শীর্ষ নির্বাহী পদে নারীদের সংখ্যা এত কম কেন?
এডিটর’স নোট: ফেসবুকের চিফ অপারেটিং অফিসার শেরিল স্যান্ডবার্গ ২০১০ সালের ডিসেম্বরে একটি টেড টক প্রদান করেন। বক্তব্যটি পরবর্তীতে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। কর্মক্ষেত্রে নারীদের পিছিয়ে পড়ার পেছনের কিছু বাস্তব কারণ এই বক্তব্যে ওঠে আসে। পাঠকদের জন্য এটি অনুবাদ করেছেন আইয়ুব আলী। পাশাপাশি বক্তব্যটির একটি পর্যালোচনা তুলে ধরেছেন সিএসসিএস-এর পরিচালক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক। বক্তব্যের শেষে পর্যালোচনাটির ভিডিও যোগ করে দেয়া হয়েছে।
*****
আজ আমরা যারা এখানে উপস্থিত হয়েছি, তারা খুব ভাগ্যবান। আমাদের পৃথিবীটা আমাদের মা-দাদীদের চেয়ে কম প্রতিকূল। তাদের সময় নারীদের ক্যারিয়ার গড়ার করার সুযোগ ছিলো অত্যন্ত সীমিত। আমরা যারা এখানে বসে আছি, তাদের প্রায় সবাই এমন এক পৃথিবীতে বড় হয়েছি, যেখানে মৌলিক নাগরিক অধিকারগুলো তুলনামূলকভাবে অধিকতর প্রতিষ্ঠিত। তবে এটাও সত্য, এখনো অনেক নারী এই অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত।
যা হোক, আজকে আমি অন্য একটি মৌলিক সমস্যা নিয়ে কথা বলবো। সেটি হলো, বর্তমানে পৃথিবীর কোথাও কোনো পেশায় নারীরা নিজেদেরকে শীর্ষস্থানে নিয়ে যেতে পারছে না। এ সংক্রান্ত পরিসংখ্যান চোখে আঙ্গুল দিয়ে আমাদেরকে প্রকৃত সত্যটা দেখিয়ে দেয়। ১৯০ জন রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে মাত্র ৯ জন হলেন নারী। বিশ্বের সমস্ত পার্লামেন্ট মেম্বারদের মাত্র ১৩ শতাংশ নারী। করপোরেট সেক্টরের একদম শীর্ষস্থানীয় বোর্ড মেম্বার পর্যায়ে মাত্র ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ নারী। ২০০২ সালের পর থেকে (অদ্যাবধি, ২০১০ সাল) এই পরিসংখ্যানের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। এমনকি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষপর্যায়েও নারীদের অবস্থান মাত্র ২০ শতাংশ। অথচ আমাদের একটা ধারণা হলো, সেখানে নারী নেতৃত্বের হার বেশি।
পেশাগত সফলতা ও ব্যক্তিজীবনের প্রয়োজনের মধ্যে কোনো একটিকে বেছে নেয়া হলো আমাদের আরেকটি সমস্যা। নারীদের জন্য এটি খুব কঠিন বিষয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পরিচালিত এক সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, বিবাহিত সিনিয়র ম্যানেজারদের দুই-তৃতীয়াংশ পুরুষের সন্তান রয়েছে, আর মাত্র এক-তৃতীয়াংশ নারীর সন্তান রয়েছে।
আমার নিজের একটি অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। বছর কয়েক আগে একটি ব্যবসায়িক চুক্তি করার জন্য নিউইয়র্কের চমৎকার ছিমছাম একটি বেসরকারী ইক্যুইটি অফিসে গিয়েছিলাম। প্রায় তিন ঘণ্টা দীর্ঘ মিটিং ছিলো সেখানে। দুই ঘণ্টা পর একটি বিরতি দেয়া হয়। আমি ওয়াশরুমে যাওয়ার প্রয়োজনের কথা জানালাম। এতে আমাদের ব্যবসায়িক পার্টনার বেশ বিব্রতবোধ করছেন বলে মনে হলো। নারীদের ওয়াশরুমটি তাঁর অফিসের কোথায় আছে, সেটি যে তিনি জানেন না, তা বুঝতে পারছিলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম, অফিসটা নতুন বলে হয়তো এখনো সবকিছু তারা গুছিয়ে ওঠতে পারেনি। কিন্তু আশপাশে ভালো করে তাকিয়ে তা মনে হলো না। তখন আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘অফিসটা নতুন নাকি?’ তিনি বললেন, ‘না তো, আমরা তো প্রায় বছরখানেক ধরে এখানে আছি।’ আমি বললাম, ‘তারমানে আপনি বলতে চাচ্ছেন, গত এক বছরে এই অফিসে কোনো কাজে আসা আমিই একমাত্র নারী?’ তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ। আর সম্ভবত আপনিই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি কিনা ওয়াশরুম ব্যবহার করতে চেয়েছেন।’
এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কীভাবে এই সমস্যার সমাধান করতে পারি? শীর্ষ নির্বাহী পর্যায়ে নারীদের সংখ্যা কীভাবে বাড়ানো যায়? বর্তমান পরিস্থিতি পরিবর্তনের উপায় কী?
এ ব্যাপারে নারীদের জন্য আমার সর্বপ্রথম কথা হলো, কর্মক্ষেত্র ছাড়া যাবে না। কারণ আমি মনে করি, এটাই হলো উপর্যুক্ত প্রশ্নগুলোর সমাধান। কিন্তু সমস্যা হলো শীর্ষস্থানীয় ৫০০ সিইও, বা অন্যান্য ইন্ডাস্ট্রির সমপর্যায়ের পদ, অর্থাৎ কর্মক্ষেত্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের পদগুলো থেকে নারীরা ক্রমে ঝরে পড়ছেন। বিষয়টি নিয়ে লোকজনের মাঝে এখন প্রচুর কথাবার্তা হচ্ছে। তাদের মতে, কোম্পানিগুলোর উচিত নারীদের জন্য সুবিধাজনক কাজের সময় নির্ধারণ করা, নারীদেরকে মানসিকভাবে সমর্থন যোগানো এবং তাদের জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। এগুলো যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও আমি এর কোনোটি নিয়েই আজ কথা বলবো না। বরং একজন ব্যক্তি হিসেবে আমরা কী করতে পারি, সে বিষয়ের ওপর আজ আলোকপাত করতে চাই। আমাদের নিজেদের জন্য কোন কথাগুলো বলা দরকার? আমাদের নিজেদের জন্য বা আমাদের সাথে যেসব নারী কাজ করছেন, তাদের জন্য আমাদের বক্তব্য কী হওয়া উচিত? আমাদের কন্যাদের জন্য কোন কথাগুলো বলা জরুরি? এসব প্রশ্ন নিয়ে আজ কথা বলতে চাই।
শুরুতে আমি আরেকটা বিষয় পরিষ্কার করে রাখতে চাই– এই আলোচনায় আমি কোনো জাজমেন্টে যাচ্ছি না। আমার নিজের কাছেও একেবারে নির্ভুল কোনো উত্তর নেই। এমনকি আমার নিজের এটি প্রযোজ্য। আমি সান ফ্রান্সিসকোতে থাকি। এই কনফারেন্সে যোগ দিতে প্লেন ধরার জন্য গত সোমবার আমি বাড়ি থেকে বের হই। আমার তিন বছরের মেয়েটাকে যখন তার স্কুলে নামিয়ে দিতে যাচ্ছিলাম, সে তখন আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলো। বলছিলো, ‘মাম্মি, তুমি যেও না…!’ এটি খুব কঠিন এক পরিস্থিতি। এসব কারণে আমি মাঝেমধ্যে অপরাধবোধে ভুগি। আমি জানি, গৃহবধু হোক, কর্মজীবী হোক – এমন কোনো মা নেই, যিনি মাঝেমধ্যে এই ধরনের অপরাধবোধে ভোগেন না। তাই প্রত্যেক নারীকেই পেশাজীবী হতে হবে, এমনটা আমি বলছি না।
যারা কর্মক্ষেত্রে থাকতে চান, তাদের জন্যই শুধু আজ কিছু কথা বলবো। আমার পরামর্শ তিনটি – (১) অফিসের কাজে যথাযথভাবে মনোযোগ দিন, (২) জীবনসঙ্গীর সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলুন, এবং (৩) আগেভাগেই হতাশ হয়ে পড়বেন না।
(১) অফিসের কাজে যথাযথভাবে মনোযোগ দিন:
কয়েক সপ্তাহ আগের ঘটনা। ফেসবুক কার্যালয়ে আমরা অত্যন্ত সিনিয়র একজন সরকারী কর্মকর্তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। সিলিকন ভ্যালিতে কর্মরত জ্যেষ্ঠ নির্বাহীদের সাথে দেখা করার জন্য তিনি এসেছিলেন। ততক্ষণে সবাই টেবিল ঘিরে বসে পড়েছেন। কিন্তু তাঁর সাথে আসা দুইজন ভদ্রমহিলা বসলেন না। অথচ যারা নিজেরাও সংশ্লিষ্ট সরকারী বিভাগের মোটামুটি সিনিয়র কর্মকর্তা। আমি তাদেরকে বিনয়ের সাথে অনুরোধ করলাম, ‘দয়া করে আমাদের সাথে বসুন।’ কিন্তু তারা আমাদের সাথে না বসে রুমের এক প্রান্তে গিয়ে বসলেন।
কলেজে পড়ার সময় শেষ বর্ষে ‘ইউরোপিয়ান ইন্টেলেকচুয়াল হিস্ট্রি’ শিরোনামের একটি কোর্স নিয়েছিলাম। কলেজ জীবনে আপনারাও নিশ্চয় এ ধরনের কোর্স নিতে পছন্দ করতেন। আমার ধারণা, আমি এখনো এ ধরনের কোর্স নিতে পছন্দ করবো। যা হোক, আমার সাথে কোর্সটা নিয়েছিলো আমার রুমমেট ক্যারি। ও ছিলো সাহিত্যের মেধাবী ছাত্রী। পরবর্তীতে সাহিত্যের গবেষক হিসেবে সে নামডাক করেছে। আমাদের সাথে আমার ছোট ভাইও কোর্সটা নিয়েছিলো। সে তখন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। আমার এই ভাইটা দারুণ স্মার্ট। ওয়াটার-পোলো খেলার পাগল ছিলো তখন।
আমরা তিনজন একসাথে ক্লাস করতাম। ক্যারি এই কোর্সের সবগুলো বই সরাসরি ল্যাটিন ও গ্রীক ভাষায় পড়েছে। কোনো ক্লাস সে মিস দেয়নি। আমিও সবগুলো বই পড়েছি, তবে ইংরেজিতে। সবগুলো ক্লাস না করলেও বেশিরভাগ ক্লাসই করেছি। আর আমার ভাই ১২টি বইয়ের মধ্যে পড়েছে মাত্র একটি বই। সে অল্প দুয়েকটি ক্লাস করেছে। পরীক্ষার মাত্র কয়েকদিন আগেও পড়া বুঝে নেয়ার জন্য সে আমাদের রুমে আসতো।
আমরা একসাথে পরীক্ষার হলে যেতাম। সেই পরীক্ষাটিও একসাথে বসে দিয়েছিলাম। টানা তিনঘন্টা ধরে। আমাদের ছোট্ট নীল নোটবুকটার কথাও আমার মনে আছে। পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে আমরা একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করছিলাম, ‘পরীক্ষা কেমন হলো?’ ক্যারি বললো, ‘আর বলিস না! হেগেলিয়ান ডায়ালেক্টের মেইন পয়েন্টটাই লিখতে পারিনি।’ আমি আফসোস করে বললাম ‘ইশশ! জন লকের থিওরি অব প্রপার্টির সাথে যদি পরবর্তীকালের দার্শনিকদের থিওরিগুলো কানেক্ট করতে পারতাম!’ আর আমার ভাইটি কী বললো জানেন? সে বললো, ‘আমিই সবচেয়ে বেশি নম্বর পাবো।’ আমরা পুরো থ বনে গেলাম। ‘তুমি পাবে সবচেয়ে বেশি নম্বর? তুমি তো কিছুই পারো না!’
নারীরা কীভাবে নিজেদের সামর্থ্যকে নিজেরাই ছোট করে দেখে, এই ঘটনা আমাদেরকে সেটি দেখিয়ে দেয়। আপনি যদি নারী ও পুরুষদের মধ্যে একটি সার্ভে করেন এবং পরীক্ষার জিপিএর মতো একেবারেই নিরপেক্ষ কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করলেও দেখবেন– স্বভাবগতভাবে পুরুষরা কিছুটা বাড়িয়ে বলে এবং নারীরা কিছুটা কমিয়ে বলে।
কর্মক্ষেত্রে নারীরা নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যাপারে সাধারণত উচ্চবাচ্য করে না। শিক্ষাজীবন শেষ করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করা মানুষদের উপর গত দুই বছর ধরে চালানো এক গবেষণায় দেখা গেছে – ৫৭ ভাগ পুরুষ তাদের প্রথম চাকরিতে বেতন নিয়ে বোঝাপড়া করে নিয়েছে। অন্যদিকে, নারীদের মধ্যে এই হার মাত্র ৭ ভাগ।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, পুরুষরা নিজেকেই সফলতার নায়ক মনে করে, আর নারীরা নানা ধরনের বাহ্যিক বিষয়কে সফলতার কারণ মনে করে। পুরুষদের কাছে যদি জানতে চান, এত ভালো একটা চাকরি সে কীভাবে পেয়েছে? তখন তারা বলবে, ‘নিশ্চয় আমার যোগ্যতা আছে, তাই। এটা আবার জিজ্ঞাসা করার কী আছে?’ একই প্রশ্ন নারীদেরকে করলে তারা বলবে– কেউ তাকে সাহায্য করেছে, বা তিনি খুব ভাগ্যবতী, কিংবা এর জন্য তিনি অনেক পরিশ্রম করেছেন, ইত্যাদি।
বিষয়টিকে কেন আমি এতো গুরুত্ব দিচ্ছি? কারণ, আসলেই এর নানা মাত্রার গুরুত্ব রয়েছে। অফিসে নিজেকে গুটিয়ে রাখলে, নীতিনির্ধারণী আলোচনায় অংশগ্রহণ না করলে কারো পক্ষেই উচ্চপর্যায়ে যাওয়া সম্ভব নয়। নিজের যোগ্যতার উপযুক্ত মূল্যায়ন পাওয়ার চিন্তা না থাকলে, কিংবা অন্তত নিজের সফলতা সম্পর্কে উপলব্ধি না থাকলে সাধারণত কেউ পদোন্নতি পায় না।
আমার ইচ্ছে করে কর্মজীবী তরুণীদের কাছে গিয়ে বলি– ‘নিজের উপর বিশ্বাস রাখো এবং কোম্পানির সাথে দরকষাকষি করো। নিজের সফলতাকে তুলে করো।’ আমার ইচ্ছা করে, নিজের মেয়েকেও এসব বলি। কিন্তু বিষয়গুলো এতো সরল নয়। কারণ, এসব কিছুর বাইরেও গবেষণায় দেখা গেছে, সফলতা ও সৌহার্দ্যপূর্ণতার (likeability) মতো বিষয়গুলোর সাথে পুরুষদের সম্পর্ক ইতিবাচক এবং নারীদের সম্পর্ক নেতিবাচক। কথাটি শুনে প্রত্যেকেই এখন মাথা নাড়াচ্ছেন। কারণ আমরা সবাই জানি, এটি কতটা সত্য কথা।
এ বিষয়ে সত্যিই একট ভালো গবেষণা আছে, যেখানে বিষয়টি চমৎকারভাবে দেখানো হয়েছে। Heidi Roizen নামের একজন নারীর উপর বিখ্যাত হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের একটি গবেষণা রয়েছে। ওই নারী সিলিকন ভ্যালিতে একটি কোম্পানি পরিচালনা করেন। তিনি তাঁর পেশাগত দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে একজন সফল ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
এটি বেশিদিন আগের কথা নয়। ২০০২ সালের ঘটনা। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক শিক্ষার্থীদেরকে দুই ভাগে ভাগ করে এক গ্রুপকে হেইডি রোয়াইজেনের কেসটি দিয়েছিলেন। অন্য গ্রুপটিকেও একই কেস দিয়েছিলেন, তবে সেখানে ‘হেইডি’র পরিবর্তে পুরুষবাচক ‘হাওয়ার্ড’ নামটি বসিয়ে দেন। কিন্তু এই একটি শব্দের পরিবর্তনই জরিপের ফলাফলে ব্যাপক পার্থক্যের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।
এরপর তিনি শিক্ষার্থীদের মাঝে এ বিষয়ে জরিপ করলেন। শিক্ষার্থীরা নারী হেইডি এবং পুরুষ হাওয়ার্ডকে সমান দক্ষ হিসেবে বিবেচনা করলেও সবাই কেন জানি হাওয়ার্ডকেই পছন্দ করছিলো। তাদের বিবেচনায় হওয়ার্ড একজন অসাধারণ ব্যক্তি। তারা তার সাথে কাজ করতে আগ্রহী। এমনকি ছুটির দিনে তার সাথে মাছ ধরার উৎসাহও দেখাচ্ছিলো কেউ কেউ। আর হেইডি? শিক্ষার্থীরা তাকে ততটা আস্থায় নিতে পারছিলো না। যেন তার ব্যক্তিত্ব তার সাথে যথেষ্ট মানানসই নয়। তাদের ধারণায়, ভদ্রমহিলা হয়তো কিছুটা পলিটিক্যাল। এমনকি তার সাথে আদৌ কাজ করা যাবে কিনা, সে ব্যাপারেও তারা ততটা নিশ্চিত নয়। এটাই হলো সমস্যা।
আমাদের কন্যা ও সহকর্মীদেরকে বলতে হবে এবং আমাদের নিজেদেরকেও বিশ্বাস করতে হবে– আমরা পরীক্ষায় সর্বোচ্চ গ্রেড পেয়েছি। আমরা সর্বোচ্চ পদোন্নতি লাভের যোগ্য। আমরা যে কোনো নীতিনির্ধারণী কাজে অংশগ্রহণ করতে পারি। এসব আমাদের করতেই হবে। কেননা আমরা এমন এক পৃথিবীতে বসবাস করছি, যেখানে রয়েছে প্রতিযোগিতা। এখানে পুরুষরা আমাদেরকে কোনো প্রকারের ছাড় দেবে না।
এ প্রসঙ্গে আমার অত্যন্ত দুঃখজনক একটি অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমার জন্য সত্যিই এটি বিব্রতকর। ঘটনাটি মনে করাটাও দুঃস্বপ্নের মতো। তারপরও আপনাদের সামনে এটি বলা প্রয়োজন মনে করছি। কিছুদিন আগে ফেসবুক কার্যালয়ে প্রায় শ’খানেক এমপ্লয়ীর উদ্দেশ্যে আমি কিছু কথা বলেছিলাম। ঘটনাটি এর কয়েক ঘণ্টা পরের।
আমার ছোট্ট ডেস্কটির পাশে একজন তরুণী বসে কাজ করে। সেই মেয়েটি আমার সাথে কথা বলতে চাইলো। আমি রাজি হলাম। তারপর আমরা বসে কথা শুরু করলাম। সে বললো, ‘আজ আমি নতুন কিছু শিখেছি। আমি শিখেছি যে হাত তুলে রাখতে হয়।’ আমি জানতে চাইলাম– ‘তুমি কী বুঝাতে চাইছো?’ সে বললো, ‘আজকে বক্তব্য দেয়ার পর আপনি বলেছিলেন, মাত্র দুটি প্রশ্নের উত্তর দেবেন। তখন অনেকের সাথে আমি প্রশ্ন করার জন্য হাত তুলেছিলাম। আপনি দুজনের প্রশ্ন নিলেন। তারপর আমি আমার হাত নামিয়ে নিলাম এবং খেয়াল করলাম, নারীদের সবাই হাত নামিয়ে নিয়েছে। কিন্তু তারপরও আপনি আরো কয়েকটি প্রশ্ন নিয়েছেন। সবগুলোই ছিলো পুরুষদের।”
আমি চিন্তা করে দেখলাম– হ্যাঁ, তাই তো। আমি আরো প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলাম। তবে এরপরও যারা হাত তুলে রেখেছিলো, তাদের প্রশ্নের জবাবই কেবল দিয়েছিলাম। এদের মধ্যে কে পুরুষ বা কে নারী, সেটি আমি খেয়াল করিনি। কোম্পানি ও সংস্থাগুলোর নারী ম্যানেজার হিসেবে যারা কর্মরত তাদের একজন হিসেবে এখন বুঝতে পারছি, পুরুষেরা সুযোগ-সুবিধা অর্জন করার দিক থেকে নারীদের তুলনায় অনেক বেশি এগিয়ে। এখন সময় এসেছে, কর্মক্ষেত্রে নারীদের আরো বেশি সিরিয়ার হওয়ার।
(২) জীবনসঙ্গীর সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলুন:
এটি আমার দ্বিতীয় পরামর্শ। আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত, ঘর সামলানোর চেয়ে কর্মক্ষেত্রে আমরা বেশি এগিয়ে গেছি। পরিসংখ্যানগত উপাত্ত থেকে বিষয়টি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। কোনো পরিবারের একজন পুরুষ ও একজন নারী যদি ফুলটাইম বাইরে কাজ করে এবং তাদের যদি একটি বাচ্চা থাকে; তাহলে দেখা যায়, পুরুষের তুলনায় নারীকে দ্বিগুণ পরিমাণ ঘরের কাজ করতে হয়। আর বাচ্চা দেখাশোনার ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে একজন নারী তিনগুণ বেশি সময় দেয়। সুতরাং নারীরা আসলে ২/৩টি জব করছে, যেখানে পুরুষরা করছে মাত্র একটি। তারপরও যদি ঘরে আরো বেশি সময় দেয়ার প্রয়োজন হয়, তাহলে চাকরি থেকে কে ছিটকে পড়বে বলে আপনি মনে করেন?
এর কারণগুলো সত্যিই অনেক জটিল। সেগুলো নিয়ে কথা বলার মতো সময় আমার হাতে এখন নেই। তবে এর পেছনে ছুটির দিনে খেলা দেখা বা গতানুগতিক অলসতার মতো সাধারণ বিষয়কে আমি দায়ী মনে করি না। আমার মতে, এর পেছনের কারণগুলো আরো বেশি জটিল। আমাদের সমাজে সফলতা অর্জনের জন্য মেয়েদের চেয়ে ছেলেদেরকে বেশি চাপ দেয়া হয় বলে আমার ধারণা। আমি এমন পুরুষদেরকেও চিনি যারা ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত থাকা স্ত্রীদেরকে সাহায্য করার জন্য বাসায় থাকে এবং বাসার কাজকর্ম করে। এবং এটা মেনে নেয়া পুরুষদের জন্য বেশ কঠিন।
আমি যখন মায়ের সাথে গৃহস্থালীর কাজ করি, তখন বাবাও আমাদের সাথে হাত লাগান। কিন্তু অনেক মা বিষয়টিকে ভালো চোখে দেখে না বলে আমার মনে হয়েছে। এটা অন্যতম একটা সমস্যা। আমাদের বুঝতে হবে গৃহস্থালীর কাজও বাইরের কাজের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি সমানভাবে ভাগাভাগি করে নিলেও নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যেই গৃহস্থালীর কাজ হলো দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন কাজ।
গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব পরিবারে নারী-পুরুষ দুজনেই উপার্জন করে এবং সংসারের দায়দায়িত্বও সমানভাবে ভাগ করে নেয়, সেসব পরিবারে ডিভোর্সের হারও প্রায় অর্ধেক কম। এই তথ্যও যদি সবার মোটিভেশনের জন্য যথেষ্ট না হয়, তাহলে আমি আর কী বলতে পারি? এতটুক বলা যায়, দাম্পত্য জীবনেও তারা বেশ সুখী।
(৩) আগেভাগেই হতাশ হয়ে পড়বেন না:
এটি আমার তৃতীয় পরামর্শ। আমি দেখেছি, কর্মক্ষেত্রে টিকে থাকার জন্য নারীরা যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করে, সেগুলোই তাদের কর্মক্ষেত্র ত্যাগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এটা নারীদর জন্য এক ধরনের উভয়সংকট। বাস্তবে আমরা সবাই ব্যস্ত। একজন নারীও তাই স্বভাবত ব্যস্ত। এবং এই ব্যস্ত নারীটি যখন সন্তান নেয়ার কথা ভাবে, তখন থেকেই সে সন্তান লালন-পালন নিয়ে চিন্তা করতে থাকে, সন্তানের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তিনি ভাবতে থাকে। তখন তার একমাত্র ভাবনা হয়ে দাঁড়ায়– সন্তান জন্মের পর এত শত ব্যস্ততা আমি কীভাবে সামলাবো?
তখন থেকে আক্ষরিক অর্থেই অফিসের মিটিংয়ে প্রশ্ন করার জন্য তার হাত তোলা বন্ধ হয়ে যায়। পদোন্নতির জন্য তার মাঝে তেমন কোনো তাগাদা কাজ করে না। নতুন কোনো প্রজেক্ট নেয়ার কথাও সে ভাবতে পারে না। সে বলতে পারে না– ‘হ্যাঁ, আমি। এ কাজটা আমি করতে চাই’। এভাবে সে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করে।
সমস্যাটা হলো এ রকম…। যেদিন একজন নারী গর্ভবতী হয়, সেদিন থেকে তার সমস্যার শুরু। তার নয় মাস কেটে যায় গর্ভধারণে। তিন মাস কেটে যায় মাতৃত্বজনিত ছুটিতে। এর পরবর্তী অন্তত ছয় মাস সময় লাগে নিজেকে গুছিয়ে নিতে। এভাবে দ্রুতই দুই বছর সময় পেরিয়ে যায়। আমি দেখেছি, এই দীর্ঘ ঝামেলাপূর্ণ সময় সম্পর্কে নারীরা বেশ আগেভাগেই দুঃশ্চিন্তায় ভুগতে থাকে। এই দুঃশ্চিন্তা শুরু হয় কারো সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া কিংবা বিয়ের পর থেকে। এই দুঃশ্চিন্তা তাদের মধ্যে আরো বেশি জেগে ওঠে একটি সন্তান নেয়ার কথা ভাবার পর থেকে। এমনকি সম্পর্ক বা বিয়ের দীর্ঘদিন পরেও যদি তা হয়।
একবার একটা মেয়ে এ বিষয়ে আমার সাথে কথা বলতে এসেছিলো। মনে হচ্ছিলো তার বয়স খুব বেশি নয়। তাকে আমি বললাম, ‘তুমি কি এসব নিয়ে এজন্য ভাবছো যে তুমি আর তোমার স্বামী এখনই একটা বাচ্চা নেয়ার কথা চিন্তা করছো?’ তখন সে বললো, ‘আসলে তা নয়, আমি তো এখনো বিয়েই করিনি।’ এমনকি তার কোনো বয়ফ্রেন্ডও নেই। তখন তাকে আমি বললাম, ‘মাতৃত্ব নিয়ে তুমি এখনই দুঃশ্চিন্তা করছো, যেটা করার জন্য তোমার আরো অনেক সময় পড়ে আছে।’
আপনি যখন এভাবে নীরবে নিজেকে একবার গুটিয়ে নিতে শুরু করেন, তখন এর পরিণতি কী দাঁড়ায়? যারা এ পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে গেছেন তারা সবাই তা ভালো করেই জানেন। আমি আপনাদেরকে বলতে চাই– একটি সন্তানের মা হয়ে যাওয়ার পর বাড়ি ফিরে যাওয়াই আপনার জন্য ভালো। কারণ, বাচ্চাকে বাড়িতে রেখে চাকরিতে যাওয়া একজন মায়ের জন্য আসলেই খুব কঠিন কাজ। অথচ আপনার কাজটি চ্যালেঞ্জিং হওয়া চাই। যে কাজের প্রতিদান পাওয়া যাবে, সেটিই করা উচিত। ব্যতিক্রমী একটা কিছু করছেন, এই বোধ আপনার থাকা প্রয়োজন। সন্তান নেয়ার কারণে এমনিতেই আপনি কর্মক্ষেত্রে দুই বছর পিছিয়ে পড়বেন। আর এর আগে যদি প্রমোশন না নিয়ে থাকেন এবং এ সময়ের মধ্যে আপনার জুনিয়র কেউ যদি প্রমোশন নিয়ে ফেলে, তার উপর সন্তান নেয়ার চিন্তায় তিন বছর আগে থেকেই যদি নিজের জন্য নতুন সুযোগ খোঁজা বন্ধ করে দেন; তাহলে আপনি একটি অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির দিকেই এগিয়ে যাচ্ছেন।
আপনার উচিত হলো, সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করে যাওয়া। শেষ মুহূর্তের আগে প্রস্থান করবেন না। সন্তানের জন্য যখন আপনাকে কর্মক্ষেত্র থেকে বিদায় নিতেই হবে, তার আগ পর্যন্ত লেগে থাকুন। সময় হবার আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলবেন না, বিশেষত যে বিষয় সম্পর্কে আপনি এখনই নিশ্চিত নন।
দুঃখজনক সত্য হলো, শীর্ষপর্যায়ে নারীদের সংখ্যা বাড়ানোর ব্যাপারে আমার প্রজন্মের কোনো উদ্যোগ নেই। এ ব্যাপারে তারা কিছুই করছে না। নারীরা জনসংখ্যার অর্ধেক হলেও কোনো ইন্ডাস্ট্রির শীর্ষপদেই আমাদের প্রজন্মের ৫০ শতাংশ নারী যেতে পারবে না, এটি ধারণা করা যায়। তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তা পারবে বলে আমি আশাবাদী। আমি এমন এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি, যেখানে দুনিয়ার সমস্ত দেশ ও কোম্পানির অর্ধেকই পরিচালিত হবে নারীদের নেতৃত্বে। নিশ্চয় সেই পৃথিবীটা হবে আরো সুন্দর। তখন লোকেরা নিছক নারীদের বাথরুমের অবস্থান জানবে বলেই পৃথিবীটা সুন্দর হয়ে যাবে, তা নয়। আর যদি তা হয়ও, সেটাও তো মন্দ নয়। আমি মনে করি, তখনকার পৃথিবীটা সার্বিকভাবেই সুন্দর হয়ে ওঠবে।
আমার দুটি সন্তান আছে। ছেলেটির বয়স পাঁচ বছর, মেয়েটির বয়স দুই। আমি চাই, কর্মক্ষেত্র কিংবা বাসায় কাজ করা – যে কোনোটি বেছে নেয়ার পথ আমার ছেলেটির জন্য খোলা থাকুক। আর আমার মেয়ের জন্য এমন একটা সুযোগ চাই, যাতে করে কর্মজীবনে সফলতা অর্জন না করলেও সে তার সামগ্রিক অর্জনগুলোর জন্য যথাযথ মূল্যায়ন লাভ করবে।
ধন্যবাদ।
*****
শেরিল স্যান্ডবার্গের এই বক্তব্যটির পর্যালোচনা শুনুন: