আব্দুল্লাহ গুল

একেপিতে আবদুল্লাহ গুল আর নাই কেন

এডিটর’স নোট: নয়া তুরস্কে ধর্ম ও গণতন্ত্র শিরোনামের মোস্তফা আকিউলের সাক্ষাৎকারে এরদোয়ানের তুরস্ক সম্পর্কে কিছু ‘ভিন্নমত’ উঠে এসেছে। এদিকে গত সপ্তাহে (১৪ মার্চ, ২০১৫) রাজনীতিতে আব্দুল্লাহ গুলের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে আকিউল Why Gül is not in the AKP anymore শিরোনামে একটি কলাম লেখেন। সমকালীন তুরস্কের ‘ইসলামীকরণ’ সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা তৈরিতে এটি আগ্রহী পাঠকদের কাজে লাগতে পারে। অনুবাদ করেছেন আবিদুল ইসলাম চৌধুরী।

*****

সাম্প্রতিক একটা রাজনৈতিক গুঞ্জন হলো তুরস্কের সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুলকে নিয়ে। যিনি ইতোমধ্যে রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছেন। ক্ষমতাসীন ডেভলপমেন্ট এন্ড জাস্টিস পার্টি’র (একেপি) মনোনয়ন নিয়ে তিনি হয়তো আবার সংসদে ফিরবেন এবং রাজনীতিতে পুনরায় সক্রিয় হবেন। তবে গত সপ্তাহে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এ ব্যাপারে তাঁর সিদ্ধান্ত জানিয়ে তিনি বলেন, “আমি আর সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে অংশ নেব না। বরং যখনই প্রয়োজন হবে তখনই আমার চিন্তা-গবেষণা দিয়ে তাদেরকে (একেপি) সাহায্য করে যাব।”

সাধারণত রাষ্ট্রনায়ক এবং রাজনীতিবিদগণ যখন বুঝতে পারেন যে রাজনীতিতে তাদের সময় শেষ তখন তারা অবসর নিয়ে নেন। কিন্তু আবদুল্লাহ গুলের ব্যাপারটা তেমন নয়। তাঁর বয়স এখন ৬৪ বছর। সক্রিয় রাজনীতি ছেড়ে দেয়ার জন্যে বয়সটা খুব বেশি নয়। ২০০১ সালে যে আবদুল্লাহ গুল নিজেকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, জরিপে দেখা যাচ্ছে, সেই আবদুল্লাহ গুল এখনো বেশ জনপ্রিয় এবং জনগণের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র। প্রায় সাত বছর একটানা দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। এ দায়িত্ব পালন শেষে নেতা হিসেবে পুনরায় দলে ফিরে আসার ব্যাপারটা ২০১৪ সালের আগস্টের আগ পর্যন্ত বেশ আলোচিত বিষয় ছিল। তারপর এরদোয়ান রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেন এবং খুব সাবধানে তাঁর রাজনৈতিক পরিকল্পনার ছক তৈরি করলেন। দলের নেতৃত্বে আবদুল্লাহ গুলের পুনরায় ফিরে আসার সুযোগ তিনি আটকে দিলেন। এক্ষেত্রে অবশ্য আহমেদ দাউতুগলো এরদোয়ানের সুনজর লাভ করেন।

বলা হয়ে থাকে, আবদুল্লাহ গুল ব্যক্তিগত কারণে সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছেন। কিন্তু এর সাথে আরো গভীর কিছু বিষয় জড়িত রয়েছে। গুলের শাসনামলের (২০০১-২০০৭) একেপি এবং বর্তমান সময়ের একেপি’র রাজনৈতিক চরিত্রে অনেক পার্থক্য লক্ষ করা যায়। শুরু দিকের একেপিকে আমি বলি ‘পুরাতন একেপি’ আর বর্তমানটাকে বলি ‘নতুন একেপি’। এ দুটোর মাঝে যে পার্থক্যটা রয়েছে সেটা সত্যি বিস্ময়কর। বুঝার জন্যে একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে দিলাম:

১. পুরাতন একেপি তুরস্কে ‘কোপেনহেগেন ক্রাইটেরিয়া’ বাস্তবায়নে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল। অর্থাৎ রাজনীতি, আইন ও অর্থনীতিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেয়া মানদণ্ডে পরিবর্তন করতে তাদের চেষ্টা ছিল। কিন্তু নতুন একেপি’র এ ধরনের কোনো আগ্রহই দেখা যাচ্ছে না। বরং ‘সাংহাই ইউনিয়নে’র ব্যাপারে একেপির আগ্রহের সুস্পষ্ট ইংগিত দেখা যাচ্ছে। রাশিয়া, চীন ও উজবেকিস্তানের মতো প্রভাবশালী দেশগুলো সেখানে রয়েছে।

২. পুরাতন একেপি তখন বিশ্বকে ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব দিয়ে বিবেচনা করতো না। দলটিকেই বরং ষড়যন্ত্র-তত্ত্বের লক্ষ্যে পরিণত করা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে নতুন একেপি অনেক ক্ষেত্রে ষড়যন্ত্র-তত্ত্বের আলোকে বিশ্লেষণ করা শুরু করেছে।

৩. প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর জন্যে পুরাতন একেপির নীতি ছিল ‘জিরো প্রবলেমস উইথ নেইবরস’। কিন্তু নতুন একেপি শুধু অনেকগুলো সমস্যাই তৈরি করেনি বরং তারা প্রতিবেশীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকাটাকে বেশ উপভোগ করছে বলে মনে হয়!

৪. অর্থনৈতিক বাস্তবতা এবং বিশ্ববাজারের বিধিসমূহ বিবেচনা করে পুরাতন একেপি তাদের নীতি নির্ধারণ করতো। ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী আলি বাবাকান এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর এরদাম বাসগি’র (Erdem Basci) মতো ব্যক্তিদের প্রচেষ্টায় এ নীতির কিছু অংশ এখনো ঠিকে আছে বটে। কিন্তু নতুন একেপি অর্থনীতিতে উল্টোপথ অনুসরণ করছে। তারা অর্থনীতিতে ইন্টারেস্ট রেট লবি’র (সুদের হার বৃদ্ধিতে তৎপর গ্রুপ) মতো কাল্পনিক দানবের ভীতি ছড়ানোর চেষ্টা করছে। এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংক দুর্নীতি করতে পারে– এ ধরনের অনাস্থামূলক আশংকার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।

৫. পুরাতন একেপিকে তখন বিনয়ী হিসেবে বিবেচনা করা হতো। সে সময় প্রতিবেশীদের মিলেমিশে ছোট একটা এপার্টমেন্টে এরদোয়ান থাকতেন। অথচ বর্তমানে নতুন একেপিকে একটা অহংকারী দল বলেই মনে হয়। এখন এরদোয়ান থাকেন বিশ্বের অন্যতম বিলাসবহুল বিরাট এক প্রাসাদে।

৬. পুরতান একেপি ছিল উদার। অন্যকে গ্রহণ করে নেয়ার মতো মন-মানসিকতা তাদের ছিল। তারা ‘ঘরের-শত্রু’ (Enemy Within) ধরনের ধারণার বিরোধী ছিল। বরং সবার সাথে সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব পোষণ করতো। নির্বাচনের সময় তাদের স্লোগান ছিল ‘একই রংধনুতে আমরা ভিন্ন ভিন্ন রং’। কিন্তু নতুন একেপি ‘শত্রু, বিশ্বাসঘাতক, অশুভ শক্তি’– এসব বাগাড়ম্বরে বেশি বিশ্বাস করে। অথচ তাদের পক্ষ হতে নেতিবাচকভাবে চিহ্নিত মানুষ দেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক।

আবদুল্লাহ গুল পুরাতন একেপির উদারবাদী মূলনীতিগুলোতে এখনো আস্থা রাখেন। অন্যদিকে এরদোয়ান নতুন একেপিতে কর্তৃত্ববাদীতাকে সর্বোচ্চ মাত্রায় চর্চায় আগ্রহী। আমি যতটুকু বুঝেছি, এজন্যেই আবদুল্লাহ গুল ‘আপাতত সক্রিয় রাজনীতি থেকে দুরে থাকা’র সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমি হতাশ এজন্যে যে, তিনি (গুল) নিরবিচ্ছিন্নভাবে তাঁর চিন্তা-গবেষণা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পারছেন না। যদি পারতেন তাহলে শুধু তুরস্ক নয়, সমগ্র মুসলিম বিশ্বও এ থেকে উপকৃত হতে পারতো।

এ ধরনের আরো লেখা