ইলম, আকাইদ, ইসলামী রাজনীতি, সংস্কৃতি ও নারী শিক্ষা প্রসঙ্গে প্রচলিত ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির পর্যালোচনা

তুরস্কের প্রতিথযশা আলেম ও উসূলে ফিকাহর পণ্ডিত প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ ২০২০ সালের জুনে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের সাথে একটি ডিসকাশনে অংশগ্রহণ করেন। সেখানে তিনি একটি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য প্রদান করেন এবং বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। বক্তব্য ও প্রশ্নোত্তরগুলো বাংলা ভাষায় সংকলন করেছেন সায়েম মুহাইমিন। সিএসসিএসের পাঠকদের জন্য সেটির একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করেছেন জনাব মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক

***

ইলম ও আলেম সংক্রান্ত ভুল ধারণার অপনোদন

ইসলামী সভ্যতা জ্ঞানকে যে পরিমাণে গুরুত্ব দিয়েছে এবং যে উচ্চ মর্যাদার আসনে সমাসীন করেছে, অন্য কোনো দ্বীন বা সভ্যতা এত গুরুত্ব কখনো দেয়নি এবং এত উচ্চ মর্যাদায় প্রদান করেনি। রাসূলে আকরাম (সা) একটি হাদীসে ইরশাদ করেছেন ‍“যারা জ্ঞান অর্জন করে ফেরেশতারা তাদের জন্য নিজেদের পাখা বিছিয়ে দেয়। আসমান জমিনের মাঝে যা কিছু আছে সবকিছুই তাদের জন্য দোয়া করে। এমনকি সাগরের মাছ পর্যন্ত তাদের জন্য দোয়া ও ইস্তেগফার করে।”

আলেমরা হচ্ছেন নবীগণের উত্তরাধিকারী। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের একটি আয়াতে বলা হয়েছে-

قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ ۗ إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُولُو الْأَلْبَابِِ

‍“যারা জানে আর যারা জানে না তারা উভয়ে কি কখনো এক হতে পারে?” (সূরা যুমার: ৩৯, আয়াত ৯)

অন্য একটি আয়াতে বলা হয়েছে।

إِنَّمَا يَخْشَى اللَّـهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ

‍“কেবলমাত্র যারা জ্ঞানী তারাই আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভয় করে।” (সূরা ফাতির: ৩৫, আয়াত ২৮)

তাহলে এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আলেম কে?

শুধুমাত্র কিছু তথ্য উপাত্ত জানলেই কি আলেম হওয়া যায়?

যেমন উইকিপিডিয়ায় সকল তথ্য আছে, তারমানে কি উইকিপিডিয়া আলেম? অথবা গুগলের কথাই ধরা যাক। এমন কোনো তথ্য নাই যা সে জানে না। সে সকল তথ্যকে তার মাঝে সংরক্ষিত করে রেখেছে। তাহলে আমরা কি গুগলকে আলেম বলবো?

ইলম কী?

ইলম কি শুধুমাত্র তাফসীর এবং হাদীস? শুধু কি কালাম এবং তাসাউফ? পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়নসহ আরো যেসব জ্ঞান আছে, যা মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীনের সৃষ্টির সৃষ্টিতত্ত্বকে বুঝতে সহায়তা করে, এগুলো কি জ্ঞান নয়? যারা এই ধরনের জ্ঞান অর্জন করে তাদেরকে কি আলেম বলবো না?

অনেক জ্ঞানার্জন করার পরও যদি একজন মানুষ তার কর্মে জ্ঞানের প্রতিফলন না ঘটায় তাহলে কি আমরা তাকে আলেম বলতে পারবো? আমল কি আলেম হওয়ার জন্য শর্ত? কোনো মানুষের ভিতরে যদি ইখলাস না থাকে তাহলে তাকে কি আলেম বলা যাবে? আমরা যদি এই সকল প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারি, তাহলেই একজন মানুষ সত্যিকার অর্থে কীভাবে আলেম হতে পারেন এবং আলেম কাকে বলে এই প্রশ্নের উত্তর পাবো।

প্রথমত, আমাদেরকে ইলম শব্দটিকে বুঝতে হবে। ইলমের উদ্দেশ্য কী? কুরআনের আয়াত বুঝার জন্য রচিত ইলমুত তাফসীরই কি শুধু ইলম? নাকি সমগ্র সৃষ্টিতত্ত্বকে বুঝার জন্য যে জ্ঞান রয়েছে সেগুলোও ইলম?

এই বিষয়কে আমরা কীভাবে বুঝব? ইসলামী সভ্যতার সবচেয়ে বড় টার্নিং পয়েন্ট তথা ভঙ্গুর পয়েন্ট হলো জ্ঞানকে দ্বীনি এবং দুনিয়াবী হিসেবে বিভাজন করা। এটি হচ্ছে একটা সেক্যুলার বিভাজন। মহান রব্বুল আলামীনের আয়াতসমূহ ব্যাখ্যাকারী তাফসীরসমূহ যেমন ইলম, তেমনি মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীনের এই পৃথিবীকে ব্যাখ্যাকারী যত রকম জ্ঞান রয়েছে সেগুলোও (ইসলামসম্মত জ্ঞান বা) ইলম।

তাকবীনি বনাম তানযীলি আয়াত:

তাকবীনি (এই পৃথিবী ও সৃষ্টিজগতের সাথে সম্পর্কিত আয়াতসমূহ) এবং তানযীলি (নাযিলকৃত কুরআনের আয়াত) আয়াতসমূহকে পরস্পর থেকে পৃথক করতে পারবো না। কারণ, আমরা যখন কুরআন পড়ি তখন কুরআন তাকবীনি আয়াত তথা সৃষ্টির দিকে আমাদেরকে নিয়ে যায়। যেমন:

الَّذِينَ يَذْكُرُونَ اللَّـهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَىٰ جُنُوبِهِمْ وَيَتَفَكَّرُونَ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ

‍“যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং চিন্তাগবেষণা করে আসমান ও জমিন সৃষ্টির বিষয়ে…” (সূরা আলে ইমরান: ৩, আয়াত ১৯১)

এই আয়াতে সৃষ্টিতত্ত্ব তথা আকাশ ও জমিন সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা করতে বলা হয়েছে।

إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَآيَاتٍ لِّأُولِي الْأَلْبَابِ

‍“নিঃসন্দেহে আসমানসমূহ ও জমিনের সৃষ্টি এবং দিবা-রাত্রির আবর্তনের মাঝে জ্ঞানী লোকদের জন্য রয়েছে অনেক নিদর্শন। (সূরা আলে ইমরান: ৩, আয়াত ১৯০)

وَمِنْ آيَاتِهِ خَلْقُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافُ أَلْسِنَتِكُمْ وَأَلْوَانِكُمْ ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّلْعَالِمِينَ

তাঁর আরও এক নিদর্শন হচ্ছে নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সৃজন এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে। (সূরা রূম: ৩০, আয়াত ২২)

উপরোক্ত আয়াতগুলো শুধু তানজীলি তথা নাজিলকৃত কোরআনের আয়াতই নয়, বরং এসব আয়াতে একইসাথে সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়েও অধ্যয়ন করতে বলা হয়েছে। এজন্য আমাদেরকে কখনোই তাকবীনি ও তানযীলি আয়াতসমূহের মাঝে বিভাজন সৃষ্টি করা যাবে না। তাওহীদুল উলুম তথা জ্ঞানের মধ্যকার তাওহীদ, তাওহীদুর রবুবিয়্যাত তথা স্রষ্টার তাওহীদের মতোই গুরুত্বপূর্ণ।

আমরা জ্ঞানকে দ্বীনি-অদ্বীনি, ইসলামিক-অনৈসলামিক, শরয়ী-গয়রে শরয়ী, এভাবে পার্থক্য করতে পারবো না। আমরা জ্ঞানকে শুধু উপকারী এবং অপকারী হিসেবেই পার্থক্য করতে পারি। এজন্য রাসূল (সা) এরশাদ করেছেন “আমি সেই জ্ঞান থেকে পানাহ চাই যেই জ্ঞান কোনো ধরনের উপকার করে না।”

নিছক তথ্য নয়, জ্ঞান হলো ইলম, হিকমত ও মারিফতের সমন্বয়:

ইসলামী সভ্যতায় ইলম বলতে শুধু তথ্যকে বুঝায় না। বরং ইলম, হিকমত, মারিফত এই তিনটি বিষয়কে বুঝায়। এগুলোকে পরস্পর থেকে কখনোই পৃথক করতে পারবো না। যে জ্ঞানার্জন করে তাকে আলেম বলা হয়। যে হিকমতের অধিকারী তাকে হাকিম বলা হয়। আর যে মারিফাতের অধিকারি তাকে আরিফ বলা হয়।

ইসলামী সভ্যতায় আলেম বলতে আলেম হওয়ার সাথে সাথে হাকিম তথা প্রজ্ঞাবান এবং আরিফ তথা ইরফানের অধিকারী হওয়াকে বুঝানো হয়। এগুলো একটি আরেকটির সাথে সম্পর্কিত। এগুলোকে কখনোই পরস্পর থেকে পৃথক করা যাবে না। মারিফাতুল্লাহ ছাড়া কখনো হিকমত অর্জন করা সম্ভব নয়। হিকমতবিহীন ইলম সম্ভব নয়। যদি আমরা হিকমত ও মারিফতকে ইলম থেকে পৃথক করি, তবে ইলম নিছক তথ্য উপাত্তে পরিণত হবে। আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমরা প্রচুর তথ্য উপাত্ত জানি। ইন্টারনেটের আবিষ্কারের কারণে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত জানা এখন দুনিয়ার সবচেয়ে সহজ বিষয়। অথচ শুধুমাত্র কিছু তথ্য উপাত্ত জানলেই একজন মানুষ আলেম হিসেবে গণ্য হতে পারে না।

এমনকি ইলমের সাথে অবশ্যই আমলে সালেহের সংযোগ থাকতে হবে। আমলে সালেহ ছাড়া সে যদি আল্লামাও হয়, তাকে আলেম বলা যাবে না। আলেম হওয়ার জন্য উসূলের অধিকারী হতে হয়। শুধুমাত্র দ্বীন সম্পর্কেই জানলেই হবে না। দ্বীনের সাথে সাথে মানুষ এবং মানুষের জীবনকে জানতে হবে। এমনকি এই তিনটির মধ্যে কীভাবে সমন্বয় সাধন করা যায় তাও জানতে হবে।

শুধুমাত্র কুরআনকে জানলেই হবে না, বরং এর সাথে আয়াতে তাকবীন ও আয়াতে তানযীল বুঝার জন্য উসূলকে বুঝতে ও জানতে হবে। উসূল তথা মূল এবং শাখা-প্রশাখার মধ্যে পার্থক্য করার জ্ঞান থাকতে হবে। জুয’ইয়্যাত, কু্ল্লিয়্যাত তথা শাখা-প্রশাখা এবং মূল বা সামগ্রিক বিষয় কাকে বলে তা জানতে হবে এবং এর মাঝে পার্থক্য নিরূপণ করার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। কোনটি পরিবর্তনীয় আর কোনটি অপরিবর্তনীয়, কোনটি স্থানীয় আর কোনটি সার্বজনীন এগুলোর মাঝে পার্থক্য নিরূপণ করার মতো যোগ্যতা থাকতে হবে।

শুধুমাত্র কিতাব জানলেই হবে না, এর সাথে সুন্নাহ তথা হাদীসকে জানতে হবে। কিতাব ও সুন্নাহর মাঝে যে সম্পর্ক রয়েছে সে সম্পর্কিত উসূলও জানতে হবে। কিতাব এবং সুন্নাহকে কীভাবে বুঝবো এই সম্পর্কে ইসতিম্বাতের উসূলকে জানতে হবে। যারা এই সকল বিষয় জানবে তাদের পক্ষেই আলেম হওয়া সম্ভব। তাদেরকেই আমরা আলেম বলবো।

জ্ঞানের তিনটি মৌলিক বিষয় আছে: ওহী, মানুষ ও সৃষ্টিজগত। এগুলোকে পরস্পর থেকে কখনো আলাদা করা যাবে না।

ওহীকে বুঝানোর জন্য যেসব জ্ঞান রয়েছে যেমন- তাফসীর, হাদীস, কালাম এগুলো নির্দিষ্ট। শুধুমাত্র এসব বিষয়ের উসূলকে ভালোভাবে জানতে হবে। উসূলে দ্বীন ও উসূলে ফিকাহর উপর গুরুত্ব দিতে হবে। মানুষকে বুঝানোর ক্ষেত্রে যেসব জ্ঞান আছে আমাদেরকে সেসবও জানতে হবে। এজন্য ইতিহাস, সোশিওলজি, সাইকোলজি ভালোভাবে জানতে হবে। কেননা এসব জ্ঞান মানুষের সাথে সম্পৃক্ত। তৃতীয়টি হচ্ছে বিশ্বসৃষ্টি। যেসব জ্ঞান এই বিশ্বসৃষ্টিকে ব্যাখ্যা করে, সেসবও আমাদেরকে জানতে হবে। কারণ, সৃষ্টিজগত হচ্ছে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের সৃষ্টি সম্পর্কিত বিষয়সমূহ। মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর সৃষ্টি জগতে যেসব নিয়ম-কানুন প্রতিষ্ঠা করেছেন সেগুলোকে ব্যাখ্যা করে পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত। এসব বিষয় আমাদেরকে আল্লাহর সৃষ্টিজগতের নিয়ম-কানুন সম্পর্কে শিক্ষা দেয়।

আমরা যদি এই সকল বিষয়কে একটি সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পারি, তাহলে তাওহীদুল উলুমের অধিকারী হতে পারবো।

আকাইদ সংক্রান্ত জ্ঞান ও চর্চা

এখনকার সময় আকাইদ সংক্রান্ত যেসব গ্রন্থ পড়ানো হয়, সেগুলোতে শুধুমাত্র আল্লাহর সৃষ্টি এবং সিফাত সমূহের বর্ণনা থাকে। কিন্তু এসবের উদ্দেশ্য বর্ণনা করে না। অথচ, আমাদেরকে রুবুবিয়াত, উলুহিয়াত, নবুয়্যাত, মওত তথা আখিরাত এই সকল বিষয়কে বুঝতে হবে সামগ্রিকভাবে। খণ্ডিতভাবে নয়। এমন কিছু বুঝানোর ক্ষেত্রে কায়িনাত তথা সৃষ্টিজগতের আইনসমূহকে বিবেচনায় নিতে হবে। আজকে আমরা আমাদের যুবকদেরকে যে আকাইদ পড়িয়ে থাকি এটা অনেক দিক থেকেই অসম্পূর্ণ। এতে অনেক ঘাটতি রয়েছে।

কেউ কেউ আমাদেরকে তাওহীদ বুঝানোর পরিবর্তে তাকফিরকে বুঝিয়ে থাকে। অথচ আমাদের শেখা দরকার তাওহীদ।

আল্লাহর আসমাউল হুসনা বা গুণবাচক নামসমূহকে খুব ভালোভাবে জানতে হবে। শুধুমাত্র এটি জানার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। বরং সেই সকল আসমা ও সিফাতসমূহ থেকে আখলাক সৃষ্টি করে আমাদের নিজেদের জীবনকে গঠন করতে হবে।

প্রথম যুগের মুসলমানগণ, যেমন হাসান বসরী (রহ.) মানুষ এবং আল্লাহর মধ্যকার সম্পর্কের বোঝানোর জন্য ‘মারহামাতের’ উপর ভিত্তি করে একে সংজ্ঞায়িত করেছেন এবং সেই অনুযায়ী বই-পুস্তক রচনা করেছেন।

এরপর আসেন মুতাজিলাগণ। তারা আল্লাহ এবং মানুষের মধ্যকার সম্পর্ককে আদালতের উপরে ভিত্তি করে নির্ধারণ করার চেষ্টা করেন।

এরপর ইমাম আশয়ারি আসেন। তিনি মানুষ এবং আল্লাহর মধ্যকার সম্পর্ককে ইরাদা এবং কুদরতের উপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করার চেষ্টা করেন।

এরপর ইমাম মাতুরিদি আসেন। তিনি মানুষ এবং আল্লাহ মধ্যকার সম্পর্ককে হিকমার উপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করার চেষ্টা করেন।

আহলে তাসাউফ তথা সুফীগণ আল্লাহ এবং মানুষের মধ্যকার সম্পর্ককে ইশক এবং মুহাব্বতের উপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করার চেষ্টা করেন।

বর্তমান সময়ে এসে মানুষ এবং আল্লাহর মধ্যকার সম্পর্ককে কোনো কোনো আইডিওলজি হাকিম এবং মাহকুমের উপর ভিত্তি করে ডিফাইন করার চেষ্টা করেছে।

এগুলোর প্রত্যেকটিই হচ্ছে এক এক ধরনের তাবিল তথা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। এই প্রত্যেকটি থেকে আমাদের উপকার নিতে হবে। প্রথমত আকাইদ তথা আল্লাহর সাথে মানুষের মধ্যকার সম্পর্ককে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। দৃঢ় ভিত্তি ছাড়া কখনোই আকাইদকে সত্যিকার অর্থে উন্নত করা যায় না।

মি-ছাক্ব:

আল্লাহ এবং মানুষের মধ্যকার সম্পর্ক ‘মিছাক্ব’ তথা একটি চুক্তির উপর নির্ভর করে। আর সেই ‘মিছাক্ব’ হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত মানুষের ফিতরাত।

এই ‘মিছাক্ব’কে দুই ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। একটি হচ্ছে ‘মি-ছাক্বুল আমানাহ’, আরেকটি হচ্ছে ‘মি-ছাক্বুশ শাহাদাহ’।

‘মি-ছাক্বুশ শাহাদাহ’র মানে হলো, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সবসময় আমাদেরকে দেখেন ও পর্যবেক্ষণ করেন। আর আমরাও সব সময় আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সৃষ্টিতত্ত্ব, তাঁর নিয়ামত, তাঁর আসমা ও সিফাতসমূহকে পর্যবেক্ষণ করে থাকি। ‘আমানতু বিল্লাহ’ এবং ‘আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র মাঝে এখানেই হলো পার্থক্য।

‘মি-ছাক্বুল আমানাহ’ হচ্ছে এটি মনে করা যে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সমস্ত সৃষ্টিকে মানুষের নিকট আমানত হিসেবে দিয়েছেন। মানুষের দায়িত্ব হচ্ছে এই আমানতের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা না করা।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে নিঃসন্দেহে আকাইদকে আমাদের সবকিছুর কেন্দ্র হিসেবে স্থাপন করতে হবে। আল্লাহ কি আকাশে, নাকি মাটিতে? আল্লাহ কোথায়? এগুলো নিয়ে আবার চৌদ্দশ বছর পরে এসে তর্ক-বিতর্ক করার নাম আকাইদ নয়। (নাউজুবিল্লাহ!) আল্লাহর হাত আছে কিনা? আল্লাহ কোথাও বসেন কি বসেন না, এই সকল বিষয় নিয়ে চৌদ্দশ বছর পর আবার তর্ক করার প্রয়োজন নেই। এসব বিষয় নিয়ে চৌদ্দশ বছর আগে বিতর্ক হয়ে গেছে, এবং এগুলোর সমাধানও হয়ে গিয়েছে। নতুন করে এসব বিষয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করার প্রয়োজন নেই।

ইবনে সিনা, আল ফারাবী প্রমুখ কি কাফের ছিলেন?

অনেক আলেম, বিশেষত মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া করেছেন এমন স্কলারগণ বলেন, ইবনে সিনা কাফের! এ সম্পর্কে তাঁরা ইমাম গাজ্জালী থেকে শুরু করে বড় বড় ইমামদের রেফারেন্স দিয়ে থাকেন।

যাকে তাকে কাফের সাব্যস্ত করা তথা তাকফীরের প্রবণতা হচ্ছে সবচেয়ে বড় অসুস্থতা। কোনো মুসলমানকে জ্ঞানগত কারণে, কোনো আয়াতের ভিন্ন ব্যাখ্যার কারণে, কয়েকটি ভিন্নমতের কারণে তাকফীর করার কোনো সুযোগ নেই। রাসূল (সা) তাকফীর করাকে নিষিদ্ধ করেছেন।

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) তাঁর ‘ফিকহুল আকবরে’ একটা কথা বলেছেন: ‘মান আমানা বিত তানযীল, লান ইউকাফফারু বিত ত’উয়ীল।’ অর্থাৎ, যে ব্যক্তি আল্লাহর অবতীর্ণ গ্রন্থের প্রতি ঈমান এনেছে, সেই গ্রন্থের কোনো আয়াত বা কোনো বিষয় ব্যাখ্যা করার কারণে তাকে কখনোই তাকফীর করা যাবে না।

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের সবচেয়ে বড় মূলনীতি হচ্ছে আহলে কিবলাকে তাকফীর করা যাবে না। এটা হচ্ছে প্রথম বিষয়।

দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, ইতিহাসে ঘটে যাওয়া বড় বড় আলেমদের মধ্যকার বিতর্ককে আজকের যুগে নিয়ে এসে সেই বিতর্কের উপর ভিত্তি করে যেন আমরা নিজেদের মধ্যে ইখতিলাফ না করি।

ইমাম গাজ্জালী এবং ইবনে সিনার মধ্যকার বিভিন্ন বিতর্ক আছে এটা আমরা জানি। কিছু কিছু চিন্তা মানুষকে কুফরের দিকে নিয়ে যায়, ইমাম গাজ্জালী এটা বলেছেন, এটা আমরা জানি। তবে ইসলামী সভ্যতার সবচাইতে বড় নক্ষত্রদের একজন, বিখ্যাত দার্শনিক, সবচেয়ে বড় চিকিৎসাবিদ ইবনে সিনা এবং ‘আল মাদিনাতুল ফা-দ্বিলা’ গ্রন্থের রচয়িতা আল ফারাবীকে কাফের বলা তো দূরে থাক, এইসব বিষয়ে কথা বলাকেও আমি কখনো সমর্থন করি না।

যেমন ইমাম গাজ্জালী এবং ইবনে রুশদের মধ্যে মতভেদ আছে। প্রথমে ইমাম গাজ্জালী ‘তাহাফাতুল ফালাসিফা’ লেখেন। ইবনে রুশদ তার জবাব দেন। এমনকি (প্রত্যুত্তরে) নতুন একটা বই (তাহাফুতুত তাহাফুত) রচনা করেন। কিন্তু দেখুন, ইবনে রুশদ কী করেছেন। তিনি ইমাম গাজ্জালীরি ‘আল মুস্তাসফাহ’কে সংক্ষিপ্ত করে ‘আদ দ্বারুরি ফি উসূলুল ফিকহ’ নামে আরবীতে একটি নতুন বই লিখে তাঁর নিজের ছাত্রদেরকে পড়িয়েছেন। এভাবেই তারা একজন অন্যজনকে সম্মানিত করেছেন। (এ ধরনের সশ্রদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখা সাপেক্ষে) আলেমদের ইখতিলাফ হচ্ছে একটি রহমত। আমরা এই রহমতকে যেন অসুবিধায় বা মুসিবতে পরিণত না করি ।

নারীদের উচ্চশিক্ষা প্রসঙ্গে ইসলামের অবস্থান

রাসূল (সা) বলেছেন, “জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক মুমিন নর নারীর জন্য ফরজ।” এখানে নারী ও পুরুষের মাঝে কোনো পার্থক্য করা হয়নি। একটি সভ্যতা বা একটি উম্মত কখনোই একটি ডানা দিয়ে উড়তে পারে না। রাসূলে আকরাম (সা) মদীনাকে একটি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করেছিলেন। নারী এবং পুরুষ উভয়ই সেখানে একসাথে জ্ঞানার্জন করেছেন।

নারী ও পুরুষকে জ্ঞানের ক্ষেত্রে কখনোই বিভাজন করা যাবে না, কাউকে কোনো ধরনের জ্ঞান থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। আমাদের পুরুষ আলেমের যতটুকু প্রয়োজন, মহিলা আলেমের ততটুকুই প্রয়োজন। যে জাতি তার নারীদেরকে মূর্খ বানিয়ে রাখে সেই জাতির দ্বারা কখনোই কোনো ভালো কাজ করা সম্ভব নয়। তাদের পক্ষে সফলতা অর্জন করা সম্ভব নয়। কারণ, মানুষ গঠনকারী, প্রজন্ম গঠনকারী হচ্ছে নারীগণ। যে জাতি মহিলাদের মূর্খ রাখবে, তাদের পরবর্তী প্রজন্মও মূর্খ হবে— এটাই তো স্বাভাবিক ।

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নারী এবং পুরুষকে একই মূল থেকে সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টিগত দিক থেকে নারী এবং পুরুষ সমান এবং তাদের মধ্যে কোনো ধরনের পার্থক্য নেই। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন, ‘আমি পৃথিবীতে খলিফা সৃষ্টি করবো।’ তিনি কখনই বলেননি যে শুধুমাত্র পুরুষরা খলিফা হবে, নারীরা খলিফা হবে না।

পুরুষরা যতটুকু আল্লাহর খলিফা, নারীরাও ততটুকুই আল্লাহর খলিফা। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যখন ওহী পাঠিয়েছেন সেটি শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য পাঠাননি। সেটি তিনি নারীদের জন্যও পাঠিয়েছেন। ওহীর উদ্দেশ্যগত দিক থেকে নারীরাও আল্লাহর উদ্দেশ্য, পুরুষরাও আল্লাহর উদ্দেশ্য। পৃথিবীতে ‘আমর বিল মা’রূফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার’ তথা সৎ কাজের আদেশ প্রদান ও অসৎ কাজের নিষেধাজ্ঞা প্রদানের যে দায়িত্ব মানুষের উপর অর্পিত হয়েছে, সেই দায়িত্ব তিনি নারী-পুরুষ উভয়ের উপরই দিয়েছেন।

পবিত্র কুরআনে ‘মুমিন নারী এবং মুমিন পুরুষ একজন আরেকজনের বন্ধু। একজন আরেকজনের সহযোগী। তারা একসাথে সত্যের আদেশ এবং অপকর্মের বিরোধিতা করবে’— এ কথাই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা) চারটি আইডিওলজির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন, শিরক, দাসত্ব, সাম্প্রদায়িকতা বা বর্ণবাদ ও জেন্ডারইজম তথা নারীকে ছোট করে দেখা

শুধুমাত্র নারী হওয়ার কারণে কাউকে ছোট করে দেখা একটি চরম জাহেলি চিন্তা।

রাসূল (সা) এমন এক সময়ে এই সকল ভ্রান্ত আইডিওলজির মোকাবেলা করেছেন, যখন তারা কন্যাশিশুদেরকে জীবন্ত কবর দিতো। শুধু নারীদের সাথে কথা বলার জন্য মসজিদে নববীতে তিনি সপ্তাহের দিন ধার্য করেছিলেন। সেই দিন তিনি তাদেরকে ইসলাম শিক্ষা দিতেন। তিনি তাদেরকে লেখাপড়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন। হযরত আয়েশা (রা) সাহাবীদের মধ্যে সবচাইতে বড় আলেম ছিলেন। তিনি ২২২০টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি কুরআনের কিছু কিছু আয়াত নাযিল হওয়ার সময় সাক্ষী হিসেবে ছিলেন। তিনি ছিলেন কিছু কিছু আয়াতের নাযিল হওয়ার উপলক্ষ্য।

পরবর্তীতে জেন্ডারইজম তথা ‘জিনছি’ চিন্তা মাঝেমধ্যে মুসলমানদের উপর আপতিত হয়েছে। এমনকি এই উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়ন করার জন্য তারা এ রকম বানোয়াট হাদীস পর্যন্ত সৃষ্টি করেছে— “তোমরা তাদেরকে লেখাপড়া শিক্ষা দিও না।” যে গ্রন্থ নাযিল হওয়া শুরুই হয়েছে ‘ইকরা’ (পড়) দ্বারা, সেই গ্রন্থ কীভাবে মুমিনদের অর্ধেককে বলতে পারে যে তোমরা পড়তে ও লিখতে পারবে না? এটা কীভাবে সম্ভব?

ইমাম বুখারীর উস্তাদদের মধ্যে নয় জন নারী উস্তাদ ছিলেন। এই নয় জন নারী থেকে তিনি রেওয়ায়েত গ্রহণ করেছেন। ইলমুল হাদীসে অনেক নারী রাবী রয়েছেন।

নারী হওয়ার কারণে তাদেরকে নিচু করে দেখা, খাটো করে দেখা, এ ধরনের যত কথা আছে এগুলো রাসূলুল্লাহর কথা হতে পারে না। নারীদের আকলে কমতি আছে, নারীদের আকলে ঘাটতি আছে, এ রকম কোনো রেওয়ায়েতই আল্লাহর রাসূলের সাথে সম্পৃক্ত করা যাবে না। আল্লাহর রাসূলের (সা) নামে এ রকম কোনো রেওয়ায়েত নেই। ‘মহিলারা দ্বীনের ক্ষেত্রে অর্ধেক’— এ ধরনের কোনো রেওয়ায়েতকে আল্লাহর রাসূলের (সা) সাথে সম্পৃক্ত করা যাবে না। এ সংক্রান্ত হাদীসসমূহকে তারা ভুল বুঝে, ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে নিজেদের স্বার্থের জন্য। এই সকল রেওয়ায়েতসমূহ ‘কুল্লি আসাস’ তথা সামগ্রিকতার মূলনীতির ভিত্তিতে বুঝতে হবে ।

আমি একজন মুহাদ্দিস। এই হাদীসের উপর ভিত্তি করে ‘নারীদের দ্বীনের ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে’ এটা কখনোই বলতে পারবেন না। কেউ এমনটি বললে বুঝতে হবে, তিনি ঐ হাদীসকে আদৌ বুঝতে পারেননি।

আমাদের মেয়েদেরকে সকল ধরনের মন্দ বিষয় থেকে রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। কিন্তু একটি খারাপ থেকে রক্ষা করতে গিয়ে যেন তাদেরকে আমরা দশটি খারাপের মধ্যে নিপতিত না করি। সবচাইতে বড় খারাপ বিষয় হচ্ছে মূর্খতা। আমরা জাহালতকে কখনোই আমাদের নারীদের উপর চাপিয়ে দিতে পারি না।

প্রচলিত গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা প্রসঙ্গে

বিশেষত মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় হতে পাশ করা আলেমগণের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ প্রচলিত গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিরুদ্ধে ইমাম ইবনে তাইমিয়া ও সাইয়্যেদ কুতুবকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করেন। এ ব্যাপারে বক্তব্য হলো:

আমরা যেন আমাদের দুনিয়াকে কখনো ব্যক্তির উপর নির্ভর করে প্রতিষ্ঠা না করি। রাসূল (সা) ছাড়া কোনো ব্যক্তি হাকিকতের উৎস হতে পারবেন না। প্রত্যেক আলেমের ভুল হতে পারে, ঘাটতি হতে পারে, বিভিন্ন ধরনের সমস্যা থাকতে পারে। আমরা না কাউকে তাকফির করতে পারি, আর না কাউকে ঘৃণা করতে পারি। আমরা যখন কোনো আলেমকে মূল্যায়ন করবো তখন আমাদেরকে আদিল বা ন্যায়পরায়ণ হতে হবে।

এই দুজন ব্যক্তির বিভিন্ন বিষয়ে কিছু কিছু চিন্তা খুবই এক্সট্রিম। কারণ, এই দুজনই তাদের চিন্তাকে প্রকাশ করেছেন খুব কঠিন সময়ে। জুলুম-নির্যাতনের মধ্যে। ইবনে তাইমিয়া জীবনের বড় একটি সময়ই জেলের মধ্যে অতিবাহিত করেছেন। তিনি মোঙ্গলদের সাথে যুদ্ধ করেছেন। ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন বিষয়ে তিনি একটু কঠিন হতেই পারেন, একটু কঠিন কথা বলতে পারেন। এটাই স্বাভাবিক। আমার ওস্তাদ আমাকে বলতেন, ইমাম ইবনে তাইমিয়া এবং মহিউদ্দীন আরাবীর মতো আলেমগণ বিশাল এক মহাসাগরের মতো। যদি সাঁতার কাটতে পারো তাহলে ঐ মহাসাগরে সাঁতার কাটো। সমস্যা নাই। তবে যদি সাঁতার কাটতে না জানো তো খুব বেশি যাওয়ার দরকার নাই। মনিমুক্তা হচ্ছে সাগরের একদম তলদেশের সম্পদ।

আমি নিজে ইবনে তাইমিয়াকে খুব ভালোভাবে পড়েছি। তাঁর সকল ফতোয়া পড়ার সুযোগ আমার হয়েছে। আধুনিক সময়ে এসে আইডিওলজিক্যাল সালাফিজম, দায়েশ এবং আরও যেসব চরমপন্থী গোষ্ঠী আছে, তারা তাদের উৎস হিসেবে ইমাম ইবনে তাইমিয়াকে নেয়, যা সম্পূর্ণ তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি।

আপনারা যদি ইমাম ইবনে তাইমিয়ার ‌‘তায়রিদুল আক্বলি ওয়ান নাকলি’ বইটি আব্দুল ওহহাবের বর্তমান সময়ের যে কোনো একজন ছাত্রকে দেন, তাহলে তারা কেউ এটাকে গ্রহণও করবে না, পড়া তো দূরে থাক। একইসাথে সাইয়্যেদ কুতুব একজন মুতাফাক্কির। তিনি আলেম নন। তিনি একজন শহীদ। আল্লাহ তার উপর রহম করুন। তিনি উম্মাহর একজন শহীদ। কিন্তু তিনি যখন ‘ফি যিলালিল কুরআন’ লিখেন তখন তিনি জেলে বন্দী ছিলেন। এখানে আর্তচিৎকার আছে, ফরিয়াদ আছে। এখানে তিনি জালিমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। প্রত্যেক আলেমকে তাঁর অবস্থার আলোকে পড়তে হবে। ইসলামকে কখনোই ব্যক্তির উপর নির্ভর করে প্রতিষ্ঠা করা যাবে না।

ইসলামে রাজনীতির গুরুত্ব প্রসংগে:

আমি মুসলমানকে এভাবে ডিফাইন করে থাকি: একজন মুসলমান সমগ্র মানবতার সমগ্র পৃথিবীর দায়িত্বশীল। যদি আপনি সমগ্র দুনিয়ার ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন, তাহলে দুনিয়াকে পরিচালনা করে যে রাজনীতি, তা থেকে আপনি কীভাবে দূরে থাকতে পারেন? যদিও শুধুমাত্র রাজনীতির উপর ভিত্তি করে মুসলমানদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করা, পার্থক্য করা, একজন আরেকজনকে তাকফির করা কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

সিয়াসাতের অপর নাম হচ্ছে আখলাক। একজন মুসলমান যখন রাজনীতি করবেন তখন তিনি কখনও সিয়াসাতকে আখলাক থেকে পৃথক করতে পারেন না। আদালত বা ন্যায়বিচারকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য রাজনীতির প্রয়োজন অপরিসীম। কারণ, আদালত হচ্ছে আসাসুল মূলক তথা রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি।

এক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের একজন মুমিনের জন্য এরকম একটি কর্মধারা জারী থাকা জরুরী। যদি সম্ভব হয় তাহলে অবশ্যই একজন মুসলমানকে হক ও আদালত প্রতিষ্ঠা করার আন্দোলনে এবং যারা এ ধরনের রাজনীতি করেন তাদের সাথে যোগ দেওয়া উচিৎ।

দাড়ি বা পোশাক নিয়ে বাড়াবাড়ি করার সমস্যা

দাড়ি বা পোশাক নিয়ে বাড়াবাড়ি করার যে সমস্যা সেটার মূল কারণ হচ্ছে, মুসলমানদের মধ্যে উসূলগত সমস্যা। অনেক সময় আমরা মূল ও শাখা-প্রশাখাকে একীভূত করে ফেলছি। ‘কুল্লিয়াত’ এবং ‘জুজ’ইয়্যাত’কে একত্রিত করে ফেলি। উসিলা তথা মাধ্যম এবং মাকাসিদ তথা উদ্দেশ্যকে আমরা এক করে ফেলি। মাঝে মধ্যে আমরা উসিলা তথা পন্থাকে মাকাসিদে রূপান্তরিত করে ফেলি। জুজ’ইয়্যাতকে কুল্লিয়্যাতে রূপান্তর করে ফেলি। যেটা আকাইদ নয় সেটাকেও আকাইদে রূপান্তর করে ফেলি।

দুঃখজনক হলেও সত্য, এটা সমগ্র উম্মাহর মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে এবং এটা সব জায়গায়ই আছে। আসলে এটা একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবচাইতে বড় সমস্যা হচ্ছে, কোনটি দ্বীনি এবং কোনটি সাংস্কৃতিক এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য করতে না পেরে গুলিয়ে ফেলা।

কোনো নবী তার নিজের কওমের সংস্কৃতিকে বিশ্বজনীন সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত করেননি। দ্বীনের মধ্যে সবচাইতে বড় যে বিদায়াতটি প্রবেশ করতে পারে, সেটি হচ্ছে, ওই নবী যে কওমে বা গোত্রে এসেছেন সেই গোত্রের কোন কৃষ্টি-কালচারকে দ্বীনে রূপান্তরিত করা।

এ কথা বলার সময় পোশাক-আশাকের ব্যাপারে ইসলাম যে নির্দেশ ও নির্দেশনা দিয়েছে সেগুলোকে আমি অবজ্ঞা বা ছোট করছি না। পোশাক-আশাকের ব্যাপারে ইসলাম যে মূলনীতি দিয়েছে সেটা হচ্ছে: পোশাক-আশাকের মাধ্যমে যাতে করে কোনো হারাম প্রকাশিত না হয়। পোশাকের ক্ষেত্রে নারীদের পোশাক ভিন্ন, পুরুষদের পোশাক ভিন্ন। নারীদের পোশাকের ক্ষেত্রে তাদের অঙ্গকে সঠিকভাবে ঢাকতে হবে এবং পবিত্রতা রক্ষা করতে হবে। অমুসলিমদেরকে অনুকরণ করার জন্য কোনো পোশাক পরিধান করা যাবে না। এই সকল মূলনীতির বাহিরে একজন মুসলমান হিসেবে সে তার পছন্দমতো পোশাক পরতে পারে। এ ক্ষেত্রে ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো সমস্যা নেই ।

উহুদ এবং বদরের যুদ্ধের কথা চিন্তা করেন। এক পাশে মুসলমানরা, আরেক পাশে মুশরিকরা। উভয়ের মাঝে পোশাক-আশাকে খুব বেশি পার্থক্য ছিল না। মুসলমানদের মাথায়ও পাগড়ি ছিল, তাদের মাথায়ও ছিল। মুশরিকদেরও দাড়ি ছিল, মুসলমানদেরও ছিল। বাহ্যিক দিক থেকে তাদের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য ছিল না। রাসূলুল্লাহর (সা) বিপ্লব শুধুমাত্র বাহ্যিক দিক থেকে ছিল না। রাসূলের (সা) বিপ্লব ছিল মূল নীতিগত দিক থেকে। বাহ্যিকতা ও আনুষ্ঠানিকতার গুরুত্ব অবশ্যই আছে, অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু রূহবিহীন বাহ্যিকতা এবং রূহবিহীন আনুষ্ঠানিকতার কোনো মূল্য নেই।

এ ধরনের আরো লেখা