম’ শব্দটি সার্বভৌমত্ব অর্থে ইসলামী চিন্তাবিদদের মধ্যে সর্বপ্রথম ব্যবহার ‎‎করেছেন মাওলানা মওদূদী এবং এরপর সাইয়েদ কুতুব। পরবর্তীতে ইসলামী রাজনীতির ‎‎সাথে জড়িত প্রায় সবাই এ অর্থেই শব্দটি ব্যবহার করছেন। সলফে সালেহীনদের যুগে কেউ ‎‎শব্দটি সার্বভৌমত্ব অর্থে ব্যবহার করেছেন বলে আমার নজরে পড়েনি। সবচেয়ে বড় কথা, ‎আহলে সু্ন্নতের ‎অনুসারী বলে পরিচিত কোনো গ্রুপ গত হাজার বছরেও এটাকে ইস্যু ‎হিসেবে দাঁড় করায়নি। ‎

প্রথম যুগের ফকীহদের মধ্যে বিতর্ক হয়েছে উলুল আমর নিয়ে। এটাও কর্তৃত্ব এবং আনুগত্য ‎‎বিষয়ক। উলুল আমরের ব্যাপারে সাহাবাদের দুটো মত আছে। কারো মতে, উলুল আমর ‎হচ্ছেন উলামায়ে ‎কেরাম এবং কারো মতে, দেশের শাসক-প্রশাসক। ইমাম তাবারীসহ প্রাচীন ‎মুফাসসিরদের মতে, উলুল আমর বা হুকুম দেয়ার অধিকারী বলতে শাসক, আলেম এবং ‎সাহাবাদের বুঝানো হয়েছে। ইসলামী সংগঠনের দায়িত্বশীলকে উলুল আমর বলার ‎প্রবণতা ‎বিংশ শতকের আবিষ্কার। কুরআনে উলুল আমরের শর্তাধীন আনুগত্যের কথা বলা হয়েছে।‎ ‎নিঃশর্ত আনুগত্যের মালিক একমাত্র আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সা)। কিন্তু কোনো কোনো ‎ইসলামী সংগঠনের দায়িত্বশীলগণ সকল জায়েজ কাজে নিঃশর্ত আনুগত্য ফরজ বলে দাবি ‎করেন। কুরআনের এ আয়াত এবং কিছু হাদীসের বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যা দিয়ে তারা বহু বই-‎পুস্তকও লিখেছেন। ‎

আল্লাহকে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক বলা হলে আভিধানিক অর্থের দিক দিয়ে অর্থের বিকৃতি বা ‎‎দূরবর্তী অর্থ করা হয়েছে বলে দাবি করার সুযোগ নেই। ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী, আল্লাহ ‎‎সার্বভৌম বা নিরঙ্কুশ ক্ষমতার মালিক, তাঁর ক্ষমতায় কোনো অংশীদার নেই এবং কারো তা ‎‎চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা নেই। বিশ্বজাহানের প্রতিটি অণু-পরমাণুতে তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত। এটা ‎‎প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন। তাঁর হুকুম বা ইচ্ছা ব্যতীত গাছের একটি ‎‎পাতাও নড়াচড়া করতে পারে না। সত্যিকার বিচারে, এই অর্থে আল্লাহর সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস ‎‎রাখা মুসলমানদের ঈমানের অঙ্গ। কুরআনের অসংখ্য আয়াত, হাদীসের অসংখ্য ব্যাখ্যা এবং ‎‎কালিমা ঈমানে মুফাসসালে তা বিবৃত হয়েছে। সচেতনভাবে বুঝেশুনে কেউ তা অস্বীকার ‎‎করলে তার ঈমান থাকবে না। এটা খালেস দ্বীনি বা থিওলজিক্যাল বিষয়। রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ‎‎ও নেতৃত্বের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।

ইংরেজি ভাষায় ব্যবহৃত sovereignty শব্দটির বাংলা তরজমা করা হয় সার্বভৌমত্ব। কথ্য ‎‎ল্যাটিন শব্দ superanus থেকে উদ্ভূত শব্দটি ইংরেজি ভাষায় এসে sovereignty হয়ে ‎‎গেছে। মূলত এর শাব্দিক অর্থ প্রধানব্যক্তি বা শাসক হলেও শত বছরের পথ পরিক্রমায় ‎‎রাজনীতি বিজ্ঞানের ভাষায় নতুন অর্থ ধারণ করেছে। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নিরঙ্কুশ ‎‎ক্ষমতা বুঝাতে তা ব্যবহার করা হয়। এ শব্দটি ইউরোপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শাসক, চার্চ ও ‎‎জনগণের মধ্যে বহু লড়াই ও রক্তপাতের মধ্য দিয়ে। সময়ের বিবর্তনে সার্বভৌমত্ব বা নিরঙ্কুশ ‎‎ক্ষমতার সীমানা, আওতা এবং বহির্ভূত বিষয়ের সংজ্ঞায় পরিবর্তন এসেছে। সময়ে হয়তো ‎‎আরো প্রসারিত বা সঙ্কুচিত হবে। গ্লোবাল পৃথিবীতে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক ‎‎সম্পর্কের কারণেও এতে অনেক পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। ‎

বৃটিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন অস্টিন (৩ মার্চ ১৭৯০ – ১ ডিসেম্বর ১৮৫৯) প্রদত্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী, সার্বভৌম-শক্তি সীমাহীন ক্ষমতা সংরক্ষণ করে, যা অবিভাজ্য ও চূড়ান্ত। ফলে এটি আধুনিক বিশ্বের উপযোগী নয়। বর্তমান বিশ্বে এক রাষ্ট্রের কার্যক্রম অন্যান্য রাষ্ট্রের কার্যক্রম ও ‎‎অধিকার দ্বারা বাহ্যিকভাবে সীমাবদ্ধ এবং অভ্যন্তরীণ দিক থেকে রাষ্ট্র ও সরকারের বিভিন্ন ‎‎বিভাগের (আইন, শাসন ও বিচার বিভাগ) মধ্যে রাষ্ট্রের ক্ষমতা বিভক্ত। সে বিবেচনায় বাস্তব ‎‎ক্ষেত্রে বর্তমানে পৃথিবীর কোনো দেশ বা সংস্থা সীমাহীন সার্বভৌমত্বের অধিকারী নয়। দেশীয় ‎এবং আন্তর্জাতিক ‎পরিমণ্ডলে সার্বভৌম ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বর্তমানে সম্পূর্ণ বিভক্ত। স্বাভাবিক ‎কারণেই ‎রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে এ নিয়ে অসংখ্য বিতর্ক বিদ্যমান।

অনেকে বলেন, দেশের জনগণ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। এটা একটি হাস্যকর দাবি। ‎পৃথিবীর কোনো দেশের জনগণ সার্বভৌম ক্ষমতা ভোগ করে না। শাসকগোষ্ঠী, বুদ্ধিজীবী, ‎সেনাবাহিনী, ধনিকশ্রেণী এবং মিডিয়া যেভাবে দেশকে চালাতে চায় সেভাবেই দেশ চলে। ‎জনগণ সার্বভৌমত্বের মালিক বলে তাদের আসলে ধোকা দেয়া হয়। গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে জনগণ ‎ভোট দিয়ে দেশ শাসনের দায়িত্ব একটা দলকে প্রদান করে। কিন্তু সার্বজনীন ভোটাধিকার ‎প্রয়োগের সময়ও তা শাসকশ্রেণী এবং মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণে থাকতে দেখা যায়। ‎

সার্বভৌমত্বের সংজ্ঞা বা সীমানা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও রাজনৈতিক আলোচনায় রাষ্ট্র ও ‎‎পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব একটা আবশ্যিক বিষয়। একটা দেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পরিচয়ের ‎‎একটি শর্ত হলো রাষ্ট্রকে সার্বভৌম হতে হবে। পার্লামেন্ট পদ্ধতির সরকারে পার্লামেন্টকে সার্বভৌম ‎‎বলা হয়। বাইরের কোনো শক্তির প্রভাবমুক্ত থেকে দেশের পার্লামেন্ট যে কোনো আইন প্রণয়ন ‎‎করতে পারে। দেশের সকল রাজনৈতিক দল এটা মেনে নিয়েই নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে। ‎‎বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের ইসলামপন্থীরাও এর ব্যতিক্রম নয়। ‎

আমাদের মতে, কুরআনে হুকুম বা সার্বভৌমত্বের যে ধারণা দেয়া হয়েছে সেটা প্রতিষ্ঠা করার বিষয় ‎নয়, বরং ‎‎বিশ্বাসের বিষয়। এর প্রতি বিশ্বাস আনার জন্যে নবী-রাসূলগণ মানুষকে আহবান ‎জানিয়েছেন। ‎‎সে আহবানে কেউ সাড়া না দিলে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব চলে যায় না। ‎মুসলমানরা যে আল্লাহর ‎‎উপর বিশ্বাস করেন তাঁর সার্বভৌমত্ব সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত ‎আছে। এটাকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা ‎‎কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নেই। সার্বভৌমত্বের ‎ব্যাপারে শুধু নয়, কোনো ব্যাপারেই আল্লাহ কারো ‎‎মুখাপেক্ষী নন। মানুষকে আল্লাহ ‎বিশ্বাস ও কর্মের স্বাধীনতা দিয়েছেন এবং এর আলোকে ‎‎শাস্তি ও পুরস্কারের বিধান ‎রেখেছেন। আল্লাহ প্রদত্ত সে স্বাধীনতা আছে বলেই কোনো কোনো ‎‎মানুষ আল্লাহ এবং ‎আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করতে পারে। আল্লাহ সে ক্ষমতা না ‎‎দিলে তারা ‎তা করতে পারতো না। কিন্তু অস্বীকারের কারণে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন বা ‎‎বিনষ্ট হয় না। ‎

আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতার কথা কুরআনের বেশ কিছু আয়াতে বলা হয়েছে। সব‎চেয়ে ‎‎আলোচিত আয়াত হচ্ছে, ‘ইনিল হুকমু ইল্লা লিল্লাহ’। এ সকল আয়াতের ‎পূর্বাপর কথাগুলো ‎‎বিবেচনায় নিলে আমরা এর তাৎপর্য সহজেই বুঝে নিতে ‎পারবো।

১.

قُلْ إِنِّي عَلَىٰ بَيِّنَةٍ مِّن رَّبِّي وَكَذَّبْتُم بِهِ ۚ مَا عِندِي مَا تَسْتَعْجِلُونَ بِهِ ۚ إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ ۖ ‏يَقُصُّ ‏‏الْحَقَّ ۖ وَهُوَ خَيْرُ الْفَاصِلِينَ

‎‍বলো, আমার রবের পক্ষ থেকে আমি একটি উজ্জ্বল প্রমাণের ওপর প্রতিষ্ঠিত আছি এবং ‎‎তোমরা তাকে মিথ্যা বলেছো। এখন তোমরা যে জিনিসটি তাড়াতাড়ি চাচ্ছো সেটি আমার ‎‎ক্ষমতার আওতাধীন নয়। ফায়সালার সমস্ত ক্ষমতা আল্লাহর হাতে। তিনিই সত্য বিবৃত করেন ‎‎এবং তিনিই সবচেয়ে ভালো ফায়সালাকারী।” [৬ আনআম: ‎৫৭]‎

অবিশ্বাসীদের পক্ষ থেকে নবীর কাছে অলৌকিক ক্ষমতা দেখানোর দাবির প্রেক্ষিতে আল্লাহ ‎‎এখানে নবীর ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কথা জানিয়ে দিয়েছেন। ‎ইমাম রাজী এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন,‎

‏﴿إنِ الحُكْمُ إلّا لِلَّهِ﴾ عَلى أنَّهُ لا يَقْدِرُ العَبْدُ عَلى أمْرٍ مِنَ الأُمُورِ إلّا إذا قَضى اللَّهُ بِهِ،

‌‘ইনিল হুকমু ইল্লা লিল্লাহ’ কথাটার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর ফায়সালা ব্যতীত কোনো ব্যাপারে ‎‎বান্দার কোনো কিছু করার ক্ষমতা নেই।

২.

إِنِ ‏الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ ۚ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ ۚ ذَٰلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ

“আল্লাহ ছাড়া সার্বভৌম ক্ষমতা আর কারো নেই। তাঁর হুকুম— তোমরা তাঁর ছাড়া আর কারোর ‎‎বন্দেগী করবে না। এটিই সরল সঠিক জীবন পদ্ধতি, কিন্তু অধিকাংশ লোক জানে ‎‎না।” [তাফহীমুল কুরআন, ১২ ইউসুফ: ৩৯-৪০]‎

এখানে ইউসুফ (আ) কয়েদখানার সঙ্গীদের তাওহীদের দাওয়াত দিতে গিয়ে এ কথা ‎‎বলেছেন। এখানে রাজনৈতিক কর্তৃত্বের কথা নেই। তা ছাড়া ইউসুফ (আ) নবী হওয়া সত্ত্বেও একজন অমুসলিম সার্বভৌম রাজার অধীনে কাজ করতে সম্মত হয়েছেন এবং নিজের ‎‎পক্ষ থেকে কোন পদে কাজ করবেন, সে বিষয়ে প্রস্তাব দিয়েছেন। ‎

ইবনে জারির তাবারী এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন,‎

‏﴿إن الحكم إلا لله أمر ألا تعبدوا إلا إياه﴾ ، يقول: وهو الذي أمر ألا تعبدوا أنتم وجميعُ خلقه، إلا ‏‏الله الذي له الألوهة والعبادة خالصةً دون كل ما سواه

এ আয়াতের অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ সমগ্র সৃষ্টিকে উলুহিয়াত ও ইবাদতের দিক দিয়ে খালিসভাবে ‎‎একমাত্র তাঁরই ইবাদত করতে আদেশ করছেন। ‎

৩.

وَقَالَ يَا بَنِيَّ لَا تَدْخُلُوا مِن بَابٍ وَاحِدٍ وَادْخُلُوا مِنْ أَبْوَابٍ مُّتَفَرِّقَةٍ ۖ وَمَا أُغْنِي عَنكُم مِّنَ ‏اللَّهِ مِن ‏‏شَيْءٍ ۖ إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ ۖ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ ۖ وَعَلَيْهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُتَوَكِّلُونَ

‎‍তারপর সে [নবী ইয়াকুব (আ)] বললো, হে আমার সন্তানরা! মিসরের রাজধানীতে এক ‎‎দরজা দিয়ে প্রবেশ করো না, বরং বিভিন্ন দরজা দিয়ে প্রবেশ করো। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা ‎‎থেকে আমি তোমাদের বাঁচাতে পারি না। তাঁর ছাড়া আর কারোর হুকুম চলে না, তাঁর ওপরই ‎‎আমি ভরসা করি এবং ভরসাকারীরা তাঁর ওপরই ভরসা করে। [তাফহীমুল কুরআন, ১২ ‎‎ইউসুফ: ৬৭]‎

এখানেও রাজনীতি নেই, বরং তাওহীদের ব্যাখ্যা রয়েছে। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বিংশ ‎‎শতকের প্রসিদ্ধ তিউনিসিয়ান ইসলামী চিন্তাবিদ তাহির ‎ইবনে আশুর বলেন: ‎

‏﴿إنِ الحُكْمُ إلّا لِلَّهِ﴾ ، والحُكْمُ: هُنا بِمَعْنى التَّصَرُّفِ والتَّقْدِيرِ،ِ أنَّهُ لا يَتِمُّ إلّا ما أرادَهُ ‏‎ ‎اللَّهُ، ‏كَما قالَ ‏‏تَعالى ﴿إنَّ اللَّهَ بالِغُ أمْرِهِ﴾ ‏

‎হুকুম বলতে এখানে বুঝানো হয়েছে, পরিবর্তন সাধন এবং তাকদীর আল্লাহর হাতে এবং ‎আল্লাহ ইচ্ছা না ‎‎করলে কোনো কিছু সম্পন্ন হবে না।

৪.

أَوَلَمْ يَرَوْا أَنَّا نَأْتِي الْأَرْضَ نَنقُصُهَا مِنْ أَطْرَافِهَا ۚ وَاللَّهُ يَحْكُمُ لَا مُعَقِّبَ لِحُكْمِهِ ۚ وَهُوَ سَرِيعُ ‏‏‏الْحِسَابِ

‎‍এরা কি দেখে না আমি এ ভূখণ্ডের ওপর এগিয়ে চলছি এবং এর গণ্ডি চতুর্দিক থেকে ‎‎সংকুচিত করে আনছি? আল্লাহ রাজত্ব করছেন, তাঁর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার কেউ নেই ‎‎এবং তাঁর হিসেব নিতে একটুও দেরি হয় না।” [তাফহীমুল কুরআন, ১৩ রাদ: ৪১]‎‎

৫.

قُلِ اللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا لَبِثُوا ۖ لَهُ غَيْبُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۖ أَبْصِرْ بِهِ وَأَسْمِعْ ۚ مَا لَهُم مِّن دُونِهِ مِن ‏‏وَلِيٍّ وَلَا ‏يُشْرِكُ فِي حُكْمِهِ أَحَدًا

‍“তুমি বলো, আল্লাহ তাদের (আসহাবে কাহাফ) অবস্থানের মেয়াদ সম্পর্কে বেশি জানেন। ‎‎আকাশ ও পৃথিবীর যাবতীয় প্রচ্ছন্ন অবস্থা তিনিই জানেন, তিনি কেমন চমৎকার দ্রষ্টা ও ‎‎শ্রোতা! পৃথিবী ও আকাশের সকল সৃষ্টির তত্ত্বাবধানকারী তিনি ছাড়া আর কেউ নেই এবং ‎‎নিজের শাসন কর্তৃত্বে তিনি কাউকে শরীক করেন না। [তাফহীমুল কুরআন, ১৮ ‎কাহাফ: ২৬]‎

এখানেও প্রাকৃতিক বিশ্বব্যবস্থা সম্পর্কে বলা হচ্ছে, জনপ্রশাসনের কথা বলা হচ্ছে না।

৬.

قُلِ اللَّهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِي الْمُلْكَ مَن تَشَاءُ وَتَنزِعُ الْمُلْكَ مِمَّن تَشَاءُ وَتُعِزُّ مَن تَشَاءُ وَتُذِلُّ ‏مَن تَشَاءُ ‏ۖ ‏بِيَدِكَ الْخَيْرُ ۖ إِنَّكَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ

“হে সাম্রাজ্য ও সার্বভৌমত্বের মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে চাও রাজ্যক্ষমতা দান করো। আর ‎‎যার কাছ থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা কেড়ে নাও। [৩ আলে ইমরান: ২৬]‎

এ আয়াত থেকে বুঝা যাচ্ছে, রাষ্ট্রক্ষমতা পাওয়া না পাওয়া আল্লাহর ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। ‎‎এখানে কাউকে ক্ষমতা দখলের রাজনীতি করে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে নির্দেশ ‎‎দেয়া হয়নি। ‎

৭.

أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ ۗ تَبَارَكَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ

“সাবধান! সৃষ্টি তার, কর্তৃত্বও তাঁর। আল্লাহ বরকতের অধিকারী, তিনি সমগ্র বিশ্ব জাহানের রব৷” [৭ আরাফ: ৫৪]‎

এ আয়াতের টিকায় তাফহীমুল কুরআনে বলা হয়েছে, ‍

“তিনি সৃষ্টি করার পর নিজের সৃষ্ট ‎‎বস্তুসমূহকে অন্যের কর্তৃত্বে সোপর্দ করে দেননি অথবা সমগ্র সৃষ্টিকে বা তার অংশ বিশেষকে ‎‎ইচ্ছামতো চলার জন্যে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেননি৷ বরং কার্যত সমগ্র বিশ্বজগতের পরিচালনা ‎‎ব্যবস্থা আল্লাহর নিজের হাতেই কেন্দ্রীভূত রয়েছে৷ দিন-রাত্রির আবর্তন আপনা-আপনিই হচ্ছে ‎‎না৷ বরং আল্লাহর হুকুমে হচ্ছে৷ তিনি যখনই চাইবেন দিন ও রাতকে থামিয়ে দেবেন, আর ‎‎যখনই চাইবেন এ ব্যবস্থা বদলে দেবেন৷ সূর্য, চন্দ্র, তারকা— এরা কেউ নিজস্ব কোনো শক্তির ‎‎অধিকারী নয়৷ বরং এরা সবাই সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর কর্তৃত্বাধীন৷ এরা একান্ত অনুগত দাসের ‎‎মতো সেই কাজই করে যাচ্ছে যে কাজে আল্লাহ এদেরকে নিযুক্ত করেছেন৷”

৮.

يَقُولُونَ هَل لَّنَا مِنَ الْأَمْرِ مِن شَيْءٍ ۗ قُلْ إِنَّ الْأَمْرَ كُلَّهُ لِلَّهِ ۗ ِ

“ওরা জিজ্ঞেস করছে: কর্তৃত্বে আমাদেরও অংশ আছে কি? বলো: কর্তৃত্ব সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর ‎‎জন্যে নির্দিষ্ট। [৩ আলে ইমরান: ১৫৪]‎

ওহুদ যুদ্ধের ব্যাপারে বলতে গিয়ে আল্লাহ এখানে বলছেন, যা কিছু হয়েছে আল্লাহর হুকুমে ‎‎হয়েছে।

উপরে উল্লেখিত আয়াতগুলোর কোনো একটি আয়াত সম্পর্কেও এটা বলা যায় না যে ‎সেখানে ‎‎রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেয়া ‎হয়েছে। সকল স্থানে ‎‎একটি সত্যই ঘোষণা করা হয়েছে যে আকাশ ও পৃথিবীর ‎সর্বত্র আল্লাহর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত। ‎‎সবকিছু তাঁর নির্দেশ, মর্জি এবং ইচ্ছা অনুযায়ী ‎পরিচালিত হয়। সেখানে আর কারো ‎‎শরিকানা নেই। আল্লাহকে ইলাহ হিসেবে ‎গ্রহণ করে নেয়ার অনিবার্য দাবি হচ্ছে এ কথা ‎‎মেনে নেয়া যে তিনি সার্বভৌম ‎ক্ষমতার অধিকারী এবং তার সার্বভৌমত্ব বিশ্বজাহানের সর্বত্র ‎‎প্রতিষ্ঠিত আছে। এটা ‎ঈমানের আবশ্যিক অনুষঙ্গ।

ইসলামের ইতিহাসে ‘ইনিল হুকমু ইল্লা লিল্লাহ’র অর্থাৎ হিসেবে ‘সার্বভৌমত্বের মালিক আল্লাহ ‎ছাড়া কেউ ‎‎নেই’ কথাটা রাজনৈতিকভাবে সর্বপ্রথম খারেজি সম্প্রদায় ব্যবহার করে। খারেজি সম্প্রদায়ই ‎‎ইসলামের ইতিহাসে প্রথম চরমপন্থী রাজনৈতিক দল। ‎সে সময় খারেজিদের শ্লোগান ছিল ‎‎‎‘ইনিল হুকমু ইল্লা লিল্লাহ’ এবং ‘লা হুকমা ইল্লা ‎হুকমুল কুরআন।’‎‏ ‏অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কারো ‎‎হুকুম দেয়ার ক্ষমতা নেই এবং কুরআনের হুকুম ছাড়া আর কারো হুকুম চলবে না।

হযরত আলী (রা) এবং হযরত মুয়াবিয়ার (রা) মধ্যে বিরোধ নিস্পত্তির ভার দুজন ‎‎‎মীমাংসাকারীর উপর অর্পিত হয়। হযরত আলীর (র) মনোনীত ব্যক্তি ছিলেন আবু ‎মুসা ‎‎আশয়ারি (রা) এবং হযরত মুয়াবিয়ার (রা) মনোনীত ব্যক্তি ছিলেন আমর ইবনুল ‎আস (রা)। ‎‎হযরত আলী (রা) তাঁদের সালিশ হিসেবে মেনে নেন। কিন্তু খারেজিরা অভিযোগ করে, ‎‎আল্লাহকে বাদ দিয়ে ‎মানুষকে সালিশ মেনে হযরত আলী (রা) আল্লাহর কর্তৃত্বকে অস্বীকার ‎‎‎করেছেন। এটি যারা করে তারা ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে গেছে। হযরত মুয়াবিয়ার (রা) ‎‎উপরও তাদের এ অভিযোগ ছিল। কথিত এ ‎অপরাধে খারেজিরা হযরত আলী (রা) এবং ‎‎হযরত মুয়াবিয়া (রা) — দুজনকেই ‎হত্যার চেষ্টা করে। হযরত মুয়াবিয়া (রা) তাদের ‎‎আক্রমণ থেকে রক্ষা পেলেও ‎হযরত আলী (রা) তাদের হাতে শাহাদাত বরণ করেন। তাদের ‎‎হাতে আরো অনেক সাহাবী নিহত হয়েছেন।

ঐতিহাসিকদের বক্তব্য থেকে জানা যায়, খারেজিদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে হযরত আলী ‎‎(রা) ‎তাদের ‎কয়েকজনকে ডেকে আনেন। তিনি কুরআন শরীফে হাত রেখে বলেন, ‎‎‘হে ‎কুরআন, তুমি ‎আল্লাহর বিধান লোকদের বুঝিয়ে দাও।’ মানুষ ‎অবাক হয়ে বলে, ‘এ আপনি ‎কী করছেন? ‎কুরআন কথা বলতে পারবে না। ‎কুরআন তো মানুষ নয়।’ তখন হযরত আলী ‎‎(রা) বলেন, ‎আমি এটাই বলছি। কালি দিয়ে লেখা কয়েকটি পৃষ্ঠা হচ্ছে কুরআন। কুরআনের ‎কথা বলার ‎ক্ষমতা নেই। মানুষকেই কুরআনের হয়ে কথা বলতে হবে। সীমিত বিচার-‎বুদ্ধি ‎প্রয়োগ করে ‎মানুষকেই কুরআনের ব্যাখ্যা দিতে হবে।’‎

হজরত আলী (রা) হুদাইবিয়া সন্ধির উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‎হুদাইবিয়া সন্ধির অনেক আগেই ‎‎‎‌‘ইনিল হুকমু ইল্লা লিল্লাহ’ আয়াতটি নাজিল হয়। ‎হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় রাসূল ‎‎(সা) কুরাইশদের ‎‎অনেক দাবি মেনে নিয়েছিলেন। আল্লাহ ‎তায়ালা এ হুদাইবিয়ার ‎সন্ধিকে ‘ফাতহুম মুবিন’ বা ‎‎সুস্পষ্ট বিজয় বলেছেন। ‎আল্লাহ তায়ালা নিজেই মানুষের ফায়সালা সমর্থন করে কুরআনের ‎‎আয়াত নাজিল করেছেন।

ইমাম রাজির মতে, ‍

“আইন দুই প্রকার: দুনিয়াবী আইন ও পরকালীন আইন। ‎দুনিয়ার আইন ‎‎প্রণয়নের সুযোগ আল্লাহ তায়ালা মানুষকেও দিয়েছেন। কিন্তু ‎পরকালীন আইন প্রণয়নের ‎‎সুযোগ কেবল আল্লাহ তায়ালার জন্যে নির্দিষ্ট। ‎আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াতে মানুষকে আইন ‎‎প্রণয়ন করার বা আদেশ করার সুযোগ না দিলে কোনো গোলামকে তার মালিক হুকুম ‎দিতে ‎পারতো না, কোনো স্ত্রীকে ‎তার স্বামী হুকুম দিতে পারতো না, কোনো সন্তানকে তার ‎বাবা-মা ‎হুকুম দিতো ‎পারতো না, কোনো সরকার জনগণকে হুকুম দিতে পারতো না, এবং ‎কোনো ‎‎নবী-রাসূল তাঁদের উম্মতকে হুকুম দিতে পারতেন না।”[1]

বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, ‘আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও ‎মানুষের ‎‎সার্বভৌমত্বের মাঝে কোনো বিরোধ আছে?’ জবাবে নুরসী বলেন, ‎‎‘ক্ষমতা দুই প্রকার। ‎‎মুলক ও মালাকুত। মুলক মানে পার্থিব ক্ষমতা এবং মালাকুত ‎মানে অপার্থিব ক্ষমতা। পার্থিব ‎‎জগতে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে তাদের ক্ষমতা ‎প্রয়োগ করার স্বাধীনতা দিয়েছেন। কিন্তু ‎‎অপার্থিব বিষয়ে ক্ষমতা প্রয়োগ করার ‎মালিক একমাত্র আল্লাহ, মানুষ চাইলেও কোনো ‎‎অপার্থিব বিষয়ে তাদের ক্ষমতা ‎প্রয়োগ করতে পারবে না। যেমন, মানুষ চাইলেও সূর্যকে ‎‎পশ্চিম দিক থেকে উদিত ‎করতে পারবে না।’‎ ‎

অপরদিকে মাওলানা মওদুদী এবং সাইয়েদ ‎কুতুব আইন প্রণয়নে মানুষের ‎ক্ষমতাকে অস্বীকার করেন। সাইয়েদ কুতুবের ‎মতে আল্লাহ ছাড়া কাউকে আইন প্রণয়নের ‎ক্ষমতা প্রদান করা শিরক।

আমরা ইতোপূর্বে নিচের আয়াতটির বাংলা অর্থ তাফহীমুল কুরআন থেকে উদ্ধৃত করেছি। ‎এ ‎পর্যায়ে প্রদত্ত বাংলা তরজমা ‘ইসলামের রাজনৈতিক মতবাদ’ গ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে। ‎‎এখানে গ্রন্থকার অতিরিক্ত একটি বাক্যাংশ ‘আইন রচনার অধিকার নেই’ জুড়ে দিয়েছেন, ‎কুরআনের মূল আয়াতে এই বাক্যাংশটুকু নেই। লেখকের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত এই বাক্যাংশ যোগ ‎করে দিয়ে লেখক আয়াতের ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

‎إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ ۚ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ ۚ ذَٰلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ‎

আল্লাহ ছাড়া আর কারো নির্দেশ দানের ও আইন রচনার অধিকার নেই। তাঁরই আদেশ ‎‎এই যে, আল্লাহ ছাড়া কারো বন্দেগী বা দাসত্ব কবুল করো না, বস্তুত এটাই সঠিক ও নির্ভুল ‎‎জীবন ব্যবস্থা।” (১২ ইউসুফ: ৪০)‎[2]

উসূলে ফিকাহর নিয়ম অনুসারে, শরীয়তের একমাত্র আইনদাতা ও বিধানদাতা হলেন আল্লাহ এবং ‎তাঁর রাসূল ‎‎(সা)। কিন্তু এগুলো শরীয়তের বিধানের ব্যাপারে। রাসূল (সা) ওহীর মাধ্যমে তা ‎সম্পন্ন ‎করতেন। পার্থিব নিয়ম-নীতির ব্যাপারে মানুষের স্বাধীনতা শরীয়ত কর্তৃক স্বীকৃত। ‎মহানবী ‎‎(সা) নবী হওয়ার পরও সাহাবীগণের পরামর্শের আলোকে তাঁর অনেক সিদ্ধান্ত বা ‎নির্দেশনা ‎পরিবর্তন করেছেন। একটি চুক্তিবলে মদীনা রাষ্ট্রটি গঠিত হয় যাতে মুসলমান, ‎ইহুদী, খ্রিষ্টান ‎এবং পৌত্তলিকরা অংশীদার ছিল। মদীনা সনদে ইহুদীদের নিজেদের আইন ‎অনুযায়ী বিচার-ফায়সালার ‎অধিকার মহানবী (সা) প্রদান করেন। মহানবী (সা) নিজেও ‎কমপক্ষে একটি মামলায় ইহুদীদের আইন ‎অনুযায়ী রায় প্রদান করেন।

এ ব্যাপারে ড. সাফি বলেন,

‍“Sovereignty in the society [of Medina] would not ‎‎rest with the rulers or any particular group, but with the law founded ‎‎on the basis of justice and goodness, maintaining dignity of all.”[3]

অর্থাৎ ‍“মদীনার সমাজে শাসক বা কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর ওপর সার্বভৌমত্ব ন্যস্ত ছিল না। ‎‎বরং সকলের মর্যাদা রক্ষা করে ন্যায়বিচার ও কল্যাণের ওপর ভিত্তি করে রচিত আইনের ‎‎ওপর ন্যস্ত ছিল।”

খেজুর গাছে ফুল দেখা দিলে এক গাছের ফুল অন্য গাছের ফুলের সাথে লাগিয়ে মদীনার ‎‎কৃষকরা ফসলের পরাগায়ন করতেন। মহানবী (সা) এ ব্যাপারে একবার নেতিবাচক মনোভাব ‎‎দেখালে তারা সে বছর পরাগায়ন করেননি। ফলে সে বছর ফসল কম হয়। সাহাবীরা বিষয়টি ‎‎মহানবীকে (সা) অবহিত করলে তিনি বলেন, তোমরা এ ব্যাপারে বেশি অভিজ্ঞ। ‎

ইবনে মাজাহ হাদীসগ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, ‎

حَدَّثَنَا عَلِيُّ بْنُ مُحَمَّدٍ، حَدَّثَنَا عُبَيْدُ اللَّهِ بْنُ مُوسَى، عَنْ إِسْرَائِيلَ، عَنْ سِمَاكٍ، أَنَّهُ سَمِعَ مُوسَى بْنَ ‏‏طَلْحَةَ بْنِ عُبَيْدِ اللَّهِ، يُحَدِّثُ عَنْ أَبِيهِ، قَالَ مَرَرْتُ مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فِي نَخْلٍ فَرَأَى ‏‏قَوْمًا يُلَقِّحُونَ النَّخْلَ فَقَالَ ‏”‏ مَا يَصْنَعُ هَؤُلاَءِ ‏”‏ ‏.‏ قَالُوا يَأْخُذُونَ مِنَ الذَّكَرِ فَيَجْعَلُونَهُ فِي الأُنْثَى ‏.‏ قَالَ ‏‏‏”‏ مَا أَظُنُّ ذَاكَ يُغْنِي شَيْئًا ‏”‏ ‏.‏ فَبَلَغَهُمْ فَتَرَكُوهُ وَنَزَلُوا عَنْهَا فَبَلَغَ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ ‏”‏ ‏‏إِنَّمَا هُوَ ظَنٌّ إِنْ كَانَ يُغْنِي شَيْئًا فَاصْنَعُوهُ فَإِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ وَإِنَّ الظَّنَّ يُخْطِئُ وَيُصِيبُ وَلَكِنْ مَا ‏‏قُلْتُ لَكُمْ قَالَ اللَّهُ فَلَنْ أَكْذِبَ عَلَى اللَّهِ ‏”‏

অর্থাৎ, ‍“তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে একটি খেজুর বাগান অতিক্রম করছিলাম। তিনি ‎‎লোকদেরকে দেখলেন যে, তারা নর খেজুর গাছের কেশর মাদী খেজুর গাছের কেশরের ‎‎সাথে সংযোজন করছে। তিনি লোকদের জিজ্ঞাসা করলেন: ‌‘এরা কী করছে?’ তালহা (রা) ‎‎বলেন, তারা নর গাছের কেশর নিয়ে মাদী গাছের কেশরের সাথে সংযোজন করছে। তিনি ‎‎বলেন: ‌‘এটা কোনো উপকারে আসবে বলে মনে হয় না।’ লোকজন তাঁর মন্তব্য অবহিত হয়ে ‎‎উক্ত প্রক্রিয়া ত্যাগ করলো। ফলে খেজুরের উৎপাদন হ্রাস পেলো। নবী (সা) বিষয়টি অবহিত হয়ে বলেন: ‌‘এটা তো ছিল একটা ধারণা মাত্র। ঐ প্রক্রিয়ায় ‎‎কোনো উপকার হলে তোমরা তা করো। আমি (এ বিষয়ে) তোমাদের মতোই একজন মানুষ। ‎‎ধারণা কখনো ভুলও হয়, কখনো ঠিকও হয়। কিন্তু আমি তোমাদের ‘আল্লাহ ‎‎বলেছেন’ বলে যা বলি, সেক্ষেত্রে আমি কখনো আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করবো না।’”

বদরের যুদ্ধের সময় মহানবী (সা) প্রথমে একটি স্থানে তাবু স্থাপনের নির্দেশ দেন। এক ‎‎সাহাবী এসে জিজ্ঞেস করেন, তাবু খাটানোর স্থান নির্ধারণ কি ওহীর মাধ্যমে হচ্ছে, নাকি এটা ‎‎তাঁর ব্যক্তিগত অভিমত? জবাবে মহানবী (সা) বলেন, এটা তাঁর ব্যক্তিগত মতামত। ওই ‎‎সাহাবী তখন আরেকটি জায়গা দেখিয়ে বললেন, আমার মনে হয় ওখানে তাবু খাটালে ‎‎মুসলমানরা সুবিধাজনক স্থানে থাকবে। মহানবী (সা) সাহাবীর কথা মেনে ‎‎নির্দেশিত স্থানে তাবু খাটাতে নির্দেশ দেন।

ওহুদ যুদ্ধের সময় সাহাবীদের পরামর্শের ভিত্তিতে ‎‎মহানবী (সা) তাঁর ব্যক্তিগত অভিমতের বিরুদ্ধে মদীনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত ‎‎নেন।

উসূলে ফিকাহর নিয়ম হচ্ছে, ইবাদতের ক্ষেত্রে নতুন কিছু সংযোজন করা বিদাত। তবে ‎‎ফকীহগণ মাকাসিদে শরীয়াহ সামনে রেখে নতুনভাবে উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনা করে নতুন ‎‎বিষয়ে ইজতেহাদ করতে পারেন। ফলে পার্থিব বিষয়ে প্রয়োজন অনুসারে নতুন নিয়ম-কানুন ‎‎তৈরি করা বিদাত নয়। রাজনীতি একটা পার্থিব বা সেক্যুলার বিষয়। নাগরিকদের প্রয়োজন ‎‎ও সুবিধা অনুযায়ী রাষ্ট্র আইন তৈরি, সংশোধন বা বাতিল করতে পারে। শিরক-বিদাতের ‎‎সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। এখন যদি বলা হয়, মানুষ আইন তৈরি করতে পারবে না বা ‎আইন প্রণয়নের অধিকার মানুষের নেই, তাহলে সে অবস্থায় বর্তমান বিশ্বের কোনো রাষ্ট্র ‎চলতে পারবে না। কোনো রাষ্ট্র এ নীতি গ্রহণ করে নিলে সে দেশের শাসনব্যবস্থা অকার্যকর ‎হয়ে পড়বে। ইসলামে এ ধরণের কূপমণ্ডূকতার স্থান নেই। সাহাবীরা দেশ পরিচালনা করতে ‎গিয়ে অসংখ্য আইন তৈরি করেছেন। এমনকি দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা) দেশের ‎অবস্থা বিবেচনা করে শরীয়ত নির্দেশিত হুদুদ পর্যন্ত মুলতবী করেছেন। এ কারণে ১৪’শ ‎বছরের ইতিহাসে কোনো আলেম বা ফকীহ এটা বলেননি যে হযরত ওমর (রা) হারাম বা কুফরী ‎কাজ করেছেন। ‎

ইসলাম কেয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষের উপযোগী একটা ব্যবস্থা। ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবন ‎‎পরিচালনার জন্যে সেখানে কোনো সংকীর্ণতা বা সীমাবদ্ধতা নেই। ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যক্তি, ‎‎সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে রাষ্ট্রের পরিচালকগণ আইন প্রণয়নের ব্যাপারে ক্ষমতাবান। খুলাফায়ে ‎‎রাশেদিন থেকে নিয়ে যুগে যুগে শাসকরা তা করে এসেছেন, এ ব্যাপারে কেউ প্রশ্ন তুলেনি। ‎‎এ অর্থে তারা সার্বভৌম। ‎

বর্তমান সময়ে রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও দায়িত্ব অনেক সম্প্রসারিত। কিন্তু বিশ্বায়নের কারণে, সময়ের ‎চাহিদা অনুযায়ী, ‎স্বাভাবিকভাবে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব বা ক্ষমতা ও অধিকারের সীমানায়ও ‎ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত ‎হয়েছে। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি অনুযায়ী এ পরিবর্তন ‎অব্যাহত থাকবে। ‎

ইসলাম ও অন্যান্য মতাদর্শের তুলনামূলক আলোচনা সম্পর্কিত অন্যান্য নিবন্ধ

রেফারেন্স:

[1] ইমাম রাজি, মাফাতিহুল ‎‎গায়েব, ‎সূরা ২৮/কাসাস: ৭০।

[2] সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী, ইসলামের রাজনৈতিক মতবাদ, মুহাম্মদ আব্দুর ‎‎রহীম কর্তৃক অনূদিত।

[3] Dr. ‎‎Louay M. Safi, Overcoming the Religious-Secular Divide: Islam’s ‎‎Contribution to Civilization in Muslim Contributions to World ‎‎Civilization, International Institute of Islamic Thought, U.S.A., 2005, p ‎‎‎16.‎

এ ধরনের আরো লেখা