ড. তারিক সোয়াইদান

সফল নেতৃত্ব গঠনে সুন্নাহসম্মত বাস্তব কর্মপন্থা

এডিটর’স নোট: সমসাময়িক খ্যাতিমান ইসলামী স্কলার ড. তারিক আল সোয়াইদান নেতৃত্বের উপর মালয়েশিয়ায় এক কনফারেন্সে ২০১৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি একটি যুগান্তকারী বক্তব্য দিয়েছেন। বিশেষ করে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে নেতৃত্ব সংক্রান্ত কিছু প্রচলিত ধারণাকে তিনি চ্যালেঞ্জ করেছেন। মুসলমানদের একটা সাধারণ ভুল ধারণা হচ্ছে, নেতৃত্বকে সদাসর্বদা এককেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিবেচনা করা। নেতৃত্বের মর্যাদা এবং আনুগত্যের ধরন ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষিতে স্বতন্ত্র। অতএব, জামায়াতে নামাজ, সামাজিক আন্দোলন, প্রশাসনিক কার্যক্রম, তাত্ত্বিক আলোচনা কিম্বা যুদ্ধক্ষেত্রসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব একই রকম হবে না। ড. সোয়াইদান এ বিষয়ের উপর তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা করেছেন।

সিএসসিএস-এর পাঠকদের জন্য আলোচনাটি ভিডিও লেকচার থেকে প্রবন্ধ আকারে স্ক্রিপটিং এবং ভাষান্তরিত করেছেন মো: হাবিবুর রহমান হাবীব।

ভূমিকা

বর্তমানে মুসলিম বিশ্বের প্রধানতম সমস্যা হচ্ছে নেতৃত্ব। মুসলিম উম্মাহর পুনর্জাগরণের জন্যে নেতৃত্ব তৈরির উদ্দেশ্যে একটি কৌশলগত পরিকল্পনা থাকা দরকার। ইসলাম সর্বোত্তম আদর্শ হওয়া সত্ত্বেও সমকালীন মুসলিম জনগোষ্ঠী সামগ্রিকভাবে একটি অনগ্রসর জাতিতে পরিণত হয়েছে।

একদিন শায়খ ইউসুফ আল-কারযাভীর সাথে মুসলিম উম্মাহর পুনর্জাগরণের জন্যে একটি কৌশগত পরিকল্পনা প্রণয়নের বিষয়ে কথা বলছিলাম। আমাদের সামগ্রিকভাবে কী করা দরকার, কিভাবে আমরা আমাদের লোকদের প্রশিক্ষিত করতে পারি কিম্বা কিভাবে নেতৃত্ব তৈরির উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারি এসব মৌলিক বিষয় নিয়ে আমি তাঁকে কয়েকটি প্রশ্ন করেছিলাম। উত্তরে তিনি যা বললেন তাতে সত্যিই আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। তিনি বললেন, ‘ড. তারিক, আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না; বলতে পারেন, একেবারেই অজ্ঞ’। এ কথা শুনে আমি বসা অবস্থা থেকে দাঁড়িয়ে গেলাম। বর্তমান সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত শায়খ আল-কারযাভীর মতো মানুষ এ কথা বললেন!

আমার বিস্ময় দেখে তিনি বললেন, ‘না, আমাকে এতো বড় করে দেখার কিছু নেই। আমাকে উপহাস করবেন না, আমিও নিজেকে নিয়ে উপহাস করি না। এই ব্যাপারে আমি আসলেই তেমন কিছু জানি না। ড. তারিক, এ বিষয়ে আপনি উদ্যোগ গ্রহণ করাই যথার্থ হবে। আমি স্কলারদেরকে আপনার কথা শুনার জন্যে ডাকবো, যাতে আপনি তাদেরকে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে পারেন’।

পরবর্তীতে আমরা সেটি করেছিলাম। আমি স্কলারদের সামনে মুসলিম উম্মাহর জন্যে কিভাবে কৌশলগত পরিকল্পনা তৈরি করা যায়, সে বিষয়ে একটি বক্তব্য উপস্থাপন করেছিলাম।

কৌশলগত পরিকল্পনা

যে কোনো কৌশলগত পরিকল্পনার চারটি উপাদান থাকে–

১. বর্তমান সম্পর্কে স্পষ্টধারণা
২. ভবিষ্যতের সুস্পষ্ট রূপরেখা গঠন
৩. বর্তমান অবস্থা থেকে উন্নতি লাভ করে ভবিষ্যতে অগ্রসর হওয়ার পরিকল্পনা এবং
৪. ভবিষ্যৎ লক্ষ্য পূরণে সম্ভাব্য বাঁধাগুলো সম্পর্কে ধারণা রাখা এবং এগুলো অতিক্রম করে সফল হওয়ার কৌশল রপ্ত করা।

 বর্তমান অবস্থা দিয়েই শুরু করা যাক। বর্তমানে মুসলিম উম্মাহ পাঁচটি প্রধান সমস্যার সম্মুখীন–

১. অনৈসলামিক আচরণ
২. অদক্ষতা
৩. পশ্চাৎপদতা
৪. ফিকির (বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান) এবং
৫. নেতৃত্ব।

১. অনৈসলামিক আচরণ: আমরা মুসলমান কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমাদের আচার-আচরণ ইসলামী বিধি-বিধানের বিপরীত। বিষয়টি জীবনের সব দিক ও বিভাগে লক্ষণীয়। যেমন, আমাদের নিজ পরিবারের অনৈসলামিক আচরণ, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বা সন্তানের সাথে অনৈসলামিক আচরণ, পথে-ঘাটে, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে, এমনকি ইবাদতের ব্যাপারে আমাদের অনৈসলামিক আচরণ বেশ প্রকট আকার ধারণ করেছে।

২. অদক্ষতা: মুসলমান মানেই তো কর্মক্ষম এবং দ্ক্ষ হওয়ার কথা। মুসলমানরা ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে; সর্বোপরী একটি দেশ বা জাতি হিসেবে অত্যন্ত দক্ষ হওয়ার কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অদক্ষ, আনাড়ি ।

৩. পশ্চাৎপদতা: মুসলমানদের তো যুগের অগ্রগামী হওয়ার কথা। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, জ্ঞান, শিক্ষা, অর্থনীতি, প্রতিযোগিতামূলক কাজসহ বিভিন্ন বিষয়ে মুসলামানদের নেতৃত্ব দেয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। আমাদের অতীত ইতিহাস তো তাই বলে। কিন্তু বর্তমানে আমরা যুগের অগ্রগামী তো হতে পারিনি। বরং আমরা জীবনের সকল দিকে অন্য সবার তুলনায় বহুগুণে পিছিয়ে আছি। দু’একটি ব্যতিক্রম থাকলেও সামগ্রিকভাবে মুসলমানরা একটি অনগ্রসর জাতিতে পরিণত হয়েছে।

এই তিনটি সমস্যা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করার পর আমার কাছে মনে হয়েছে, এগুলো বড় সমস্যা হলেও বাস্তবে এগুলো আরো বড় ধরনের সমস্যার উপসর্গ মাত্র। প্রকৃতপক্ষে, দুইটি বড় ধরনের সমস্যার ফলে এই উপসর্গগুলো দেখা যাচ্ছে। এ দুটো হলো–

ক. ফিকির (বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান) এবং
খ.নেতৃত্ব

যদি সঠিক বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান কাঠামো গঠন ও সঠিক নেতৃত্ব দেয়া সম্ভব হয় তাহলে বাকি সমস্যাগুলো সমাধান করা সম্ভব। এর মাধ্যমে জাতি, উম্মাহ কিম্বা সংগঠনকে প্রতিযোগিতা-সক্ষম হিসাবে গড়ে তুলে বিশ্বে নেতৃত্ব দেয়া সম্ভব।

৪. ফিকির (বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান): বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানের সাথে কয়েকটি বিষয় জড়িত–

ক. আকিদা (ঈমান): যদি কারো ঈমান বা বিশ্বাসের জায়গাটিতে ত্রুটি থাকে তাহলে বাকি সব কিছুই ভুলের উপর প্রতিষ্ঠিত হবে।

খ. মূল্যবোধ ও নৈতিকতা: মূল্যবোধ ও নৈতিকতা বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানের অন্যতম প্রধান অংশ।

গ. পারিপার্শ্বিক জীবন-জগৎ ও বৈশ্বিক জ্ঞান: একজন ব্যক্তি হিসেবে আমাদের পারিপার্শ্বিক জীবন ও জগৎ এবং বৈশ্বিক জ্ঞান থাকাটা বাঞ্ছনীয়। তবে এক্ষেত্রে যদি কেউ ষড়যন্ত্র তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকেন তাহলে তিনি নিশ্চিতভাবে ভুলের জগতে বসবাস করছেন।

ঘ. ব্যক্তির নিজস্ব ভূমিকা সম্পর্কে স্পষ্ট জ্ঞান: বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ব্যক্তি হিসেবে জীবন, জগৎ এবং বৈশ্বিক বিষয়ে আমাদের ভূমিকা কী হবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট জ্ঞান থাকা।

ঙ. জীবন সম্পর্কে পরিকল্পনা থাকা: যদি কারো বুঝজ্ঞানের ক্ষেত্রে ন্যূনতম স্বচ্ছতা থাকে তাহলে তার অবশ্যই জীবন সম্পর্কে পরিকল্পনা থাকতে হবে।

৫. নেতৃত্ব: বুদ্ধিবৃত্তিক বোঝাপড়ার পাশাপাশি নেতৃত্ব অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। অযোগ্য নেতৃত্ব অধীনস্তদেরকে ভুল পথে পরিচালিত করে। এই সব বিবেচনায়, আমি নেতৃত্ব তৈরির প্রশিক্ষণ নিয়ে একটি বিশেষ কাজ শুরু করেছিলাম। নেতৃত্ব দিতে গেলে প্রথমে বুঝা দরকার, নেতৃত্ব বলতে কী বুঝায়? নেতৃত্ব বিষয়টি বুঝার জন্যে আমার একটি তত্ত্ব আছে। আসলে এটি অনেকগুলো তত্ত্বের সমন্বয়ে একটি তত্ত্ব।

প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষাদান এই দুইটি বিষয়ের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। যখন আমরা কাউকে শিক্ষাদান করি তখন আমরা মূলত জ্ঞান বিতরণ করে থাকি। অন্যদিকে আমরা যখন প্রশিক্ষণ দিই তখন মূলত তিনটি কাজ করে থাকি –

ক. জ্ঞান বিতরণ করি
খ. দক্ষতা বৃদ্ধি করি এবং
গ. মানসিকতা পরিবর্তন করি।

আমি মনে করি, এই তিনটি বিষয় প্রশিক্ষণ দেয়া হলে ব্যক্তির আচরণে ইতিবাচক পরিবর্তন হবে এবং তার সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। সুতরাং প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য হলো জ্ঞান, দক্ষতা এবং মানসিকতা পরিবর্তনের মাধ্যমে ব্যক্তির আচরণ পরিবর্তন করা এবং যোগ্যতা বৃদ্ধি করা।

দীর্ঘদিন নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ দেয়ার অভিজ্ঞতায় লক্ষ্য করেছি, বয়স্ক মানুষদের প্রশিক্ষণ দিলে সহজে জ্ঞান বিতরণ এবং দক্ষতা বৃদ্ধি করা গেলেও তাদের মানসিকতা পরিবর্তন করা খুবই কঠিন। তখন আমরা আরেকটু কম বয়সী উচ্চ মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা করলাম। বয়স্কদের তুলনায় তাদের প্রশিক্ষণের ফলাফল অনেক ভালো হয়েছিল। এবার আমরা আরো কম বয়স্ক তথা মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দিলাম। উচ্চ মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের তুলনায় তাদের প্রশিক্ষণের ফলাফল আরো ভালো হয়েছিল। এভাবে আমরা আরো কম বয়স্কদের প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা করলাম। এবার আমরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ দিয়ে ব্যাপক সাফল্য পেলাম। তারপর আরো কম বয়সীদের তথা নার্সারিতে পড়া ছাত্রছাত্রীদেরকে নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ দিলাম।  মজার ব্যাপার হলো সব শেষে আমরা বুঝলাম, নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যাপারে সবচেয়ে সঠিক সময় হচ্ছে দুই থেকে ছয় বছর বয়স। এই হলো নেতৃত্ব তৈরির প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যাপারে আমার জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা।

‘নেতৃত্ব’ বিশ্লেষণ

নেতৃত্বের সংজ্ঞা: নেতৃত্ব নিয়ে আমার নিজের সংজ্ঞাটি হলো –‘leadership is the ability to move people towards goals.’ অর্থাৎ, ‘মানুষকে লক্ষ্যের দিকে ধাবিত করার বা পরিচালনা করার যোগ্যতা হলো নেতৃত্ব’। এই সংজ্ঞাটিকে চারটি ভাগে ভাগ করে বুঝা দরকার।

প্রথমত, নেতৃত্ব হলো ‘যোগ্যতার’ বিষয় (leadership is an ability)।নেতৃত্ব কোনো বিজ্ঞান কিম্বা জ্ঞানের বিষয় নয়। নেতৃত্ব নিয়ে হাজার হাজার বই পড়তে পারেন, তবে বই পড়ে নেতা হওয়া সম্ভব নয়। নেতৃত্ব দিতে গেলে অবশ্যই কিছু যোগ্যতা থাকতে হবে। বই সহায়ক হতে পারে কিন্তু বই পড়ে নেতা হওয়া যায় না।

দ্বিতীয়ত, নেতৃত্বের ব্যাপারে যে কথাটি আসে তা হলো, ‘মানুষ পরিচালনা করা’(moving people)। এখন প্রশ্ন হলো, কীভাবে মানুষকে পরিচালনা করবেন? মানুষ পরিচালনার পাঁচটি উপায় আছে–

১. মানুষকে প্রলুব্ধ করার মাধ্যমে: ব্যক্তির অবস্থান, অর্থ-সম্পদ, পরকালীন মুক্তি ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষকে প্রলুব্ধ করা যায়।

২. ভীতি প্রদর্শন করে: মানুষকে ভয় দেখিয়ে কিম্বা হুমকি দিয়ে তাদের উপর নেতৃত্ব ফলানো সম্ভব। যেমন, কেউ বলতে পারেন, আপনি যদি আমার নির্দেশিত কাজটি না করেন তাহলে আপনাকে কঠিন শাস্তি দেয়া হবে। এটা ঠিক, মানুষ হুমকির মুখে বাধ্য হয়ে কারো পক্ষে কাজ করে থাকে।

৩. বক্তৃতা দেয়ার মাধ্যমে: কারো যদি আকর্ষনীয় বক্তব্য দিয়ে মানুষকে আকৃষ্ট করার যোগ্যতা থাকে তাহলে তারা নেতৃত্ব দিতে অনেক বেশি সক্ষম।

৪. মানুষকে প্ররোচিত করার যোগ্যতা দিয়ে: নেতৃত্বের ক্ষেত্রে এই যোগ্যতাটি অনেক বেশি কার্যকর এবং অনেক বেশি স্থায়ী।

৫. অনুসরণের জন্যে আদর্শ হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করে: মানুষের মাঝে নিজেকে অনুসরণ এবং অনুকরণের আদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করার মাধ্যমে নেতৃত্ব দেয়া সম্ভব।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই পাঁচটির মধ্যে কোন পদ্ধতিটি রাসূল (সা) ব্যবহার করেছিলেন? উত্তর হলো, তিনি এর সব কয়টি ব্যবহার করেছিলেন। সুতরাং নেতৃত্ব দিতে গেলে জানতে হবে কিভাবে মানুষকে কাজে লাগাতে হয়, এমনকি সেটা ভয় দেখিয়ে হলেও করতে হবে। কারণ কিছু মানুষ আছে যারা ভীতি বা হুমকি ছাড়া কাজ করতে চায় না। তবে নিতান্তই প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে বুদ্ধিমত্তার সাথে এবং ন্যায়ভাবে ভীতি প্রদর্শন করতে হবে।

তৃতীয়ত, যে বিষয়টি নেতৃত্বের সাথে জড়িত তাহলো ‘মানুষ’ (people)। তবে মানুষের চেয়ে আরো উপযুক্ত শব্দ হলো অনুসারী (followers)। অর্থাৎ নেতৃত্ব হলো নিজের অনুসারীদেরকে পরিচালনা করার যোগ্যতা। যেহেতু অনুসারী শব্দটি নেতিবাচক অর্থেও ব্যবহার করা হয়, তাই আমি অনুসারী না বলে মানুষ শব্দটি ব্যবহার করেছি।

সর্বশেষ, নেতৃত্বের সাথে গভীরভাবে জড়িত যে বিষয়টি, তাহলো ‘লক্ষ্য’(goals)। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে একজন নেতার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কি ভালো হওয়া উচিত? নাকি খারাপ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়েও নেতৃত্ব দেয়া সম্ভব? জবাব হচ্ছে অবশ্যই সম্ভব। অধিকাংশ নেতৃত্বই হলো ক্ষতিকর কিম্বা বাজে নেতৃত্ব। তাই আমাদের বুঝতে হবে ক্ষতিকর কিম্বা বাজে নেতৃত্ব বলতে কী বুঝায়; কীভাবে এই ধরনের নেতৃত্ব কাজ করে এবং কীভাবে এই ক্ষতিকর কিম্বা বাজে নেতৃত্ব থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া সম্ভব?

তিন ধরনের বাজে বা ক্ষতিকর নেতৃত্ব রয়েছে–

ক. যে নেতার উদ্দেশ্য খারাপ: যদি উদ্দেশ্য অসৎ হয় তাহলে নেতৃত্ব ক্ষতিকর বা বাজে তো হবেই। হতে পারে সেই উদ্দেশ্য সাধারণভাবেই খারাপ অথবা কেউ ব্যক্তি স্বার্থে নেতৃত্বের সুবিধা ভোগ করে যাচ্ছে। দুইটিই সমানভাবে ক্ষতিকর। দুঃজনকভাবে অধিকাংশ নেতারাই বর্তমানে ব্যক্তি স্বার্থে কাজ করে থাকে। আর এসব কারণে অবাধ দুর্নীতির মতো বিষয়গুলো ছড়িয়ে পরেছে।

খ. খারাপ নৈতিকতা সম্পন্ন নেতা: যাদের নীতি-নৈতিকতা এবং আচরণ ভালো নয়, নেতৃত্বের ক্ষেত্রে তারা অবশ্যই ক্ষতিকর।

গ. অযোগ্য নেতা: একজন মানুষের উদ্দেশ্য অনেক বেশি সৎ হতে পারে। হতে পারে তিনি অনেক বেশি নীতিবান এবং নৈতিকতার দিক থেকে অনেক উন্নত। কিন্তু যদি তিনি অদক্ষ এবং অযোগ্য হন তাহলে তিনি অবশ্যই ক্ষতিকর ও বাজে নেতা। তাই সততা এবং নীতি-নৈতিকতার চেয়ে দক্ষতা ও যোগ্যতা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

নেতৃত্ব কি জন্মগত নাকি অর্জনের ব্যাপার?

একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো নেতৃত্বের যোগ্যতা কি জন্মগত নাকি তা অর্জন করতে হয়? বিষয়টি কয়েক ভাগে আলোচনা করা যাক:

এক.

নেতৃত্ব এবং ইতিহাস নিয়ে ব্যাপক গবেষণার পর আমি নেতৃত্ব সংক্রান্ত একটি মডেল দাঁড় করিয়েছি। আমার মতে, পৃথিবীতে মাত্র এক শতাংশ মানুষ জন্মগতভাবে নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা সম্পন্ন। যেমন, আমর ইবনুল আ’স (রা) ছিলেন জন্মগতভাবে নেতৃত্বের গুণ সম্পন্ন একজন নেতা। উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) একবার আমর ইবনুল আ’স (রা) সম্পর্কে বলেছিলেন, আমর’কে পৃথিবীর বুকে একজন আমীর (প্রশাসক) হিসেবেই মানায়, তিনি কারো অনুসারী হতে পারেন না। তাকে সব সময় নেতৃত্ব দেয়াই মানায়।’

জন্মগত নেতৃত্বের আরেকটি উদাহরণ হচ্ছেন খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা)। ইয়ারমুকের যুদ্ধে উমর (রা) খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা)-এর পরিবর্তে আবু উবাইদাহ (রা)-কে সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ দেন। সেই যুদ্ধে রোমানদের বিরুদ্ধে শুরু থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা)। আবু উবাইদাহ (রা) জানতেন খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা) হচ্ছেন শ্রেষ্ঠ নেতা এবং অন্য যে কারো তুলনায় অনেক বেশি দ্ক্ষ। খালিদের মতো সেনাপতি আর একজনও ছিল না। তাই তিনি খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা)-কে সেনাবাহিনীর শুরা সদস্য মনোনীত করলেন এবং সবাইকে জানিয়ে দিলেন, কোনো বিষয়ে শুরায় মতবিরোধ দেখা দিলে খালিদের সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত; তার মতের বিরুদ্ধে কত জন অবস্থান নিয়েছে তা দেখা হবে না। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, সেনাপতি না হয়েও খালিদ (রা) সবাইকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

তবে খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা) সেখানেই ক্ষ্যান্ত হননি। তিনি নেতৃত্বকে আরো উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। কারণ, সত্যিই তিনি জন্মগতভাবে নেতা ছিলেন। ইয়ারমুকের যুদ্ধের পর খালিদ (রা) একদিন আবু উবাইদাহ (রা)’র অনুমতি ছাড়াই একদল সৈন্য নিয়ে রোমের একটি গ্রামে আক্রমণ করেন। এই খবর পেয়ে আবু উবাইদাহ (রা) খালিদ (রা)-কে নিয়ে একটি বিখ্যাত উক্তি করেন,‘খালিদ নিজেই নিজেকে নেতা বানিয়ে নিয়েছে। তার জন্যে নেতৃত্ব ছাড়া অন্য কিছুই মানায় না’। এভাবে জন্মগতভাবে যাদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন, চার খলিফা, খাদিজা (রা), ফাতিমা (রা), আয়েশা (রা), হাসান (রা) এবং হোসাইন (রা)।

অন্যদিকে, এক শতাংশ মানুষ আছে যারা জন্মগতভাবে কারো না কারো অনুসারী। তারা কখনই নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা রাখে না এবং কিভাবে নেতৃত্ব দিতে হয় সেটা তাদের পক্ষে শেখা সম্ভব নয়। এর অন্যতম উদাহরণ হলেন আবু যর গিফারি (রা)। তিনি প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে পঞ্চম ব্যক্তি। তিনি শ্রেষ্ঠ মুসলমানদের মধ্যে অন্যতম। রাসূল (সা) আবু যর (রা) সম্পর্কে বলেছিলেন, আবু যরের চেয়ে বেশি সত্য কথা বলে এমন কেউ নেই, যার জন্যে পৃথিবী প্রশস্ত হয়ে যাবে এবং আকাশ সুশীতল ছায়া দেবে। আলী (রা) আবু যর (রা) সম্পর্কে বলেছেন, আবু যর হলেন জ্ঞানের রাস্তা।

এত উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও আবু যর (রা) কখনো কোনো কিছুর নেতৃত্বে ছিলেন না। এমনকি তিনি যাকাত সংগ্রহের উদ্দেশ্যেও কোনো দলের নেতৃত্ব দেননি।  তবে তিনি একবার চেষ্টা করেছিলেন। একদিন তিনি রাসূল (সা)-এর কাছে এসে বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমাকে আপনার পছন্দ অনুযায়ী একটি দায়িত্ব দিন’। তিনি এভাবে ইসলামের সেবা এবং সাহায্য করার জন্যে নবী (সা)-এর কাছে আবেদন করেন। তার সদিচ্ছার কোনো ঘাটতি ছিল না। কিন্তু সদিচ্ছাই যথেষ্ট নয়। আন্তরিকতা ও সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকা সত্ত্বেও একজন ব্যক্তি (পুরুষ কিম্বা নারী) নেতা হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। রাসূল (সা) আবু যর (রা)-কে বললেন, ‘ওহ! আবু যর তুমি নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে দুর্বল। যদি তোমার সাথে অন্য একজন ব্যক্তিও থাকে তাহলে সে নেতৃত্ব দেবে, তুমি তার অনুসরণ করবে’। এখন প্রশ্ন এসে যায়, তিনি কি নেতৃত্বের যোগ্যতা অর্জন করতে পারতেন? কিভাবে নেতা হতে হয় তা কি তিনি শিখতে পারতেন? তার সময় রাসূল (সা), আবু বকর (রা) এবং উমর (রা)-এর মতো মানুষ ছিলেন। তাঁরা তো আবু যর (রা)-কে নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ দিতে পারতেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো তাঁরা আবু যর (রা)-কে নেতৃত্ব কিভাবে দিতে হয় তা শিখাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।

দুই.

আমার মতে, ৮/৯ শতাংশ মানুষের অবস্থান হলো উপরিউক্ত দুই শ্রেণীর মাঝামাঝি। তারা জন্মগতভাবে নেতা নয়, আবার জন্মগতভাবে অনুসারীও নয়। তাদের মাঝে জন্মগত নেতৃত্বের কিছু বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। আমরা যদি তাদেরকে নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ দিতে পারি তাহলে তারা নেতা হওয়ার যোগ্যতা রাখে। আর যদি তাদেরকে খুব অল্প বয়স থেকে প্রশিক্ষণ দেয়া যায় তাহলে তাদের নেতা হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। সুতরাং তাদের নেতা হওয়ার বিষয়টি নির্ভর করছে কত অল্প বয়সে আমরা তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারছি, কে বা কারা তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন, তাদের প্রশিক্ষণের পাঠ্যক্রম কী এবং তাদেরকে কিভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে এসব বিষয়ের উপর।

এখন প্রশ্ন হতে পারে, কীভাবে এই শ্রেণীর মানুষদের চিহ্নিত করা সম্ভব? এই শ্রেণীর মানুষগুলো কোনো দেশ বা জনসমষ্টির জন্যে তেল-গ্যাসসহ যে কোনো সম্পদের চেয়েও মূল্যবান। আফসোসের বিষয় হলো অনেক দেশ, জনগোষ্ঠী কিম্বা রাজনৈতিক দল এই মূল্যবান সম্পদের যথার্থ ব্যবহার করছে না। মাঝেমধ্যে তারা এই মানব সম্পদের বিরুদ্ধাচরণ করে তাদেরকে কিভাবে ধ্বংস করা যায় তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরে!

তিন.

আলোচনার তৃতীয় বিষয়টি হলো, নেতৃত্ব এবং ব্যবস্থাপনার মধ্যে পার্থক্য। এটি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিছু কথা শোনা যায়; যেমন, ‘সব নেতাই হলো ম্যানেজার কিন্তু সব ম্যানেজার নেতা নয়’। এগুলো হলো নির্বোধের কথাবার্তা। এই বিষয়টি বুঝার জন্যে আমাদের নেতৃত্ব এবং ব্যবস্থাপনার মধ্যে পার্থক্য বুঝতে হবে।

নেতারা দুইটি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিয়ে থাকে– স্বল্প মেয়াদী পরিকল্পনা এবং ভবিষ্যতের জন্যে কমপক্ষে পাঁচ বছর মেয়াদী দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা। অন্যদিকে, ম্যানেজারগণ স্বল্প মেয়াদী ফলাফলের উপর গুরুত্ব দিয়ে থাকে। যে কোনো প্রতিষ্ঠানে যতো ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিদের সাথে কথা বলবেন ততোই তুলনামূলক অধিক নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাবেন। এভাবে যতো নিচের দিকে আসবেন ততো বেশি ম্যানেজারের বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাবেন। অর্থাৎ, প্রত্যেক ব্যক্তির মাঝেই কিছু না কিছু নেতৃত্ব এবং ম্যানেজারের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। কিন্তু ক্রমান্বয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিদের মাঝে নেতৃত্বের গুণাবলি বেশি দেখা যায় এবং বিপরীতক্রমে ক্রমান্বয়ে অধঃস্তনদের মাঝে ম্যানেজারের বৈশিষ্ট্য বেশি দেখা যায়। তবে কেউ যদি কোনো প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকেন, তারপরও তিনি কিছু ম্যানেজমেন্টের কাজ করে থাকেন। এমনিভাবে কেউ যদি কোনো প্রতিষ্ঠানের সর্বনিম্ন পর্যায়ে থাকেন, তারপরও তিনি কিছু নেতৃত্বের কাজ করে থাকেন; তবে তিনি মূলত ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। সুতরাং ‘সব নেতাই হলো ম্যানেজার কিন্তু সব ম্যানেজার নেতা নয়’ এই কথাটি পুরোপুরি সঠিক নয়।

নেতৃত্ব প্রসঙ্গে কতিপয় অযৌক্তিক বিবেচনা

লোকজন সাধারণত নেতৃত্বের সাথে এমন কিছু অপ্রয়োজনীয় বিষয়কে জুড়ে দেয়, যার সাথে নেতৃত্বের কোনো সম্পর্ক নেই। আমি এই ধরনের অপ্রয়োজনীয় বিষয়গুলোকে জুড়ে দেয়ার ধারণাটি বদলে দিতে চাই। এসব অপ্রয়োজনীয় বিষয় হলো –

১. নেতৃত্বের সাথে জ্ঞানের সম্পর্ক
২. নেতৃত্বের সাথে তাকওয়ার সম্পর্ক
৩. নেতৃত্বের সাথে জ্যেষ্ঠতার সম্পর্ক
৪. নেতৃত্বের সাথে বয়সের সম্পর্ক
৫. নেতৃত্বের সাথে জেন্ডারের সম্পর্ক
৬. নেতৃত্বের সাথে শারীরিকগঠনের সম্পর্ক

১. নেতৃত্বের সাথে জ্ঞানের সম্পর্ক: নেতৃত্বের সাথে জ্ঞানের সম্পর্ক দেখানোর চেষ্টা করা ঠিক নয়। অনেক সময় দেখা যায়, লোকেরা একজন শায়খ বা শিক্ষিত ব্যক্তিকে তাদের নেতা বানানোর চেষ্টা করে। কারণ তারা মনে করে, এই ব্যক্তি তো অনেক জ্ঞানী, অনেক শিক্ষিত; তিনি হয়তো ভালো নেতৃত্ব দিতে পারবেন।

প্রশ্ন হলো, তার জ্ঞান বা শিক্ষার সাথে নেতৃত্বের সম্পর্ক কী? তার জ্ঞানের সাথে নেতৃত্বের কোনো সম্পর্ক নেই। আবু যর (রা)-এর কথা মনে করেন, তাকে তো জ্ঞানের রাস্তা বলা হতো কিন্তু তিনি কখনই কোনো বিষয়ে নেতৃত্ব দেননি। অন্যদিকে, খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা) জ্ঞানের দিক থেকে খুব সামান্যই জানতেন। তিনি যেহেতু সেনাপতি ছিলেন তাই তাকে অনেক সময় নামাজে ইমামতি করতে হতো। কিন্তু দেখা যেতো তিনি ছোট ছোট সূরাগুলো পর্যন্ত ভুল করতেন। তিনি সূরা আল-কাফিরুন খুব বেশি ভুল করতেন; কারণ সেখানে একই ধরনের কথা বার বার এসেছে। তিনি নামাজ শেষে সৈন্যদের দিকে ঘুরে বলতেন, ‘আমি জিহাদ দ্বারা এতো বেশি সম্পৃক্ত হয়ে গেছি যে, কুরআনের জ্ঞান অর্জন করতে পারিনি’।খালিদ (রা) একজন নেতা ছিলেন অথচ তিনি জ্ঞানী বলতে যা বুঝায় তা ছিলেন না। অন্যদিকে আবু যর (রা) জ্ঞানের দিক থেকে পরিপূর্ণ ছিলেন কিন্তু তিনি নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে অক্ষম ছিলেন।

সুতরাং, কেউ জ্ঞানী হওয়ার কারণে কিম্বা কারো অনেকগুলো ডিগ্রি থাকার কারণে তাকে নেতৃত্বের আসনে বসাবেন না। জ্ঞানের সাথে নেতৃত্বের কোনো সম্পর্ক নেই। আমি জানি, বর্তমানে এরকম অনেক রাজনৈতিক দল কিম্বা আন্দোলন আছে যেখানে নেতৃত্ব বা দায়িত্ব দেয়া হয় কারো জ্ঞানের বহর কিম্বা অর্জিত ডিগ্রির উপর ভিত্তি করে। যা পুরোপুরি ভুল সিদ্ধান্ত।

২. নেতৃত্বের সাথে তাকওয়ার সম্পর্ক: তাকওয়া ও নেতৃত্বকে এক করে দেখা উচিত নয়। আমাদের মাঝে অনেক ভাই-বোন তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি তাকওয়াবান। তারা হয়তো রাত জেগে ইবাদত করে থাকেন, কুরআনের অনেক আয়াত মুখস্ত বলতে পারেন ইত্যাদি। কিন্তু প্রশ্ন হলো এগুলোর সাথে নেতৃত্বের সম্পর্ক কোথায়? তাদের তাকওয়া তো তাদের নিজেদের জন্যে।

ইমাম আহমেদ ইবনে হাম্বলকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল– ‘আমরা যুদ্ধে যাওয়ার সময় কি এমন কারো নেতৃত্বে যাবো যিনি শ্রেষ্ঠ ও শক্তিশালী নেতা কিন্তু পাপী; নাকি এমন কারো নেতৃত্বে যাবো যিনি দুর্বল কিন্তু তাকওয়াবান’? ইমাম আহমদ জবাব দিলেন, ‘একজন তাকওয়াবান নেতা যদি দুর্বল হন, সেক্ষেত্রে তাকওয়া তার নিজের ব্যাপার। কিন্তু তার দুর্বলতা তার অনুসারীদের জন্যে অকল্যাণ বয়ে নিয়ে আসবে। সুতরাং এমন কোনো ব্যক্তির অধীনে থাকো যিনি শক্তিশালী। যদি তিনি পাপীও হয়ে থাকেন, তারপরও তাকে নেতা বানাও’।

বর্তমানে ইসলামী আন্দোলনগুলোতে দেখবেন, লোকেরা কারো তাকওয়া নিয়ে কটাক্ষ করছে; কার কী ভুল আছে তা বলে বেড়াচ্ছে; কিম্বা দেখবেন তারা কোনো ব্যক্তির নামে বলে বেড়াচ্ছে যে, ইসলাম সম্পর্কে তার অনেক ভুল ধারণা আছে ইত্যাদি। এই সব কিছুর সাথে নেতৃত্বের কোনো সম্পর্ক নেই। যার তাকওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা আছে, দেখা যাবে তিনি হয়তো একজন শিক্ষিত ও অধিক তাকওয়াবান ব্যক্তির চেয়ে অনেক ভালোভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। হতে পারে ঐ জ্ঞানী ব্যক্তি ভালো সংগঠক নন যদিও তিনি অনেক তাকওয়াবান। এখানে যোগ্যতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই তাকওয়ার সাথে নেতৃত্বের সম্পর্ক দেখানোর চেষ্টা করা উচিত নয়।

৩. নেতৃত্বের সাথে জ্যেষ্ঠতার সম্পর্ক: কে কত বছর ধরে সংগঠনের সাথে জড়িত কিম্বা কে আগে সংগঠনের সদস্য হয়েছে এসবের সাথে নেতৃত্বের সম্পর্ক দেখানোর চেষ্টা সমীচীন নয়। জ্যেষ্ঠতার সাথে নেতৃত্বের কোনো আবশ্যিক সম্পর্ক নেই। সমসাময়িক সমাজবিজ্ঞান এবং ইসলামের ইতিহাসে বিষয়টি খুবই স্পষ্ট। আবু যর (রা) ইসলামের প্রথম বছরেই ইসলাম গ্রহণ করেন। খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা) এবং আমর ইবনে আ’স (রা) হিজরী সপ্তম সালের শেষের দিকে ইসলাম গ্রহণ করেন। খালিদ (রা) এবং আমর (রা)-এর সাথে আবু যর (রা)-এর ইসলাম গ্রহণের ব্যবধান হলো বিশ বছর। অথচ তারা দুইজনই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আবু যর (রা) কখনই নেতৃত্ব দেননি।

আরেকটি উদাহরণ হলো, খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা) ইসলাম গ্রহণের চার মাস পরে মুতার যুদ্ধে সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বিশ্বজুড়ে সমসাময়িক ইসলামী আন্দোলনগুলোর কোথাও দেখাতে পারবেন যে, একজন ব্যক্তি সংগঠনে যোগ দেয়ার চার মাস পরে তাকে এ রকম কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নেতৃত্বের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে? নেতৃত্ব সম্পর্কে ভালো ধারণা এবং প্রয়োগ রাসূলের (সা) চেয়ে কে অধিক জানেন?

আমর ইবনে আ’স (রা) ইসলাম গ্রহণের পাঁচ মাস পরেই যাতুস্ সালাসিলের যুদ্ধে সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আমর ইবনে আ’স (রা)-এর সেনাবাহিনীতে ছিলেন আবু বকর (রা) এবং উমর (রা)-এর মতো ব্যক্তি। যুদ্ধে আমর ইবনে আ’স (রা)-এর বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে উমর (রা) বেশ ক্ষিপ্ত ছিলেন। তাই তিনি আমর (রা)-এর কাছে অভিযোগ দেন, কিন্তু আমর (রা) তা প্রত্যাখান করেন এবং উমর (রা)-কে তার সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য করেন। অর্থাৎ উমর (রা)-এর উপর আমর (রা) নেতৃত্ব দিয়েছেন। যা হোক, এতে করে উমর (রা) আরো বেশি রাগান্বিত হলেন এবং তিনি এসব ব্যাপার মানতে পারছিলেন না। তিনি আবু বকর (রা)-এর কাছে গিয়ে রাগের সাথে বললেন, ‘আমর কি সব করছে, এসব ব্যাপার আপনার চোখে পড়ছে না? এই সব দেখেও আপনি কেন নীরব থাকছেন’? আবু বকর (রা) খুব শান্ত এবং দৃঢ়তার সাথে উত্তর দেন –‘উমর! সে যদি তোমার চেয়ে এই বিষয়ে যোগ্য না হতো তাহলে রাসূল (সা) তাকে এ দায়িত্ব দিতেন না’।

সুতরাং বিষয়টি একেবারে পরিষ্কার। নেতৃত্বের সাথে জ্যেষ্ঠতার সম্পর্ক এখানে কোথায়?

মুতার যুদ্ধে রাসূল (সা) কয়েকজনকে পর্যায়ক্রমে সেনাপতির দায়িত্ব দেন। তারা হলেন, জাফর ইবনে আবি তালিব (রা), যায়েদ ইবনে হারিসা (রা) এবং আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা)। তারা সবাই যুদ্ধে শহীদ হলে ইসলামের পতাকাও পতিত হয়। সে সময় কে ইসলামের পতাকা আবার তুলে ধরেছিলেন? তিনি হলেন সাবিত ইবনে আল-আকরাম (রা), যিনি বেশ বয়োজ্যেষ্ঠ এবং বদরী সাহাবী ছিলেন। যারা বদর যুদ্ধে ইসলামের জন্যে লড়াই করেছিলেন তাদেরকে মনে করা হয় শ্রেষ্ঠ মুসলিম এবং তারা মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত। সাবিত (রা) পতাকা নিজের হাতে তুলে নিলেন এবং সরাসরি খালিদ (রা)-এর কাছে যান এবং তাঁর হাতে ইসলামের পতাকা তুলে দেন। সাবিত (রা) বলেন, ‘খালিদ, তুমি নেতৃত্ব দাও’। এ কথা শুনে খালিদ (রা) বললেন, ‘আপনি আমাদের সবার শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি এবং ইসলামের দৃষ্টিতে আপনি আমার চেয়ে উত্তম। তাছাড়া আপনি আমার চেয়ে বয়সেও বড় এবং আপনি তো বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অন্যতম’। সাবিত (রা) বলেন, ‘খালিদ, এ ব্যাপারে আর প্রশ্ন করো না। আমি এই পতাকা শুধুমাত্র তোমার জন্যে এনেছি; কারণ এ বিষয়ে তুমি আমার চেয়ে অনেক যোগ্য’। এভাবে খালিদ (রা) সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দেন। অর্থাৎ রাসূল (সা) এবং সাহাবীদের উদাহরণ থেকে এটা স্পষ্ট, সিনিয়রিটি বা জ্যেষ্ঠতার সাথে নেতৃত্বের কোনো অপরিহার্য সম্পর্ক নেই।

৪. নেতৃত্বের সাথে বয়সের সম্পর্ক: এই বিষয়টিও ইসলামে স্পষ্ট করা আছে। আবু যর (রা)-এর তুলনায় খালিদ (রা) এবং আমর (রা) বয়সে অনেক ছোট ছিলেন। এর চেয়ে আরো যথার্থ উদাহরণ হিসেবে উসামা ইবনে যায়েদ (রা)-এর কথা বলা যায়। মৃত্যুর এক সপ্তাহ আগে রাসূল (সা) তাকে সেনাপতি নিয়োগ করেন। সে সময় মুসলিম সেনাবাহিনী বেশ সুসংগঠিত ছিল এবং তারা মদিনার উপকণ্ঠে অবস্থান গ্রহণ করে। উসামা (রা)-এর সেনাবাহিনীতে আবু বকর (রা) এবং উমর (রা)-এর মতো শ্রেষ্ঠ মানুষেরা ছিলেন। সে সময় উসামা (রা)-এর বয়স ছিল মাত্র সাড়ে সতের বছর। অনেক সাহাবী তার বয়সের ব্যাপারে অভিযোগ করেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে জোরালো অভিযোগ আসে উমর (রা)-এর পক্ষ থেকে। তিনি বলেন, ‘রাসূল (সা) আমাদের নেতৃত্ব দেয়ার জন্যে একটি ছোট ছেলেকে নিয়োগ দিয়েছেন’। এই ধরনের অভিযোগ বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে এ সব কথা রাসূল (সা) জানতে পারলেন। মৃত্যুর তিন দিন আগে এক বক্তৃতায় রাসূল (সা) অনেকগুলো বিষয় নিয়ে কথা বলেন। তখন তিনি এই বিষয়টি নিয়েও কথা বলেন। রাসূল (সা) বলেন, ‘তোমরা উসামার নেতৃত্বের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছো। আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, সে তার বাবার মতো একজন নেতা হয়েই জন্ম নিয়েছে’। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় কিছু মানুষ আসলে জন্মগতভাবে নেতৃত্বের গুণ সম্পন্ন। সুতরাং নেতৃত্বের সাথে বয়সের সম্পর্ক আরোপ করার চেষ্টা একেবারেই ভুল।

৫. নেতৃত্বের সাথে জেন্ডারের সম্পর্ক: নামাজের মতো একান্ত ইবাদতের বিষয় বাদে নেতৃত্বের ব্যাপারে নারী-পুরুষ ভেদাভেদ করা উচিত নয়। পুরুষরা নারীদের তুলনায় কয়েকটি ক্ষেত্রে যেমন এগিয়ে আছে, তেমনি নেতৃত্ব দেয়ার ব্যাপারে নারীরাও পুরুষদের তুলনায় নিম্নোক্ত কয়েকটি ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে –

ক. পরামর্শ: নারীরা পুরুষদের তুলনায় আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে বেশি পছন্দ করেন। অর্থাৎ তারা শুরা বা পরামর্শকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। বিষয়টি কুরআনে আছে এবং প্রমাণিত একটি বিষয়। সুলাইমান (আ)-এর সাথে রাণী বিলকিসের ঘটনা থেকে জানা যায়, যখন বিলকিস পাখির মাধ্যমে চিঠি পেলেন তখন তিনি তার উপদেষ্টাদের ডেকে বললেন, ‘আমি আপনাদের সাথে পরামর্শ না করে কোনো সিদ্ধান্ত নিব না’। এটা সত্য যে পুরুষরা একনায়কত্বকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। এটা কুরআনের বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত। যেমন, বিলকিসের উপদেষ্টারা বললেন, ‘আমরা সাহসী এবং শক্তিশালী, আপনি যা চান ইচ্ছা মতো তা করতে পারেন’। দেখুন, বিলকিস সবাইকে নিয়ে আলোচনার কথা বলছেন আর তার উপদেষ্টাগণ একনায়কত্বকে গুরুত্ব দিচ্ছেন!

খ. সৃজনশীলতা: নারীরা পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি সৃজনশীল হয়ে থাকে। যার কারণে নারীরা নেতৃত্ব দিতে বেশি সক্ষম। যদি আপনার কোনো সৃজনশীল সিদ্ধান্ত নিতে হয়ে তাহলে আপনার কাজের সাথে নারীদের সংযুক্ত করতে পারেন। তারা আপনাকে অনেক ভালো পরামর্শ দিতে সক্ষম।

গ. দূরদৃষ্টি: নারীরা পরিকল্পনা করার সময় পুরুষদের তুলনায় অনেক গভীর চিন্তা-ভাবনা ও দূরদৃষ্টির সাথে পরিকল্পনা করে থাকে। সমস্যা হলো নারীরা পরিকল্পনার সাথে খুব বেশি জড়িত থাকে না। তারা জীবনের অনেক বড় একটা সময় সাজসজ্জা এবং জীবনের গতানুগতিক তুচ্ছ বিষয়গুলো নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকে। তারা নেতৃত্বের জায়গাগুলোতে অংশগ্রহণ না করায় পুরুষেরা সব জায়গায় নেতৃত্ব দিচ্ছে।

অন্যদিকে, পুরুষরা নারীদের তুলনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এগিয়ে আছে। সেটা হলো সিদ্ধান্ত নেয়ার যোগ্যতা। পুরুষরা নারীদের তুলনায় অনেক বেশি বিচারক্ষমতাসম্পন্ন হয়ে থাকে। পুরুষরা কঠিন মুহূর্তেও সিদ্ধান্ত নিতে পারে। অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীরা সিদ্ধান্ত নিতে কালক্ষেপণ করে ও দ্বিধায় ভোগে। প্রকৃত নেতার বৈশিষ্ট্য হলো অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও সিদ্ধান্ত নিতে পারা।

নারী নেতৃত্ব: নারী নেতৃত্বের বিষয় আসলে অনেকেই যথাসম্ভব বিরোধিতা করেন। তাঁরা নারী নেতৃত্বের বিরোধিতা করার সময় যে হাদীসটি উল্লেখ করে থাকেন তা হলো –‘যারা নারী নেতৃত্বের অধীনে থাকে তারা সফল হতে পারে না’। কেউ যদি কোনো হাদীসের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে চায় তাহলে তাকে অবশ্যই সে সংক্রান্ত সবগুলো হাদীসের খুঁটিনাটি জানতে হবে। নারী নেতৃত্ব সংক্রান্ত তিনটি বিষয় আলোচনার দাবি রাখে।

প্রথমত, উল্লেখিত হাদীসটির অনেকগুলো সংস্করণ আছে। দুর্বল হাদীস বাদ দিয়েও এই হাদীসটির ২০টি সংস্করণ আছে, যার প্রত্যেকটি সহীহ। হাদীস শাস্ত্র আনুযায়ী, যদি একই বিষয়ে হাদীসের কমপক্ষে দুইটি সংস্করণ থাকে, তাহলে দুইটি হাদীসের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যদি দুইটি হাদীসই সহীহ হয় তাহলে একটি গ্রহণ করে অন্যটিকে বাদ দেয়া যাবে না। যেমন, কুরআনে আল্লাহ সুবাহানাহু তায়ালা বলেছেন, ‘তোমরা দাসদের মুক্ত করে দাও’। অন্য আরেকটি আয়াতে একই বিষয়ে আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা মুসলিম দাস মুক্ত করে দাও’। এখন, এ বিষয়ে আমাদের উচিত হবে একজন মুসলিম দাস মুক্ত করার অর্থকে গ্রহণ করা। যখন কেউ মুসলিম দাস মুক্ত করবেন তখন তার সাধারণ অর্থে দাস মুক্ত করাও হয়ে যাবে। কিন্তু যদি কেউ অমুসলিম দাস মুক্ত করেন তাহলে তিনি অন্য আর একটি আয়াতের নির্দেশনা মানছেন না।

নারী নেতৃত্ব নিয়ে যে হাদীসটির কথা বলা হয়ে থাকে, সেই হাদীসের একটি সহীহ সংস্করণে কতগুলো সুস্পষ্ট শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন, ‘মুলক’। আমরা জানি, ‘ওয়ালাও’ শব্দের অর্থ হলো কারো নেতৃত্বের অধীনে থাকা, আর ‘মালাকু’ শব্দের অর্থ হলো কোনো রাণীর অধীনে থাকা। হাদীসের ঐ বর্ণনায় একজন নারীর কোনো রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকা নিয়ে বলা হয়েছে। সুতরাং এই হাদীসটির বরাতে কেউ নারীদেরকে সংসদ সদস্য কিম্বা বিচারক ইত্যাদি হতে বারণ করতে পারেন না। যদি কেউ তা করার চেষ্টা করেন, তাহলে হাদীসের অন্য একটি সহীহ বর্ণনাকে অস্বীকার করা হবে।

দ্বিতীয়ত, ইমাম বুখারী বর্ণিত এই হাদীসটির পিছনে একটি ঘটনা আছে। ঘটনাটি হলো, পারস্যকে সাসানাইড সম্রাটরা এক হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে শাসন করেছেন। যখন প্রথম খসরুর শাসন চলছিল, তখন রাজ্যের ভবিষ্যত কর্ণধর কে হবে তা নিয়ে ব্যাপক ষড়যন্ত্র শুরু হয়। এ নিয়ে প্রথম খসরু খুবই বিরক্ত ছিলেন। তিনি একদিন সবাইকে অবাক করে যুবরাজ এবং নিজেকে বাদ দিয়ে সাসানাইড রাজবংশের সকল পুরুষ সদস্যকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত দিলেন। তবে ভাগ্যক্রমে ইয়াযদেগারদ নামের একজন ছোট ছেলে বেঁচে যায়। পরবর্তীতে যাকে পারস্যের কিসরার রাজা বানানো হয়। মুসলমানরা যখন উমর (রা)-এর নেতৃত্বে কাদেসিয়ার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, সে সময় তিনি পারস্য সাম্রাজ্যের রাজা ছিলেন।

যা হোক, ঘটনাক্রমে সম্রাটের মৃত্যুর আগেই যুবরাজ মৃত্যুবরণ করেন। সে সময় তারা পারস্য শাসনের জন্য রাজপরিবারের কোনো পুরুষকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তখন কিসরার মেয়েকে সিংহাসনে বসানো হয়। এই খবর রাসূল (সা)-এর কাছে পৌঁছলে তিনি আলোচ্য মন্তব্যটি করেন। রাসূল (সা) কোনো আদেশ করেননি। তিনি শুধুমাত্র তার অর্ন্তদৃষ্টি থেকে তাদের সম্পর্কে একটি সাধারণ ভবিষ্যৎবাণী করেছেন।

সহীহ বুখারী মনোযোগ দিয়ে পড়লে দেখবেন, ইমাম আবু ইসমাঈল আল-বুখারী হাদীস বিশেষজ্ঞের পাশাপাশি একজন ফকিহও ছিলেন। যদিও তিনি ফিকাহর উপর কোনো বই লিখেননি। তিনি তার মতামত সহীহ বুখারীর বিভিন্ন অধ্যায়ের শিরোনামের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। ‘যারা নারী নেতৃত্বের অধীনে থাকে তারা সফল হতে পারে না’ এই হাদীসটি বুখারী শরীফের কোন অধ্যায়ে আছে?

বুখারী শরীফে ‘কিতাবুল ফিতনা’ একটি অধ্যায় এবং ‘কিতাবুল আহকাম’ আরেকটি অধ্যায়। এই হাদীসটি ‘কিতাবুল ফিতনা’য় সংযোজিত। ‘কিতাবুল আহকাম’ অধ্যায়ে ‘ইমারত’ তথা নেতৃত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা থাকা সত্ত্বেও এ হাদীসটিকে সে অধ্যায়ে রাখা হয়নি। সুতরাং নেতৃত্বের সাথে সর্বপর্যায়ে জেন্ডারের সম্পর্ক খোঁজার চেষ্টা করা উচিত নয়। নারীরা যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে যে কোনো বিষয়ে নেতৃত্ব দিতে পারেন, হতে পারে তা রাষ্ট্রপ্রধানের মতো দায়িত্ব।

৬. নেতৃত্বের সাথে শারীরিক গঠনের সম্পর্ক: মানুষের শারীরিক কাঠামোর সাথে নেতৃত্বের কোনো সম্পর্ক নেই। শারীরিক কাঠামো একটি অতিরিক্ত বৈশিষ্ট্য; যা নেতৃত্বের জন্যে সহায়ক হলেও আবশ্যক কোনো বিষয় নয়। নেতাদের শারীরিক সৌন্দর্য কিম্বা চেহারার মাধ্যমে মানুষকে আকৃষ্ট করা অপরিহার্য নয়। কুরআনে বর্ণিত তালুতের ঘটনার মাধ্যমে আমরা সবাই জানি, এটি একটি অতিরিক্ত গুণ। যখন বনী ইসরাঈলের একজন নবী তাদেরকে বললেন, আল্লাহ তোমাদের জন্যে নবী হিসেবে তালুত নামে একজনকে মনোনীত করেছেন, যিনি তোমাদের পরবর্তী শাসক হবেন। তারা এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে। কারণ, তালুত কোনো রাজপরিবারের সদস্য ছিলেন না এবং তিনি সম্পদশালীও ছিলেন না। তাদের নবী তাদেরকে দৃঢ়তার সাথে বললেন, আল্লাহ তাকে তোমাদের নেতা হিসেবে মনোনীত করেছেন। তবে তালুত শারীরিকভাবে অনেক বলিষ্ঠ ছিলেন এবং তিনি জন্মগতভাবে অনেক বুদ্ধিমান ছিলেন। এ বিষয়গুলো নেতৃত্বের জন্যে সহায়ক হতে পারে। কিন্তু কোনোভাবেই একজন সফল নেতার জন্যে আবশ্যিক বা প্রয়োজনীয় শর্ত হিসেবে গণ্য হতে পারে না।

উপসংহার

নেতারা নিজেদের ভুলগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখতে পান না বা দেখতে চান না। এ ধরনের প্রবণতা আমাদের সমাজে বেশ লক্ষ্যণীয়। পৃথিবীর অধিকাংশ সংগঠনে ভালো নেতৃত্বের ব্যাপক অভাব রয়েছে। ভালো নেতৃত্ব মানে কাজে অনেক বেশি সাফল্য। নেতৃত্বের মানের উপর নির্ভর করে কোনো সংগঠন বা আন্দোলনের সফলতা-ব্যর্থতা। তাই যোগ্য নেতৃত্ব তৈরির লক্ষ্যে প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। সংগঠন বা দল বহির্ভূত নেতৃত্বের চেয়ে আন্দোলনের ভিতর থেকে নেতৃত্ব গড়ে তোলা অনেক বেশি কার্যকর।

নেতৃত্ব (সাধারণ বা বিশেষায়িত নেতৃত্ব; যেমন, বিজ্ঞান, রাজনীতি, বিচার বিভাগ, বুদ্ধিবৃত্তি ও সামরিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে নেতৃত্ব) গড়ে তোলার জন্য আদর্শ পদ্ধতি হলো ধাপে ধাপে এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা: প্রথমে নেতৃত্বের যোগ্যতাসম্পন্ন লোক খুঁজে বের করা। তারপর তাদের মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নে কাজ করা। তারপর নেতৃত্ব তৈরির উদ্দেশ্যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। সাধারণ ও বিশেষ উভয় ধরনের প্রশিক্ষণ হতে পারে। সর্বোপরি যোগ্য নেতৃত্বকে পৃষ্ঠপোষকতা করার সংস্কৃতি গড়ে তোলা।

এ ধরনের আরো লেখা