‘আল্লাহর সার্বভৌমত্ব’ কথাটার তাৎপর্য
ইসলামী রাজনীতির সাথে জড়িত লোকেরা কুরআনের কয়েকটি বাক্য খুব বেশি ব্যবহার করেন। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, এ সকল বাক্য তাদের রাজনৈতিক বক্তব্য ব্যাখ্যা করতে সহায়তা করে। এ বাক্যগুলোর মধ্যে কুরআনে ব্যবহৃত إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ বাক্যটি অন্যতম। সাধারণত এর অর্থ করা হয়, সার্বভৌমত্বের মালিক আল্লাহ। যে আরবী শব্দের অর্থ ‘সার্বভৌমত্ব’ করা হয় সে শব্দটি হচ্ছে ‘হুকুম’। কেউ কেউ মুলুকিয়াত অর্থেও এ শব্দ ব্যবহার করেন, সুলতানাত ও সিয়াদাত অর্থাৎ কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বের অন্তর্ভুক্ত সবকিছু এর মধ্যে শামিল রয়েছে।
আরবী ‘হুকুম’ একটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ। কুরআনে এ শব্দ ২১০ বার এসেছে। অধিকাংশ সময় বিচার-ফায়সালা বুঝাতে তা ব্যবহৃত হয়েছে। অন্যান্য যেসব অর্থে কুরআনে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে এর মধ্যে রয়েছে নির্ভুল করা, প্রতিষ্ঠা করা, প্রজ্ঞা, নির্দেশ, সিদ্ধান্ত, সুস্পষ্ট, দায়িত্বশীল ইত্যাদি। ‘হুকুম’ কথাটিকে যারা সার্বভৌমত্ব অর্থে ব্যবহার করেন তারা এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, নির্দেশ প্রদান ও শাসন করার ব্যাপারে চূড়ান্ত ক্ষমতার নাম সার্বভৌমত্ব।
যতটুকু জানি, ‘হুকুম’ শব্দটি সার্বভৌমত্ব অর্থে ইসলামী চিন্তাবিদদের মধ্যে সর্বপ্রথম ব্যবহার করেছেন মাওলানা মওদূদী এবং এরপর সাইয়েদ কুতুব। পরবর্তীতে ইসলামী রাজনীতির সাথে জড়িত প্রায় সবাই এ অর্থেই শব্দটি ব্যবহার করছেন। সলফে সালেহীনদের যুগে কেউ শব্দটি সার্বভৌমত্ব অর্থে ব্যবহার করেছেন বলে আমার নজরে পড়েনি। সবচেয়ে বড় কথা, আহলে সু্ন্নতের অনুসারী বলে পরিচিত কোনো গ্রুপ গত হাজার বছরেও এটাকে ইস্যু হিসেবে দাঁড় করায়নি।
প্রথম যুগের ফকীহদের মধ্যে বিতর্ক হয়েছে উলুল আমর নিয়ে। এটাও কর্তৃত্ব এবং আনুগত্য বিষয়ক। উলুল আমরের ব্যাপারে সাহাবাদের দুটো মত আছে। কারো মতে, উলুল আমর হচ্ছেন উলামায়ে কেরাম এবং কারো মতে, দেশের শাসক-প্রশাসক। ইমাম তাবারীসহ প্রাচীন মুফাসসিরদের মতে, উলুল আমর বা হুকুম দেয়ার অধিকারী বলতে শাসক, আলেম এবং সাহাবাদের বুঝানো হয়েছে। ইসলামী সংগঠনের দায়িত্বশীলকে উলুল আমর বলার প্রবণতা বিংশ শতকের আবিষ্কার। কুরআনে উলুল আমরের শর্তাধীন আনুগত্যের কথা বলা হয়েছে। নিঃশর্ত আনুগত্যের মালিক একমাত্র আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সা)। কিন্তু কোনো কোনো ইসলামী সংগঠনের দায়িত্বশীলগণ সকল জায়েজ কাজে নিঃশর্ত আনুগত্য ফরজ বলে দাবি করেন। কুরআনের এ আয়াত এবং কিছু হাদীসের বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যা দিয়ে তারা বহু বই-পুস্তকও লিখেছেন।
আল্লাহকে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক বলা হলে আভিধানিক অর্থের দিক দিয়ে অর্থের বিকৃতি বা দূরবর্তী অর্থ করা হয়েছে বলে দাবি করার সুযোগ নেই। ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী, আল্লাহ সার্বভৌম বা নিরঙ্কুশ ক্ষমতার মালিক, তাঁর ক্ষমতায় কোনো অংশীদার নেই এবং কারো তা চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা নেই। বিশ্বজাহানের প্রতিটি অণু-পরমাণুতে তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত। এটা প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন। তাঁর হুকুম বা ইচ্ছা ব্যতীত গাছের একটি পাতাও নড়াচড়া করতে পারে না। সত্যিকার বিচারে, এই অর্থে আল্লাহর সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস রাখা মুসলমানদের ঈমানের অঙ্গ। কুরআনের অসংখ্য আয়াত, হাদীসের অসংখ্য ব্যাখ্যা এবং কালিমা ঈমানে মুফাসসালে তা বিবৃত হয়েছে। সচেতনভাবে বুঝেশুনে কেউ তা অস্বীকার করলে তার ঈমান থাকবে না। এটা খালেস দ্বীনি বা থিওলজিক্যাল বিষয়। রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
ইংরেজি ভাষায় ব্যবহৃত sovereignty শব্দটির বাংলা তরজমা করা হয় সার্বভৌমত্ব। কথ্য ল্যাটিন শব্দ superanus থেকে উদ্ভূত শব্দটি ইংরেজি ভাষায় এসে sovereignty হয়ে গেছে। মূলত এর শাব্দিক অর্থ প্রধানব্যক্তি বা শাসক হলেও শত বছরের পথ পরিক্রমায় রাজনীতি বিজ্ঞানের ভাষায় নতুন অর্থ ধারণ করেছে। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা বুঝাতে তা ব্যবহার করা হয়। এ শব্দটি ইউরোপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শাসক, চার্চ ও জনগণের মধ্যে বহু লড়াই ও রক্তপাতের মধ্য দিয়ে। সময়ের বিবর্তনে সার্বভৌমত্ব বা নিরঙ্কুশ ক্ষমতার সীমানা, আওতা এবং বহির্ভূত বিষয়ের সংজ্ঞায় পরিবর্তন এসেছে। সময়ে হয়তো আরো প্রসারিত বা সঙ্কুচিত হবে। গ্লোবাল পৃথিবীতে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের কারণেও এতে অনেক পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে।
বৃটিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন অস্টিন (৩ মার্চ ১৭৯০ – ১ ডিসেম্বর ১৮৫৯) প্রদত্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী, সার্বভৌম-শক্তি সীমাহীন ক্ষমতা সংরক্ষণ করে, যা অবিভাজ্য ও চূড়ান্ত। ফলে এটি আধুনিক বিশ্বের উপযোগী নয়। বর্তমান বিশ্বে এক রাষ্ট্রের কার্যক্রম অন্যান্য রাষ্ট্রের কার্যক্রম ও অধিকার দ্বারা বাহ্যিকভাবে সীমাবদ্ধ এবং অভ্যন্তরীণ দিক থেকে রাষ্ট্র ও সরকারের বিভিন্ন বিভাগের (আইন, শাসন ও বিচার বিভাগ) মধ্যে রাষ্ট্রের ক্ষমতা বিভক্ত। সে বিবেচনায় বাস্তব ক্ষেত্রে বর্তমানে পৃথিবীর কোনো দেশ বা সংস্থা সীমাহীন সার্বভৌমত্বের অধিকারী নয়। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সার্বভৌম ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বর্তমানে সম্পূর্ণ বিভক্ত। স্বাভাবিক কারণেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে এ নিয়ে অসংখ্য বিতর্ক বিদ্যমান।
অনেকে বলেন, দেশের জনগণ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। এটা একটি হাস্যকর দাবি। পৃথিবীর কোনো দেশের জনগণ সার্বভৌম ক্ষমতা ভোগ করে না। শাসকগোষ্ঠী, বুদ্ধিজীবী, সেনাবাহিনী, ধনিকশ্রেণী এবং মিডিয়া যেভাবে দেশকে চালাতে চায় সেভাবেই দেশ চলে। জনগণ সার্বভৌমত্বের মালিক বলে তাদের আসলে ধোকা দেয়া হয়। গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে জনগণ ভোট দিয়ে দেশ শাসনের দায়িত্ব একটা দলকে প্রদান করে। কিন্তু সার্বজনীন ভোটাধিকার প্রয়োগের সময়ও তা শাসকশ্রেণী এবং মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণে থাকতে দেখা যায়।
সার্বভৌমত্বের সংজ্ঞা বা সীমানা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও রাজনৈতিক আলোচনায় রাষ্ট্র ও পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব একটা আবশ্যিক বিষয়। একটা দেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পরিচয়ের একটি শর্ত হলো রাষ্ট্রকে সার্বভৌম হতে হবে। পার্লামেন্ট পদ্ধতির সরকারে পার্লামেন্টকে সার্বভৌম বলা হয়। বাইরের কোনো শক্তির প্রভাবমুক্ত থেকে দেশের পার্লামেন্ট যে কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারে। দেশের সকল রাজনৈতিক দল এটা মেনে নিয়েই নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে। বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের ইসলামপন্থীরাও এর ব্যতিক্রম নয়।
আমাদের মতে, কুরআনে হুকুম বা সার্বভৌমত্বের যে ধারণা দেয়া হয়েছে সেটা প্রতিষ্ঠা করার বিষয় নয়, বরং বিশ্বাসের বিষয়। এর প্রতি বিশ্বাস আনার জন্যে নবী-রাসূলগণ মানুষকে আহবান জানিয়েছেন। সে আহবানে কেউ সাড়া না দিলে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব চলে যায় না। মুসলমানরা যে আল্লাহর উপর বিশ্বাস করেন তাঁর সার্বভৌমত্ব সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত আছে। এটাকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নেই। সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে শুধু নয়, কোনো ব্যাপারেই আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন। মানুষকে আল্লাহ বিশ্বাস ও কর্মের স্বাধীনতা দিয়েছেন এবং এর আলোকে শাস্তি ও পুরস্কারের বিধান রেখেছেন। আল্লাহ প্রদত্ত সে স্বাধীনতা আছে বলেই কোনো কোনো মানুষ আল্লাহ এবং আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করতে পারে। আল্লাহ সে ক্ষমতা না দিলে তারা তা করতে পারতো না। কিন্তু অস্বীকারের কারণে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন বা বিনষ্ট হয় না।
আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতার কথা কুরআনের বেশ কিছু আয়াতে বলা হয়েছে। সবচেয়ে আলোচিত আয়াত হচ্ছে, ‘ইনিল হুকমু ইল্লা লিল্লাহ’। এ সকল আয়াতের পূর্বাপর কথাগুলো বিবেচনায় নিলে আমরা এর তাৎপর্য সহজেই বুঝে নিতে পারবো।
১.
قُلْ إِنِّي عَلَىٰ بَيِّنَةٍ مِّن رَّبِّي وَكَذَّبْتُم بِهِ ۚ مَا عِندِي مَا تَسْتَعْجِلُونَ بِهِ ۚ إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ ۖ يَقُصُّ الْحَقَّ ۖ وَهُوَ خَيْرُ الْفَاصِلِينَ
“বলো, আমার রবের পক্ষ থেকে আমি একটি উজ্জ্বল প্রমাণের ওপর প্রতিষ্ঠিত আছি এবং তোমরা তাকে মিথ্যা বলেছো। এখন তোমরা যে জিনিসটি তাড়াতাড়ি চাচ্ছো সেটি আমার ক্ষমতার আওতাধীন নয়। ফায়সালার সমস্ত ক্ষমতা আল্লাহর হাতে। তিনিই সত্য বিবৃত করেন এবং তিনিই সবচেয়ে ভালো ফায়সালাকারী।” [৬ আনআম: ৫৭]
অবিশ্বাসীদের পক্ষ থেকে নবীর কাছে অলৌকিক ক্ষমতা দেখানোর দাবির প্রেক্ষিতে আল্লাহ এখানে নবীর ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কথা জানিয়ে দিয়েছেন। ইমাম রাজী এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন,
﴿إنِ الحُكْمُ إلّا لِلَّهِ﴾ عَلى أنَّهُ لا يَقْدِرُ العَبْدُ عَلى أمْرٍ مِنَ الأُمُورِ إلّا إذا قَضى اللَّهُ بِهِ،
‘ইনিল হুকমু ইল্লা লিল্লাহ’ কথাটার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর ফায়সালা ব্যতীত কোনো ব্যাপারে বান্দার কোনো কিছু করার ক্ষমতা নেই।
২.
إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ ۚ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ ۚ ذَٰلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ
“আল্লাহ ছাড়া সার্বভৌম ক্ষমতা আর কারো নেই। তাঁর হুকুম— তোমরা তাঁর ছাড়া আর কারোর বন্দেগী করবে না। এটিই সরল সঠিক জীবন পদ্ধতি, কিন্তু অধিকাংশ লোক জানে না।” [তাফহীমুল কুরআন, ১২ ইউসুফ: ৩৯-৪০]
এখানে ইউসুফ (আ) কয়েদখানার সঙ্গীদের তাওহীদের দাওয়াত দিতে গিয়ে এ কথা বলেছেন। এখানে রাজনৈতিক কর্তৃত্বের কথা নেই। তা ছাড়া ইউসুফ (আ) নবী হওয়া সত্ত্বেও একজন অমুসলিম সার্বভৌম রাজার অধীনে কাজ করতে সম্মত হয়েছেন এবং নিজের পক্ষ থেকে কোন পদে কাজ করবেন, সে বিষয়ে প্রস্তাব দিয়েছেন।
ইবনে জারির তাবারী এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন,
﴿إن الحكم إلا لله أمر ألا تعبدوا إلا إياه﴾ ، يقول: وهو الذي أمر ألا تعبدوا أنتم وجميعُ خلقه، إلا الله الذي له الألوهة والعبادة خالصةً دون كل ما سواه
এ আয়াতের অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ সমগ্র সৃষ্টিকে উলুহিয়াত ও ইবাদতের দিক দিয়ে খালিসভাবে একমাত্র তাঁরই ইবাদত করতে আদেশ করছেন।
৩.
وَقَالَ يَا بَنِيَّ لَا تَدْخُلُوا مِن بَابٍ وَاحِدٍ وَادْخُلُوا مِنْ أَبْوَابٍ مُّتَفَرِّقَةٍ ۖ وَمَا أُغْنِي عَنكُم مِّنَ اللَّهِ مِن شَيْءٍ ۖ إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ ۖ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ ۖ وَعَلَيْهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُتَوَكِّلُونَ
“তারপর সে [নবী ইয়াকুব (আ)] বললো, হে আমার সন্তানরা! মিসরের রাজধানীতে এক দরজা দিয়ে প্রবেশ করো না, বরং বিভিন্ন দরজা দিয়ে প্রবেশ করো। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা থেকে আমি তোমাদের বাঁচাতে পারি না। তাঁর ছাড়া আর কারোর হুকুম চলে না, তাঁর ওপরই আমি ভরসা করি এবং ভরসাকারীরা তাঁর ওপরই ভরসা করে।” [তাফহীমুল কুরআন, ১২ ইউসুফ: ৬৭]
এখানেও রাজনীতি নেই, বরং তাওহীদের ব্যাখ্যা রয়েছে। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বিংশ শতকের প্রসিদ্ধ তিউনিসিয়ান ইসলামী চিন্তাবিদ তাহির ইবনে আশুর বলেন:
﴿إنِ الحُكْمُ إلّا لِلَّهِ﴾ ، والحُكْمُ: هُنا بِمَعْنى التَّصَرُّفِ والتَّقْدِيرِ،ِ أنَّهُ لا يَتِمُّ إلّا ما أرادَهُ اللَّهُ، كَما قالَ تَعالى ﴿إنَّ اللَّهَ بالِغُ أمْرِهِ﴾
হুকুম বলতে এখানে বুঝানো হয়েছে, পরিবর্তন সাধন এবং তাকদীর আল্লাহর হাতে এবং আল্লাহ ইচ্ছা না করলে কোনো কিছু সম্পন্ন হবে না।
৪.
أَوَلَمْ يَرَوْا أَنَّا نَأْتِي الْأَرْضَ نَنقُصُهَا مِنْ أَطْرَافِهَا ۚ وَاللَّهُ يَحْكُمُ لَا مُعَقِّبَ لِحُكْمِهِ ۚ وَهُوَ سَرِيعُ الْحِسَابِ
“এরা কি দেখে না আমি এ ভূখণ্ডের ওপর এগিয়ে চলছি এবং এর গণ্ডি চতুর্দিক থেকে সংকুচিত করে আনছি? আল্লাহ রাজত্ব করছেন, তাঁর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার কেউ নেই এবং তাঁর হিসেব নিতে একটুও দেরি হয় না।” [তাফহীমুল কুরআন, ১৩ রাদ: ৪১]
৫.
قُلِ اللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا لَبِثُوا ۖ لَهُ غَيْبُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۖ أَبْصِرْ بِهِ وَأَسْمِعْ ۚ مَا لَهُم مِّن دُونِهِ مِن وَلِيٍّ وَلَا يُشْرِكُ فِي حُكْمِهِ أَحَدًا
“তুমি বলো, আল্লাহ তাদের (আসহাবে কাহাফ) অবস্থানের মেয়াদ সম্পর্কে বেশি জানেন। আকাশ ও পৃথিবীর যাবতীয় প্রচ্ছন্ন অবস্থা তিনিই জানেন, তিনি কেমন চমৎকার দ্রষ্টা ও শ্রোতা! পৃথিবী ও আকাশের সকল সৃষ্টির তত্ত্বাবধানকারী তিনি ছাড়া আর কেউ নেই এবং নিজের শাসন কর্তৃত্বে তিনি কাউকে শরীক করেন না।” [তাফহীমুল কুরআন, ১৮ কাহাফ: ২৬]
এখানেও প্রাকৃতিক বিশ্বব্যবস্থা সম্পর্কে বলা হচ্ছে, জনপ্রশাসনের কথা বলা হচ্ছে না।
৬.
قُلِ اللَّهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِي الْمُلْكَ مَن تَشَاءُ وَتَنزِعُ الْمُلْكَ مِمَّن تَشَاءُ وَتُعِزُّ مَن تَشَاءُ وَتُذِلُّ مَن تَشَاءُ ۖ بِيَدِكَ الْخَيْرُ ۖ إِنَّكَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
“হে সাম্রাজ্য ও সার্বভৌমত্বের মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে চাও রাজ্যক্ষমতা দান করো। আর যার কাছ থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা কেড়ে নাও।” [৩ আলে ইমরান: ২৬]
এ আয়াত থেকে বুঝা যাচ্ছে, রাষ্ট্রক্ষমতা পাওয়া না পাওয়া আল্লাহর ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। এখানে কাউকে ক্ষমতা দখলের রাজনীতি করে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে নির্দেশ দেয়া হয়নি।
৭.
أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ ۗ تَبَارَكَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ
“সাবধান! সৃষ্টি তার, কর্তৃত্বও তাঁর। আল্লাহ বরকতের অধিকারী, তিনি সমগ্র বিশ্ব জাহানের রব৷” [৭ আরাফ: ৫৪]
এ আয়াতের টিকায় তাফহীমুল কুরআনে বলা হয়েছে,
“তিনি সৃষ্টি করার পর নিজের সৃষ্ট বস্তুসমূহকে অন্যের কর্তৃত্বে সোপর্দ করে দেননি অথবা সমগ্র সৃষ্টিকে বা তার অংশ বিশেষকে ইচ্ছামতো চলার জন্যে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেননি৷ বরং কার্যত সমগ্র বিশ্বজগতের পরিচালনা ব্যবস্থা আল্লাহর নিজের হাতেই কেন্দ্রীভূত রয়েছে৷ দিন-রাত্রির আবর্তন আপনা-আপনিই হচ্ছে না৷ বরং আল্লাহর হুকুমে হচ্ছে৷ তিনি যখনই চাইবেন দিন ও রাতকে থামিয়ে দেবেন, আর যখনই চাইবেন এ ব্যবস্থা বদলে দেবেন৷ সূর্য, চন্দ্র, তারকা— এরা কেউ নিজস্ব কোনো শক্তির অধিকারী নয়৷ বরং এরা সবাই সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর কর্তৃত্বাধীন৷ এরা একান্ত অনুগত দাসের মতো সেই কাজই করে যাচ্ছে যে কাজে আল্লাহ এদেরকে নিযুক্ত করেছেন৷”
৮.
يَقُولُونَ هَل لَّنَا مِنَ الْأَمْرِ مِن شَيْءٍ ۗ قُلْ إِنَّ الْأَمْرَ كُلَّهُ لِلَّهِ ۗ ِ
“ওরা জিজ্ঞেস করছে: কর্তৃত্বে আমাদেরও অংশ আছে কি? বলো: কর্তৃত্ব সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর জন্যে নির্দিষ্ট।” [৩ আলে ইমরান: ১৫৪]
ওহুদ যুদ্ধের ব্যাপারে বলতে গিয়ে আল্লাহ এখানে বলছেন, যা কিছু হয়েছে আল্লাহর হুকুমে হয়েছে।
উপরে উল্লেখিত আয়াতগুলোর কোনো একটি আয়াত সম্পর্কেও এটা বলা যায় না যে সেখানে রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সকল স্থানে একটি সত্যই ঘোষণা করা হয়েছে যে আকাশ ও পৃথিবীর সর্বত্র আল্লাহর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত। সবকিছু তাঁর নির্দেশ, মর্জি এবং ইচ্ছা অনুযায়ী পরিচালিত হয়। সেখানে আর কারো শরিকানা নেই। আল্লাহকে ইলাহ হিসেবে গ্রহণ করে নেয়ার অনিবার্য দাবি হচ্ছে এ কথা মেনে নেয়া যে তিনি সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী এবং তার সার্বভৌমত্ব বিশ্বজাহানের সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত আছে। এটা ঈমানের আবশ্যিক অনুষঙ্গ।
ইসলামের ইতিহাসে ‘ইনিল হুকমু ইল্লা লিল্লাহ’র অর্থাৎ হিসেবে ‘সার্বভৌমত্বের মালিক আল্লাহ ছাড়া কেউ নেই’ কথাটা রাজনৈতিকভাবে সর্বপ্রথম খারেজি সম্প্রদায় ব্যবহার করে। খারেজি সম্প্রদায়ই ইসলামের ইতিহাসে প্রথম চরমপন্থী রাজনৈতিক দল। সে সময় খারেজিদের শ্লোগান ছিল ‘ইনিল হুকমু ইল্লা লিল্লাহ’ এবং ‘লা হুকমা ইল্লা হুকমুল কুরআন।’ অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কারো হুকুম দেয়ার ক্ষমতা নেই এবং কুরআনের হুকুম ছাড়া আর কারো হুকুম চলবে না।
হযরত আলী (রা) এবং হযরত মুয়াবিয়ার (রা) মধ্যে বিরোধ নিস্পত্তির ভার দুজন মীমাংসাকারীর উপর অর্পিত হয়। হযরত আলীর (র) মনোনীত ব্যক্তি ছিলেন আবু মুসা আশয়ারি (রা) এবং হযরত মুয়াবিয়ার (রা) মনোনীত ব্যক্তি ছিলেন আমর ইবনুল আস (রা)। হযরত আলী (রা) তাঁদের সালিশ হিসেবে মেনে নেন। কিন্তু খারেজিরা অভিযোগ করে, আল্লাহকে বাদ দিয়ে মানুষকে সালিশ মেনে হযরত আলী (রা) আল্লাহর কর্তৃত্বকে অস্বীকার করেছেন। এটি যারা করে তারা ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে গেছে। হযরত মুয়াবিয়ার (রা) উপরও তাদের এ অভিযোগ ছিল। কথিত এ অপরাধে খারেজিরা হযরত আলী (রা) এবং হযরত মুয়াবিয়া (রা) — দুজনকেই হত্যার চেষ্টা করে। হযরত মুয়াবিয়া (রা) তাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেলেও হযরত আলী (রা) তাদের হাতে শাহাদাত বরণ করেন। তাদের হাতে আরো অনেক সাহাবী নিহত হয়েছেন।
ঐতিহাসিকদের বক্তব্য থেকে জানা যায়, খারেজিদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে হযরত আলী (রা) তাদের কয়েকজনকে ডেকে আনেন। তিনি কুরআন শরীফে হাত রেখে বলেন, ‘হে কুরআন, তুমি আল্লাহর বিধান লোকদের বুঝিয়ে দাও।’ মানুষ অবাক হয়ে বলে, ‘এ আপনি কী করছেন? কুরআন কথা বলতে পারবে না। কুরআন তো মানুষ নয়।’ তখন হযরত আলী (রা) বলেন, আমি এটাই বলছি। কালি দিয়ে লেখা কয়েকটি পৃষ্ঠা হচ্ছে কুরআন। কুরআনের কথা বলার ক্ষমতা নেই। মানুষকেই কুরআনের হয়ে কথা বলতে হবে। সীমিত বিচার-বুদ্ধি প্রয়োগ করে মানুষকেই কুরআনের ব্যাখ্যা দিতে হবে।’
হজরত আলী (রা) হুদাইবিয়া সন্ধির উদাহরণ দিয়ে বলেন, হুদাইবিয়া সন্ধির অনেক আগেই ‘ইনিল হুকমু ইল্লা লিল্লাহ’ আয়াতটি নাজিল হয়। হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় রাসূল (সা) কুরাইশদের অনেক দাবি মেনে নিয়েছিলেন। আল্লাহ তায়ালা এ হুদাইবিয়ার সন্ধিকে ‘ফাতহুম মুবিন’ বা সুস্পষ্ট বিজয় বলেছেন। আল্লাহ তায়ালা নিজেই মানুষের ফায়সালা সমর্থন করে কুরআনের আয়াত নাজিল করেছেন।
ইমাম রাজির মতে,
“আইন দুই প্রকার: দুনিয়াবী আইন ও পরকালীন আইন। দুনিয়ার আইন প্রণয়নের সুযোগ আল্লাহ তায়ালা মানুষকেও দিয়েছেন। কিন্তু পরকালীন আইন প্রণয়নের সুযোগ কেবল আল্লাহ তায়ালার জন্যে নির্দিষ্ট। আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াতে মানুষকে আইন প্রণয়ন করার বা আদেশ করার সুযোগ না দিলে কোনো গোলামকে তার মালিক হুকুম দিতে পারতো না, কোনো স্ত্রীকে তার স্বামী হুকুম দিতে পারতো না, কোনো সন্তানকে তার বাবা-মা হুকুম দিতো পারতো না, কোনো সরকার জনগণকে হুকুম দিতে পারতো না, এবং কোনো নবী-রাসূল তাঁদের উম্মতকে হুকুম দিতে পারতেন না।”[1]
বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, ‘আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও মানুষের সার্বভৌমত্বের মাঝে কোনো বিরোধ আছে?’ জবাবে নুরসী বলেন, ‘ক্ষমতা দুই প্রকার। মুলক ও মালাকুত। মুলক মানে পার্থিব ক্ষমতা এবং মালাকুত মানে অপার্থিব ক্ষমতা। পার্থিব জগতে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করার স্বাধীনতা দিয়েছেন। কিন্তু অপার্থিব বিষয়ে ক্ষমতা প্রয়োগ করার মালিক একমাত্র আল্লাহ, মানুষ চাইলেও কোনো অপার্থিব বিষয়ে তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে না। যেমন, মানুষ চাইলেও সূর্যকে পশ্চিম দিক থেকে উদিত করতে পারবে না।’
অপরদিকে মাওলানা মওদুদী এবং সাইয়েদ কুতুব আইন প্রণয়নে মানুষের ক্ষমতাকে অস্বীকার করেন। সাইয়েদ কুতুবের মতে আল্লাহ ছাড়া কাউকে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদান করা শিরক।
আমরা ইতোপূর্বে নিচের আয়াতটির বাংলা অর্থ তাফহীমুল কুরআন থেকে উদ্ধৃত করেছি। এ পর্যায়ে প্রদত্ত বাংলা তরজমা ‘ইসলামের রাজনৈতিক মতবাদ’ গ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে। এখানে গ্রন্থকার অতিরিক্ত একটি বাক্যাংশ ‘আইন রচনার অধিকার নেই’ জুড়ে দিয়েছেন, কুরআনের মূল আয়াতে এই বাক্যাংশটুকু নেই। লেখকের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত এই বাক্যাংশ যোগ করে দিয়ে লেখক আয়াতের ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ ۚ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ ۚ ذَٰلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ
“আল্লাহ ছাড়া আর কারো নির্দেশ দানের ও আইন রচনার অধিকার নেই। তাঁরই আদেশ এই যে, আল্লাহ ছাড়া কারো বন্দেগী বা দাসত্ব কবুল করো না, বস্তুত এটাই সঠিক ও নির্ভুল জীবন ব্যবস্থা।” (১২ ইউসুফ: ৪০)[2]
উসূলে ফিকাহর নিয়ম অনুসারে, শরীয়তের একমাত্র আইনদাতা ও বিধানদাতা হলেন আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সা)। কিন্তু এগুলো শরীয়তের বিধানের ব্যাপারে। রাসূল (সা) ওহীর মাধ্যমে তা সম্পন্ন করতেন। পার্থিব নিয়ম-নীতির ব্যাপারে মানুষের স্বাধীনতা শরীয়ত কর্তৃক স্বীকৃত। মহানবী (সা) নবী হওয়ার পরও সাহাবীগণের পরামর্শের আলোকে তাঁর অনেক সিদ্ধান্ত বা নির্দেশনা পরিবর্তন করেছেন। একটি চুক্তিবলে মদীনা রাষ্ট্রটি গঠিত হয় যাতে মুসলমান, ইহুদী, খ্রিষ্টান এবং পৌত্তলিকরা অংশীদার ছিল। মদীনা সনদে ইহুদীদের নিজেদের আইন অনুযায়ী বিচার-ফায়সালার অধিকার মহানবী (সা) প্রদান করেন। মহানবী (সা) নিজেও কমপক্ষে একটি মামলায় ইহুদীদের আইন অনুযায়ী রায় প্রদান করেন।
এ ব্যাপারে ড. সাফি বলেন,
“Sovereignty in the society [of Medina] would not rest with the rulers or any particular group, but with the law founded on the basis of justice and goodness, maintaining dignity of all.”[3]
অর্থাৎ “মদীনার সমাজে শাসক বা কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর ওপর সার্বভৌমত্ব ন্যস্ত ছিল না। বরং সকলের মর্যাদা রক্ষা করে ন্যায়বিচার ও কল্যাণের ওপর ভিত্তি করে রচিত আইনের ওপর ন্যস্ত ছিল।”
খেজুর গাছে ফুল দেখা দিলে এক গাছের ফুল অন্য গাছের ফুলের সাথে লাগিয়ে মদীনার কৃষকরা ফসলের পরাগায়ন করতেন। মহানবী (সা) এ ব্যাপারে একবার নেতিবাচক মনোভাব দেখালে তারা সে বছর পরাগায়ন করেননি। ফলে সে বছর ফসল কম হয়। সাহাবীরা বিষয়টি মহানবীকে (সা) অবহিত করলে তিনি বলেন, তোমরা এ ব্যাপারে বেশি অভিজ্ঞ।
ইবনে মাজাহ হাদীসগ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে,
حَدَّثَنَا عَلِيُّ بْنُ مُحَمَّدٍ، حَدَّثَنَا عُبَيْدُ اللَّهِ بْنُ مُوسَى، عَنْ إِسْرَائِيلَ، عَنْ سِمَاكٍ، أَنَّهُ سَمِعَ مُوسَى بْنَ طَلْحَةَ بْنِ عُبَيْدِ اللَّهِ، يُحَدِّثُ عَنْ أَبِيهِ، قَالَ مَرَرْتُ مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فِي نَخْلٍ فَرَأَى قَوْمًا يُلَقِّحُونَ النَّخْلَ فَقَالَ ” مَا يَصْنَعُ هَؤُلاَءِ ” . قَالُوا يَأْخُذُونَ مِنَ الذَّكَرِ فَيَجْعَلُونَهُ فِي الأُنْثَى . قَالَ ” مَا أَظُنُّ ذَاكَ يُغْنِي شَيْئًا ” . فَبَلَغَهُمْ فَتَرَكُوهُ وَنَزَلُوا عَنْهَا فَبَلَغَ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ ” إِنَّمَا هُوَ ظَنٌّ إِنْ كَانَ يُغْنِي شَيْئًا فَاصْنَعُوهُ فَإِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ وَإِنَّ الظَّنَّ يُخْطِئُ وَيُصِيبُ وَلَكِنْ مَا قُلْتُ لَكُمْ قَالَ اللَّهُ فَلَنْ أَكْذِبَ عَلَى اللَّهِ ”
অর্থাৎ, “তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে একটি খেজুর বাগান অতিক্রম করছিলাম। তিনি লোকদেরকে দেখলেন যে, তারা নর খেজুর গাছের কেশর মাদী খেজুর গাছের কেশরের সাথে সংযোজন করছে। তিনি লোকদের জিজ্ঞাসা করলেন: ‘এরা কী করছে?’ তালহা (রা) বলেন, তারা নর গাছের কেশর নিয়ে মাদী গাছের কেশরের সাথে সংযোজন করছে। তিনি বলেন: ‘এটা কোনো উপকারে আসবে বলে মনে হয় না।’ লোকজন তাঁর মন্তব্য অবহিত হয়ে উক্ত প্রক্রিয়া ত্যাগ করলো। ফলে খেজুরের উৎপাদন হ্রাস পেলো। নবী (সা) বিষয়টি অবহিত হয়ে বলেন: ‘এটা তো ছিল একটা ধারণা মাত্র। ঐ প্রক্রিয়ায় কোনো উপকার হলে তোমরা তা করো। আমি (এ বিষয়ে) তোমাদের মতোই একজন মানুষ। ধারণা কখনো ভুলও হয়, কখনো ঠিকও হয়। কিন্তু আমি তোমাদের ‘আল্লাহ বলেছেন’ বলে যা বলি, সেক্ষেত্রে আমি কখনো আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করবো না।’”
বদরের যুদ্ধের সময় মহানবী (সা) প্রথমে একটি স্থানে তাবু স্থাপনের নির্দেশ দেন। এক সাহাবী এসে জিজ্ঞেস করেন, তাবু খাটানোর স্থান নির্ধারণ কি ওহীর মাধ্যমে হচ্ছে, নাকি এটা তাঁর ব্যক্তিগত অভিমত? জবাবে মহানবী (সা) বলেন, এটা তাঁর ব্যক্তিগত মতামত। ওই সাহাবী তখন আরেকটি জায়গা দেখিয়ে বললেন, আমার মনে হয় ওখানে তাবু খাটালে মুসলমানরা সুবিধাজনক স্থানে থাকবে। মহানবী (সা) সাহাবীর কথা মেনে নির্দেশিত স্থানে তাবু খাটাতে নির্দেশ দেন।
ওহুদ যুদ্ধের সময় সাহাবীদের পরামর্শের ভিত্তিতে মহানবী (সা) তাঁর ব্যক্তিগত অভিমতের বিরুদ্ধে মদীনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন।
উসূলে ফিকাহর নিয়ম হচ্ছে, ইবাদতের ক্ষেত্রে নতুন কিছু সংযোজন করা বিদাত। তবে ফকীহগণ মাকাসিদে শরীয়াহ সামনে রেখে নতুনভাবে উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনা করে নতুন বিষয়ে ইজতেহাদ করতে পারেন। ফলে পার্থিব বিষয়ে প্রয়োজন অনুসারে নতুন নিয়ম-কানুন তৈরি করা বিদাত নয়। রাজনীতি একটা পার্থিব বা সেক্যুলার বিষয়। নাগরিকদের প্রয়োজন ও সুবিধা অনুযায়ী রাষ্ট্র আইন তৈরি, সংশোধন বা বাতিল করতে পারে। শিরক-বিদাতের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। এখন যদি বলা হয়, মানুষ আইন তৈরি করতে পারবে না বা আইন প্রণয়নের অধিকার মানুষের নেই, তাহলে সে অবস্থায় বর্তমান বিশ্বের কোনো রাষ্ট্র চলতে পারবে না। কোনো রাষ্ট্র এ নীতি গ্রহণ করে নিলে সে দেশের শাসনব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়বে। ইসলামে এ ধরণের কূপমণ্ডূকতার স্থান নেই। সাহাবীরা দেশ পরিচালনা করতে গিয়ে অসংখ্য আইন তৈরি করেছেন। এমনকি দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা) দেশের অবস্থা বিবেচনা করে শরীয়ত নির্দেশিত হুদুদ পর্যন্ত মুলতবী করেছেন। এ কারণে ১৪’শ বছরের ইতিহাসে কোনো আলেম বা ফকীহ এটা বলেননি যে হযরত ওমর (রা) হারাম বা কুফরী কাজ করেছেন।
ইসলাম কেয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষের উপযোগী একটা ব্যবস্থা। ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবন পরিচালনার জন্যে সেখানে কোনো সংকীর্ণতা বা সীমাবদ্ধতা নেই। ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে রাষ্ট্রের পরিচালকগণ আইন প্রণয়নের ব্যাপারে ক্ষমতাবান। খুলাফায়ে রাশেদিন থেকে নিয়ে যুগে যুগে শাসকরা তা করে এসেছেন, এ ব্যাপারে কেউ প্রশ্ন তুলেনি। এ অর্থে তারা সার্বভৌম।
বর্তমান সময়ে রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও দায়িত্ব অনেক সম্প্রসারিত। কিন্তু বিশ্বায়নের কারণে, সময়ের চাহিদা অনুযায়ী, স্বাভাবিকভাবে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব বা ক্ষমতা ও অধিকারের সীমানায়ও ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি অনুযায়ী এ পরিবর্তন অব্যাহত থাকবে।
ইসলাম ও অন্যান্য মতাদর্শের তুলনামূলক আলোচনা সম্পর্কিত অন্যান্য নিবন্ধ
রেফারেন্স:
[1] ইমাম রাজি, মাফাতিহুল গায়েব, সূরা ২৮/কাসাস: ৭০।
[2] সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী, ইসলামের রাজনৈতিক মতবাদ, মুহাম্মদ আব্দুর রহীম কর্তৃক অনূদিত।
[3] Dr. Louay M. Safi, Overcoming the Religious-Secular Divide: Islam’s Contribution to Civilization in Muslim Contributions to World Civilization, International Institute of Islamic Thought, U.S.A., 2005, p 16.