ইসলাম নিয়ে আমাদের চিন্তায় দুটি প্রান্তিক পক্ষ সৃষ্টির মাধ্যমে সুস্থ আলোচনার দরজাকে রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। ইসলাম রিলেটেড যে কোনো আলোচনা যেন এ দুটি পক্ষের একটিকে সমর্থন না করে হতেই পারে না। যারাই মাঝপথে থাকতে চাইবেন তারা এ দুই প্রান্তিক গোষ্ঠীর মুহুর্মুহু আক্রমণের শিকার।
শায়েখ ইউসুফ আল-কারাদাওয়ীর কথা চিন্তা করুন। বর্তমান সময়ে ইসলাম নিয়ে যারা পড়াশোনা করেছেন ও চিন্তা করেছেন তাদের মাঝে এই ব্যক্তির চেয়ে বড় কাউকে চিন্তা করা কঠিন। আবার বহু আলেমের কাছে তিনি বিতর্কিত। বহু আলেম তাকে এখনকার অল্প কজন মুজতাহিদ ইমামের অন্যতম হিসাবে গণ্য করেন। তাকে অর্থডক্স মুসলিমদের অনেকে মডার্নিস্ট মনে করেন, আবার পশ্চিমের অনেক অমুসলিম স্কলারদের কাছে তিনি একজন র্যাডিকাল ট্র্যাডিশনাল মোল্লার অধিক কিছু নন।
ইউসুফ আল-কারাদাওয়ীর সব মতের সাথে আপনাকে একমত হতে হবে এমন নয়। তিনি নিজেও সেটা চাননি। আমি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সব মতের সাথে একমত নই। কিন্তু তাঁর কথাকে এবং ইজতিহাদকে না বুঝে এবং অনেক সময় অন্যের কথার উপর নির্ভর করে মানুষ তাঁকে অপবাদ দিয়েছে। তাঁর ভুলগুলোকে জ্ঞান দিয়ে বিচার না করে লোকেরা নিজ নিজ পক্ষ ও দলীয় অবস্থানের আলোকে বিচার করেছে।
আল-কারাদাওয়ী নিজে গণ্ডিবদ্ধ থাকার মতো মানুষ নন। এভাবে পক্ষভুক্ত হয়ে থাকার অনেক উপরে তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা ও অবস্থান। কখনো তাঁর ফতোয়া আপনার কাছে খুবই লিবারেল মনে হবে। আবার কখনো তিনি অত্যন্ত র্যাডিকেল। প্রতিটি ইস্যু তাঁর কাছে একটি নতুন রিসার্চের সম্ভাবনা। মানুষের আশা বা আশঙ্কার উপর ভর করে তিনি মত দেন না। তিনি তাঁর রিসার্চ অনুযায়ী কথা বলেন।
একজন মানুষের অবস্থান বুঝতে হলে তার মৌলিক লেখাতেই ফিরে যেতে হবে। আল-কারাদাওয়ী তাঁর নিজের ফিলোসফি নিয়ে বহু বইতে লিখেছেন। তাঁর উসূল বা মৌলিক অবস্থান বোঝাতে গিয়ে তিনি এটাই বলেছেন যে তিনি মনে করেন, বর্তমান সময়ে ইসলামিক চিন্তাকে তিনটি দলে ভাগ করা যায়।
প্রথমটি হলো আয-যাহিরিয়্যাহ আল-জুদুদ (নব্য আক্ষরিকতাবাদী)। এরা সেই দল যারা কোরআন ও হাদীসের আক্ষরিক জ্ঞানকে কাজে লাগাতে গিয়ে নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা, স্থান-কাল-পাত্রের জ্ঞানকে বিসর্জন দিয়েছেন। এদেরকে নব্য আক্ষরিকতাবাদী বলা হচ্ছে। কেননা, পূর্বে যাহিরী নামে একটি মাযহাব ছিলো যাদের তিনি পুরোনো আক্ষরিকতাবাদী বলছেন। যার পুরোধা ছিলেন ইমাম ইবনে হাযম। ইবনে হাযম কিন্তু নব্য আক্ষরিকতাবাদীদের মতো এত গোঁড়া ছিলেন না। তাঁর নিজস্ব আক্ষরিকতাবাদের মধ্যে এক বুদ্ধিবৃত্তিক জিনিয়াসের ছোঁয়া আমরা পাই। ‘আল-মুহাল্লা’ গ্রন্থে তিনি তাঁর আক্ষরিকতাবাদী মাযহাবের পক্ষে বহু বুদ্ধিবৃত্তিক সাফাই দিয়েছেন। মজাটা এখানেই। এত বুদ্ধি তিনি খরচ করেছেন এটা বোঝাতে যে কোরআন-হাদীস বুঝতে বেশি বুদ্ধি খরচ করার দরকার নেই।
দ্বিতীয়টি হলো আল-মুয়াত্তিলাহ আল-জুদুদ (নব্য বিসর্জনবাদী)। পুরোনো বিসর্জনবাদীদের চিন্তাভাবনা কিছু বিশ্বাসগত বিষয়ে সীমাবদ্ধ ছিলো। তারা আল্লাহর কিছু নাম ও গুণাবলিকে (যা কোরআন-হাদীসে রয়েছে) অস্বীকার করতো, বিসর্জন দিতো। তাদের ধারণা ছিলো, এসব নাম ও গুণাবলি স্বীকার করলে আল্লাহর এককত্বকে অস্বীকার করা হয়। এ যুক্তির ভুলটা নিয়ে আলোচনা করার স্কোপ এখানে নেই। ঐতিহাসিকভাবে তারা টেকেওনি। কিন্তু আল-কারাদাওয়ী যে নব্য বিসর্জনবাদীদের কথা বলছেন তাদের কর্মক্ষেত্র ভিন্ন। এরা কোরআন ও সুন্নাহকে বিসর্জন দিয়ে কেবল নিজেদের বুদ্ধি ব্যবহার করে ইসলামকে দাঁড় করাতে চায়। তারা সবসময় যে কোরআন হাদীসকে বাদ দেয়ার কথা বলেছে, তা নয়। যখন কোরআন-হাদীসের কোনো ভাষ্য বুদ্ধির সাথে সামঞ্জস্য রাখছে তখন তারা বরং খুশি। কিন্তু যখনই কোরআন-হাদীসের কোনো স্পষ্ট নিরেট ভাষ্য তাদের বুদ্ধির বিরুদ্ধে যায় তখনই তারা বুদ্ধির আদালতে কোরআন হাদীসকে বিবাদীর কাঠগড়ায় খাড়া করিয়ে দেয়। এ দলের কথা শুনলে মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে কোরআন হাদীস আসলে এক দুধভাত জিনিস, থাকা না থাকা সমান, বুদ্ধি দিয়ে এমনিতেই কোনটা ঠিক-বেঠিক তা ঠিক করে ফেলা যাবে। সন্দেহ নেই পশ্চিমা নীতিনির্ধারকরা এই ইসলামকেই সঠিক ইসলাম বা গুড ইসলাম মনে করেন। যেন কোনটা ভালো ইসলাম আর কোনটা খারাপ ইসলাম, এটা মুসলিমদের অন্যের কাছে বুঝে নিতে হবে।
তৃতীয় দলটি — যা ইউসুফ আল-কারাদাওয়ী (ও আমাদের) সমর্থিত দল — হলো মধ্যমপন্থা অবলম্বনকারী দল। যারা কোরআন-হাদীসের জ্ঞানের সাথে কম্প্রোমাইজ যেমন করতে চান না, একইভাবে নিজেদের বুদ্ধিকেও বন্ধক রাখতে চান না। বরং কোরআন-হাদীসের সঠিক জ্ঞান যদি সঠিক বুদ্ধিমত্তা দিয়ে বোঝা যায় তাহলেই সত্যের সন্ধান মিলবে বলে তারা মনে করেন। উলামাদের মতে, “আল-নাকলুস-সাহীহ লা ইউয়ারিদুল আকলুস সারীহ”। এ প্রিন্সিপলের অর্থ হলো— যদি কোরআন বা হাদীসের টেক্সট সঠিক হয়ে থাকে, আর এটা বোঝার জন্য যে বুদ্ধিকে কাজে লাগানো হয়েছে তা যদি পরিষ্কার এবং ত্রুটিমুক্ত হয়ে থাকে; তাহলে এ দুয়ের মাঝে ফান্ডামেন্টালি কোনো সংঘর্ষ হতে পারে না। যেহেতু দুটিই আমাদের বিশ্বাস অনুযায়ী ত্রুটিমুক্ত। কোনো আপাত সন্দেহ যদি দেখা দেয় তাহলে দুটো সমস্যার যে কোনো একটি বা দুটোই হয়ে থাকতে পারে— হয় কোরআন বা হাদীসের যে টেক্সটটি আলোচ্য সেটি সঠিক নয় (অর্থাৎ অথেন্টিক বা সহীহ নয় অথবা ভুলভাবে কোট করা হয়েছে), অথবা কোরআন-হাদীসের টেক্সটটি বোঝার জন্য যে বুদ্ধির প্রয়োগ করা হয়েছে তাতে গোলযোগ রয়েছে, অথবা দুটোই।
যে কেউ তাড়াহুড়ো করে মত না দিয়ে যদি একটু চিন্তাভাবনা করেন, তাহলে বুঝবেন এই চ্যালেঞ্জটা খুব সহজ নয়। একই সাথে যেমন বুঝতে হবে কোরআন-হাদীসের টেক্সট সঠিক বা অথেন্টিক কিনা বা সঠিকভাবে কোট করা হয়েছে কিনা; ঠিক তেমনি আমাদের বুদ্ধি ব্যবহারে কোনো ঘাটতি থেকে যাচ্ছে কিনা সেটাও নির্ধারণ করা দরকার। এজন্য দরকার নিরলস জ্ঞানচর্চা, বিনম্রতা, নিজের চিন্তাকে যাচাই করার ক্ষমতা ও চিন্তাকে দলবাজিতা থেকে মুক্ত রাখার ক্ষমতা। দলবাজি করা এবং অন্যকে গালিগালাজ করা, টিটকারি দেয়া, দলবল নিয়ে কারো চিন্তাকে মাত করার চেষ্টা করা – এসবই অলস লোকের লক্ষণ; যারা সত্যকে বোঝার জন্য কষ্ট করতে চায় না, কিন্তু সত্যকে নিজের পৈত্রিক সম্পত্তি বানাতে চায় ঠিকই।
আল্লাহ ইউসুফ আল-কারাদাওয়ীকে আরও হায়াত দিন, তাঁকে ভালো রাখুন দুনিয়া ও আখিরাতে। আল্লাহ আমাদের শক্তি দিন যেন এই ইমামের মতো আমরাও কোরআন-হাদীসের প্রতি কমিটমেন্ট বজায় রেখেই আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা চালিয়ে যেতে পারি। আমাদের নিয়তের ব্যাপারে আমরা কাউকে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই। আমাদের পড়াশোনা ও চিন্তা আলোচনার টেবিলে আসুক এবং গৃহীত বা বর্জিত হোক।