সালাফী ইসলাম প্রসঙ্গে

সালাফী ইসলাম প্রসঙ্গে

সংজ্ঞা
সালাফী ধারার ইতিবাচক অবদান
সালাফিজমের সমালোচনা
উপসংহার

১. সংজ্ঞা

১। সালাফী ইসলাম কী?

‘সালাফিজম’ বলতে আসলে কী বুঝায়? এর সর্বসম্মত কোনো সংজ্ঞা নাই। আমার প্রস্তাব হলো– আধুনিক সালাফী ধারার একদম শুরুর দিকের রূপরেখা, তাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্যসমূহ, সাম্প্রতিককালে এর নানান গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়া এবং ইসলাম ও বর্তমান বৈশ্বিক সমাজে এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক অবদানগুলো আলোচনা সাপেক্ষে সালাফিজমকে বিশ্লেষণ করা।

আধুনিক দুনিয়ার প্রেক্ষাপটে, কিংবা আরো স্পষ্ট করে বললে, গত অর্ধশতকে ‘সালাফী’ পরিভাষাটি একটি ইসলামিক মেথডলজি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এর লক্ষ্য হলো ইসলামের প্রথম প্রজন্মের মুসলমানদের ঈমান ও আমলের যে নবুয়তী মানদণ্ড ছিলো, তার সমকক্ষ হওয়ার চেষ্টা করা। কারণ, নবুয়তী যুগ হলো রাসূলের (সা) সুন্নাহর সর্বোৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। তারপরের প্রথম তিন প্রজন্ম (সাহাবী, তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ী) মহানবীর (সা) যুগের সবচেয়ে কাছাকাছি ছিলেন। এই তিন প্রজন্মের সময়কালকে ইসলামের প্রকৃত রূপরেখা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

যেহেতু পরিভাষাটি দ্বারা একটি মেথডলজিকে বুঝায়, তাই এটা বলাই ন্যায়সঙ্গত– সালাফিজম দ্বারা মুসলমানদের বিশেষ বা স্বতন্ত্র কোনো গোষ্ঠী বা দলকে বুঝায় না। এক ডজনেরও বেশি ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপ হয় নিজেদেরকে ‘সালাফী মানহাজের’ অনুসারী বলে পরিচয় দেয়, নয়তো নিজেরা পরিভাষাটি ব্যবহার না করলেও কেউ এই পরিচয়ে তাদেরকে পরিচয় দিলে তারা আপত্তি করে না। এই বাস্তবতা পরিভাষাটিকে বুঝতে আমাদেরকে আরো বেশি সহায়তা করেছে। তবে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না – এই প্রত্যেকটি গ্রুপ নিজেদেরকেই একমাত্র সঠিক বলে মনে করে এবং অন্যান্যদেরকে সালাফিজমের সত্যিকারের প্রতিনিধি বলে মনে করে না। এই কারণে ‘সালাফিজম’ সম্পর্কে একটি সামগ্রিক ধারণা পেতে হলে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট নানান বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন সালাফী গ্রুপগুলোর ঐক্যমত ও দ্বিমতের বিষয়গুলো বুঝতে হবে।

১.১। সালাফী আন্দোলনগুলোর মধ্যে যেসব বিষয়ে ঐক্যমত রয়েছে:

ক্ষুদ্র ব্যতিক্রম বাদে সালাফী ঘরানার প্রচলিত সব গ্রুপের মধ্যে কিছু বিষয়ে সাধারণ ঐক্যমত রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো–

১) প্রত্যেকে শুধু নিজেদেরকেই সালফে সালেহীনদের শিক্ষা ও আকীদার সঠিক অনুসারী বলে মনে করে। বিশেষ করে, তারা যে ধর্মীয় আকীদার কথা বলে গেছেন, তা মনেপ্রাণে সমর্থন করে। সাধারণত এটি আছারী আকীদা হিসেবে পরিচিত।

২) আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর (তাওহীদে আসমা ওয়াল সিফাত) যে কোনো প্রকার রূপক বা প্রতীকী ব্যাখ্যাকে তারা সর্বোতভাবে প্রত্যাখ্যান করে। বলাবাহুল্য, আশআরী ও মুতাজিলা গোষ্ঠীর মধ্যে মতবিরোধের এটিই ছিলো মূল কারণ।

৩) যে কোনো প্রকার ইবাদত ও ভক্তি প্রদর্শন একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট (তাওহীদে উলুহিয়্যাহ) বলে তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে। তাদের এই বিশ্বাসের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ আপসের যে কোনো সম্ভাবনাকেই তারা প্রত্যাখ্যান করে। এ কারণে তারা বিশেষ কোনো সুফী ঘরানার রীতিবহির্ভূত বিভিন্ন প্র্যাকটিসের সমালোচনা করে। যেমন– সুফী-দরবেশদের প্রতি অতি ভক্তি, মৃত ব্যক্তিকে ওলী তথা মধ্যস্ততাকারী হিসেবে মানা ইত্যাদি।

৪) তারা সকল প্রকার বিদয়াতের বিরোধিতা করে এবং যারা এগুলোর সাথে সম্পৃক্ত (আহলে বিদয়াত) তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে। বিশেষত শিয়া মতবাদের তারা প্রচণ্ড বিরোধী। কারণ, এই মতবাদ সাধারণভাবে সাহাবী বিদ্বেষের দোষে দুষ্ট।

৫) তারা শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াকে (মৃ. ৭৪৮/১৩২৮) শ্রদ্ধা করে এবং তাঁর ফিকহী ও ধর্মতাত্ত্বিক মতামতগুলোকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। এটা বলে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, তিনি আধুনিক সালাফী আন্দোলনের জনক নন। তাঁর পক্ষে এটি হওয়া সম্ভবও নয়। কারণ তাদের নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, মহানবী মোহাম্মদের (সা) পর এর একক কোনো প্রতিষ্ঠাতা থাকতে পারে না।

১.২। সালাফী গ্রুপগুলোর মধ্যে দ্বিমতের বিষয়সমূহ:

যদিও তাদের মধ্যে কিছু সাধারণ ঐক্যমত্য রয়েছে বলে আমরা উপরে দেখেছি, তারপরও বহু ইস্যুতে তাদের মধ্যে প্রচুর দ্বিমত আছে। দ্বিমতের প্রতিটি পয়েন্ট স্ব স্ব পক্ষের আলেমদের বিস্তারিত মতামতে ওঠে এসেছে। এর মধ্যে নিম্নোক্ত ইস্যুগুলো সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য:

১। কোনো একটি মাজহাব অনুসরণের প্রয়োজনীয়তা ও বৈধতার ব্যাপারে সালাফীদের অবস্থান:

একটি বিশেষ মাজহাবের মতামতকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে থাকার ব্যাপারে সালাফী উপদলগুলোর অবস্থান পরস্পরবিরোধী। এটি তাদের মাঝে বিদ্যমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতির অন্যতম একটা কারণ।

ক) অনুমোদনযোগ্য নয়: স্থায়ী পদ্ধতি হিসেবে মাজহাবের প্রতিষ্ঠা লাভের বিরোধিতা করা ছিলো ঐতিহাসিকভাবে ইবনে হাজমের (মৃ. ৪৫৬ হিজরী) জাহেরী মাজহাবের বৈশিষ্ট্য। এই ‘মাজহাববিরোধী’ ধারার সাম্প্রতিক প্রবণতার সূচনাকারী বলা যায় মুহাম্মদ হায়াতুল সিন্ধীকে (মৃ. ১১৬৩)। আল-সানানী (মৃ. ১১৮২), আল-শাওকানী (মৃ. ১২৫০), সিদ্দীক হাসান খান (মৃ. ১৩০৭)[1] এবং অতি সাম্প্রতিককালে নাসীর উদ্দীন আল-আলবানী (মৃ. ২০০০) তাঁর দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন।

খ) অনুচিত, তবে অবৈধ নয়: কোনো কোনো সালাফী আন্দোলন সাধারণ মানুষকে বিশেষ প্রয়োজনে কোনো একটি মাজহাব অনুসরণের অনুমতি দেয়। তবে শর্ত হলো, পরবর্তীতে তার কাছে দলীল তুলে ধরা হলে মাজহাবের পরিবর্তে তাকে দলীলই মানতে হবে।[2]

গ) অনুমোদনযোগ্য: একজন সাধারণ মুসলমানের জন্য একটি নির্দিষ্ট মাজহাবের অনুসরণ বাধ্যতামূলক বা গ্রহণযোগ্য হিসেবে সুন্নী ইসলাম মোটাদাগে মেনে নিয়েছে। সালাফী ইসলামের কোনো কোনো ঘরানাও এটি মেনে নিয়েছে। নজদী দাওয়াতী ধারার পুরোধা মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহাব (মৃ. ১২০৬)[3] ধর্মীয় বিষয়ে আল-সিন্ধী দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। কিন্তু তারপরও তিনি হাম্বলী মাজহাবের একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন। কারণ তিনি মনে করতেন, একটি মাজহাবের আওতায় থেকে ইসলামের ইবাদত ও রীতিনীতিগুলো অনুসরণ করা একইসাথে বৈধ ও উত্তম।

২। আহলে বিদয়াতের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা:

তাত্ত্বিকভাবে সকল সালাফী গ্রুপ বিদয়াত, বিদয়াতের অনুসারী ও প্রচারকদের থেকে নিজেদেরকে দূরে রাখে। কিন্তু বাস্তবে এই সম্পর্ক ছিন্ন করার পদ্ধতি কীভাবে কার্যকর করা হবে এবং এর ব্যাপ্তি কতটুকু হবে, তা নিয়ে সালাফী গ্রুপ ও আলেমভেদে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য রয়েছে।

এই বিষয়ে সবচেয়ে কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি পোষণকারীগণ স্বভাবতই একজনের জন্য সবাইকে দোষারোপ করে থাকে। যেমন– ‘ক’ একজন বিপথগামী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। ‘ক’ ব্যক্তির সাথে ‘খ’ ব্যক্তির সম্পর্ক রয়েছে। সুতরাং ‘খ’ ব্যক্তিও বিপথগামী। এখন যদি ‘খ’ ব্যক্তির সাথে ‘গ’ ব্যক্তির সম্পর্ক থাকে, তাহলে সেও বিপথগামী। অন্যদের ব্যাপারে এ ধরনের প্রান্তিক অবস্থান গ্রহণ ও বিচ্ছিন্নতার নীতি সালাফী কমিউনিটির মধ্যে আরো বেশি বিভাজন ও দল-উপদলের উদ্ভব ঘটিয়েছে। ব্যাপারটি দুঃখজনক।

এভাবে যারা মানুষকে বিচার করে, তারা ‘মাদখালী’ (সৌদী শায়খ রাবী বিন হাদী আল-মাদখালীর অনুসারী) হিসেবে পরিচিত। এই গ্রুপটি ‘জারাহ ওয়াত তাদীল’ শাস্ত্রকে (এটি হাদীস পর্যালোচনার একটি পদ্ধতি, যেখানে হাদীস বিশারদগণ বর্ণনাকারীর গ্রহণযোগ্যতা বা অগ্রহণযোগ্যতা বিচার করেন) পুঁজি করে তাদের এই ধরনের কার্যকলাপকে বৈধতা দেয়। সাম্প্রতিককালে যদিও মাদখালী ধারার জনপ্রিয়তা বেশ কমে গেছে, তবে মাদখালীদের বাইরেও বহু সালাফী গ্রুপ এই ইস্যুতে এ ধরনের কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি লালন করে। এমনকি নিজেদের বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গির কাউকে তারা তাদের আলোচনা সভা বা বৈঠকে আমন্ত্রণ পর্যন্ত জানায় না।

যা হোক, কোনো কোনো সালাফী আলেম ও গ্রুপ এই ইস্যুতে তুলনামূলকভাবে নমনীয় অবস্থান গ্রহণ করেছে। তারা সালাফীদের বাইরে অন্য ঘরানার কারো কারো সাথেও সহযোগিতা করার মনোভাব রাখে। যেমন– দেওবন্দীদের সাথে কাজ করাকে তারা অনুমোদন দেয়, তবে শিয়াদের সাথে নয়।

৩। ঈমান সম্পর্কে আকীদাগত অবস্থান:

ব্যক্তির আমল ঈমানের অপরিহার্য অংশ নাকি সম্পূরক অংশ? ঈমান ও এর তাৎপর্যগত অর্থ তুলনামূলকভাবে আধুনিক যুগের জিজ্ঞাসা। এ প্রসঙ্গে ৯০ দশকের শেষদিকে শায়খ আলবানী বলেছিলেন যে তিনি আমলকে ঈমানের অপরিহার্য অংশ মনে করেন না।[4] অথচ, এর আগ পর্যন্ত স্ট্যান্ডার্ড সালাফী পজিশন ছিলো – বিশেষ কিছু কাজ ঈমানের অপরিহার্য অংশ এবং এই কাজগুলো কেউ না করলে তা ঈমানের দাবির সাথে সাংঘর্ষিক হবে। ইবনে তাইমিয়া এবং অন্যান্য আছারী আলেমগণ এ ধরনের সুস্পষ্ট মতামত দিয়েছেন।

৪। ইসলামী শাসকের (উলিল আমর) প্রতি আনুগত্যের মাত্রা এবং রাজনৈতিক তৎপরতার অনুমোদন:

এটি একটি জটিল ও বিস্তৃত বিষয়। সালাফী আন্দোলনের বাইরে অন্যান্যদের সাথে এই বিষয়টি নিয়েই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি দ্বিমত হয়। রাজনৈতিক তৎপরতা চালানো ও রাজনৈতিক বিরোধিতা করার সুযোগ, মুসলিম শাসকের প্রতি আনুগত্যের অপরিহার্যতা এবং কোনো অবৈধ শাসকের ‘ইসলামী বৈধতা’ ইত্যাদি বিষয়গুলো শরীয়তে সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি। বিদ্যমান অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নানান মতের সালাফী আলেমগণ বিষয়গুলো সুরাহা করার চেষ্টা করছেন। এ বিষয়ে তাদের অবস্থানগুলোকে নিম্নোক্তভাবে তুলে ধরা যায়:

ক) বৈধ শাসকের সমালোচনা করা ধর্মীয় দৃষ্টিতে একইসাথে বিচ্যুতি ও পাপ কাজ: সালাফীদের কেউ কেউ, বিশেষ করে মূলধারার সৌদি সালাফী ও মাদখালীরা সরকারের কট্টর সমর্থক।[5]

খ) শাসক গোষ্ঠীর কাছে জবাবদিহিতা দাবি করা এবং তাদেরকে সুপারিশ বা পরামর্শ দেয়া ‘আমর বিল মারুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার’ (সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ) নীতির অংশ: সরকারী পলিসিরি সমালোচনা করাকে সালাফীদের কেউ কেউ শুধু বৈধই মনে করেন না; বরং একে তারা সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ সংক্রান্ত ইসলামী নীতির অপরিহার্য অংশ বলে মনে করেন। এটিকে তারা জালিম শাসকের জুলুম প্রতিরোধের ইসলামী মূলনীতির সমতুল্য বলেও মনে করেন। সৌদি আরবের সাহওয়াপন্থী আলেমগণ এই ঘরানার উদাহরণ।

গ) দুনিয়ার সকল মুসলিম রাষ্ট্রের শাসকদের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা: কিছু সালাফী গ্রুপ মুসলিম দেশগুলোর শাসকদেরকে (কিংবা, যেসব মুসলিম রাষ্ট্র শরীয়াহ দ্বারা পরিচালিত নয়) অবৈধ মনে করে এবং তাদেরকে কাফের হিসেবে বিবেচনা করে। তাদের মতে, এদের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে। সম্ভব হলে শক্তি প্রয়োগ করতে হবে।[6]

৫। তাকফীর (কোনো মুসলমানের ঈমান নেই বলে বিবেচনা করা) ইস্যু, বিশেষত যেসব শাসক শরীয়াহ আইন অনুযায়ী শাসন করে না (আল-হুকুম বি গাইরি মা আনযালাল্লাহ):[7]

আবারো বলে রাখি, এ ব্যাপারেও একাধিক মতামত রয়েছে[8]:

ক) মুসলিম দেশের শাসকরা ঈমানদার: সৌদি আরবের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতি শায়খ আব্দুল আজীজ বিন বাজ (মৃ. ১৯৯৯) এবং শায়খ আলবানীসহ সালাফী আলেমদের কেউ কেউ মনে করেন, কোনো মুসলিম দেশের শাসক সেক্যুলার আইন মোতাবেক দেশ পরিচালনা করা সত্ত্বেও তারা ঈমানদার (যদি না সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়। বাস্তবে এমন প্রমাণ পাওয়া বেশ কঠিন)। তাঁদের যুক্তি হলো, এটি একটি গোনাহ বটে। তবে এ কারণে তারা ইসলামের আওতা থেকে বের হয়ে যান না।

খ) শাসকরা মুসলিম হলেও শাসনকার্য কুফর: এ জাতীয় শাসকরা মুসলিম, এবং তারা কমিউনিটির বৃহত্তর কল্যাণে নিয়োজিত। তবে তাদের শাসনকার্য আল্লাহর আইন বহির্ভূত হওয়ায় তা বড় ধরনের কুফর। এটি হলো অধিকাংশ মধ্যপন্থী সালাফীর দৃষ্টিভঙ্গি। যেমন– শায়খ মোহাম্মদ বিন সালিহ আল-উসাইমিন (মৃ. ২০০১)।

গ) শাসকরা কাফের: সেুক্যলার আইনে দেশ পরিচালনার মাধ্যমে মুসলিম দেশের শাসকগণ কুফরে নিপতিত হন। তাদের শাসন অবৈধ এবং তাদের ঈমান নেই। তাই তাদের প্রতি আনুগত্য করার শরয়ী বাধ্যবাধকতা আর থাকে না। এই গ্রুপটি কট্টরপন্থী। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন আবু মোহাম্মদ আল-মাক্বদিসি এবং আবু মুসআব আল-সুরি। এ দুজনের লেখা জিহাদপন্থী সালাফী আন্দোলনকে উজ্জীবিত করেছে।

৬। জিহাদের ব্যাপারে অবস্থান:

শীর্ষ সালাফী গ্রুপগুলোর অধিকাংশই শান্তিবাদী। তবে সালাফী আন্দোলনের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে তুলনামূলকভাবে সংখ্যালঘু একটি গ্রুপ ‘সশস্ত্রপন্থী’। তারা মনে করে, উম্মাহর নির্দিষ্ট কিছু অংশের উপর সশস্ত্র জিহাদ বাধ্যতামূলক। অন্যথায় উম্মাহর সক্ষম প্রত্যেকের উপরই সশস্ত্র জিহাদের বাধ্যবাধকতা বলবৎ হবে। নিচের যে কোনো একটি বা উভয়টির উপরই তারা গুরুত্ব দেয়:

ক) মুসলিম ভূখণ্ড থেকে সেক্যুলার শাসকদের অপসারণ করা।

খ) যেসব মুসলিম ভূখণ্ডে কোনো অমুসলিম সরকার সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াই চালিয়ে যাওয়া।

শেষ তিনটি পয়েন্ট (যথা– আল্লাহর আইন বহির্ভূত শাসনের বৈধতা, শরীয়াহ বহির্ভূত শাসনকার্য পরিচালনা করলে মুসলিম শাসকের ঈমান থাকে কিনা এবং জিহাদ ইস্যু) যে আসলে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত, এটি সহজেই বুঝা যায়। শাসনকার্যের বৈধতা এবং সেক্যুলার মুসলিম শাসকের ঈমান সম্পর্কে যারা কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন, তারা অনিবার্যভাবেই সবচেয়ে কট্টর অবস্থানটি নিয়ে ফেলেন। অর্থাৎ, অন্যদেরকে কাফের ঘোষণা দিয়ে থাকেন। আর এভাবেই সশস্ত্র জিহাদের ভিত রচিত হয়।

১.৩। উল্লেখযোগ্য কিছু সালাফী গ্রুপ:[9]

১। মূলধারার সৌদি সালাফী: সালাফী গ্রুপগুলোর মধ্যে এটিই সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গ্রুপ। সৌদি ধর্মীয় নেতাদের অধিকাংশই এই ঘরানার। এই ঘরানার আলেমগণ সাধারণত একটি মাজহাব অনুসরণ করে থাকেন। ব্যতিক্রম বাদে সেটি হলো হাম্বলী মাজহাব। এরা নির্বিবাদী এবং শাসকের প্রতি অনুগত। সৌদি আলেমদের প্রতিনিধিত্বশীল এই গ্রুপটি ‘তাকফীর’ করাকে এড়িয়ে চলে এবং চরমপন্থী জিহাদী গ্রুপগুলোর সমালোচনা করে থাকে।

২। শায়খ আলবানীর জর্ডানী সালাফিজম: অনুসারী বিবেচনায় এটি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রুপ। এরা কট্টর মাজহাববিরোধী এবং শুধুমাত্র দলিলভিত্তিক ফিকাহর সমর্থক ও প্রচারক। রাজনৈতিকভাবে একান্ত নির্বিবাদী। শাসকগোষ্ঠী কিংবা জিহাদপন্থী সালাফীদের এড়িয়ে চলার ব্যাপারে সদাসতর্ক। যদিও জিহাদীদের ব্যাপারে তাদের সমালোচনা সৌদি সালাফীদের মতো ততটা স্পষ্ট নয়। এই দলটিও ফিকাহর ক্ষেত্রে চরম অক্ষরবাদী (literalist)। এই কঠোর অক্ষরবাদী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে তারা বিদয়াত নির্ধারণ করে। যদিও অন্যান্য সালাফীরা একে দোষণীয় মনে করে না। যেমন– মসজিদের ভেতরে দাঁড়িয়ে আজান দেয়া, কার্পেটের উপর কাতারের চিহ্ন দেয়া, কিংবা মিম্বরে তিনটি ধাপের কমবেশি না হওয়া ইত্যাদি।

৩। সাহওয়াপন্থী সালাফী: সৌদি আরবের সাহওয়া আন্দোলন একটি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সংস্কারের আন্দোলন। স্বভাবতই শাসকগোষ্ঠীকে ক্ষমতাচ্যুত করা তাদের লক্ষ্য নয়। শায়খ সালমান আল-আওদাহ, তাঁর আগে শায়খ সফর আল-হাওয়ালী প্রমুখ আলেম এই ধারার প্রতিনিধি। বেশিরভাগ সময় দেখা গেছে, এই গ্রুপটির রাজনৈতিক কাণ্ডজ্ঞান চমৎকার এবং এরা সোশ্যাল মিডিয়ায় অত্যন্ত সক্রিয়। ফলে তারা তুলনামূলকভাবে শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের দাবিগুলো সহজে বুঝতে পারে। মুসলমানদের সামাজিক সমস্যাগুলোর সমাধানে তাঁদের দৃশ্যমান সক্রিয় তৎপরতা থেকেই বুঝা যায় মুসলমানদের নিয়ে তাঁরা সত্যিকার অর্থে ভাবেন।

৪। মাদখালী সালাফী: মাদখালী ধারা মূলত সৌদি সালাফীদের একটি ছোট উপগ্রুপ। এরা সাধারণ সালাফী গ্রুপগুলোর চেয়ে অনেকটা ভিন্ন ধাঁচের। তাদের কার্যধারা অন্তর্গতভাবেই বিভেদমূলক। বলতে গেলে এই উপগ্রুপটির পূর্ণ মনোযোগ হলো– অন্যরা ‘সঠিক’ সালাফী লাইনে আছে কি নাই, তা যাচাই করা। কে সঠিক মানহাজে আছে বা নাই – এই বিতর্কে মাদখালীরা নিজেরাও দিন দিন বিভক্ত হয়ে পড়ছে। প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনায় মানুষের নিকট তাদের গুরুত্ব দিন দিন কমছে। অন্যদেরকে খারিজ করার ব্যাপারে তাদের উগ্র ও বেপরোয়া কথাবার্তা এবং সমাজে এসবের তেমন একটা প্রভাব না থাকাই তাদের গুরুত্বহীনতার প্রমাণ।[10]

৫। মিশরীয় সালাফিজম: এই ধারাটির মধ্যেও ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির অস্তিত্ব রয়েছে। এই ধারাটির বড় একটি অংশ আরব বসন্তের সময় থেকে দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছে। মিশরীয় সালাফীরা শায়খ আলবানীর জর্ডানী সালাফিজম দ্বারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত। এ কারণে তারা ফিকাহর ক্ষেত্রে চরম অক্ষরবাদী। মিশরীয় সালাফীদের মধ্যেও মাদখালীদের মতো উপদল রয়েছে। অন্যান্য দেশের মতো এখানেও রাজনৈতিক ব্যাপারে তারা চরম বিভক্ত। মিশরীয় সালাফীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল ‘নূর পার্টি’ সিসির পক্ষে কট্টর অবস্থান নিয়েছে, যেখানে অন্যরা রাজনীতি-নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকেছে, এমনকি কেউ কেউ বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর সমালোচনাও করছে। আমরা দেখছি, মিশরীয় সালাফিজম এখন একটা ব্যাপক ভাঙ্গাগড়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় বিভিন্ন উপদলের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান ও যেসব পার্থক্য সামনে দেখা যাবে, সেসব ব্যাপারে চূড়ান্ত কথা বলে ফেলার সময় এখনো হয়নি।[11]

৬। তাকফীরি সালাফী: কাউকে তাকফীর করা এই গ্রুপের মুখ্য বৈশিষ্ট্য। বিশেষত যেসব শাসক শরীয়াহ আইনে দেশ পরিচালনা করে না, তাদেরকে এরা তাকফীর করে। তবে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে না। তাদের দৃষ্টিতে যেহেতু এটি জিহাদ করার সঠিক সময় নয় এবং পারিপার্শ্বিকতাও অনুকূলে নেই। এই দলটি সাধারণত মুসলিম জনগণ ও তাদের ভূখণ্ডের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের প্রতারণাপূর্ণ ফরেন পলিসি এবং মুসলিম শাসকগোষ্ঠীর ভণ্ডামিপূর্ণ অবস্থানের সমালোচনা করে থাকে। এদের মনমগজ সর্বদা ‘ওয়ালা ওয়াল বারা’ (আনুগত্য ও বিদ্রোহ) সংক্রান্ত ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। ফলে পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত বৈধ কিংবা অবৈধ যে কোনো মুসলিম গ্রুপের পক্ষে এরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সমর্থন দিয়ে থাকে। তারা তাদের সমালোচকদের বিরুদ্ধে হরহামেশা নিফাক ও কুফরের অভিযোগ আরোপ করে। এটিই তাদের তাকফীরি বৈশিষ্ট্যের বহিঃপ্রকাশ। আচার-আচরণ ও কঠোরতার দিক থেকে মাদখালীদের সাথে এই গ্রুপটির অনেক মিল রয়েছে। কিন্তু মুসলিম সরকার প্রসঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য থাকায় তারা মাদখালীদের সম্পূর্ণ বিরোধী। আবু মুহাম্মদ আল-মাক্বদিসি এবং আবু মুসআব আল-সুরিসহ সমসাময়িক কয়েকজন ব্যক্তিত্ব এই বিশেষ সালাফী ধারার সমর্থক। সংখ্যায় স্বল্প হলেও পাশ্চাত্যে তাদের একনিষ্ঠ সমর্থক রয়েছে। প্রাথমিকভাবে আমেরিকান ধর্মীয় নেতা আনওয়ার আল আওলাকীর (২০১২ সালে মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত) দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে তরুণরা[12] এই মতবাদের সমর্থক হয়। এই গ্রুপের বেশিরভাগ সদস্য সরাসরি ‘জিহাদ’ না করলেও তাদের লেখালেখি জিহাদী গ্রুপ তৈরির ভিত রচনা করে দেয়।

৭। উগ্রপন্থী জিহাদী সালাফী: উগ্র ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সালাফী মতবাদের উপর ভর করে জিহাদপন্থী সালাফী মতবাদও গড়ে ওঠেছে। আল কায়েদা ও আইএসআইএসের মতো সশস্ত্র সংগঠন এই ধারার অন্তর্ভুক্ত। এই গ্রুপ দুটির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে বলে আমি মনে করলেও অনেকের মতে– এ দুটিকে সহজে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায় না, এরা একটি আরেকটির ধারাবাহিকতা। তাদের এই অভিমত কার্যত সঠিক। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন– আকীদাগত বিশ্বাসের ক্ষেত্রে এরা সালাফী মেথডলজির কিছু বিষয় গ্রহণ করলেও তাদের সশস্ত্র তৎপরতার কারণে অন্যসব সালাফী গ্রুপ সাধারণত তাদের নিন্দা করে। আরেকটা কথা হলো, এই গ্রুপগুলো এমনসব বিষয়ের উপর জোর দেয়, যা অন্য সালাফীদের বেশিরভাগই দেয় না (যেমন– জিহাদ সম্পর্কে তাদের নিজস্ব ধ্যানধারণা)। এবং মূলধারার সালাফীরা যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করে, তারা সেসব বিষয় এড়িয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে আরেকটি কথা বলে রাখা দরকার বলে মনে করছি। এই গ্রুপগুলোর জন্ম হয়েছে মূলত আশির দশকের প্রথমদিকে সৌদি সালাফী ও মুসলিম ব্রাদারহুড থেকে বেরিয়ে যাওয়া ছোট ছোট উপগ্রুপগুলোর এক জোট থেকে। তাই টেকনিক্যালি বলা যায়, এরা ‘পিউর’ সালাফী ঘরানার নয়।

এই গ্রুপগুলোর যে কোনো একটিকে ‘সালাফী’ হিসেবে অভিহিত করার সমস্যাটি আমরা উপরে উল্লেখিত এই ভাসাভাসা ও অসম্পূর্ণ তালিকা থেকে বুঝতে পারবো। বিভিন্ন ঘরানার সালাফীদের মধ্যকার এত এত বিতর্কের উপস্থিতি থেকে আমরা বুঝতে পারি যে উপরে উল্লেখিত যে কোনো একটি ধারার কর্মকাণ্ডকেই শুধু ‘সালাফী’ ধারার কাজ হিসেবে গন্য করা হলো বাস্তবতার বিপরীত। কেননা, এই গ্রুপগুলোর কোনোটিই এককভাবে সালাফী আন্দোলনের সার্বিক প্রতিনিধিত্ব করে না।

২. সালাফী মতবাদের ইতিবাচক দিক

ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি নির্দিষ্ট মেথডলজির আলোকে শুরু হওয়া সালাফিজম একটি ইতিবাচক শক্তি। নব্বইয়ের দশকে আন্তর্জাতিকভাবে জনপ্রিয় ইংরেজিভাষী ধর্মীয় নেতাদের প্রচারণার কারণে পাশ্চাত্যের তরুণদের বড় একটি অংশ সালাফী আন্দোলনের ব্যাপারে আকৃষ্ট হয়।

সালাফী আন্দোলনের কিছু ইতিবাচক দিক:

১। কোরআন-হাদীসের মূল ভাষ্যের প্রাধান্য: নিছক আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধি নয়, বরং মুসলমানরা যেন সরাসরি কোরআন ও সুন্নাহ থেকে ইসলামের নির্দেশনা ও বুঝজ্ঞান লাভ করতে পারে, সালাফী আন্দোলন সেই উদ্যোগ নিয়েছে। এটি প্রচলিত অন্য ফিকহী মাজহাবগুলোর সম্পূর্ণ বিপরীত। বিভ্রান্তির আশংকায় প্রচলিত মাজহাবগুলো কোরআন-হাদীস থেকে সরাসরি কোনো নির্দেশনা কিংবা ফতোয়া বের করার ব্যাপারে অনুসারীদেরকে নিরুৎসাহিত করে। এ কারণে কিছু ধর্মীয় গোষ্ঠী দৃঢ়ভাবে মনে করে, বিশেষজ্ঞ ব্যতীত অন্য কারো কখনোই হাদীসের কিতাব পড়া উচিত নয়। এমনকি কোরআনের একাডেমিক অধ্যয়নকেও ক্ষেত্রবিশেষে তারা নিরুৎসাহিত করে।

২। লোক-ইসলামের বিরোধিতা: কোরআন-হাদীসের আলোকে আধুনিক সংস্কৃতি ও রীতিনীতির ভালোমন্দ পর্যালোচনা করাকে উৎসাহিত করে। এক্ষেত্রে তারা অমুক বিশিষ্ট শায়খ কী বলেছেন, কিংবা বাপ-দাদারা এতদিন কী পালন করে এসেছেন – সেসবের পরিবর্তে শক্ত দলীল-প্রমাণের উপর গুরুত্ব দেয়। এই হিসাবে সালাফিজম ‘লোক ইসলামের’ শৃঙ্খল থেকে মুসলমানদেরকে মুক্ত করতে চলেছে বলে মনে হয়। তারা স্থান-কালের সীমাবদ্ধতামুক্ত এক নিখাঁদ বৈশ্বিক ইসলামের দিকে আহ্বান করছে। এবং এটা সত্য যে নবুয়তী যুগে এমন ইসলামই পালিত হতো।

৩। কুসংস্কার ও বিকৃতি রোধে ভূমিকা: বিভিন্ন ধর্মের নানান কুসংস্কার মিলে যে ধরনের লোক-ইসলামের প্রচলন ঘটেছে, সালাফিজম সেগুলো বর্জন করেছে। যেমন– অলী-আউলিয়াদের ভক্তি-পূজা করা, কোনো প্রয়োজনে আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ডাকা ইত্যাদি। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার– ইবাদত পালনের যে নির্দিষ্ট পদ্ধতি ইসলাম বাতলে দিয়েছে, সালাফিজম মানুষকে সেই আদি ও অবিকৃত পদ্ধতির দিকে নিয়ে যেতে চায়।[13]

৪। হাদীসের বিশুদ্ধতা নিরূপণ: এটি অনস্বীকার্য বাস্তবতা যে, অধিকাংশ ইসলামী আন্দোলনে হাদীসের বিশুদ্ধতা যাচাইয়ের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে যে সচেতনতা তৈরি হয়েছে, তার পেছনে সালাফিজমের অবদান রয়েছে। এমনকি যারা সালাফিজমের বিরোধিতা করে, তারাও এখন তাদের বইয়ে হাদীস উল্লেখ করতে গিয়ে সুস্পষ্ট এবং হুবহু উদ্ধৃতি দেয় এবং ক্লাসিক্যাল ও মধ্যযুগের আলেমদের মতামত অনুযায়ী সেগুলো যাচাই করে। এটি অত্যন্ত ইতিবাচক একটি অবদান। শায়খ আলবানী ও তার লেখনীকে এ জন্য ক্রেডিট দেয়া যায়।

৫। মৌলিক জ্ঞান অর্জনে সাধারণ অনুসারীদের সচেতনতা: সাধারণভাবে তো বটেই, ইসলামের বিভিন্ন একাডেমিক শাখায়ও সামগ্রিকভাবে সচেতনতা বেড়েছে। উসূলে ফিকাহ, মুসতালাহাতুল হাদীস, উলুমুল কোরআনের মৌলিক বিষয় ইত্যাদি সম্পর্কে একজন সাধারণ সালাফীরও জানা থাকার কথা। এটা বলা বোধহয় অত্যুক্তি হবে না– অন্য ঘরানার সাধারণ অনুসারীদের চেয়ে সালাফিজমের একজন সাধারণ অনুসারী ইসলামের বিভিন্ন শাস্ত্রীয় শাখা সম্পর্কে তুলনামূলকভাবে বেশি সচেতন।

৬। বিশুদ্ধ আকীদা: সালাফীদের রয়েছে চমৎকার একটি বিশুদ্ধ আকীদা। যে কোনো নিরপেক্ষ গবেষক অনুসন্ধান করলে দেখবেন, আছারী আকীদা হচ্ছে সুন্নীদের আকীদার সবচেয়ে প্রাচীন সংকলন। এটি আশআরী ও মাতুরিদীদের কালামভিত্তিক আকীদারও আগের সংকলন।[14] হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষ দিক থেকে শুরু করে তৃতীয় শতাব্দীর শুরুর দিক পর্যন্ত এসব বিষয় নিয়ে কয়েক ডজন ধর্মীয় গ্রন্থ লেখা হয়েছে (এর কিছু কিছু ‘আকীদায়ে তাহাবী’রও আগে রচিত), যেগুলো এখনো বিদ্যমান। হিজরী চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীতে আছারী আকীদাই ছিলো সুন্নী ইসলামের প্রধান ধারা।[15] অবশ্য রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরিণতিতে ষষ্ঠ শতাব্দীতে এটি

শুধু হাম্বলী মাজহাবের মধ্যে সীমিত হয়ে পড়ে। তবে ইবনে তাইমিয়ার ক্ষুরধার লেখনীর ফলে এটি নতুন জীবন লাভ করে। সেই থেকে দিন দিন আছারী আকীদা শক্তিশালী হচ্ছে।[16]

৭। ইসলামী জ্ঞানের বিস্তার ও ইসলামী পাঠাগারের পুনরুজ্জীবন: ইসলামের সকল শাখার বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা করে হাজার হাজার কপি ছাপিয়ে বিতরণ করার ক্ষেত্রে সালাফিজমের ব্যাপক অবদান রয়েছে। এমনকি সালাফিজমের বিরোধীরাও সালাফী প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত বইগুলোর সহযোগিতা নিয়ে থাকে। একাডেমিশিয়ানরা তো প্রতিনিয়ত তাদের অনলাইন প্রকাশনা, ইলেক্ট্রনিক আর্কাইভ ও ফোরামগুলো থেকে উপকৃত হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বের যে কোনো ইসলামী পাঠাগারের বইপত্রের একটা বড় অংশ সালাফীদের দ্বারা সম্পাদিত ও মুদ্রিত। এর কারণ হলো, সালাফীদের নিকট ইসলামের ক্ল্যাসিকাল ট্র্যাডিশন খুব গুরুত্বপূর্ণ।

৮। শিরক ও বিদয়াত পরিহার: ভুলশুদ্ধ যাই হোক না কেন, সামগ্রিকভাবে সালাফী আন্দোলন বিভিন্ন ধরনের শিরক থেকে বেঁচে থাকতে পেরেছে এবং বিদয়াত সম্পর্কে চরম সতর্কতা তাদের জন্য সেফগার্ড হিসেবে কাজ করেছে। ফলে ইবাদতের ক্ষেত্রে তারা ঈর্ষনীয় বিশুদ্ধতা রক্ষা করতে পেরেছে। অতিরিক্ত সতর্কতা ক্ষেত্রবিশেষে বাড়াবাড়ি পর্যায়ের হলেও বিপথগামী হওয়া থেকে সালাফী আকীদাকে এটি রক্ষা করেছে। যদিও তাদের দৃষ্টিতে এই বাড়াবাড়ি মোটেও কোনো সমস্যা নয়।

এই সবকিছু মিলিয়ে সালাফী ধারা একটি গতিশীল আন্দোলন। যার লক্ষ্য হলো প্রত্যেক মুসলমানকে কোরআন ও সুন্নাহ সরাসরি অধ্যয়নের সুযোগ করে দেয়া। এভাবে একজন ব্যক্তি জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হয়ে কর্তৃত্ববাদকে চ্যালেঞ্জ করা, অন্ধ-আনুগত্যের ব্যাপারে প্রশ্ন তোলা এবং অতি রক্ষণশীল ধর্মীয় গুরুদের অসততা ও অনৈতিকতা রোধে ভূমিকা রাখতে পারে। তাই একটি মেথডলজি হিসেবে সালাফী মতবাদের প্রতি কোনো যুক্তিবাদী ও কৌতূহলী মানুষ আকৃষ্ট হলে এবং মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্যের কারণে এর সাথে একমত হলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

৩. সালাফী আন্দোলনের কিছু সমালোচনা

অন্য যে কোনো আন্দোলনে যেমনটা হয়, তেমনিভাবে সালাফী আন্দোলনও ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়। প্লেটোনিক ইউনিভার্সালের মতো মানুষের বাস্তব ও বোধগম্য জগতের বাইরে ‘সালাফিজম’ ধারণাটির কোনো বিমূর্ত রূপ নেই। যেহেতু মানুষ মাত্রই ভ্রান্তিপ্রবণ, সেহেতু ইসলামের প্রাথমিক যুগের সালফে সালেহীনদের অনুসরণের দাবিদার সালাফী আন্দোলনেরও কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি ও অসঙ্গতি রয়েছে।

‘সালাফ’ বলতে আসলে কী বুঝায়, এটি সহ আরো কিছু মৌলিক বিষয় তাদের নিকট অনেকটা অবহেলিত। এমনকি সাম্প্রতিককালের সালাফী গ্রুপগুলোর কাজকর্ম তাদের দ্বারা উপেক্ষিত এসব মৌলিক বিষয়ের শিক্ষার বিপরীত। উপরন্তু, সালাফগণ যেসব সমস্যার মুখোমুখি কখনোই হননি, সেসব সমসাময়িক বিষয়ে সালাফীদের মতামত প্রদানের প্রক্রিয়াটিই পদ্ধতিগতভাবে ত্রুটিপূর্ণ। জাতিরাষ্ট্রে নাগরিকত্বের ধারণা, গণতন্ত্র, সমকালীন পরিস্থিতিতে নারীদের ভূমিকা, ভোটপ্রদানের অধিকার এবং আধুনিক এই সময়ে জিহাদসহ প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন বিষয়ে সালাফীদের অবস্থান (অর্থাৎ, আধুনিক সালাফী আন্দোলনের কিছু আলেমের অবস্থান) নিছক একজন আলেমের ব্যক্তিগত মতামত (ফতোয়া) মাত্র। এসব মতামত ইসলামের প্রথম তিন যুগের সালফে সালেহীনদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধিত্ব করে না।

সালাফী আন্দোলনের সমালোচনাগুলোর একটি তালিকা দেয়ার আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ ডিসক্নেইমার দিয়ে রাখতে চাই। নিচে যে তালিকাটি দিয়েছি, কেউ হয়তো ব্যক্তিগত পর্যায়ে, কিংবা কোনো কোনো সালাফী ধারায় এসবের মোটামুটি ব্যতিক্রম অভিজ্ঞতা পেয়ে থাকতে পারেন। এর কারণ হলো, আমি বিষয়গুলো বিবেচনা করেছি সামগ্রিকভাবে। যদিও বুঝি, এ ধরনের সরলীকরণের কিছু সহজাত সমস্যা আছে। ইতোপূর্বে আমি সামগ্রিকভাবে সালাফী ধারার ইতিবাচক দিকগুলোর একটি তালিকা দিয়েছি। সে প্রসঙ্গে এখানে এটুকু বলে রাখি, তাদের যেসব নেতিবাচক দিকের কথা এখন বলবো, সেগুলো ইতিবাচক দিকগুলোর তুলনায় ততটা ব্যাপকতর নয়। এসব বিষয়ের উপর তারা সবিশেষ গুরুত্বারোপ করে, এমনও নয়।

যাহোক, আমার বক্তব্য হলো– এই সমালোচনাগুলো বেশিরভাগ সালাফী আন্দোলনের ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে প্রযোজ্য। যারা এর ব্যতিক্রম রয়েছেন, তারা নিজেদেরকে ব্যক্তিগতভাবে এই সমস্যা থেকে মুক্ত রাখতে পেরেছেন। অর্থাৎ, তারা সালাফী আন্দোলনকে পুরোপুরি গ্রহণ করেননি।

আরেকটা কথা আমাকে বলতেই হবে। সেটি হলো, এই সমালোচনামূলক তালিকা করার প্রাথমিক কারণ হলো, এর ফলে সালাফীরা হয়তো নিজেরাই নিজেদের ব্যাপারে ভাববে। এমনকি এসব সমস্যা যথাসম্ভব দূর করার জন্য হয়তো কাজও শুরু করবে। আমার আশা, এক পর্যায়ে এই সমস্যাগুলো ব্যতিক্রমে পরিণত হবে। যদিও এখন পর্যন্ত এইসব সমস্যা অধিকাংশ সালাফী ধারার মধ্যে ব্যাপকভাবে বিদ্যমান।

সালাফী আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য সমস্যাগুলো হলো:

১। জীবনবোধ ও আধ্যাত্মিকতা থেকে বিচ্ছিন্নতা: সালাফী আন্দোলন ইসলামের জীবনঘনিষ্ঠ মর্মবাণীকে মূলত একটি বিমূর্ত ও তাত্ত্বিক মতবাদে পরিণত করেছে। বিমূর্ত ধর্মতত্ত্ব ও মানবরচিত ধর্মবিশ্বাস, উভয়ই দিনশেষে ইসলামের প্রত্যেকটি দৃষ্টিভঙ্গিকে গৌণ করে ফেলে।

অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুর পরিবর্তে সালাফীরা সর্বদা অন্য মুসলমানদেরকে নানান ক্যাটাগরিতে ফেলতে ব্যস্ত থাকে। আছারী আকীদার উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলা। আল্লাহর নাম ও গুণাবলী সংক্রান্ত তাওহীদের ধারণা আলোচনা করতে গিয়ে আল্লাহর হাত আছে কিনা, বা আল্লাহর আরশ আসলে কেমন – এসব নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়া উচিত নয়। আল্লাহর নাম ও গুণসমূহ আলোচনার মৌলিক উদ্দেশ্যই তো হলো আল্লাহর স্মরণ বৃদ্ধি করা, তাঁর প্রতি ভক্তি বাড়ানো, সঠিক ও আন্তরিকভাবে তাঁর ইবাদত করা। এইসব সুন্দর সুন্দর নাম ও গুণাবলী যেসব কাজের দিকে ইঙ্গিত করে, সেগুলোর প্রতি অনুপ্রাণিত করাই তাওহীদের মূল কাজ। আকীদার ব্যাপারে সঠিক তাত্ত্বিক ধারণা থাকলেই শুধু ভালো মুসলমান হওয়া যায়, এমন ধারণা সঠিক নয়। আমাদের জেনে রাখা উচিত, একজন সাধারণ মুসলমানকে আল্লাহ ধর্মতত্ত্বের বিমূর্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন না। তিনি বরং ফরজ ইবাদতগুলো সে পালন করেছে কিনা এবং তার মধ্যে কী পরিমাণ আধ্যাত্মিকতা ছিলো, এটি দেখবেন।

২। আত্মার পরিশুদ্ধির ঘাটতি: তাজকিয়ায়ে নফস (আত্মার পরিশুদ্ধি) গ্রহণ করার ব্যাপারে ভিত্তিহীন দ্বিধাদ্বন্দ্ব এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির ব্যাপারে তাদের মাঝে আগ্রহের ঘাটতি রয়েছে। সামগ্রিক অর্থে সালাফী আন্দোলন যে তাজকিয়ায়ে নফস কিংবা আধ্যাত্মিকতার উপর যথাযথ গুরুত্ব দিতে ব্যর্থ হয়েছে, এটি অকাট্য বাস্তবতা। অথচ হাদীসে জিবরাইলের মূলকথা হলো তাজকিয়ায়ে নফস। এমনকি এটি আল-কোরআনেরও অন্যতম মর্মবাণী। এ ব্যাপারে কোনো বিতর্ক নেই। সালাফীরা আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধির মৌলিক প্রয়োজনীয়তার পরিবর্তে ‘জারাহ ওয়াত তাদীলের’ মতো উচ্চতর বিষয়ে অতিরিক্ত গুরুত্বারোপ করার কারণেই ‘সালাফী-বার্নআউট’ হওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। ‘সালাফী-বার্নআউট’ বলা হয় তাদেরকে, যারা সালাফী মতবাদ পরিত্যাগ করে অন্য কোনো ইসলামী ধারার অনুসরণ করে। এ ক্ষেত্রে তারা সাধারণত সুফিজমের দিকে ঝুঁকে পড়ে। সালাফিজমে তারা যেসব বিষয় থেকে ‘বঞ্চিত’ ছিলো, সুফিজমে এসে তারা সেগুলো খুঁজে পায়। আবার, কেউ কেউ ইসলামের প্র্যাকটিসই একদম ছেড়ে দেয়।

৩। কঠোরতা প্রদর্শন: নিজেদের বাইরে তারা অন্যদের ব্যাপারে কঠোরতা প্রদর্শন করে। দৃশ্যত নিজেদের নাজাতের ব্যাপারে তারা এক প্রকার নিশ্চয়তা বোধ করে।[17] এ ধরনের বিশ্বাস স্পষ্টতই সাধারণ সালাফীদেরকে উদ্ধত ও অহংকারী করে তোলে। এটি আমাদেরকে অনুরূপ চরিত্রের খারেজীদের কথা মনে করিয়ে দেয়। অবশ্য আমি সালাফীদেরকে খারেজী মনে করি না।

বিপথগামী ও বিপথগামিতা সম্পর্কেও সালাফী ধারার চিন্তাভাবনা স্ববিরোধী। যার ফলে কোনো কোনো সাধারণ সালাফী সঠিক বিশ্বাসের চেয়ে বিপথগামিতা সম্পর্কে বেশি জানে। মাদখালীরা হলো এর উপযুক্ত উদাহারণ। মাধখালী ধারার যে কোনো নওমুসলিম সালাফী মানহাজের একদল আলেমের নাম তোতা পাখির মতো মুখস্ত বলে দিতে পারবে। কিন্তু কয়েকজন সাহাবীর নাম বলতে তাদের খবর হয়ে যাবে। কোনো ‘ফাসেক’ ব্যক্তিকে সালাম দেয়ার মাসয়ালা সম্পর্কে তারা ‘জানলেও’ সকাল-সন্ধ্যা জিকির-আযকার করার ব্যাপারে গাফেল থেকে যায়। দুঃখজনকভাবে এটি শুধু মাদখালীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তাই সালাফী আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের আত্মজিজ্ঞাসা থাকা উচিত: ইসলাম মানে কি খেয়ে না খেয়ে অন্যদের দোষত্রুটি বের করা? নাকি সমাজে কল্যাণ প্রতিষ্ঠার একটি রোল মডেল হয়ে ওঠা? “ভাগ্যবান হলো সেই ব্যক্তি, যে অন্যের দোষত্রুটি ধরার পরিবর্তে নিজের দোষত্রুটির সংশোধন নিয়ে ব্যস্ত থাকে” (মুসনাদে বাযার)।

৪। বিদয়াতের ব্যাপারে বাড়াবাড়িমূলক অবস্থান: বিদয়াত ও বিদয়াতকারীদের ব্যাপারে বেশিরভাগ সালাফী ধারার অবস্থান অনেক বেশি কট্টর। এ বিষয়ে বাড়াবাড়ির ফলে অন্য মুসলমানদের নিকট তারা হাসির পাত্রে পরিণত হয়েছে। মসজিদে কাতারভিত্তিক কার্পেট বিছানোকে বিদয়াত (!) হিসেবে গণ্য করে। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের কারণে সাধারণ মুসলমানরা তাদেরকে অতি-অক্ষরবাদী হিসেবে বিবেচনা করে।

সাধারণ ‘ফাসেক’ ব্যক্তিদের ব্যাপারে তাদের নীতি প্রশ্নসাপেক্ষ। ভ্রান্ত গোষ্ঠীসমূহের ব্যাপারে সালাফদের বক্তব্যকে সালাফীরা এমনভাবে গ্রহণ করে, যেন এগুলো কোরআন-হাদীসেরই কথা। বিদয়াতকারীদের প্রতি সালাফদের কোনো কোনো বক্তব্যকে অবশ্যই কোরআন-হাদীস ও তৎকালীন পরিস্থিতির আলোকে বিবেচনা করতে হবে। বিশেষ কোনো আলেমের বক্তব্যের চেয়ে ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধের অধিকার (যার রূপরেখা মহানবী (সা) দিয়ে গেছেন) বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর সত্যবিরোধীদের ব্যাপারে গ্রহণযোগ্য অবস্থান কী হবে, তা নির্ভর করবে স্থান, কাল, ব্যক্তি, সংশ্লিষ্ট বিচ্যুতি ও পরিস্থিতির উপর। ইসলাম একতরফাভাবে মানুষকে দোষী সাব্যস্ত করতে চায় না।

সালাফদের মতামতকে বুঝতে হবে তাদের ইজতিহাদ, তৎকালীন পরিস্থিতিতে এর ন্যায্যতা ও প্রয়োগযোগ্যতা যাচাই সাপেক্ষে। আধুনিক সালাফীদেরকে বুঝতে হবে একবিংশ শতাব্দীর আমেরিকা (কিংবা, ইংল্যান্ড – এবং হ্যাঁ, বার্মিংহাম শহরও!) সপ্তম শতাব্দীর বাগদাদ নয়। ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধ রক্ষা করার জন্য কোরআন-হাদীসের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও এর পরিবর্তে সালাফদের ফতোয়ার অপব্যহার করা অবিবেচনাপ্রসূত এবং ইসলামী মূলনীতির খেলাফ। বিভিন্ন কমিউনিটির মধ্যে বিভাজন তৈরি করা, বিশেষ কোনো গোষ্ঠীকে চোখ বুজে তাকফীর করা এবং তাদের সাথে যারাই দ্বিমত পোষণ করে, তাদের থেকে নিজেদেরকে আলাদা রাখার ব্যাপারে সালাফীদের বদনাম রয়েছে। এটি দুঃখজনক একটি বাস্তবতা।

৫. অগ্রাধিকার নির্ণয়ে বিভ্রান্তি: মহানবী মোহাম্মদ (সা) বলেছেন, “সেটিকেই গুরুত্ব দাও, যা তোমার জন্য উপকারী!” কোনো কোনো সালাফীর নিকট ‘ডেভিয়েন্টদেরকে’ খারিজ করাই যেন সফলতা। মানুষকে খারিজ করা সংক্রান্ত লেখাজোকা, ‘ডেভিয়েন্টদের’ সংশ্রব থেকে দূরে থাকার সতর্কবার্তা এবং মানুষকে সংশোধন করতে গিয়ে অত্যন্ত কর্কশ ও অশোভন ভাষা ব্যবহার করে তারা মজা পায়।

উম্মাহ এখন যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে, তার সাথে আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর ভুল ব্যাখ্যা কিংবা মিলাদ পালনের বৈধতার সম্পর্ক নেই।[18] হ্যাঁ, মিলাদ, আল্লাহর গুণাবলী কিংবা ঈমানের অন্যান্য বিষয় নিয়ে কিছু মানুষকে একটা পর্যায় পর্যন্ত কথাবার্তা বলতে হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এগুলো আমাদের সময়ের মূল সমস্যা নয়। এমনকি আমাদের তরুণ-তরুণীরা ঈমান নিয়ে যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে, এগুলো তাও নয়। অথচ এসব বিষয় নিয়ে যুগ যুগ ধরে বিতর্ক চলে আসছে। সালাফী ও আশআরীগণ চাইলে নিজেদের মধ্যে এসব বিষয় নিয়ে বিতর্কে বসতে পারেন। একজন ধর্মতাত্ত্বিক হিসেবে আমিও উপযুক্ত ফোরাম ও শ্রোতা সাপেক্ষে এ ধরনের বিতর্কের মজলিশে অংশগ্রহণের সুযোগ পেলে কৃতার্থবোধ করবো। কিন্তু আমাদের তরুণ প্রজন্ম সাধারণত এ ধরনের অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য ধর্মতাত্ত্বিক আলোচনার খুব একটা ধার ধারে না। তারা বরং তাদের ধর্মে বিশ্বাস বজায় রাখা নিয়ে সংকট মোকাবেলা করছে। ডারউইনবাদ, সেক্যুলারিজম, উত্তরাধুনিকতাবাদ, মানবতাবাদ, উদারতাবাদ এবং এ ধরনের শত শত মতবাদ তাদের বিশ্বাসের ভিত্তিকে নাড়িয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে, সালাফীরা (একইসাথে দেওবন্দী, আশআরী এবং সুফীরাও) নিজেদের সার্কেলে এখনো যেসব বিষয় নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত, সেগুলো মাত্র ০.১ % লোকের আগ্রহের বিষয়।

এই মুহূর্তে কট্টর সেক্যুলারিজমের নজিরবিহীন মতাদর্শিক আক্রমণ ইসলাম মোকাবেলা করছে। এসব আক্রমণ সাধারণত ধর্মকে, বিশেষত ইসলামকে, আধুনিক সমাজে অবজ্ঞার পাত্রে পরিণত করেছে। নব্য নাস্তিক্যবাদ ও সেক্যুলারিজম দিন দিন পাবলিক ইন্টেলেকচুয়্যালদের ফ্যাশনে পরিণত হচ্ছে। আধুনিক সংস্কৃতি এখন বস্তুবাদ, আত্মসুখবাদ, পর্নোগ্রাফি এবং যৌন নিপীড়নের বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে। এর সাথে যোগ হয়েছে উগ্র নারীবাদের মতো কট্টর সব মতাদর্শ। একটা কথা সোজাসুজিই বলি– নিছক খারিজ করা ব্যতীত এসব ইস্যু নিয়ে কথা বলার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন একজন সালাফী আলেম খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। আর যদি কোনো আলেমকে পাওয়া যায়ই, তাহলে তাঁর এই যোগ্যতার পেছনে সালাফী প্রশিক্ষণের কোনো ভূমিকা নেই। বরং সালাফী প্রশিক্ষণের বাইরে ব্যক্তিগতভাবে তিনি এসব চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে সক্ষম বলেই তা পেরেছেন।

যুগ যুগ ধরে বিদ্যমান যে সকল সামাজিক সমস্যা দূর করার উদ্দেশ্য ইসলামের আগমন ঘটেছিলো, সেসব সমস্যা নিজেই এখন ‘মুসলিম বিশ্বে’ মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। ক্রমবর্ধমান সামাজিক সমস্যা, পারিবারিক ও যৌন নিপীড়ন, শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘন, ঘুষ ইত্যাদি দিন দিন ব্যাপকতা লাভ করা সত্ত্বেও এসব সমস্যা নিয়ে কথাবার্তা বলা হয় না। যে সমাজের সর্বত্র বিদেশী শ্রমিকদের সাথে চরম দুর্ব্যবহার ও শোষণ করা হয়, নারী গৃহকর্মীদের উপর যৌন নিপীড়ন চালানো হয়, ঘুষ ও দালালচক্র ব্যাপকভাবে সক্রিয়, আরো সব নেতিবাচক প্রবণতা সমাজে বিদ্যমান; সেখানে এসব বাদ দিয়ে নারীদের ড্রাইভিংয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য নিজের ব্যক্তিগত মতামতকে আবেগপূর্ণভাবে প্রচার করা, কিংবা দিনরাত মিলাদ উদযাপনের সমালোচনা করা আলেমদের জন্য অমার্জনীয় অপরাধ।[19]

আমাদের প্রতি প্রিয় নবীর (সা) সর্বশেষ আহ্বান ছিলো সমাজের সবচেয়ে দুর্বল সদস্যদের অধিকারগুলো পূরণ করা সংক্রান্ত। তাই যে আন্দোলন স্বপ্রণোদিত হয়ে নিপীড়িত মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলে না, তাদের অবস্থান নবীজির (সা) সুন্নত থেকে অনেক দূরে।

৬. নারীদের ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব: আধুনিক সালাফী আন্দোলন মোটের উপর নারীদেরকে এমন এক সত্তা হিসেবে তুলে ধরে, যাকে অমানবিক বললেই সম্ভবত সঠিক বলা হবে। এই বাস্তবতার একটি সহজ উদাহরণ হলো– নিজ স্ত্রীর নাম বা সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর স্ত্রীর নাম উচ্চারণ করাকে পর্যন্ত আপত্তিকর মনে করা হয়।[20] একজন নারীর নাম উচ্চারণ করাকেই যদি নিষিদ্ধ মনে করা হয়, তাহলে সমাজে আদতে নারীদের ভূমিকা কী? অথচ উগ্র নারীবাদী ব্যাখ্যার বিপরীতে ইসলামের প্রকৃত বাস্তবতা ব্যাখ্যা করতে সক্ষম স্পষ্টভাষী ও বুদ্ধিমান বোনদেরকে মুসলিম সমাজের প্রয়োজন।

নারীদের প্রতি এই দৃষ্টিভঙ্গি শুধু কথাবার্তায় সীমাবদ্ধ নয়; সৌদি নারীদের তো গাড়ি চালাতে পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অবিশ্বাস্য ব্যাপার হলো, সৌদি ধর্মীয় নেতাদের বেশিরভাগই এখন পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞাকে ধর্মের অংশ বলে মনে করেন। দুঃখজনক বিষয় হলো, পাশ্চাত্য সালাফিজমের কিছু অংশ একের পর এক বিবাহ ও তালাক প্রদানের জন্য কুখ্যাতি অর্জন করেছে, সিঙ্গেল মায়েদের সংখ্যা বাড়ছে, শিশুরা পরিত্যক্ত হচ্ছে এবং ব্যভিচার বেড়েই চলছে। এ বিষয়ে ভুল বুঝাবুঝি এড়ানোর জন্য আমার পরিষ্কার কথা হচ্ছে– এরা আমেরিকান ও ব্রিটিশ সালাফিদের মাঝে ক্ষুদ্র একটি অংশ। অথচ এটি এমন এক বাস্তবতা, যাকে কোনো ধর্মীয় নেতাই ইসলামের দিক থেকে ন্যায্যতা দিতে পারেন না। কিন্তু এই আলামত এত স্বাভাবিক হয়ে পড়ছে, যা উপেক্ষা করা যায় না। নারীদের ব্যাপারে সালাফীদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং সঠিক তরবিয়তের অভাবই যে এই সমস্যার মূল কারণ, তা পরিষ্কার।

৭. সকল বিষয়ে চূড়ান্ত মতামত প্রদানকারী ‘মুরুব্বী আলেমদের’ একটি গ্রুপের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য: স্বাধীনভাবে চিন্তাভাবনা করা ও অন্ধ-আনুগত্য পরিহার করার দাবিদার আন্দোলনটির বেশিরভাগই সেক্টেরিয়ান ও ‘কিবার’ তথা মুরুব্বী আলেমদের অনুসরণ করার ব্যাপারে অত্যন্ত গোঁড়া দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা অত্যন্ত দুঃখজনক। বাস্তবতা হলো এই ‘কিবারগণ’ সাধারণত একটি বিশেষ জাতীয়তা ও সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত। কোনো সুস্থ আলোচনায় তাদের অংশগ্রহণ অত্যন্ত বিরল। অথচ ইসলাম, কিংবা আছারী আকীদার জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট মানবীয় কর্তৃপক্ষ হতে পারে না, যারা ঐশী প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত। ফলত একদল আলেমের সাথে দ্বিমত করা, তাঁরা যত সিনিয়রই হোন না কেন, কোনোভাবেই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা) সাথে দ্বিমত করার সমতুল্য নয়।

মহানবী (সা) বলেছেন, “আলেমরা হলো নবীর উত্তরসূরী।” আল্লাহ মাফ করুন, স্বয়ং ইসলামিক স্কলারশিপের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আমি তর্ক করছি না। অনেক জ্ঞানীগুণী কোনো আলেমকে কোনো তুচ্ছ তালেবে ইলম শর্তহীনভাবে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়তে পারবে, তেমনটিও আমি বলছি না। বরং আপত্তির বিষয় হলো– একটি নির্দিষ্ট, সমমনা ও একই জাতীয়তার আলেমদেরকেই শুধু আলেম মনে করার ব্যাপারটি। অথচ সকল নৃগোষ্ঠীর মধ্যেই ইসলামের অসংখ্য আলেম রয়েছেন। প্রত্যেক আলেমের ইজতিহাদ থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য সালাফীদের যথেষ্ট উদার মনমানসিকতা থাকা উচিত।

সালাফীদের এটা মনে রাখা উচিত, ইবনে তাইমিয়ার জীবদ্দশায় তাঁর সমালোচকদের মধ্যে যারা সবচেয়ে বেশি সরব ছিলেন, তারা তাঁরই অনুসৃত হাম্বলী মাজহাবের আলেম ছিলেন (অর্থাৎ, তারা ছিলেন অষ্টম শতাব্দীর দামেস্কের ‘কিবার’)। কেন তিনি প্রচলিত শিক্ষাদান পদ্ধতি ও লেখার ধরনের পরিবর্তন করতে চাচ্ছিলেন, এসব আলেমগণ তখন তা বুঝতে পারতেন না।

৮. আধুনিক রাজনৈতিক ব্যাপারগুলো বুঝার নিদারুণ অক্ষমতা: ইবনে তাইমিয়াকে সরাসরি অধ্যয়ন করলে দেখা যায়, তিনি তৎকালীন শাসকদেরকে নিয়মিতই প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ করতেন। আর এখন তাঁকে অনুসরণের দাবিদাররা কীভাবে বর্তমান শাসকদের প্রতি চরম অনুগত ও নতজানু হয়ে থাকে, যেখানে এই শাসকদের অপরাধগুলো ইবনে তাইমিয়ার সময়ের যে কোনো শাসকের চেয়ে বহুগুণ বেশি!

আলেমদের উচিত বর্তমান শাসকদের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধের ডাক দেয়া, এমনটি আমি বলছি না। আমার কথা হলো, মাঝামাঝি একটি অবস্থান গ্রহণ করা জরুরি, যেন শাসকদের দৃশ্যমান অন্যায়গুলোর প্রকাশ্য সমালোচনা করা যায়। ইসলামের দাবি হলো, আলেমগণ সব সময় শাসকদেরকে ক্ষমতার অপব্যবহার করা থেকে সংযত রাখবেন। এর অন্য কোনো বিকল্প নেই। অথচ অধিকাংশ সৌদি সালাফী বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর যে কোনো ধরনের সমালোচনা করাকে ধর্মীয় বিচ্যুতির সমতুল্য বলে মনে করে। এই লেখাটি আমি যখন লিখছি, ঠিক তখন এসব অঞ্চলের শাসকগোষ্ঠী মুসলিম ব্রাদারহুড ও এর সমর্থকদের ব্যাপারে জুলুমের পন্থা বেছে নিয়েছে। এসব সুস্পষ্ট অন্যায়ের ব্যাপারে সালাফী আলেমদের নিরবতা দেখে মনে হয় যেন তারা বধির হয়ে গেছে। মিশরীয় সালাফীদের মূলধারার প্রতিনিধি নূর পার্টির কথাই বলা যাক। তারা হলো স্বৈরশাসক সিসির একনিষ্ঠ সমর্থক। যা শুধু দুঃখজনক ব্যাপারই নয়, বরং এই সমর্থন সিসির শাসনকে এক ধরনের বৈধতা প্রদান করেছে। এই ধরনের অন্যায় অবস্থানের তালিকা করতে থাকলে সংখ্যাটি শুধু বাড়বেই।

৪. উপসংহার

রশিদ রিদা (মৃ. ১৯৩৫) হলেন প্রথম আলেম, যিনি তার পরিচালিত আন্দোলনের পরিচয় তুলে ধরতে সর্বপ্রথম ‘সালাফী’ পরিভাষাটি জনপ্রিয় করে তোলেন। সেই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিলো মাজহাবের অন্ধ অনুসরণকে প্রত্যাখ্যান করা এবং ফিকাহ ও আধুনিকতার সমন্বয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করা। এ কারণে তখনকার সালাফী আন্দোলন ছিলো তুলনামূলকভাবে উদারপন্থার অনুসারী। একজন উদীয়মান তরুণ আলেম আলবানী একদিন রশিদ রিদার একটি নিবন্ধ পড়লেন। সেখান থেকে তিনি ‘সালাফী’ পরিভাষাটি গ্রহণ করেন এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন আরেকটি আন্দোলনকে বুঝাতে এটি ব্যবহার করেন। মজার ব্যাপার হলো, রশিদ রিদার আন্দোলন ক্রমেই মডার্নিস্ট ইসলামে পরিণত হয় এবং এক পর্যায়ে ‘সালাফী’ লেবেল পরিত্যাগ করে। অন্যদিকে, আলবানী সমর্থিত লিগ্যাল মেথডলজি পন্থীরা (ইসলাম সম্পর্কে রশিদ রিদার চিন্তার সাথে যাদের মিল খুব কম) ‘সালাফী’ লেবেল আঁকড়ে ধরে।

এরই ধারাবাহিকতায় আলবানী কর্তৃক গৃহীত এই লেবেল নজদীপন্থীরাও গ্রহণ করে। তারপর একে একে এই আন্দোলনের অন্যান্য ধারার মাঝেও পরিভাষাটি ছড়িয়ে পড়ে। অন্যথায়, এই শতাব্দীর আগে ‘সালাফী’ পরিভাষাটি একটি কমন লেবেল ও প্রপার নাউন হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার কথা ছিলো না।[21] তাই বলা যায়, ‘সালাফী’ পরিভাষাটি এমন একটি আধুনিক পরিভাষা, যা নিজেকে আছারী আকীদার মতো একটি প্রাচীন ধর্মীয় গোষ্ঠীর সাথে সংযুক্ত করেছে।

আমি মনে করি, ইসলামের অন্য সকল আন্দোলনের মতো সালাফী আন্দোলনও কিছু মানুষের গড়ে তোলা একটি আন্দোলন, যার মধ্যে ভালো-মন্দ দুটি দিকই আছে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের নিকট ‘সালাফী আন্দোলন’ নাজিল করেননি। তিনি বরং কোরআন নাজিল করেছেন এবং একজন রাসূল (সা) পাঠিয়েছেন। সালাফী আন্দোলন যেহেতু মানুষের অংশগ্রহণে গড়ে ওঠা একটি আন্দোলন, তাই এর ভুলত্রুটি মূলত মানুষেরই ত্রুটিবিচ্যুতি। এই বিষয়টি থেকেই বুঝা যায়, কেন ‘একক’ কোনো সালাফী আন্দোলন নেই। এর পরিবর্তে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন স্বতন্ত্র উপধারাসমূহের সমষ্টি হলো সালাফিজম। আমি মনে করি, নির্দিষ্ট একটি আন্দোলন ইসলামের একক ও যথার্থ বুঝজ্ঞান থাকার দাবি করতে পারে না। তবে বিশেষ কিছু বিষয়ে বিশেষ কোনো আন্দোলন অন্যদের চেয়ে সত্যের অধিক নিকটবর্তী হতে পারে। মনে রাখতে হবে, প্রতিটি আন্দোলনই মানবীয়। তাই কেউই ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়। আমি আবারো বলছি, হকের ব্যাপারে কোনো নির্দিষ্ট দল, গোষ্ঠী বা ধর্মতত্ত্বের একচেটিয়া অধিকার থাকতে পারে না।

সামগ্রিক দৃষ্টিতে সালাফী আন্দোলনের চমৎকার কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেগুলো বজায় রাখার ব্যাপারে তারা সচেষ্ট। তবে এর পাশাপাশি আন্দোলনটির কিছু ত্রুটিবিচ্যুতিও উপেক্ষা করার মতো নয়। কেউ হয়তো জানতে চাইতে পারে, “নেতিবাচক বিষয়গুলো পরিহার করে এবং ইতিবাচক বিষয়গুলো বজায় রেখে সালাফী আন্দোলনকে সুন্দরভাবে পরিচালিত করা কি সম্ভব নয়?” অবশ্যই সম্ভব। এই আন্দোলনের সাথে সম্পর্কিত অনেকে এই কাজটিই করতে চান। সালাফিজম কিংবা ইসলামের অন্যান্য ধারার এ ধরনের অভ্যন্তরীণ প্রচেষ্টাকে আমি সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সাথে সমর্থন করি। যা হোক, প্রশ্ন হলো: উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পদ্ধতিগত ভুল থাকা থাকা সত্ত্বেও, ‘সালাফী’ লেবেলটির সাথে নানান নেতিবাচকতা সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়লেও এবং ‘সালাফী’ পরিভাষাটি দিয়ে প্রকৃতপক্ষে যা বুঝাতে চাওয়া হয়েছিলো, তার কোনো প্রতিফলনই এতে না থাকা সত্ত্বেও কেন কেউ এর সাথে নিজেকে জড়াবে? বিশেষ করে যখন কেউ বুঝতে পারে যে, এই লেবেলটির স্বয়ং কোনো ধর্মীয় মাহাত্ম্য নেই। বাস্তবতা হলো ইসলামের সুদীর্ঘ ইতিহাসের নিরীখে একেবারে সাম্প্রতিককালে এটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে।

এসব কারণেই পূর্ববর্তী সেকশনে আলোচিত সালাফী ধারাগুলোর কোনো ধারার সাথেই আমি নিজেকে আর সংশ্লিষ্ট রাখি না। তবে যারা তারপরও নিজেকে এর সাথে সংশ্লিষ্ট রাখতে চায় তাদের জন্য আমার পরামর্শ হলো: তারা যেন সালাফীদের ভুলত্রুটি সংক্রান্ত উপর্যুক্ত পর্যালোচনাটি বিবেচনায় নিয়ে আত্মসংশোধনের কাজে ব্রতী হয়। আর কেউ এই পরিচয় ত্যাগ করতে চাইলে, সে ব্যাপারে তার পূর্ণ অধিকার তো রয়েছেই। অন্য যে কোনো লেবেল বা পরিচয়ের তুলনায় শুধুমাত্র ‘ইসলাম’ পরিচয়ই অনেক বেশি প্রশস্ত।

বিগত দুই দশক লাগাতার গবেষণার পর আমি আছারী আকীদা গ্রহণ করেছি। আমি মনে করি, এটি সবচেয়ে নিরাপদ ও সবচেয়ে বিশুদ্ধ আকীদা। ইসলাম নিছক কতগুলো গৎবাঁধা বিশ্বাসের চেয়েও বেশি কিছু। আমার চূড়ান্ত আনুগত্য মানুষের তৈরি কোনো আকীদার প্রতি নয়। বরং আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের (সা) প্রতি। তারপর খাঁটি ঈমানদার ও তাকওয়াবানদের প্রতি। তাই, আমি একজন মধ্যপন্থী-দেওবন্দী-তাবলীগী-মাতুরিদীর সাথে তুলনামূলকভাবে বেশি মিল পাই ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন অনুভব করি। এই ধারার কোনো ব্যক্তি ফিকাহ, ধর্মতত্ত্ব ও পদ্ধতিগত জায়গা থেকে আমার সাথে দ্বিমত পোষণ করা সত্ত্বেও তার ধার্মিকতা ও উম্মাহর জন্য চিন্তাভাবনার সাথে আমি নিজেকে রিলেট করতে পারি। অন্যদিকে, একজন হার্ডকোর সালাফীর একমাত্র চিন্তা হলো আমার প্যান্টের দৈর্ঘ্য এবং তার দেখা মতে, আমার কথাবার্তায় ‘কিবারদের’ উদ্ধৃতি না থাকা নিয়ে।

এছাড়া কোনো মধ্যপন্থী সুফীর দৃষ্টিতে আমি তার মতোই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা) প্রতি বিশ্বাসী, যদিও কিছু ছোটখাটো মতপার্থক্য রয়েছে। কিন্তু একজন স্ট্যান্ডার্ড গোঁড়া সালাফী পূর্বধারণার বশবর্তী হয়ে শুরুতেই আমাকে একটা ছঁকে ফেলে দেবে এবং তারপর আমার ব্যাপারে তার একমাত্র কাজ হবে ‘আমার বিরুদ্ধে সাবধান করা’। আল্লাহ নিশ্চয় তাঁর মতো করেই আরশে সমুন্নত রয়েছেন (ইসতাওয়া আলাল আরশ) – এই ব্যাপারে একজন হার্ডকোর সালাফীর সাথে আমি হয়তোবা একমত হতে পারবো; কিন্তু উম্মাহর বর্তমান সমস্যাগুলো সম্পর্কে  তাদের সংকীর্ণতাসুলভ অদূরদর্শিতা, স্বীয় ধার্মিকতার দম্ভ এবং কাল্ট মানসিকতা আমার বিরক্তির কারণ। সামগ্রিকভাবে উম্মাহর জন্যও এসব ক্ষতিকর। তাই, কথায় কথায় আকীদার প্রসঙ্গ তোলা ও ‘পথভ্রষ্টদের’ খারিজ করা ছাড়া যেসব ফ্যানাটিক সালাফীর আর কোনো ধার্মিকতা চোখে পড়ে না; তার থেকে বরং আমি এমন একজন মধ্যপন্থী সুফীর সাথে বেশি একাত্মবোধ করবো, যিনি আমার চেয়ে বেশি কোরআন পড়েন এবং হালাল উপার্জন সম্পর্কে আমার চেয়ে বেশি সচেতন থাকেন। এর মানে আবার সুফি ব্যক্তিটি তার ধর্মতাত্ত্বিকভাবে ‘সঠিক’ অবস্থানে রয়েছেন, তা নয়। দুই-চারটা মত-দ্বিমতের চাইতে ইসলাম ও ইসলামী চেতনা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

সর্বশেষ কথা: সালাফিজমের সাথে যাদের দীর্ঘদিনের শত্রুতা রয়েছে, তারা এর বিপক্ষে এই প্রবন্ধটিকে ব্যবহার করবে, এটি সহজেই অনুমেয়। প্রগতিশীল ও আধুনিকতাবাদী থেকে শুরু করে শিয়া, সুফী এবং আশআরী ধারাসহ ইসলামের সকল ধারার ক্ষেত্রেই এমনটি ঘটে। বাস্তবতা হলো, আমার মতো কেউ যদি একটি নির্দিষ্ট সময় কোনো আন্দোলনে যুক্ত থাকে, তারপর এর ভুলত্রুটিগুলো ধরিয়ে দেয়, তখন স্বভাবতই অন্যান্য গ্রুপগুলো উল্লসিত হয়ে ওঠে। এই ক্ষেত্রে তাদের স্মরণ রাখা দরকার– আমার আকীদাগত অবস্থান দুই দশক আগে যা ছিলো, এখনো তাই আছে। আপনাদের আন্দোলনগুলোও সালাফিজমের মতো নিছক কিছু মানুষের গড়ে তোলা আন্দোলনই মাত্র।

অন্যভাবে বললে– আমি মনে করি, ইসলামের অনুসারী প্রতিটি আন্দোলনই মানুষের গড়া আন্দোলন। যার কারণে এসব আন্দোলনে ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিকই থাকে। কোনো আন্দোলন হয়তো অন্যদের চেয়ে কোনো কোনো দিক থেকে রাসূলের (সা) সুন্নাহর অধিক নিকটবর্তী। কিন্তু কোনো আন্দোলনই নিজেদেরকে সুন্নতে রাসূলুল্লাহর (সা) একমাত্র প্রতিনিধি, কিংবা এই পৃথিবীতে আল্লাহর মনোনীত দ্বীনের সোল এজেন্ট দাবি করতে পারে না। এসব আন্দোলনের মধ্যে সালাফী আন্দোলন আকীদার ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদান রেখেছে, এটি ঠিক। কিন্তু এই কারণে তাদেরকে ইসলামের সকল বিষয়ে সর্বেসর্বা বলা যায় না। আমাদের উচিত তাদের ভালো কাজগুলো গ্রহণ করা এবং সম্ভব হলে ভদ্রতা ও প্রাজ্ঞতার সাথে তাদের ভুলত্রুটিগুলো সংশোধন করে দেয়া। আন্দোলনের ভেতর থেকে যিনি বা যারাই সংস্কার সাধন করতে চান, তিনি বা তাদের জন্য আমার দোয়া ও পরামর্শ থাকবে। প্রত্যেকেরই যার যার মতো নিজস্ব অবস্থান ও কর্মপদ্ধতি রয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে বৃহত্তর উম্মাহর খেদমতে নিজেকে নিয়োজিত করাকে অধিক কল্যাণকর বলে মনে করছি।

ডিসক্লেইমার: আমার গড়ে ওঠার পেছনে যে আন্দোলনের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে, যে আন্দোলনের আলেমদের নিকট থেকে আমি উপকৃত হয়েছি, সে আন্দোলনটির প্রতি আমি অবশ্যই সর্বদা সম্মান বজায় রাখবো। তাদের পদ্ধতিগত কিছু বিষয়ে দ্বিমত করলেও আমি আন্তরিকভাবেই তাদের প্রশংসা করি। তাই কেউ যদি মনে করে, এই নিবন্ধের কোথাও অযৌক্তিক কঠোরতা প্রকাশ পেয়েছে, তাহলে আমি আন্তরিক ক্ষমাপ্রার্থী। কারণ, অপমান বা কুৎসা রটনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার কথা যদি কঠোর লাগে, তাহলে এর কারণ বোধহয় এটি– যে আন্দোলন উম্মাহর সালাফদের অনুসারী বলে নিজেকে দাবি করেছিলো, তাদের কাছে আমার প্রত্যাশা ছিলো আরো বেশি। কিন্তু তারা তাদের মহৎ লক্ষ্য থেকে অনেকখানি বিচ্যুত হয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে আমার আন্তরিক চাওয়া হলো– সব ঘরানার ইসলামী আন্দোলন, বিশেষ করে সালাফী আন্দোলন, আমাদের দ্বীনের নীতিমালাসমূহকে শুদ্ধভাবে তুলে ধরবে।

সালাফী হই কিংবা না হই, ঈমানদার হিসেবে আমরা প্রত্যেকেই আমাদের সবটুকু বুঝজ্ঞান, সামর্থ্য, আমাদের কণ্ঠস্বরের সবটুকু ক্ষমতা এবং সকল রিসোর্সকে কাজে লাগিয়ে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিয়োজিত। যেহেতু আমরা জানি– আল্লাহর কথাই হলো চূড়ান্ত এবং তাঁর রাসূলের (সা) দেখানো পথই হলো একমাত্র সঠিক পথ।

সমালোচকদের প্রতি: এই নিবন্ধ থেকে বিচ্ছিন্নভাবে একটি বাক্যের উদ্ধৃতি দিয়ে সেটিকেই আমার সম্পূর্ণ মতামত হিসেবে চিত্রিত করা ইসলামসম্মত কাজ নয়। প্রেক্ষাপট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একে বিবেচনা না করলে এমনকি কোরআন ও সুন্নাহকে পর্যন্ত সহজেই ভুল বুঝা সম্ভব। দ্বিমত করুন নির্দ্বিধায়; তবে দয়া করে পুরো নিবন্ধের লিংক উল্লেখ করবেন এবং পাঠকরা যেন পুরো নিবন্ধটি পড়ে নিজেরাই আমার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে জানতে পারে, সেই সুযোগ দেবেন। সালাফী  আন্দোলনের সমালোচনার পাশাপাশি যেসব প্রশংসা করেছি এবং সর্বশেষ যে ডিসক্লেইমার দিয়েছি, দয়া করে সেগুলোও বিবেচনায় রাখবেন।

[মূল: ড. ইয়াসির ক্বাদী, অনুবাদ: মাসউদুল আলম]

*****

নোট:

[1] সিদ্দিক হাসান খান ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের আহলে হাদীস আন্দোলনের অনুপ্রেরণা।

[2] একজন সাধারণ ব্যক্তির পক্ষে ধর্মীয় মতামতগুলো (তারজীহ) থেকে সঠিকটা বেছে নিতে বাধ্য করা হিতে বিপরীত হতে পারে। কারণ, এ ধরনের বিষয়ে এনগেজ হওয়ার জন্য একেবারে প্রাথমিক বিষয়গুলো জানার ঘাটতিও তার রয়েছে।

[3] ‘ওয়াহাবী’ শব্দটিকে একটি গালি হিসেবে সালাফী আন্দোলনের সমালোচকরা প্রায়শ ব্যবহার করে থাকে। এটি মর্যাদাহানিকর। তাই এই নিবন্ধে শব্দটি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। তাছাড়া, আল্লাহ তায়ালার একটি নাম (আল-ওয়াহহাব) থেকে কোনো অবমাননাকর শব্দচয়ন করা মুসলমানদের জন্য উচিত নয়।

[4] এই বক্তব্য তখন প্রচণ্ড বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলো। বিশেষ করে সাহওয়াপন্থী আলেম শায়খ সফর আল-হাওয়ালী যখন আলবানীর বক্তব্যের বিরোধিতা করে ‘যাহিরাতুল ইরজা’ শিরোনামে বই লিখেন, তখন বিতর্ক তুঙ্গে ওঠে। আলবানী মুরজিয়াদের (ইসলামের প্রাথমিক যুগের একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী, যারা আমলকে ঈমানের অংশ মনে করতো না) মতামতের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন বলে এই বইয়ে তিনি অভিযোগ করেন। এই ঘটনা তখন দুটি সালাফী গ্রুপের সম্পর্কের মধ্যে মারাত্মক ফাটল ধরায়। একটি হলো সৌদিভিত্তিক মূলধারার সালাফী গ্রুপ, অপরটি জর্ডানভিত্তিক শায়খ আলবানীর নেতৃত্বাধীন গ্রুপ। এখন পর্যন্ত এই দ্বন্দ্বের অবসান না ঘটলেও তাদের মধ্যে আগের মতো বৈরিতা আর নেই।

‘সাহওয়া’ শব্দটির মানে হলো রেনেসাঁ বা পুনর্জাগরণ। ৯০ দশকের প্রথম দিকে উত্তেজনাপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা এবং প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের প্রেক্ষিতে সৌদি সালাফীদের সক্রিয় রাজনৈতিক অবস্থানকে বুঝাতে মূলত এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়। সাহওয়াপন্থী আলেমগণ যুদ্ধ ও মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ অবস্থান নিয়েছিলেন। অন্যদিকে, আলেমদের আরেকটি পক্ষ শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক বিদেশী সেনাদেরকে ডেকে আনার সিদ্ধান্তের পক্ষে ছিলেন। এভাবে সৌদি আরবের মূলধারার সালাফী আলেমদের মধ্যে বিভাজন তৈরি হয়।

সৌদি সালাফী গ্রুপগুলোর মধ্যে মাদখালীরা হলো সাহওয়াপন্থী আলেমদের বিরোধিতাকারী সর্বশেষ গ্রুপ। তারা সাহওয়াপন্থী আলেমদেরকে সাইয়েদ কুতুব ও তাঁর ভাই মুহাম্মদ কুতুবের রাজনৈতিক চিন্তার অনুগামী অভিহিত করে ‘কুতুবপন্থী’ বলে ট্যাগ দেয়। মুহাম্মদ কুতুব ছিলেন সফর আল-হাওয়ালীর থিসিস সুপারভাইজর। কেউ কেউ শায়খ হাওয়ালীকে সাহওয়া আন্দোলনের ‘প্রতিষ্ঠাতা’ মনে করতে পারে।

[5] অনেকে এর পেছনের কারণটা বুঝতে পারে না। ফলে তাদের দাবি হলো, সৌদি সরকার টাকাপয়সা দেয় বলেই তারা সরকারের প্রতি অনুগত। টাকাপয়সার একটা ভূমিকা আছে বটে। তবে সৌদির বাইরে সালাফীদের মধ্যে যারা এই মতের সমর্থক, তাদের বেশিরভাগই সৌদি পেট্রোডলারের সুবিধাভোগী নয়। তাই সালাফী আন্দোলন সম্পর্কে ন্যায্য কথাটি হলো– মূলত ‘বৈধ শাসকের আনুগত্য’ সংক্রান্ত ক্লাসিক্যাল সুন্নী মতবাদের উপর ভিত্তি করে তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি দাঁড়িয়ে আছে। বলে রাখা ভালো, আমার মতে তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি ধর্মীয়ভাবে সমর্থনযোগ্য নয় এবং এটি নৈতিকতারও পরিপন্থী; বিশেষ করে এ মূলনীতি যখন কোনো বৈধ শাসকের প্রকাশ্য সমালোচনার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। উপরন্তু, বেশিরভাগ সালাফী গ্রুপের অনুসারীদের মধ্যে একটি স্থূল আবেগ দেখা যায়। সেটা হলো– সমস্ত ভুলত্রুটি সত্ত্বেও সৌদি রাজতন্ত্রই কেবল ‘তাওহীদ ও সুন্নাহর রক্ষক’; তাই সৌদি রাজতন্ত্রের অন্য সব দোষত্রুটি উপেক্ষা করে যেতে হবে। তাই, তাদের দৃষ্টিতে সরকারের সমালোচকরা আসলে তাওহীদ রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের সমালোচক।

[6] এই ধর্মতাত্ত্বিক অবস্থানটির পরিণতিই হলো তাকফীর করা, যা পরবর্তী পয়েন্টে বলা হয়েছে।

[7] আমার একটি একাডেমিক পেপারে এ বিষয়ে কিছুটা বিস্তারিত আলোচনা করেছি। লিংক: https://www.youtube.com/watch?v=RZoAzlnpIgk

[8] এই প্রত্যেকটি মতামত এবং এর পক্ষের আলেমদের চিন্তায় পার্থক্য খুব সামান্যই। এরা প্রত্যেকেই নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার ব্যাপারে সদাসতর্ক। তাদের দৃষ্টিভঙ্গির এই সূক্ষ্ম পার্থক্যগুলো সম্পর্কে আমি ভালো করেই জানি। অবশ্য সবার ব্যাপারে এখানে আলোচনা করা সম্ভব নয়। কারণ, এটি কোনো গবেষণামূলক নিবন্ধ নয়। একটি সংক্ষিপ্ত সাদামাটা বর্ণনা তুলে ধরাই এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য। আগ্রহী পাঠকগণ  চাইলে এই গ্রুপগুলোর মধ্যকার দৃষ্টিভঙ্গিগত সূক্ষ্ম পার্থক্য সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিলে বিস্তারিত জানতে পারবেন।

[9] এখানে একটি কথা বলে রাখা জরুরি: এই গ্রুপগুলো ও তাদের দৃষ্টিভঙ্গিসমূহ একটা আরেকটা থেকে পুরোপুরি পৃথক কিংবা বিচ্ছিন্ন নয়। বরং কোনো কোনো বিষয়ে দলগুলোর মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির মিল থাকতে পারে। এবং বিশেষ কোনো আলেম বা ব্যক্তির মধ্যে একাধিক উপদলের বৈশিষ্ট্য থাকাও অসম্ভব নয়।

[10] মাদখালী ধারার সালাফিজমের গুরুত্ব কমে যাওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে: (১) তারা অত্যন্ত অসহিষ্ণু হিসেবে পরিচিত হয়ে গিয়েছিলো এবং তাদের এই পরিচিতি পুরো সালাফী আন্দোলনের এত বেশি ক্ষতিসাধন করেছে যে অন্যান্য সালাফী ধারার অধিকাংশ ধর্মীয় নেতা (এমনকি মাদখালী ধারারও কোনো কোনো আলেম) বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, এই ধারাটির মধ্যে চরমপন্থার সহজাত উপাদান রয়েছে। (২) মাদখালীদের জনপ্রিয়তার হুজুগে পড়ে যারা তখন গা ভাসিয়েছিলো, পরবর্তীতে তারা হয় এই গ্রুপ ত্যাগ করেছে, নয়তো সালাফিজম ত্যাগ করেছে। কেউ কেউ এমনকি ধর্মীয় প্র্যাকটিস থেকেই সরে গেছে। এই ঘটনা এত বেশি ঘটেছে যে এ ধরনের লোকদের বুঝাতে ‘সালাফি বার্নআউট’ বলে একটা পরিভাষা চালু হয়ে গেছে। (৩) সরকারের কট্টর সমর্থক হওয়ার কারণে কিছু সময়ের জন্য (৯০ দশকের শেষ থেকে শূন্য দশকের প্রথম পর্যন্ত) সৌদি সরকার মাদখালী মতবাদ প্রমোট করেছিলো। কিন্তু এই মতবাদের নানা ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব বেড়ে গেলে সরকার নিজেই মাদখালী ধর্মীয় নেতাদের উপর থেকে কৌশলে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। তারপর সৌদি আরবের বাইরে এটি শুধু পাশ্চাত্যের মুসলিম সমাজে সক্রিয় থাকে। বিশেষ করে ধর্মান্তরিত কিংবা স্বল্প শিক্ষিত নন-প্র্যাকটিসিং অভিবাসী মুসলিমদের মধ্যে। এদের হাবভাব দেখে মনে হয় যেন তারা প্রসিদ্ধ ধর্মীয় নেতৃবৃন্দকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য হঠাৎ করে একটি অস্ত্র হাতে পেয়ে গেছে।

[11] এখানে মিশরের নাম এসেছে নিছক উদাহরণ হিসেবে। অন্য দেশগুলোর নাম না নিলেও পাশ্চাত্যসহ প্রায় সব দেশের অবস্থাই সম্ভবত একই রকম। কখনো কখনো প্রাচ্যের সালাফীদের রাজনৈতিক অবস্থান পাশ্চাত্যের সালাফীদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়– দুজন ধর্মান্তরিত আমেরিকান মুসলিম হয়তো সৌদি আরবের কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সহীহ আকীদাগত অবস্থান নিয়ে তীব্র বাদানুবাদে লিপ্ত হয়ে পড়ছে। এ রকম চিত্র একেবারে অপরিচিত নয়।

[12] ব্যক্তিগতভাবে আমাকে মাদখালী ও তাকফীরি – উভয় ঘরানার সালাফীদের ক্ষোভের মুখোমুখি হতে হয়েছে। তাই স্পষ্টতই এই ঘরানা দুটোর ব্যাপারে আমি নিরপেক্ষ কেউ নই। তারপরও এই গ্রুপ দুটোর মধ্যে তাকফীরিদের ব্যাপারে আমার কথা হলো: পদ্ধতিগত দিক থেকে মাদখালীদের তুলনায় তারা বেশি বুদ্ধিমান। তাদের ঈমানের তেজও বেশি। কিন্তু তাদের কাজকর্ম ও যাদেরকে তারা সমর্থন করে, এর দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব বুঝার মতো প্রজ্ঞার অভাব তাদের রয়েছে। তাদের সাথে দ্বিমত পোষণকারীদেরকে মূল্যায়ন করার ব্যাপারে তারা মাদখালীদের মতোই কঠোর ও অসহিষ্ণু। অথচ নিছক দ্বিমত পোষণের কারণেই কেউ ইসলামের শত্রুদের কাতারে চলে যায় না। তাছাড়া আপনার বয়স, অভিজ্ঞতা, সার্বিক দক্ষতা বিবেচনা করাটাও আপনার জন্য বিচক্ষণতার কাজ হবে। তুলনামূলকভাবে বয়স্ক ও প্রাজ্ঞ লোকেরা কেন আপনাদের আন্দোলনে খুব একটা নেই? চল্লিশ, পঞ্চাশ বা ষাটের কোটায় যাদের বয়স, যারা ইসলামের জন্য সারাটা জীবন ব্যয় করেছেন, তাদের ঈমান ও ইসলামের জন্য তাদের খেদমতকে কি সন্দেহ করা যায়? আপনি কি আসলেই মনে করেন– একজন টিনেজার বা বিশ-পঁচিশ বছর বয়সের তরুণ পাশ্চাত্যের মুসলমানদের এগিয়ে নেয়ার জন্য তার চেয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ বেশি বয়সের লোকদের থেকে বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন?

এ ব্যাপারে আমার সর্বশেষ পরামর্শ হলো, অন্যান্য ধর্মীয় নেতা ও মানুষজন সম্পর্কে আপনার অন্ধবিশ্বাস ও পূর্বানুমান সম্পর্কে সচেতন থাকুন। আপনি হয়তো কোনো ব্যক্তির এমন ভুলত্রুটি বা মতামতের সমালোচনা করছেন, আদতে যার অস্তিত্বই নেই। এটি হতেই পারে। সেক্ষেত্রে মিথ্যা অপবাদের জন্য আপনাকে আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করতে হবে। যারা আপনার শত্রু নয়, তাদেরকে শত্রু বানানো বোকামি। এ ধরনের কাজ আপনার জন্য ক্ষতিকর। খুব সম্ভবত পরকালেও আপনি এ ধরনের কাজের জন্য ক্ষতির সম্মুখীন হবেন।

[13] অনেকের মতে, ক্যাথলিকদের সাথে নিয়ে প্রটেস্ট্র্যান্টরা যেভাবে সংস্কার আন্দোলন করতে চেয়েছিলো সালাফীরাও একইভাবে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে সুফিবাদ ও লোক-ইসলামের সাথে কাজ করতে চায়।

[14] এটি হলো ইগনাজ গোল্ডজিহের থেকে শুরু করে রিচার্ড এম. ফ্রাঙ্ক, জর্জ ম্যাকডিসি এবং জোসেফ ভ্যান অ্যাস পর্যন্ত প্রায় সকল অমুসলিম ইসলামী ধর্মতাত্ত্বিকের অভিমত। যদিও এটা সত্য যে, এই গবেষকদের বেশিরভাগ আছারী আকীদাকে তেমন পাত্তা দেননি। কারণ তাদের মতে, এই ধারাটি অতিসরলীকরণের দোষে দুষ্ট। অবশ্য তারা স্বীকার করেছেন, আদি সুন্নী মতবাদের এই ধারাটি আশআরীদের কালাম ধারারও আগে প্রচলিত ছিলো।

কিন্তু আধুনিক আশআরীদের কেউ কেউ এই বাস্তবতাকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে। অথচ সমস্ত তথ্য-প্রমাণ তাদের বিপরীত। তাদের অভিযোগ, ইবনে তাইমিয়া ইসলামের একটি নতুন ধারণা ‘চালু’ করে গেছেন। অথচ, যেখানে বসে আমি এখন এই কথাগুলো লিখছি, অর্থাৎ আমার ব্যক্তিগত পাঠাগারে ধর্মতত্ত্বের উপর অন্তত এক ডজন গবেষণামূলক বই দেখতে পাচ্ছি। এগুলোর সবই আবুল হাসান আল-আশআরীর সময়কালের আগে লেখা। এই বইগুলোতে আল্লাহর গুণসমূহের সুস্পষ্ট ও পরিপূর্ণ বর্ণনা রয়েছে এবং এর পাশাপাশি কালাম শাস্ত্রকে প্রত্যাখান করা হয়েছে। ইবনে তাইমিয়ার সাথে কেউ দ্বিমত করতেই পারেন, কিন্তু এই ঐতিহাসিক সত্যকে কেউ অস্বীকার করতে পারেন না যে, তিনি যা প্রচার করে গেছেন, তা তাঁর সময়কালের অন্তত পাঁচ শতাব্দী আগে থেকেই সাধারণ আকীদা হিসেবে প্রচারিত হয়ে আসছিলো।

[15] ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার পিএইচডি থিসিসের বিষয় ছিলো ইবনে তাইমিয়ার শ্রেষ্ঠ রচনা ‘Averting the Conflict Between Reason and Revelation’ (ওহী ও যুক্তিবুদ্ধির বিরোধ মীমাংসা) শীর্ষক বইয়ের উপর একটি বিশ্লেষণমূলক গবেষণা। থিসিসের শুরুতে শ’খানেক পৃষ্ঠার সূচনা অধ্যায়ে আমি আশআরী ঘরানার উত্থানের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্যপ্রমাণ উল্লেখ করেছি। সেখানে সুস্পষ্টভাবে দেখিয়েছি, এই ঘরানাটি শুরুতে ছিলো ক্ষুদ্র ও সমাজের কাছে অপাঙক্তেয় একটি আন্দোলন। অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠী এদেরকে নানাভাবে হয়রানী করতো। কিন্তু কিছু ঐতিহাসিক কারণে (কারণগুলো আমি সেখানে বিস্তারিত উল্লেখ করেছি) তৎকালীন প্রভাবশালী আছারী আকীদার স্থলে আশআরী আকীদা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এটি সেলজুকদের অফিসিয়াল আকীদায় পরিণত হয়, যা পরবর্তী রাজবংশগুলোও বহাল রাখে। তাই সুন্নী ধারায় আশআরী আকীদাই সবসময় মূলধারা ছিলো – আধুনিক আশআরীদের এই দাবি ঐতিহাসিকভাবে সত্য নয়।

[16] আমার ধারণা– আল্লাহ তায়ালা যদি আছারী আকীদার পৃষ্ঠপোষক ও প্রচারক হিসেবে ইবনে তাইমিয়ার মতো ক্যালিবারসম্পন্ন কাউকে না পাঠাতেন, তাহলে এটি হয়তো অত্যন্ত ক্ষুদ্র ও ক্ষীণকায় একটি আন্দোলনে পরিণত হয়ে পড়তো। একটি ব্যক্তিগত বিষয় বলি, আমার নিজের চিন্তাভাবনার উপর ইবনে তাইমিয়ার মতো বড় মাপের ও তীক্ষ্ম অন্তদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের গভীর প্রভাব রয়েছে। উম্মাহর জ্ঞানীদের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ হোন বা না হোন, সর্বশ্রেষ্ঠদের মধ্যে তিনি নিঃসন্দেহে অন্যতম। দুর্ভাগ্যবশত, সালাফীদের প্রায় সকলে ইবনে তাইমিয়ার লেখালেখি পড়াকেই শুধু যথেষ্ট মনে করে (যদিও তাঁর কিছু লেখা, বিশেষ করে হেলেনীয় চিন্তা ও দর্শন সংক্রান্ত লেখাগুলো, বুঝার যোগ্যতাই তাদের নেই)। কিন্তু তাঁর দেখানো পথ অনুসরণের হিম্মত তাদের নেই। ইবনে তাইমিয়া তখন যা লিখেছিলেন, এখন বেঁচে থাকলে খুব সম্ভবত তা লিখতেন না। বরং বর্তমানে উম্মাহ যেসব বুদ্ধিবৃত্তিক হুমকি মোকাবেলা করছে, সেসব বিষয়ে মনোযোগী হতেন। তিনি তখন আসলে তার সময়কার চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবেলায় কলম ধরেছিলেন। অন্যদিকে, আধুনিক সালাফীদের অধিকাংশই বর্তমান সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা তো দূরে থাক, ইবনে তাইমিয়ার লেখা সাতশ বছর আগের চিন্তাভাবনা ও এর সীমানা পর্যন্ত ডিঙ্গানোর সাহস করে না।

[17] ৭৩ ফিরকা সংক্রান্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। অনেকেই যে ফিরকার ব্যাপারটিকে আসলে ভুল বুঝেছে, সেটি ব্যাখ্যা করেছি। এ ধরনের একটি আলোচনা পাওয়া যাবে এখানে: https://www.youtube.com/watch?v=6fDXifZ5jnY

[18] এ বিষয়ে আমি আরো বিস্তারিত বলেছি এখানে– https://muslimmatters.org/2009/03/11/the-birth-date-of-the-prophet-and-the-history-of-the-mawlid-part-i-of-iii/

[19] এসব ইস্যুতে এখানে-সেখানে অনিয়মিত ও বিচ্ছিন্ন দুয়েকটা খুতবা দেয়ার মাধ্যমে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটবে না। এসব ইস্যু সালাফীদের আলোচনার মূল পয়েন্ট নয়, যদিও সংশ্লিষ্ট সমাজে এসব সমস্যা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে।

এর মানে এই সমালোচনা যে শুধু সৌদি ধর্মীয় নেতাদের জন্য, তা নয়। বরং এর পাশাপাশি অন্যান্য সমাজের জন্যেও এসব কথা প্রযোজ্য।

[20] পুরুষ ও নারী সাহাবীদের সবাই সবার নাম ভালো করেই জানতেন। দরকার হলে তারা পরস্পর কথাবার্তাও বলতেন। অথচ নারীদের অস্তিত্ব পর্যন্ত মুছে দেয়ার এই সুস্পষ্ট প্রচেষ্টা থেকে আপাতভাবে মনে হতে পারে, সালাফদের জীবনে যেন এ ধরনের কোনো দৃষ্টান্ত ছিলো না। অন্যদিকে, এ ব্যাপারে প্রকৃত ইসলামী আদব হলো– শুধু বৈধ প্রয়োজনে, যথাযথ শিষ্টাচার রক্ষা করে এবং ন্যূনতম মাত্রায় বিপরীত লিঙ্গের কারো সাথে সরাসরি কথাবার্তা বলা যেতে পারে। এটি কেউ অস্বীকার করে না। কিন্তু কিছুটা অনুমোদন দেয়া হলেও প্রথমে তা বিপথগামিতা এবং পরবর্তীতে লাগামহীন বিকৃতির দিকে নিয়ে যাবে বলে সালাফীদের বদ্ধমূল ধারণা।

[21] হ্যাঁ, প্রাচীন ও ক্লাসিক্যাল ইসলামের হাতেগোনা কিছু বর্ণনায় এর অস্তিত্ব পাওয়া যায় বটে। তবে এটি যে প্রচলিত কোনো পরিভাষা ছিলো না; কিংবা বর্তমানে যে অর্থে ব্যবহৃত হয়, সে অর্থে ব্যবহৃত হতো না – সেই সত্য অস্বীকার করার জো নেই।

এ ধরনের আরো লেখা