সমসাময়িক রাজনৈতিক ফিকাহর দিক-বিদিক: পর্ব-২

প্রথম পর্ব

শাইখুল ইসলাম মোস্তফা সাবরি:

আল্লামা রশিদ রেদা (রহ)-এর পর খেলাফত পুনর্প্রবর্তনের পক্ষে কলম ধরেন শাইখুল ইসলাম মোস্তফা সাবরি (১৮৬৯-১৯৫৪)। ‘খেলাফত, দ্বীন এবং উম্মাহর নেয়ামত অস্বীকারকারীদের প্রতি নিন্দা’ শিরোনামে ১৯২৩ সালে তিনি একটি বই রচনা করেন। এ বইয়ে তিনি খেলাফতে ব্যবস্থাকে রাজনৈতিক দিক থেকে বিশ্লেষণ করেছেন।

মোস্তফা কামাল পাশার অনুগামী ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের তীব্র সমালোচনা করেন তিনি। তাদের বিরুদ্ধে সমস্ত মুসলিম বিশ্বে গণআন্দোলন গড়ে তোলার ডাক দেন। কামালপন্থী নব্য নেতৃত্ব কর্তৃক খেলাফত থেকে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে আলাদা করার ব্যাপারেও তিনি মুসলমানদেরকে সতর্ক করেন। কামাল পাশা কর্তৃক তুর্কী বংশোদ্ভূতদের প্রতি স্বজনপ্রীতিমূলক আচরণ, উম্মাহর ঐক্য ধ্বংসকারী ও আত্মবিনাশী তৎপরতা উম্মাহর সামনে তিনি তুলে ধরেন। নবউত্থিত তুর্কী জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে উম্মাহর ঐক্যের প্রয়োজনীয়তাও তার লেখনী থেকে বাদ পড়েনি।

তবে শেখ মোস্তফা সাবরির এ বইটির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে খেলাফতকে ঘিরে বিতর্ককারীদের দুটি ভুল ধারণার অবসান। এগুলো হলো-

১। খেলাফত ব্যবস্থায় ইসলামী শরীয়তের স্থান
২। খেলাফত ব্যবস্থা বা ইসলামী রাষ্ট্রে ধর্মীয় নেতাদের অবস্থান ।

প্রথম বিষয়টিতে ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের আপত্তি ছিল এমন, ‘কীভাবে একটা স্বাধীন রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে, যেখানে ধর্ম রাষ্ট্রকে চারদিক থেকে শরীয়তের আইনে বেধে রাখে?’

লেখক এর জবাব দিয়েছেন এভাবে, ‘যদি আমাদের দৃঢ় প্রত্যয় থাকে যে, ইসলাম ইহকাল এবং পরকাল উভয় জগতের জন্য নেয়ামত স্বরূপ, তাহলে আমরা কিভাবে বলতে পারি ইসলাম স্বাধীন রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েমের পথে বাধা? ইসলামের বিধি-নিষেধগুলো তো সরকারকে ভুল পথে পরিচালিত হওয়া থেকে রক্ষা করতেই এসেছে। ইসলাম উম্মাহকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে, উম্মাহর সরকারকে নয়। কারণ তাতে সরকার স্বৈরাচার হয়ে উম্মাহর ঘাড়ে চেপে বসার আশংকা থাকে।

আর ধর্মীয় নেতাদের ব্যাপারে ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের আপত্তির কারণ ছিল ‘তৎকালীন আলেমগণ কর্তৃক ফিকাহর গোঁড়া তাকলিদ এবং পুরাতন রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা’।

এর জবাবে লেখক তৎকালীন আলেমদেরকে ব্যাপকভাবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাস্তবসম্মত রাজনৈতিক প্রজ্ঞা গড়ে তোলার আহবান জানান।

হাসান আল-বান্না:

একই ধারায় খেলাফতকে পুনরায় আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনার জন্য সবচেয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন শেখ হাসান আল-বান্না (রহ) (১৯০৬-১৯৪৯), যিনি ১৯২৮ সালে ইখওয়ানুল মুসলিমিন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তার এ কাজের সূচনা করেন।

১৯৩৮ সালে তিনি ঘোষণা করেন, ‘ইখওয়ান বিশ্বাস করে, খেলাফত হচ্ছে ইসলামের একমাত্র প্রতীক এবং ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়া সকল জাতিগোষ্ঠিকে ঐক্যবদ্ধ রাখার একমাত্র মাধ্যম। খেলাফত এমন আবশ্যিক বিষয়, যা মুসলমানদেরকে অবশ্যই বিশেষ বিবেচনায় রাখতে হবে, এ বিষয়ের সকল কার্যাবলিকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে আঞ্জাম দিতে হবে। আর খলিফা আল্লাহর দ্বীনের অনেক হুকুম-আহকাম বাস্তবায়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত, যাকে ছাড়া সে হুকুমগুলো পালনের আর কোনো উপায় নেই।’

আর এ কারণেই খেলাফত ব্যবস্থার ধারণা ও বাস্তবায়ন ইখওয়ানের কর্মতালিকার প্রথম দিকেই ছিল। আল-বান্নার চিন্তা অনুযায়ী, খেলাফত ব্যবস্থার পূর্ণ বাস্তবায়নের আগে অনেকগুলো ধাপ পার হয়ে যেতে হবে। তাই সকল তৎপরতা এ চূড়ান্ত লক্ষ্যকে ঘিরেই পরিচালিত হতে হবে। ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার আলোচনাকে হাসান আল-বান্না কয়েকটি শিরোনামে ভাগ করেন:

# ইসলামে রাষ্ট্রব্যবস্থার মূলভিত্তিসমূহ
# শাসকের দায়-দায়িত্ব
# উম্মাহর ঐক্য
# জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা
# সমসাময়িক অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যবস্থার ব্যাপারে তাঁর অবস্থান।

(আরো বিস্তারিত জানতে হাসান আল-বান্নার ‘রিসালাহ’ পড়ে দেখা যাতে পারে)

একইভাবে ইমাম আল-বান্না ইখওয়ানুল মুসলিমুনের আন্দোলনের ধাপগুলিকে পাঁচ স্তরে ভাগ করেছেন:

১। মুসলিম ব্যক্তি গঠন
২। মুসলিম পরিবার গঠন বা মুসলিমের ঘর
৩। মুসলিম সমাজের পুনর্গঠন
৪। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা
৫। ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা।

একটু সহজ ভাবে ব্যাখ্যা করলে এভাবে বলা যায়, প্রথমে ইসলামী ব্যক্তিত্বের পুনর্গঠন করতে হবে, তারপর পরিশুদ্ধ একজন মুসলিম পুরুষ অপর একজন পরিশুদ্ধ মুসলিম নারীকে বিয়ে করে একটি ইসলামী পরিবার গঠন করবে, বেশকিছু ইসলামী পরিবার মিলে ইসলামী সমাজ গড়ে তুলবে, ইসলামী সমাজসমূহ মিলে ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করবে, আর ইসলামী রাষ্ট্রগুলো মিলে ইসলামী খেলাফতের পুনর্গঠন করবে।

খেলাফতকেন্দ্রিক সমসাময়িক রাজনৈতিক ফিকাহর চিন্তাগোষ্ঠির আলোচনা আপাতত এখানেই শেষ করছি। যদিও এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা করা দরকার, কিন্তু কলেবর বেড়ে যাওয়ার আশংকায় এখানেই থামতে হচ্ছে।

চলবে…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *