হালাল হলেই কি ইসলামিক হবে? ইসলামী নৈতিক চেতনার গুরুত্ব

এডিটর’স নোট: ‘রিসার্চ সেন্টার ফর ইসলামিক লেজিসলেশন অ্যান্ড এথিকস’ (সিআইএলই) তাদের ওয়েবসাইটে ২০১৩ সালে Halal but un-islamic, restoring the Ethical Core of Islam শীর্ষক একটি আর্টিকেল প্রকাশ করে। লিখেছেন শরীফ হাসান আল বান্না। সিএসসিএস-এর পাঠকদের জন্য এটি অনুবাদ করেছেন মাসউদুল আলম।

*****

আইন ও নৈতিকতার মধ্যে যে বিশাল ফারাক রয়েছে, গত তিন’শ বছরের মুসলিম ইতিহাসে তা আরো স্পষ্ট হয়েছে। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে ইসলামের নৈতিক অবস্থানের সাথে আইনশাস্ত্র ক্রমান্বয়ে সামঞ্জস্যহীন হয়ে পড়েছে। ‘হালাল’ নয়তো ‘হারাম’ – ইসলামী ধারণাগুলো এই সংকীর্ণ আইনী নিক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।

আমাদের ফিকাহ শাস্ত্রের প্রচলিত ও শক্তিশালী ধারার ঐতিহ্য হচ্ছে সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়কে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করা। যার মাধ্যমে চারপাশের জীবন ও জগতকে বিশ্লেষণ করে একটা উপসংহার টানা হয়। নিত্যনতুন আইনি সমস্যার সমাধান করতে এসব বিশ্লেষণ করা হয়। তো এর ফলাফল হিসাবে বাস্তব অবস্থার দাবি পূরণ করতে গিয়ে নতুন নতুন ফতোয়া তথা আইনী মতামত ও রায় দেয়া হচ্ছে।

‘হালাল’ কীভাবে অনৈসলামী হতে পারে? হ্যাঁ, এটা হতে পারে এবং এটা হচ্ছেও। ফিকাহ যখন নৈতিক অবস্থান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, সামগ্রিক বিবেচ্য বিষয়গুলো বাদ দিয়ে যখন শুধু আইনী দিকটাকেই বিচেনা করা হয়, তখন এমনটা ঘটে। হালাল খুঁজতে খুঁজতে আমরা শরীয়াহর বৃহত্তর ক্ষেত্রকে ভুলে যাই। আমরা একে শুধু আইনীব্যবস্থা মাত্র মনে করি। অথচ সময়ের ব্যবধানে ইসলামের মূল উৎস থেকে উৎসারিত একটা মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে শরীয়াহ। নানা ধরনের মতামতের সমন্বয়ে (ইখতিলাফ) গড়ে ওঠা আইনী মূল্যবোধ (ফিকাহ) শরীয়াহর একটা অংশ মাত্র। ইসলাম যে নিছক কোনো আইনী কাঠামো মাত্র নয়, আমরা তা ভুলে যাই। জগত ও জীবনের চূড়ান্ত সত্যকে বিশেষ কোনো আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে– ইসলাম তা মনে করে না।

চলুন এ বিষয়ে আমরা তিনটা ইস্যুর উপর আলোকপাত করি। তাহলে বুঝা যাবে হালাল হওয়া সত্ত্বেও কোনো বিষয় কীভাবে অনৈসলামী হয়ে ওঠে।

১। খাদ্য

বিশ্ব জুড়ে হালাল মাংসের বাজার কোটি কোটি ডলারের একটি ব্যবসা। কোনো কিছু ভোগ করার ‘আদব’ কী হবে, সে প্রসঙ্গে কোরআন আমাদেরকে ‘হালাল’ (অনুমোদিত) এবং ‘তায়্যিব’ (বিশুদ্ধ এবং উত্তম) এর ধারণা দেয়।[1] একে যথাক্রমে আইন এবং নৈতিকতা বলা যায়। এই দুটোকেই বিবেচ্য বিষয় হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। পশু জবাইকে আইনসিদ্ধ করতে মুসলিমরা বলে থাকে, এটা ইসলামী আইন দ্বারা নির্ধারিত। কিন্তু পশুটা কতটুকু ভালোভাবে বেঁচেছিল এবং তার সাথে কোনো অমর্যাদাকর আচরণ করা হয়েছিল কিনা– এসব নিয়ে তারা খুব একটা সচেতন নন। অথচ ইসলামের দৃষ্টিতে মাংস কিংবা কোনো খাবার শুধু কনজিউম করাই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং প্রাণীজগতের ইকো-সিস্টেমও গুরুত্বপূর্ণ। প্রাণীজগত এবং স্রষ্টার অন্যান্য সৃষ্টির সাথে কী ধরনের আচরণ করা হবে, সে ব্যাপারে নির্দিষ্ট ‘আদব’ রয়েছে। মাংস যদিও হালাল, কিন্তু আমরা কোনোক্রমেই এটা মনে করতে পারি না যে– প্রাণীজগতের প্রতি নিষ্ঠুরতা বা অবহেলাকে ইসলাম অনুমোদন করে।

২। অর্থব্যবস্থা

গত দুই দশকে আমরা একটা অর্থব্যবস্থার উত্থান দেখেছি, যাকে ‘ইসলামী অর্থব্যবস্থা’ বলা হয়। বিশ্ববাজারে লেনদেনের ক্ষেত্রে ঈমান বজায় রাখা নিয়ে মুসলমানরা উদ্বিগ্ন। এই উৎকণ্ঠা দূর করার জন্যে ‘ইসলামী অর্থব্যবস্থা’র প্রবর্তন করা হয়েছে। এ ব্যবস্থার আলোকে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোর চুক্তি ও লেনদেনগুলোকে বৈধতা দিতে শরীয়াহ উপদেষ্টারা সদাপ্রস্তুত থাকেন। গভীরভাবে দেখলে বুঝা যায়, নয়া-উদারনৈতিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সাথে এই ব্যবস্থা পুরোপুরিভাবে মিলে যায়। এতে ‘ইসলামী’ নামের একটা বৈধতার আবরণ যোগ হয়েছে মাত্র। প্রচলিত অর্থনৈতিক খাতে ন্যায়বিচার, সম্পদের সুষম বণ্টন, মূলধনের মালিকানা এবং বাণিজ্যিক চুক্তির ভিত্তি (যেমন– বিল্ডিং নির্মাণে ক্ষতিকর পদার্থের ব্যবহার) সম্পর্কিত খুঁটিনাটি বিষয়গুলোকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হয় না। পশ্চিমা পুঁজিবাদী মুক্তবাজার অর্থনীতি কিংবা ‘শরীয়াহসম্মত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা’– উভয় ব্যবস্থায়ই ধনীরা আরো ধনী হচ্ছে এবং দরিদ্ররা আরো দরিদ্র হচ্ছে। এমনকি ইউরোপে সেক্যুলারিজমের ঘাঁটি ফ্রান্স ‘ইসলামী অর্থব্যবস্থা’কে একটা টেকসই ব্যবস্থা হিসেবে তাদের আইনী কাঠামোর সাথে সমন্বয় করতে জোরেশোরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আইএমএফের বর্তমান প্রধান ক্রিস্টিন লাগার্দ ফ্রান্সের অর্থমন্ত্রী থাকাকালে ‘ইসলামী অর্থব্যবস্থা’ চালুর পক্ষে ছিলেন। একটা বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে ফ্রান্সের এই প্রচেষ্টার মধ্যে নৈতিক বিবেচনাকে স্থান দেয়া হয়েছে কি? মূলত এটা হলো ইউরোর ধারাবাহিক পতন রোধে উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর বিনিয়োগ আকর্ষণের একটা প্রচেষ্টা। অর্থব্যবস্থাকে শরীয়াহসম্মত করার ক্ষেত্রে যেসব আইনগত সমস্যা রয়েছে, সেগুলোর সমাধা করা গুরুত্বপূর্ণ হলেও ‘ইসলামী অর্থব্যবস্থা’র মধ্যে ‘ইসলাম’ আসলে কতটুকু– এই প্রশ্নটি থেকেই যায়।

[আরো পড়ুন: ইসলামিক ফাইন্যান্স: কল্পকথা বনাম বাস্তবতা]

৩। শিল্প ও সংস্কৃতি

সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের অপরিহার্য বিষয় হলো মিউজিক। এটি সহজেই বহু মানুষের কাছে পৌঁছে যায় এবং তাদেরকে প্রভাবিত করে। সংগীত এখন সর্বত্র। বিশ্বাস-সচেতন মুসলিম সংগীতশিল্পীরা এখন মূলধারার পপ কালচারের বাইরে ‘ইসলামী সংগীতের’ নতুন ধারা তৈরির চেষ্টা করছেন। গানের লিরিক বাদে বাদবাকি বিষয়ে মূলধারার শোবিজ কালচারের সাথে এর কোনো পার্থক্য নেই। ইসলামী কালচারাল ইন্ড্রাস্ট্রিতেও তারকাখ্যাতির মোহ ও পপ কালচার দৃশ্যমান।

আধ্যাত্মিক দেউলিয়াপনা এবং আধুনিক-বাণিজ্যিক ভোগবাদী জীবনধারার মধ্যে শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা চলছে। এর বিপরীতে ইসলামে শিল্পচর্চা হচ্ছে এক ধরনের আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা সংশ্লিষ্টতা জাতীয় ব্যাপার, নিছক আত্মতুষ্টি বা বিনোদন মাত্র নয়। গানের লিরিকে ইসলামের শিক্ষাগুলোর প্রতিফলন থাকায় তা একটা হালাল প্রচেষ্টা হিসেবে গণ্য হতে পারে বটে। কিন্তু পাশ্চাত্যের মূলধারার সংস্কৃতির মতো খ্যাতির মোহ, বস্তুবাদ ও ভোগবাদী প্রবণতাও কি ইসলামসম্মত?

ইসলামের নৈতিক প্রস্তাবনা

নৈতিক প্রস্তাবনার মধ্যেই ইসলামের মর্মবাণী নিহিত। ইসলামের মৌলিক গ্রন্থগুলোতে তিনটা গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা বারবার এসেছে। এগুলো হলো – আদব (চিন্তা ও আচরণের নীতিমালা), ইহসান (আধ্যাত্মিক উৎকর্ষতা) এবং আখলাক (নৈতিক শুদ্ধতা)। কোনো ব্যক্তির বাহ্যিক কাজকর্মের চেয়ে তার অন্তর্গত বৈশিষ্ট্য ও আচার-আচরণের পদ্ধতি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

কোরআনের বর্ণনা অনুসারে সৎকর্মশীলতা হচ্ছে:

সৎকর্ম শুধু এই নয় যে পূর্ব কিংবা পশ্চিমদিকে মুখ ফিরাবে, বরং বড় সৎকাজ হলো এই যে ঈমান আনবে আল্লাহর উপর, কিয়ামত দিবসের উপর, ফেরেশতাদের উপর এবং সমস্ত নবী-রসূলগণের উপর, আর সম্পদ ব্যয় করবে তাঁরই মহব্বতে আত্মীয়-স্বজন, এতীম-মিসকীন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্যে। আর যারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত আদায় করে এবং যারা কৃত প্রতিজ্ঞা সম্পাদনকারী এবং অভাবে, রোগেশোকে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্যধারণকারী, তারাই হলো সত্যাশ্রয়ী, আর তারাই পরহেজগার।[2]

এই আয়াত অনুযায়ী সৎকর্মশীলতা হচ্ছে– ঈমান, ইবাদত, ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং আধ্যাত্মিকতার সমন্বয় করা।

মোহাম্মদ (সা) বলেছেন, আমি নৈতিক  মানদণ্ডের উৎকর্ষতার জন্যেই প্রেরিত হয়েছি।

উত্তম ঈমানদার ও ভালো মানুষ তৈরি করা ছিল তাঁর মিশন। মহানবী (সা) আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন– কোরবানীর পশুর রক্ত এবং গোশত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, শুধু বান্দার আন্তরিকতাই তাঁর কাছে পৌঁছে। বাহ্যিক ধর্মীয় আচারের মধ্যেই খোদাভীরুতা সীমাবদ্ধ নয়। বরং অন্তরের অবস্থা এবং কাজকর্মের নৈতিক মানই হচ্ছে বড় ব্যাপার। যাইহোক, আদবের এই চেতনা হারিয়ে গেছে। আইন ও নৈতিকতার মধ্যে বিভিন্ন কৃত্রিমতা মিশে গেছে।

আধুনিক বিশ্বের অন্যতম মুসলিম দার্শনিক অধ্যাপক সাইয়্যিদ নকীব আল-আত্তাস তাঁর বিভিন্ন লেখায় আদবের এই অবক্ষয়কে চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি আদবকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন, তাতে এর সুগভীর তাৎপর্য ফুটে উঠেছে। তাঁর ভাষায়, “জ্ঞান এবং সত্ত্বা গুরুত্ব অনুসারে সুবিন্যস্ত। এটি হলো একটি বাস্তবতা এবং এর স্বীকৃতি ও পরিচিতি নির্ণিত হয় এতদুভয়ের নানা রকম ও পর্যায়ের ভিত্তিতে। এরসাথে বিদ্যমান বাস্তবতার আলোকে গৃহীত ব্যক্তি-মানুষের অবস্থানও সংশ্লিষ্ট। এরমধ্যে রয়েছে তার দৈহিক, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং আধ্যাত্মিক সক্ষমতা ও সম্ভাবনা” (the recognition and acknowledgement of the reality that knowledge and being are ordered hierarchically according to their various grades and degrees of rank, and of one’s proper place in relation to that reality and as in one’s physical, intellectual and spiritual capacities and potentials.)।

পোস্ট-ইসলামাইজেশন

গত চার দশক ছিল ‘ফারুকী’ ডিসকোর্স অনুসারে ইসলামীকরণের যুগ। বলাবাহুল্য, ‘জ্ঞানের ইসলামীকরণ’ প্রকল্পের প্রস্তাবক ছিলেন ড. ইসমাঈল রাজি আল-ফারুকী। এই ডিসকোর্সের ফলাফল হিসেবে মানববিদ্যার বিষয়গুলোসহ জ্ঞানের অধিকাংশ ডিসিপ্লিনের আগে ‘ইসলামী’ শব্দটি যোগ করার প্রচলন ঘটে। যেমন– ইসলামী সমাজতত্ত্ব, ইসলামী চিকিৎসাবিদ্যা, ইসলামী রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইসলামী অর্থনীতি, ইসলামী ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি।

এই বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টার অনেক ইতিবাচক ফলাফল রয়েছে এবং এ থেকে অনেক কিছু শেখা গেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে একইসাথে এটাও স্বীকার করে নেয়া উচিত, ইসলামীকরণ প্রকল্প ব্যর্থ হয়েছে। মানুষ এর গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেনি বলেই এটা ব্যর্থ হয়েছে, শুধু তা নয়; বরং ইসলামের নৈতিক শ্রেষ্ঠত্বকে তুলে ধরতে না পারাও এই ব্যর্থতার অন্যতম কারণ। আসলে জীবনের সবকিছুকে ‘ইসলামীকরণ’ করার প্রয়োজন নেই। বরং ইসলামী নীতিমালা অনুযায়ী বাস্তবজীবনের ব্যাপারগুলোকে নৈতিক মানে উন্নীত করাই আসল কাজ। এক্ষেত্রে ইসলাম ও নৈতিকতাকে যদি আমরা সমার্থক ধরি, তাহলে এটা নিতান্তই একটা পরিভাষাগত বির্তক।

তবে কিছু ব্যতিক্রমও রয়েছে। ইসলামী দর্শন, ইসলামী কলাবিদ্যা, ইসলামী আধ্যাত্মিকতা (বা সুফিবাদ) ও ইসলামী নীতিবিদ্যার ‘ইসলামী’ বিশেষণকে যুক্তিযুক্ত করতে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক কাঠামো ও ঐতিহ্য রয়েছে। কলা, দর্শন, আধ্যাত্মবিদ্যা এবং নীতিবিদ্যার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ও স্বতন্ত্র উপাদান রয়েছে। যা ‘ইসলামী’ বিশেষণটাকে অর্থবহ করে তোলে। বিশেষ করে মরোক্কান দার্শনিক ও পণ্ডিত ড. তাহা আব্দুর রহমান ইসলামী নীতিবিদ্যাকে নতুন আঙ্গিকে দাঁড় করিয়েছেন। তিনি ইসলামী আধ্যাত্মিকতা এবং মরমি ধারাকে অভিনব ও চিত্তাকর্ষকভাবে উপস্থাপন করেছেন। আমাদের স্কলাস্টিক ট্র্যাডিশনে (তা’সিল) কোনো ডিসকোর্সকে অনুসরণ করার ক্ষেত্রে এটি একটি বিশেষ পদ্ধতি। তবে একে এমন ভাষায় তুলে ধরতে হবে, যা আমাদের মডার্ন রিয়েলিটির (তাওসিল) সাথে সংগতিপূর্ণ। সমকালীন ইসলামী ডিসকোর্সের প্রস্তাবকদের এটি অন্যতম প্রধান করণীয়।

‘ইসলামী’ মানে কী?

কোনো ব্যাপারে ‘ইসলামী’ বলতে আমরা কী বুঝবো? এটা কি শুধু দলীলনির্ভর আইনী বৈধতার ব্যাপার? নাকি এর কোনো নৈতিক দৃষ্টিকোণ রয়েছে? এ বিষয়ে লোকজন সাধারণত দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একদল সবকিছুকে ইসলামীকরণ করতে চায়। আরেকদল ‘ইসলামী’ শব্দটা নিয়ে এক ধরনের হীনমন্যতায় ভোগে। তারা মনে করে, জনপরিমণ্ডলে ধর্মবিশ্বাসের ভূমিকা নিতান্তই সীমিত।

আমার মতে, ‘ইসলামী’ পরিভাষাটির আইনগত এবং নৈতিক উভয় দিকই রয়েছে। আইনগতভাবে কোনো কিছু ‘অনুমোদনযোগ্য’ হলে তা ‘হালাল’ বা ‘মুবাহ’। আর যদি তা ‘অনুমোদনযোগ্য’ হওয়ার পাশাপাশি ইসলামের নৈতিক মানেও উত্তীর্ণ হয়, কেবল তখনই তা ‘ইসলামী’ হিসেবে গণ্য হবে। আইন ও নৈতিকতা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। এ দুটি নিয়েই কোনো কিছু পরিপূর্ণতা লাভ করে। আইন ও নৈতিকতার এই ব্যাখ্যার প্রচলন নেই। অথচ ইমাম আবু হানিফার (রহ) মতো শীর্ষ ফিকাহবিদ ফিকাহকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে: “ফিকাহ হচ্ছে কোনো ব্যক্তির দায়দায়িত্ব এবং কর্তব্যবোধের জ্ঞান” (knowledge of the responsibilities and liabilities of one’s self.)। এই সংজ্ঞায় আইনগত এবং নৈতিক উভয়দিকই ফুটে উঠেছে।

‘ইসলামী’ শব্দের ব্যাখ্যায় আরো বলে রাখা দরকার– অন্যান্য একেশ্বরবাদী ধর্মগুলোর মতো ইসলামের একটা বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। সেটা হচ্ছে পরমের দিকে মানুষের আধ্যাত্মিক যাত্রা। যতক্ষণ পর্যন্ত জাগতিক ব্যাপারগুলোর সাথে ইসলামের এই চূড়ান্ত উদ্দেশ্যের সমন্বয় করা না যাবে, ততক্ষণ ‘ইসলামী’ পরিভাষাটি পূর্ণতা পাবে না। বিবাহ, তালাক, সম্পদের উত্তরাধিকার এবং আর্থিক লেনদেনের মতো কিছু কিছু বিষয়ে ধর্মগ্রন্থে তুলনামূলকভাবে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু জীবনের অন্যান্য ব্যবহারিক বিষয়ের বিস্তারিত করণীয় ধর্মগ্রন্থের মূল নীতিমালার আলোকে মানুষের চিন্তাশক্তি, সামষ্টিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই খুঁজে বের করতে হবে। উদাহরণ হিসেবে রাজনীতি ও ব্যবস্থাপনার কথাই ধরুন। এগুলোর ‘ইসলামী’ পরিপ্রেক্ষিত কী? (What is Islamic about them?) কোরআন-হাদীসে এগুলো নিয়ে কী বলা হয়েছে যাতে আমরা এগুলোকে ‘ইসলামী’ বলতে পারি? সত্যি বলতে কি, খুঁটিনাটি ও প্রয়োজনীয় নির্দেশনার নিরিখে এসব বিষয়ে খুব কমই বলা হয়েছে। যাইহোক, ইতিবাচক রাজনীতি ও কল্যাণমূলক ব্যবস্থাপনা ‘ইসলামী’ হতে পারে।

এই ধরনের যুক্তির আলোকে যে কোনো চিন্তা বা কাজ ইসলামের মূলনীতি, আইন ও নৈতিকতার সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ না হলে তাকে ‘ইসলামী’ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এমনকি ইসলাম এর উৎস না হলেও। যদিও একে এভাবে বলার খুব একটা দরকার নাই। বিশ্ব জুড়ে বহু সচেতন ব্যক্তিবর্গ বৈশ্বিক উষ্ণতা ও আবহাওয়ার পরিবর্তন নিয়ে সচেতনতামূলক কাজ করছেন। পরিবেশ নিয়ে কোরআনের নৈতিক অবস্থানের আলোকে এসব কাজও ‘ইসলামী’ হিসেবে গণ্য হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কিংবদন্তী সংগীতশিল্পী মাইকেল জ্যাকসনের গাওয়া ‘Man in the Mirror’ গানটি ইসলামী ভাবধারার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। এই গানে নিজেকে বদলানোর কোরআনিক মূলনীতির প্রতিফলন রয়েছে।

অধ্যাপক তারিক রমাদানের প্রস্তাবনাও এই আলোচনায় প্রাসঙ্গিক। তাঁর মতে, ‘অভিযোজনমূলক’ (adaptive) এবং ‘মৌলিক রূপান্তরধর্মী’ (transformative)– এই দুই ধরনের সংস্কারের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আমাদের আলোচ্য বিষয় আইন ও নৈতিকতার ফারাকের সাথে রমাদানের এ বক্ত্যবের প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। রমাদানের মতে, যদি আমরা চারপাশের বাস্তব জগতের সাথে স্রেফ তাল মিলিয়ে চলতে চাই, তাহলে আমাদের জন্যে প্রচলিত ফিকাহই যথেষ্ট। আর যদি আমরা চ্যালেঞ্জ করতে চাই, মৌলিক পরিবর্তন চাই, বাস্তবতাকে আমাদের মতো করে গড়ে তুলতে চাই; তাহলে এমন এক ধরনের নৈতিক পুনর্গঠন দরকার, যাতে করে সমাজে রূপান্তরধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠে। ইসলাম তার অনুসারীদেরকে নিষ্ক্রিয় দর্শক হিসেবে থাকার পরিবর্তে সক্রিয় কর্মী হিসেবে গড়ে ওঠার তাগিদ দেয়।

ইসলামী নৈতিকতার মৌলিক ভিত্তি কোরআন ও সুন্নাহ থেকে নিঃসৃত। আল মুহাসিবি, আল তুসি, মিসকাওয়াহ, ইসফাহানী, আল ফারাবী, আল গাজালী, ইবনে রুশদ, ফখরুদ্দীন আল রাজী, শাহ ওয়ালীউল্লাহর মতো চিন্তাবিদদের সাহিত্য, সমাজচেতনা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা একে শক্তিশালী করেছে। এভাবে প্রায় দেড় হাজার বছরের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ইসলামের নৈতিক ধারা সমৃদ্ধ ও পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। আমাদের আন্তরিক প্রত্যাশা– শরীয়াহ, বিশেষ করে নীতিশাস্ত্রের ডিসকোর্স পুনর্গঠনের চ্যালেঞ্জ পূরণে ‘সিআইএলই‘ এগিয়ে আসবে এবং একবিংশ শতাব্দীতে ইসলামী নৈতিকতার সারমর্মকে পুনঃপ্রতিষ্ঠায় অবদান রাখতে সক্ষম হবে।

রেফারেন্স:

[1] সূরা বাকারা: ১৬৮।
[2] সূরা বাকারা: ১৭৭।

এ ধরনের আরো লেখা