আন নাহদার সাম্প্রতিক সংস্কার কার্যক্রমের সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য
এডিটর’স নোট: তিউনিশিয়ার ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল আন নাহদা সম্প্রতি নিজেদের মধ্যে ব্যাপক সংস্কার সাধন করেছে। রাজনৈতিক ইসলাম সম্পর্কে যারা খোঁজখবর রাখেন, তারা দলটির এই পরিবর্তনে নড়েচড়ে বসেছেন। তিউনিশিয়ার প্রেক্ষাপটে এই অবস্থানকে বিশ্লেষকরা দলটির দূরদর্শিতা হিসেবেই বিবেচনা করছেন। গত ২১–২৫ মে আন নাহদার জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর রাজনৈতিক ইসলাম বিশেষজ্ঞ মনিকা মার্কস এ প্রসঙ্গে ওয়াশিংটন পোস্টে একটি নিবন্ধ লেখেন। সিএসসিএস-এর পাঠকদের জন্য এটি অনুবাদ করেছেন আইয়ুব আলী।
*****
গত সোমবার তিউনিসিয়ার অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল আন নাহদার জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। ১৯৭৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এটি ছিল দলটির দশম কংগ্রেস। একটি চমকপ্রদ ঘোষণার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টানা হয়েছে। একে মসজিদ ও রাষ্ট্রের পৃথকীকরণের ঐতিহাসিক ঘোষণা হিসেবে বিবেচনা করা হলেও আন নাহদা একে ধর্মীয় কার্যক্রম থেকে রাজনীতির পৃথকীকরণ হিসেবে অভিহিত করছে। এছাড়াও দলের নতুন পরিচিতি তুলে ধরা, নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করা, নতুন বক্তব্য ও দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে সদস্য সংগ্রহ কার্যক্রমসহ কিছু নতুন পরিকল্পনা এই অধিবেশনে গ্রহণ করা হয়েছে। ধর্ম ও রাজনীতির পৃথকীকরণের আকস্মিক একটি পদক্ষেপ হিসেবেই এই কংগ্রেসকে পাশ্চাত্য মিডিয়া তুলে ধরেছে। অথচ আন নাহদার নেতাকর্মীরা এই পরিবর্তনকে দলটির ভেতরে দীর্ঘদিন ধরে অনুসৃত ধ্যানধারণার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হিসেবেই বিবেচনা করছে। ধর্মের সাথে রাজনীতির পুরোপুরি পৃথকীকরণ নয়, বরং রাজনীতির সাথে ধর্মের সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করে তারা এক ধরনের সমন্বয় করেছে।
এই নতুন ঘোষণা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দলটি তার নেতৃবৃন্দকে ধর্মীয় সংগঠনসহ নাগরিক সমাজের যে কোনো ধরনের সংগঠনের নেতৃত্ব গ্রহণের অনুমতি না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দলটির নেতৃবৃন্দের মসজিদে ধর্মীয় বক্তব্য দেয়ার উপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এমনকি অনানুষ্ঠানিক বা অনিয়মিতভাবেও তারা তা করতে পারবেন না। এর মানে হলো দলটির শুরা কাউন্সিলের সদ্য পুনঃনির্বাচিত দুই সদস্য শায়খ সাদেক শুরো এবং হাবীব আল লাউজের মতো সুপরিচিত ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হয় ধর্মপ্রচার বন্ধ করবেন নয়তো দলীয় পদ ত্যাগ করবেন।
দ্বিতীয়ত, এতোদিন ধরে যারা দলটির কর্মকৌশল ও অর্থনৈতিক নীতিকে পছন্দ করা সত্ত্বেও কঠিন শর্তাবলীর কারণে দলে যোগ দিতে পারেনি, তাদের কথা চিন্তা করে আন নাহদার সদস্যপদের শর্তাবলী সহজ করা হয়েছে। দলটিতে যোগ দিতে হলে এখন আর দুজন দলীয় কর্মীর সত্যায়নের প্রয়োজন পড়বে না। আরো একটি আশ্চর্যজনক পরিবর্তন হলো – এর সদস্যপদের শর্তাবলী থেকে ‘আখলাক’ (নৈতিকতা) শব্দটি তুলে নেয়া হয়েছে। এই পরিবর্তনের ফলে জীবনযাপন সম্পর্কে দলটির পূর্বেকার রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি মেনে চলার চাপ হয়ত হ্রাস পাবে।
ধর্ম ও রাজনীতির সম্পর্ক সংক্রান্ত এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গিকে দলটির নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে তৃণমূল সদস্যদের কেউই ‘ফাসল’ (পৃথকীকরণ) হিসেবে অভিহিত করতে রাজি নন। আন নাহদার শুরা কাউন্সিল ও সংসদ সদস্য ফরিদা লা’বিদীর মতে, “আসলে এটা পৃথকীকরণ নয়, এটা হচ্ছে বিশেষায়িতকরণ (তাখাসসুস)। আমাদের ইসলামী মনোভাব আগের মতোই থাকবে। তারমানে অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে সবকিছু ধর্মীয় শিক্ষার (তরবিয়ত) আলোকেই করতে হবে, এমনটা আমরা যুক্তিসঙ্গত মনে করি না।” তার এই বক্তব্যে আন নাহদার অন্যান্য সদস্যের চিন্তার প্রতিফলনই ঘটেছে।
আন নাহদার নেতা হাবীব আল লাউজ রাজনীতির চেয়ে ধর্মীয় কাজেই বেশি মনোযোগী। তার মতে, “যারা যে কাজে পারদর্শী, তাদেরকে সে কাজের সুযোগ করে দেয়াই হলো এই পরিবর্তনের উদ্দেশ্য।” শুরুতে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলেও পরে তিনি পরিবর্তনের পক্ষে সমর্থন দেন এই যুক্তিতে, বিশেষায়িতকরণের ফলে উভয় দিকই শক্তিশালী হবে। স্বাধীনভাবে ধর্মীয় কাজে মনোনিবেশ করার জন্য তিনি শুরা কাউন্সিলের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
হাবীব আল লাউজসহ আন নাহদার নেতৃবৃন্দের অনেকেই মনে করছেন, ক্রমবর্ধমান জিহাদী চরমপন্থীদের মোকাবেলায় আরো কার্যকর ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে তিউনিশিয়ার জন্য এই ধরনের বিশেষায়িতকরণ সহায়ক হবে। সালাফী জিহাদপন্থার মোকাবেলা করতে হলে তিউশিয়ার ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ঢেলে সাজানোকে আন নাহদা গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। আননাহদার অনেক সদস্যই মনে করেন, বিপথগামী চরমপন্থীদেরকে ধর্মীয়ভাবে মোকাবেলা করার জন্য দলের সুযোগ্য ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের এটি বিশেষ দায়িত্ব।
একইভাবে, আন নাহদার অধিকাংশ সদস্য মনে করেন, সবার জন্য সদস্যপদ উন্মুক্ত করার পদক্ষেপ নেয়ায় দলের রাজনৈতিক সক্ষমতা আরো বাড়বে। ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনের সময় আন নাহদা প্রথমবারের মতো ইসলামপন্থী নয় এমন কয়েকজনকে রিক্রুট করে। এদের মধ্যে কয়েকজনকে নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ আসনে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল, যারা এমনকি আন নাহদার সদস্য পর্যন্ত নন। এই প্রার্থীদের মধ্যে ছয় জন বিজয়ী হয়। এ প্রসঙ্গে আন নাহদার সংসদ সদস্য সাইয়েদা ওয়ানিসির বক্তব্য হলো, “বাইরের কারো অন্তর্ভুক্তির ফলে সামষ্টিক ঐক্য কিংবা দলীয় মূল্যবোধ যে হুমকির মধ্যে পড়েনি, তাদের এই অংশগ্রহণ থেকে তা বুঝা গেছে।”
আন নাহদা নেতৃবৃন্দের ধারণা অনুযায়ী, তাদের ভোটব্যাংক সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ। ভোটের এই সীমা ছাড়িয়ে যেতে হলে দলের একনিষ্ঠ সদস্য ও তাদের পরিবারের বাইরে অবশ্যই নতুন সমর্থকদের আকৃষ্ট করতে হবে। তাদের মতে, একটি পূর্ণাঙ্গ জাতীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিপক্কতা অর্জনের লক্ষ্যে ইতিবাচক ভূমিকা দাঁড় করাতে হলে আন নাহদাকে তার দীর্ঘদীনের ‘ইসলামপন্থী’ পরিচয় থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কারণ, বোকো হারাম এবং ISIS এর মতো সহিংস গোষ্ঠীগুলোর সাথে এই পরিভাষাটিকে প্রায়ই সংশ্লিষ্ট করা হচ্ছে। এ কারণে জার্মানির ‘খ্রিস্টান ডেমোক্র্যাট’দের উদাহরণ সামনে রেখে আন নাহদা আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদেরকে ‘মুসলিম ডেমোক্র্যাট’ হিসেবে পরিচয় দিয়েছে। আন নাহদার বিরুদ্ধে সহিংস চরমপন্থীদেরকে প্রশ্রয় দেয়ার অভিযোগ ছিল। এর ফলে আন নাহদার কর্মীদের মাঝে যে হতাশা ও নতুন উপলব্ধি তৈরি হয়, এই কৌশলগত নতুন পরিচয়কে তার প্রতিফলন বলা যেতে পারে।
এ ধরনের প্রতীকী ও সত্যিকারের পরিবর্তন তুরস্কের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির শুরুর দিকের বহুত্ববাদী (pluralistic) অবস্থানের কথাই মনে করিয়ে দেয়। অযাচিত সামরিক কর্তৃত্বের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জনপ্রিয়তার উপর ভর করে গড়ে ওঠা বৃহৎ ও রক্ষণশীল জাতীয় দল হিসেবে একেপির কাছে ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলো তখন নিজেদের সঁপে দিয়েছিল। একইভাবে, আন নাহদাও নিজেদের পলিসি নির্ধারণের ক্ষেত্রে আরব-ইসলামী পরিচয়কে ডিফেন্ড না করে এখন নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রশাসনিক অদক্ষতা ও দুর্নীতিসহ সাধারণ তিউনিশিয়ানদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারগুলোকে প্রাধান্য দিচ্ছে। ২০১২ সালে শরীয়াহ ও ব্লাসফেমি নিয়ে উত্তেজনাপূর্ণ দীর্ঘ বিতর্কের পর আন নাহদা ঘোষণা দেয়, এ থেকে তারা শিক্ষা নিয়েছে। ফলে জনগণের সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে এখন থেকে তারা আরো কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
আন নাহদার আগের গঠনতন্ত্রে ৪০টির মতো ধারা ছিল। প্রায় তিনগুণ বাড়িয়ে নতুন গঠনতন্ত্রে ১৪৬টি ধারা রাখা হয়েছে। এই ব্যাপারটিও দলটির পেশাদার হয়ে ওঠার আকাঙ্খা এবং যে কোনো মূল্যে নতুন ভোটারদের আকৃষ্ট করার প্রচেষ্টারই প্রতিফলন। দলটিকে বছরের পর বছর বিভিন্ন সরকারের বিরূপ মনোভাব মোকাবেলা করে টিকে থাকতে হয়েছে। সে কারণে গত দুই বছরে নিজের রাজনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী করতে তারা সতর্কতার সাথে কাজ করেছে। তারপরও এই কংগ্রেসে অংশগ্রহণকারীদের ধারণা, নানা ধরনের সমঝোতামূলক পদক্ষেপের কারণে হতাশ হয়ে আন নাহদার ১০-১৫ শতাংশ ভোটার দল থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। তবে ২০১৯ সালের সংসদীয় নির্বাচনে দলটি এরচেয়েও বেশি নতুন ভোটার আকৃষ্ট করতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে।
‘দল ও আন্দোলনের’ এই পরিবর্তিত সম্পর্কের ব্যাপারে আন নাহদার সমর্থক ও নেতৃবৃন্দের অনেকেই শুরুতে দ্বিধান্বিত ছিলেন। তারপরেও ২০১৬ সালের এই বসন্তে এসে তাদের অধিকাংশই এই পরিবর্তনকে সমর্থন দিতে সম্মেলনে উপস্থিত হয়েছেন। সপ্তাহের শেষান্তে এই পরিবর্তন বিপুল সংখ্যাগরিষ্টতা লাভ করেছে; অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশ বা তারচেয়েও বেশি সদস্য এর পক্ষে ভোট দিয়েছেন।
আন্দোলন (হারাকা) থেকে দলীয় (হিজব) কার্যক্রমকে আনুষ্ঠানিকভাবে পৃথক করা আন নাহদার জন্য তুলনামূলক সহজই ছিল বলা যায়। কারণ, দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে এক ধরনের ক্ষীণ যোগাযোগ থাকলেও বিপ্লবের পর থেকে দলটি মূলত রাজনৈতিক দল হিসেবেই তৎপরতা চালাচ্ছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট যাইন আল আবেদীন বেন আলীর দমনপীড়নের কারণে মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো তিউনিশিয়ায় আন নাহদা ধর্মীয় সংগঠন ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানের কার্যকর ও শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে পারেনি।
প্রস্তাবিত পরিবর্তন নিয়ে নিজেদের মধ্যে নিবিড় আলাপ-আলোচনায় মনোযোগী থাকায় এই জাতীয় সম্মেলন দুই বছর দেরিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ তো বটেই, নেতৃবৃন্দের সাথে মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের মধ্যে পর্যন্ত এই বিষয়গুলোর খুটিনাটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। তিউনিশিয়ার অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বেশ দুর্বল। কয়েকজন বড় বড় ব্যক্তিত্বকে কেন্দ্র করেই দলগুলো গড়ে ওঠেছে। তবে আন নাহদার অভ্যন্তরে প্রতিনিধিত্বমূলক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দলটি অনেক দূর এগিয়ে গেছে। দলের সদস্যদের সাথে নিবিড় যোগাযোগ রাখার কারণে কংগ্রেস ও শুরা কাউন্সিলে গৃহীত ‘এক ব্যক্তি, এক ভোট’ এই সুচিন্তিত নীতি দলের সদস্যরা মেনে নিয়েছে। এর ফলে তৃণমূল পর্যায়ের অধিকাংশ সমর্থককে সন্তুষ্ট রেখেই সম্ভাব্য বিতর্কিত পরিবর্তনগুলোর পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়া দলটির পক্ষে সহজ হয়েছে।
তাছাড়া দলটির নেতৃবৃন্দ আকস্মিকভাবে পরিবর্তনের ঘোষণা না দিয়ে আন নাহদার ঐতিহাসিক বিকাশের স্বাভাবিক পরিণতি আকারেই পরিবর্তনগুলো এনেছেন। এর ফলে দলের সদস্যরা এই পদক্ষেপকে একটি প্রফেশনাল দল হিসেবে গড়ে ওঠার লক্ষ্যে আন নাহদার ধারাবাহিক বিবর্তনের ফলাফল এবং বহুল প্রতীক্ষিত ব্যাপার হিসেবে বিবেচনা করছেন। আন নাহদার বেশ পুরনো একজন নেতা আবদেল হামিদ জেলাসির মতে, “বেন আলীর শাসনামলে সত্যিকারের রাজনীতি করার সুযোগ আমাদের ছিল না। তাই কর্মীদেরকে সংগঠিত রাখা এবং কাজ করার জন্য নানা ধরনের উপায় অবলম্বন করতে হয়েছে। যেমন – আমরা মসজিদে একত্রিত হতাম।”
এই ন্যারেটিভ ইসলামপন্থাকে এক ধরনের পরিস্থিতিনির্ভর লিবারেশন থিওলজি হিসেবে চিত্রায়িত করে। অর্থাৎ, স্বৈরশাসকরা দশকের পর দশক ধরে আন নাহদাকে নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক তৎপরতা চালাতে না দেয়ায় ইসলামপন্থা একটি সরকারবিরোধী প্লাটফরম হিসেবে গড়ে ওঠেছে। বর্তমান সময়ে ইসলামপন্থার উপযোগিতা থাকা সত্ত্বেও আন নাহদার অনেক নেতাই এখন যুক্তি দিচ্ছেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ থাকায় যে যে ধরনের লিবারেশন অর্জিত হয়েছে তাতে করে এখন আর ইসলামপন্থার আশ্রয় নেয়ার দরকার থাকছে না। কেননা, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যও সরকার পরিচালনা সংক্রান্ত বিষয়ে বাস্তবমুখী হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। ‘বিরোধী পক্ষের হাতিয়ার হিসেবে ইসলামপন্থা যতটা কার্যকর, সরকার পরিচালনার জন্য ততটা নয়’ – আন নাহদার একজন শীর্ষনেতা সাঈদ ফারজানী গত মার্চে এ মন্তব্য করেন।
গণতন্ত্রই সর্বোত্তম পন্থা – আন নাহদার নেতাকর্মীদের মধ্যে এই উপলব্ধি আসার ফলেই তারা দশম কংগ্রেসে উদারপন্থা ও ইতিবাচক লক্ষ্য-উদ্দেশ্যগুলোকে গ্রহণ করে নিতে পেরেছে। তিউনিশিয়ার পরিবর্তন প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপে সেক্যুলার এবং ইসলামপন্থী – উভয় পক্ষের মাঝে এক ধরনের ভীতিজনিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। প্রত্যেকেই নিজেদের আইডেন্টিটিকে তিউনিশিয়ার নতুন সংবিধান ও বিপ্লবোত্তর রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট ছিল। এই প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের অস্তিত্ব নিশ্চিত করা এবং নীতিনির্ধারণী একটি পক্ষ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করা। আন নাহদার ইসলামপন্থীরা মিডিয়ার বিদ্বেষ এবং সরকারী প্রশাসনের বৈরীতার সম্মুখীন হয়েছিল। তিউনিশিয়ার গণতান্ত্রিক অর্জনকে উল্টে দেয়ার লক্ষ্যে একটি প্রতিবিপ্লবের ভয়ও দলটির ছিল। ২০১৩ সালে মিশরে যেমনটি ঘটেছিল। এমনটি হলে ইসলামপন্থীদেরকে পুনরায় জেল কিংবা নির্বাসনে যেতে হতো।
বাইরের কেউ আন নাহদায় যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে কর্মীদের মধ্যে অস্বস্তি থাকার পেছনে ঐতিহাসিক বাস্তবতা যেমন আছে, আবেগের ব্যাপারও আছে। দলের সদস্য বাড়ানোর নতুন পরিকল্পনার ক্ষেত্রে এই অস্বস্তি এক ধরনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে হাজির হয়েছে। এ সংক্রান্ত কংগ্রেসের পরিবর্তনের ব্যাপারে শুরুতে কর্মীদের সমালোচনা ছিল। যেমন – নতুন কেউ হয়তো দলের ভেতর ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে ঢুকে পড়বে! বেন আলীর দল প্রায়ই এ ধরনের এজেন্ট ঢোকানোর চেষ্টা করতো। কিংবা কেউ হয়তো নিজস্ব স্বার্থে বা সুবিধাবাদী উদ্দেশ্য নিয়ে দলকে ব্যবহার করবে। আরেকটা নীরব ভীতি আন নাহদার কিছু কর্মীর মধ্যে কাজ করে, সেটি হলো – কর্মীদের কাছে দলকে পরিবারের মতোই যতটা নিরাপদ ও সুরক্ষিত মনে হতো, সবার জন্য দলকে উন্মুক্ত করে দিলে আন্দোলনের সেই পরিবেশ হয়তো বিঘ্নিত হবে। আন নাহদার কর্মীরা প্রায়ই বলে থাকেন, বছরের পর বছর ধরে তাদের উপর যখন রাজনৈতিক জেল-জুলুম চলছিল কিংবা যখন কেউ নির্বাসনে যেতে বাধ্য হতো, তখন শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষুর ভয়ে তাদের রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়স্বজনরা ভীতস্বন্ত্রস্ত থাকত। তারা কোনো সহায়তা করতে পারতো না। আন নাহদার কর্মীরাই তখন তাদের পাশে দাঁড়াতো। দলকে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিলে এই ধরনের দৃঢ় ভ্রাতৃত্ববোধের সংস্কৃতি হয়তো দুর্বল হয়ে পড়বে।
সর্বশেষ পরিবর্তনগুলো সত্ত্বেও আন নাহদার অভ্যন্তরীণ সংস্কৃতি সম্ভবত ধর্মীয় রক্ষণশীল হিসেবেই থেকে যাবে। সমুদ্র তীরবর্তী হামেমেত শহরের যে হোটেলে এই কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে মদ পরিবেশন করা হয় না। মিশরের ইসলামপন্থী বুদ্ধিজীবী ফাহমী হুয়াইদীসহ কংগ্রেসে আমন্ত্রিত অন্যান্য বিখ্যাত ধর্মীয় চিন্তাবিদগণও সম্ভবত আন নাহদার নেতা রশিদ ঘানুশীর পাশেই থাকবেন। এতোসব গুরুত্বপূর্ণ প্রতীকী ও বাস্তব পরিবর্তন সত্ত্বেও আরো দীর্ঘ সময় পর্যন্ত আন নাহদার সামগ্রিক সাংগঠনিক বিন্যাসে ইসলামপন্থার একটা ছাপ সম্ভবত থেকেই যাবে। গতিপথ পরিবর্তন হলেও দলের অভ্যন্তরীণ সংস্কৃতি বহাল থাকায় কর্মীরা এখানে আগের মতোই স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপদ বোধ করবে।
দশকের পর দশক ধরে আন নাহদা যে ধরনের রাজনৈতিক দমনপীড়নের শিকার হয়েছে, তাতে করে পরিবর্তনের পূর্বশর্ত হিসেবে ন্যূনতম মাত্রার স্থিতিশীলতার দরকার ছিল। পূর্বেকার নজরদারিনির্ভর, নির্বতনমূলক স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার মোকাবেলায় টিকে থাকার জন্য আন নাহদা যেসব কৌশল অবলম্বন করেছিল, সেসবের প্রয়োজনীয়তা ও প্রাসঙ্গিকতা যে আর থাকছে না, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য তিউনিশিয়ার রাজনীতির গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে উত্তরণের ব্যাপারে আস্থা তৈরির দরকারও ছিল।
যাইহোক, আন নাহদার কংগ্রেসে গৃহীত এই পরিবর্তনের পেছনে তিউনিশিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট বেজি সাঈদ এসেবসির মূখ্য ভূমিকাও অনস্বীকার্য। যদিও কেউ এতোটা ভাবেনি। নিদা তিউনিশ দলের প্রতিষ্ঠাতা এসেবসি আগে আন নাহদার কঠোর সমালোচনা করলেও এখন তিনি আর সেই অবস্থানে নেই। এসেবসি ও ঘানুশীকে একত্রে সম্বোধন করতে প্রায়ই মজা করে ‘দুই শায়খ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। ২০১৩ সালে বার্দো জাতীয় জাদুঘরে আক্রমণের ফলে সৃষ্ট সংকট থেকে উত্তরণে এই দুই নেতা পরস্পরকে সহযোগিতা শুরু করেন। ওই সংকট এমন এক রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি করে, যাতে তিউনিশয়ার সম্ভাবনাময় পালাবদল অঙ্কুরেই বিনষ্ট হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছিল। সে সময়ের নেপথ্য আলোচনাই নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ন্যাশনাল ডায়ালগ কোয়ার্টেট’কে বিদ্যমান সংকট নিরসনে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালনের পথ করে দিয়েছিল।
কংগ্রেসের প্রধান বক্তা সাইদ এসেবসি যখন লম্বা লম্বা পা ফেলে মঞ্চে ওঠে আসেন, তখন সবচেয়ে নাটকীয় মুহূর্তের অবতারণা হয়। উপস্থিত হাজারো মানুষের মুহুর্মুহু করতালি এবং ‘বেজি! বেজি!’ হর্ষধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে সম্মেলনস্থল। আন নাহদার সাথে নিদা তিউনিশের জন্মগত বিরোধ (আন নাহদার বিরোধী হিসেবে ২০১২ সালে দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়), ২০১৩ সালের চরম বিবাদমূলক ঘটনাসমূহ এবং ২০১৪ সালের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন দল দুটিকে একে অপরের বিরুদ্ধে ঠেলে দিয়েছিল। এই ব্যাপারগুলো যারা জানে, তাদের কাছে সেই মুহূর্তটি ছিল পরাবাস্তব ঘটনার মতো।
উপস্থিত লোকদের মাঝে বয়ে যাওয়া স্বস্তির বাতাস সহজেই টের পাওয়া যাচ্ছিল। যার ব্যাপারে অনেকের ভয় ছিল যে, তিনি হয়তো তাদেরকে আবারো কারাগারে নিক্ষেপ করবেন; সেই তিনিই কিনা আন নাহদার স্বাভাবিক পথচলার এই ক্রান্তিলগ্নে স্বয়ং অংশগ্রহণ করলেন! ২০১৪ সালে যিনি আন নাহদাকে পশ্চাৎপদ, ক্রিমিনাল, সন্ত্রাসবাদের প্রশ্রয়দাতা – এসব ভাষায় তীব্র আক্রমণ করেছিলেন, এবার সেসবের পুনরাবৃত্তি না করে তিনি বরং স্বীকৃতি দেন যে, আন নাহদা ‘সঠিক পথেই চলছে’। দলটিকে তিউনিশিয়ার রাজনীতির একটি নির্ভরযোগ্য জোট সদস্য এবং বৈধ প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবেও তিনি অভিহিত করেন।
পাশ্চাত্য মিডিয়া আন নাহদার কংগ্রেসের সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে মসজিদ ও রাষ্ট্রের মধ্যকার অভাবিত ও আরোপিত পৃথকীকরণের উপর ফোকাস। অথচ, সমঝোতার জন্য নতুন উদ্যোগ গ্রহণই হলো এই কংগ্রেসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
ঘানুশী ও এসেবসির যৌথ নেতৃত্বে সমঝোতার (তাওয়াফুক) যে রাজনীতি শুরু হয়েছে, তা অব্যাহত রাখার পক্ষে কংগ্রেস ভোট দেয়। কংগ্রেসে আমন্ত্রিত জাতীয় পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ের প্রতিনিধিরা এই ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেন। ভোটের ফলাফলে দেখা যায়, দুই-তৃতীয়াংশ বা তারও বেশি কংগ্রেস ডেলিগেট ঘানুশী সমর্থিত রাজনৈতিক ঐক্যমত ও সমঝোতার প্রস্তাবকে দৃঢ় সমর্থন দেন।
সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার এই বাস্তবসম্মত নীতি থেকে বুঝা যায়, অপেক্ষাকৃত প্রাগ্রসর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বই শুধু নয়, সামগ্রিকভাবে আন নাহদাই গত চার বছরে যথেষ্ট রাজনৈতিক শিক্ষা অর্জন করেছে। আন নাহদার সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নিছক অনুকূল একটি জোট গঠনের পরিবর্তে সত্যিকারের কার্যকর একটি জোট গড়ে তোলা, যেটি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তিউনিশিয়ার লড়াই, প্রশাসনিক অদক্ষতা, দুর্নীতি ও তরুণদের বেকারত্ব দূর করতে কাজ করবে। এর মাধ্যমেই অর্জিত রাজনৈতিক শিক্ষার প্রকৃত বাস্তবায়ন ঘটবে।
*****
আন নাহদার জাতীয় সম্মেলনে প্রদত্ত রশিদ ঘানুশীর বক্তব্য পড়ুন: তিউনিশিয়ার স্বপ্ন
আরো পড়ুন: আন নাহদা কি ইসলামপন্থী, নাকি মুসলিম ডেমোক্র্যাট?