জিহাদ নিয়ে ভুল বুঝাবুঝি
এডিটর’স নোট: শায়খ ড. ইউসুফ আল-কারযাভীকে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী আলেম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইসলামের নানাবিধ বিষয়ে তিনি ১২০টিরও বেশি পাণ্ডিত্যপূর্ণ বই লিখেছেন। তাঁর সবচেয়ে মৌলিক কাজগুলোর মধ্যে ২০০৯ সালে প্রকাশিত ‘ফিকহুল জিহাদ’ অন্যতম। ১৬’শ ৪৬ পৃষ্ঠার সুবিশাল এই গ্রন্থে শায়খ কারযাভী জিহাদ নিয়ে প্রচলিত ব্যাখ্যাগুলো পর্যালোচনা করে বর্তমান সময়ের আলোকে জিহাদের ধারণাকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিউনিশিয়ার ইসলামপন্থী নেতা ড. রশিদ ঘানুশী সুবিস্তৃত এই গ্রন্থের একটি পর্যালোচনা করেছেন, যার বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেছে ‘সঞ্চারণ’। বইটি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পেতে আগ্রহী পাঠক পর্যালোচনাটি পড়তে পারেন। জিহাদোফোবিয়া আর জিহাদম্যানিয়ার এই উদ্ধত সময়ে প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় বইটির একটি ক্ষুদ্র অংশ পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন শাইখুল আবরার।
*****
জিহাদ নিয়ে অনেকেই লেখালেখি করেছেন। বিভিন্ন ইসলামী ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাস্টার্স ও পিএইচডি পর্যায়ে এ বিষয়ে প্রচুর থিসিস লেখা হয়েছে। গবেষকরাও এ নিয়ে কম লেখালেখি করেননি। অন্যদিকে, এ বিষয়ে জানা ও মানা, প্রচার ও প্রয়োগের ব্যাপারে বিভিন্ন ইসলামী দল ও আন্দোলন আকৃষ্টই শুধু হয়নি, নিজেদের নামের মধ্যে পর্যন্ত জিহাদ শব্দটি জুড়ে দিয়েছে। যেমন, অনেক আরব ও মুসলিম দেশে ‘জামায়াতুল জিহাদ’ জাতীয় নামের একাধিক দল রয়েছে।
কিন্তু জিহাদের মতো ব্যাপক বিস্তৃত এই বিষয়টির ক্ষেত্রে সমস্যা হলো, বাড়াবাড়ি ও শিথিলতার মতো উভয় ধরনের প্রান্তিক অবস্থানের মাঝে প্রকৃত বাস্তবতা হারিয়ে গেছে। এই দুই প্রান্তিকতাকে কোরআনে ‘ত্বগয়ান’ ও ‘ইখসার’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
وَالسَّمَاءَ رَفَعَهَا وَوَضَعَ الْمِيزَانَ- أَلَّا تَطْغَوْا فِي الْمِيزَانِ- وَأَقِيمُوا الْوَزْنَ بِالْقِسْطِ وَلَا تُخْسِرُوا الْمِيزَانَ
“আসমানকে তিনি সমুন্নত করে রেখেছেন এবং ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। তোমরা যেন এই ভারসাম্যের ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন না করো। এবং তোমরা ন্যায্যতার সাথে পরিমাপ বা যাচাই করো, ভারসাম্য হারিয়ো না।”
[সূরা রহমান: ৫-৭]
যাইহোক, জিহাদ নিয়ে আমরা মোটাদাগে তিনটি গোষ্ঠী দেখতে পাই:
১) যারা জিহাদ ধারণাটির বিলোপ চায়
এই গ্রুপটি জিহাদের বিলুপ্তি কামনা করে। তারা চায় মুসলমানদের জীবন থেকে জিহাদের ধারণা হারিয়ে যাক। তাদের ধ্যানজ্ঞানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, মুসলমানদেরকে আধ্যাত্মিকতা, উন্নত চরিত্র ও মূল্যবোধের দীক্ষা দেয়া, যেমনটা তারা বলে থাকে। এই ব্যাপারটিকে তারা ‘নফস ও শয়তানের বিরুদ্ধে জিহাদ’ হিসেবে বিবেচনা করে একে ‘জিহাদে আকবর’ (উচ্চতর জিহাদ) দাবি করে।
অবাক করা ব্যাপার হলো, এই গ্রুপটির সাথে সেইসব সুফী ধর্মপ্রচারকের দৃষ্টিভঙ্গির মিল রয়েছে, পশ্চাৎমুখী ও পতনের যুগ থেকেই জিহাদের ব্যাপারে যারা নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে আসছে (অবশ্য সুন্নী ধারার যেসব সুফী ধর্মপ্রচারক জিহাদের ব্যাপারে ইতিবাচক ছিলেন এবং জিহাদের ময়দানে যাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে, তাদের কথা আলাদা। যেমন: আলজেরিয়ার আমীর আব্দুল কাদের, লিবিয়ার উমর মুখতার এবং সেনুসী ধারা প্রমুখ)। সেক্যুলার ও পাশ্চাত্যপন্থীদের সাথেও এই গ্রুপটির দৃষ্টিভঙ্গির মিল রয়েছে। এদের সাথে রয়েছে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ডান-বাম নির্বিশেষে উপনিবেশবাদী শক্তির দালালেরা।
এরা সবাই উম্মাহকে নিরস্ত্র করে রাখতে চায়। যেন শত্রুর সামনে মুসলমানরা একদম খালি হাতে দাঁড়াতে বাধ্য হয়। জিহাদের ধারণা এবং নতুন-পুরনো সব ধরনের জিহাদী আন্দোলনকে তারা এক চোট দেখে নেয়। জিহাদকে ‘আক্রমণাত্মক শত্রুতা’ বলেও তারা অভিযোগ করে থাকে।
উল্লেখিত এই সকল গোষ্ঠীকে নতুন-পুরনো সকল উপনিবেশবাদী শক্তি স্বাগত জানায়। এসব গোষ্ঠীকে তারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে থাকে। যেন তারা শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে এবং উপনিবেশবাদীদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য যে কোনো ধরনের সহযোগিতা করতে পারে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা ভারতীয় উপমহাদেশে ‘কাদিয়ানী’ নামে এ ধরনের একটা সম্প্রদায় গড়ে তুলেছিল। জিহাদের ধারণাকে নির্মূল করার জন্য এদের তৎপরতার কথা সর্বজনবিদিত। এই তৎপরতার উদ্দেশ্য ছিল উপনিবেশবাদের পথ পরিষ্কার করা। যেন মুসলমানদের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই তারা শাসন-কর্তৃত্ব চাপিয়ে দিতে পারে।
আরো দুঃখজনক ব্যাপার হলো, কোনো কোনো আলেম ও দাঈ আধুনিক যুগের ভালো-মন্দ, সঠিক-বেঠিক, ন্যায্য-অন্যায্য সকল প্রকার জিহাদের নিন্দা করে থাকেন। অথচ খোদাদ্রোহী শাসকদের দ্বারা সংঘটিত আইনের শাসনের ব্যত্যয়, অনৈতিকতার সয়লাব এবং যাবতীয় অন্যায়-অপকর্ম যেন সমর্থনযোগ্য! কত মানুষের খুন ঝরানো হয়েছে, কত ইজ্জত-আব্রু লুণ্ঠন করা হয়েছে, কত শত ‘হুরমত’[1] লঙ্ঘন করা হয়েছে, কত অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে, কত মানুষের মর্যাদাকে ধুলিস্যাৎ করে দেয়া হয়েছে, কত হাজারো মানুষকে অপহরণ করে নিয়ে গুম করে ফেলা হয়েছে— যারা বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে কিছুই জানা যায় না, কত মানুষকে জেলের ভেতর প্রকাশ্যে বা গোপনে মেরে ফেলা হয়েছে, এভাবে কত শত অন্যায় সাধিত হয়েছে তার কোনো সীমা পরিসীমা নেই। এই সবকিছু বুঝি বৈধ ও সমর্থনযোগ্য! অন্যদিকে, নিপীড়িত কেউ এইসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালে তা হয়ে যায় অপরাধ, তারা হয়ে যায় অপরাধী, আর তাদের কাজ হয়ে যায় অবৈধ!
হ্যাঁ, এটা ঠিক, তাদের কেউ কেউ প্রতিরোধ করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করে ফেলে। তবে তাদের তো অন্তত একটা কৈফিয়ত আছে। অথচ তাদের উপর যারা অত্যাচার করে, দ্বীনের বিরোধিতা করে, জাতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে এবং দেশে দেশে সীমালঙ্ঘন ও বিপর্যয় সৃষ্টি করে, তাদের তো সেই কৈফিয়তটুকুও থাকে না।
২) যারা পুরো দুনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বসে আছে
প্রথম গ্রুপটির একেবারে বিপরীতধর্মী আরেকটা গ্রুপ আছে। এদের বুঝ অনুযায়ী জিহাদের মানে হলো পুরো দুনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। একটি পক্ষ মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, দাওয়াতী কাজে বাধা দিয়েছে, দ্বীন পালন থেকে বিরত রেখেছে; আরেকটি পক্ষ মুসলমানদেরকে নিরাপত্তা দিয়েছে, শান্তিপূর্ণ সমঝোতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেনি, শত্রুতাও করেনি—এই দুই পক্ষের মধ্যে তারা কোনো পার্থক্য করে না।
এই গ্রুপটি মনে করে, প্রত্যেক সক্ষম মুসলমানেরই কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা অবশ্য কর্তব্য। অমুসলিমদেরকে হত্যা করার কারণ হিসেবে নিছক তাদের কুফরই (ইসলামকে অস্বীকার করা) নাকি যথেষ্ট!
তারা মনে করে, মুসলমানদেরকে যারা নিরাপত্তা দিয়েছে তাদের নিরাপত্তা প্রদান করা, যারা আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি বা আমাদের ঘরছাড়া করেনি কিংবা আমাদের ঘরছাড়া করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে, তাদের সাথে ভালো ও ন্যায্য আচরণ করা সংক্রান্ত কোরআনের আয়াত ও রাসূলের (সা.) হাদীসগুলো বা এরূপ যা কিছু আছে, সবই নাকি অস্থায়ী! এগুলোর কার্যকারিতা নাকি শেষ হয়ে গেছে! মুসহাফ তথা কোরআনের কপিগুলোতে এগুলো নাকি স্রেফ লিখিত আকারে আছে, কিন্তু কোনো তাৎপর্য নাকি আর অবশিষ্ট নেই! তাদের দাবি মতে, এ ধরনের প্রায় একশ চল্লিশ থেকে দুই’শর মতো আয়াতের কার্যকারিতা মাত্র একটি আয়াতের দ্বারা রহিত হয়ে গেছে! এই আয়াতটিকে তারা ‘আয়াতুস সাইফ’ বা ‘তরবারির আয়াত’ বলে অভিহিত করে থাকে।
তবে সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হলো, ঠিক কোনটি ‘তরবারির আয়াত’, সেটি তারা আজ অব্দি ঠিক করে উঠতে পারেনি।
তারা জাতিসঙ্ঘের সনদ মানে না। কারণ, তা নাকি উম্মাহকে জিহাদ থেকে নিবৃত রাখে, সার্বভৌম রাষ্ট্রের নিজস্ব সীমানাকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য করে এবং আঞ্চলিক বিবাদ-বিসম্বাদকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিহিত করতে তাগিদ দেয়।
এছাড়া যুদ্ধবন্দী বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তিকেও তারা অস্বীকার করে। কারণ, তাদের দৃষ্টিতে কোনো বিধিনিষেধ বা শর্ত ছাড়াই বন্দীদেরকে হত্যা করা যায়। কিন্তু এ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি তাদের অমনটা করতে বাধা দেয়।
এমনিভাবে দাস প্রথার বিলোপ সংক্রান্ত বৈশ্বিক ঐকমত্যকেও তারা প্রত্যাখ্যান করে। তাদের দৃষ্টিতে, এটি মেনে নিলে আল্লাহ কর্তৃক হালাল বিধানকে হারাম করে নেয়া হয়, যা আল্লাহর বিধানকে বাতিল করার নামান্তর!
তারা আরো মনে করে, তরবারি ও জিহাদের মাধ্যমেই দুনিয়া জুড়ে ইসলামের প্রসার ঘটেছে। দাওয়াতী কাজ, যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপন, মানুষকে বুঝানো এবং মুসলমানদের চারিত্রিক মাধুর্যের মাধ্যমে ইসলামের বিস্তৃতি ঘটেছে, তলোয়ার কিংবা বর্শা, অর্থাৎ যুদ্ধের মাধ্যমে নয় বলে যারা মনে করে — ব্রিটিশ ঐতিহাসিক ও প্রাচ্যবিদ থমাস আর্নল্ড The Preaching of Islam বইয়ে যেমনটা উল্লেখ করেছেন — এই গ্রুপটির মতে, তারা হলো বিপথগামী। কারণ, তারা নাকি মুসলমানদেরকে জিহাদ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায়। যারা এসব প্রাচ্যবিদের মতামতকে সমর্থন করে, তারা নাকি ইসলামের প্রকৃত জ্ঞান সম্বন্ধে একেবারেই অজ্ঞ। ইসলামী জ্ঞানে এদের দৌড় নাকি খুবই সীমিত। এরা নাকি শয়তান প্রাচ্যবিদদের শিষ্য!
এ ধরনের চিন্তার বেশ খারাপ প্রভাব আছে। এই জাতীয় চিন্তাভাবনা লালনের পরিণতিতে একনিষ্ঠ নিয়তের যুবকেরা স্বজাতি ও পরিবার-পরিজনদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ও তাদেরকে হত্যা করে। এরা তাদেরকে ঐসব কাফেরদের দলে গণ্য করে, যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাটা আবশ্যক। কারণ, তারা নাকি ইসলাম থেকে বের হয়ে গেছে! আর যারাই এদের সাথে ভিন্নমত পোষণ করে, তাদেরকে তারা নির্বিচারে কাফের অপবাদ দিয়ে থাকে। এমনকি আলেমগণও এই অপবাদ থেকে রেহাই পান না। এই সশস্ত্র তৎপরতায় কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি মারা গেলেও তারা পরোয়া করে না। তাদের এইসব কাজের ফলে ইসলামের উপর ‘সহিংসতার’ কলঙ্ক চেপে বসে।
এদের মধ্যে কেউ কেউ আরো এক ধাপ এগিয়ে এমনসব ব্যক্তিকে হত্যা করে যাদের সাথে তাদের কোনো সম্পর্কও নেই, সমস্যাও নেই। যেমন: পর্যটক, বিমানযাত্রী বা এ জাতীয় কেউ। এসব মানুষকে হত্যা, অপহরণ কিংবা পণবন্দী করার মাধ্যমে তারা সমাজে আতঙ্ক তৈরি করতে চায়। এসব তৎপরতার মাধ্যমে তারা ইসলামের বিরুদ্ধে ‘সহিংসতার’ পাশাপাশি ‘সন্ত্রাসবাদের’ অভিযোগ তোলার সুযোগও করে দেয়।
৩) মধ্যপন্থী ও ভারসাম্যপূর্ণ দল
তৃতীয় গ্রুপটি হলো মধ্যপন্থী দল (উম্মাতুল ওয়াসাতু)। এদেরকে আল্লাহ তায়ালা মধ্যপন্থার পথ দেখিয়েছেন, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দিয়েছেন এবং শরীয়াহ ও বাস্তবতা উভয়ের তাৎপর্য উপলব্ধির দূরদর্শিতা প্রদান করেছেন। ফলে যারা চায় উম্মাহর অধিকারগুলো শক্তিহীন থাকুক, মুসহাফ বা কোরআনের কপি জিহাদমুক্ত থাকুক, উম্মাহর সীমানা পাহারাবিহীন পড়ে থাকুক এবং জান-মাল-আব্রু অরক্ষিত অবস্থায় থাকুক— এহেন প্রথম গ্রুপটির শৈথিল্য থেকে তারা মুক্ত থাকে।
একইভাবে তারা দ্বিতীয় গ্রুপের বাড়াবাড়ি ও গোঁড়ামি থেকেও মুক্ত থাকে। দ্বিতীয় গ্রুপটি মুসলমানদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করতে চায়, দুনিয়ার সবার উপর আক্রমণ করতে চায় এবং সাদা-কালো, প্রাচ্য-প্রতীচ্য সবার বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করে। তারা দাবি করে, এসব কাজকর্মের মাধ্যমে তারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করবে এবং জান্নাতে যেতে পারবে। এ কারণে তারা মনে করে, তাদের সাথে চললে সরল সঠিক পথের দিশা পাওয়া যাবে এবং তাদের সামনে অত্যাচারী শাসকদের তৈরি বাধার পাহাড় দূর হয়ে যাবে। কোনো রকম বিকৃতি ও প্রপাগান্ডা না করে স্পষ্টভাবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) দাওয়াত মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়াটা এদের জন্য যেন বেজায় কষ্টসাধ্য ও অসম্ভব ব্যাপার।
এটা ঠিক, অতীতকালে জিহাদের এই পদ্ধতিটি ঠিকই ছিল। কারণ, তখন কায়সার ও কিসরা কিংবা তাদের মতো অত্যাচারী শাসকেরা তাদের জাতির সামনে প্রতিবন্ধক হয়ে থাকতো। তাই তাদেরকে পরাজিত ও জোরপূর্বক বিতাড়িত না করে মানুষের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানো অসম্ভব ছিল। এই বাস্তবতার কারণেই সাহাবী ও তৎকালীন মুসলমানরা এই পন্থা অবলম্বন করেছিলেন।
কিন্তু বর্তমানে আমাদের জন্য এই পন্থা অবলম্বনের আর দরকার নেই। কারণ, আধুনিক মিডিয়ার কল্যাণে আমরা ইসলামের দাওয়াতকে বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে দিতে পারছি, আমাদের বক্তব্যগুলো শোনাতে পারছি। কোনো কর্তৃপক্ষ এই কাজকে থামিয়ে দিতে পারছে না।
দাওয়াতী কাজের জন্য এখন আমাদের হাতে রয়েছে বিশ্বব্যাপী প্রচার ক্ষমতাসম্পন্ন স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল, রেডিও স্টেশন এবং ইন্টারনেট। কারো অনুমতির অপেক্ষা না করেই এই প্রচারমাধ্যমগুলো সবার ঘরে ঢুকে পড়ে। এছাড়া রয়েছে আর্ন্তজাতিক ভাষায় লিখিত বিভিন্ন প্রবন্ধ ও পুস্তিকা। এইসব উপকরণ ও মাধ্যমই আমাদের যুগের জিহাদের জন্য শক্তিশালী ও কার্যকর অস্ত্র। তবে এগুলোকে কাজে লাগাতে হলে আমাদের দরকার একদল দক্ষ, বিশ্বস্ত ও শক্তিশালী দাঈ, প্রশিক্ষক ও মিডিয়াকর্মী। তাদেরকে সময়োপযোগী পদ্ধতিতে নানা ভাষাভাষী মানুষের কাছে ইসলামের বক্তব্য তুলে ধরতে সক্ষম হতে হবে। যেন তারা মানুষকে ভালোভাবে বুঝাতে পারেন এবং তাদের চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করতে পারেন।
কিন্তু দুঃখজনক সত্য হলো, এই গুরুত্বপূর্ণ ময়দানে প্রতি দশজনে একজন, এমনকি হাজারে একজন লোকও আমাদের নেই।
ইন্টারনেটে আমাদের বৈশ্বিক ওয়েবসাইট www.Islamonline.net উদ্বোধনের দিন আমি বলেছিলাম, নিশ্চয় এই কার্যক্রমগুলো এখনকার সময়ের জিহাদ। যারা মুজাহিদ হতে ইচ্ছুক, যারা আত্মত্যাগ, ধনসম্পদ বা শ্রম দেয়ার মাধ্যমে আল্লাহর পথে জিহাদের মর্যাদা লাভ করতে চান, তাদের জন্য এটিই হলো আজকের যুগের জিহাদ। এখনকার জন্য এটিই হলো বড় ও দীর্ঘমেয়াদী জিহাদ।
নোট:
[1] মান-মর্যাদা, আশ্রয়, নিরাপত্তা, স্ত্রী, নারী— এসবকে একত্রে ‘হুরমত’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। এর শাব্দিক অর্থ হলো নিষিদ্ধতা। ইসলামে যেহেতু উল্লেখিত বিষয়গুলো অন্যায়ভাবে লঙ্ঘন করা নিষিদ্ধ, তাই এগুলোকে একত্রে ‘হুরমত’ বলা হয়। — অনুবাদক