ইসলামপন্থার সাথে বোঝাপড়া

ইসলামপন্থার সাথে বোঝাপড়া

এডিটর’স নোট: ব্রাসেলসভিত্তিক থিংকট্যাংক ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’ নানা বিষয়ে নিয়মিত গবেষণামূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। পাশ্চাত্যের নীতি-নির্ধারণী মহল কর্তৃক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে এসব গবেষণা যেন সহায়ক ভূমিকা পালন করে, এই হলো তাদের উদ্দেশ্য। ২০০৫ সালের ২ মার্চ তারা ‘Understanding Islamism‘ শিরোনামে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। পাশ্চাত্যের একটি থিংকট্যাংক ইসলামপন্থাকে কোন দৃষ্টিতে দেখে, তা এই প্রতিবেদনে ফুটে ওঠেছে। নানা কারণেই বাংলাদেশে এখন ইসলামপন্থা নিয়ে নতুন করে আগ্রহ তৈরি হওয়ার পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে। তাই সিএসসিএস-এর পাঠকদের জন্য প্রতিবেদনটির নির্বাচিত অংশের অনুবাদ করেছেন আইয়ুব আলী।

*****

সারসংক্ষেপ

৯/১১’র ভয়াবহ ও ধ্বংসাত্মক ঘটনার পর প্রতিক্রিয়া হিসেবে পশ্চিমা পর্যবেক্ষক ও নীতিনির্ধারকদের অনেকের মাঝেই একটি প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। তাহলো সকল ধারার ইসলামপন্থাকে তারা একইভাবে বিবেচনা করছে। তাদেরকে উগ্রপন্থী হিসেবে ব্র্যান্ডিং করা হচ্ছে এবং শত্রু হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে।

এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি আদতেই ত্রুটিপূর্ণ। ইসলামপন্থা বা ইসলামী এক্টিভিজমের (এ দুটি পরিভাষাকে আমরা সমার্থক হিসেবেই বিবেচনা করছি) অসংখ্য ধারা-উপধারা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে অল্প কয়েকটি ধারাই কেবল উগ্রপন্থা সমর্থন করে। তাদের মধ্যে মাত্র হাতেগোনা কিছু উপধারা সশস্ত্র তৎপরতায় লিপ্ত।

পশ্চিমা বিশ্বকে তাই বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে। রাজনৈতিক ইসলামপন্থার ভেতরকার দৃষ্টিভঙ্গির এই বৈচিত্রতাকে বিবেচনায় নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, ইসলামপন্থীদের মাঝে সবচেয়ে আধুনিকতাপন্থীরাও আমেরিকার চলমান নীতির ঘোর বিরোধী হওয়া সত্বেও পাশ্চাত্যের সাথে তাদের সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করতে  আগ্রহী। পশ্চিমা বিশ্বকে এটাও বুঝতে হবে, ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত, ইরাক আগ্রাসন ও ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধ’ – এ সবগুলোই আসলে বিপদজনক ও অনাকাঙ্খিত জিহাদী তৎপরতাকেই উসকে দিচ্ছে এবং সেসবকে জনপ্রিয় করে তুলতে ভূমিকা রাখছে।

ইসলামী এক্টিভিজমের ধারাগুলো বুঝতে চাইলে শুরুতেই শিয়া-সুন্নী বিভাজনকে বুঝতে হবে। শিয়াদের তৎপরতার মাধ্যমে ১৯৭৯ সালে ইরান বিপ্লব সংঘটিত হয়। সে সময়ই প্রথম ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ ধারণাটি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। সে কারণে ‘শিয়া তৎপরতা’কে তখন সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হতো।

যাইহোক, শিয়ারা আসলে মুসলমানদের ক্ষুদ্র একটি অংশ। মুসলমানদের শতকরা ৮০ জনই সুন্নী। বিভিন্ন দেশে বসবাসরত শিয়ারা সংখ্যালঘু হওয়ায় তাদের তৎপরতা মূলত গোষ্ঠীস্বার্থ কেন্দ্রিক। অর্থাৎ, তারা অন্য জনগোষ্ঠী, এমনকি রাষ্ট্রীয় স্বার্থের চেয়েও নিজ সম্প্রদায়ের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়। নিজেরা সংখ্যালঘু হওয়া ছাড়াও তাদের এই ঐক্যবদ্ধতার পেছনে আরেকটি কারণ রয়েছে। সেটি হলো, রাজনৈতিক তৎপরতায় শিয়াদের ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ও আলেমগণ মূখ্য ভূমিকা পালন করে থাকেন। সে কারণে তারা সুন্নী মুসলমানদের মতো নানা রকম বিরোধপূর্ণ ধারায় খুব বেশি বিভক্ত হয়ে যায়নি।

তবে সুন্নী ইসলামপন্থার দিকেই পাশ্চাত্যের নজর এখন সবচেয়ে বেশি। তাদেরকেই এখন সবচেয়ে ভীতির চোখে দেখা হয়। গোটা সুন্নী ইসলামপন্থাকে মৌলবাদী, চরমপন্থী ও পাশ্চাত্যের স্বার্থের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা হয়। যদিও সুন্নী ইসলামপন্থার সকল ধারা একই ধাঁচের (monolithic) নয়; বরং, তিনটি স্পষ্ট স্বতন্ত্র ধারায় বিভক্ত। প্রতিটি ধারারই নিজস্ব বিশ্বদৃষ্টি (worldview), কার্যপ্রণালী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ (characteristic actors) রয়েছে।

  • রাজনৈতিক ধারা: ইসলামী রাজনৈতিক আন্দোলনগুলোর (আল-হারাকাত আল-ইসলামিয়্যাহ আস-সিয়াসিয়্যাহ) ক্ষেত্রে মিশরের ইখওয়ানুল মুসলিমুন উল্লেখযোগ্য। আলজেরিয়া, জর্ডান, কুয়েত, ফিলিস্তিন, সুদান এবং সিরিয়াসহ সর্বত্র এর শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত। এছাড়া তুরস্কের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (Adalet ve Kalkinma Partisi, AKP) ও মরক্কোর পার্টি ফর জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (Parti pour la Justice et le Développement, PJD) মতো আন্দোলনগুলো স্থানীয় পর্যায়ে সংগঠিত। এই সবগুলো দলের উদ্দেশ্য হলো জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হওয়া। এ দলগুলো জাতিরাষ্ট্রের ধারণাকে মেনে নিয়ে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে থেকে পরিচালিত হয়। বৈদেশিক আগ্রাসনের শিকার না হলে অন্যসব ক্ষেত্রে তারা সংঘাত এড়িয়ে চলে। বৈপ্লবিক আকাঙ্খার পরিবর্তে তারা নিজেদেরকে সংস্কারপন্থী হিসেবে চিন্তা করে। তারা সার্বজনীন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ধারণ করে।

দলীয়-রাজনৈতিক সক্রিয়তাই এই ধারার চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে।

  • দাওয়াতী ধারা: ইসলামী দাওয়াতী কাজের প্রধান দুটি ধারা রয়েছে। একটি হচ্ছে তাবলিগী আন্দোলন (তাবলীগ জামায়াত), যা খুবই সংগঠিত। আরেকটি হচ্ছে সালাফী আন্দোলন, যা ব্যাপক বিস্তৃত। এ দুটি ধারার কোনোটিরই রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের উদ্দেশ্য নেই। তাদের কাছে বরং মুসলিম পরিচয় ও ঈমান রক্ষা এবং কুফরী শক্তির বিপরীতে নৈতিক শিক্ষা অর্জন করা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

আলেম ও দ্বীনের দায়ীগণ এই ধারার মুখ্য ব্যক্তি।

  • জিহাদী ধারা: সশস্ত্র ইসলামী সংগ্রাম তথা জিহাদের সাথে তিনটি ধারার সম্পৃক্ততা রয়েছে। এক) অভ্যন্তরীণ ধারা: যারা নিজ দেশে মুসলিম নামধারী অধার্মিক শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। দুই) স্বাধীনতাকামী ধারা: যারা দেশকে অমুসলিম শাসকের হাত থেকে উদ্ধার কিংবা দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত করার জন্য জিহাদ করে থাকে। তিন) বৈশ্বিক ধারা: এই ধারার জিহাদীরা পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে।

সশস্ত্র মুজাহিদরা এই তিনটি ধারায় সক্রিয়।

সুন্নী ইসলামপন্থার এ সবগুলো ধারাই ঐহিত্য ও আধুনিকতার মধ্যে সমন্বয় ঘটানোর চেষ্টা করে। ঐতিহ্যের অপরিহার্য বিষয়গুলোকে আধুনিক যুগের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য তারা নানাভাবে চেষ্টা করে। তারা সবাই ঐতিহ্যকে গ্রহণ করার পাশাপাশি পাশ্চাত্যের কিছু কিছু বিষয়ও অনুসরণ করে। এভাবে তারা আধুনিকতার আলোকে বিষয়গুলোর সমন্বয় করে। তবে মুসলিম বিশ্বের মৌলিক সংকটগুলো কী, তা নিয়ে যেমন তাদের মধ্যে মতভেদ আছে; তেমনি সেগুলো সমাধানের উপায় নিয়েও মতপার্থক্য রয়েছে।

রাজনৈতিক ইসলামপন্থীরা মুসলিম সরকারের অপশাসন ও সামাজিক অবিচারকে মূল সমস্যা মনে করে। এ সমস্যা সমাধানকল্পে  তারা রাজনৈতিক সংস্কারকে অগ্রাধিকার দেয়। রাজনৈতিক তৎপরতা তথা নতুন পলিসি দাঁড় করানো, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রভৃতির মাধ্যমে তা অর্জন করা সম্ভব বলে তারা মনে করে।

দাওয়াতী ধারার ইসলামপন্থীদের নিকট ইসলামী মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং ঈমানী দুর্বলতা হচ্ছে মূল সমস্যা। তারা এমন এক ধরনের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক পুনর্জাগরণের কথা বলে, যার ফলে ব্যক্তির মূল্যবোধের বিকাশ সাধনের মাধ্যমে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পাশাপাশি সামষ্টিক নাজাত লাভ করা সম্ভব হবে।

জিহাদী ধারার ইসলামপন্থীরা ইসলামী বিশ্বজুড়ে অমুসলিমদের রাজনৈতিক ও সামরিক আগ্রাসনকে মূল সমস্যা মনে করে। তাই তারা সশস্ত্র প্রতিরোধের উপর গুরুত্বারোপ করে।

এই তিনটি প্রধান ধারার কোনটি মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী সময়কাল ধরে প্রভাব বিস্তার করবে সেটা মুসলামানদের জন্য তো বটেই, পশ্চিমা বিশ্বের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামপন্থীরা তাদের মতপার্থক্যগুলোর ব্যাপারে যেন একটা কাছাকাছি অবস্থানে আসতে পারে, সে জন্য পাশ্চাত্য, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রকে ন্যায়সঙ্গত অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। পাশ্চাত্যের পলিসি ইসলামপন্থীদেরকে কীভাবে প্রভাবিত করছে, সেটা নিয়েও সচেতন হওয়া দরকার। ইসলামপন্থার আধুনিকতাবাদী ও মৌলবাদী – উভয় ধারার ব্যাপারে একইরকম আগ্রাসী মনোভাব পোষণের ফলে আমেরিকান ও ইউরোপীয় নীতিনির্ধারকরা মূলত দুটি পরিণতির যে কোনো একটিকেই ডেকে আনছেন:  এক) ইসলামিক এক্টিভিজমের ভিন্ন ভিন্ন ধারাকে একই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করার প্রতিক্রিয়ায় তাদের নিজেদের মধ্যকার পার্থক্য কমে যাচ্ছে। অথচ এই পার্থক্যকে আরো ফলপ্রসূভাবে কাজে লাগানো যেত। দুই) আধুনিকতাবাদী এবং অহিংস ধারাগুলো জিহাদী ধারার মাঝে বিলীন হয়ে যেতে পারে।

১. ইসলাম, ইসলামপন্থা এবং ইসলামিক এক্টিভিজম

ক্রাইসিস গ্রুপ এই প্রতিবেদনে ইসলামপন্থাকে ‘ইসলামিক এক্টিভিজমে’র সমার্থক হিসেবেই সংজ্ঞায়িত করছে এবং আগামীতেও করবে। ইসলামিক এক্টিভিজম বলতে এমন কোনো বিশ্বাস, নির্দেশনা, বিধান বা পলিসির প্রতি জোরালো সমর্থন ও প্রচারকে বুঝায়, যা বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে ইসলামী।[1] এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে ইসলামপন্থার অনেকগুলো ধারা লক্ষ করা যায়। কিন্তু প্রায় সকল ধারার মধ্যে একটি অভিন্ন ব্যাপার রয়েছে। সেটা হচ্ছে, তারা সকলেই মনে করে তাদের কর্মকাণ্ড কোরআন-হাদীস ও প্রামাণ্য ব্যাখ্যাগ্রন্থসমূহে বিদ্যমান ইসলামী শিক্ষা এবং ঐতিহ্যের আলোকেই পরিচালিত হচ্ছে।

পশ্চিমা ডিসকোর্সে যে কোনো ধরনের ইসলামিক এক্টিভিজমকে ‘ইসলামপন্থা’, বা ‘রাজনৈতিক ইসলাম’, কিংবা ‘ইসলামী মৌলবাদ’ হিসেবে চিহ্নিত করে কমবেশি একমাত্রিক হিসেবে তুলে ধরা হয়। তারপর ধর্মীয় বিশ্বাস হিসেবে ‘সাধারণ মুসলমানগণ’ ইসলামকে যেভাবে মেনে চলে, তার বিপরীত হিসেবে এগুলোকে উপস্থাপন করা হয়। ৯/১১’র হামলার প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ঘোষণার প্রেক্ষিতে এই প্রবণতা আরো প্রবল হয়ে ওঠে।

আমেরিকায় এই হামলার পর আফ্রিকা ও এশিয়ায় গত তিন বছর ধরে যেসব হামলা সংঘটিত হচ্ছে, তাতে ইসলামিক এক্টিভিজমের ক্ষেত্রে অনেক ‘আশংকাজনক’ পরিবর্তন এসেছে বলে মনে করা হচ্ছে। এ পরিবর্তন ব্যাপক মাত্রায় সহিংসতার দিকে মোড় নিচ্ছে এবং এর পরিণতিতে পাশ্চাত্যের পাশাপাশি অন্যান্য দেশগুলোতেও হামলা হচ্ছে। পাশ্চাত্যের এই একপেশে ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। তাদের অকার্যকর পলিসি গ্রহণের পেছনেও এই ভুল ধারণা দায়ী।

সকল ধারার ইসলামিক এক্টিভিজমকে একই দৃষ্টিতে  দেখার এই চরম প্রবণতা এসেছে মূলত ‘সভ্যতার সংঘাত’ তত্ত্ব  থেকে। এই তত্ত্বে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব তথা ইসলামকে একটা ‘আধা সভ্যতা’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। অর্থাৎ, মনে করা হচ্ছে, সভ্যতা হিসেবে ইসলাম স্বভাবজাতভাবেই একটি একক সমস্যা। অতএব, একে টার্গেট করতে হবে।

এই একই প্রবণতা সাধারণত পাশ্চাত্যের অন্যান্য জটিল তত্ত্বগুলোর ক্ষেত্রেও পরিলক্ষিত হয়। সবক্ষেত্রেই একটি সাধারণ ব্যাপার হলো, পশ্চিমা নেতৃবৃন্দ মুসলমানদেরকে দুটি পক্ষে (dichotomy) ভাগ করে থাকে। এর এক পক্ষে আছে, ‘আধা সভ্য’ ধর্ম হিসেবে ইসলাম ও তার অনুসারী সেই গোবেচারা মুসলমানরা; যাদের নিকট ‘ইসলাম’ আত্মশুদ্ধি অর্জনের উপায়, রাজনৈতিক লক্ষ্য হাসিলের উপায় নয়। আর অপর পক্ষটি হচ্ছে ‘ইসলামপন্থা’ এবং ‘রাজনৈতিক ইসলামে’র অনুসারীরা। যারা মুসলমানদের বিশ্বাসকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ইসলামকে মুষ্ঠিমেয় আন্দোলনকারীর স্বার্থে কাজে লাগাচ্ছে। পাশ্চাত্যের স্বার্থ, এমনকি মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থের বিরুদ্ধে পর্যন্ত ক্ষোভ উসকে দিচ্ছে এবং সমস্যা তৈরি করছে।

নানা কারণেই এই দ্বি-বিভাজন ((dichotomy) যথেষ্ট বিভ্রান্তিকর। প্রথমত, যেসব ধ্যানধারণার (premise) উপর দাঁড়িয়ে ইসলামকে দেখা হয়, তা আসলে অবাস্তব। ইসলাম যতটা শান্তির ধর্ম,[2] তারচেয়েও বেশি আইননির্ভর ধর্ম[3] (religion of law)। এই দৃষ্টিকোণ থেকে খ্রিস্টধর্মের সাথে ইসলামের তেমন মিল নেই, বরং ইহুদী ধর্মের সাথেই এর মিল বেশি। ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মের বার্তাবাহক ভিন্ন হলেও ঐশীবাণী একই – এই ধারণা থেকে ইসলামকে একটি অরাজনৈতিক শান্তির ধর্ম হিসেবে উপস্থাপন করার প্রচেষ্টা করা হয়। অথচ এটি মূলত খ্রিষ্টধর্মের একান্ত স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্য অন্যান্য ধর্মবিশ্বাসে নাও থাকতে পারে এবং ইসলামে তা মোটেও নেই।[4] আইনী ধর্ম (religion of law) হওয়ায় ইসলাম স্বভাবতই সরকারব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত এবং রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট।

দ্বিতীয়ত, ধর্মীয় বিশ্বাসকে নিতান্তই এক ধরনের ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে ‘সাধারণ মুসলমান’দের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়।[5] কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গি মোটেও বাস্তবসম্মত নয়। বরং অধিকাংশ মুসলমানই ইসলামকে ‘একটি সহজাত সামাজিক ব্যাপার’ (an intrinsically public matter) বিবেচনা করে। এটি স্বীকার করে নেয়াটাই অধিক যুক্তিসংগত। কারণ, ইসলাম নিছক মুসলিম উম্মাহর ব্যাপার নয়। ইসলাম অন্যান্যদের নিকটও তার আইনী নির্দেশনা ও নৈতিক মূল্যবোধগুলো প্রচার করার কথা বলে। ফলে এটি ‘সমাজব্যবস্থার একটি রূপরেখা’ হয়ে উঠেছে।[6] এই কারণে অধিকাংশ ‘সাধারণ মুসলমাদের’ মধ্যে একটা অদৃশ্য, কিন্তু শক্তিশালী, প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। সেটা হচ্ছে, সংখ্যালঘু ইসলামপন্থী এক্টিভিস্টদের প্রতি তারা ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে। যেই এক্টিভিস্টদের লক্ষ্য হলো – তারা যেখানে বাস করে সেখানে ধর্মীয় নির্দেশনা অনুযায়ী সামাজিক রীতিনীতি, আইনকানুন এবং সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।

এভাবে ‘সাধারণ মুসলমান’ ও ইসলামী এক্টিভিস্টদের মাঝে কল্পিত দ্বন্দ্ব বেশ দুর্বল হয়ে পড়ছে, যা চাপের মুখে ভেঙ্গে পড়তে বাধ্য। আর সবাই না হলেও অধিকাংশ মুসলমানই যে এখন ব্যাপক অস্থিরতার মধ্যে বসবাস করছে, তা বলাও অত্যুক্তি হবে না।

তৃতীয়ত, এ দ্বি-বিভাজনে ‘রাজনৈতিক ইসলামে’র ধারণাকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তা ঐতিহাসিক তো নয়ই; বরং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ আমেরিকারই উদ্ভাবিত একটি পরিভাষা। ইরান বিপ্লবের সময় থেকে এর ব্যবহার শুরু হয়। ধরেই নেয়া হয়েছে, ‘অরাজনৈতিক ইসলাম’ই মূল ধারা। যেন খোমেনী এসেই ধারাটিকে একদম উল্টে দিয়েছেন। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, ১৯৭৯ সালের বহু আগে থেকেই ইসলাম একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ধর্ম হিসেবে প্রচলিত। ১৯৪৫ থেকে ১৯৭০ সালের মাঝের ক্ষণস্থায়ী সেক্যুলার আরব জাতীয়তাবাদের সময়টুকু ছাড়া ইতিহাসের খুব কম সময়েই ইসলাম অরাজনৈতিক প্রকৃতির ছিল। ওই সময়টুকুতেও যে ইসলাম পুরোপুরি অরাজনৈতিক ছিল, সে কথাও হলফ করে বলা যায় না।

ধর্মীয় ক্ষেত্রকে নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি ইসলামের মধ্যকার আধুনিকতাপন্থী ও জাতীয়তাবাদী ধারাগুলোকে শুধু আরব জাতীয়তাবাদী সরকারগুলোই সমর্থন করতো না, পাশ্চাত্যও করতো। আরব জাতীয়তাবাদের বিরোধিতার অংশ হিসেবে গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের শুরু থেকে পাশ্চাত্য (বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র) সৌদি আরব ও পাকিস্তানের নেতৃত্বে রক্ষণশীল মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে একটি জোট গঠন করতে সমর্থন ও উৎসাহ দিতে থাকে। এর উদ্দেশ্য ছিল পাশ্চাত্যপন্থী প্যান-ইসলামিজমের একটি ধারণা প্রতিষ্ঠা করা, যা জামাল নাসেরের মিশর এবং এর মিত্র দেশগুলোতে (আলজেরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া ও দক্ষিণ সুদান) গড়ে ওঠা আরব জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করবে।

‘রাজনৈতিক ইসলাম’ ও এর সংজ্ঞা নিয়ে তখনই সমস্যা তৈরি হয়েছে, যখন ইসলামী রাজনীতি পশ্চিমাবিরোধী – এবং আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে আমেরিকাবিরোধী – দৃষ্টিভঙ্গি লালন করতে শুরু করে। যাইহোক, এখানে একটা বিভ্রান্তি রয়েছে। সেটা হলো, একদিকে তারা এই ধারণা আরোপ করে – ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ হলো অরাজনৈতিক ইসলামের একটি বিচ্যুত রূপ (যদিও ঐতিহাসিকভাবে এটি সঠিক নয়); আবার তারা এটাও বুঝতে পারে (তবে এই উপলব্ধি গোপন রাখে) – আসলে রাজনৈতিক ইসলামের সাথে পাশ্চাত্যপন্থী রাজনীতির পার্থক্য রয়েছে। এই বিভ্রান্তির ফলে, ‘ইসলাম’কে যখন পাশ্চাত্যের জন্য হুমকি মনে করা হয়েছে, তখনই কেবল একে রাজনৈতিক হিসেবে বিবেচনা করা শুরু হয়েছে।

সবশেষে বলা যায়, ‘রাজনৈতিক ইসলাম’, ‘ইসলামপন্থা’ এবং ‘ইসলামী মৌলবাদ’ – এগুলোকে বাস্তব ক্ষেত্রে এক ও অভিন্ন হিসেবেই এই দ্বি-বিভাজনে ধরে নেয়া হয়। এই অনুমানের মাধ্যমে ইসলামিক এক্টিভিজমে বিদ্যমান চিন্তাধারা, উদ্দেশ্য ও কর্মপদ্ধতির বৈচিত্র্যকে পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া হয়। ‘চরমপন্থী’ এবং ‘উদারপন্থী’ হিসেবে যে দুটি বিভাজন করা হয়, তা প্রকৃতপক্ষে একই ধরনের চিন্তাধারা থেকে উদ্ভূত। এ দুই ধারার মধ্যে উদ্দেশ্য ও পলিসিগত মতপার্থক্যের চেয়েও অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিই অধিকতর শক্তিশালী।

বাস্তবে, এই দ্বি-বিভাজন মুসলমানদেরকে দুই ভাগে ভাগ করতে চায়। এক ভাগ হচ্ছে মডারেট, যাদের ব্যাপারে পাশ্চাত্যের সরকারগুলোর কোনো মাথাব্যাথা নেই। আর অন্য ভাগের ব্যাপারে তাদের আপত্তি রয়েছে। এই প্রবণতাকে এভাবেও বলা যায় – পাশ্চাত্যের চোখে, একটি ধারা তাদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে। আর অন্য ধারাটি নিজেদের ধর্মবিশ্বাসকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকে। তাদেরকে প্রভাবিত করা যায় না। এদের ব্যাপারে সাধারণত পাশ্চাত্যের অনুমান হলো, তাদেরকে কোনোভাবেই ছাড় দেয়া যাবে না, অবশ্যই মোকাবেলা করতে হবে।[7]

এই বিশ্লেষণমূলক তত্ত্বের একটি মৌলিক দুর্বলতা হলো, এটি ইসলামী এক্টিভিজমের ধারাগুলোর স্বাতন্ত্র্য বা বৈচিত্র্যতার কারণগুলো নির্ণয় করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই ধারাগুলো কট্টরপন্থা কিংবা উদারপন্থা দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে নিজস্ব পরিস্থিতি ও চিন্তাধারার আলোকেই গড়ে ওঠেছে। এরমধ্যে মুসলিম সমাজে বিরাজমান সমস্যাগুলোর সমাধানে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও ইসলামী আইনের বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যার উপস্থিতি রয়েছে। এছাড়া কাজের আসল ক্ষেত্রগুলো (রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামরিক ইত্যাদি) কী এবং সে ক্ষেত্রগুলোতে কাজ করার বৈধ ও উপযুক্ত পন্থা কী – এই উভয় ব্যাপার নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ধারণা বিদ্যমান রয়েছে। এসব কারণে ইসলামী এক্টিভিজমের ধারাগুলোর মধ্যে স্বাতন্ত্র্য এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা লক্ষ্য করা যায়।

শিয়া[8]-সুন্নী বিভাজনের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগুলো থেকে এসব ধারার বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতা রয়েছে। এই ধারাগুলো যতটা না ধর্মীয় ঐতিহ্যের সাথে সম্পর্কিত, তারচেয়েও সমসাময়িক ইসলামী এক্টিভিজমের সাথে বেশি সম্পর্কিত। এই ধারাগুলো মূলত সুন্নী ধারার ভেতরে সাম্প্রতিক সময়ে গড়ে ওঠেছে। এগুলো এখন পর্যন্ত স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠতে না পারলেও ধীরে ধীরে বিকশিত হচ্ছে।

২. সুন্নী এক্টিভিজমের প্রধান প্রধান ধারা

এক দশক আগেও সুন্নী এক্টিভিজমের ধারাগুলোকে একসাথে গুলিয়ে ফেলা হতো। এখন এই ধারাগুলোকে আলাদা হিসেবে বিবেচনা করা দরকার। অতীতে কিছু মৌলিক উদ্দেশ্য ও নীতির আলোকে এই ধারাগুলোকে চিহ্নিত করা গেলেও বর্তমানে সেগুলো পরিবর্তিত হয়ে গেছে। এই ধারাগুলো এখন নানা ধরনের পরিস্থিতির চাপ ও নতুন অভিজ্ঞতার আলোকে তাদের কৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে। ফলে এগুলোর মাঝে বিদ্যমান পার্থক্য এখন স্পষ্টভাবে বুঝা যায়। আমরা যদি তাদেরকে বুঝতে চাই এবং নীতিগত অবস্থানকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করতে চাই, তাহলে কাজের ধরন অনুযায়ী এদেরকে কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করা দরকার।

স্থানীয় জটিল পরিস্থিতি এবং ধারাগুলোর পারস্পরিক সূক্ষ্ম পার্থক্যগুলো বিবেচনা করে সমসাময়িক সুন্নী এক্টিভিজমকে আমরা তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করতে পারি।[9]

এগুলোর মাঝে প্রথম ধারাটিকে বলা যায়, ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ (৩ নং সেকশনে এ সংক্রান্ত বিস্তারিত আলোচনা করা হবে)। রাজনৈতিক ইসলামপন্থী আন্দোলনগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো – ধর্মান্তরকরণ প্রচেষ্টার চাইতে রাজনৈতিক পদক্ষেপের প্রতি তারা বেশি গুরুত্ব আরোপ করে থাকে। তারা সহিংসতার পরিবর্তে রাজনৈতিক উপায়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী হতে চায়। তাই তারা রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

উদাহরণ হিসেবে মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুড এবং এর  সাথে সম্পর্কিত কিংবা এর প্রভাবে গড়ে ওঠা দলগুলোর কথা কথা বলা যায়। বিশেষত, জর্ডান ও আলজেরিয়ায় এ ধরনের দল রয়েছে। এছাড়া ইন্দোনেশিয়ায় ‘প্রসপারাস জাস্টিস পার্টি’কেও (Partai Keadilan Sejahtera) এই ধারার দল হিসেবে গণ্য করা যায়। রাজনৈতিক ইসলামের আরেকটু ভিন্ন ধারার দল হিসেবে পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামী, তুরস্কের একেপি এবং মরক্কোর পিজেডি’র কথা বলা যায়। এই দলগুলো মুসলিম ব্রাদারহুডের কাঠামোর বাইরে স্বাধীনভাবে গড়ে ওঠেছে। রাজনৈতিক ইসলামপন্থী আন্দোলনগুলোর একটি সাধারণ নীতি হচ্ছে সহিংস উপায় অবলম্বন না করা। তবে বৈদেশিক দখলদারিত্বের মধ্যে থাকলে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। সে ক্ষেত্রে তারা সশস্ত্র প্রতিরোধসহ নানাভাবে তা মোকাবেলা করে। এর অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে ফিলিস্তিনের আন্দোলন হামাস।[10]

দ্বিতীয় ধারাটিকে বলা যায় ‘দাওয়াতী তৎপরতা’ (৪নং সেকশনে এ সংক্রান্ত বিস্তারিত আলোচনা করা হবে)। এই ধারাটি একইসাথে পুনর্জাগরণবাদী ও মৌলবাদী। এই ধারার আন্দোলনগুলো সাধারণত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এড়িয়ে চলে। তারা রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভে যেমন ইচ্ছুক নয়, তেমনি নিজেদেরকে কোনো দলীয় পরিচয়েও আবদ্ধ করে না। ঈমানের মজবুতি অর্জন এবং নৈতিক শৃঙ্খলা মেনে চলার মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যবদ্ধতা বজায় রাখার লক্ষ্যে দাওয়াতী কাজ পরিচালনা করাই এই ধারার লক্ষ্য।

বর্তমানকালে এই ধারার একটি অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে সালাফী আন্দোলন। এর উৎপত্তি আরব বিশ্বে হলেও বর্তমানে এটি বৈশ্বিক রূপ লাভ করেছে। সাব-সাহারা আফ্রিকা, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে এই ধারার কার্যক্রম রয়েছে। ইউরোপেও এর তৎপরতা বাড়ছে।

এই ধারার আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে তাবলীগ জামায়াত। ১৯২৬ সালে ভারতে এর উৎপত্তি হয়। তারপর এটি সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এখন পর্যন্ত তাবলীগের যথেষ্ট জনপ্রিয়তা থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সালাফীদের তুলনায় তাদের ঔজ্জ্বল্য ম্লান হয়ে পড়েছে।

তৃতীয়টি হচ্ছে জিহাদী ধারা (৫ নং সেকশনে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে)। এই ধারার অনুসারীরা সহিংসতায় বিশ্বাসী। কারণ তারা মনে করে, দারুল ইসলামকে (ইসলামী অঞ্চল – বিশ্বের যেসব অঞ্চল ঐতিহাসিকভাবে মুসলিম শাসিত) সামরিক প্রতিরক্ষা প্রদান করা (কিংবা, প্রয়োজনে দারুল ইসলামের ভূখণ্ড সম্প্রসারণ করা) তাদের দায়িত্ব। তারা আরো মনে করে, কাফের মাত্রই উম্মাহর শত্রু।[11] এই ধারাটির মধ্যে আবার দুইটি প্রধান উপধারা রয়েছে:

১. তথাকথিত সালাফীপন্থী ‘জিহাদী’ ধারা (আল-সালাফিয়্যাহ আল-জিহাদিয়্যাহ): এ ধারার অনুসারীদেরকে আপাতদৃষ্টিতে সালাফী মনে হলেও তারা আসলে উগ্রপন্থী। তারা অহিংস ধারার দাওয়াতী তৎপরতা পরিত্যাগ করে সশস্ত্র জিহাদী তৎপরতায় শামিল হয়েছে।

২. তথাকথিত কুতুবপন্থী এক্টিভিস্ট (আল-কুতুবিয়্যিন): এরা মিশরের সাইয়েদ কুতুবের (১৯০৬–১৯৬৬)[12] র‍্যাডিক্যাল চিন্তাভাবনা দ্বারা প্রভাবিত। তাদের কথা হচ্ছে, ‘দূরের শত্রু’ তথা ইসরাইল ও পাশ্চাত্যের (বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের) বিরুদ্ধে বৈশ্বিক জিহাদ শুরু করার আগে ‘কাছের শত্রু’র অর্থাৎ, ‘কাফের’ হিসেবে বিবেচিত স্থানীয় শাসকদের (যেমন, মিশরের শাসকগোষ্ঠী) বিরুদ্ধে জিহাদ করতে হবে।

গত প্রায় পনের বছর ধরে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। সেটি হলো, এই দুই ধারার জিহাদী গোষ্ঠী দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে পরস্পরের অধিকতর নিকটবর্তী হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় ওসামা বিন লাদেনের আল কায়েদা নেটওয়ার্কটি সালাফীপন্থী জিহাদী ও কুতুবপন্থী চিন্তাধারার সমন্বয়ে নতুনভাবে পরিচিতি লাভ করেছে। বিন লাদেনের প্রধান সহযোগী আইমান আল জাওয়াহিরীর হাত ধরে আল কায়েদায় কুতুবপন্থী চিন্তাধারার প্রবেশ ঘটেছে। জাওয়াহিরী এক সময় মিশরের কুতুবপন্থী গ্রুপ ‘তানজিম আল-জিহাদে’র নেতা ছিলেন। এই দলটি ১৯৭৬ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত মিশর সরকারের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী তৎপরতা পরিচালনা করতো।[13]

এই সকল ধারার মাঝে একমাত্র তাবলীগ জামায়াতই হলো সবচেয়ে শান্ত প্রকৃতির। অন্য ধারাগুলো তাবলীগের মতো প্রচারবিমুখ নয়। বাকি সবগুলো ধারারই রাজনীতির সাথে সংযোগ রয়েছে।

সুন্নী এক্টিভিজমের এই তিনটি ধারার প্রায় সবাই মুসলিম সরকার ও সরকারের অনুগত আলেম এবং একইসাথে আমেরিকা ও অন্যান্য পশ্চিমা সরকারের বিভিন্ন নীতির কঠোর সমালোচনা করে থাকে। তবে তারা স্ব স্ব অবস্থান থেকে এ জাতীয় সমালোচনা করলেও সবার দৃষ্টিভঙ্গিই খুব সংকীর্ণ।

কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে সহিংসতা বৈধ নাকি অবৈধ – তা নিয়ে ইসলামপন্থী আন্দোলনগুলোর সাথে মুসলিম বিশ্বের সেক্যুলারদের মধ্যে যত বিতর্ক রয়েছে, তারচেয়েও বেশি বিতর্ক রয়েছে এসব আন্দোলনগুলোর নিজেদের মধ্যেই। অন্যদিকে, মুসলিম বিশ্ব ও পাশ্চাত্যের মধ্যে এ সংক্রান্ত বিতর্ক আরো কম। মুসলমানদের বিদ্যমান সংকট নিয়ে সুন্নী ইসলামপন্থার তিনটি ধারার মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। এই ভিন্নতার কারণে সংকট উত্তরণের উপায় নিয়ে তাদের প্রস্তাবনাগুলোও আলাদা। ফলে এগুলো নিয়ে তাদের নিজেদের মধ্যে যথেষ্ট দ্বন্দ্ব রয়েছে করে। এগুলো নিম্নরূপ:

  • রাজনৈতিক ইসলামপন্থীরা সালাফীদের সমালোচনা করে থাকে, কিংবা তাদের থেকে অন্তত দূরত্ব বজায় রেখে চলে। তাদের সমালোচনার মূল কথা হচ্ছে, সালাফীরা ব্যক্তিগত আচার-আচরণ নিয়ে খুব বেশি ব্যস্ত থাকে (যেমন, যথাযথ ইসলামী পোশাক, খাওয়া-দাওয়া, উঠা-বসা এবং ঘুমের মতো ছোটখাট বিষয়ের আদব নিয়ে ব্যস্ত থাকা)। এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকায় অধিক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো থেকে মুসলমানদের দৃষ্টি অন্যদিকে সরে যায়।
  • রাজনৈতিক ইসলামপন্থীরা তাদের প্রতিদ্বন্দী কট্টর জিহাদীদেরও তীব্র সমালোচনা করে থাকে। উদাহরণ হিসেবে মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডের কথা বলা যায়। এ দলটি ইসলামী-জাতীয়তাবাদী চেতনাকে ধারণ করে এবং সনাতনী ধারার জিহাদকে সমর্থন করে; যেমন – ফিলিস্তিনের হামাসের জিহাদ। তবে তারা সালাফপন্থী জিহাদী এবং সাইয়েদ কুতুবের জিহাদী প্রবণতাকে সমর্থন করে না। সর্বোপরি, মুসলিম ব্রাদারহুড ও অন্যান্য রাজনৈতিক ইসলামপন্থীরা জিহাদী ধারা থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলে। এর কারণ হচ্ছে, জিহাদীরা আইন সংক্রান্ত ব্যাপারে সালাফীদের মতো (যে দৃষ্টিভঙ্গি মুসলিম ব্রাদারহুডের সাম্প্রতিক দৃষ্টিভঙ্গির সম্পূর্ণ বিপরীত) এবং রাষ্ট্র সম্পর্কে কুতুবপন্থীদের মতো দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে।
  • জিহাদীরা ‘কাছের শত্রু’র বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হলে সালাফী ধার্মিক ইসলামপন্থীরা তাদের সমালোচনা করে বলে, জিহাদীরা আসলে কুতুবপন্থীদের মতো কাজ করছে। এভাবে সালাফীরা অধঃপতিত মুসলিম শাসকদেরকে উগ্র জিহাদী ও কুতুবপন্থীদের কোপানল থেকে রক্ষা করে। কিন্তু ‘দূরের শত্রু’র বিরুদ্ধে জিহাদের ব্যাপারে সালাফীদের তেমন কোনো আপত্তি নেই; যেমন – কাফেরদের আগ্রাসন থেকে উম্মাহকে রক্ষা করার জন্য জিহাদ। তবে এক্ষেত্রে বিরোধিতা করলেও বাস্তব কারণেই করে থাকে, কোনো তাত্ত্বিক কারণে নয়। এসব ক্ষেত্রে যেসব মুসলিম সরকারের সাথে সালাফীদের সম্পর্ক রয়েছে সেই সরকারের পলিসির উপর ভিত্তি করে তাদের বিরোধিতা করা বা না করা নির্ভর করে। ফলে সরকারের যেসব পলিসি জনগণের চোখে সন্দেহজনক, সেগুলো আপাত হয়তো ‘বৈধতা’ পায়, তবে জিহাদীদের সম্পর্কে সালাফীদের এসব সমালোচনার কোনো নৈতিক ভিত্তি নেই।
  • রাজনৈতিক ও দলীয় উদ্দেশ্যে ধর্মকে ব্যবহার করা এবং মুসলিম শাসকদের সাথে দ্বন্দ্বে জড়ানোর জন্য সালাফীরা রাজনৈতিক ইসলামপন্থী, বিশেষত মুসলিম ব্রাদারহুডের তীব্র সমালোচনা করে থাকে। সালাফীদের সাম্প্রতিক অভিধানে সংযুক্ত ‘ইখওয়ানী’ (এর অর্থ হচ্ছে, ইখওয়ানুল মুসলিমিন তথা মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্য) শব্দটি এক ধরনের গালি হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। রাজনৈতিক ইসলামপন্থীদের সমালোচক সালাফীরা এই ক্ষেত্রে রক্ষণশীল সুন্নীদের মতোই মুসলিম শাসকদেরকে (তারা যতো খারাপই হোক না কেন) ভিন্ন চোখে দেখে থাকে। অন্যদিকে, তারা ‘পশ্চিমা’ রাজনৈতিক ধারণাগুলোর (যেমন – নির্বাচন, রাজনৈতিক দল ইত্যাদি) প্রতি বৈরি মনোভাব পোষণ করে। ‘রাজনৈতিক ইসলামে’র ব্যাপারে পাশ্চাত্যের সমসাময়িক বিশ্লেষণগুলোকে তারা ধর্মের এক প্রকার বিকৃতি বলে মনে করে।
  • সালাফীদের মতো জিহাদীরাও একই কায়দায় রাজনৈতিক ইসলামপন্থীদের সমালোচনা করে। অর্থাৎ, তাদের মতে, রাজনৈতিক ইসলামপন্থীরা রাজনৈতিক ও দলীয় উদ্দেশ্যে ধর্মকে ব্যবহার করে এবং পশ্চিমা (‘কোনো কিছু পশ্চিমা হওয়া মানেই তা অনৈসলামী’ বলে তারা মনে করে) রাজনৈতিক মডেলের অন্ধ অনুকরণ করে। তবে জিহাদীরা সাধারণত রাজনৈতিক ইসলামপন্থীদের সাথে দ্বন্দ্বে না গিয়ে পাশ কাটিয়ে যায়।
  • কোনো কোনো জিহাদী গোষ্ঠী বৃহত্তর সালাফী আন্দোলনের অভ্যন্তরীণ বিতর্কে বেশ ভালোভাবেই জড়িয়ে পড়ে। তারা সরকারী সালাফী আলেমদের (যেমন – সৌদি আরবের সরকারী আলেমগণ) পরিবর্তে ভিন্নমতাবলম্বী সালাফী আলেমদের ধারাকে শক্তিশালী করার প্রয়াস চালায়। তবে এই ধরনের প্রচেষ্টাকে ভিন্নমতাবলম্বী সালাফী আলেমদের কেউ কেউ প্রত্যাশা করেন না। এই প্রচেষ্টার ফলে তারা উল্টো বিব্রতবোধ করেন।

এই পরিস্থিতিতে যেটা বেশ লক্ষ্যণীয় এবং বিশেষত পশ্চিমাদের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হচ্ছে, ‘ইসলামী মৌলবাদ’ ও ‘চরমপন্থা’র সাথে ‘রাজনৈতিক ইসলাম’কে একই দৃষ্টিতে দেখা হলেও বাস্তবে এটি একটি রাজনৈতিক ব্যাপার। মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুড, মরক্কোর জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (পিজেডি) এবং তুরস্কের জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি) – এই দলগুলো অনেক বেশি রাজনৈতিক এবং খুবই কম মাত্রার মৌলবাদী চরিত্রের। এই দলগুলো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও রীতিনীতি মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে, অতীতে যেগুলোকে ‘অনৈসলামী’ মনে করে এড়িয়ে চলা হতো। একইসাথে তারা ইসলামী আইনের ব্যাপারে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিকে গ্রহণ করে নিচ্ছে।

এই দলগুলোর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষিত বিবেচনা করলে স্পষ্টতই বুঝা যায়, ঐক্য গড়ে তোলা এবং জনমতকে পক্ষে নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে এ ধরনের রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করা হয়। ইসলামী ঐতিহ্যের ভেতর থেকেই এই ব্যাপারগুলোকে সমকালীন বাস্তবতার সাথে খাপ খাইয়ে নেয়াও এর একটা উদ্দেশ্য।

সালাফীরা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে আগ্রহী নয়। নিজস্ব আলেমদের প্রদত্ত ধর্মগ্রন্থের আক্ষরিক ব্যাখ্যার উপর তারা পুরোপুরি নির্ভরশীল। এটাকে তারা তাদের আলেমদের বায়বীয় কর্তৃত্ব বলেই ধরে নেয়। সালাফী আলেমগণ সাধারণ রাজনৈতিক বিষয়ে আগ্রহ দেখান না (যদিও সাম্প্রতিককালে সৌদী আলেমদের মধ্য থেকে ‘সাহওয়া’ নামে পরিচিত একদল তরুণ প্রজন্মের কিছু বৈশিষ্ট্যকে বিবেচনায় নিলে বুঝা যায়, তাদের মাঝে এক ধরনের পরিবর্তন শুরু হয়েছে)।

তাই এ কথা বলাই যথার্থ হবে, রাজনৈতিক ইসলামপন্থীরা নয় বরং ধর্মীয় কিংবা দাওয়াতী এক্টিভিস্টরাই বর্তমানে আসল মৌলবাদী। আফগান জিহাদ, ফিলিস্তিন ইস্যু এবং সাম্প্রতিককালের ইরাক আগ্রাসনের ফলে সৃষ্ট বিপর্যয় দেখে তারা সালাফী মতাদর্শের উগ্র অনুসারী হয়ে ওঠে; যদিও আধুনিক ধারার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তাদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। এ ব্যাপারে তাদের কোনো আগ্রহও নেই। ফলে তারা সোজা ‘জিহাদী ফর্মুলা’য় আকৃষ্ট হয়ে পড়ে।

মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে এই প্রধান তিনটি ধারার কোনটি টিকে থাকবে, তা অনুমান করা বেশ দুরূহ ব্যাপার। মরক্কো ও তুরস্কে সাম্প্রতিককালে ইসলামী রাজনৈতিক আন্দোলনগুলো উল্লেখযোগ্য সফলতা অর্জন করেছে। তবে মিশরে এখন পর্যন্ত মুসলিম ব্রাদারহুড নিষিদ্ধ রয়েছে এবং আলজেরিয়া ও জর্ডানেও তাদের রাজনৈতিক প্রভাব কমে যাচ্ছে (যদিও ফিলিস্তিনে এখন পর্যন্ত তাদের প্রভাব অক্ষুন্ন রয়েছে এবং ইউরোপের মুসলিম অভিবাসীদের মাঝেও সম্ভবত তাদের প্রভাব বাড়ছে)।

আশির দশক পর্যন্ত সালাফী ধারার প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল শীর্ষে। তখন এর প্রাসঙ্গিকতাও ছিল। পরবর্তীকালে এই ধারাটি ওয়াহাবী মতাদর্শনির্ভর হয়ে পড়ে। ১৯৯০-১৯৯১ সালের দিকে সৌদি ওয়াহাবিজমে মারাত্মক ভাঙ্গন ধরে এবং পরবর্তীতে তা অব্যাহত থাকে। উপরন্তু, সাম্প্রতিককালে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও আধ্যাত্মিক নেতৃত্বে এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়েছে। তাই বলা যায়, আরব বিশ্বে ইতোমধ্যে সালাফী আন্দোলনের পতন শুরু হয়েছে। তবে সাব-সাহারা আফ্রিকা, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ইউরোপে তারা এখন পর্যন্ত বেশ ভালোভাবেই বিস্তৃতি লাভ করছে।

মুসলিম বিশ্বের আনাচে-কানাচে এবং অভিবাসী মুসলমানদের মাঝে সালাফী আন্দোলন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। তরুণদের মধ্যে এর প্রভাব এতো বেশি বিস্তৃত ও গভীর যে, সালাফি-জিহাদপন্থা থেকে এর পার্থক্য করা দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। এই জটিলতা ক্রমে বেড়েই চলছে।

মুসলিম দেশগুলোর রাজনৈতিক সংস্কারের সম্ভাবনা, পাশ্চাত্য ও মুসলিম বিশ্বের মধ্যকার সম্পর্ক, পাশ্চাত্যের দেশগুলোর জাতীয় নিরাপত্তা এবং ইউরোপীয় দেশগুলোতে মুসলিম অভিবাসীদের ইন্টিগ্রেশনের সম্ভাবনার ক্ষেত্রে উপরোল্লিখিত ধারাগুলোর পারস্পরিক দ্বন্দ্বের ফলাফল যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এই প্রভাবগুলো কী কী এবং এসব ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য কী ভূমিকা রাখতে পারে, সে সংক্রান্ত আলোচনা এই প্রতিবেদনের সর্বশেষ সেকশনে (৭নং সেকশন) আলোচনা করা হয়েছে।

৩. সুন্নী রাজনৈতিক ইসলামপন্থা: ‘হারাকাত’ ও ‘হিজব’

বর্তমানের শীর্ষ রাজনৈতিক ইসলামপন্থী দলগুলো প্রথমদিকে (মোটামুটি ১৯২০ থেকে ১৯৭০ এর দশক) ইসলামী দাওয়াতী কাজের পুনর্জাগরণবাদী আন্দোলন[14] হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। তখন এ আন্দোলনগুলো মোটাদাগে মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতো। এক পর্যায়ে এই আন্দোলনগুলো রাজনীতিসচেতন হয়ে ওঠে। এর ফলে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কার্যক্রমের মধ্যে পার্থক্য তৈরি হয়। রাজনৈতিক তৎপরতায় মনোযোগ দেওয়ার ফলে তারা সংগঠনব্যবস্থার সমসাময়িক মডেলগুলো (মূলত ইউরোপীয় মডেল) গ্রহণ করে। অর্থাৎ, রাজনৈতিক দল (আরবীতে একে ‘হিজব’ বলা হয়) গঠন করে। তারপর তারা স্ব স্ব দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। সেই লক্ষ্যে তারা তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও কর্মপদ্ধতি নতুনভাবে গড়ে তোলে।

সময়ের পরিক্রমায় এই বিবর্তনের বেশ গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য রয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যে এই আন্দোলনগুলো নিজেদের স্থানীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। সংক্ষেপে ব্যাপারগুলো এ রকম:

  • ধর্মসহ অন্যান্য ক্ষেত্রগুলো থেকে রাজনীতিকে তারা আলাদা হিসেবে বিবেচনা করে এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তারা প্রচেষ্টা চালায়। এভাবে তারা ধর্ম ও রাজনীতির প্রচলিত পার্থক্যকে ক্রমান্বয়ে উপেক্ষা করার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করছে।
  • এরা (আলজেরিয়া, মিশর, জর্ডান, মরক্কেো, পাকিস্তান, তুরস্ক প্রভৃতি দেশের আন্দোলনগুলো) ‘জাতিরাষ্ট্র’ ধারণাকে তাদের তৎপরতার অন্যতম প্রধান কাঠামো হিসেবে শুধু গ্রহণই করেনি, বরং এ ধারণাকে তারা (ইসলামের দৃষ্টিতে) বৈধ বলেও মনে করে।[15] এর মাধ্যমে তারা রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিত্যাগ করে। রক্ষণশীলরা জাতীয়তাবাদকে (nation) অগ্রহণযোগ্য মনে করে। কারণ তাদের দৃষ্টিতে, এটি উম্মাহ ধারণার বিরোধী।
  • বিদ্যমান শাসনব্যবস্থা উৎখাত করে সম্পূর্ণ ভিন্নধারার ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ (দাওলাহ আল-ইসলামিয়্যাহ) গড়ে তোলার মতো বৈপ্লবিক চিন্তাভাবনা তারা এড়িয়ে চলে। যদিও প্রায়শই তারা সাংবিধানিক সংস্কারের প্রস্তাব করে, তবুও নিজেদের রাজনৈতিক তৎপরতার আইনী বৈধতার কৌশলগত স্বার্থে তারা বিদ্যমান সংবিধানকে মেনে নেয়।

উপরোক্ত তিনটি পয়েন্টের মধ্যে শেষেরটি সবচেয়ে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। অনেক মুসলিম রাষ্ট্রেই এখন ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তৈরি হয়েছে। তবে যেসব রাষ্ট্রে তাদের কার্যক্রমের বৈধতা কমবেশি চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে সেখানে এই শেষোক্ত অবস্থানটি লক্ষ্য করা যায়। কিংবা এটাও বলা যায়, এই অবস্থান হলো তাদের সংস্কারবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। মুসলিম ব্রাদারহুড কর্তৃক জর্ডানে প্রতিষ্ঠিত ‘ইসলামিক অ্যাকশন ফ্রন্ট’ হাশেমী রাজতন্ত্রকে শুধু মেনেই নেয়নি, বরং ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকেই রাজতন্ত্রকে তারা বৈধ মনে করে।[16] মরক্কোর পিজেডি’র ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার দেখা গেছে। সেখানকার রাজার ‘আমীরুল মুমেনীন’ পদবীকে স্বীকৃতি দিয়ে ‘রাজকীয়’ কর্তৃত্বের প্রতি পিজেডি সুস্পষ্ট সমর্থন দেখিয়েছে।[17] অন্যদিকে, মুসলিম ব্রাদারহুড ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে নিছক ‘প্রজাতান্ত্রিক’ মিশরকেই স্বীকৃতি দেয়নি, সরকারব্যবস্থাকেও স্বীকার করে নিয়েছে।[18] তুরস্কের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল একেপি’ও একইভাবে কামালপন্থী সংবিধানের সেক্যুলার ও প্রজাতান্ত্রিক দিকগুলোকে স্পষ্টতই মেনে নিয়েছে।[19]

এর ফলাফল এই দাঁড়িয়েছে, মুসলিম বিশ্বের বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থার বিপরীতে ইসলামী রাজনৈতিক আন্দোলনগুলো একসময় যে ধরনের সুনির্দিষ্ট ও কাঙ্খিত ‘ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা’র ধারণা প্রস্তাব করতো, এখন তারা আর সেই অবস্থানে নেই। বরং তারা স্বীকার করে নিচ্ছে, কোরআন-হাদীসে ‘ইসলামী রাষ্ট্রে’র স্পষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই। ফলে ইসলামী রাষ্ট্রের নানাবিধ রূপরেখা থাকতে পারে। পাশাপাশি, ধর্মগ্রন্থের এই সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করার ফলে এই আন্দোলনগুলো ‘ইসলাম হচ্ছে সমাধান’, ‘কোরআন আমাদের সংবিধান’ জাতীয় জনপ্রিয় শ্লোগানগুলো এখন আর ব্যবহার করছে না। প্রথম হিজরী শতাব্দীর তৎকালীন আরবের ইসলামী সমাজের অনুরূপ রাজনৈতিক মডেল বাস্তবায়ন করার যে সেকেলে ধ্যানধারণা রক্ষণশীল ইসলামপন্থী আন্দোলনগুলো পোষণ করে, রাজনৈতিক ইসলামপন্থীরা তা করে না।

এর পরিণতিতে, রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গির সাথে এই আন্দোলনগুলোর প্রকাশ্য বিরোধ দিন দিন বেড়েই চলছে। ‘দাওলাহ আল-ইসলামিয়্যাহ’ (ইসলামী রাষ্ট্র) প্রতিষ্ঠার বৈপ্লবিক ও ইউটোপিয়ান প্রকল্প পরিত্যাগ করার পর তারা ন্যায়বিচার (আদল), মুক্তি (আল-হুররিয়্যাহ) – এ জাতীয় বিষয়গুলোর উপর জোর দিচ্ছে। তাদের দাবি অনুযায়ী, শরীয়াহ সম্পর্কিত বুঝজ্ঞানই তাদেরকে এ বিষয়গুলোর উপর জোর দেয়ার পেছনে ভূমিকা রাখছে। অর্থাৎ, শরীয়াহকে ভিত্তি ধরেই এখন পর্যন্ত ইসলামপন্থী রাজনৈতিক এজেন্ডা ও বক্তব্য নির্মিত হচ্ছে। তবে শরীয়াহ সম্পর্কে এই দৃষ্টিভঙ্গি এখন দুটি বিষয়ের আলোকে তৈরি হচ্ছে।

প্রথমত, এই আন্দোলনগুলো স্বীকার করে নিয়েছে – সপ্তম শতাব্দীর মদীনায় যে ধরনের ইসলামী সমাজ ছিল, হুবহু সে ধরনের সমাজ গড়ার প্রচেষ্টার চেয়ে মুসলমানদের এখন দরকার ‘বর্তমান সময়ে বসবাস উপযোগী’[20] সমাজ গঠন। এই উপলব্ধির ফলে তারা ইজতিহাদের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিচ্ছে। অর্থাৎ, মুসলিম দেশগুলোর জন্য আইন হিসেবে শরীয়াহর মূলনীতিগুলোই সর্বোৎকৃষ্ট – এই বক্তব্য তুলে ধরাকে তারা গুরুত্ব দিচ্ছে।[21]

দ্বিতীয়ত, ইজতিহাদের গুরুত্বকে স্বীকার করে নেয়ায় তারা স্বভাবতই আলাপ-আলোচনার প্রয়োজনীয়তাকেও স্বীকার করে নিয়েছে। এর ফলে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শ্রেণীর প্রতিনিধিদের (যেমন – সংসদ সদস্য) কাছ থেকে মতামত গ্রহণ করাকে তারা গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। ইসলামপন্থী রাজনৈতিক আন্দোলনগুলোর রাজনৈতিক চিন্তার এই বিবর্তন মুসলমানদের রাজনৈতিক চিন্তাধারায় বিদ্যমান ধর্মতাত্ত্বিক ধারণা থেকে একদম আলাদা। ধর্মতত্ত্ব অনুযায়ী, আল্লাহই কেবল সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। সে তুলনায় ইসলামপন্থী রাজনৈতিক আন্দোলনগুলো কমবেশি গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণা পোষণ করে। গণতন্ত্রে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হলো জনগণ।[22]

মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুড এবং ব্রাদারহুডের সাথে সংযুক্ত কিংবা নিদেনপক্ষে তাদের দ্বারা প্রভাবিত বিশ্বের অন্যান্য আন্দোলন ও রাজনৈতিক দলগুলোর সবাই স্বীকার না করলেও অনেকের ক্ষেত্রেই এই বিবর্তনকে একটি ঐতিহাসিক ‘ইউ-টার্ন’ হিসেবে বিবেচনা করা যায়।

১৯২৮ সালে হাসান আল বান্নার (১৯০৬–১৯৪৯) হাত ধরে মুসলিম ব্রাদারহুড প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল পাশ্চাত্যবিরোধী, রক্ষণশীল এবং অনুদার। ইসলামের রাজনৈতিক ধারণাকে তিনি গণতন্ত্রের বিপরীতে দাঁড় করিয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন, অন্তর্নিহিতভাবেই গণতন্ত্র একটি পাশ্চাত্য ধারণা, ফলে এটি অনৈসলামী।

সাইয়েদ কুতুবের চিন্তাধারায় প্রভাবিত হয়ে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে মুসলিম ব্রাদারহুডের দৃষ্টিভঙ্গি আরো বেশি সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। তিনি ব্রাদারহুডকে তৎকালীন জাতীয়তাবাদী শাসক জামাল আব্দেল নাসেরের বিরোধিতায় মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন। সাইয়েদ কুতুব যুক্তি দেখিয়েছেন, মুসলিম বিশ্ব এক নতুন ধরনের জাহেলিয়াতে পতিত হয়েছে। প্রাক-ইসলামী যুগের ঐতিহাসিক জাহেলিয়াতের চেয়ে এটা একটু ভিন্ন ধরনের। জাতীয়তাবাদের মতো মতাদর্শ মুসলিম বিশ্বে জাহেলিয়াতের প্রসার ঘটাচ্ছে। জাতীয়তাবাদ আল্লাহর সার্বভৌমত্বের পরিবর্তে জনগণের সার্বভৌমত্বকে প্রতিস্থাপিত করেছে। আর তাই জাতীয়তাবাদী শাসনব্যবস্থা ইসলামসম্মত নয়।[23] সে কারণে জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা বাধ্যতামূলক না হলেও অবৈধ নয়।

সাইয়েদ কুতুবের মৃত্যুর পর ব্রাদারহুডের নেতাকর্মীরা তার অতি বৈপ্লবিক ধ্যানধারণা পরিত্যাগ করে পুনরায় হাসান আল বান্নার তুলনামূলক কম বৈপ্লবিক চিন্তাধারায় ফিরে আসে এবং অহিংস ও ধীরে চলার নীতি অবলম্বন করে।[24] এর মাধ্যমে তারা মিশর রাষ্ট্রের সাথে এক ধরনের অস্থায়ী সমঝোতামূলক অবস্থানে পৌঁছার চেষ্টা করে যাচ্ছে। বিগত তিন দশক ধরে তাদের এই প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

মুসলিম ব্রাদারহুড হাসান আল বান্নাকে সাধারণত তাদের অন্যতম তাত্ত্বিক গুরু হিসেবে মেনে চলে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তারা বান্নার চিন্তাধারার কিছু মৌলিক দিককে নীরবে পরিত্যাগ করে পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে গ্রহণ করার ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ  করছে।[25] এটা তাদের একটি চলমান প্রক্রিয়া, যা তারা প্রকাশ্যে স্বীকারও করে। বান্নার চিন্তাধারার অনুদার (illiberal) দিকগুলো নিয়ে তারা একটা মীমাংসায় পৌঁছার চেষ্টা করছে। অবশ্য আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বান্নার অসামান্য অবস্থানের কারণে এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ বেশ জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পাশ্চাত্য ধ্যানধারণায় ‘রাজনৈতিক ইসলাম’কে মোটাদাগে মৌলবাদী ও গণতন্ত্রবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির সমতুল্য মনে করা হলেও বাস্তবচিত্র ভিন্ন। মূলধারার রাজনৈতিক ইসলামিক এক্টিভিজমগুলো আধুনিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলোর সাথে নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নেয়া কিংবা এগুলোকে অন্তত বিবেচনা করার বিষয়টি প্রমাণ করতে পেরেছে। একটি বিমূর্ত ধারণা হিসেবে ইসলাম ও গণতন্ত্রের মূলনীতিগুলোর মধ্যে কোনো ধরনের সাদৃশ্য থাকা কিংবা না থাকার সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। মূলত তিনটি বাস্তব কারণে তাদের মধ্যে এই পরিবর্তন এসেছে। সেগুলো হলো:

১. সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বজায় রাখার পাশাপাশি যথাসম্ভব তা আরো বৃদ্ধি করা।

২. যেসব রাষ্ট্রে এ আন্দোলনগুলোর কার্যক্রম রয়েছে সেখানকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সাথে মানিয়ে চলা।

৩. অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে পলিসি ঠিক করা (এরমধ্যে রয়েছে তাদের অতীতের গণতন্ত্রবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে পাশ্চাত্যের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া। অন্যদিকে, ইসলামপন্থীদের রাজনৈতিক অধিকার রক্ষায় গণতান্ত্রিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর ইতিবাচক অবদান)।

তবে অতীতে কোনো কোনো রাজনৈতিক ইসলামী আন্দোলন যে কিছু অগণতান্ত্রিক কৌশল ও অবস্থান গ্রহণ করেছিল, তা ভুলে গেলে চলবে না। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৭৭ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর জেনারেল জিয়াউল হক যে কঠোর সামরিক শাসন কায়েম করেছিলেন, জামায়াতে ইসলামী সেটাকে সমর্থন ও বৈধতা দিয়েছিল।[26] একইভাবে, সুদানের ন্যাশনাল ইসলামিক ফ্রন্টের নেতা হাসান আল তুরাবী একদল সেনা কর্মকর্তার সাথে হাত মেলান এবং ১৯৮৯ সালে জেনারেল ওমর আল বশির ও তার অনুগত কর্মকর্তাদের সাথে জোট বেঁধে ক্ষমতায় আসেন।[27]

সেনাবাহিনীর সাথে অগণতান্ত্রিক জোট বাঁধার এই কৌশলগুলোর ব্যর্থতার ফলেই সম্ভবত অন্যান্য দেশের ইসলামী রাজনৈতিক আন্দোলনগুলো গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণাকে গ্রহণ করে নিতে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। তবে এ ধরনের অগণতান্ত্রিক জোট গঠনের পেছনে যে আকাঙ্খা কাজ করেছিল, পরিস্থিতি তৈরি হলে তা পুনরায় ঘটবে না – এমনটা আশা করাও নিশ্চয় উচিত হবে না।

রেফারেন্স ও নোট:

[1] ক্রাইসিস গ্রুপের আগের প্রতিবেদনগুলোতে ইসলামপন্থাকে আরো সংকীর্ণভাবে ‘রাজনৈতিক রূপে ইসলাম’ (Islam in political mode) হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু এই গবেষণা প্রতিবেদন থেকে এটা স্পষ্ট বুঝা গেছে, ইসলামপন্থা নিয়ে আগের সংজ্ঞাটির দুটি সমস্যা ছিল। প্রথমত, ধরে নেওয়া হয়েছিল, ইসলাম স্বভাবতই রাজনৈতিক নয়। অথচ এখন পর্যন্ত দেখা গেছে, ইসলাম স্বভাবতই শাসনকার্য সম্পর্কিত ব্যাপারগুলো নিয়ে আগ্রহী। তারমানে, ইসলাম আসলে রাজনৈতিক। দ্বিতীয়ত, আগের প্রতিবেদনগুলোতে ধরে নেওয়া হয়েছিলো, ইসলামপন্থার সকল ধারাই রাজনৈতিক। কিন্তু ব্যাপারটি আসলে তা নয়। রাজনৈতিক, দাওয়াতী ও সহিংস ধারাগুলো তাৎপর্যপূর্ণভাবে একে অপরের থেকে আলাদা। ক্রাইসিস গ্রুপের আগের প্রতিবেদনগুলোতে, বিশেষ করে উত্তর আফ্রিকার প্রেক্ষাপটে, ইসলামপন্থার নানান ধারার প্রভাব এবং তাদের মধ্যকার বিবর্তনের যে বাস্তব চিত্র উপস্থাপন করা হয়েছিল, সে সম্পর্কে বর্তমান প্রতিবেদনে আরো বিস্তারিত বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকা নিয়ে ক্রাইসিস গ্রুপের পূর্ববর্তী প্রতিবেদনগুলোর জন্য দ্রষ্টব্য: Islamism in North Africa I: The Legacies of History, 20 April 2004; Islamism in North Africa II: Egypt’s Opportunity, 20 April 2004; Crisis Group Middle East and North Africa Report N°29, Islamism, Violence and Reform in Algeria: Turning the Page, 30 July 2004; also, Crisis Group Asia Report N°83, Indonesia Backgrounder: Why Salafism and Terrorism Mostly Don’t Mix, 13 September 2004, and Crisis Group Middle East Report N°31, Saudi Arabia Backgrounder: Who Are the Islamists?, 21 September 2004.

[2] ২০০১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর কংগ্রেসের এক যৌথ অধিবেশনে প্রেসিডেন্ট বুশ এই পরিভাষাগুলো ব্যবহার করেছিলেন। ‘ইসলামের শান্তিপূর্ণ শিক্ষার’ প্রতি নির্দেশ করে তিনি বার বার বলছিলেন, ‘ইসলামের মর্মবাণী মানুষকে ভালো এবং শান্তিপূর্ণ’ হতে শেখায়। এ বক্তব্য দেয়ার পর খ্রিষ্টান মৌলবাদীরা তার কড়া সমালোচনা করে। তারা বরং উল্টো দাবি করে, ইসলাম কার্যত ও স্বভাবতই একটি আগ্রাসী ও যুদ্ধপ্রবণ ধর্ম। ইসলাম নিয়ে এই দুই প্রকার বক্তব্যের উভয়টিই ভুল ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ধর্ম হিসেবে ইসলাম খ্রিষ্টান ধর্মের চেয়ে কোনো মাত্রায় কম বা বেশি ‘শান্তিপূর্ণ’ – এমনটা বলা যাবে না। উভয় ধর্মই ভালো-মন্দের লড়াইয়ের ব্যাপারে আপসহীন ধারণা পোষণ করে। উভয় ধর্মই স্রষ্টার নামে পরিচালিত অসংখ্য যুদ্ধকে বৈধতা দিয়েছে। ধর্ম দুটির মধ্যে ধর্মতাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব যেমন রয়েছে, আইনী কাঠামোগত দ্বন্দ্বও রয়েছে। খ্রিষ্টধর্ম ত্রিত্ববাদ ও যিশুখ্রিষ্টের ঐশ্বরিক ক্ষমতার উপর বিশ্বাস করে, অন্যদিকে ইসলাম একত্ববাদের উপর দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে। আবার, এ দুটি ধর্মের আরেকটি মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে – ইসলামের একটি পরিপূর্ণ আইনী কাঠামো রয়েছে, যা সরাসরি আল্লাহর কাছ থেকে প্রেরিত, যেগুলো সকল মুসলমান মেনে চলতে বাধ্য। অন্যদিকে খ্রিষ্টান ধর্মেও ‘দশটি বিধান’ (Ten Commandments) রয়েছে, যা স্রষ্টা কর্তৃক প্রেরিত বলে মনে করা হয় এবং যে ব্যাপারে খ্রিষ্টধর্মে কোনো দ্বিমত নেই।

[3] এটা ইসলামের নিজস্ব সংজ্ঞা নয়। বাস্তবতার আলোকে এটা ধরে নেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে সার্বজনীন কোনো সংজ্ঞা নেই। বাস্তবে মুসলমানরা তাদের ধর্মকে কীভাবে দেখে, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। আর মুসলমানদের এ উপলব্ধির ব্যাপারটি সময় ও পরিস্থিতি ভেদে পরিবর্তিত হয়। সাম্প্রতিককালে অনেক মুসলমানই ইসলামকে নিছক একটি আইনী ধর্ম (religion of law) হিসেবে সংজ্ঞায়িত করার ব্যাপারে আপত্তি করছে। কিছু মুসলিম চিন্তাবিদ ধর্মগ্রন্থে বিদ্যমান আইনী নির্দেশগুলোর তাৎপর্যকে কিছুটা কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন, এমনকি অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করছেন (এ নিয়ে পড়ুন: নাজিহ আইয়ুবীর Political Islam: Religion and Politics in the Arab World (London and New York , 1991), pp. 201-213 )। তবে খুব কম সংখ্যক  মুসলমানই এরকম মনোভাব পোষণ করে। ইসলামের জনপ্রিয় সুফী ধারায় ধর্মের আধ্যাত্মিক দিককে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। দুনিয়াবী আইন ও রীতিনীতির চেয়ে  স্রষ্টা সম্পর্কিত জ্ঞানের (প্রায়শই যা গুপ্ত ও আধ্যাত্মিক) সন্ধান করাকেই সুফি ধারায় ব্যক্তির জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। কিছু আধুনিকতাবাদী মুসলিম চিন্তাবিদ ধর্মগ্রন্থের আইনী বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন তুললেও সুফীরা তা করে না। আর এ কারণেই অনেক প্রসিদ্ধ আলেম সুফী ধারার সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও তাদের পক্ষে ফিকাহর উপর পাণ্ডিত্য অর্জন করা সম্ভব হয়েছে।

[4] রোমান সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক কাঠামোতে খ্রিষ্টর্ধমের যাত্রা শুরু হয়েছিল। যেখানে চার্চ ছিল কমবেশি নিপীড়িত। খ্রিষ্টধর্ম এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। অন্যদিকে এমন একদল মুসলমান নিয়ে ইসলামের যাত্রা শুরু হয়েছিল, যাদের মাধ্যমে ইসলাম নিজেই একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে গড়ে ওঠতে চেয়েছে। এই চাওয়া বেশ দ্রুত বাস্তবায়িত হয়। তারপর আরো দ্রুততার সাথে তা প্রসার লাভ করে। আশেপাশের ভূখণ্ড ও মানুষকে ইসলামের আইনী কাঠামো ও সরকারব্যবস্থার অধীনে নিয়ে আসার পাশাপাশি তাদেরকে ইসলাম ধর্মেও দীক্ষিত করে। ঈশ্বর ও সিজারকে পৃথকীকরণ করাই ছিল রাজনীতি সম্পর্কে খ্রিষ্টধর্মের মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি। খ্রিষ্টধর্মের জন্মলগ্ন থেকে প্রথম তিন শতক পর্যন্ত এই দৃষ্টিভঙ্গি বহাল ছিল। অন্যদিকে, ইসলামের প্রাথমিক কাল থেকেই এ ধরনের কোনো ধারণা মুসলমানদের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত ছিল।

[5] ‘সাধারণ মুসলমানদের’ দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে এমন ভ্রান্ত ধারণা মূলত স্বয়ং ইসলাম সম্পর্কে ভুল ধারণারই পরিণতি। যা ইতোমধ্যে উল্লেখ করা  হয়েছে।

[6] Ernest Gellner, Muslim Society (Cambridge, 1981), p. 1.

[7] ফাওয়াজ জর্জেসের মতে, ৯/১১-র আগে আমেরিকায় ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ সংক্রান্ত বিতর্কে এর পক্ষে-বিপক্ষে আমরা দুটি শ্রেণীকে দেখতে পাই – উদারপন্থী (the accommodationists) এবং উগ্রপন্থী (the confrontationalists); দেখুন জার্জেসের লেখা বই America and Political Islam: Clash of Cultures or Clash of Interests? (Cambridge, 1999), chapter 2। মজার ব্যাপার হলো, ইসলাম স্বয়ং ঈমানদার ও মুনাফেক তথা ভালো-মন্দের যে ধরনের মৌলিক পার্থক্য করেছে, পাশ্চাত্যের সরকারগুলো র‍্যাডিক্যাল ও মডারেট ভাগ করার মাধ্যমে একই ধরনের দ্বি-বিভাজন করছে।

[8] শিয়া এক্টিভিজম সম্পর্কে জানতে সেকশন ৬ দেখুন।

[9] পৃথিবীর অধিকাংশ (প্রায় ৮০ থেকে ৯০ ভাগ) মুসলমানই সুন্নী। বাকীদের মধ্যে অধিকাংশই শিয়া ধারার অনুসারী। এরমধ্যে একমাত্র ইরানে শিয়ারা সংখ্যাগরিষ্ট। এছাড়া আজারবাইজান, বাহরাইন ও ইরাকে সর্বাধিক সংখ্যক শিয়া মুসলমানদের বাস। বর্তমানে লেবানন, কুয়েত, সৌদি আরব, আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং ভারতে কিছু শিয়া মুসলমান বসবাস করছে।

[10] মুসলিম ব্রাদারহুডের ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাস জিহাদী ক্যাটাগরির পরিবর্তে ‘রাজনৈতিক ইসলামে’র অন্তর্ভুক্ত। তারা ব্রাদারহুডের ‘আধুনিকতাবাদী ইসলামী’ চিন্তাধারাকে গ্রহণ করে। এ কারণে তারা সাইয়েদ কুতুবপন্থী জিহাদী এবং সালাফী জিহাদী আন্দোলনগুলো থেকে বেশ আলাদা। তাদের সশস্ত্র প্রতিরোধকে অবশ্যই জিহাদ বলা যায়, যেহেতু তারা মনে করে (সেটা সঠিক বা ভুল যাই হোক না কেন) পরিস্থিতি (অর্থাৎ ইসরাইলী দখলদারিত্ব) তাদেরকে বাধ্য করেছে। কুতবপন্থী জিহাদী ও সালাফী জিহাদীরা অহিংস রাজনৈতিক তৎপরতার পরিবর্তে সশস্ত্র জিহাদকে যেমন প্রাধান্য দেয়, হামাসের ক্ষেত্রে ব্যপারটা তেমন নয়। ইসলামপন্থীদের বাইরে অন্যান্য শক্তির সাথেও হামাস মিত্রতা স্থাপন করতে আগ্রহী। অমুসলিম ফিলিস্তিনীদের প্রতি তাদের কোনো প্রকাশ্য সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নেই (যদিও ইহুদীবাদ ও ইসরাইলবিরোধী প্রবণতা তাদের মধ্যে পুরোমাত্রায় বিদ্যমান)। জিহাদীদের মাঝে এ ধরনের উদারতা দেখা যায় না।

[11] এখানে উল্লেখিত তিন ক্যাটাগরির কোনোটাতেই যে ধারাটি পড়ে না সেটা হচ্ছে ‘হিজবুত তাহরীর আল ইসলামী’। গোপনে তৎপরতা চালানোর লেনিনীয় মডেল দ্বারা দলটি অনুপ্রাণিত হলেও একে প্রচলিত ধারার রাজনৈতিক গোষ্ঠী বলা যায় না। আবার এটি ধর্মীয় দাওয়াতী তৎপরতার সাথেও যুক্ত নয়, এমনকি জিহাদী গ্রুপও নয়। দলটি ১৯৫২ সালে জেরুজালেমে প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরু থেকেই ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে দলটির কার্যকর কোনো যোগাযোগ নেই। এই দলটি এমন এক ধরনের আন্দোলন গড়ে তুলেছে, যার কর্মকাণ্ড মুসলমানদের কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে সীমাবদ্ধ নয়। এদিক দিয়ে এটা অনেকটা তাবলীগ জামায়াতের মতো। দলটি বিশ্বব্যাপী তাদের কর্মকাণ্ড বিস্তার করতে চায়। ইসলামী খেলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য তারা প্রচারণা চালায়। জিহাদী গ্রুপগুলোরও একই ধরনের উদ্দেশ্য রয়েছে। তবে হিজবুত তাহরীর জিহাদীদের মতো সহিংস তৎপরতা থেকে বিরত থাকে। ব্রিটেন ও অন্যান্য ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মুসলিম শিক্ষার্থীদের মাঝে এরা বেশ জনপ্রিয়। সম্প্রতি মধ্য এশিয়াতেও এদের কর্মকাণ্ড লক্ষ করা যাচ্ছে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত দেখুন: Crisis Group Asia Report N°58, Radical Islam in Central Asia: Responding to Hizb ut-Tahrir, 30 June 2003.

[12] সাইয়েদ কুতুবের চিন্তা ও প্রভাব সম্পর্কিত আলোচনার জন্য দেখুন: Crisis Group Briefing, Islamism in North Africa I, op. cit.

[13] দেখুন ক্রাইসিস গ্রুপের ব্রিফিং: Islamism in North Africa II, op. cit.

[14] আন্দোলন শব্দের আরবি হচ্ছে ‘হারাকা’, যার বহুবচন ‘হারাকাত’। এই পরিভাষাটি সাধারণত ইসলামী রাজনৈতিক আন্দোলন ও দলগুলো (বিশেষ করে মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডের আদর্শে উদ্বুদ্ধ দলগুলো) ব্যবহার করে থাকে। উদাহরণ হিসেবে আলজেরিয়ার ‘হারাকাত আল-মুজতামাস সিলম’ (Movement of Society for Peace, MSP), ‘হারাকাত আন-নাহদা’ (Movement of the Renaissance, MN) ও ‘হারাকাত আল-ইসলাহ আল-ওয়াতানী’ (Movement for National Reform, MRN) এবং ফিলিস্তিনের ‘হারাকাত আল-মুকাওয়ামাহ আল-ইসলামিয়্যাহ’র (Islamic Resistance Movement) কথা বলা যায়। শেষোক্তটি এর আরবি সংক্ষিপ্তরূপ ‘হামাস’ হিসেবেই অধিক পরিচিত। অন্যান্য ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয়তাবাধী ও সেক্যুলারদের মতো ‘হিজব’ (পার্টি) শব্দটি ব্যবহার করে থাকে। কোনো কোনো দল ‘জাবহা’ (ফ্রন্ট) শব্দটিও ব্যবহার করে।

[15] এই দিক থেকে বলা যায়, এই আন্দোলনগুলো ইসলামপন্থা ও জাতীয়তাবাদের মাঝে ঐতিহাসিক সমঝোতার একটি নিছক পরিণতি মাত্র নয়। বরং আন্দোলনগুলো স্বয়ং নিজেদেরকে জাতীয়তাবাদী ধারার উত্তরাধিকারী হিসেবে দাবি করে। ইতোমধ্যে তারা জাতীয়তাবাদী ধ্যানধারণা ও চেতনার প্রকাশ ঘটাতে শুরু করেছে। দেখুন Olivier Roy, Globalised Islam: The Search for a New Ummah (New York, 2004), pp. 62-65: “From Islamism to nationalism”.

[16] দেখুন Jennifer Noyon, Islam, Politics and Pluralism: Theory and Practice in Turkey, Jordan, Tunisia and Algeria (London, 2004), chapter 7: “Islam and the Jordanian monarchy”, আরো দেখুন Gilles Kepel, Jihad: Expansion et Déclin de l’Islamisme (Paris, 2000), pp. 326 ff.

[17] ক্রাইসিস গ্রুপের সাথে পিজেডি’র সহ-সাধারণ সম্পাদক সাদ উদ্দীন আল-উসমানীর সাক্ষাৎকার, রাবাত, ২৩ জুলাই ২০০৩।

[18] দেখুন ক্রাইসিস গ্রুপের ব্রিফিং Islamism in North Africa II, op. cit.

[19] দেখুন Kepel, op. cit., part 3, chapter 11: “Du salut à la prospérité: la laïcisation contrainte des islamistes turcs”, and Noyon, op. cit., chapter 6: “Islam and secularism in Turkey”. আরো দেখুন “The AKP, Turkey and Islamic Politics”, The Estimate: Political and Security Intelligence Analysis of the Islamic World and its Neighbours, Vol. XIV, No. 20, 4 November 2002.

[20] ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদন Islamism, Violence and Reform in Algeria, op. cit..

[21] এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক আন্দোলনগুলো কোরআন-হাদীসের আক্ষরিক অর্থ গ্রহণ করার প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসছে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ও বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে চালু হওয়া ‘ইসলামিক-মডার্নিস্ট’ আন্দোলনে প্রত্যাবর্তন করছে। এই আন্দোলনের শীর্ষ তাত্ত্বিক ছিলেন মিশরের মোহাম্মদ আব্দুহ (১৮৪৯–১৯০৫)। আধুনিক সময়ে ইসলামী আইন প্রয়োগের সমস্যাগুলো নিয়ে তিনি তখনই ভেবেছিলেন। ‘ইসলামিক-মডার্নিস্ট’ আন্দোলন ও আব্দুহ সম্পর্কে আরো জানতে দেখুন ক্রাইসিস গ্রুপের ব্রিফিং Islamism in North Africa I, op. cit.

[22] দেখুন ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদন Islamism, Violence and Reform in Algeria, op. cit.

[23] সাইয়েদ কুতুবের চিন্তা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে মিশরসহ নানা দেশে কিছু উগ্রপন্থী ধারা ও গ্রুপ গড়ে ওঠে। তাদের কাছে ‘তাকফীর’ ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়। ‘তাকফীর’ হচ্ছে কাউকে বা কোনোকিছুকে ‘কুফর’ হিসেবে সাব্যস্ত করে তাকে বাতিল ঘোষণা করা।

[24] ব্রাদারহুড প্রভাবিত ফিলিস্তিনী সংগঠন হামাসের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য নয়।

[25] এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময়ের ‘ইসলামিক-মডার্নিস্ট’ আন্দোনকে একটি অবয়ব দান করেছে।

[26] Mumtaz Ahmad, “Islamic Fundamentalism in South Asia: the Jamaat-i-Islami and the Tablighi Jamaat of South Asia”, in Martin E. Marty and R. Scott Appleby (eds.), Fundamentalisms Observed (Chicago and London, 1991), pp. 457-530: 479-485.

[27] Gilles Kepel, op. cit., part 2, chapter 6: “Le putsch militaire des islamistes soudanais”.

এ ধরনের আরো লেখা