উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে নারী শিক্ষার্থীদের বহুগামিতা: সংকট ও স্বরূপ

সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী-
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক
পরিচালক, সমাজ ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন কেন্দ্র (সিএসসিএস)

সাক্ষাৎকার প্রদানকারী-
গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

শুরুর কথা

আমি আজকে কথা বলতে চাচ্ছি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী সাথীর সাথে। আমি একটা লেখা কয়েকজনের সাথে শেয়ার করেছিলাম যার শিরোনাম হলো ‘মানুষের মন এক যাদুর আয়না’। সেখানে আমি মানবিক সম্পর্ক, বিশেষ করে নারী-পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে কথা বলেছি। বলেছি, প্রতিটা নারীর মধ্যে একজন আদর্শ পুরুষের কল্পনা থাকে। আর প্রতিটা পুরুষের মধ্যে একজন আদর্শ নারীর কল্পনা থাকে। বাস্তবের মানুষটাকে সে ওই আদর্শ রূপটার সাথে মিলাতে চায়। আয়নাতে যেভাবে প্রতিফলন ঘটে তেমনি করে বাস্তবে পাওয়া মানুষটার মধ্যে সে আদর্শ মানুষটার প্রতিফলন দেখতে পায়।

যেই মানুষটার সাথে বাস্তবে আমার সাক্ষাৎ হলো সেই মানুষটাকে আমরা প্রাথমিকভাবে আদর্শ মানুষ বলেই মনে করি, যতক্ষণ না আরো বেশি মিল আছে এমন কারো সাথে সাক্ষাৎ হয়। নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য এটি অংকের নিয়মের মতো প্রযোজ্য। অবশ্যম্ভাবী।

এখানে আরেকটা জিনিস ঘটে। যখন আমরা কারো সাথে মেলামেশা করি, নারী বা পুরুষ বিপরীত লিঙ্গের কারো সাথে, তখন আমাদের পাশে যে আছে আমার সঙ্গী হিসাবে, আমার স্বামী বা স্ত্রী হিসেবে, ওয়েস্টার্ন ভাষায় আমার পার্টনার হিসেবে, তার মধ্যে যেসব ত্রুটি আছে, হয়তো দেখা গেল, কোনোভাবে আমার কাছে আসা সেই নারী বা পুরুষটার মধ্যে ওই সব ত্রুটি নাই কিংবা কম আছে। কিংবা কোনো একটা গুণ একটু বেশি আছে।

স্বভাবতই আমরা যা পাই তা আমাদের মনে থাকে না। যা আমাদের না-পাওয়া বা কম-পাওয়া, সেটার প্রতি আমাদের আকর্ষণ তৈরি হয়। তখন আমরা আকৃষ্ট হয়ে পড়ি পরপুরুষ বা পরনারীর প্রতি। এমতাবস্থায় আমরা যখন পুরনো সম্পর্কটাকে অবহেলা করে নতুন মানুষের সাথে নতুন সম্পর্ক গড়ে তুলি, ভাগ্যের পরিহাস বা ট্রাজেডি হলো, দেখা গেল নতুন মানুষটার যে বিষয়টা দেখে আমি আকৃষ্ট হয়েছিলাম তার মধ্যে সেটা তো আছে, কিন্তু তার মধ্যে যে আরো কতগুলো ঘাটতি বা ত্রুটি রয়ে গেছে, সেটা আমরা আগে খেয়াল করি নাই।

কিন্তু আমাদের মনের আয়নায় আমরা যে আদর্শ মানুষের ছবি প্রতিনিয়ত দেখতে পাই, ঐ আদর্শ রূপের সাথে যখন আমরা নতুন মানুষটাকে মিলাতে যাই তখন আমরা নতুন সম্পর্কটা নিয়েও আবার সমস্যার মধ্যে পড়ি। দ্রুতই ডিস্যাটিসফাইড হয়ে পড়ি। মানবিক সম্পর্কের এই যে টানাপড়েন ও সংকট, এগুলোই ছিল মূলত ঐ লেখাটার আলোচ্য বিষয়। লেখাটা আমি বেশ কয়েকজনের কাছে পাঠাই, যার মধ্যে এই ছাত্রীটিও ছিল। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী।

আমার লেখার বিষয়ে ও আমাকে একটা উত্তর দেয়। সেটা নিয়ে আলোচনার জন্য ওকে আমি ডেকেছি। ছাত্রীটার সাথে আমার আলাপচারিতার সময়ে উপস্থিত ছিল ‘সমাজ ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন কেন্দ্র’র দু’জন সহকারী জনাব আবদুল কাইয়ুম সৌরভ ও জনাব মো: ফয়সাল মিয়া।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: তোমার উত্তরটা কি আমি পড়ব?

সাথী: জ্বি স্যার পড়ুন। সমস্যা নেই।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: তুমি লিখেছ, ‘আসসালামু আলাইকুম স্যার। বাংলাদেশে বর্তমানে মেয়েদের দেহের পর্দা বেশি। কিন্তু মনের পর্দা একেবারে নেই। দেখা যায়, একজন মেয়ে পর্দা করে, নিকাব পরে চলাফেরা করে। তবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া তার দ্বারা হয়ে ওঠে না। তার সাথে কিছুদিন থাকলেই বোঝা যায় সে বহুগামী।

বর্তমানে বেশিরভাগ মেয়ের মধ্যেই এই প্রবণতা প্রবল। তারা একইসাথে জাস্ট ফ্রেন্ড, পাতানো ভাই, বেস্ট ফ্রেন্ড নামক একাধিক সম্পর্কে জড়িত থাকে। যা বয়ফ্রেন্ডের আধুনিক ভার্সন। সোজা কথায় এগুলো হলো সবদিকে এক্সেস থাকার ভ্যালিডিটি। এছাড়াও মি. পার্ফেক্টকে খুঁজতে গিয়ে তারা একের পর এক রিলেশন ব্রেকআপ ইত্যাদি করে। পাশাপাশি নিজেরাও মেন্টাল ট্রমায় ভোগে।

মেয়েদের হলে প্রায় রাতেই ঘুমানোর সময় শুনি, কোনো না কোন মেয়ে তার বয়ফ্রেন্ডকে ফোনে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করছে। যে ধরনের গালিগালাজ একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর মুখে কল্পনাও করা যায় না। এসব সমস্যা ভবিষ্যতে ক্রমান্বয়ে আরো বাড়বে। আগামীতে ইউরোপ আর ভারত উপমহাদেশের কালচারের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য হয়তো থাকবে না।’

এটা তোমার মন্তব্যে। আজকে তোমাকে আমি ডেকেছি এটি বলার জন্য, তোমার এই মন্তব্যটা খুবই সাহসী এবং ব্যতিক্রমী। মেয়েদের হলে কি আসলেই এরকম ঘটে?

সাথী: জ্বি স্যার। মেয়েদের হলে এমন ঘটে এবং আমার চেনাজানা এরকম অনেকেই আছে। যে কথাটা আমি বলেছি, এমনকি পর্দানসীন অনেক মেয়েও বহুগামী। দেখা যায় যে এদের একাধিক বয়ফ্রেন্ড থাকে। হয়তোবা ভার্সিটিতে থাকে বা অন্য কোনো এলাকায়। আমার পরিচিত একজন, তার বয়ফ্রেন্ড ঢাকায় থাকে। কিন্তু তার আবার ক্লাসমেট দু’জন আছে, যাদের সাথে তার খুবই ক্লোজ সম্পর্ক। দেখে প্রথমে আমরা ভেবেছি হয়তোবা যে এই দুজনের মধ্যে কোনো একজন তার বয়ফ্রেন্ড হবে।

পরে জানলাম যে না তারা কেউ তার বয়ফ্রেন্ড না। তারা শুধুমাত্রই তার বেষ্টফ্রেন্ড। ঐ মেয়ের সাথে আবার আরেকটা ছেলের সম্পর্ক। অন্য ডিপার্টমেন্টের। আমরা ভাবলাম বয়ফ্রেন্ড। পরে দেখলাম, না এরা যাস্টফ্রেন্ড নামক একটা সম্পর্কে আবদ্ধ।

এর কিছুদিন পরই শুনি মেয়েটা ঐ যাস্টফ্রেন্ডের দ্বারা হ্যারেসড হয়েছে। এখন আমি বা আপনি যদি ঐ ছেলেটাকে শাস্তি দেই তাহলে সমাজ আপনাকে বাহবা দিবে, ওয়াও! নারী অধিকার নিশ্চিত করেছে। নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরী ইত্যাদি……

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: ঐ ছেলেটা খুব সম্ভবত …। হ্যারেসমেন্টের অভিযোগ আসছে নিশ্চয়ই…। মানে, সম্মতিবিহীন কোনো একটা কিছু সে করতে চেয়েছে।

সাথী: জ্বি, সম্মতিবিহীন সে করতে চেয়েছে। কিন্তু আপনি যদি মেয়েটার একটা সিঙ্গেল ফল্টের কথাও বলেন কিংবা মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করেন যে, এতদিন তো তোমার কাঁধে হাত দিয়ে হেঁটেছে…, এখন যখন আনএপ্রোপ্রিয়েট টাচ করল। এই জিনিসটা তোমার কাছে কেন আনএপ্রোপ্রিয়েট মনে হলো?

তখন কিন্তু পুরো সমাজ আপনার বিরুদ্ধে তেড়ে আসবে……

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: এটাকে বলবে ভিক্টিম ব্লেমিং।

সাথী: হ্যাঁ, এটাকে বলবে ভিক্টিম ব্লেমিং। তাহলে এখানে দোষটা কার? দোষটা হচ্ছে আমাদের সমাজের। কারণ আমাদের সমাজ আমাদেরকে কোন দিকে লিড করছে? আমরা বাংলা সিনেমা দেখি বা ইন্ডিয়ান সিনেমা দেখি। গান, নাটক যেটাই বলেন। সবকিছু কী? রোমান্টিক লাভ নিয়ে। কিন্তু আমাদের জীবনে রোমান্টিক লাভ ছাড়াও অন্য অনেক ব্যাপার আছে।

আমি ফেইসবুকে দেখি…। আমার ফেইসবুকের ৫০শতাংশ রিলস হচ্ছে রোমান্টিক লাভ নিয়ে। এই রকম কেন হচ্ছে? এছাড়াও আমার মনে হয় যে বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্কুল-কলেজ তথা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক শিক্ষিকারাও এই রোমান্টিক লাভ জিনিসটাকে প্রমোট করছে।

আমি নিজে একজন ক্যান্ট. পাবলিকের স্টুডেন্ট। আমি যখন ছোট ছিলাম ক্যান্ট পাবলিকের রুলস এমন ছিল, যদি কোনো ছেলে মেয়ে দুইজন একাকী দাঁড়িয়ে কথা বলে আর এইটাকে কেউ যদি নোটিস করে ক্লাস টিচারকে জানায়, তখন স্কুল কর্তৃপক্ষ গার্ডিয়ান কল করে …..

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: এটাকে ইনডিসিপ্লিন হিসেবে দেখে?

সাথী: হ্যাঁ, ইনডিসিপ্লিন হিসেবে দেখে। এখন সেখানে যা হচ্ছে সেটা শুনে আমি তাজ্জব হয়ে যাই। আমার বোন ওখানে এখন পড়ে ক্লাস নাইনে। ও বলেছে, ‘আপু, ভ্যালেন্টাইনস ডে’তে টিচাররা ক্লাসে এসে জিজ্ঞেস করে, কে কয়টা গোলাপ পেয়েছ আজকে? এবং যে মেয়েটা বেশি গোলাপ পেয়েছে তাকে বাহবা দেওয়া হয়। আমি অবাক হয়ে যাই….

মোহাম্মদ মোজাম্মের হক: লেখার মধ্যে তুমি লিখেছো, এগুলো সব হলো বিভিন্ন দিকে এক্সেস থাকার ভ্যালিডিটি। তো বিভিন্ন দিকে এক্সেস থাকা বলতে তুমি যে বিষয়টা বলছো এটা একটা সোশ্যাল ভ্যালিডিটি তৈরি করছে …

সাথী: জ্বি, স্যার। আর আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো, এই যে সোশ্যাল ভ্যালিডিটিটা…, এটা সম্পূর্ণ একটা সেকুলারিজমের প্যারাডাইম থেকে এসেছে। তো আমরা বাংলাদেশকে যতই বলি, এটা হচ্ছে একটা মুসলিম কান্ট্রি …। কিন্তু আমরা দেখছি, এটা একটা সেকুলার কান্ট্রি। এবং এই সেকুলার কান্ট্রি থেকে এই সেকুলার প্যারাডাইম উচ্ছেদ করা কিন্তু সম্ভব না। তাহলে আমরা কী করতে পারি? আপনার একটা কথা মনে আছে, having awareness is the half of the solution।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: অথবা আমরা কথাটাকে এভাবেও বলতে পারি, identification of the problem is half of the solution। আদৌ আমরা এটাকে এখন প্রবলেম মনে করছি কিনা, That is the main problem.

সাথী: এটা অবশ্যই একটা প্রবলেম। কিন্তু এটা আপনি যখন বলবেন যে এটা প্রবলেম তখন তারা কিন্তু এটাকে বিভিন্ন ট্যাগ দিবে। বলবে, ‘না এটা প্রবলেম না। ও আমার ফ্রেন্ড, ও আমার ক্লাসমেইট, ও আমার যাস্ট ফ্রেন্ড। ওদের সাথে আমার ভাই ভাই সম্পর্ক’ ইত্যাদি। তাহলে আপনি যখন বলবেন, ‘তাহলে তোমার এই সম্পর্কটা তো একটা মেয়ের সাথে হতে পারে। বেস্ট ফ্রেন্ড তো একজন মেয়েও হতে পারে’।

কিন্তু তারা তখন বিভিন্ন কথা বলবে। বলবে, ‘মেয়েদের সাথে মেয়েদের বেস্ট ফ্রেন্ড হয় না। মেয়েরা মেয়েকে সাহায্য করে না’। কিন্তু আমি পার্সোনালি আমি অনেক মেয়েকে সাহায্য করি। আমি আমার ডিপার্টমেন্টে একটা ভালো পজিশনে আছি। মেয়েরা যখন আসে আমার কাছে আমি বিভিন্নভাবে সাহায্য করি।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: তুমি তো স্টুডেন্ট লিডার, নেত্রী …

সাথী: তো মানে এই জিনিসটাকে এভাবে ভ্যালিড করতে চাওয়া যে মেয়েদের বেস্ট ফ্রেন্ড হয় না, এটা আসলে অযৌক্তিক।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: আমাদের সময় তো আমরা দেখতাম মেয়েরাই মেয়েদের বেস্ট ফ্রেন্ড, ছেলেরাই ছেলেদের বেস্ট ফ্রেন্ড। মেয়েরা এখন ছেলেদের বেস্ট ফ্রেন্ড, ছেলেরা মেয়েদের বেস্ট ফ্রেন্ড। এটা এখনকার সময়ের ব্যাপার। আমাদের সময় কিন্তু এরকম ব্যাপারটা ছিল না।

আমরা এই কথাটার পরবর্তী করণীয় নিয়ে কথা বলি। এবার তুমি বলো, তুমি কেন এটাকে খারাপ মনে করছ? কথার কথা, কেউ বলতে পারে যে ছেলেমেয়েদের সম্পর্ক হলো … যতক্ষণ …., মানে কনসেন্ট বেইজড যে থিউরি, কনসেন্ট থিউরি যেটা বলে আর কী…। so far consent is there, anything can happen; and without consent, nothing can happen। তো এই ধরনের একটা রোমান্টিক লাভফুল কনসেন্ট বেইজড রিলেশন, এই বিষয়টার মনে হচ্ছে তুমি বিরোধী।

সাথী: জ্বি, স্যার।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: কেন তুমি বিরোধী? তুমি তোমার ধর্মের কথা বলতে পার…। but from logical rational point of view, what is your argument?

সাথী: আর্গুমেন্টটা হচ্ছে যখন আমরা একটা ফ্যামিলির চিন্তা করি …। যেহেতু আমার সবদিকে যাওয়ার এক্সেস আছে, (সেহেতু) আমি ফ্যামিলিতে আমার হাজবেন্ডকে রেখে আমার কর্মস্থলে আমি একটা এক্সট্রামেরিটাল এফেয়ার রাখলাম। যেটা আপনি বলেছেন যে হতে পারে আমার মনের আয়নাতে যে পুরুষটার কথা আমি চিন্তা করি, সেটার সাথে আমার কলিগের ৭০% মিলে, (অথচ) আমার হাজবেন্ডের সাথে এরচেয়ে কম, ধরেন ৬০% মিলে। তো অবশ্যই আমি আমার কলিগটার… দৃশ্যত হয়তোবা..

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: হতে পারে আমার পরকীয়া সম্পর্কের ওই পুরুষকে ডিল করার পর দেখা গেল, না যেটা আমার কাছে বেশি মনে হয়েছিল সেটা কিন্তু আসলে সঠিক না। অথবা সেটা ওর মধ্যে থাকলেও সেটার পাশাপাশি আরও কিছু বৈশিষ্ট্য ওর মধ্যে আছে যা আমি অনাকাঙিক্ষত বলে মনে করি। এরকমও হতে পারে …

সাথী: হতে পারে। তাহলে আমি ওদিকেও একটা এফেয়ার রাখলাম আবার এদিকে আমার ফ্যামিলি। আমার ফ্যামিলির কী হবে, আলটিমেইটলি? এটা তো একটা পাশ্চাত্য কালচার হয়ে গেল….

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: সেক্ষেত্রে দেখা যাবে ফিমেল পার্সনটার সাথে ওর হাজবেন্ডের ইমোশনাল বন্ডিংটা নষ্ট হয়ে যাবে। হেলদি ইমোশনাল বন্ডিং না থাকার কারণে তাদের সম্পর্কের বাকি সবকিছুর মধ্যে এর প্রভাব পড়বে। তুমি বলতে চাচ্ছো (স্টুডেন্টদের) ফিউচার ফ্যামিলি? স্টুডেন্টদের তো মোস্টলি ফ্যামিলি নাই। কারো কারো আছে।

তার ফিউচার ফ্যামিলি লাইফটা এক্ষেত্রে….

সাথী: আর স্যার স্টুডেন্টদের ক্ষেত্রে যেটা হয় যে আমি একটু আগে একটা উদাহরণ দিলাম, মেয়েটা হ্যারেসড হয়েছে। কিন্তু মেয়েটা হ্যারাসড হয়ে কিন্তু কাউকে বলতেও পারছে না যে সে হ্যারাসড হয়েছে। সে এটা নিজের ভিতরে রাখতেছে। কারণ এখানে মেয়েটাও একই দোষের ভাগিদার।

মেয়েটা ছেলেটার সাথে মিশেছে। ছেলেটাকে টাচ করার ফ্রিডম দিয়েছে। তো এখানে মেয়েটাও কোনো বিচার পাচ্ছে না। ঐদিকে সে আবার হ্যারাসেরও শিকার হচ্ছে। তাহলে এটার সলিউশন কি?

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: এখন মেয়েটা যদি বিচার চায় এবং বিচার যদি মেয়েটার পক্ষে আসে, তাহলে?

সাথী: স্যার এক্ষেত্রে তো ছেলেটাও দাবি করতে পারে যে মেয়েটা আমাকে এক্সেস দিয়েছে।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: ওমুক সময় দিয়েছে, তমুক সময় দিয়েছে। নানা ধরনের ডকুমেন্টস সে দেখাতে পারে। তার সাথে আমার রিলেশনটা ছিল কনসেন্সুয়াল ইত্যাদি।

আর একটা তথ্য এখানে বলা যায়, ওয়েস্টে এমনিতে তো এট দ্যা ফার্স্ট প্লেস তারা বিয়েই করে না বেশিরভাগ। যারা বিয়ে করে, দৃশ্যত সুখী দাম্পত্যজীবন যাপন কারী বিবাহিত মহিলা তাদের মোর দ্যান ফিফটি পার্সেন্টের কেউ একজন থাকে যে হচ্ছে তার ব্যাক বার্নার। অর্থ্যাৎ পেছন থেকে তাকে হাওয়া বাতাস দেওয়ার জন্য একটা লোক থাকে। মানে তার অন্তত একটা ইমোশনাল রিলেশন থাকে মেরিটাল বন্ডিং এর বাইরে।

বৈবাহিক সম্পর্কটা করা হয় এমনভাবে যে এটা বোধ হয় টিকবে না। না টিকলে কী করা যায় ইত্যাদি নিয়ে তারা সব লাইনঘাট ঠিক করে রাখে। মানে নিয়তেই তাদের থাকে গলদ…।

সাথী: স্যার, এক্ষেত্রে যদি হয় যে বৈবাহিক সম্পর্ক টিকবে না, আমাদের মুসলিম কান্ট্রিতে বিশেষ করে বাংলাদেশে তাহলে ডিভোর্সটাকে সহজ করা উচিত। ধরেন আমার অল্প বয়সে একটা বিয়ে হলো, কিন্তু আমার হাজবেন্ডের সাথে আমার মিলছে না। বছর ৩০ পর আর মিলছে না। তখন তাহলে আমি কী করব?

তখন আমি যদি তাকে ডিভোর্স দিই তাহলে আমার ভবিষ্যত তো অনিশ্চিত। আমরা দেখেছি যে সাহাবীদের সময়ে যুদ্ধে যদি কেউ মারা যেত, তার যদি ওয়াইফ থাকতো, তাহলে তারা কিন্তু বেশিদিন অবিবাহিত থাকত না। অন্য যে কোনো সাহাবী তাকে অতিসত্ত্বর বিয়ে করত। তো বাংলাদেশে এই জিনিসটাকে তাহলে নরমালাইজ করতে হবে।

মোহাম্মদ মোজাম্মল হক: তুমি চাইতেছ মেরিটাল সিকিউরিটি। ম্যারেজ রিম্যারেজ এনি টাইম।

সাথী: বেশিরভাগ মানুষই এটা পারে না দেখে এফেয়ারে থাকে…

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: এসব কিছুর মধ্যে মেয়েটা নিজেও কিন্তু মেন্টাল ট্রমা এবং স্ট্রেসে ভোগে। তুমি তো হলে থাক, তাই না? What is your experience there?

সাথী: আমার এক্সপেরিয়েন্স হলো স্যার, ধরেন একটা মেয়ে বিভিন্ন দিকে রিলেশন বজায় রাখছে। তার বয়ফ্রেন্ড কোনোভাবে জানতে পারছে। তার বয়ফ্রেন্ড ওদিক থেকে প্রেশার ক্রিয়েট করছে। আবার তার একটা যাস্ট ফ্রেন্ড …, যাস্ট ফ্রেন্ড কিন্তু আচরণ বয়ফ্রেন্ডের মতো। সে আবার দেখা যাচ্ছে তার অন্য একটা মেয়েফ্রেন্ডের সাথে বেশি মিশছে। এটার জন্য সে আবার ট্রমায় পড়ছে।

এটা নিয়ে চিল্লাচিল্লি, হলের মধ্যে গালাগালি, কান্নাকাটি…। হলের মধ্যে এ’গুলো অহরহ চলতেই থাকে।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: খুব গালাগালি করে? এগুলো বাহির থেকে কল্পনাও করা যায় না।

সাথী: না, এগুলো বাইরে কল্পনাও করা যায় না। এমন এমন মানুষ যে দেখবেন আপনার পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছে। খুবই পরিপাটি মেয়েটা। খুবই ব্রিলিয়ান্ট, খুবই দেখতে সুন্দর। কিন্তু সে যে হলের মধ্যে এরকম কান্ডকারখানা করছে…

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: হলে চাকরি করে আবার হলের ভেতরে কিছু দোকান চালায় এমন কর্মচারীদের কেউ আমাকে কখনো বলেছে, ‘আপনারা ফ্যাকাল্টিতে যে সুবোধ, সুন্দর, ভদ্র মেয়েদেরকে দেখেন, হলের গেট পার হওয়ার সাথে সাথে তাদের আচার-আচরণ সব চেঞ্জ হয়ে যায়। তারা কিন্তু আর এতটা সুবোধ, ভদ্র থাক না …।

সাথী: জ্বি, স্যার। আমার একটা অভিজ্ঞতা বলি। একদিন রাত সাড়ে ১২টার দিকে হলের নিচে প্রচন্ড চিল্লা-পাল্লা। তো আমরা মেয়েরা কয়েকজন নিচে নামলাম, দেখার জন্য কী হয়েছে ব্যাপারটা। একটা আপু হলে ঢুকলো তখন। হলে কিন্তু নিয়ম আছে যে ১০ কিংবা সাড়ে ১০টার পর হলে ঢুকলে খাতায় নাম এন্ট্রি করতে হয়।

দারোয়ানটা বলেছে যে আপু এন্ট্রি করেন। কিন্তু আপু এন্ট্রি করতে চায় না। মেয়েটা নানা কথা বলে ভেতরে চলে যায়। ওই সময় সম্ভবত দারোয়ানের সাথে তার একটা বন্ধু সম্ভবত বসে ছিল। সেও বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো জায়গায় চাকরি করে। দারোয়ানের সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছিল।

সে কথায় কথায় মেয়েটাকে বেয়াদপ বলে ওঠে। ঐ মেয়েটা পেছনে ঘুরে ওই লোকটাকে ধরে দারোয়ানটাকে এবং তার বন্ধুটাকে, তাকে বেয়াদব কেন বলা হলো। তো এখানে দেখেন, বেসিক্যালি দোষটা কার?

দোষটা কিন্তু মেয়ের। সে রাত করে হলে ঢুকেছে। কোনো প্রয়োজন থাকতে পারে, ঠিক আছে। কিন্তু নিয়মানুযায়ী তার খাতায় এন্ট্রি করতে কী সমস্যা? এবং তাকে যখন এন্ট্রি করতে বলা হলো সে খারাপ বিহেভ করল। হলের প্রভোস্ট পর্যন্ত রিপোর্ট পাঠিয়েছে। পুরো হলের মেয়েদেরকে ডেকে এনে এখানে একটা সিন ক্রিয়েট করল।

এখন যেটা হয়, আমি যদি চোখের সামনে কাউকে ভুল করতে দেখি আমি এড়িয়ে যাই। আমি কোনো কমেন্ট করি না। কারণ এখানে আমার একটা মানসম্মানের ভয় আছে।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: তো এখানে তুমি আরেকটা কথা আনছিলা তোমার পরিচিত একজনের ব্যাপারে। কথাটা এরকম, সে পর্দা করে পুরোপুরি। কিন্তু কাছ থেকে দেখলে দেখা যায় যে সে আসলে বহুগামী। বহুগামী বলতে কী? সে বিভিন্ন জনের সাথে ফ্রেন্ডশীপ, রিলেশন…। অর সামথিং মোর? অর হোয়াট?

সাথী: স্যার, ফ্রেন্ডশীপ রিলেশন অর মোর…। আমরা চোখে না দেখলেও গেস করি যে এ ধরনের খুব সম্ভবত।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: তো এখন যে অনেক মেয়েদেরকে বোরকা পরা দেখা যায়, পর্দা করতে দেখা যায়। তাহলে এখানে কি আমরা বলতে পারি, পর্দা বেড়েছে কিন্তু শালীনতাবোধ কমেছে, এই রকম কিছু?

সাথী: জ্বি, স্যার। পর্দা হচ্ছে বর্তমানে একটা ফ্যাশন।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: এ’রকম একটা ফ্যাশন চালু হলো কীভাবে?

সাথী: স্যার, সাধারনত ছেলেরা কী ভাবে? একটা মেয়ে সামনে বোরকা পরে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই মেয়েটা ভালো। এটা হচ্ছে নিজেকে ভালোভাবে উপস্থাপন করা, সুবোধ হিসাবে উপস্থাপন করা যে আমি ভালো মেয়ে। পর্দা করি, নামাজ রোজা পড়ি। কিন্তু যখন সে তার হলের রুমে যায়, এটা সম্পূর্ণ চেঞ্জ হয়ে যায়…! এই আর কি…

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: তোমার সাথে আমি মোস্টলি সব ব্যাপারে তো একমত। তবে আমার কাছে যেটা মনে হয়, ইউনিভার্সিটার উচিত এবং গার্ডিয়ানদেরও উচিত হলো এই সমস্যাগুলো যে হচ্ছে এটার সমাধান আপাতত আমাদের হাতে থাকুক বা না থাকুক, এগুলো যে সমস্যা এইটা স্বীকার করা।

একটা মেয়ে এরকম একটা মুক্ত জীবন যাপন করার পরে সে একটা বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে, আমাদের প্রচলিত ধরনের বৈবাহিক সম্পর্ক, এটার মধ্যে সে আসবে, সুখী হবে, একটা হ্যাপি লাইফ হবে, এইটা আমরা কী করে আশা করতে পারি? স্বাধীন জীবন আর বৈবাহিক জীবন, এই দুইটা জিনিস কিন্তু মিলে না …। এইটা একটা সংকট বলেই মনে হয়।

সাথী: জ্বি, স্যার। কারণ আমি আমার পার্সোনাল এক্সপেরিয়েন্স বলি। যেমন আমি হচ্ছি হলে থাকি। হলে থাকার পরে আমি যখন বাসায় যাই। এক সপ্তাহ পরে আমার ভালো লাগে না। কেন ভালো লাগে না? কারণ এখানে আমার হলে মুক্ত পরিবেশ। আমি যখন যেটা চাচ্ছি…

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: ইভেন কি তোমার নিজেরও? দৌ ইউ লিভ আ কনজারভেটিভ লাইফ।

সাথী: হ্যাঁ, আমারও (বাসায়) ভালো লাগে না। (হলে থাকলে) আমি নিচে নামছি । যখন যেখানে ইচ্ছা যাচ্ছি। কিন্তু বাসায় গেলে আমি এটা করতে পারছি না। সুতরাং আমার নিজেরও ভালো লাগে না।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: এমনকি বন্ধের মধ্যেও অনেক মেয়েরা বাড়ি যেতে চায় না। আমরা খেয়াল করে দেখি …।

সাথী: মূলত এই কারণেই, একটা মুক্ত লাইফ লিভ করার পরে এরকম বদ্ধ একটা (পারিবারিক) পরিবেশ, যেটাকে আমরা নরমাল ভাবি সে রকম নরমাল একটা ফ্যামিলি এনভায়রনমেন্ট, এইটা আর ভালো লাগে না। এটা একটা সমস্যা।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: সো এনিওয়ে, থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ্চ ফর ইউর কনসার্ন। অল দিজ সোশ্যাল প্রবলেমস মাস্ট বি এড্রেস এন্ড ডিসকাসড। সলিউশন কোথাও দেওয়া আছে, আমরা যাস্ট এটা এনে বসাই দিব, আসলে ব্যাপারটা সেরকম নয়। ইন সাচ্চ কেওটিক এন্ড কমপ্লিকেটেড সিচুয়েশন আমাদেরকে অনেক বেশি কেয়ারফুল হতে হবে। মোস্টলি আমাদেরকে সিনসিয়ার হতে হবে টু কনফেস দ্যা প্রবলেম এন্ড একসেপ্ট দ্যা রিয়ালিটি। থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ।

সাক্ষাৎকারটির ভিডিও পাবেন এই লিংকে

এ ধরনের আরো লেখা