তিউনিশিয়া: মধ্যপ্রাচ্যের জন্য দৃষ্টান্ত
এডিটর’স নোট: গত ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৩ তারিখে ফরেন অ্যাফেয়ার্সে Tunisia’s Lessons for the Middle East: Why the First Arab Spring Transition Worked Best শিরোনামে ইবরাহীম শারকীহ একটি নিবন্ধ লেখেন। সিএসসিএস-এর পাঠকদের জন্য এটি অনুবাদ করেছেন মো. হাবিবুর রহমান হাবীব।
*****
আরব বিশ্বের সবচেয়ে জোরালো নিরাপত্তাবেস্টিত রাষ্ট্র তিউনিশিয়া। ২০১১ সালে এর প্রেসিডেন্ট জেইন এল-আবেদিন বেন আলীর আকষ্মিক পতন ঘটে। এর প্রতিক্রিয়ায় এবং অব্যবহিত পরবর্তীতে মিশর থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত একের পর এক স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের বিস্ফোরণ ঘটে। কিছু কিছু দেশে আন্দোলন ব্যর্থ হলেও কয়েকটি দেশে স্বৈরাচারী শাসকদের অপসারণ করা সম্ভব হয়েছে।
যদিও তিউনিশিয়ার অভ্যন্তরে অনেক সমস্যা রয়েছে; তারপরও বলা যায়, আরব বসন্তের ছোঁয়া লেগেছে এমন দেশগুলোর সাথে তুলনা করলে দেশটি বেশ ভালো অবস্থায় রয়েছে। তিউনিশিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ের জ্যেষ্ঠ সরকারী কর্মকর্তা, শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সুশীল সমাজের শীর্ষ প্রতিনিধি, শিক্ষাবিদ, বিশ্লেষক এবং এককালীন রাজবন্দীদের সাক্ষাৎকারে এটা স্পষ্ট যে, রাষ্ট্র হিসাবে তিউনিশিয়া সুষ্ঠু উত্তরণ প্রক্রিয়া এবং যৌক্তিক নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রতিষ্ঠায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অপরাপর আরব রাষ্ট্রগুলো যেহেতু নতুন সরকার ব্যবস্থা গঠনের সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, তাই তিউনিশিয়া থেকে তাদের অনেক কিছু শেখার আছে।
সাম্প্রতিক কালে তিউনিশিয়া বেশ জটিল রাজনৈতিক সংকট মোকাবেলা করে যাচ্ছে। গত ২৫ জুলাই একজন সালাফী চরমপন্থী জাতীয় গণপরিষদের প্রথিতযশা সদস্য (সাময়িক) মোহাম্মদ আল ব্রাহিমীকে হত্যা করে। এর প্রতিক্রিয়ায় ৫০ জনেরও বেশি বিরোধী দলীয় সদস্য গণপরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন। তাঁরা সরকার ভেঙ্গে দিয়ে একটি নতুন টেকনোক্র্যাটিক সরকার গঠনের দাবি জানান, যেন বাদ-বাকি সময়ে নতুন নেতৃত্বের মাধ্যমে জাতীয় রূপান্তর প্রক্রিয়া সহজতর হয়। লক্ষণীয়, নিজেদের শীর্ষনেতার হত্যাকাণ্ডের পর অস্ত্রধারণ করার পরিবর্তে বিরোধী দলগুলো শান্তিপূর্ণভাবে এ ঘটনার প্রতিবাদে আন্দোলন করেছে।
যাহোক, চলমান অচলাবস্থা দূর করতে সরকার সকল পক্ষের সাথে নিবিড়ভাবে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। শুরু থেকেই তাঁরা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে আসছে। যেমন, জাতীয় ঐক্যমতের সরকার গঠন এবং গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা, যা ছিল বিরোধীদলের অন্যতম দাবি। সেখানে মিশরের মত বিদেশীদের মধ্যস্থতা বা হস্তক্ষেপের কোনো প্রসংগ আসেনি। যদিও টেকনোক্র্যাটিক সরকার গঠনের বিষয়ে এখনো তাঁরা কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেননি। তারপরও সকল পক্ষ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং বিকল্প সমাধানে পৌঁছানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। শুরু থেকেই তিউনিশিয়ার নেতৃবৃন্দ জাতীয় রূপান্তর প্রক্রিয়া নিয়ে যৌথভাবে কাজ করছেন, এটা তারই প্রমাণ।
মিশরে মূলধারার ইসলামপন্থীরা শেষ মুহুর্ত পর্যন্তও ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। আমরা জানি, মোবারক পরবর্তী ভোটে মুসলিম ব্রাদারহুড শক্তিশালী অবস্থান প্রদর্শন করেছে। ঠিক তাদের মত তিউনিশিয়ায় ‘আন-নাহদা’ পার্টি বেন আলী পরবর্তী ভোটে গণপরিষদে ৪১ শতাংশ আসনে জয়লাভ করে। অন্যান্য দলগুলোর মতো শক্তিশালী অবস্থান তৈরির পরিবর্তে আন-নাহদার নেতৃবৃন্দ ‘আত-তাকাতুল’ এবং ‘কংগ্রেস ফর দ্যা রিপাবলিক পার্টি’র (দুটি দলই রক্ষণশীল বাম) সাথে ত্রিপক্ষীয় জোট গঠন করে। এছাড়াও ক্ষমতাসীন আন-নাহদা দেশের প্রেসিডেন্ট পদে দৃশ্যত সেক্যুলার মোনসেফ মারজুকির মনোনয়নকে সমর্থন দেয়ার মতো দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল।
কংগ্রেস ফর দ্যা রিপাবলিক পার্টির প্রধান মারজুকি একজন মানবাধিকার কর্মী। তিনি বেন আলীর সময় জেল খেটেছিলেন। তার দল গণপরিষদে মাত্র ১৩.৪ শতাংশ আসন পেয়েছে। দল তিনটির মতাদর্শগত পার্থক্য সত্ত্বেও প্রায় দুই বছর ধরে তাঁদের জোট টিকে আছে। মারজুকি এখন পর্যন্ত জোটের মধ্যে তাঁর শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছেন। তবে চলমান রাজনৈতিক সংকট মোকাবেলা এবং সর্বোপরি একজন শক্তিশালী জাতীয় নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করায় তিনি ব্যর্থ হয়েছেন ।
অধিকাংশের জন্য ন্যায়বিচার
তিউনিশিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সর্বজনগ্রাহ্য ও যৌক্তিক ন্যায়বিচার ভিত্তিক আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে, যা প্রশংসার দাবি রাখে। আইনের খসড়া তৈরির জন্য গঠিত স্বাধীন কমিটিতে ১২ সদস্যের মধ্যে মাত্র দুইজন আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা; বাকি দশজনকে সুশীল সমাজ থেকে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ঐ প্রতিনিধিদল সারা দেশে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁদের মতামত গ্রহণ করেছে। তাঁরা জানার চেষ্টা করে, বেন আলীর শাসনামলে ক্ষতিগ্রস্তরা বর্তমানে ন্যায়বিচার প্রক্রিয়ায় কোন ধরনের বিষয়গুলোর প্রয়োজনীয়তাবোধ করেন এবং তাঁদের প্রত্যাশাগুলো কি। এই কমিটি রূপান্তর-প্রক্রিয়া এবং ন্যায়বিচার আইন বিষয়ক কমিটিতে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের সাথে পরামর্শ করেছে। ‘দি আল-কাওয়াকিবি ডেমোক্র্যাসি ট্র্যানজিশন সেন্টার’ এবং ‘দি তিউনিশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ট্র্যানজিশনাল জাস্টিস’ উভয়ই এই কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে।
তিউনিশিয়া পূর্বের শাসন ব্যবস্থা সংস্কারের বিষয়ে মধ্যমপন্থা বেছে নিয়েছে। আইন তৈরির ক্ষেত্রে লিবিয়া ‘রাজনৈতিক বিচ্ছিন্ন আইনের’ (Political Isolation Law) মাধ্যমে ১৯৬৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত কর্মরত সরকারী কর্মকর্তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করেছে। লক্ষ্য করবার বিষয়, এ ধরনের প্রতিশোধমূলক বিষয়গুলোকে তিউনিশিয়া সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছে। তিউনিশিয়া ইয়েমেনের চেয়েও প্রাগ্রসর কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। উল্লেখ্য, ‘উপসাগরীয় দালালী নিষ্পত্তি আইনে’র সাথে ‘সুরক্ষা আইন’ (immunity law) সংযোজন করে ইয়েমেন অন্তর্বতীকালীন ন্যায়বিচার প্রতিরোধের যে কোনো প্রয়াস নস্যাৎ করার ব্যবস্থা করেছে। ইয়েমেনে অতীত অপরাধের দায়ে কাউকে দায়ী করা হয়নি এবং আগের ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে কোনো সংস্কার আরোপ করা ছাড়াই শাসনকার্য অব্যাহত রেখেছে।
তিউনিশিয়ার দৃষ্টিভঙ্গিকে বলা হচ্ছে ‘তাহসিন আত-তাওরা’ (বিপ্লবের সুরক্ষা)। সেখানে কিছু সাবেক সিনিয়র কর্মকর্তাকে পাঁচ বছর সরকারী অফিস থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যাদেরকে বিচারের মুখোমুখি কিংবা দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি, তাদেরকে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের অনুমতি দেয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে হাবিব বুরগিবার আমলে সরকারী কর্মকর্তা বেজি সাঈদ এসেবসিকে ‘নিদা তিউনেস’ পার্টির নেতৃত্বে থাকার অনুমতি দেয়া হয়েছে। এসেবসি ইতোমধ্যে বলেছেন, তিনি পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণের পরিকল্পনা করছেন। তিউনিশিয়া পরিবর্তনকালীন ন্যায়বিচারের লক্ষ্যে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার উপর গুরুত্বারোপ করেছে। এর অংশ হিসেবে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যক্তিকেন্দ্রিক মামলা দায়ের করে বিচারের সম্মুখীন করা হচ্ছে। বিচার সম্ভব না হলে তাদেরকে ব্যালট বাক্সের মাধ্যমে জনজীবন থেকে সরিয়ে দেয়া সম্ভব বলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মনে করে।
লিবিয়ার মতো করে সর্বাত্মক প্রতিস্থাপন (full-scale purge or tatheer) এর পরিবর্তে সংবিধান-পরিষদ ক্রমধারায় পরিবর্তন (the approach of shifting or gharbala) এর নীতিকে গ্রহণ করেছে। বিচার বিভাগ সংস্কারের ক্ষেত্রে যে সব বিচারকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা অসদাচারণের স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে শুধুমাত্র তাদের অপসারণের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করা হয়েছে।
নিরাপত্তা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে তাঁরা নতুন কার্যকর কাঠামো গঠন করেছে। যেমন, নির্যাতন প্রতিরোধে শুধুমাত্র জাতীয় কর্তৃপক্ষ নজরদারী (supervise) করবে। তাঁরা দেশের কারাগারগুলো পর্যবেক্ষণ ও পরিবদর্শন করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত। তাঁরা যে কোনো কারাগারে প্রবেশ করে বন্দীদের সাক্ষাৎকার নিতে পারবে। সরকারের বিরুদ্ধে মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ থাকলেও বাস্তবে গণপরিষদ রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া পরিদর্শন ও সংস্কারের জন্য বিশেষ কমিটি গঠন করেছে। ঐ মিডিয়াগুলো এতদিন সাবেক একনায়কতন্ত্র ও ঐতিহাসিকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থার গৌরবগাঁথা প্রচার করত। এসব প্রচেষ্টার পাশাপাশি পুরোনো শাসনব্যবস্থার উত্তরাধিকার নির্বাচন করার জন্য জাতীয় সংলাপের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পুরো প্রক্রিয়াটি রাষ্ট্রপতি এবং ‘তিউনিশিয়ান জেনারেল লেবার ইউনিয়নের’ (UGTT) অধীনে এগিয়ে নেয়া হচ্ছে।
রাষ্ট্রের প্রকৃতি, নির্বাচন এবং সংবিধানের মৌলিক উপাদান ইত্যাদিসহ দেশটি যে সকল প্রধান চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন সেসব বিষয়ে ঐক্যমতে পৌঁছানোর লক্ষ্যে এই সংলাপের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ষাটটিরও বেশি রাজনৈতিক দল এবং পঞ্চাশটি সুশীল সমাজের সংগঠন সমান্তরালে কাজ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে তাঁরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐক্যমতে পৌঁছেছে। যেমন, সর্বাবস্থায় যথাসম্ভব সহিংসতা পরিহার করা, অর্থনৈতিক খাতে সরকারের অগ্রাধিকার প্রদান ও সকলের সহযোগিতা, রূপান্তরের লক্ষ্যে একটি রোডম্যাপ তৈরি, একটি বেসামরিক রাষ্ট্র ও সংবিধান ব্যবস্থার মতো বিষয়ে ঐক্যমত্য, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং সমাবেশের স্বাধীনতা ইত্যাদি। এছাড়াও ১৭টি রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের চারটি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে জাতীয় সংলাপ বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
তিউনিশিয়ায় রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির উৎস
তিউনিশিয়ার চলমান পুরো রূপান্তর প্রক্রিয়ায় অনেকগুলো সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংস্থা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। বিভিন্ন সংলাপে তিউনিশিয়ার জনগণ বার বার জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করেছে যে, তাঁরা কট্টরপন্থা ও সহিংসতাকে সমর্থন করে না। আন-নাহদার রাজনীতিবিদ সাইয়্যেদ ফেরজানিসহ অনেকেই মনে করেন যে, মধ্যপন্থী মালিকি মাজহাবের প্রসারের ফলে ঐতিহাসিকভাবে তাঁরা চরমপন্থাকে পরিহার করেছেন। উল্লেখ্য, তিউনিশিয়ার ৯৮ শতাংশ মানুষ ঐতিহ্যগতভাবে মালিকি মাজহাবের অনুসারী। এ ধরনের মধ্যপন্থী জাতীয়-মানস গঠনের পিছনে কেউ কেউ তিউনিশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট বরগিবার শাসনামল (১৯৫৭-১৯৮৭) এবং তাঁর আধুনিকায়ন প্রকল্পের সাংস্কৃতিক প্রভাবের কথা বলেন। এছাড়া তিউনিশিয়ায় তেমন কোনো জাতিগত, উপজাতীয় কিংবা বিচ্ছিন্নতাবাদী ধর্মীয় বিভেদ নেই বললেই চলে, যা অন্যান্য দেশে অনেক প্রকটভাবে দেখা যায়।
শুধুমাত্র ঐতিহ্য ও অবকাঠামোগত বিষয়গুলোর মাধ্যমে তিউনিশিয়ার অবস্থা পরিপূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করা দুরূহ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল আন-নাহদা পার্টির দৃষ্টিভঙ্গী, যা মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুড থেকে অনেকখানি ভিন্নতর। মিশরে ব্রাদারহুডের নেতারা দশকের পর দশক ধরে দমন, নির্যাতন এবং বাধ্যতামূলক সংস্কারের শিকার হয়েছে। তাঁদের রাজনৈতিক কর্মসূচি স্বৈরশাসকের কারাগারেই ঘুরপাক খায়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, মুসলিম ব্রাদারহুডের সর্বোচ্চ নেতা মোহাম্মদ বাদী প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুল নাসের এবং আনোয়ার সাদাতের শাসনামলে ১৯৬৫ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত জেল খেটেছেন। অতিসম্প্রতি তাঁকে আবারো কারারুদ্ধ করা হয়েছে। আন-নাহদার নেতৃবৃন্দও বেন আলীর সময় বছরের পর বছর নির্বাসিত জীবন যাপন করেছেন। ১৯৯১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত আন-নাহদার নেতা রশিদ আল-ঘানুসী লন্ডনে নির্বাসিত ছিলেন। দলটির অন্যান্য শীর্ষনেতাদের অবস্থাও একই। এইসব অভিজ্ঞতার ফলে আন-নাহদার রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার উপর এক ধরনের আধুনিকায়নের প্রভাব পড়ে। ফলে তাঁরা সমন্বয়মূলক আদর্শ ধারণ ও লালন করার সুযোগ পায়। উল্লেখ্য যে, মিশরে সালাফীরা ২০১১ সালের নির্বাচনে ২৮ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। তাঁদের তুলনামূলক প্রভাবের ফলে দেশটির রাজনীতিতে এক ধরনের মেরুকরণ তৈরি হয় এবং এটি মিশরের ব্রাদারহুডকে অধিকতর দক্ষিণপন্থার দিকে ঠেলে দেয়।
মিশরের বিপরীতে তিউনিশিয়ায় একটি পেশাদার ও প্রজাতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ এবং রাষ্ট্রের কাজে কোনো হস্তক্ষেপ করে না- এমন সেনাবাহিনী আছে। মিশরের সেনাবাহিনী ঐতিহাসিকভাবে জনগণের সরকারকে ক্ষমতাচ্যূত করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছে। এমনকি তাদের নিজস্ব আন্তর্জাতিক মিত্র রয়েছে। যার ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও মিশরীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক মাঝে মাঝে দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক সম্পর্ককে ছাপিয়ে যায়। অন্যদিকে, তিউনিশিয়ার সেনাবাহিনী বেন আলীর ক্রীড়নক ছিল না এবং পরবর্তী রূপান্তর প্রক্রিয়ায়ও তা দেখা যাচ্ছে। কারণ তারা দৃশ্যত তিউনিশিয়ার রাজনীতিতে অনুপস্থিত।
এছাড়াও পুরো রূপান্তর প্রক্রিয়ায় একটি কার্যকর সংবিধান-পরিষদ থাকার ফলে তিউনিশিয়া অনেক বেশি সুবিধা পেয়েছে, যা কিনা বিভিন্ন বিষয়ে ঐক্যমতে পৌঁছার জন্য একটি বৈধ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করেছে। অন্যদিকে, মিশরে সংসদের একটি দুর্বল উচ্চ কক্ষের কাছে ক্ষমতা দিয়ে আদালতের আদেশে নিম্ন কক্ষের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। সম্প্রতি তিউনিশিয়ার সংবিধান-পরিষদের কার্যক্রম স্থগিত করা হলেও আশা করা যায় শীঘ্রই তাদের কার্যক্রম শুরু হবে। দেশটির রাজনৈতিক সংকটে মধ্যস্থতার বেশিরভাগ প্রচেষ্টায় মনে হয় তাঁরা একটি রেজুলেশন তৈরির কাছাকাছি পৌঁছেছে; যার ফলে পরিষদের কাজ পুনরায় শুরু করার উপর বেশ তাগিদ দেয়া হচ্ছে। এছাড়াও, জাতীয় সংলাপ এবং মধ্যস্থতার জন্য সুশীল সমাজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে।
তিউনিশিয়ার মডেল
এটা বলা কখনোই ঠিক হবে না যে, তিউনিশিয়ার রূপান্তর প্রক্রিয়া কোনো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়নি। দেশটিতে চলমান বিভিন্ন প্রতিবাদ সমাবেশ এবং অর্থনীতির বেহাল দশার মাধ্যমে বিষয়টি বেশ পরিষ্কার বুঝা যায়। রূপান্তরের জন্য বড় ধরনের বাজেটের প্রয়োজন। দেশটির পুনর্গঠন মূলত পূর্বের শাসনামলে বিভিন্ন সময় কারাবন্দী, যারা গুম হয়েছিল তাদের পরিবার এবং বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ক্ষতিপূরণের উপর অনেকাংশে নির্ভর করছে। তিউনিশিয়ায় দারিদ্রের হার বেড়েই চলছে এবং দেশটির পর্যটন শিল্প, বিপ্লব এবং বিপ্লব পরবর্তী ঘটনা প্রবাহের ফলে মারাত্মকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। পর্যটকেরা পর্যটন এলাকাগুলোতে খুব কমই যায় এবং গেলেও এলাকাগুলো প্রায় জনশূন্য, যা স্বাভাবিক দৃশ্যে পরিণত হয়েছে।
এছাড়াও তিউনিশিয়ার বিপ্লব সুরক্ষা কমিটিসমূহ (CPRs- The Committees for the Protection of the Revolution) রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ এবং আইনের শাসনের বিষয়ে এক কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। সাবেক বিপ্লবীদের নিয়ে গঠিত এই কমিটিগুলো বিপ্লব রক্ষার দায়ভার নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে এবং পুরোনো শাসন উপাদানগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার বিষয়ে আগ্রহী। যদিও রূপান্তর প্রক্রিয়া অনেকখানি এগিয়েছে, কমিটির সদস্যরা বিপ্লবের ফলে ক্ষমতাচ্যুতদের দ্বারা একটি প্রতিবিপ্লবের আশংকা করছন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, বিরোধী দলের রাজনীতিবিদ ‘নিদা তিউনিশ পার্টি’র লুতফি নাবিককে হত্যার অভিযোগ রয়েছে একটি কমিটির বিরুদ্ধে।
তিউনিশিয়ায় UGTT-কে আক্রমণ করার অভিযোগও রয়েছে CPRs এর বিরুদ্ধে। কয়েকটি বিরোধী দল দাবি করে যে, CPRs হল আন-নাহদা পার্টির রক্ষীবাহিনী। বাস্তবতা হল, যদিও সেখানে কিছু দলীয় লোক আছে কিন্তু তারা সে রকম নয়। বরং অন্যান্য যে কোনো বিপ্লবে যেমন বিপ্লবকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হয়, তিউনিশিয়ার বিপ্লবও তার ব্যতিক্রম নয়। সেখানে এই কমিটিগুলোকে মোকাবেলার বিষয়টি অন্যতম কারণ। আন-নাহদার যুক্তি হল, কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে কমিটিগুলোকে যদি ভেঙে দেয়া হয়, তাহলে পুরো রূপান্তর প্রক্রিয়ায় ধ্বস নামবে। বরং যদি কোনো কমিটি সহিংসতার সাথে যুক্ত থাকে, তাহলে তিউনিশিয়ার আদালতের মাধ্যমে সেটি বিলুপ্ত করা উচিত। অন্যান্যদের যুক্তি হল, অবৈধভাবে আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে সহিংসতা করার বৈধতা দেওয়াটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আর বিপ্লবের চেতনা রক্ষা করা রাষ্ট্রের একান্ত কর্তব্য।
তিউনিশিয়াকে এক ধরনের মেরুকরণের মোকাবেলা করতে হবে যা অন্যান্য আরব দেশগুলোর তুলনায় এক প্রকার চরম আকার ধারণ করতে পারে। আর সেটা হল, তিউনিশিয়ার সেক্যুলার উদারপন্থী এবং অতিমাত্রায় রক্ষণশীল সালাফীদের মধ্যে ব্যাপক এবং ক্রমবর্ধমান বিভেদ। তিউনিশিয়ার সেক্যুলাররা স্থিতিশীল নয় এবং আরব বিশ্বে তারা অতুলনীয়। বরগিবা এবং বেন আলীর অধীনে তিউনিশিয়া ছিল একমাত্র দেশ যেখানে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে হিজাব নিষিদ্ধ ছিল। অন্যদিকে, তিউনিশিয়ার সালাফী জিহাদীরা একটি পরিপূর্ণ ধর্মীয় রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখে এবং ইসলাম পরিপন্থী সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের উপর আক্রমণ করার মত মানসিকতা ইতোমধ্যে তারা দেখিয়েছে।
তিউনিশিয়ার সাথে মিশরের স্পষ্ট বৈসাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। মিশরে যেখানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সবাই প্রায় একমত ছিল, সেখানে তিউনিশিয়ায় দুটি ভিন্ন চরম সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের কারণে দেশটিতে একক স্বপ্ন পূরণের সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। উপরন্তু, তিউনিশিয়ায় সালাফীরা বিপ্লবের আগে জেল খেটেছে এবং তারা গোপনে রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করত। এখন তারা পর্যায়ক্রমে শক্তিশালী হয়ে উঠছে। ‘আনসার আল-শরিয়াহ’র নেতা আবু আইদাহসহ কারারুদ্ধ সালাফী নেতারা দেশটির বিপ্লব পরবর্তী রাষ্ট্রীয় ক্ষমার অংশ হিসেবে জেল থেকে মুক্তি পায়। এরপর থেকে তারা প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। সালাফীদের একটি গ্রুপ আনসার আল-শরিয়াহ’র ২০১২ সালের বার্ষিক সম্মেলন প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ উপস্থিত ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, খাইরুন শহরে ২০১৩ সালের অনুষ্ঠিতব্য সম্মেলনে প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ উপস্থিত হবে।
উদারপন্থী এবং সালাফীদের মধ্যে এই ক্রমবর্ধমান সম্পর্কের অবনতি খুব স্বাভাবিকভাবে মধ্যপন্থী আন-নাহদা পার্টিকে তিউনিশিয়ায় প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। যার ফলে, আন-নাহদার নেতাদেরকে একই সাথে উদারপন্থীরা মৌলবাদী হিসেবে আর সালাফীরা কাফের এবং স্বৈরচারী হিসেবে গালি দিয়ে থাকেন। অবশ্য এই প্রত্যেকটি সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার বিভিন্নভাবে কাজ করতে বদ্ধপরিকর। রাজনৈতিক রূপান্তর প্রক্রিয়ার অগ্রগতিই হবে তিউনিশিয়ার অর্থনৈতিক দূরবস্থার একমাত্র সমাধান। যেমন, এর ফলে জনজীবনে স্বাভাবিকতা ফিরে আসবে, পর্যটন শিল্প আবার চাঙ্গা হয়ে উঠবে ইত্যাদি। যা হোক, ততদিনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই রূপান্তর প্রক্রিয়ায় আর্থিকভাবে সহায়তা করতে পারে। এর সমর্থনে তারা যুক্তি দিতে পারে যে, তারা তিউনিশিয়ার রূপান্তর প্রক্রিয়াকে মডেল ধরে বিনিয়োগ করছে, যা পুরো আরব অঞ্চলের জন্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে।
CPRs এর বিষয়ে উভয় পক্ষই উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে। সে ক্ষেত্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে জোর দেয়া উচিত। CPRs কে একটি একক কমিটি হিসেবে গণ্য করা উচিত হবে না। অথবা কমিটিগুলোর মধ্যে সবগুলোকে বহাল রাখা কিংবা রাজনৈতিক ডিক্রি জারি করে সবগুলোকে বাতিল করে দেয়া উচিত হবে না। বরং যদি কোনো একটি বিশেষ কমিটি আইন ভঙ্গ করে অথবা তার নিবন্ধনের নীতি এবং ঘোষিত লক্ষ্য বিরোধী কিছু করে তাহলে অবিলম্বে তিউনিশিয়ার বিচার কাঠামোর আওতায় এনে সেই কমিটি ভেঙ্গে দেয়া উচিত।
এছাড়াও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে দেশটির অভ্যন্তরীণ চরমপন্থা রোধ করা সম্ভব। তিউনিশদের দরিদ্রতম প্রতিবেশী তাদামুনে সহিংসতার কারণে এ বছর আনসার আল-শরিয়াহ’র সম্মেলন বাতিল করা হয়। দ্বিতীয়ত, তিউনিশিয়া মালিকি আইন শাস্ত্রের উপর নির্ভর করতে পারে। তিউনিশিয়ার ‘আজ-জিতোয়ানা মসজিদ’ বিশ্বে মালিকি দর্শনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। মসজিদটিতে মালিকি পন্ডিতগণ অতিরক্ষণশীল ওয়াহাবী চিন্তাধারার বিরুদ্ধে ইসলামী জ্ঞান এবং যুক্তিবৃত্তি উন্নয়নের জন্য কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। চরমপন্থার বিপরীতে প্রবল প্রচেষ্টা এবং সামাজিক ঐক্য প্রতিষ্ঠায় তাঁরা বেশ প্রত্যয়ী।
সামনে এত সব চ্যালেঞ্জের কারণে, রূপান্তরের বিষয়ে তিউনিশিয়ার জনগণের খুব সামান্যই আস্থা রয়েছে বলে মনে হয়। তাদের সাথে কথা বললে তারা ক্রমাগত প্রশ্ন তোলে, কিভাবে তাদের বিষয়গুলো অন্য দেশের সাথে তুলনা করা সম্ভব। এত সব কিছুর পরেও তিউনিশিয়ার জনগণ আরব অঞ্চলের রূপান্তররত রাষ্ট্রগুলোর জন্য একটি মডেল হিসেবে দাঁড়িয়েছে। যা হোক, তাঁরা শুধু নতুন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সেটই তৈরি করেনি, সাথে সাথে তাঁরা জবাবদিহিতা এবং আইনের শাসনের একটি সংস্কৃতি চালু করতে সক্ষম হয়েছে। বলা যায়, আস-সাবসি এবং কামেল মারজানির মতো বিপ্লব পূর্ববর্তী জাতীয় ব্যক্তিত্বকে তিউনিশিয়ার রাজনৈতিক কার্যক্রমে সংযুক্ত করতে পারায় এক দৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে।
যদিও তিউনিশিয়া বিশেষ কিছু ব্যক্তির মাধ্যমে লাভবান হচ্ছে; অন্যান্য আরব দেশের উচিত অভ্যন্তরীণ রাষ্ট্রীয় সংলাপের সূচনা করা, রাজনৈতিক জোট গঠন করা এবং সংস্কারের উদ্দেশ্যে অন্তর্বর্তীকালীন বিচার আইনের খসড়া প্রস্তুত করার মাধ্যমে গোড়া থেকে পরিবর্তনের নীতি গ্রহণ করা। তিউনিশিয়ার ক্ষেত্রে এই ধরনের ধীরস্থির সামগ্রিক নীতি এবং নিয়মভিত্তিক রাষ্ট্র-গঠনের প্রক্রিয়া ঐক্যবদ্ধ এবং একটি বাস্তবভিত্তিক বিবর্তনকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করেছে। সুতরাং আরব বিশ্বের সামগ্রিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে তিউনিশিয়া একটি উৎকৃষ্ট পথ দেখাতে পারে।