মৃত্যুদণ্ডই কি মুরতাদের একমাত্র শাস্তি?

এডিটর’স নোট: মুরতাদ বা ধর্মত্যাগীদের সম্পর্কে ইসলামের অবস্থান কী? বাংলাদেশে এটি সাম্প্রতিককালে আলোচিত ইস্যু। প্রভাবশালী ইসলামী স্কলার ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তারিক রমাদান ২০০৯ সালে প্রদত্ত The Scope and Limits of Reforming Islam শীর্ষক একটি বক্তৃতা অনুষ্ঠানে একজনের প্রশ্নের উত্তরে এ বিষয়ে অভিমত তুলে ধরেন। প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনা করে সিএসসিএস-এর পাঠকদের জন্য এটি অনুবাদ করেছেন আইয়ুব আলী।

*****

মুসলমানরা সচরাচর এমন কিছু ইস্যুর মুখোমুখি হয়ে থাকে, যেগুলো নিয়ে কথা বলতে তারা প্রস্তুত নয় কিংবা বিব্রতবোধ করে। উদাহরণ হিসেবে ধর্মত্যাগের বিধান তথা ‘হুকমুর রিদ্দা’র কথা বলা যায়। ‘কোনো মুসলমান ধর্মত্যাগ করতে পারে না’— এমনটা বলা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত?

অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে অধিকাংশ আলেমই এর পক্ষে মতামত দিয়েছেন। তাদের মতামতের পক্ষে দলীল হচ্ছে একটি হাদীস— ‘যে ব্যক্তি ধর্মত্যাগ করবে তাকে হত্যা করো।’ আরেকটি হাদীসে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি (মুসলিম) সম্প্রদায় থেকে বেরিয়ে যায়, তাকে হত্যা করা বৈধ।’ এই হাদীসগুলোর উপর ভিত্তি করে কিছু আলেম বলে থাকেন, ‘এটা পরিষ্কার যে আপনি ধর্মত্যাগ করতে পারেন না।’

আমি এ বিষয়গুলো নিয়ে সচেতন। তারপরও মনে করি, এই মতামত সঠিক নয়।

অষ্টম শতাব্দীর প্রখ্যাত মুসলিম স্কলার সুফিয়ান আস-সাওরীও এই মতামতকে সঠিক নয় বলে উল্লেখ করেছেন।

প্রথমত, ধর্মত্যাগের কারণে রাসূল (সা.) কখনোই কাউকে হত্যা করেননি।

দ্বিতীয়ত, ব্যাপারটি যুদ্ধের সাথে সম্পর্কিত। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে শত্রুপক্ষের কেউ কেউ মুসলিম শিবিরের তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ইসলাম গ্রহণ করতো। তারপর নিজেদের শিবিরে ফিরে যেতো। তারা ছিলো মূলত বিশ্বাসঘাতক। তাদের এই তৎপরতার সাথে প্রচলিত ধর্মত্যাগের কোনো সম্পর্ক নেই।

মহানবীকে (সা.) নিয়ে আমি একটি বই লিখেছি। সেটি লেখতে গিয়ে আমি রাসূলের (সা.) জীবদ্দশায় ধর্মত্যাগ সংক্রান্ত তিনটি ঘটনা খুঁজে পেয়েছি। এগুলো থেকে আমরা দেখতে পাই, নিছক ধর্মত্যাগের কারণে তিনি কাউকে হত্যা করেননি।

প্রায় বিশ বছর ধরে আমি এসব কথা বলে আসছি। এ কারণে কেউ কেউ, বিশেষ করে মরিশাসের মুফতি আমার ব্যাপারে বলেছেন, ‘তারিক রমাদান একজন কাফের, মুরতাদ।’ তখন ইসলামের ট্র্যাডিশন থেকে উদাহরণ দিয়ে আমি বললাম, ‘আপনি কী বলতে চাচ্ছেন? আমি তো নিজ থেকে কিছু বলিনি। অষ্টম শতাব্দীর আলেমগণ যা বলে গেছেন, আমি সেগুলোই বলছি মাত্র। আমি তো দলীল দিয়েছি। আমাকে বলুন, ধর্মত্যাগের কারণে রাসূল (সা.) কাউকে হত্যা করেছিলেন কিনা। আমাকে দেখান। আমি দেখতে চাই।’ এখন পর্যন্ত আমি এর জবাব পাইনি।

মিশরের গ্র্যান্ড মুফতি শায়খ আলী জুমা সম্প্রতি ওয়াশিংটন পোস্টের সহযোগী প্রকাশনা নিউজউইকে ‘ধর্মবিশ্বাস’ (faith) সম্পর্কে ঠিক এই কথাই বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘কেউ সজ্ঞানে ধর্মত্যাগ করলে তাকে হত্যা করতে হবে— এমনটা আপনি বলতে পারেন না। এটা একান্তই একটা ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপনি এমন কাউকে হত্যা করতে পারেন না।’ এই বক্তব্য প্রকাশের দুইদিন পর মিশরের দারুল ইফতা কাউন্সিল তাদের নিকট একটা বিবৃতি পাঠায়। এতে বলা হয়, ‘তার বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে।’ তারপরের ঘটনা বেশ মজার। এর পরদিন শায়খ জুমা একটি বিবৃতি পাঠান, যাতে বলেন, ‘না (ভুল ব্যাখ্যা করা হয়নি), আমি নিজেই এই বক্তব্য দিয়েছি।’

আমি মনে করি, এ ধরনের স্পর্শকাতর বিষয়ে কথা বলার ক্ষেত্রে আলেমদের এগিয়ে আসা উচিত। ইসলামী ট্র্যাডিশনের অধিকাংশ আলেম ধর্মত্যাগীদেরকে হত্যা করার কথা বলেছেন, এটা সত্য। কিন্তু সেই অষ্টম শতাব্দীর একজন আলেমও এর সাথে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন। যদিও এ ধরনের আলেমদের সংখ্যা কম ছিলো; কিন্তু আমাদের অবস্থান হওয়া উচিত ইসলামের প্রামাণ্য উৎস ও দলীলের ভিত্তিতে।

আমি নিজে ঠিক এটাই করার চেষ্টা করি। এ ব্যাপারে আমার বক্তব্য হলো— স্বাধীনতার প্রশ্নে ব্যক্তিকেই সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ দিতে হবে। কেউ ইসলাম ত্যাগ করলে অবশ্যই আমি খুশি হবো না। কিন্তু দিনশেষে এটা ব্যক্তির নিজস্ব পছন্দের ব্যাপার। বরং আমার নিজেকেই প্রশ্ন করা উচিত, ‘তাদেরকে আমরা কী ধরনের শিক্ষা দিয়েছি!’ মুসলমানদের এটা পরিষ্কার করে বলা উচিত। কিন্তু তারা তা করছে না। তারা খ্রিস্টানদের ইসলাম গ্রহণের স্বাধীনতা থাকা উচিত বলে মনে করে। অথচ নিজেদের জন্য প্রযোজ্য অনুরূপ বিষয়ে তারা নিশ্চুপ। এটি এক ধরনের স্ববিরোধিতা।

ভবিষ্যতে আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নিজেদের ধর্ম সম্পর্কে নিঃসংশয় হওয়া। এতে আশঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই…। এটি যদি হক হয়, তাহলে এতে অসুবিধারও কিছু নেই। উসূল বা মূলনীতি নিয়ে স্ববিরোধিতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা দরকার, যা আজকাল হচ্ছে না।

এ ধরনের আরো লেখা