মাকাসিদে শরীয়াহর আলোকে মসজিদ ও নারী প্রসঙ্গ

মাকাসিদে শরীয়াহর আলোকে মসজিদ ও নারী প্রসঙ্গ: অনুবাদকের ভূমিকা

ইসলামী সমাজের কেন্দ্র হলো মসজিদ। মসজিদ কেবল ইবাদতের স্থানই নয়, এটি ইসলামী সমাজের একটি প্রতিচ্ছবিও বটে। ইতিহাসে ফিরে তাকালে আমরা দেখব, রাসূল (সা) মদীনায় যাওয়ার পর সর্বপ্রথম একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। তারপর গড়ে তুলেছিলেন মদীনার সমাজ। মদীনায় একটি নতুন সমাজ গড়ার জন্যে মসজিদকে তিনি কর্মস্থল হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন।

নতুন কোনো সমাজ গড়ার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধসহ সকলের অংশগ্রহণ থাকতে হয়। রাসূল (সা) মদীনায় ঠিক সেই কাজটিই করেছিলেন। মদীনার মসজিদে তিনি সমাজের সকল স্তরের মানুষের অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করেছিলেন। বিশেষত, নারীদের অংশগ্রহণকে রাসূল (সা) খুবই গুরুত্বের সাথে দেখেছিলেন। নামাজ আদায়ের জন্যে নারীদের মসজিদে প্রবেশ, মসজিদ পরিচর্যার কাজে নারীদের নিয়োগ এবং সামাজিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণকে তিনি নিশ্চিত করেছিলেন।

ইসলামী সমাজে নারীরা জাহেলী যুগের মতো অসম্মানিত ও পরিত্যাজ্য হিসাবে যেমন বিবেচিত হয় না, তেমনি বর্তমান যুগের মতো পণ্য হিসাবেও ব্যবহৃত হয় না। বরং ‘আল্লাহ্‌র দরবারে নারী-পুরুষ উভয়ে সমান মর্যাদার অধিকারী’ – এই মৌলিক সূত্রের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠে ইসলামী সমাজ। এবং এমনই ছিল রাসূলের (স) ইসলামী সমাজের চিত্র। এভাবে সাহাবীদের যুগ পর্যন্ত নারীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মসজিদে অংশগ্রহণ করতে পেরেছেন।  তারপর ধীরে ধীরে অধিকাংশ মসজিদে নারীদের প্রবেশাধিকার রহিত হয়ে যায়।

অথচ আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলছেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا نُودِيَ لِلصَّلَاةِ مِن يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَىٰ ذِكْرِ اللَّهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ ذَٰلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ

“হে ঈমানদারগণ, জুমার দিনে যখন নামাজের জন্যে আজান দেয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে ত্বরা করো এবং বেচাকেনা ত্যাগ করো। এটা তোমাদের জন্যে উত্তম যদি তোমরা উপলব্ধি করো।” (সূরা জুমা: ৯)

এখানে স্পষ্ট বলা হচ্ছে যে, যাদের ঈমান আছে – হোক নারী বা পুরুষ – সবাইকে জুমার নামাজে অংশ নিতে হবে। আর জুমার নামাজ একাকী বাড়িতে বসে হয় না, এর জন্যে মসজিদে আসতে হয় এবং সামষ্টিকভাবে এই সালাত আদায় করতে হয়।

অন্য একটি আয়াতে আল্লাহ তায়ালা মরিয়মকে (আ) এই বলে আদেশ করছেন:

يَا مَرْيَمُ اقْنُتِي لِرَبِّكِ وَاسْجُدِي وَارْكَعِي مَعَ الرَّاكِعِينَ

হে মারিয়াম! তোমার পালনকর্তার উপাসনা করো, সেজদা করো এবং রুকুকারীদের সাথে রুকু করো। (সূরা আলে ইমরান: ৪৩)

আল্লাহ তায়ালা মরিয়মকে (আ) বলেছেন, ‘রুকুকারীদের’ সাথে রুকু করো। এখানে “الرَّاكِعِينَ” বা ‘রুকুকারী’ একটি পুরুষবাচক শব্দ, যা পুরুষদের জন্যেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অর্থাৎ, মরিয়মকে (আ) আল্লাহ তায়ালা পুরুষদের সাথেই সালাত আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। এ আয়াতটি কোরআনে পুনর্বর্ণনার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা পরবর্তী নারীদেরকেও একই নির্দেশ দিচ্ছেন। অথচ আমরা আজ মসজিদে নারীদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করে দিয়েছি!

মসজিদে নারী-পুরুষের প্রবেশাধিকার নিয়ে মুসলিম সমাজ এখন স্পষ্টতই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একদিকে, বাংলাদেশসহ অধিকাংশ মুসলিম দেশে মসজিদে নারীদের প্রবেশাধিকার কার্যত নিষিদ্ধ। অল্প কিছু মসজিদে নারীদের নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা থাকলেও তা রাসূলের (সা) সুন্নত মোতাবেক নয়। অর্থাৎ, নারীদেরকে পুরুষদের সাথে একই ফ্লোরে নামাজ আদায়ের অনুমতি দেয়া হয় না। এর বিপরীতে, ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়ার বেশকিছু দেশে নারীরা এখন মসজিদ নির্মাণ করছে। এসব মসজিদে পুরুষের প্রবেশাধিকার নিষেধ। সেখানে আজান, ইকামত ও ইমামতিসহ  সব কাজ  নারীরাই করে থাকে। তাদের বক্তব্য  হলো – পুরুষদের মসজিদে যেহেতু আমরা প্রবেশ করতে পারি না, তাই আমাদের মসজিদেও পুরুষেরা প্রবেশ করতে পারবে না। আমরাই আমাদের ইমাম হবো এবং আমাদের মসজিদে আমরাই খুতবা দিবো।

ইবাদতের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের এই দ্বন্দ্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। পুরুষেরা যেমন রাসূলের (সা) সুন্নত থেকে সরে গিয়ে এক ধরনের কঠোর পন্থা অবলম্বন করছে, নারীরাও তেমন রাসূলের (সা) সুন্নত থেকে সরে গিয়ে আরেক ধরনের কঠোর পন্থা বেছে নিচ্ছে। কেউ বলছে, পুরুষদের মসজিদে নারীদের প্রবেশ নিষেধ; আবার কেউ বলছে, নারীদের মসজিদে পুরুষদের প্রবেশ নিষেধ। আদতে, এ দুটি ধারণাই সমভাবে উগ্র এবং তা রাসূলের (সা) সুন্নত বিরোধী।

মুসলিম সমাজকে এই উভয় ধরনের উগ্রতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আমাদেরকে অবশ্যই আবার রাসূলের (সা) সুন্নতের দিকে ফিরে যেতে হবে। রাসূলের (সা) যুগে নারী সাহাবীরা কীভাবে নামাজ আদায় করতেন? কোথায় নামাজ আদায় করতেন? তখন নারীদের ধর্মীয় ও সামাজিক মর্যাদা কেমন ছিল? কীভাবে রাসূলের (সা) সময়ের একটি ছোট্ট সমাজ পরবর্তীতে বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়েছিল? সেখানে নারীরা কী ধরনের ভূমিকা পালন করেছিল? – এসব আমাদের জানতে হবে।

মসজিদে নারীদের প্রবেশাধিকার, অবস্থান ও কার্যক্রম ইত্যাদি নিয়ে শায়খ ড. জাসের আওদা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি গবেষণাকর্ম করেছেন। বইটির আরবী শিরোনাম হচ্ছে أسئلة حول المرأة والمسجد في ضوء نصوص الشريعة ومقاصدھا ‘মাকাসিদে শরীয়াহর আলোকে মসজিদ ও নারী প্রসঙ্গ’– বাংলায় এ রকম একটি চলতি অর্থ করা যায়। যাইহোক, বইটিতে তিনি বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। কোরআন, হাদীস, রাসূলের (সা) সুন্নাহ ও সাহাবীদের ঘটনাবলির আলোকে প্রশ্নগুলোর বিশ্লেষণধর্মী উত্তরও তিনি দিয়েছেন। সূচিপত্রে শিরোনাম আকারে থাকা প্রশ্নগুলোর বাংলা অর্থ নিম্নরূপ:

mosque-and-women-auda১) নারীদের কি মসজিদে প্রবেশাধিকার আছে? নাকি, তাদেরকে মসজিদে ঢুকতে না দেয়াই উত্তম?

২) নারীরা মসজিদের কোথায় নামাজ আদায় করবে?  রাসূলের (সা) যুগে নারীরা কোথায় নামাজ আদায় করত?

৩) মসজিদে নারী ও পুরুষের ‘স্বাভাবিক’ কথাবার্তা ও কাজকর্ম কি বৈধ?

৪) মসজিদে নারীদের কি বিশেষ ধরনের পোশাক পরিধান করতে হয়?

৫) জুমা ও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামায়াতে পড়তে নারীদের মসজিদে আসায় কি কোনো ফজিলত  আছে?

৬) কোনো ঋতুবতী নারী নামাজ ব্যতীত এমনিতে মসজিদে অবস্থান করতে পারবে কি? এ অবস্থায় তার জন্য কি কোরআন পড়ার অনুমোদন আছে? হজ্জ্বের সময় ঋতুস্রাব হলে কি করা উচিত?

৭) কোনো নারী কি নারীদের জামায়াতের ইমাম হতে পারবে? নারীর পক্ষে কি কখনো পুরুষদের ইমাম হওয়া জায়েজ?

৮) নারীরা কি মসজিদে ইতেকাফ কিংবা  কোনো জনকল্যাণমূলক কাজে অংশগ্রহণ করতে পারবে?

৯) নারীরা কি মসজিদে নারী ও পুরুষের মিশ্র সমাবেশে পাঠদান করতে পারবে?

১০) নারীরা কি মসজিদের পরিচালনা কমিটির সদস্য কিংবা কমিটির প্রধান হতে পারবে?

সূচিপত্রটির এই উপস্থাপনা থেকে গবেষণাকর্মটি সম্পর্কে পুরোপুরি জানা সম্ভব না হলেও কিছুটা ধারণা পাওয়া সম্ভব। বাংলাদেশের মতো মুসলিম সমাজে যেখানে নারীদের মসজিদে প্রবেশ কার্যত নিষিদ্ধ, সেই প্রেক্ষিতে উস্তাদ জাসের আওদার এই বইটি ইসলামী সমাজ বিনির্মাণ কর্মীদের জন্য একটি পাথেয় হতে পারে।

গত মাসে ‘রাজনীতির সাথে মুসলমানদের সম্পর্ক’ শিরোনামে জাসের আওদার একটি খুতবার অনুবাদ সিএসসিএস-এ প্রকাশিত হয়েছিল। সেই অনুবাদের সূত্র ধরে শায়খ আওদা এই বইটি বাংলায় অনুবাদের জন্য আমাকে অনুরোধ করেছেন। সমাজ ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন কেন্দ্রের (সিএসসিএস) মাধ্যমে বইটির ধারাবাহিক অনুবাদ প্রকাশ করা হবে, ইনশাআল্লাহ।

এ ধরনের আরো লেখা