মোস্তফা আকিউল

নয়া তুরস্কে ধর্ম ও গণতন্ত্র

এডিটর’স নোট: তুর্কি সাংবাদিক ও লেখক মোস্তফা আকিউল তাঁর স্বতন্ত্র, স্বাধীন ও অকপট বক্তব্যের জন্য পরিচিত। ‘ইসলাম উইদাউট এক্সট্রিমস’ তাঁর সাড়া জাগানো বই। ‘আরব বসন্ত’ প্রভাবিত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে তুর্কি মডেলের শাসনব্যবস্থার দাবি উঠেছিল। সেই প্রেক্ষিতে আমেরিকান পাবলিক মিডিয়ার রেডিও শো On Being প্রোগ্রামের উপস্থাপক ক্রিস্টা টিপেট ২০১২ সালের জুলাই মাসে আকিউলের একটি নাতিদীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেন। আকিউল তাঁর ব্যক্তিজীবনে ধর্মের ভূমিকা, তুরস্কের সমাজ ও রাষ্ট্রে ইসলামের প্রভাব, একেপি’র শাসনব্যবস্থাসহ নানা বিষয়ে খোলামেলা কথাবার্তা বলেন। এতে একটি ‘নয়া তুরস্কের’ চিত্র উঠে আসে। সিএসসিএস-এর পাঠকদের জন্য উপস্থাপক ক্রিস্টা টিপেটের ভূমিকাসহ সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন আবিদুল ইসলাম চৌধুরী।

*****

পশ্চিমা প্রকাশনা ছাড়াও তুর্কি ও ইংরেজি ভাষায় বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত মোস্তফা আকিউলের বেশকিছু লেখালেখি রয়েছে। তুরস্কে চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে ১৯৭২ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বিংশ শতকের মাঝামাঝিতে দেশটিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে তখন পর্যন্ত দুই বার সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। তৃতীয় অভ্যুত্থানের আগ পর্যন্ত রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করতে থাকে। এসবের মাঝেই আকিউল বেড়ে উঠেন। তাঁর জীবনের গল্পগুলোর মধ্য দিয়ে সাম্প্রতিক দশকগুলোতে তুরস্কে ঘটে যাওয়া পরিবর্তনগুলো ধরা পড়ে। দাদা ধর্মিক মুসলমান হলেও বেড়ে ওঠার বয়সগুলোতে তিনি তাঁর বাবাকে দেখেছেন আতাতুর্কের গড়া সেক্যুলারিজমের সমর্থক হিসেবে। তাঁর বাবা সাংবাদিক ছিলেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এরদোয়ান ধার্মিক মুসলিম। জনাব আকিউল নিজেকে একাধারে এরদোয়ানের সমর্থক ও সমালোচক মনে করেন।

***

ক্রিস্টা টিপেট: আপনি জানেন, এক সময় গোটা মধ্যপ্রাচ্য উসমানীয় সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। আমরা আজকে যে জায়গাটায় বসে কথা বলছি সেটা ছিল এই সাম্রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র। তো মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান অবস্থাকে কীভাবে দেখছেন?

মোস্তফা আকিউল: আমি মনে করি মধ্যপ্রাচ্যে উসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রভাব এখনো রয়েছে।

ক্রিস্টা টিপেট: অবশ্যই, এ অঞ্চলে উসমানীয় সাম্রাজ্য এখনো তাৎপর্য বহন করে।

মোস্তফা আকিউল: আমরা যেটাকে আজকে মধ্যপ্রাচ্য বলছি, সেটা বিংশ শতক পর্যন্ত উসমানীয় সাম্রাজ্য হিসেবে পরিচিত ছিল। একজন তুর্কি হিসেবে কথাটা আমি অহংকার বা জাতীয়তাবাদের তাত্ত্বিক বোধ থেকে বলিনি। বলেছি এ অঞ্চলের পরিবর্তন ও সংস্কারের মানসিকতা এবং গণতান্ত্রিকতার ঐতিহাসিক ধারার ওপর ভিত্তি করে। দীর্ঘ একটা সময় পর্যন্ত উসমানীয় সাম্রাজ্য আধুনিকায়নের ধারায় নিজেকে উন্নীত করার চেষ্টা করেছে। উসমানীয় শাসকদের আধুনিকায়নের এই চিন্তাভাবনা ও পদক্ষেপ নিয়ে এখানে কিংবা পশ্চিমে– কোথাও কোনো আলোচনা হয়নি।

পতন মুহূর্তেও এই সাম্রাজ্যের শাসনব্যবস্থা মধ্যযুগের অন্যসব রাজতন্ত্রের মতো ছিল না। বলা যায়, এটি ছিল এক ধরনের সাংবিধানিক রাজতন্ত্র। সেখানে আইনসভা ছিল। ছিল এর নির্বাচিত সদস্যবৃন্দ। শুধু কি তাই? ইহুদী এবং খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারীদেরও আইনসভার সদস্য হওয়ার সুযোগ ছিল। সেই আইনসভায় প্রণীত আইনগুলোতে নারীদের সমান অধিকারের বিষয়টি নিশ্চিত করা হতো। উসমানীয় সাম্রাজ্যে খ্রিস্টান এবং ইহুদীরা অন্য সবার মতো একই রকম নাগরিক মযার্দা ভোগ করতো, যা এখন পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশে নেই। অভিজাত শ্রেণী, প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গ এবং আলেমদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণ করা হতো।

ইসলাম ও গণতন্ত্রের কথাই ধরুন। এ দুটোর মধ্যে সমন্বয় হতে পারে কি, পারে না– তা নিয়ে এখন নতুন করে বির্তক হচ্ছে। অথচ একবিংশ শতকের প্রথম থেকেই উসমানীয় গবেষকরা এসব নিয়ে আলোচনা করতেন। উসমানীয় বুদ্ধিজীবী নামিক কামাল (Namik Kemal) বলেছিলেন, গণতন্ত্র আদতে ইসলামের পরামর্শের ধারণার (শু’রা) সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। স্বাধীনতা ও মুক্তির পশ্চিমা মূলনীতি এবং ব্যক্তি অধিকারের ধারণা– এগুলো মূলত আমাদের জীবনব্যবস্থার শেকড় থেকেই উঠে এসেছে।

ক্রিস্টা টিপেট: এখানে ব্যক্তির দায়-দায়িত্বের ওপর কতটুকু গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে? এবং তা গণতন্ত্রের আদর্শের সাথে কতটুকু সংগতিপূর্ণ?

মোস্তফা আকিউল: একথা স্বীকার করতে হবে, রাজনৈতিক উদারতার ভিত্তি যেখানে দুর্বল সেখানে গণতন্ত্রের অবস্থা খুবই নাজুক। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্রায়নের নামে যা হচ্ছে তা অনেকটা উপর থেকে চাপানো। যেটাকে উদার গণতন্ত্র না বলে নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র বলা যেতে পারে। এ অবস্থায় সেখানে ব্যক্তি স্বাধীনতার চর্চা বিপজ্জনক। এ সমস্যাটা তুরস্কেও একটু আধটু লক্ষ্য করা যায়। এমনকি আমি নিশ্চিত বলতে পারি, এই সমস্যা তিউনিসিয়া এবং মিশরেও বিদ্যমান।

মোস্তফা রশিদ পাশা। উসমানী খেলাফতের এই কর্মকর্তা ছিলেন তানজিমাতের মূল কারিগর
উসমানী খেলাফতের কর্মকর্তা মোস্তফা রশিদ পাশা ছিলেন তানজিমাতের মূল কারিগর

অথচ, ঊনিশ শতকের শেষদিকে উসমানীয় খিলাফত ‘তানজিমাত’ নামে আধুনিকায়ন শুরু করেছিল। সে সময় খিলাফত ছিল পুরো পৃথিবীতে একমাত্র সর্বোচ্চ ইসলামী কর্তৃপক্ষ বা সরকার ব্যবস্থা। ওই সময়ে তারা সত্যিই কিছু উদার পশ্চিমা ধ্যান-ধারণা গ্রহণের চেষ্টা করছিল। এসবের সাথে পশ্চিম থেকে ফ্যাসিজম ও একদলীয় শাসনের মতো কিছু বাজে আদর্শও এ অঞ্চলে অনুপ্রবেশ করেছে। যেমন সিরিয়ায় এই নেতিবাচক ব্যবস্থা এখনো প্রভাব বিস্তার করে আছে। তাই বলা যাবে না যে, পাশ্চাত্যের কাছ থেকে আসা সবগুলো আদর্শই ভালো। অবশ্য, উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটা পশ্চিমা আধুনিকতার তুলনামূলক ভালো দিক। আমি মনে করি, ঊনিশ শতকের শেষ এবং বিংশ শতকের শুরুর দিকে উসমানীয়দের চলমান এই আধুনিকায়ন প্রচেষ্টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তারা খুব ভালোভাবেই আধুনিকায়নের সাথে ছন্দ মেলাতে সচেষ্ট ছিল। তাই বলা যেতে পারে, গণতন্ত্রের চেতনা এ অঞ্চলের জন্য নতুন কিছু নয়।

ক্রিস্টা টিপেট: আপনার এ কথার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে এসেছে।

মোস্তফা আকিউল: হ্যাঁ, কিছুটা তো বটেই। এছাড়া আমি ঊনিশ শতকের উসমানীয় আমলে সংস্কারের ব্যাপারটাও উল্লেখ করবো। যেমন ধর্মত্যাগের (মুরতাদ) কথাই ধরুন। এটা অনেকটা এক ধর্ম ত্যাগ করে অন্য ধর্ম গ্রহণ করার মতো। ক্লাসিক্যাল ইসলামী আইনে ধর্মত্যাগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যদিও আমি মনে করি, এর ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করা উচিৎ নয়। তবে আপনি যদি বিষয়টার গোড়ায় যান তাহলে দেখবেন, ধর্মত্যাগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে মূলত রাজনৈতিক কারণে। সে সময় নিজের দলের কেউ ধর্মত্যাগ করার অর্থ ছিল যুদ্ধের মাঠে প্রতিপক্ষের দল ভারী করা।

দৃশ্যত উসমানীয় শাসকরা বাস্তবতা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তাই ধর্মত্যাগকে ব্যক্তির ইচ্ছাধীন করে দেয়া হয়েছিল। পরিবেশটা এমন করে দেয়া হয়েছিল যে, কোনো মুসলিম ইচ্ছে করলে খ্রিস্টান ধর্মও গ্রহণ করতে পারতো। এমনকি খোলাখুলিভাবে নাস্তিকতার চর্চাও করতে পারতো। সে সময় অনেকেই ছিল ইউরোপের বস্তুবাদী চিন্তাবিদদের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা অনুপ্রাণিত। কই, এ জন্যে তো উসমানীয় সাম্রাজ্যের আলেমগণ শিরশ্ছেদ বা পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা করার ফতোয়া দেননি! বরং তাঁরা বস্তুবাদী দর্শনের গঠনমূলক সমালোচনা করে বই লিখেছেন। পাশাপাশি ইসলামী দর্শনকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।

তো, আমি মনে করি মধ্যপ্রাচ্যের জন্য আসলে কী ধরনের ব্যবস্থা দরকার তা নিয়ে উন্মুক্ত আলাপ-আলোচনা হওয়া জরুরি। যারা মনে করেন- এ অঞ্চলের লোকজন উদারতা ও মুক্তচিন্তার ধারা সম্পর্কে অজ্ঞ- তারা আসলে ভুলের মধ্যে আছেন। এখানে আগে থেকেই উদারতাবাদের একটা ধারা ছিল। তবে এটাও সত্য, রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে কর্তৃত্ববাদী এবং স্বৈরশাসনের ধারাও ছিল। এ অঞ্চলের মানুষগুলো পুরো শতাব্দী জুড়ে এসবের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে।

ক্রিস্টা টিপেট: আপনি আধুনিক তুরস্ক বলতে কী বুঝেন? প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক সেক্যুলার আদর্শে যে তুরস্ককে গড়ে তুলেছেন সেটাকে কীভাবে দেখেন? আপনি তো এগুলোর মধ্যে বেড়ে উঠেছেন। আমি আসলে আতাতুর্ক সস্পর্কে জানতে খুবই আগ্রহী। কারণ গত দুদিন এখানে থেকে বুঝতে পেরেছি, আতাতুর্ক এখনো একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব।

মোস্তফা আকিউল: হ্যাঁ, একেবারে পূজনীয় ব্যক্তিত্ব বলা চলে।

ক্রিস্টা টিপেট: তাহলে আতাতুর্ক এবং তুর্কি পরিচয় নিয়ে আপনার অভিমত কী? এক্ষেত্রে কোনটাকে সেক্যুলার বলা চলে?

মোস্তফা আকিউল: চমৎকার প্রশ্ন। আমার মনে হয়, আসলে সেক্যুলারিজমকে অতি মূল্যায়ন করা হয়েছে। সেক্যুলারিজমকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে মনে হবে, সেক্যুলারিজমের কাজ হলো পাবলিক স্পেস থেকে ধর্মকে নির্মূল করা। যা ফ্রান্সে চর্চা করা হয়। কিন্তু ফ্রান্সের মতো যদি এ অঞ্চলে সেক্যুলারিজম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয় তাহলে সেটা গণতন্ত্র বা উদারতাবাদকে নিশ্চিত করবে না।

বহু সেক্যুলার স্বৈরশাসকের যাঁতাকলে পিষ্ট হওয়ার অভিজ্ঞতা এ অঞ্চলের রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে আপনি উসমানীয় সাম্রাজ্যের শেষ আমলের সাথে সেক্যুলার প্রজাতান্ত্রিক তুরস্কের তুলনা করতে পারেন। দেখা যায়, সেক্যুলার প্রজাতান্ত্রিক তুরস্কের একজন খ্রিস্টানের চেয়ে উসমানীয় সাম্রাজ্যের একজন খ্রিস্টান বেশি স্বাধীনতা ভোগ করেছে। এই পার্থক্যের কারণটা হলো, আমদানি করা সেক্যুলারিজমের সাথে জাতীয়তাবাদের নেতিবাচক দিকগুলো ঢুকে পড়েছে। ফলে এমন এক শাসন ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটেছে, যেটা ক্লাসিক্যাল ইসলামী আদর্শের তুলনায় অনেক বেশি অসহিঞ্চু। আপনি নিশ্চয় জানেন, ক্লাসিক্যাল ইসলামী ঐতিহ্যে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের আহলে কিতাব তথা খ্রিস্টান ও ইহুদী হিসেবে মর্যাদা দিয়ে তাদের স্বাতন্ত্র্যকে স্বীকার করা হয়।­­

সেক্যুলার আদর্শ অনুসারে রাষ্ট্রের কোনো ধর্মীয় মতাদর্শ থাকবে না। যাতে করে ধর্মীয় মতাদর্শের কারণে কেউ নিগৃহীত না হয়। খুব ভালো কথা। কিন্তু রাষ্ট্র তো ধর্ম বাদে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মতো অন্যান্য তত্ত্বগুলোকে আদর্শিক ভিত্তি হিসেবে ঠিকই গ্রহণ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ফ্যাসিজম এবং স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে কমিউনিজমের ইতিহাস তারই স্বাক্ষ্য বহন করে।

ক্রিস্টা টিপেট: আপনার পরিবারে ধর্মের চর্চাটা কেমন? যতটুকু পড়েছি, আপনার দাদা ছিলেন…

মোস্তফা আকিউল: আমার দাদা-দাদী উভয়ই ধার্মিক মুসলিম ছিলেন। আমার মনে আছে, ইসলামের প্রথম শিক্ষাটা আমি তাঁদের কাছে থেকেই পেয়েছি। দাদা আমাকে ধর্মের মৌলিক বিষয়গুলো শিখিয়েছিলেন। শুরুটা বেশ নাটকীয় ছিল। তখন আমার বয়স ছিল ৯ বছর। একদিন দাদার লাইব্রেরিতে আমি একটি বই খুঁজে পাই। কোরআন নয়, সেটা ছিল একটা পুরোনো ইসলামী বই। বইটাতে মানুষের সত্ত্বা, জীবন, সৃষ্টিরহস্য- এসব বিষয়ের আলোচনা ছিল। প্রতিটি বিষয়ের সাথে ছিল শিহরণ জাগানো কোরআনের বাণী। এক জায়গায় গিয়ে আমি থমকে যাই, সেখানে বলা ছিল অনেকটা এরকম, “তোমার সন্তান যদি তার ১০ বছর বয়স থেকে নামায পড়া শুরু না করে, তাহলে তাকে প্রহার করো।” সম্ভবত তখন থেকেই ইসলামী আইন এবং ঐতিহ্যের কর্তৃত্ববাদী বিষয়গুলোর সাথে আমার পরিচয় ঘটে। আমার মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব শুরু হয়। বিশ্বাসী মুসলিম হয়েও কীভাবে আমরা ইসলামের কর্তৃত্ববাদী আইনগুলোতে পরিবর্তন আনতে পারি– এসব নিয়ে আমার চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়।

আমার বাবা-মা ধর্ম মোটামুটি পালন করতেন। আসলে সময়টাও ছিল তেমন। ধর্মপালনের বিষয়টা তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তবুও আমি তাঁদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। বিশেষ করে বাবার কাছ থেকে। তাঁর অবস্থান ছিল সবসময় স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে। ১৯৮০ সালে সামরিক জান্তা-সরকার যখন রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের জেলে পুরছিল তখন আমার বাবাও নির্যাতনের শিকার হন। সে সময় জান্তা সরকার দ্বারা গ্রেফতার ও নির্যাতনের শিকার হয় প্রায় ৬ লক্ষ মানুষ। মনে আছে, আমার বয়স তখন ছিল আট। বাবাকে দেখতে গিয়েছিলাম। দেখলাম বাবা মিলিটারি ব্যারাকের অসংখ্য কাঁটাতারের মধ্যে আবদ্ধ। এটা দেখতে ঠিক সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘গুলাগ’ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের মতোই ছিল।

***

On Being প্রোগ্রাম থেকে আমি ক্রিস্টা টিপেট বলছি। আজ আমরা এসেছি ইস্তান্বুল শহরে। ধর্ম এবং গণতন্ত্রকে সমন্বয় করে গড়ে ওঠা উদীয়মান তুর্কি মডেলকে এগিয়ে নেয়ার পেছনে কোন বিষয়গুলো কাজ করছে- সেগুলো নিয়ে কথা বলছি মোস্তফা আকিউলের সাথে। ২০০২ সালে এরদোয়ানের মতো ধার্মিক মুসলিম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ায় অনেকেই নাখোশ হয়েছিলেন। পশ্চিমা এবং তুর্কি রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এ দেশের রাজনীতিতে ‘ইসলামিজম’ অনুপ্রবেশের আশঙ্কার কথা প্রচার করে ভীতি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তবে বর্তমান আধুনিক তুরস্কে এক অভিনব পরিস্থিতি বিরাজ করছে। একদিকে রয়েছে আতাতুর্কের সেক্যুলার সংস্কৃতি আর অন্যদিকে এরদোয়ান প্রবর্তিত ধর্মীয় স্বাধীনতা। কট্টর সেক্যুলারিজমের প্রভাবের মধ্যে ধর্মীয় স্বাধীনতা চর্চার পরিবেশ তৈরি করেছেন এরদোয়ান। তুমুল জনপ্রিয়তার কারণে টানা তিন বার সাধারণ নির্বাচনে জয় লাভ করেছেন তিনি। সে হিসেবে তুরস্কের ইতিহাসে এরদোয়ান দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা একমাত্র নেতা। অথচ একটা সময় ছিল যখন তুরস্কে আতার্তুকের কট্টর সেক্যুলারিজমের উত্তরসূরী শাসকরা জনসম্মুখে সব ধরনের ধর্মীয় আচার নিষিদ্ধ করেছিল। সে সময়কার বিতর্কিত আইনের কারণে ধার্মিক মুসলিম নারীরা এমনকি স্কার্ফের উপর পরচুলা লাগিয়ে রাস্তায় বের হতেন। আজ সে বিতর্কের স্রোত উল্টো দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী নিজেই এখন হেডস্কার্ফ পরিধান করেন।

***

ক্রিস্টা টিপেট: আপনার মতে, তুরস্কে সেক্যুলারিজম ছিল সরকারী পর্যায়ে। আর এটা ছিল সেক্যুলারিজমের ফ্রান্স মডেল। অর্থাৎ ধর্মীয় আওতা থেকে সর্বোত প্রকারে মুক্ত হওয়া। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের সেক্যুলারিজম মানে হলো চার্চ এবং রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের পৃথকীকরণ ব্যবস্থা। যেখানে ধর্মগুলো থাকবে স্বাধীনভাবে।

মোস্তফা আকিউল: আমি মনে করি, বিংশ শতকটা ছিল মুসলিম বিশ্বের জন্যে সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম জনপদগুলো কখনো যুক্তরাষ্ট্রের মতো উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চর্চা করার সুযোগ পায়নি। উল্টো তারা তথাকথিত আধুনিক

মোস্তফা কামাল পাশা
মোস্তফা কামাল পাশা

সেক্যুলারিজমের ছদ্মবেশী স্বৈরশাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে এসেছে। যেমন তুরস্কে কামালবাদী সেক্যুলারিজম, মিশরে নাসের এবং মুবারকের একনায়কতন্ত্র, তিউনিশিয়ায় বেন আলীর মতো স্বৈরশাসকরা শাসন করেছে শতাব্দীর অধিকাংশ সময় ধরে। যার ফলে মানুষের মনে জন্ম নিয়েছে ক্ষোভ আর হতাশা। স্বৈরশাসনের বিকল্প প্লাটফরম হিসেবে গড়ে উঠেছে কট্টর ইসলামপন্থা। টিকে থাকার জন্যে তারা চরমপন্থা অবলম্বন করেছে। ফলে মধ্যপ্রাচ্য কর্তৃত্ববাদী সেক্যুলারিস্ট ও কর্তৃত্ববাদী ইসলামপন্থীদের মাঝে আটকে ছিল। উভয়পক্ষের কট্টরবাদীতার কারণে, বহুত্ববাদ (pluralism) আর উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতির মতো মধ্যপন্থী ব্যবস্থা চর্চা করার সুযোগ এ অঞ্চলের মানুষ খুব একটা পায়নি।

ইতোমধ্যে আরব বসন্তের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পরিবর্তনের দাবি উঠছে। দেখে সত্যি ভাল লাগছে। এটাকে আমি উদার গণতন্ত্রের আকস্মিক উত্থান বলবো না। তবে বলা যায়, এটি মুসলিম বিশ্বের জন্যে রাজনৈতিক উদারতাবাদের প্রথম ঊষালগ্ন। তুরস্কে আমরা একটা কারণে ভাগ্যবান, আরবরা তা থেকেও বঞ্চিত হয়েছে। তারা একদলীয় শাসনের অধীন ছিল। আমাদের ভাগ্য ভালো এ জন্য যে, ১৯৫০ সালে প্রথমবারের মতো একটা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছিল। তখন থেকে তুর্কি জনগণ একটা কার্যকরী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পেয়েছে। যদিও অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে, সামরিক হস্তক্ষেপ ছিল; তারপরও উদারপন্থী আইন ও বাক স্বাধীনতা বিদ্যমান রয়েছে। অবশ্য মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের তুলনায় বহুদলীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতি পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ আমাদের অনেক বেশি ছিল। মিশর মাত্র মাস ছয়েক ধরে এটা শুরু করেছে।

ক্রিস্টা টিপেট: মিশরের জন্যে একেবারেই প্রাথমিক অবস্থা বলা যায়।

মোস্তফা আকিউল: হ্যাঁ, মিশরীয়দের জন্যে এটা নতুন অভিজ্ঞতা।

ক্রিস্টা টিপেট: আমার মনে হয়, আপনার বাবা-মায়ের চেয়ে আপনি অনেক বেশি ধার্মিক। নাকি শুধু পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণেই ইসলামের প্রতি আপনার সহানুভূতি কাজ করছে?

মোস্তফা আকিউল: বাবা-মায়ের তুলনায় ইসলামের তাত্ত্বিক বিষয়গুলো আমাকে বেশি অনুপ্রাণিত করেছে। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বিয়ের আগে তাঁরা প্রেম করেননি। ২২ বছর বয়সে তাঁরা বিয়ে করেছেন। অবশ্য সামাজিক জীবনে আমি তাঁদের চেয়ে আরো বেশি উদার মনোভাব পোষণ করি। বর্তমান সময়টা হলো বিশ্বায়নের। সময়ের সাথে আমাকে দৌঁড়াতে হচ্ছে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে। বিভিন্ন দেশের নানা বন্ধু-বান্ধবদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে হয় সবসময়। এরকম আরো কত কিছুর সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হচ্ছে- তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ক্রিস্টা টিপেট: কখন থেকে ইসলামী ধর্মতত্ত্ব আপনাকে অনুপ্রাণিত করে?

বদিউজ্জামান সাঈদ নূরসী
বদিউজ্জামান সাঈদ নূরসী

মোস্তফা আকিউল: যখন আপনি পরিবারের সাথে থাকবেন, তখন আপনার বেড়ে ওঠা, আপনার পরিবার, সংস্কৃতি, পরিপার্শ্ব– এসব দ্বারাই আপনার পরিচয় নির্ধারিত হবে। যেমনটা আমার ক্ষেত্রে হয়েছে। আমার মনে মাঝেমধ্যেই নানা প্রশ্ন উঁকিঝুকি দিত। আমাদের পরিচয় কী, জীবন চলার সঠিক পথ কোনটি, জীবনের উদ্দেশ্য কী– এ প্রশ্নগুলো নিয়ে আমি খুব ভাবতাম। হাইস্কুলের শেষ বছর নূরসীর ধর্মীয় আন্দোলনের সাথে আমার সাথে পরিচয় ঘটে। এ আন্দোলনটা গড়ে উঠেছিল মূলত বদিউজ্জামান সাঈদ নূরসীর বইয়ের পাঠকদের দ্বারা। তিনি ছিলেন একজন প্রখ্যাত আলেম । ১৯৬০ সালে তিনি মারা যান। আমি তাঁদের শিক্ষা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছি। তখন থেকে ব্যক্তিগত জীবনে আমি ধার্মিক হয়ে উঠি।

সময়ের পরিক্রমায় সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি কোনো নির্দিষ্ট মাজহাব বা সম্প্রদায়ের অনুসারী হবো না। এজন্যে আমি নিজেকে একজন মুক্তচিন্তার মুসলিম হিসেবে পরিচয় দেই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ইসলামের মৌলিক বিষয়ের ওপর আমার ঈমান ও আস্থা অবিচল আছে এবং তা আজীবন অটুট থাকবে।

ক্রিস্টা টিপেট: আমি মাঝেমধ্যে একটা তুলনা করতে পছন্দ করি– যদিও তা যথেষ্ট নিখুঁত নয়– তারপরও আমি মনে করি এ সম্পর্কে কথা বলার জন্য এটা কার্যকরী। আবারো বলছি, সবকিছুই আপেক্ষিক এবং যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের পরিস্থিতিও খুবই আলাদা। বিশ শতকের শেষাংশে যুক্তরাষ্ট্রও একটা সেক্যুলার কাল পার করে এসেছে, তখন এলিট শ্রেণী ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সেক্যুলারে পরিণত হয়েছিল। তখন সরকার ব্যবস্থা এবং এর পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রগুলোকে সেক্যুলার হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছিল। কিন্তু সত্য কথা হলো, সাধারণ মানুষ তখনো ধার্মিক ছিল। আপনি নিশ্চয় জেনে থাকবেন, নানা বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও ধর্ম দিন দিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রসার লাভ করছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, তুরস্কেও ঠিক এই ব্যাপারটাই ঘটেছে! এক সময় তুরস্কেও সেক্যুলার শাসন ছিল এবং সরকারীভাবে সেক্যুলার সংস্কৃতি ছিল। কিন্তু এখনকার মতো তখনো মানুষ ইসলামের অনুসারী ছিল। আপনি নিজেই এর চমৎকার দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন।

মোস্তফা আকিউল: এই দিক বিবেচনায় তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে বেশ মিল রয়েছে। আস্তিক ও ধর্মপালনকারী মানুষ বিবেচনায় দেশ দুটিতে মিল আছে। প্রখ্যাত মার্কিন সমাজতত্ত্ববিদ পিটার বার্গার একবার বলেছিলেন, “যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে এলিট সুইডিশদের দ্বারা শাসিত একটি ভারতীয় দেশ”। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষেরা ভারতীয়দের মতো ধর্মভীরু, তবে তাদের শাসন ব্যবস্থা সুইডেনের মতো সেক্যুলার। আমি বার্গারের উক্তিকে তুরস্কের প্রেক্ষাপটে এভাবে বলতে আগ্রহী, “তুরস্ক হচ্ছে একদল উত্তর কোরিয়ান দ্বারা শাসিত একটি ভারতীয় দেশ”। আমি বলতে চাচ্ছি, সুইডিশরা অন্তত উদার প্রকৃতির। কিন্তু কোরিয়ান শাসকদের রীতিমতো পূজা করতে হয়, তারা কট্টর স্বৈরশাসক। তুরস্কেও সাম্প্রতিক অতীতে এমন অবস্থা ছিল।

তো, প্রেসিডেন্ট রিগ্যানের সময়ে আমেরিকার হৃৎপিণ্ড বলে পরিচিত নিউইয়র্ক, সানফ্রান্সিসকোর মতো শহরগুলোতে খ্রিস্টান ডানপন্থীদের উত্থান ঘটে। তারা সেক্যুলার আমেরিকানদের চ্যালেঞ্জ করা শুরু করে। তুরস্কেও অনেকটা একইভাবে ইসলামী শক্তির উত্থান ঘটেছিল।

অবশ্য তুরস্কের ইসলামপন্থীদের উত্থান ইরানের মতো হয়নি। সে রকম হলে- তা বাজে একটা ব্যাপার হতো। আপনি নিশ্চয় জানেন, ইরানে এক স্বৈরশাসকের কাছ থেকে আরেক স্বৈরশাসকের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছে মাত্র। সেখানে আগের মতোই এখনো স্বৈরশাসন বলবৎ রয়েছে। রেজা শাহ হেডস্কার্ফকে নিষিদ্ধ করেছিলেন। তারপর খোমেনী এসে বললেন, এখন থেকে সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে হেডস্কার্ফ পরতে হবে; কারণ, এটা তাঁর আইন। তুরস্কে যে এমনটা ঘটেনি এ জন্যে আল্লাহকে ধন্যবাদ। আমাদের গণতন্ত্র চর্চার অভিজ্ঞতার ফলেই হয়তো ইসলামপন্থীরা ধীরে ধীরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একীভূত হচ্ছে। যদিও সেক্যুলারদের বিবেচনায় তারা এখনো বেশ রক্ষণশীল রয়ে গেছে।

গর্ভপাত নিয়ে এরদোয়ান সম্প্রতি যে নয়া সাংস্কৃতিক যুদ্ধ শুরু করেছেন, রক্ষণশীলতার উদাহরণ হিসেবে এটি উল্লেখযোগ্য। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও গর্ভপাত নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তুরস্কে একথা কেউ বলবে না যে, গর্ভপাতের কারণে কোনো নারীকে পাথর নিক্ষেপ করা হোক। গর্ভপাতের ব্যাপারে ব্যক্তির স্বাধীনতা থাকবে নাকি থাকবে না– এটা হলো মূল বিষয়। আমি মনে করি, এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা থাকা উচিৎ। কিন্তু কোনো স্বাধীন ও মুক্ত সমাজেই এসব বিষয় বিতর্কমুক্ত থাকে না।

ক্রিস্টা টিপেট: তা অবশ্য ঠিক।

মোস্তফা আকিউল: মধ্যপ্রাচ্যে আধুনিকতার বিকাশ বারবার বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণ হলো এ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা। এ অঞ্চলের মুসলিমদের ধারণা হলো, আধুনিক হতে চাইলে আপনাকে ধর্মীয় বিশ্বাস বাদ দিতে হবে, সমাজকে ধর্মমুক্ত করতে হবে, অনেক বেশি সেক্যুলার হতে হবে ইত্যাদি। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র একটা গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। আমার এক রক্ষণশীল মুসলিম বন্ধু কিছুদিনের জন্য আমস্টারডাম গিয়েছিল। ফিরে এসে বলল, “আমরা সেখানকার মানুষগুলোর মতো হতে চাই না। কারণ তারা খুব বেশি সেক্যুলার। যদিও আমি তাদের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাপোষণ করি”। সেই বন্ধুর কথা শুনে বুঝতে পারলাম, পশ্চিমা জনগণ এতটাই সেক্যুলার যে, এ অঞ্চলের ধর্মবিশ্বাসী মানুষগুলো তাদের মতো করে আধুনিক হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে না।

তবে আমি মনে করি, পশ্চিমাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ব্যতিক্রমী উদাহরণ। ধর্মের প্রতি নিষ্ঠাবান সমাজ সেখানে রয়েছে। একই সাথে তারা খুবই উদার ও চিন্তাধারায় আধুনিক প্রকৃতির। এর ফলে সেখানে ধর্ম ও আধুনিকতা নিয়ে যে কোনো ধরনের মুক্ত আলোচনা চলতে পারে। তাই আমি বিশ্বাস করি, আধুনিকতাকে গ্রহণ করার জন্যে এ অঞ্চলের মানুষের কাছে যুক্তরাষ্ট্র তুলনামূলক ভালো উদাহরণ হতে পারে।

ক্রিস্টা টিপেট: আপনার জানা থাকার কথা, তুরস্ক ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেবে, নাকি দেবে না- তা নিয়ে গত ১০ বছর ধরে সবচেয়ে বেশি মাতামাতি হচ্ছে। অথচ তুরস্ক এখন এমন একটা পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, ইইউ’তে যোগ দেয়ার বিষয়টা আর তেমন গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হচ্ছে না।

মানচিত্রে তুরস্কের অবস্থানটা দেখলে মনে হয়, তুরস্ক বিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থান করছে। সবখানেই পরিবর্তন ঘটছে, তাই না? মিশর ও তিউনিশিয়ায় নিকট ভবিষ্যতে কী ঘটতে যাচ্ছে, কে জানে! তবে ইতোমধ্যে এসব দেশে পরিবর্তন শুরু হয়েছে। শুধু তাই নয়, ইউরোপেও এই পরিবর্তনের হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। আর এই সমস্ত রূপান্তরের কেন্দ্রে রয়েছে তুরস্ক। একজন তুর্কি হিসেবে এসব নিয়ে আপনি কী ভাবছেন?

মোস্তফা আকিউল: হ্যাঁ, সেটাই। একজন তুর্কি নাগরিক হিসেবে এ জন্যে আমি খুবই গর্বিত, এর আগে এমন গর্ব করার সুযোগ হয়নি। তবে তুরস্কের সব ব্যাপার নিয়ে আমি সন্তুষ্ট নই। বাক-স্বাধীনতার প্রশ্ন তো আছেই, এছাড়াও আমাদের অনেক সমস্যা রয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠের কথা বাদই দিলাম, আমরা এখনো সংখ্যালঘুদের সমস্যার সমাধানই করতে পারিনি। বলা যায়, আমাদের দেশে গণতন্ত্র চর্চায় এখনো অনেক ভুল-ভ্রান্তি রয়ে গেছে। সব সমস্যা অলৌকিকভাবে একদিন সমাধান হয়ে যাবে বলে যারা মনে করেন, আমি তাদের সাথে একমত নই।

ক্রিস্টা টিপেট: এসব ভুল-ভ্রান্তি অতিক্রম করেই তো গণতন্ত্রের ভিত্তিটা মজবুত হবে, তাই না?

মোস্তফা আকিউল: এজন্যে কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষপ গ্রহণ করা জরুরি। ইসলামী বিশ্বাসের প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মানুষগুলো এই সংস্কার কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। আমাদের দেশের সংকটময় মুহূর্তে এরদোয়ানের পদক্ষেপ একটা ভালো উদাহরণ। তিনি ঘোষণা করেছেন যে, তুর্কি স্কুলে কুর্দিদের জন্যে ক্লাসের ব্যবস্থা থাকবে। এটাকে চমৎকার একটা পদক্ষেপ বলা যায়। কিন্তু দু’দিন আগেও আমরা এমন সব কাজ করছিলাম যা উদার দৃষ্টিভঙ্গিতে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। অবশ্য এরদোয়ানের শাসনব্যবস্থার ভালো-মন্দ দু’টি দিকই রয়েছে। কোন দিকটা শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হবে আমি জানি না।

ক্রিস্টা টিপেট: এভাবে বলাটা মনে হয় ঠিক নয়। আমেরিকান রাজনীতিবিদরা কিন্তু এসব ব্যাপারে খুবই কঠোর… (হাসি)

মোস্তফা আকিউল: একবিংশ শতকের সূচনালগ্নে তুরস্কে যে জাগরণ শুরু হয়েছে, তার উৎস খুঁজতে হলে তুরস্কের ইতিহাসকে আগে বিবেচনা করতে হবে। বর্তমানে তুরস্ক তার ঐতিহাসিক পরিচয় এবং উসমানীয় ঐতিহ্যকে ধারণ করতে শুরু করেছে। এতেই তারা উন্নতি ও সমৃদ্ধির প্রেরণা খুঁজে পেতে চাচ্ছে।

তার মানে এই নয় যে, আমরা আবারো সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছি। যেমনটা অনেকে মনে করেন যে, তুরস্ক পুরোপুরি পাশ্চাত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে প্রাচ্য অভিমুখী হচ্ছে। আসলে তা নয়, বরং তুরস্ক দিন দিন উদার হচ্ছে। এক সময় এ অঞ্চলের সবার সাথে তুরস্কের সু-সম্পর্ক বজায় ছিল। সেই আস্থার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে তুরস্ক কাজ করছে। এর পেছনে যে বিষয়টি প্রেরণা দিচ্ছে তা হলো ‘মুসলিম পরিচয়’। মাঝখানে কিছু সময় তুরস্কে মুসলিম পরিচয়ের কারণে মানুষ দমন-পীড়নের শিকার হয়েছিল। কিন্তু আজকের তুরস্ক পাল্টে গেছে। এখন মুসলিম পরিচয় দিতে মানুষ গর্ববোধ করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সফলতা আসবে তখনই, যখন আমরা তুরস্কের এই পালাবদলের সময়কে গণতান্ত্রিক কাঠামোতে সঠিকভাবে গড়ে তুলতে পারবো এবং সেক্যুলার ও অমুসলিমদের প্রাপ্য অধিকারসমূহ নিশ্চিত করতে পারবো। কারণ, পাশ্চাত্য নাকি প্রাচ্য– এ ধরনের প্রান্তিক ভেদ-জ্ঞান নিয়ে বসে থাকার দিন আর নেই।

ক্রিস্টা টিপেট: মডেলটা একটু ভিন্ন ধরনের মনে হচ্ছে।

মোস্তফা আকিউল: হ্যাঁ। তবে এর জন্যে শর্ত হলো, গণতন্ত্রকে তার নিজের সুরে বাজতে দেয়া। একদল জেনারেলের শাসনাধীনে ধার্মিকদের উপর নিপীড়ন চালানো হবে– এটা তুর্কি ইসলামী গণতন্ত্রের উদাহরণ হতে পারে না। তুরস্ক তখনই সত্যিকার অর্থে ইসলামী গণতন্ত্রের উদাহরণ হয়ে উঠবে, যখন ধার্মিক জনগণ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ধারণ করবে এবং তা এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে। আমি মনে করি, এক্ষেত্রে আমরা অনেকটা অগ্রসর হয়েছি।

ক্রিস্টা টিপেট: এরদোয়ানের একটা কথা আমি লিখে রেখেছিলাম। যা অনেকটা মার্কিন রাজনীতিবিদদের কথার মতো শোনায়। সেটা হলো, “যখন আমি ঘরে থাকি, তখন আমি একজন মুসলিম। আর যখন অফিসে থাকি, তখন আমি গণতন্ত্রের জন্যেই কাজ করি।”

মোস্তফা আকিউল: আসল কথা হচ্ছে, তুরস্ককে বিশ্বশক্তি হিসেবে গড়ে তোলা এবং গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে এরদোয়ান সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে চান। তুরস্কের অর্থনীতিতে গতি আনতে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। এছাড়া তাঁর গৃহীত উদ্যোগের অনেকগুলো ইতোমধ্যে সফলতার মুখ দেখেছে। কিন্তু গণতন্ত্রের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি কতটুকু ইতিবাচক– সেটাই আসল প্রশ্ন। আমার মনে হয়, ক্ষমতায় টিকে থাকার আকাঙ্ক্ষা তাঁর গণতান্ত্রিক প্রতিশ্রুতিকে মাঝেমধ্যে ম্লান করে দেয়। তাঁকে একেক সময় একেক রূপে দেখা যায়। একদিন ঘুম থেকে ওঠে হয়তো দেখবেন এরদোয়ান খুব উদারবাদী। কিন্তু দু’দিন পর আবারো ঘুম থেকে ওঠে দেখবেন এরদোয়ানের মেজাজ বেশ চড়া। মনেই হবে না তিনি কোনো গণতান্ত্রিক দেশের নেতা।

ক্রিস্টা টিপেট: এরদোয়ানের আচরণের চেয়েও বড় প্রশ্ন হলো, তুরস্কে গণতন্ত্রের ক্রমবিকাশটা কীভাবে হয়েছিল? গণতান্ত্রিক পরিপক্কতা অর্জনের অভিজ্ঞতাইবা কতটুকু?

মোস্তফা আকিউল: শুধু তাই নয়, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কতটুকু সমন্বয় করতে পারছি, এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এছাড়া কীভাবে আমরা ‘হার-জিতের’নেতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবো- সে প্রশ্নও রয়েছে। এ প্রসঙ্গে তুরস্কে একটা কথা প্রচলিত আছে, ‘যদি আপনি হাত বাড়িয়ে দেন তাহলে পুরো হাতটাই আপনাকে হারাতে হবে’। আমাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানো দরকার। তাই আমি বলতে চাই, ‘আপনি যদি হাত না বাড়ান, তাহলে আপনি কখনো বন্ধুত্বই করতে পারবেন না’। আপনি যদি কিছু ইস্যুতে ছাড় না দেন, তাহলে কখনোই ঐক্যমত্যে পৌঁছতে পারবেন না। ‘কুর্দি নাকি তুর্কি, ইসলামপন্থী নাকি সেক্যুলারপন্থী’– এসব বিতর্ক নিরসনে এখন পর্যন্ত আমরা কোনো ধরনের ঐক্যমত্যে আসতে পারিনি। আমি মনে করি, সেক্যুলারিজম প্রশ্নে এবং প্রাত্যহিক জীবনের মৌলিক ব্যাপারগুলোতে আমাদের ঐক্যমতে আসতে হবে। যদিও কিছু ইস্যুতে সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব বিরাজ করছে। তবে আমি মনে করি, কেউ স্কার্ফ পড়তে চাইলে তাকে সে সুযোগ দেয়া উচিৎ। কেউ চায় তো মিনিস্কার্টও পড়তে পারে। এই ব্যাপারটা তুরস্কের অধিকাংশ জনগণই মেনে নিয়েছে।

ক্রিস্টা টিপেট: আপনি কি এ বিষয়গুলোকে সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করছেন?

মোস্তফা আকিউল: অবশ্যই, আপনি তো তা দেখতেই পাচ্ছেন। আপনাকে আরো একটা উদাহরণ দেই। আরবদের কাছে তুরস্ক দিন দিন অর্থবহ হয়ে উঠছে। আপনি দেখতে পাবেন তুরস্কে অনেক আরব পর্যটক ভ্রমণ করতে আসে। তারা দেখছে, এখানে অনেক মসজিদ আছে এবং নামাজের সময় প্রচুর মুসল্লী সেখানে যায়। আবার অনেক মদের বারও আছে। সেখানেও প্রচুর লোক সমাগম তাদের চোখে পড়ে। আসলে এগুলো নিয়েই বর্তমান তুরস্ক। আমার ধারণা, আরবরা চায় তাদের দেশটাও এভাবেই গড়ে উঠুক।

***

এতক্ষণ আমি ইস্তান্বুলে মোস্তফা আকিউলের বাসায় তাঁর সাথে কথা বলছিলাম। আকিউলের এ সাক্ষাৎকার থেকে তুর্কি জাতি ও এ অঞ্চলের জটিল বাস্তবতাগুলো সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে। কীভাবে নবী মুহাম্মদ (সা) তুরস্কের নতুন প্রজন্মের কাছে প্রেরণার বাতিঘর হয়ে উঠছেন- ইসলামিক ক্যালভিনিস্ট (সংস্কারবাদী) মোস্তফা আকিউল তা বিশ্লেষণ করেছেন।

তুরস্কে চলমান ধর্ম ও গণতন্ত্রের সমন্বিত মডেলটি নিয়ে জনাব আকিউল তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি পেশ করেছেন। মূলত এই বিষয়টিকে এ অঞ্চলের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের অন্যতম কারণ বলা যায়। ইস্তান্বুল এক সময় কনস্টান্টিনোপল নামে উসমানীয় সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। গ্রীক ও রোমানদের পতনের পর এই সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটে। মোস্তফা আকিউলের মত যারা ‘নয়া তুরস্কে’র স্বপ্ন দেখেন তাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও উদার সাংবিধানিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ স্বপ্নকে তারা বাস্তবে রূপ দিতে চান।

সাম্প্রতিক একটি জরিপ থেকে এ অঞ্চলে তুরস্কের প্রভাব টের পাওয়া যায়। দেখা গেছে, প্রায় ৬৩ শতাংশ মিশরীয় জনগণ তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী এরদোয়ানকে বিশ্বনেতা হিসেবে পছন্দ করেছে। সৌদি বাদশা পেয়েছেন মাত্র ৫ শতাংশ লোকের সমর্থন। বারাক ওবামাও সৌদি বাদশার সমান ভোট পেয়েছেন।

***

ক্রিস্টা টিপেট: প্রায় বছরখানেক আগে অর্থাৎ ২০১১ সালে ইউএস-ইসলামিক ওয়ার্ল্ড ফোরামের একটা অনুষ্ঠানে আমি যোগ দিয়েছিলাম। আপনি কি সেখানে ছিলেন?

মোস্তফা আকিউল: দু’সপ্তাহ আগে আমি সেখানে ছিলাম।

ক্রিস্টা টিপেট: ইসলামিক ওয়ার্ল্ড ফোরামের অনুষ্ঠানটির পর, সম্ভবত ২০১১ সালের মার্চ বা এপ্রিলের দিকে, আরব বসন্ত তখন মাত্র শুরু হয়েছে। তারপর থেকে আরব দেশগুলোতে দারুণভাবে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছিল। মিশর-তিউনিশিয়ায় আওয়াজ উঠলো, তারা তুরস্ক মডেলের শাসনব্যবস্থা চায়। আন্দোলনকারীদের মতো আমিও অনুভব করলাম বিষয়টা। অনেকে তো মনে করছে এটা তুর্কিদের কারসাজি, মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের প্রভাব তৈরির প্রচেষ্টা। কিন্তু যে মডেলটা গড়ে ওঠতে তুরস্ক দীর্ঘ সময় নিয়েছে, সেখানে আরব দেশগুলোতে হুট করে ‘তুর্কি মডেল’ কতটুকু কাজে লাগতে পারে? সব মিলিয়ে যা কিছু ঘটছে, সেগুলোকে কীভাবে দেখছেন?

মোস্তফা আকিউল: রক্ষণশীল তুর্কিদের একটা বিশ্বাস আছে, যাকে আমি ‘Turkey’s Manifest Destiny’ বলে থাকি। এর মূল চেতনা হলো: বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্যে তুর্কি জাতির একটা ঐতিহাসিক মিশন আছে। তারা মনে করে, শত শত বছর ধরে ইসলামী সভ্যতার সত্যিকারের ধারক-বাহক ছিল তুর্কি জাতি। শুধু নেতৃত্বই নয়, গণতন্ত্রের সমন্বয়ে ইসলামী সভ্যতা বিনির্মাণের ক্ষেত্রেও তুর্কিরা অগ্রগামী ছিল। আমার মতে, চূড়ান্ত বিচারে গণতান্ত্রিক আদর্শের সাথে ইসলামে কিছু বিষয়ের মিল রয়েছে। তবে গণতন্ত্র আসলে আধুনিক পাশ্চাত্যেরই সৃষ্টি। উসমানীয়রা গণতন্ত্রকে গ্রহণ করেছ, সমন্বয়ের চেষ্টা করেছে। যদি জানতে চাওয়া হয়, তুরস্কের জন্যে উল্লেখযোগ্য দিক কোনটি? উত্তরটা হবে, গণতন্ত্র। এই গণতন্ত্রের অভিজ্ঞতা আমাদের অনেক দিনের।

যদি তুরস্ক ইসলামী মূল্যবোধ ও আচার-আচরণকে যথাযথভাবে ধারণ করতে পারে তাহলে আরবদের সাথে দূরত্ব কমে আসবে। কারণ আরব ও তুর্কিদের মধ্যে এ ব্যাপারটি অভিন্ন। তুরস্কের পক্ষ থেকে দূরত্ব কমানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে ইতোমধ্যে। তুরস্কের থিঙ্ক ট্যাঙ্কে যারা আছেন তারা বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। সম্প্রতি কায়রোতে অনুরূপ থিঙ্ক ট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। উদ্যোগটা প্রশংসনীয়। শুধু তাই নয়, তুরস্ক পশ্চিমাদের সাথেও একত্রে কাজ করছে। মধ্যপ্রাচ্যের জটিল রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে সংলাপের আয়োজন করেছে। ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক আলোচনার মধ্যস্থতাকারী হচ্ছে তুরস্ক। সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় তুরস্ক গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে নিজের অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে।

ক্রিস্টা টিপেট: মধ্যপ্রাচ্যের সাথে ইউরোপের সেতুবন্ধন তৈরিতেও তুরস্ক কাজ করছে বলা যায়।

কামাল ল্যাটিন হরফ শেখাচ্ছেন ১৯২৮ সালে। ছবি স্বত্ত্ব: লস্ট ইসলামিক হিস্ট্রি
কামাল ল্যাটিন হরফ শেখাচ্ছেন, ১৯২৮ সালে

মোস্তফা আকিউল: একদম ঠিক বলেছেন। যদি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে এই ধারা অব্যাহত রাখা যায়, তাহলে তুরস্ক অনুপ্রেরণার দৃষ্টান্ত হয়ে উঠবে। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে তুরস্ক এখনো যথেষ্ট পিছিয়ে আছে। দেখুন না, তুরস্কে খুব কম লোকই আরবিতে কথা বলে থাকে। কারণ আমরা আরববিশ্ব থেকে এক রকম বিচ্ছিন্ন বলা যায়। আমরা যেমন আরবিতে বলি না, তেমনি আরবরা তুর্কিতে বলে না। আরবি ভাষার সাথে তুর্কি ভাষার পার্থক্য রয়েছে।

ক্রিস্টা টিপেট: ঠিক বলেছেন।

মোস্তফা আকিউল: উসমানীয় আমলে ভাষার লিখিত রূপ ছিল আরবি। তখন প্রচুর আরবি শব্দ ছিল। তবে তুর্কি ব্যাকরণই অনুসরণ করা হতো। তুর্কি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার পর তুর্কি বর্ণমালা পাল্টে ফেলা হয়। এমনকি তুর্কি ভাষাকে বিশুদ্ধ রাখার অযুহাতে আরবি ও ফারসি শব্দগুলো ছেঁটে ফেলা হয়।

ক্রিস্টা টিপেট: জানতাম না তো!

মোস্তফা আকিউল: এটাকে সে সময় ভাষার ক্ষেত্রে বিপ্লব হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল। কাজটা আমার কাছে এক ধরনের বর্বরতা বলেই মনে হয়েছে। এর ফলে তুর্কি শব্দভাণ্ডার সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। পরে নব্য শাসকদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত Turkish Language Institution কৃত্রিম শব্দ দিয়ে নতুন অভিধান তৈরি করে।

ক্রিস্টা টিপেট: কাজগুলো আতাতুর্কের আমলে হয়েছিল?

মোস্তফা আকিউল: হ্যাঁ, সময়টা আতাতুর্কেরই ছিল। তুরস্কের সংস্কৃতিকে আরবি ও ফার্সির প্রভাব থেকে মুক্ত করতে এসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। আশ্চর্যজনকভাবে অনেকেই সে সময় তুর্কি ভাষার ওপর এমন নৃশংস পদক্ষেপকে ইতিবাচক হিসেবে দেখে থাকেন। কিন্তু আমি মনে করি এটা আমাদের সাহিত্য, এমনকি চিন্তা-চেতনায়ও অবক্ষয় তৈরি করেছে। আমরা তুর্কি ভাষার দ্যোতনা হারিয়ে ফেলেছি। শুধু কি তাই? বর্ণমালা ও শব্দ ভাণ্ডারে এত বড় পরিবর্তনের ফলে অধিকাংশ মানুষ তখন রাতারাতি অক্ষরজ্ঞানহীন ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন! এক সময় বাপ-দাদারা কী লিখে রেখে গিয়েছিলেন, সেগুলো বুঝার সাধ্য আর নেই এখনকার নাতি-পুতিদের। এভাবে তুর্কিদের সাথে আরবদের ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে একটা অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করা হয়েছে। অবশ্য নয়া তুর্কি শাসক ও শিক্ষিত সমাজ এসব চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে আগ্রহী হয়ে উঠছে।

ক্রিস্টা টিপেট: ঠিক। যদি খোলামেলাভাবে চিন্তা করি, তাহলে তুরস্কের গৌরবময় অতীতের সাথে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার সময় এখন, তাই না?

মোস্তফা আকিউল: অবশ্যই। তুরস্কে কিছু কথা প্রায় শোনা যায়। যেমন, আপনি যদি কামালপন্থী হন, তাহলে আপনার সেরা সময়টা ছিল আতাতুর্কের যুগ। আপনি ভাববেন, তুরস্কের জন্যে আতাতুর্কের সময়টা ছিল সবচেয়ে ভালো। আর আপনি যদি রক্ষণশীল হয়ে থাকেন, তাহলে আপনার সেরা সময়টা ছিল উসমানীয় শাসনামল। সব কিছুকে আপনি শুধু সাম্রাজ্যের সময়ের সাথে মেলাতে থাকবেন। তবে তারমানে এই নয় যে, আপনি আবার সেই সাম্রাজ্য ফিরে যেতে চান বা দেশ দখল করতে চান। বরং আপনি সেই সাম্রাজ্যের মানদণ্ডে পুরো দুনিয়াকে মাপতে থাকবেন!

বসনিয়ার কথাই ধরুন। তুর্কিরা তাদেরকে ইউরোপীয় মুসলিম ভাই হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। কারণ বসনিয়া এক সময় উসমানীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, উসমানীয় আমলে বসনিয়ানদের মধ্য থেকে কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। উসমানীয় সাম্রাজ্যের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের অনেকেই জাতিগতভাবে ছিলেন তুর্কি, ফিলিস্তিনি কিংবা বাগদাদের অধিবাসী। অর্থাৎ জাতীয়তা নিয়ে তখন কোনো পার্থক্য করা হতো না। এ ধরনের ব্যবস্থা যদি এখনকার দুনিয়ার দৃষ্টিভঙ্গিতে মেলাতে যান, দেখবেন উসমানীয় শাসনব্যবস্থা ছিল অনেক উদার। আর তার বিপরীতে যে সেক্যুলারিজম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, সেটা ছিল নিছক জাতীয়তাবাদী চিন্তাপ্রসূত এবং খুবই সংকীর্ণ মনোভাবাপন্ন।

ক্রিস্টা টিপেট: ২০১১ সালের মিসর সফরে এরদোয়ানকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয়েছিল। তারা এরদোয়ানের নেতৃত্বকে বেশ পছন্দ করে। তাছাড়া সমাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভূমিকা পালনের জন্যে সৌদি আরবের চেয়ে ‘তুরস্ক মডেল’ তাদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। আমেরিকান থিঙ্ক ট্যাঙ্কের এক জরিপ থেকে এ বিষয়টি উঠে আসে। জরিপে দেখা যায়, ৪১ শতাংশ মিসরীয় তুরস্ককে, ২৫ শতাংশ সৌদি আরবকে এবং ৫ শতাংশ লোক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সুপার পাওয়ার হিসেবে দেখতে চায়। এরদোয়ান খুবই প্রশংসিত একজন নেতা এবং তুরস্ক আরো বেশি প্রশংসিত। অথচ যেখানে ইসলামের রোল মডেল হিসেবে সমাজ ও রাজনীতিতে সৌদি আরবের আরো বেশি ভূমিকা থাকার কথা। তবে আমি একটা ব্যাপারে আগ্রহী। সেটা হলো, আপনি ৮০’র দশকের তুর্কি ইসলামী সংস্কারবাদ সম্পর্কে লিখেছেন। সেই সংস্কারের ফলে যে সব নতুনত্ব এসেছিল তার ফলাফল আপনি নিজেও। আমার প্রশ্নটা হলো, ইসলামী মূল্যবোধকে ধারণ করে তুরস্ক গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার যে মডেল দাঁড় করাতে যাচ্ছে, তার বিশেষ দিকগুলো কী কী?

মোস্তফা আকিউল: প্রথমেই বলে নিই, মধ্যপ্রাচ্যে এখন তিনটি মডেল দেখা যায়। একটা হলো ইরানি মডেল, যেখানে ধর্মতন্ত্র শাসনব্যবস্থা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সেখানে ইসরাঈলকে ধ্বংস করার মনোভাব বেশ তীব্র।

আরেকটা হলো সৌদি মডেল, যারা রাজনৈতিকভাবে মধ্যপন্থী। যেমন, তারা ফিলিস্তিন-ইসরাইল সমস্যার ‘দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানে’ আগ্রহী। তবে তারা ধর্মীয় দিক থেকে খুবই রক্ষণশীল ও কর্তৃত্ববাদী। ধর্মীয় পুলিশ দিয়ে সেখানে ধর্মপালনে বাধ্য করা হয়! তাই সৌদি আরবকে সালাফী মডেল বলা যেতে পারে।

আর সর্বশেষ মডেলটি হলো সাম্প্রতিক তুরস্ক। ১০ বছর আগেও তুরস্ক অপ্রাসঙ্গিক ছিল। কারণ, এটি ছিল কট্টর সেক্যুলার রাষ্ট্র। যে রাষ্ট্রটা মিলিটারি জেনারেলদের কথায় উঠত আর বসত। মধ্যপ্রাচ্যে এমনটা আর দেখা যায়নি। যেখানে হেডস্কার্ফ পরা পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল। কে জানতো, সেই তুরস্ক এক সময় মুসলিম বিশ্বের জন্যে উদাহরণ সৃষ্টি করবে?

যারা ঐতিহ্য ও ধর্মীয় মূল্যবোধে আস্থা রাখে এবং একই সাথে আধুনিকতারও অংশীদার হতে চায়, তাদের জন্যে বর্তমান তুরস্ক একটি নতুন মডেল। তিউনিশিয়ায় আননাহদা পার্টির কথাই ধরুন। তাদের বক্তব্য হলো, “আমরা মুসলিম এবং আমাদের ঐতিহ্য ইসলাম। তাই বলে আমরা ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছি না। আমরা বরং অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সমাজ সংস্কার ও আধুনিকায়নে সেক্যুলারদের সাথে একত্রে কাজ করতে চাই।”

আননাহদার এই কথার সূত্রই হলো তুরস্ক মডেল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো আরবরা এই মডেল কতটুকু বোঝে এবং গ্রহণ করছে? কারণ আরবদের সাথে আমাদের যে সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা তৈরি করা হয়েছে, তা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

আর দ্বিতীয় কথাটি হলো, তুর্কি মডেলটা হুবহু অনুসরণ করা উচিৎ হবে না। কারণ প্রত্যেকটি দেশের নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য, মূল্যবোধ রয়েছে। সেগুলোকে ভিত্তি করে তাদের নিজস্ব পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিৎ। সবার উচিত তুরস্ককে অনুকরণ করা- এ কথা বলা খুবই বোকামি হবে। তবে একনিষ্ঠ মুসলিম হলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো তুরস্ককে অনুরসণ করা যেতে পারে। তবে আসল মনোযোগ থাকতে হবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে। হয়তোবা আন্তর্জাতিক সংস্থায় সদস্যপদ থাকবে, তুরস্ক যেমন ন্যাটোভুক্ত দেশ। তারমানে এই নয়, আপনার সমাজের মূল্যবোধের বিপরীত কিছু আপনাকে করতে হবে। যেমন আপনি ফিলিস্তিনির পক্ষে কথা বলবেন, তবে ইসরাইলের অস্তিত্বের বিরোধিতা করে নয়। দেখুন তুর্কি সরকার ফিলিস্তিনের সমর্থক হলেও ইসরাইলবিরোধী নয়। তুর্কি সরকার কিছু কিছু ইস্যুতে ইসরাইলের খুব কড়া সমালোচনা করে থাকে। তবে আদতে তুর্কি সরকার ‘দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানে’ আগ্রহী।

মোটকথা হলো, আরব বসন্তের পর থেকে আরব অঞ্চলে পরিবর্তনের জন্যে যারা রাজনৈতিক আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে তুরস্ক তাদের কাছে প্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছে। কারণ তারা শুধু ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীলই নয়, তারা মন-মানসিকতায় আধুনিক এবং বাস্তববাদীও বটে।

***

On being থেকে ক্রিস্টা টিপেট বলছি। ধর্ম, নৈতিকতা ও এ সম্পর্কিত চিন্তা-ভাবনাগুলো নিয়ে বলছিলেন মোস্তফা আকিউল। এ আলোচনায় ধর্ম ও গণতন্ত্র নিয়ে উদীয়মান তুরস্কের পদক্ষেপগুলো কী, তা তুলে আনার চেষ্টা করা হয়েছে।

***

ক্রিস্টা টিপেট: ‘ইসলামিক ক্যালভিনিস্ট’ (সংস্কারবাদী) ধারণাটা আমার বেশ পছন্দ হয়েছ। প্রাথমিক পর্যায়ের আমেরিকান গণতন্ত্রের সাথে এর একটা মিল পাওয়া যাচ্ছে। সে সময় রোটারি ক্লাব, দ্যা চেম্বার অব কমার্স, দ্যা ইয়াং ম্যান’স ক্রিশ্চিয়ান এসোসিয়েশনসহ সকল নাগরিক সংগঠনই ছিল খ্রিস্টধর্মভিত্তিক। অবশ্য ধীরে ধীরে কয়েক প্রজন্মের ব্যবধানে এগুলো সেক্যুলার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে যায়।

মোস্তফা আকিউল: ‘ইসলামিক ক্যালভিনিস্ট’ টার্মটা ইউরোপীয় থিঙ্ক ট্যাঙ্ক European Civil Initiative প্রথম ব্যবহার করে। তুরস্কের রক্ষণশীল ব্যবসায়ীদের, বিশেষ করে তুরস্কের মধ্যপশ্চিমাঞ্চল, নিয়ে সংস্থাটি গবেষণা করেছে। যদি আপনি…

ক্রিস্টা টিপেট: রক্ষণশীল বলতে কী বুঝাচ্ছেন? ধর্মীয় নাকি রাজনৈতিক?

মোস্তফা আকিউল: ধর্মীয়ভাবে রক্ষণশীল। তাদের ব্যবসা সফল কোম্পানি রয়েছে। তারা রেফ্রিজারেটর, টিভি, ব্লু-জিন্স- এইসব উৎপাদন করে। এগুলো তারা মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকাসহ বিশ্ব জুড়ে রপ্তানী করে। তারা খুবই সফল উদ্যোক্তা এবং পরিশ্রমী ব্যবসায়ী।

বিশেষ করে কোনিয়া এবং কায়সেরি’র মতো তুরস্কের খুব গুরুত্বপূর্ণ শহরের মানুষজন ধর্মীয়ভাবে বেশ রক্ষণশীল। ঐ সব ব্যবসায়ী গোষ্ঠী মূলত এসব শহরে বসবাস করে। তারা নবী মুহাম্মদ (সা) কে যোদ্ধা হিসেবে নয়, বরং একজন ব্যবসায়ী হিসেবে দেখে থাকে। নবী (সা) কে অনুসরণ করে তারাও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে এবং অর্থ উপার্জন করছে। তারা উপার্জিত অর্থকে সামাজিক উন্নয়ন কাজে ব্যবহার করে। এই ব্যবসায়ীরা জনস্বার্থে দাতব্য সংস্থায় অর্থ দান করে, গরীব ছাত্রদেরকে বৃত্তি প্রদান করে। এমনকি তারা দরিদ্রদের জন্যে খাবারের দোকানও খুলেছে। তুরস্কে এ ধরনের উদ্যোগ নেয়ায় তাদেরকে আমি ধন্যবাদ জানাই। তুরস্কের দাতব্য খাত বেশ বড়। গাজা ফ্লোটিলার মতো কিছু উদ্যোগ অবশ্য রাজনৈতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। তবে এটা একটা উদাহরণ মাত্র। অরাজনৈতিক উদ্যোগই বরং বেশি।

এসব তো দেশের ভেতরকার কথা। তুরস্কের এনজিও এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের বাইরেও তাদের সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আফ্রিকার অবহেলিত অঞ্চলে তারা খাদ্য ও ঔষধপত্র নিয়ে যাচ্ছে। তারা স্কুল চালু করেছে। সুনামী দুর্গত মানুষের জন্যে পৌঁছে দিচ্ছে সহযোগিতা। মূলত এ অঞ্চলের ধর্মীয় রক্ষণশীল মানুষেরাই এ ধরনের অর্থনৈতিক সহযোগিতা করে যাচ্ছে। তারা মনে করে, প্রতিবেশীকে সহযোগিতা করাটা আল্লাহ প্রদত্ত দায়িত্ব। আরেকটা ব্যাপার হলো, তুরস্কের এ ধরনের মানুষেরা এরদোয়ানের ভোট ব্যাংক হিসাবে কাজ করে। কারণ তারা দেখতে পাচ্ছে, এরদোয়ানের কর্মকাণ্ডে তাদের মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটছে। এছাড়া এরদোয়োন এসব ব্যবসায়ীদের সহায়তাও করছেন। কারণ, একেপি ব্যবসায়ী পরিচালিত দলও বটে। তাই তার দলীয় নীতির সাথে তুরস্কের আর্থিক ও বানিজ্যিক স্বার্থ রক্ষার সাযুজ্যতা রয়েছে।

এসব বিবেচনায়, তুরস্কের এই সামাজিক রূপান্তর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ধর্মীয় আচার-আচরণেও ইতিবাচক পরিবর্তন আসছে। ইসলামপন্থী সংস্কারবাদীরা তাদের ধর্মীয় ঐতিহ্যকে প্রাধান্য দিচ্ছে। আসন্ন পরিবর্তনটা যাতে গঠনমূলক হয় সে জন্যে তারা কখনো কখনো বাপ-দাদাদের চেয়েও অনেক বেশি খোলামেলা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দ্বিধাবোধ করছে না। তবে অবশ্যই এটা একটা দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া।

ক্রিস্টা টিপেট: হুম, যুক্তরাষ্ট্রের সমাজেও পরিবর্তন আসতে বেশ সময় লেগেছিল।

মোস্তফা আকিউল: একদম ঠিক বলেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে চার্চ কর্তৃক যে সব বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেগুলো এক সময় সেক্যুলার এবং সার্বজনীন প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়ে যায়। আমি আশা করি, তুরস্কের সুশীল সমাজও এ ধরনের সার্বজনীন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সচেষ্ট আছেন। এর ফলে তুর্কি জনগণ বৈশ্বিকতাকে অনুধাবন করবে এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে উঠবে আরো বাস্তবসম্মত।

ক্রিস্টা টিপেট: অবশ্যই। গত ১০ বছর ধরে ইসলাম নিয়ে আমি বহু লোকের সাথে কথা বলে আসছি। এখন আপনার যে অব্স্থা, অর্থাৎ আপনি ধার্মিক হিসেবে বেড়ে উঠেননি। আপনি বলেছেন, আপনি শুধু ধর্মতাত্ত্বিকভাবে অনুপ্রাণিত। আমার জানতে ইচ্ছে করছে, আপনার মতো যারা আছেন তাদের মনোভাবটা এখন কী রকম হতে পারে?

মোস্তফা আকিউল: প্রথমেই বলা দরকার, আমেরিকানরা এমন এক সময়ে ইসলাম সম্পর্কে শুনছে এবং দেখছে, যখন মুসলিমরা ইসলামী মূল্যবোধ থেকে সামগ্রিকভাবে অনেক দূরে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, মুসলিমদের অনাকাঙ্ক্ষিত ত্রুটিগুলোই তাদের চোখে পড়ছে। তেমনি মুসলিমরাও সময়ে সময়ে পশ্চিমাদের উগ্রতা দেখেছে। ২০১০ সালে ফ্লোরিডার এক ব্যক্তির কোরআন পোড়ানোর খবরটা তুরস্কে পোস্টার লাগিয়ে প্রচার করা হয়েছে। যদিও ঐ ব্যক্তি পুরো খ্রিস্টান সমাজের হয়ে কাজটা করেনি, তবুও খবরটা এমনভাবে ছড়িয়েছে যেন সব খ্রিস্টানরাই কাজটা করেছে। উগ্রপন্থী কিছু আলেম রয়েছে যারা এ ধরনের খবরগুলো ছড়িয়ে দিয়ে মানুষকে উসকে দেয়। তারা অন্যের বিশ্বাসকে সম্মান করতে জানে না। অবশ্য সে সব আলেমদের দৃষ্টিভঙ্গি মূলধারার ইসলামী সমাজ থেকে বেশ আলাদা।

এ কথা স্বীকার করতে হবে, মুসলিম মানসিকতায় অনেক সংস্কার দরকার। ধর্মীয় স্বাধীনতার ব্যাপারে মুসলিমদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দরকার। মধ্যযুগে ইউরোপীয় অঞ্চলে যখন ক্যাথলিক শাসন চলছিল তখন সেখানে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের কোনো স্বাধীনতা ছিল না। অথচ সে সময়ের মুসলিম সাম্রাজ্যগুলো ছিল ধর্মীয় স্বাধীনতা চর্চার প্রাণকেন্দ্র। কিন্তু এখন আর তা নেই। নারী এবং সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে এখনকার মুসলিমরা অনেক সংকীর্ণ হয়ে গেছে। তাই এসব ইস্যুতে আলোচনা হওয়া দরকার, সংস্কার আনা দরকার। কিন্তু মুসলিম দেশগুলো যদি বিদেশী শক্তি বা সেক্যুলার একনায়কতন্ত্রের পদানত হয়ে থাকে, তাহলে ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব হবে না। এ ধরনের শাসক গোষ্ঠী শুধু ধার্মিক মুসলিম হওয়ার কারণে মানুষকে কারাগারে নিক্ষেপ করে। ফলে এ ধরনের শাসনব্যবস্থা মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কার প্রক্রিয়াকে বরং বাধাগ্রস্ত করেছে।

তাহলে পরিবর্তনের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো কী কী? গুরুত্বপূর্ণ হলো: ইসলামের প্রতি বিশ্বস্ততা, বৈশ্বিক পরিবর্তন সম্পর্কে বাস্তববাদী জ্ঞান ও যৌক্তিক চিন্তা। মানসিকতা হতে হবে উদার। আর এসব বিষয় নির্ভর করবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কী ধরনের মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে উঠছে- তার ওপর। এছাড়া শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, চিন্তাবিদ এবং জননেতৃবৃন্দ সামাজিক মূল্যবোধের ওপর কতটুকু আস্থাশীল- সেটাও বিবেচনার বিষয়। কেউ যদি পরিবর্তনের কথা বলে তাকে অবশ্যই উদারতার কথাও বলতে হবে। আর এ দায়িত্বটা পালন করতে হবে তার মূল্যবোধ ও বিশ্বাসের জায়গা থেকে, শুধুমাত্র বিশ্বাস প্রচার করার উদ্দেশ্যে নয়।

যুক্তরাষ্ট্রে ইদানীং কিছু লোক নাম কামিয়েছেন, যারা এক সময় মুসলিম ছিলেন। তারা বলছেন, ‘ইসলাম খুবই বাজে ধর্ম। তাই আমি এ ধর্ম পরিত্যাগ করেছি।’ আমি অবশ্য তাদের মতামতকে শ্রদ্ধা করি, যদিও তাদের সাথে এ ব্যাপারে একমত নই। পশ্চিমারা ভাবছে, তারা বুঝি মুসলিম সংস্কারক। কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব? মুসলিম সংস্কারককে তো আগে ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে, তারপরই না সংস্কার!

ক্রিস্টা টিপেট: তার মানে হলো, নামেমাত্র মুসলিম হওয়াটা সংস্কারের জন্যে যথেষ্ট নয়। সবার আগে জিনিসটাকে ধারণ করা জরুরি?

মোস্তফা আকিউল: যারা ইসলামের বদনাম করে বেড়ায় তারা মুসলিম বিশ্বের ইতিবাচক পরিবর্তনে নেতৃত্ব দেবে– এটা আপনি আশা করতে পারেন না। আসলে তারা চায় না কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আসুক। ইসলামের বিরুদ্ধাচারণকে সাধারণ মুসলিম জনগণ ইসলামের ওপর সরাসরি আঘাত বলে মনে করে। ফলে ইসলাম প্রশ্নে তারা আরো রক্ষণশীল হয়ে পড়ে।

ক্রিস্টা টিপেট: তুরস্ক সম্পর্ক একটা কথা প্রচলিত আছে যে, তুর্কি পরিচয় আর মুসলমানিত্ব- এই দুটি জিনিস নাকি সমার্থক। এ কথাটা আপনার লেখায় পেয়েছি এবং আপনি বলেও থাকেন। কিন্তু এ কথাও সত্য, ইস্টার্ন আর্থোডক্স খ্রিস্টানদের জন্যে তুরস্ক এখনো পূণ্যভূমি হিসেবে বিবেচিত। বিশ্ব জুড়ে এ ধর্মের প্রায় ৩০০ মিলিয়ন অনুসারী রয়েছে। আমরা গত সপ্তাহে আর্চবিশপ বার্থোলমিউর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তুরস্কে মুসলিম যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে খ্রিস্টানদের বসবাস। তাহলে কীভাবে মুসলিম পরিচয় শুধুমাত্র তুর্কি পরিচয়ের সমার্থক?

মোস্তফা আকিউল: অবশ্যই, সেন্ট বার্থোলমিউ (Bartholomew I) তুরস্কের ঐতিহ্য ও সম্পদ। একজন খ্রিস্টান ধর্মীয় নেতা হিসেবে আমি তাঁকে শ্রদ্ধা করি। তিনি ছিলেন জ্ঞানী ব্যক্তি। তাঁর প্রতিষ্ঠিত পেট্রিয়ার্ক কর্তৃক ধর্মীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যু নিয়ে আয়োজিত সংলাপগুলো বেশ গঠনমূলক। সেই প্রতিষ্ঠানটিকেও আমি শ্রদ্ধার চোখে দেখি। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, বিশ শতকের কিছু তুর্কি এই প্রতিষ্ঠানটিকে যথাযথ সম্মান দিতে পারেনি। এজন্য ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি নয় বরং জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিই দায়ী ছিল।

কারণ হিসেবে তুরস্কের সাথে গ্রীসের রাজনৈতিক উত্তেজনার কথা বলা যায়। বিরোধটা ছিল সাইপ্রাস নিয়ে। এসব রাজনৈতিক ইস্যুতে তুরস্কে গ্রীক বংশোদ্ভুত লোকদের হেয় প্রতিপন্ন করা হতো। যদিও তারা ছিল তুরস্কেরই নাগরিক। তবে তুরস্কের বেশিরভাগ মানুষ এ ধরনের কাজকে সমর্থন করতো না। অনেকেই তৎকালীন সময়ে নির্যাতিত মানুষগুলোর দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। অন্যদিকে, তৎকালীন সেক্যুলার তুরস্কে পেট্রিয়ার্ক অনুসারীদের পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা দেয়া হয়নি বলে গ্রীসেও তুর্কি মুসলিমরা পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করতে পারেনি।

ধর্মীয় স্বাধীনতা না পাওয়া খ্রিস্টান এবং ইহুদীদের মনে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। যা হোক, একবিংশ শতকের শুরুতে তুরস্কের অবস্থা দেখে আশা করতেই পারি, সেই বিপর্যয়ের অবসান ঘটেছে। যদিও বাক স্বাধীনতা ইস্যুতে এখনো একেপি’র সমালোচনা করার যথেষ্ট কারণ আছে। তবে এটাও সত্য যে, এরদোয়ান সরকার তুর্কি খ্রিস্টান ও ইহুদীদের ধর্মপালনের ওপর থেকে বিধি-নিষেধ তুলে নিয়েছে।

ক্রিস্টা টিপেট: পেট্রিয়ার্ক বার্থোলমিউ জানিয়েছেন, তাঁরা সেক্যুলার আমলের চেয়ে ইসলামপন্থী সরকারের আমলে অনেক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করতে পারছেন।

মোস্তফা আকিউল: একদম ঠিক। কারণ তুরস্কের সেক্যুলারিস্ট সরকার সকল ধরনের ধর্মচর্চাকে নিষিদ্ধ করেছিল, এমনকি খ্রিস্টান ধর্মকেও। ফলে সব ধর্মের ধার্মিক জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। কর্তৃত্ববাদী সরকারের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলে একমত ছিলেন। সে সময় প্রখ্যাত কিছু মুসলিম ব্যক্তিত্ব পেট্রিয়ার্ক ও সংখ্যালঘু ইহুদীদের ওপর যে কোনো ধরনের জাতীয়তাবাদী বা সাম্প্রদায়িক আচরণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। ব্যাপারটা ভাবতেই ভাল লাগে। তাঁদের মতো করে এখন আমাদেরও এগিয়ে আসতে হবে। এছাড়া পেট্রিয়ার্ক কর্তৃক পরিচালিত Halki Seminary স্কুলটাও তুরস্কের জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রতিষ্ঠান…

ক্রিস্টা টিপেট: স্কুলটা এখনো খুলে দেয়া হয়নি।

মোস্তফা আকিউল: অবশ্যই এটা খুলে দেয়া উচিৎ। এখনো পর্যন্ত খুলে না দেয়ার কারণ আমি জানি না। তবে তুরস্কের শিক্ষা আইনে এখনো কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। তুরস্কে কোনো ধরনের বেসরকারী শিক্ষাব্যবস্থার অনুমতি নেই। এসবের মূলে রয়েছে সরকারী নিয়ন্ত্রণ। এমনকি ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থাও সরকারের অধীন। এরদোয়ানের উচিৎ হবে এ ব্যাপারে দ্রুত সংস্কার আনা।

বিশ্বের সামনে ‘নয়া তুরস্ক’কে মডেল হিসেবে দাঁড় করাতে চাইলে আমাদের আগের চেয়ে আরো বেশি গণতান্ত্রিক এবং আরো ভালো মুসলিম হতে হবে। এমনকি আরো উদার হতে হবে। তবে এটা ঠিক যে সমস্যা থাকবেই। সবকিছু একেবারে যথাযথভাবে সমাধান হয়ে যাবে, এমনও নয়। তবে আমি আশা করি, এরদোয়ান সরকারের গৃহীত সংস্কার কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। এসব সংস্কারমূলক পদক্ষেপের ফলে তুরস্কের ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরাও উপকৃত হবে বলে আশা রাখি।

ক্রিস্টা টিপেট: তুরস্কের পরিবর্তনগুলো সেক্যুলার তুর্কিদের জন্যে শঙ্কার সৃষ্টি করছে। এক্ষেত্রে তাদের জন্যে পদক্ষেপটা কী ধরনের হবে? অর্থাৎ তুরস্কের উদীয়মান রাজনৈতিক ইসলামপন্থীরা তাদের জন্যে কী করবে?

মোস্তফা আকিউল: সেক্যুলারিস্ট তুর্কিদের কথা বলছেন তো? সেক্যুলার এবং সেক্যুলারিস্টদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।

ক্রিস্টা টিপেট: আচ্ছা, সেক্যুলার এবং সেক্যুলারিস্ট।

মোস্তফা আকিউল: উদারপন্থী সেক্যুলারদের চিন্তার সাথে সেক্যুলারিস্টদের পার্থক্য রয়েছে।

ক্রিস্টা টিপেট: ও আচ্ছা, অনেকে আবার সেক্যুলার হলেও ব্যক্তিগতভাবে ধর্মে বিশ্বাসী, তাই তো?

মোস্তফা আকিউল: হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। আপনার প্রশ্নটা ছিল সেক্যুলারিস্টদের সম্পর্কে। আসলে তাদের বুঝা উচিৎ, যদি তারা ক্ষমতায় যেতে চায় তাহলে নির্বাচনে জিততে হবে। নির্বাচিত সরকারের বিপরীতে তারা মিলিটারি এবং জুডিশিয়ারির মাধ্যমে এখনো ক্ষমতা ভোগ করছে। এগুলোর জোরেই মূলত তারা তাদের আদর্শটাকে এখনো টিকিয়ে রেখেছে। এজন্যেই হয়তো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে তারা ঝিমিয়ে পড়েছে। ভবিষ্যৎ তুরস্ক নিয়ে তাদের কোনো ভিশন নেই। তারা জানে না অর্থনীতি কীভাবে পরিচালনা করতে হয়। কথাগুলো মূলত তুরস্কের বর্তমান প্রধান বিরোধীদলকে নিয়ে যারা তুর্কি সমাজে সেক্যুলারিস্টদের প্রতিনিধিত্ব করছেন। অর্থনৈতিক ভিশন, বৈশ্বিক বুঝজ্ঞান, পররাষ্ট্রনীতি- এসব ব্যাপারে তাদের অবস্থান এরদোয়ানের একেপির তুলনায় খুবই দুর্বল। যদি তারা নির্বাচনে জিততে চায়, তুর্কি জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে চায়, তাহলে ইসলামপন্থীদের কাছ থেকে তারা শিক্ষা নিতে পারে।

ক্রিস্টা টিপেট: আমরা মানচিত্রে তুরস্কের বিস্ময়কর ভৌগোলিক অবস্থান নিয়ে কথা বলছিলাম। অর্থাৎ তুরস্ক বিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থান করছে এবং বিশ্বের নেতৃত্ব গ্রহণে প্রস্তুত হচ্ছে।

মোস্তফা আকিউল: তুরস্কের প্রতিবেশীগুলোর দিকে একবার তাকান। সিরিয়ার সাথে রয়েছে আমাদের সবচেয়ে দীর্ঘ সীমান্ত, দেশটা এখন সবচেয়ে অশান্তিতে আছে। তারপর আছে ইরান। এছাড়া ককেশাশের দিকে আছে আজারবাইজান, জর্জিয়া ও আর্মেনিয়া। দুঃখজনকভাবে আর্মেনিয়ার সাথে সীমান্ত যোগাযোগটা বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। আমাদের প্রতিবেশী প্রত্যেক দেশেরই আভ্যন্তরীণ সমস্যা রয়েছে। অপরদিকে ইউরোপীয় প্রতিবেশীদের দিকটা মোটামুটি স্থিতিশীল। অতীত বাদ দিলে গ্রীসের সাথে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ ভালো যাচ্ছে। তবে গ্রীসও এখন ভেঙে পড়ছে। তাই গ্রীসের সম্ভাব্য পরিবর্তন নিয়েও তুরস্ককে ভাবতে হবে। সুতরাং সব দিক বিবেচনা করলে প্রতিবেশীদের নিয়ে তুরস্ককে কঠিন সময় পার করতে হতে পারে।

অবশ্য এ ধরনের পরিবেশে সুবিধা-অসুবিধা- উভয় দিকই রয়েছে। একটা রাষ্ট্র তার প্রতিবেশীকে ইতিবাচকভাবেও প্রভাবিত করতে পারে। যেমন আরব বসন্তের সময় মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছিল। সিরিয়ার সাথে বর্তমানে তুরস্কের সম্পর্কে বেশ উত্তেজনাপূর্ণ। কারণ তুরস্ক সরকার যৌক্তিকভাবেই আসাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলছে। কিন্তু আমি মনে করি এ ধরনের ভয়ঙ্কর প্রতিবেশীকে সহায়ক বন্ধুতে পরিণত করে ফেলা যায়। যেমন ইরানের পরমাণু বিতর্কের কূটনৈতিক সমাধানে তুরস্ক বেশ দক্ষতা দেখিয়েছে। সংকট সমাধানে ইরানকে পশ্চিমাদের সাথে আলোচনার টেবিলে বসিয়েছে। অবশ্য সমাধান না আসা পর্যন্ত আলোচনা অব্যাহত রাখতে তুরস্ক চেষ্টা চালিয়ে যাবে। কিন্তু ইরানের সাথে আলোচনা…

ক্রিস্টা টিপেট: আমিও মনে করি তুরস্ক সেটা করতে পারবে।

মোস্তফা আকিউল: হ্যাঁ। ইস্তান্বুলে অনুষ্ঠিত ইরান ও পশ্চিমাদের মধ্যকার আলোচনাটা বেশ ফলপ্রসূ ছিল। বারাক ওবামার সাথে বৈঠক করে এরদোয়ান পরদিন গেলেন আয়াতুল্লাহ খামেনীর সাথে কথা বলতে। তুরস্কের দূতিয়ালির উপর উভয় পক্ষ আস্থা রেখেছে। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে এ ধরনের ঘটনা খুবই বিরল বলা যায়। ইরান হয়তো তুরস্কের সীমান্তবর্তী দেশ বলে এক্ষেত্রে সুবিধা অর্জন করতে পেরেছে। আশা করি, এটার ভালো একটা ফলাফল আসবে।

তুরস্ক তার সীমানার অপর পাশটা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ভয়ের মধ্যে ছিল। এক সময় স্কুলে আমাদের পড়ানো হতো, ‘তুরস্কের তিন দিকে সমুদ্র আর চতুর্দিকে শত্রুদেশ দিয়ে ঘেরা।’ ৮০’র দশকে স্কুলে আমরা এগুলো শিখেছি। আর প্রধানমন্ত্রী এরদোয়ান এসে বলছেন, তুরস্ক আর আগের মতো নেই। তুরস্ক হতে যাচ্ছে বৈশ্বিক দুনিয়ার অংশীদার। আমি এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানাই।

এ ধরনের আরো লেখা