রাজনৈতিক ইসলামের ব্যর্থতা দাবির সারবত্তা কতটুকু?

এডিটর’স নোট: রশীদ ঘানুশী সমকালীন বিশ্বের একজন প্রাগ্রসর মুসলিম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও চিন্তাবিদ। তিনি তিউনিশিয়ার ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল আন-নাহদার প্রধান। আরব বসন্তের প্রেক্ষিতে পতিত স্বৈরশাসক বেন আলী সরকার পরবর্তী ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক জোটের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। গত ২৪ অক্টোবর আল জাজিরার আরবি ওয়েবসাইটে ঘানুশীর এই লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। তারপর ৩১ অক্টোবর মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি ম্যাগাজিন মিডল ইস্ট মনিটর How credible is the claim of the failure of Political Islam? শিরোনামে এর ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করে। সেখান থেকে এর বাংলা অনুবাদ করেছেন আবু সুলাইমান।

*****

যখনই ইসলামপন্থীরা কোনো বিপর্যয়ের শিকার হয় অথবা ভোটের রাজনীতিতে সামান্য ব্যবধানে হেরে যায়, তখনই ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাস ও কার্যপদ্ধতি নিয়ে যে সকল পশ্চিমা বিশেষজ্ঞ কাজ করে তারা দাবি করে বসে যে, পলিটিক্যাল ইসলাম কার্যত ব্যর্থ ও ধ্বংস হয়েছে। তারা তাদের সকল ফোরাম ও মিডিয়ায় এই একই কথার পুনরাবৃত্তি করতে থাকে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে এ সকল পশ্চিমা বিশেষজ্ঞদের অনুসারী মিডিয়া ও পর্যবেক্ষকরা তখন তর্কাতীত ও বাস্তব তথ্য হিসেবে এই কথাটির প্রতিধ্বনি করতে শুরু করে।

মিশরের বর্তমান ঘটনা প্রবাহ এ সকল ব্যক্তিদের সভা-সেমিনার ও দাবির জন্য যথেষ্ঠ উপাদান সরবরাহ করেছে এবং জনসম্মুখে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা কিছুটা বৃদ্ধি করতে সমর্থ হয়েছে ।

কিন্তু এসব দাবি কতটা যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত? পলিটিক্যাল ইসলাম হিসেবে যা পরিচিত তা কি প্রকৃতপক্ষে ক্রমাগত ক্ষীয়মান এবং চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ কিংবা পরাজিত হতে যাচ্ছে? নাকি নব উদ্যোগে যাত্রার জন্য কৌশলগতভাবে কয়েক ধাপ পিছনে যাচ্ছে; যা প্রকৃতপক্ষে তাদের গতিকে উর্ধ্বমুখী করবে?

০১। ইসলামপন্থীরা নিজেদের জন্য পলিটিক্যাল ইসলাম এর পরিবর্তে ‘ইসলামিক মুভমেন্ট’ পরিভাষাটি ব্যবহার করে। ইসলামিক মুভমেন্ট বলতে আল্লাহর সকল আইন প্রতিপালন, জীবনের সকল ক্ষেত্রে সে আইনের অনুসরণ, মানব জাতির নিকট আল-কোরআনের যে বার্তা তার বাস্তবায়ন– এসব কিছুকেই বুঝায়। পরিসংখ্যানিক তথ্য অনুযায়ী ইসলাম হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে ক্রমবর্ধমান ধর্ম এবং তার অনুসারীরা ধর্মের কারণে তাদের মূল্যবান ধন-সম্পদ উৎস্বর্গ করতে প্রস্তুত।

কাজেই পলিটিক্যাল ইসলাম বা ইসলামিক মুভমেন্ট – যাই বলিনা কেন, এটাই হচ্ছে মুসলিম সম্প্রদায়ের মাঝে সবচেয়ে বড় আন্দোলন- ধর্মীয় ভিত্তি যার রয়েছে। আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তির কারণে ইসলামিক মুভমেন্ট সম্প্রসারিত হচ্ছে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে দ্রুত গতিতে। বিশেষ করে আদর্শিক শূন্যতা, অস্তিত্ব রক্ষার উদ্বেগ এবং পরিবার ও গোত্র প্রথার ক্ষেত্রে আধুনিক সভ্যতার দুর্বলতা- এসব কারণে ইসলামী আন্দোলন তথা পলিটিক্যাল ইসলামের গতি খুব কম বাধার সম্মুখীন হচ্ছে।

ইসলামিক মুভমেন্টের গতি বৃদ্ধির এই ঘটনা এমন সময় ঘটছে, যখন বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা জনগণের প্রতি তাদের যে দায়িত্ব-কর্তব্য, তা পরিত্যাগ করছে। এর ফলে সাধারণ জনগণের মাঝে উদ্বেগ ও বিচ্ছিন্নতা প্রবণতা বাড়ছে। আর এটি হচ্ছে সেক্যুলারাইজেশনের ক্রমাগত বৃদ্ধির একটি ফলাফল। ফলে মানুষ সেক্যুলারাইজেশনের পরিবর্তে সংস্থা-সংগঠনের এমন একটি কেন্দ্রের সন্ধান করেছে যেখানে দেহ ও আত্মার চাহিদা, ব্যক্তি ও সমষ্টির চাহিদা, ধর্মীয় ও পার্থিব চাহিদা এবং জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক সকল কিছুরই সন্নিবেশ আছে। ইসলামের যে সর্বব্যাপী ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি তাতে বর্তমান সমাজের প্রার্থিত এসব বৈশিষ্ট্যের সব কিছুই বিদ্যমান।

আর এসব কারণেই ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন ও ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা, অপপ্রচার এবং দানবীয় নানা দোষ যুক্ত করার পরও বিভিন্ন পেশা ও সংস্কৃতির মানুষ ইসলামের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে।

০২। সকল ধর্ম ও জাতির মাঝেই চরমপন্থী গোষ্ঠী রয়েছে। ইসলামী আন্দোলন খুব সচেতনভাবে এ চরমপন্থা ও উগ্রবাদিতা থেকে মুক্ত। মূলধারার ইসলামিক আন্দোলন ইসলামকে উপস্থাপন করেছে বিভিন্ন সভ্যতার যে অর্জন ও অবদান তার পরিপূরক ও সম্পূর্ণতা দানকারী হিসেবে। বর্তমান আধুনিক সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ  এ অর্জনগুলো হলো– নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্য শিক্ষা, সুবিচার, ন্যায়নীতি, আইনের সমতা; ধর্ম বিশ্বাস-লিঙ্গভেদ-গোত্রভেদ নির্বিশেষে সবার জন্য সম-স্বাধীনতা, সকলের নাগরিক অধিকার, মানবতার মূল্যায়ন এবং রাজনৈতিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। ইসলামী আন্দোলন কখনোই এসবের বিরোধিতা করেনি। বরং আল-কোরআনে এসব অধিকার ও স্বাধীনতাকে স্বর্গীয় মানবীয় অধিকার বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে কুরআনের ঘোষণা হচ্ছে, “আমরা নিঃসন্দেহে আদমের সকল সন্তানকে সম্মানিত করেছি।” [সূরা বনী ইসরাইল:৭০]

০৩। ইসলামী আন্দোলন সব সময় বিশ্বাস করে- ইসলাম মানুষের সহজাত ধর্ম। তাই ইসলামী আন্দোলন মানব সমাজের সমস্যা সমাধান করতে চায় এবং মানব সমস্যার যে কোনো সমাধানে অবদান রাখতে চায়। আর এ কাজ করতে গিয়ে ইসলামী আন্দোলন ইসলামের চিন্তা-দর্শনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যে কোনো সভ্যতার অর্জিত অভিজ্ঞতা- যা মানব সমাজের সামষ্টিক স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখে- তার সাহায্য গ্রহণ করে। ইসলামী আন্দোলন মানব জাতির বিবেকবোধের সবচেয়ে কাছাকাছি এবং ইসলামী আন্দোলন  তাদের নীতিবোধ, চিন্তা-চেতনা এবং ভাষার পক্ষে কথা বলে। ইসলামী আন্দোলন যদি মানব সমাজের সমস্যাবলী অনুধাবন করতে পারে এবং তা সমাধানের জন্য মানব জাতির সর্বজনীন নীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ উপায়ে তা সমাধানের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে পারে, তবে ইসলামী আন্দোলনের সহজাত আবেদন নিঃসন্দেহে সকল বিতর্ক ও অপপ্রচারকে ছাড়িয়ে যাবে।

০৪। বিগত অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ইসলামী আন্দোলনগুলো বিশ্বব্যাপী ক্রমাগত নির্যাতনের শিকার হচ্ছে এবং বিরামহীনভাবে এ নির্যাতনের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

০৫। ইসলামী আন্দোলনের উপর ক্রমাগত নির্যাতনের অনেক ইতিবাচক ফলাফল রয়েছে। যেমন- আন্দোলনের একটি উত্তরাধিকার প্রজন্ম তৈরি হয়েছে। ইসলামপন্থী আন্দোলনের মধ্যে বিদ্যমান দল বা গোষ্ঠীগুলো নিজেদের মধ্যে পরস্পর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে যুক্ত হচ্ছে এবং বিগত তিনটি জেনারেশনের ভেতর ইসলামী আন্দোলনের অংশীদারিত্বমূলক অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে।

ইসলামী আন্দোলনের উপর চালানো অকথ্য নির্যাতনের ফলে তারা অতিরিক্ত সুবিধা হিসেবে অন্য যে কোনো রাজনৈতিক দলের তুলনায় জনগণের সহানুভূতি অর্জন করেছে। কারণ, অন্যায়-অবিচারের বিপক্ষে ইসলামী আন্দোলনের এই ত্যাগ-তিতিক্ষাকে সাধারণ মানুষ স্মরণ রাখছে এবং মূল্যায়ন করছে ।

০৬। বর্তমানে ইসলামী আন্দোলন অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অপেক্ষাকৃত ভাল অবস্থানে রয়েছে। কারণ, ইসলামী আন্দোলন শুধুমাত্র জনগণের আর্দশগত ও সংস্কৃতিগত চিন্তাকেই সম্মান করছে না। বরং জনগণের মৌলিক মানবাধিকার ও ভোটের যে অধিকার রয়েছে তা সংরক্ষণ করার জন্য লড়াইও করছে,বিশেষ করে মিশরের ক্ষেত্রে।

তদুপরি, তারা গৌরবান্বিত  বিপ্লবকে সমুন্নত রেখেছে। এই বিপ্লবের অন্যতম ফসল  হিসেবে গণমাধ্যমের  স্বাধীনতাকে তারা নিশ্চিত করেছে, যদিও পরবর্তীতে সামরিক অভ্যুত্থানকারীরা এই স্বাধীনতাকে খর্ব  করেছে। এর পাশাপাশি ব্রাদাহুডের নেতৃত্বে পরিচালিত বিপ্লব রাজনৈতিক বহুত্ববাদিতাকে (Political Pluralism) প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাছাড়া ফিলিস্তিন ইস্যুর মতো প্রধান জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতেও তারা সোচ্চার  হয়েছে।

অন্যদিকে, ওয়াফদা পার্টিসহ তথাকথিত উদারপন্থী দলগুলো প্রতি-বিপ্লবের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। এটা করতে গিয়ে তারা সামরিক অভ্যুত্থানকারীদের সাথে আতাঁত করেছে এবং তাদের সমর্থন দিয়েছে। সেনাবাহিনী যখন বন্দুকের নলের মুখে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিচ্ছে, জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে পদদলিত করছে, মানুষের লাশকে পৃষ্ঠ করছে, গণমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরছে; জেলখানাগুলো যখন রাজনৈতিক বন্দিতে পূর্ণ; যখন বেসামরিক জনগণ অকারণে গুলির স্বীকার হচ্ছে– তখন তথাকথিত উদারতাবাদী দলগুলো এ সব ঘৃণ্য অপকর্মকে নির্লজ্জভাবে সমর্থন ও সহযোগিতা করেছে।

একজন নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে এমন একটি বিষয়ে অভিযোগ আনা হয়েছে, যেটি তাদের অন্যতম জাতীয়  ইস্যু। যেমন, ফিলিস্তিন সংকট। প্রেসিডেন্টকে পদচ্যুত করাকে বৈধতা দানের জন্য হামাসের সাথে সহযোগিতার ‘অভিযোগ’ তোলা হয়েছে। স্পষ্টতই ইসরাইলকে সন্তুষ্ট করার  জন্য এটা করা হয়েছে।

তথাকথিত মিশরীয় অভিজাত আধুনিকতাপন্থী এবং তাদের আরব দোসররা, যারা অবৈধ অভ্যুত্থানে হাততালি দিয়েছে, তাদের এ কাজ কি গণ আত্মহত্যার শামিল নয়? এর পাশাপাশি ইসলামী আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের অবস্থানকে যদি আমরা তুলনা করি, তাহলে দেখা যাবে, এসব মহান ব্যক্তিগণ স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে রাস্তায় দাঁড়িয়েছে, যখন তাদের হাতে ঈমান ছাড়া অন্য কোনো অস্ত্র নেই।

ঐতিহাসিক, কৌশলগত এবং জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কোনো ভাবেই কি আমরা নৃশংস সামরিক ক্যু-এর সমর্থনকে উদারতাবাদী, প্রগতিশীল, জাতীয়তাবাদী ও সেক্যুলারদের বিজয় বলতে পারি? এবং সামরিক শাসনের নির্যাতন-নিষ্পেষণ ও একগুঁয়েমির কারণে যা হয়েছে, তাকে কি পলিটিক্যাল ইসলাম তথা ইসলামী আন্দোলনের পরাজয় বা মৃত্যু বলে বিবেচনা করতে পারি?

০৭। প্রকৃতপক্ষে মিশরে যা ঘটেছে তা কোনো ভাবেই ইসলামী আন্দোলনের পতন নয়। এটি বরং আরব জাতীয়তাবাদ ও সেক্যুলারদের পরাজয় । যদি তারা তাদের অবস্থার পরির্বতন করে জনগণের সারিতে না আসে– তাহলে তাদের অতীত ভূমিকার পতন ঘটবে।

ইতোমধ্যে মিশরের সামরিক এই ক্যু ইসলামী আন্দোলনের জন্য অনেক বাড়তি সুযোগ নিয়ে আসবে। ইসলামী আন্দোলন রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের গৃহীত নীতির পূনর্মূল্যায়ন করতে পারবে এবং তাদের ভুলগুলো সংশোধন করতে পারবে। মিশরসহ যে কোনো দেশের ক্ষেত্রেই ইসলামী আন্দোলন বিরোধী দলগুলোর সাথে যোগাযোগ আরও বাড়াতে শিখবে। বিশেষ করে অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে সরকার পরিচালনা যে একটি দল দ্বারা হওয়া উচিত নয় অথবা রাষ্ট্রীয় সংবিধান প্রণয়নের বিষয়টি যে একটি দল বা একই ধারার দলসমূহের দ্বারা প্রণীত হওয়া ঠিক নয়– এসব বিষয়ে ইসলামী আন্দোলন অধিকতর অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ পাবে।

মিশরসহ সকল দেশের ইসলামী আন্দোলন এই বাস্তবতা উপলব্ধি করবে যে, জাতীয় পর্যায়ের অন্যান্য দলের সাথে সহযোগিতা এবং তাদের জোটে অন্তর্ভুক্তিই যথেষ্ট নয়। বরং ইসলামী দলগুলোর নেতৃত্বের পর্যায়েও তাদেরকে স্থান দিতে হবে। কারণ ইসলাম হচ্ছে গোটা জাতির সম্পদ ।

০৮। যদিও মুসলিম ব্রাদারহুড মিশরের সামরিক  স্বৈরশাসকদের দ্বারা ধারাবাহিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে, বিশেষ করে জামাল আব্দেল নাসেরের হাতে। তবে গুণগত কিংবা পরিমাণগত- যেভাবেই বিবেচনা করা হোক না কেন,  জেনারেল আল সিসির হাতে বর্তমানে তারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, তা কোনোভাবেই তুলনীয় নয়। বিগত ষাট বছরে মিশরে ৬০ জনের বেশি শহীদ হয়নি। কিন্তু জেনারেল সিসির হাতে শুধুমাত্র মিশরের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের সামনেই এর চাইতে বেশি লোক শহীদ হয়েছে। এর পরেই আমরা শুনতে পেলাম হাজার হাজার লোকের শাহাদাতের সংবাদ, আহত হবার এবং জেলে যাবার ঘটনা। সিসির এই নির্যাতনই তার সামরিক বৈধতার দুর্বলতাকে স্পষ্টভাবে নির্দেশ করছে। জেনারেল সিসি জনগণের শান্তিপূর্ণ ও বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধকে দমন করার জন্য  নির্যাতনের  মাত্রা ক্রমাগত বাড়িয়েই চলছে ।

০৯। জামাল আব্দেল নাসের এবং জেনারেল সিসির মধ্যে পার্থক্য এই যে, জামাল আব্দেল নাসের বিরোধী দলের উপর একদিকে যেমন নির্যাতন করার পাশাপাশি জনগণের জন্য অনেক বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ করেছিল। যদিও এসব কতটুকু ফলপ্রসু ছিল ত প্রশ্নসাপেক্ষ।

রাজনৈতিক বিরোধীদের উপর চালানো দমন-নিপীড়ন ঢাকবার জন্য জামাল নাসের অসংখ্য আকর্ষনীয়, চিত্তাকর্ষক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রকল্প গ্রহণ করেছিল।। যেমন- কৃষি সংস্কার প্রকল্প, শিক্ষার প্রসার, আল-আযহারের সম্প্রসারণ, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা, আরব জাতিকে একত্রীকরণ, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা এবং জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলন গঠনে ভূমিকা পালন ইত্যাদি ।

বিপরীতে, আল-সিসি তার জনগণ ও জাতির জন্য কি  প্রকল্প গ্রহণ করেছে? কিছুই করেনি। বরং আল-সিসি তার দমন-পীড়ন ঢাকবার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক শঠতা অবলম্বন করেছে এবং একজন নির্বাচিত বৈধ প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে হামাসের সাথে সহযোগিতার মতো নিম্নমানের অভিযোগ এনেছে।

১০। আধুনিক যুগে স্বৈরশাসকদের নির্যাতন সংঘটিত হচ্ছে মিডিয়ার সার্বক্ষণিক নজরদারির আওতায়। অতীতে ফারাও সম্রাটদের সময় এ জাতীয় নির্যাতন সংঘটিত হতো অনেকটা সংগোপনে এবং পর্দার অন্তরালে। এ কারণে হযরত মূসা (আ) এর সময়ে তৎকালীন ফেরাউনের পক্ষে বলা সম্ভব হয়েছিল, “[মুসা (আ) বললেন,] হে আমার কওমের লোকেরা, আজ তোমরা বাদশাহীর অধিকারী এবং ভূ-ভাগের বিজয়ী শক্তি। কিন্তু আল্লাহর আযাব যদি আমাদের ওপর এসে পড়ে তাহলে আমাদেরকে সাহায্য করার মতো কে আছে? ফেরাউন বললো, আমি যা ভাল মনে করছি সে মতামতই তোমাদের সামনে পেশ করছি। আর আমি তোমাদেরকে সঠিক পথের নির্দেশনাই দিচ্ছি।” [মু’মিন:২৯] দৃশ্যত, তথ্য গোপনের মাধ্যমে ফারাও রাজা জনগণের উপর তার নিয়ন্ত্রণ রাখতে সক্ষম হয়েছিল।

 ইতিহাসের সেই সময়টি অনেকদিন আগেই গত হয়েছে। বর্তমানের স্বৈরশাসকরা বড় বড় অপরাধগুলো আমাদের চোখের সামনে সংঘটিত করছে। যার কারণে আল-সিসি এবং  তার মতো অন্যান্যদের পক্ষে তথ্যের এই অবাধ প্রবাহের ফলে সচেতন মহলকে বোকা বানানো সম্ভব হচ্ছে না।

ফলাফল:

এতোক্ষণের আলোচনার প্রেক্ষিতে আমি পূর্ণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, মিশর কিংবা পৃথিবীর যে কোনো দেশেই পলিটিক্যাল ইসলাম পরাজিত হয়নি। অতীতের  যে কোনো সময়ের চাইতে দর্শন ও চিন্তার জগতে ইসলাম আজ আরও শক্তিশালীভাবে দৃশ্যমান। যদিও আধুনিকতা তার সর্বশক্তি দিয়ে উন্নয়নমূলক বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়ে ইসলামকে কোনঠাসা করার চেষ্টা করলেও ব্যক্তি স্বাধীনতা, উন্নয়ন, সুবিচার, ঐক্য অথবা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা– সবক্ষেত্রেই তাদের গৃহীত পদক্ষেপ কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতার কারণে ইসলাম প্রসংগটি বার বার সামনে উঠে এসেছে এবং আধুনিকতার ইতিবাচক দিকগুলোকে অস্বীকার না করে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে ইসলামের ভূমিকা কী হবে সে বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে।

পলিটিক্যাল ইসলাম বা ইসলামী আন্দোলন বলতে যা বুঝানো হচ্ছে তা কোনো ভাবেই উপেক্ষা করার মতো নয়। বরং ইসলামী আন্দোলন তার নীতি ও কৌশলের ভুল-ত্রুটিসমূহ সংশোধনের পর্যায় অতিক্রম করে নতুন বিপ্লবের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর এর আশু ফলাফল হবে জন নন্দিত কার্যকর সরকার ব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা। তথ্য প্রবাহের এই যুগে নৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গীকারশুন্য সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে ইসলামী আন্দোলনকে এখন আর যুগের পর যুগ অপেক্ষা করতে হবে না।

এটি অনস্বীকার্য যে, ইসলামী আন্দোলনের শিকড় সংশ্লিষ্ট সমাজ ও রাষ্ট্রের গভীরে প্রোথিত। ইসলামী আন্দোলন শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক বিপ্লবের চেতনা ও ভারসাম্যপূর্ণ গণতান্ত্রিক উত্তরণে বিশ্বাস করে। যার ফলে, বিশ্বব্যাপী ইসলামী আন্দোলনসমূহ স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও আগ্রাসনের বিরোধিতা করে আসছে। এর মাধ্যমে তারা ইসলাম ও আধুনিকতার সুসামঞ্জস্য সম্পর্ক স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। কেননা তারা বিশ্বাস করে, “… এবং নিঃসন্দেহে সকল ক্ষমতার মালিক আল্লাহ এবং সব কিছুরই উপর তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। যদিও অধিকাংশ মানুষই তা অবগত নয়।” (সূরা ইউসূফ:২১)

এ ধরনের আরো লেখা