তিউনিশিয়ায় ইসলামপন্থীদের মতাদর্শিক সমঝোতা
এডিটর’স নোট: বিশ্বব্যাপী ইসলামপন্থা একটি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ব্রুকিংস ইন্সটিটিউশনের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো শাদি হামিদ তার Islamic Exceptionalism: How the Struggle Over Islam Is Reshaping the World শীর্ষক বইয়ে এই পরিবর্তনের একটি চিত্র এঁকেছেন। বইটিতে Tunisia: Islamists Conceding Their Islamism শিরোনামে একটি চ্যাপ্টার রয়েছে। তিউনিশিয়ার রাজনীতি, বিশেষত সেখানকার ইসলামপন্থীদের কর্মকৌশল বোঝাপড়ার একটা চেষ্টা আমরা করে যাচ্ছি। এরই অংশ হিসেবে সিএসসিএস-এর পাঠকদের জন্য এই চ্যাপ্টারটি অনুবাদ করেছেন মাসউদুল আলম।
*****
রাষ্ট্র নিয়ে ইসলামপন্থীদের মধ্যে এক ধরনের অবশেসন রয়েছে। এ কারণে মিশরে তারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। এর ফলে তাদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। নিজেদের কর্মী তো বটেই, আরব অঞ্চলের ব্রাদারহুড ঘরানার অন্যান্য সংগঠনের আপত্তি সত্ত্বেও মুসলিম ব্রাদারহুড প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেয়। যার ফলে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে জটিল রাষ্ট্রগুলোর একটি পরিচালনার দায়িত্ব গত শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী ইসলামপন্থী সংগঠনটির কাঁধে এসে পড়ে।
যে আন্দোলনটি এক ধরনের নীতি-নৈতিকতা মেনে চলার চেষ্টা করতো, এই সিদ্ধান্তটি সে আন্দোলনকে এক অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেয়। তাদের নীতিগত অবস্থান হলো, ইসলামের স্বার্থকে দল ও রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বে বিবেচনা করতে হবে। ইসলামপন্থীরা প্রায়ই বলে থাকেন, তারা নিজেদের স্বার্থে ক্ষমতায় যাওয়ার পরোয়া করেন না। বরং তারা যে আদর্শের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, সেটাই তাদের নিকট গুরুত্বপূর্ণ। অন্য কেউ যদি এই চিন্তাধারা বাস্তবায়নে অগ্রসর হয় তাহলে তারা সর্বোতভাবে তাদেরকে সমর্থন করবে। (অথচ এখন, ক্ষমতা ও পদের প্রতি আগ্রহ খুব সহজেই ব্রাদারহুড আন্দোলনে একটি কলঙ্কতিলক এঁকে দিলো। তারা বলতো, পদ চাওয়া একটা নিন্দনীয় কাজ। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরাই কাউকে মনোনীত করবে।)
সমাজে যা ঘটে তার প্রতিফলনই কোনো না কোনোভাবে রাষ্ট্রে ঘটে। রাষ্ট্র সমাজের উপর নির্ভরশীল। কারা ক্ষমতায় যাবে এবং কীভাবে ক্ষমতা পরিচালনা করবে– এটি নির্ভর করে সমাজের দীর্ঘ ও ক্রমাগত পরিবর্তনের চূড়ান্ত ফলাফলের উপর। তাই, তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রেসিডেন্ট পদ গ্রহণ করা খুব আর্জেন্ট ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল না বলেই মনে হয়। ক্ষমতার জন্য এই বেপরোয়া ভাব দেখানো এক দৃষ্টিতে ব্রাদারহুডের প্রকৃত প্রস্তাবনার (পরিবর্তন শুরু করতে হবে ব্যক্তি থেকে) বিপরীত ধারণাকেই গ্রহণ করার নামান্তর। মনে হচ্ছে, ব্রাদারহুড যেন গোড়া থেকে পরিবর্তনের (bottom-up transformation) যে সম্ভাবনা, তার উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে।
তুরস্কে এরদোয়ান ও একেপি যেভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে, তা উঠতি ইসলামী প্রজন্মের কাছে কাজের ধরন হিসেবে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।[1] অবশ্য ‘আকর্ষণীয় হয়ে ওঠার’ মধ্যে কিছুটা সমস্যা রয়েছে। কারণ, এতে মসজিদ, পরিবার ও কমিউনিটির জন্য নির্ধারিত দায়িত্বগুলো রাষ্ট্র কর্তৃক গ্রহণ করে নেয়ার একটা আশংকা থাকে। একটি বিশেষ দলের সাথে এ ধরনের নিছক ধর্মীয় তৎপরতার সংশ্লিষ্টতা ঝুঁকিপূর্ণ। রাজনীতিতে ইসলামের ভূমিকা কিংবা নিছক ধর্মীয় ব্যাপারগুলোর ভূমিকা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার জন্য কাজ করা যদি একটি নির্দিষ্ট দলের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ে, তাহলে ধার্মিকদের ধর্মভীরুতার উপর দলটির রাজনৈতিক ব্যর্থতা এবং ভুল পলিসির নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়কারী মুসলমানদের ৭৪ শতাংশ ২০১৪ সালে এরদোয়ানকে সমর্থন দিয়েছিল। ২০১০ সালে তা ছিল ৬৭ শতাংশ।[2] ২০১৫ সালের জুনের নির্বাচনে একেপির রক্ষণশীল ভিত আরো বৃদ্ধি পেলেও তা সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের মতো যথেষ্ট বাড়েনি। সামগ্রিকভাবে বরং দলটির জনপ্রিয়তা কিছুটা কমেছে। যতদিন পর্যন্ত ইসলামপন্থীরা সাফল্যের দেখা পেয়েছে, ততদিন পর্যন্ত চিন্তার কিছু ছিল না। কারণ, একেপির শাসনামলে মাথাপিছু জিডিপি বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে এবং ১০ বছরের মধ্যে গড় জিডিপি বেড়ে প্রায় তিনগুণ হয়েছে। সুশাসন ও জীবনমানের উন্নতির সাথে তুর্কি ইসলামপন্থীদের নাম যুক্ত হয়ে পড়েছে।[3] কিন্তু তাদের নাম যদি রাজনৈতিক বিভেদ, সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ এবং একটি নিম্নমুখী অর্থনীতির সাথে জড়িয়ে যায়, তাহলে এর পরিণতি কী?
এরদোয়ানের স্বৈরাচারী আচরণের কারণে ‘ইসলামপন্থার প্রথম বড় ধরনের সম্ভাবনা’ একেপির পতন ঘটলে তিউনিশিয়ার ইসলামপন্থীরা ‘ইসলামপন্থার পরবর্তী বড় ধরনের সম্ভাবনা’ হিসেবে বিবেচিত হবে। স্বৈরাচারী শাসন ও গৃহযুদ্ধের উপর বিতৃষ্ণ আরব অঞ্চলের মানুষের নিকট তিউনিশিয়া একটি আকর্ষণীয় উদাহরণ হয়ে ওঠেছে। যার ফলে তিউনিশিয়ার প্রধান ইসলামী দল আন নাহদার (যার অর্থ হচ্ছে ‘রেনেসাঁ’) সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতার কারণে গণমানুষের প্রত্যাশা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
দ্যা গ্রেট ইসলামিস্ট হোপ
আন নাহদার সম্ভাবনা সহজেই অনুমেয়। আরব অঞ্চলের অন্যান্য ইসলামপন্থী দলে তরুণ সদস্যদের যেখানে প্রতিনিয়ত টিকে থাকার সংগ্রাম করতে হয়, আন নাহদা সেখানে নতুন প্রজন্মের নেতাকর্মীদের গড়ে তুলছে। যাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও বক্তব্য বয়স্কদের চেয়ে ভিন্ন।
ইংরেজি ও ফরাসী ভাষায় পারদর্শী, মাত্র আটাশ বছরের তরুণী সাইয়েদা ওয়ানিসি তিউনিশিয়ার তরুণ সংসদ সদস্যদের অন্যতম। তার বাবা আন নাহদার সদস্য ছিলেন। সরকারের নির্যাতনের মুখে তিনি পরিবারসহ প্যারিসের উদ্দেশ্যে তিউনিশিয়া ত্যগ করেন। তখন ওয়ানিসির বয়স ছিল মাত্র নয় বছর।[4] প্যারিসের প্রবাস জীবনে তিনি বেড়ে ওঠেন। একজন ফিলিস্তিনী-আমেরিকান বিশেষজ্ঞের বাসায় ২০১৫ সালের শুরুর দিকের এক সকালে জম্পেশ নাস্তা শেষে কফি পান করতে করতে তার সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। তার পরনে ছিল ফ্যাশনেবল হেডস্কার্ফ। রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মের ব্যবহার অর্থাৎ কোরআন-হাদীসের বক্তব্য অতিরঞ্জিত করে নেতৃবৃন্দ যেসব রাজনৈতিক বক্তব্য দিতো আন নাহদা কিছুদিন আগে তা ‘পরিত্যাগ’ করেছে, যদিও সেক্যুলার দলগুলো রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মের ব্যবহার অব্যাহত রেখেছে। ওয়ানিসি এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন। তবে নিজ পরিচয় সম্পর্কে তিনি সচেতন। বাগাড়ম্বরপূর্ণ কথাবার্তা বলে তিনি আলোচনাকে ভারাক্রান্ত করার প্রয়োজন মনে করেননি। কিন্তু তার নিজের ব্যাপারে বড় সমস্যা হলো– সরাসরি নির্যাতনের শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতা যার রয়েছে, তেমন ব্যক্তির মনে সেই কালো দিনগুলো ফিরে আসার যে আশংকা সবসময় কাজ করে, তেমন অভিজ্ঞতা তার নেই।
ধর্মকে ‘ব্যবহার’ করলে সাময়িকভাবে হয়তো লাভবান হওয়া যায়, কিন্তু এটা খুব সহজে বুমেরাংও হতে পারে। তিনি বলছিলেন, “আমরা, অর্থাৎ আন নাহদার তৎপরতা যদি কাউকে কখনো হতাশও করে, তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে নামাজ ছেড়ে দেয়াটা কারো জন্য প্রাসঙ্গিক বিবেচিত হবে না। যদি কোনো দিন আমরা জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলি, এমনকি ১০ শতাংশের বেশি ভোট নাও পাই; আমরা চাই, তেমন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও মসজিদগুলো যেন আক্রান্ত না হয়, হিজাব পরিহিত নারীরা রাস্তায় বেরিয়ে যেন বিপদে না পড়ে।”[5]
অন্যান্য ইসলামপন্থী দলগুলোর মতো আন নাহদাও দীর্ঘমেয়াদী কৌশলকেই একমাত্র কৌশল মনে করতো। কিন্তু ২০১১ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৩ সালের শেষ পর্যন্ত দুটি সেক্যুলার দলের সাথে কোয়ালিশন করে স্বল্প সময়ের জন্য ক্ষমতায় থাকার অভিজ্ঞতা ছিল আন নাহদার জন্য খুবই চ্যালেঞ্জিং ও সংকটপূর্ণ, যা তাদের অতীত রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার সাথে খাপ খায় না। বেন আলী ক্ষমতায় এসে সংগঠনটিকে ক্রমান্বয়ে নিঃশেষ করে দিয়েছিলেন। ফলে নব্বই পরবর্তী এক দশকে আন নাহদার কার্যকর কোনো অস্তিত্ব ছিলই না বলা যায়। দলের নেতৃবৃন্দকে জেলে পুরে রাখা হয়েছিল। অনেকে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও ইটালিতে নির্বাসিত জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছিল। আরব বসন্তের প্রথম ধাক্কাতেই বেন আলীর পতন ঘটে। তারপর দেশটির প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে আন নাহদা জয়লাভ করে। দল থেকে একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দলটির এই ক্ষমতা লাভকে আকস্মিক ঘটনাই বলা চলে। তবে পেছনে ফিরে তাকালে বুঝা যায়, তারা কিছু কৃতিত্বের দাবি করতেই পারে। তারা দেখিয়ে দিয়েছে সেক্যুলারদের সাথে ইসলামপন্থীদের ক্ষমতা ভাগাভাগি করা সম্ভব। তিউনিশিয়ার বেশিরভাগ প্রতিবেশী দেশের ক্ষেত্রে যা কল্পনাও যায় না। তবে সম্ভবত তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য হচ্ছে, ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে বৃহত্তর ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে তুলনামূলকভাবে উদার একটি সংবিধান পাশ করানো।
তারপরেও দলটি যে কোনো সময় ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। ২০১৩ সালে তা প্রায় হয়েও গিয়েছিল। দুজন বিশিষ্ট বামপন্থী নেতা আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার পর তিউনিশিয়ায় নজিরবিহীন রাজনৈতিক মেরুকরণ তৈরি হয়। পপুলার ফ্রন্টের মতো বামপন্থী দলগুলো অভিযোগ করে, এই হত্যাকাণ্ডের জন্য আন নাহদা পরোক্ষভাবে দায়ী। তাদের যুক্তি হলো, আন নাহদাই চরমপন্থীদেরকে তৎপরতা চালানোর সুযোগ করে দিয়েছে।[6] এই পরিস্থিতিতে তিউনিশিয়ার ইসলামপন্থীদের মধ্যে আবারো নির্যাতনের যুগ ফিরে আসার ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। একই সময়ে মিশরে সেনা অভ্যুত্থানের ফলে এই ভীতি আরো বেড়ে যায়। বহু কষ্টে অর্জিত গণতান্ত্রিক উত্তরণ প্রক্রিয়াকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আন নাহদার নেতৃবৃন্দ যে কোনো ধরনের সাংঘর্ষিক পরিস্থিতিকে এড়িয়ে চলতে থাকেন। অধিকাংশ বিরোধী সেক্যুলার দল দাবি করতে থাকে– হয় গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সংবিধান সভা ভেঙ্গে দিতে হবে, নয়তো গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার ভেঙ্গে দিতে হবে। না হলে উভয়টিই ভেঙ্গে দিতে হবে। ঠিক যেন মিশরের ঘটনার প্রতিধ্বনি! বিরোধী পক্ষগুলো পরোক্ষভাবে আন নাহদাকেই সরিয়ে দিতে চাচ্ছিল। মুরসির পতনের লক্ষ্যে মিশরে সংঘটিত তামাররুদ (বিদ্রোহ) আন্দোলনের পর তিউনিশিয়ায়ও একইভাবে তামাররুদ আন্দোলন শুরু হয়। মিশরের ‘ন্যাশনাল স্যালভেশন ফ্রন্ট’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিউনিশিয়ার ‘স্যালভেশন ফ্রন্ট’ আন নাহদা সরকারের নিয়োগকৃত স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অপসারণের লক্ষ্যে আন্দোলনের ডাক দেয়।[7]
ইসলামপন্থীরা নির্বাচনে জিতে এলেও তাদেরকে কখনোই সরকার চালাতে দেয়া হবে না– আন নাহদার এই আশংকা যে সঠিক, মিশরের পরিণতি থেকে তা নিশ্চিত হওয়া যায়।[8] ২০১৫ সালের শুরুর দিকে আন নাহদার নেতা ও সহ-প্রতিষ্ঠাতা রশিদ ঘানুশীর সাথে যখন কথা বলছিলাম, ততদিনে মিশরের ঘটনা ম্রিয়মান হয়ে গেছে। কিন্তু তার কাছে মিশরের ক্যু যেন তখনো খুব তাজা ছিল। তিনি বলছিলেন, মিশরের ফলাফল দেখে “এখানেও বিরোধীরা উচ্চাকাঙ্খী হয়ে উঠলো এবং ক্ষমতাসীনদেরকে রাস্তায় ছুড়ে ফেলতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে লাগলো…। এমনকি মিশরের মতো একই নামে তারা নিজেদেরকে অভিহিত করলো!”[9]
আমার ধারণা ছিল, আমার মতো পশ্চিমা দেশে বসবাসকারী গবেষকের সাথে কথা বলার সময় আন নাহদার কর্তাব্যক্তিরা গণতন্ত্রের প্রতি নিজেদের মহানুভবতা দেখাতে সচেষ্ট থাকবেন। কিন্তু আন নাহদার বেশিরভাগ নেতা তাদের সহযোগী আরব ইসলামপন্থীদের পতনের ব্যাপারে স্পষ্টতই আবেগতাড়িত ও ব্যক্তিগত মন্তব্য করেছেন। সংবিধান সভার ভাইস প্রেসিডেন্ট মেহেরজিয়া লাবিদী বলেন, “রাবেয়া স্কয়ারের ঘটনায় আমি ক্ষুব্ধ হয়েছি। ISIS-এর লোকেরা যে অমানবিক তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু মিশরে স্বয়ং রাষ্ট্রই বর্বর হয়ে উঠেছে। মিশরীয় সংঘাতের এই নিষ্ঠুরতা তিউনিশিয়াতেও বিশাল ধ্বংসাত্মক শক্তি হয়ে ওঠার আশংকা ছিল। কিন্তু তিউনিশিয়ার কেউই এটি চায়নি। তাই রাজনীতিবিদরা সংলাপের জন্য আলোচনার টেবিলে বসেছেন।[10] এবার আন নাহদার সংসদ সদস্য ত্রিশ বছর বয়সী তরুণী ইমান বেন মোহাম্মদের কথা বলা যাক। তিনি বলেছেন, “মিশরের ঘটনার জন্য আমরা মর্মাহত। তবে আমাদের সমর্থকদেরকে কনভিন্স করার জন্য এই ঘটনা ইতিবাচক হয়েছে বলা যায়। তারা দেখেছে, অতি উৎসাহী কর্মকাণ্ড থেকে ব্রাদারহুড সাময়িকভাবে লাভবান হলেও দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অথচ গণতন্ত্র থাকার উপরেই নির্ভর করছে আপনার রাজনৈতিক অস্তিত্ব।[11]
সমঝোতার মাধ্যমে স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ায় হয়তো আন নাহদার পতন ঘটতে পারতো। তিউনিশিয়ার প্রেক্ষাপট তেমনই বলে। তারপরও এত বড় ঝুঁকি নেয়ায় এর কৃতিত্ব দলটির প্রাপ্য। সবচেয়ে বড় কথা হলো, যে কোনো ধরনের খারাপ পরিস্থিতিকে তারা এড়াতে পেরেছে। ‘স্বাভাবিক’ গণতান্ত্রিক পরিবেশেও এতটা আশা করা যায় না। অথচ আন নাহদা কিন্তু একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছিল। সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতি হিসেবে বিরোধী পক্ষ সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামাতে চাইলে অনাস্থা ভোট আয়োজনের চেষ্টা করতে পারতো। সেক্ষেত্রে আন নাহদার দায়িত্ব ছিল জনগণের এ ধরনের কোনো ইচ্ছা থাকলে, তা ব্যক্ত করার সুযোগ দেয়ার জন্য আগাম নির্বাচনের আয়োজন করা। কিন্তু সেখানে এসব কিছুই ঘটেনি। একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখার সুযোগ পেয়েও সেক্যুলাররা তা কাজে লাগাতে মোটেও রাজি ছিল না। ফলে আন নাহদা ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, অন্যসব অগ্রগতি সত্ত্বেও অতীতে তো বটেই, এমনকি বর্তমানেও তিউনিশিয়া একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। গণতান্ত্রিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এখন পর্যন্ত ‘স্বাভাবিক’ হয়ে ওঠেনি। তাই আন নাহদার মতো ধর্মভিত্তিক দলকে বিকল্প কৌশল অবলম্বন করে চলতে হচ্ছে। এই জটিল পরিস্থিতিকে সাইয়েদা ওয়ানিসি তুলনা করেছেন পরস্পরের প্রতি প্রচণ্ড গতিতে ধাবমান দুটি হাই-স্পিড ট্রেনের সাথে। বলাবাহুল্য, ট্রেন দুটি হচ্ছে অনমনীয় সেক্যুলার ও ইসলামপন্থী পক্ষ। ফলে এক পক্ষকে নিরাপদ পথ বেছে নিতে হয়েছিল। ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত তাদের ছাড় দেওয়া অব্যাহত রয়েছে। এরই অংশ হিসেবে দেশটির সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে সুসংগঠিত দল আন নাহদা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এমনকি অন্য কোনো প্রার্থীকেও তারা সমর্থন দেয়নি। তারপর ২০১৪ সালে সংসদ নির্বাচনের সময় একটি অদ্ভূত দৃশ্য দেখা গেলো– পরাজিত দল নিজেদের পরাজয়কে উদযাপন করছে! অবশ্য ইসলামপন্থী দলগুলোর ‘ইচ্ছাকৃত পরাজয়ের’ ব্যাপারটি আরব বসন্তের আগে থেকেই খুব অস্বাভাবিক কিছু ছিল না।[12] আন নাহদার একজন জ্যেষ্ঠ নেতার উচ্ছ্বাস ছিল এ রকম– আমরা ভারমুক্ত হয়েছি, আলহামদুলিল্লাহ।[13]
তবে এই ঘটনার পর ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেক্যুলার নিদা তিউনেসের সাথে কোয়ালিশন সরকারে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্তটি ‘দৃষ্টিকটু’ ছিল। ওয়ানিসি অবশ্য ব্যাপারটা স্বীকার করে নিয়ে বলেছেন, আমার মতো আমেরিকানের জন্য নাকি ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পারা কিছুটা কঠিন। ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানরা কখনোই একসাথে একই সরকারে থাকতে চাইবে না– তার এই ব্যাখ্যা সম্ভবত ঠিকই আছে। কিন্তু এর ফলে আবারো প্রশ্ন ওঠে, আন নাহদা কেন এমন কিছু করতে গেলো, কোনো ‘স্বাভাবিক’ গণতান্ত্রিক দল যা করবে না? ২০১৪ সালের অক্টোবরের নির্বাচনে সংসদীয় আসনের ৩১ শতাংশ সিট পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও একুশটি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে মাত্র একটি (তাও সেটি হলো তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়) এবং তিনটি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী পদের বিনিময়ে আন নাহদা সমঝোতা করেছে। আপনি যদি সরকারে অংশগ্রহণ করতেই চান, তাহলে কেন মাত্র একটি ক্যাবিনেট পদ নিলেন? একা একজন মন্ত্রীর হয়তো প্রতীকী তাৎপর্য আছে, কিন্তু এটি পরিস্কারভাবে প্রমাণ করে দিয়েছে: আন নাহদা তথা ইসলামপন্থীদেরকে অভ্যন্তরীণভাবে কোনঠাসা করা যতটা কঠিন, বাইরে ততটা নয়।
এ ব্যাপারে তৃণমূল পর্যায়ে অসন্তুষ্টি থাকলেও আন নাহদার নেতারা বিশ্বাস করেন– এটাই হলো একমাত্র অনুসরণীয় পন্থা। তাদের এই বিশ্বাস ঈমানের প্রায় কাছাকাছি। এমনই একজন নেতা হলেন সাঈদ ফারজানী। ভূতপূর্ব প্রখ্যাত সাংবাদিক অ্যান্থনি শাদীদ ২০১২ সালে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক নিবন্ধে তার ব্যাপারে আলোকপাত করেছিলেন। প্রথম দিকে ফারজানী ছিলেন কিছুটা কট্টরপন্থী। তিউনিশিয়ার ‘জাতির জনক’ হাবিব বুরগিবার বিরুদ্ধে তিনি তখন একটা অভ্যুত্থান প্রায় করে ফেলেছিলেন। কিন্তু বুরগিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বেন আলী অকল্পনীয়ভাবে ফারজানী ও তার সহযোগীদের ডিঙ্গিয়ে, তাদের সতের ঘণ্টা আগেই অভ্যুত্থান করে ক্ষমতায় চলে আসেন। পরে ফারজানী গ্রেফতার হন। তাকে অকথ্য নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনে তার মেরুদণ্ড ভেঙ্গে যায়।[14]
অ্যান্থনি শাদীদের সাথে সাক্ষাৎকারে ফারজানী ১৯৭০-এর দশকে রশিদ ঘানুশীর সাথে তার পড়ালেখার কথা স্মরণ করছিলেন। ফারজানী বলছিলেন, “আমরা মুসলমানরা কেন পিছিয়ে আছি? এর অন্তর্নিহিত কারণ কী? এটাই কি আমাদের নিয়তি? ঘানুশী সবসময় এ জাতীয় বিশ্ব পরিস্থিতি ও রাজনীতি নিয়ে কথা বলতেন।”[15] আধুনিক ইসলামপন্থীদের মধ্যে বহু আগে থেকেই এই প্রশ্নগুলো ছিল। আন নাহদার নেতৃবৃন্দের ধারণা ছিল, তারা নিজেরা এই প্রশ্নগুলোর এক ধরনের সমাধান দিতে পারবেন। যদিও ইতোমধ্যে তাদের কর্মপদ্ধতিতে যথেষ্ট পরিবর্তন এসেছে। কোয়ালিটি অর্জন করাটা দীর্ঘমেয়াদী ব্যাপার। যা হোক, ২০১৪ সালের নির্বাচনের হতাশাজনক সমাপ্তির পর আন নাহদার গৃহীত কৌশলের কার্যকারিতা নিয়ে আমি ফারজানীকে প্রশ্ন করলে তিনি এক ধরনের সমঝোতার কথা স্বীকার করে নিয়ে বললেন, “সরকারে অংশগ্রহণ এবং একটি মন্ত্রী পদ গ্রহণ করার ফলে কিছুটা জনপ্রিয়তা যে হারাতে যাচ্ছি, তা আমরা জানি।[16] তিনি জোর দিয়ে বলছিলেন, “এটা এক ধরনের অন্তবর্তী সময়।” এই অবস্থা থেকে উত্তরণে পনের থেকে বিশ বছর সময় লেগে যেতে পারে। তার মতে, তারপরই কেবল আন নাহদার কাজকর্ম নিয়ে এ ধরনের প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। তিনি বার বার এ জাতীয় কথাগুলোই বলছিলেন। এখন অন্যরকম একটা সময় চলছে। এই সময়ের লক্ষ্য হলো পরিবর্তন প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করা, ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা এবং মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করা। এতে করে দলীয় ঐক্যকে কম গুরুত্ব প্রদান কিংবা অস্থিরমনা সমর্থকদের বিরক্তি বেড়ে গেলেও এই কাজগুলো করতে হবে।
* * *
আন নাহদার এই কৌশল কি দূরদর্শী রাজনীতির অংশ, নাকি উচ্চাকাঙ্খী চিন্তা– তা নির্ভর করছে আপনি ব্যাপারটাকে কীভাবে দেখছেন। কারো পক্ষে যতটুকু স্বচ্ছতার কথা কল্পনা করা সম্ভব, ২০১৪ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় আন নাহদা ততটুকু স্বচ্ছতাই দেখিয়েছে। যদিও অধিকাংশ দলই তা করেনি। দলটি ইসলামপন্থার উপর কম গুরুত্ব দিয়েছে এবং নিজেদেরকে জাতীয় ঐক্যের ‘মধ্যমনি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আন নাহদার প্রথম সারির মুখপাত্রগণ বয়সে মূলত তরুণ। তাদের দাড়িবিহীন কর্মকর্তাদেরকে আপনার সহজেই নজরে পড়বে। দেশের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান নিয়ে তারা বিরতিহীনভাবে কথা বলে যেতে পারেন। তারা যে একটি ইসলামপন্থী দলের সদস্য, নিছক কথাবার্তা শুনে তা বুঝার কোনো উপায় নেই। একজন ক্যাম্পেইন অর্গানাইজার আমাকে বলেছেন, তাদের এই আচরণ ও আত্মসচেতনতা আন নাহদার ‘নয়া দৃষ্টিভঙ্গির’ প্রতিফলন। ধর্মীয় রেটরিকের ব্যবহার ছেড়ে দলটি সতর্ক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারায় তারা গর্বিত।[17]
আদর্শিক বিভাজনের প্রশ্নে আন নাহদা যেখানে সুর নরম করছে, নিদা তিউনেস সেখানে ইসলামপন্থী বনাম সেক্যুলার প্রশ্নে সুর চড়াচ্ছে। যা স্পষ্টতই সংঘাতের উসকানি। পতিত শাসকগোষ্ঠী, বামপন্থী এবং নিও-লিবারেল ব্যবসায়ীরা মিলে নিদা তিউনেস গঠন করেছে। দলটির এই গ্রুপগুলো অন্যসব বিষয়ে খুব একটা একমত হতে না পারলেও ইসলামপন্থী ও ইসলামপন্থার অস্তিত্বই যে একটা হুমকি এবং একে যে পরাজিত করা প্রয়োজন, সে ব্যাপারে পুরোপুরি একমত। তিউনিশীয় সেক্যুলারদের নিয়ে যে কয়েকজনের গভীর জানাশোনা আছে, তাদের একজন হলেন অ্যানি উলফ। তিনি লিখেছেন, “ইসলামপন্থার বিরোধিতাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা (নিদা তিউনেসের) অন্যতম দুর্বলতা।”[18] তাত্ত্বিকভাবে হয়তো এটি সত্য। তবে নির্বাচনী রাজনীতির জন্য মেরুকরণ, মতাদর্শ এবং ব্যক্তি আক্রমণ আপাতদৃষ্টিতে সুফল বয়ে আনে বলেই মনে হয়। ২০১১ সালে যে দলটির অস্তিত্বই ছিল না, সেই নিদা তিউনেস ৩৭.৫ শতাংশ ভোট এবং ৮৬টি আসন পেয়ে নির্বাচনে প্রথম স্থান লাভ করেছে। এছাড়া দলটির প্রধান নেতা ৮৮ বছর বয়সী বেজি সাইদ এসেবসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সহজেই জয় লাভ করেছেন। অন্যদিকে, ঘানুশী আরো বেশি সমঝোতার মনোভাবসম্পন্ন হয়ে ওঠেছেন। সংঘাত এড়িয়ে তিনি মধ্যপন্থী পথে এগিয়ে গেছেন। এভাবে তিনি এক অর্থে ফাউন্ডার ফাদার হিসেবে নিজের ইমেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন, নিজের জনপ্রিয়তার উচ্চমান প্রতিষ্ঠা করেছেন।[19]
সমালোচকদের মতে, এসেবসির উত্থান বিপ্লবের প্রতি এক ধরনের আঘাত। এসেবসি ছিলেন বেন আলী প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। হাবিব বুরগিবার আমলেও তিনি স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ছিলেন। অবশ্য, তিউনিশীয় সেক্যুলারদের অনেকে এমনটা মনে করেন না। নির্বাচনের আগে পিউ রিসার্চের এক জরিপের ফলাফল এমনটাই ইঙ্গিত করে। দেখা গেছে, একনায়কতন্ত্রের প্রত্যাবর্তনকে সমর্থনের প্রশ্নে ধর্মানুরাগীদের চেয়ে ধর্মীয় আচার কম মানা তিউনিশীয়রাই বেশি এগিয়ে। জরিপে অংশগ্রহণ করা ৪১ শতাংশ মানুষ একনায়কতন্ত্রকে সমর্থন করেছেন। এরা অনিয়মিতভাবে নামাজ পড়েন। অন্যদিকে, ৫২ শতাংশ মানুষের মতামত হলো, ‘একজন শক্তিশালী নেতার’ কাছে গণতন্ত্রই অধিকতর পছন্দনীয়। এই মতামত প্রদানকারীরা প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন।[20] ২০১২ সালের আরেক জরিপে ৭৮ শতাংশ তিউনিশীয় মত দিয়েছিলেন, তাদের জীবনে ধর্ম ‘খুব গুরুত্বপূর্ণ’। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৬৩ শতাংশ জানিয়েছেন, তারা প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন এবং ৯৬ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন, তারা রমজানে রোজা রাখেন।[21]
“মধ্যপন্থার দিকে আমাদের যাত্রা”
তুরস্কের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, প্রচণ্ডভাবে বিভক্ত তুর্কি সমাজে ইসলামপন্থীদের পক্ষে ও বিপক্ষে শক্ত অবস্থান রয়েছে। মাঝামাঝি কোনো অবস্থান সেখানে টিকতে পারে না। তাই একটা শক্ত অবস্থান তৈরি ও গণভিত্তি পেতে হলে এই বাস্তবতা বিবেচনায় রাখা সেখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তবে তুরস্কের এই প্রেক্ষাপটের আলোকে কেউ যদি আন নাহদার নির্বাচনী কৌশলকে ব্যর্থ মনে করে (যদিও তা ব্যর্থই বটে), তাহলে একটা বিষয় এড়িয়ে যাওয়া হয়। মধ্যপন্থার দিকে এগিয়ে যাওয়া মানেই নির্বাচনে জয়ী হওয়া নয়– আন নাহদার শীর্ষ নেতৃত্ব এই সত্যটা মেনে নিতে প্রস্তুত। তারা মনে করেন– তারা যা করছেন, পরিণতির কথা না ভেবেই সেগুলো করে যেতে হবে। ওয়ানিসি আমাকে যেমনটা বলেছিলেন, “আমরা এই মুহূর্তে নির্বাচনী কৌশল নিয়ে ভাবছি না। বরং তিউনিশিয়ার সামগ্রিক ভালোমন্দ মাথায় রেখেই কাজ করছি। এটাকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি। এর ফলে আমরা যদি নির্বাচনে দ্বিতীয় অবস্থানেও চলে যাই, তাহলে আমরা তা নিয়েই সন্তুষ্ট।” এ প্রসঙ্গে মেহেরজিয়া লাবিদীর কথাও বলা যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন, মধ্যপন্থার দিকে যেতে হলে মূল্য দিতে হয়। নির্বাচনে হেরে যাওয়া হচ্ছে আমাদের সেই প্রদেয় মূল্য।”
আন নাহদার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ও শীর্ষস্থানীয় তাত্ত্বিক নুরুদ্দীন আরবাউয়ীর মতো কেউ কেউ স্বীকার করেছেন, বিভিন্ন পলিসির খুঁটিনাটি বিষয়ের উপর অত্যাধিক গুরুত্বারোপ এবং দক্ষ বিশেষজ্ঞদের নিয়োগের মাধ্যমে আন নাহদার উচ্চাকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটেছে বলা যায়। আরবাউয়ী আমাকে বলেছেন, “আমরা যদি বাস্তববাদী হই (অবশ্য এখন পর্যন্ত আমরা বাস্তববাদী) তাহলে বলতে হয়, দলের প্রকৃত কর্মসূচি মূল্যায়ন করে কেউ ভোট দেয় না। এমন একজনও নেই, যে ব্যালট বাক্সের নিকট গিয়ে মনে করেছে, এদের কর্মসূচি যেহেতু উদার, তাই এদেরকেই আমি ভোট দিলাম। বরং আমরা যেহেতু আন নাহদা, সে জন্যই সমর্থকরা আমাদেরকে ভোট দিয়েছে। আর অন্যরা নিদা তিউনেসকে ভোট দিয়েছে, যেহেতু তারা আন নাহদার বিরোধী।”[22]
ভালো-মন্দ যাই হোক, তিউনিশিয়ার গণতান্ত্রিক উত্তরণের দায়িত্ব আন নাহদা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। আরেকটু এগিয়ে আমরা ‘তিউনিশীয় মডেলের’ কথা বলতে পারি। সেটা হলো: ইসলামপন্থীরা তাদের ইসলামপন্থার ব্যাপারে এক ধরনের আপস করেছে। কারণ তারা তাদের চারপাশে যেসব বিকল্প পদক্ষেপ দেখেছে, তার সবগুলোতেই গণতন্ত্রের পতন ঘটেছে। আন নাহদা হয়তো অযথা ভয় পেয়েছিল, তাই সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ঝুঁকি নেয়নি। তাছাড়া লিবিয়া, সিরিয়া ও ইয়েমেনের উত্তেজনা দরজার উপর কড়া নাড়ছিল, সে কারণেও হয়তো তারা সুযোগটি গ্রহণ করেনি। এ ব্যাপারে ঘানুশীর ব্যাখ্যা হচ্ছে, “হ্যাঁ, আমরা ছাড় দিয়েছি, এটা সত্য। কিন্তু এটি আমাদের জন্য লোকসানী নয়। আমাদের ন্যায্যতা থাকা সত্ত্বেও ২০১৩ সালে আমরা যদি সরকারে থাকতাম, তাহলে দেশ হয়তো ধ্বংস হয়ে যেত।”[23]
এটা নিছক কথার কথা নয়। মধ্যপন্থার দিকে আমাদের এই যাত্রা সংগঠনের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ ফলাফল বয়ে এনেছে – ঘানুশী আমাকে এমনটাই বলেছেন।[24] আরব বসন্তের শুরু থেকেই আন নাহদার নেতৃবৃন্দ একটি সংকটের মোকাবেলা করতে না করতেই আরেকটা সংকটের মুখোমুখি হচ্ছেন। প্রত্যেকবারই মতাদর্শিক বা বিপ্লবী দাবি থেকে বিরত থাকার জন্য সমর্থকদেরকে নানাভাবে বুঝাতে হয়েছে। সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের সময় শরীয়াহ, লিঙ্গ সমতা এবং ব্লাসফেমি সংক্রান্ত তিনটি বিতর্কিত ধারা থেকে দলটি সরে আসে।[25] আন নাহদার সংসদীয় ব্লক শরীয়াহকে আইনের ‘উৎসসমূহের উৎস’ হিসেবে প্রস্তাব করেছিল।[26] আরব দেশগুলোর রীতি অনুসারে যা ছিল খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। যে কোনো ইসলামপন্থী মাত্রই মনে করে থাকেন, শরীয়াহকে যে যেভাবেই ব্যাখ্যা করুক না কেন, জনজীবনে এর একটা ভূমিকা থাকবে। তা সত্ত্বেও একটি ইসলামপন্থী দল শরীয়াহর উল্লেখ পর্যন্ত না করে একটি সংবিধান অনুমোদন করেছে। যদিও সংবিধান সভায় আন নাহদার প্রাধান্য ছিল। তারচেয়েও বড় কথা হলো, তিউনিশীয় সমাজে ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এসব কিছুর পরও আন নাহদা এই ছাড় দিয়েছে। ২০১৪ সালে পিউ রিসার্চ পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, ৫৩ শতাংশ তিউনিশীয় মনে করেন, আইন প্রণয়নে ইসলামী মূল্যবোধ ও নীতিমালা মেনে চলা উচিত। এরমধ্যে আবার ৩০ শতাংশ আরেক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, আইন প্রণয়নে পুরোপুরিভাবে কোরআনের বিধান অনুসরণ করা উচিত।[27] শরীয়াহকে সংবিধানের একটি অনুচ্ছেদ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার যে বিশেষ কোনো প্রয়োজন নেই, আন নাহদার রক্ষণশীল এক্টিভিস্টদেরকে তা বুঝাতে চেষ্টা করেছিলেন দলটির বিশিষ্ট নেতা রিয়াদ শাইবি। যিনি পরে পদত্যাগ করেছেন। সে কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, “তাদেরকে বুঝানো ছিল দুঃসাধ্য। এতে কেউ কেউ এতটা ক্রুদ্ধ হতেন, যা প্রায় ঘৃণার পর্যায়ে চলে যেতো।”[28]
তবে ঘানুশীর ক্যারিশমা ও দূরদর্শিতার ফলে দলটির নেতৃবৃন্দ সঠিক পথেই এগিয়েছে। শরীয়াহর উপর গুরুত্বারোপ করলে কেন অনাহুত হাঙ্গামা তৈরি হতে পারে, সেই ব্যাপারটি তারা তাদের জনশক্তির কাছে ব্যাখ্যা করেছে। দলীয় শৃঙ্খলা ঠিক রাখার দিকে মনোযোগ দিলেও আন নাহদা বৃহত্তর সমাজের নিকট শরীয়াহর ব্যাপারে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করার ব্যাপারে কম মনোযোগ দিয়েছে। এর ফলে দলটির প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। আবার তাদের নিকট যখন বৈপ্লবিক দাবি-দাওয়ার প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়, তখনো তাদেরকে একই ধরনের সমস্যায় পড়তে দেখা যায়। ২০১৩ সালে মাত্র এক ভোটের ব্যবধানে প্রস্তাবিত ‘এক্সক্লুশন ল’ সংসদে পাশ হতে পারেনি। এই আইন পাশ হলে ১৯৮৭ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বেন আলী সরকারে কর্মরত সকল কর্মকর্তার পাশাপাশি পূর্ববর্তী শাসক দলের সকল সিনিয়র সদস্যসহ তিউনিশিয়ার হাজার হাজার মানুষের উপর সরকারী পদে বহাল থাকার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়ে যেত।[29] এই বিল ঠেকানোর লক্ষ্যে আন নাহদার প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রতিনিধি যেন সর্বশেষ মিনিটে তাদের ভোট প্রদান করে, এ বিষয়ে রাজি করাতে ঘানুশী তার মূল্যবান রাজনৈতিক পুঁজির অনেকটা ব্যয় করেছেন। যে কোনো সংগঠনেরই সামর্থ্য থাকে সীমিত। তারপরেও বাস্তবতা হলো অভ্যন্তরীণ বিতর্কের সমাধান করতেই দলের রাজনৈতিক সামর্থ্যের অনেকটা খরচ হয়ে যায়।
যেসব ইসলামপন্থী আন্দোলন প্রতিনিয়ত নতুন নতুন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়, সে দলগুলোর মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণভাবে কাজ করার ক্ষমতাসম্পন্ন দলের সর্বোচ্চ একটি উদাহরণ হলো আন নাহদা। সেক্যুলার এলিট, নানাবিধ আন্তর্জাতিক শক্তি কিংবা কৌতুহলী যে কারো কাছে এই আন্দোলনগুলোকে নিশ্চিতভাবে ‘মধ্যপন্থী’ বলে মনে হবে। আবার, তাদের রক্ষণশীল অংশ এক ধরনের আত্মপরিচয়, মতাদর্শ ও ধর্মীয় মান বজায় রাখতে চায়। সেটি সম্ভব না হলে অন্ততপক্ষে এ ব্যাপারগুলোকে আন্দোলনের ‘চেতনা’ হিসেবে ধরে রাখতে চায়। দুই কূল রক্ষার এই অন্তহীন প্রচেষ্টা এক ধরনের আত্মপরিচয়ের সংকট তৈরি করে। একজন সিভিল সোসাইটি অ্যাক্টিভিস্ট আমাকে বলেছেন, “আন নাহদা অন্য কারো মতো নয়। এমনকি, অন্যরা তাদের ব্যাপারে যা অনুমান করে, তারা তেমনও নয়।”[30] ২০১৫ সালের এপ্রিলে একজন ফরাসী সাংবাদিকের সাথে সাক্ষাৎকারে ঘানুশী নিজেকে একটি ঝুলন্ত রশির উপর দিয়ে হাঁটা ব্যক্তির সাথে তুলনা করেছেন। ব্লাসফেমির বিরুদ্ধে ইসলামপন্থীদের গতানুগতিক অবস্থান এবং উত্তরাধিকার ও জেন্ডার সমতার ব্যাপারে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গিই তিনি বার বার আওড়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সমকামীদের ব্যাপারে তিনি সহনশীলতা দেখিয়েছেন। এ ব্যাপারে তার যুক্তি হলো, ‘কোনো ব্যক্তির উপর গোপনে নজরদারি’ করার কথা ইসলাম বলে না।[31]
আন নাহদার এই মধ্যপন্থী অবস্থান কতটা ‘কৌশলগত’ এবং কতটা খাঁটি আদর্শিক বিবর্তনের ফসল? তিউনিশিয়ার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, অর্থাৎ দুর্বল পরিবর্তন প্রক্রিয়া ও দমনপীড়নের নেতিবাচক ফলাফলের দিকে যদি নজর দেই, তাহলে আন নাহদার সতর্ক পদক্ষেপ ও সমঝোতার নীতিকে আমরা সহজে বুঝতে পারবো। এই অতীত অভিজ্ঞতার কারণেই তাদের বিশ্বাস ও কাজের মধ্যে সম্পর্ক খুব কম। এটি নিশ্চিত, বিশ্বাস কর্মকে প্রভাবিত করে। কিন্তু দীর্ঘসময় ধরে কোনো কিছু ক্রমাগত বলতে থাকলে এবং করতে থাকলে তা উল্টোভাবে আপনার বিশ্বাসকেই পরিবর্তন করে ফেলতে পারে। যদিও শুরুতে আপনি এ ব্যাপারে মোটেও সচেতন থাকেন না।
* * *
আন নাহদার নেতৃবৃন্দের মধ্যে যারা নীতি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে অনড় বা কঠোর মনোভাবসম্পন্ন, তাদের মাঝে শায়খ হাবিব আল লাউজ অন্যতম। দলটির ইসলামী পরিচয় যেন অক্ষুন্ন থাকে, সে জন্য তিনি নিজ উদ্যোগে এক ধরনের অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেন। দলটি দিন দিন আপসের দিকে এগিয়ে যাওয়ায় তিনি উদ্বিগ্ন। ১৯৮০’র দশকের শেষ দিকে আন্দোলনটি যখন নিজের নাম ‘হারাকাত আল ইতিজাহ আল ইসলামীর’ পরিবর্তে ‘আন নাহদা’ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়, তখনো তিনি এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন। দুই দশক পর এখনো তিনি একই ধরনের সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংসদীয় অধিবেশনের একটা উত্তেজনাপূর্ণ সময়ে আমি আল লাউজের সাথে প্রথমবারের মতো দেখা করি। আন্দোলনটির এই অন্যতম ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব এখন বেশ বৃদ্ধ। তের বছরের নির্জন কারাবাসকালে তার একটি চোখ অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাকে দেখতে বিশ বছরের প্রাণবন্ত যুবকের মতোই মনে হচ্ছিল। ইতিহাস নিজের পক্ষে ছিল বলে বিশ্বাসী কোনো ব্যক্তি যেভাবে আত্মবিশ্বাসের সাথে কথা বলে, তিনি সেভাবেই কথা বলছিলেন। নিছক কৌশল হিসেবে মধ্যপন্থার দিকে দলের এগিয়ে যাওয়াকে তিনি নাকচ করে দেন। তিনি আমাকে বলেছেন, “আমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যিনি শরীয়াহ আইনে বিশ্বাস রাখেন না। আমাদের সবাই বিশ্বাস করে, একদিন মদ নিষিদ্ধ করা হবে। আমাদের ইসলামী আইডিয়াগুলো সর্বোৎকৃষ্ট পদ্ধতিতে কীভাবে তুলে ধরা যায়, সেটা নিয়েই কেবল আমাদের মতদ্বৈততা।”[32]
দুই বছর পর যখন তার সাথে আমি আবার দেখা করলাম, তখন তিনি আগের মতো নিঃশঙ্ক ছিলেন না। এই দুই বছরে অনেক কিছু পরিবর্তিত হয়ে গেছে। তিনি যে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছেন, তা বুঝতে পারছেন। তিনি আমাকে আন নাহদার সদর দপ্তরে দেখা করতে বলেছিলেন। কিন্তু সেখানে তো প্রায় সবাই তার থেকে ভিন্ন চিন্তাধারা পোষণ করে। তাই আমি ভাবলাম, তিনি যেহেতু দলের নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সাথে আসলেই মানিয়ে নিতে পারছেন না, তাই সেখানে তার সাথে দেখা করাটা উচিত হবে না। সদর দপ্তরের কর্মকর্তাদের অধিকাংশই তরুণ। যাদের কমন পোশাক হলো সাদা শার্ট, কালো স্যুট, মানানসই চিকন কালো টাই। যেন আমরা একটি ফ্যাশন শুট সেশনে এসে পড়েছি– স্যুটগুলো চোখে পড়ার মতো সুন্দর করে বানানো এবং পরনের প্যান্টগুলো বেশ সরু। অন্যদিকে, আল লাউজ পরিধান করেন ঐতিহ্যবাহী জোব্বা, মাথায় থাকে লাল পশমি টুপি (তিউনিশিয়ায় এটি ‘শাশিয়া’ নামে পরিচিত)। যা হোক, আমরা একটি বড় কনফারেন্স রুমের এক প্রান্তে বসলাম। কিন্তু কিছু লোক সেখানে উচ্চস্বরে কথাবার্তা বলছিল। আন্দোলনটির একজন ঐতিহাসিক নেতা যে এখানে বসে সাক্ষাৎকার দেয়ার চেষ্টা করছেন, তারা তা খেয়ালই করছিল না। ফলে স্টাফদেরকে তিনি একটি শান্ত রুমের ব্যবস্থা করতে বললেন। কিছুক্ষণ পর আমরা এই পাঁচতলা ভবনটির টপ ফ্লোরের একটি ছোট রুমে স্থানান্তরিত হই।
দ্বিমত পোষণ করলেও আল লাউজ সবসময় দলের প্রতি অনুগতই ছিলেন। কিন্তু এবার তিনি দলের ব্যাপারে তার খোলামেলা ও ছাঁচাছোলা সমালোচনা তুলে ধরলেন। তিনি সমালোচনাগুলোর একটা তালিকা দিলেন এবং একে একে সবগুলো নিয়ে বিস্তারিত বললেন। প্রথমত, কর্মকর্তাদের তৈরি করা দায়সারা, সাদামাটা ও রেডিমেড প্রচারণায় সীমাবদ্ধ থাকলে নির্বাচনে হেরে যাওয়াই তো আন নাহদার জন্য স্বাভাবিক ব্যাপার। তিনি আরো বলেছেন, সেক্যুলারদের কাছে পৌঁছানোর যত চেষ্টাই আপনি করেন, তারা সবসময় আপনাকে সন্দেহ করবে।[33] তবে নির্বাচনী কৌশল নিয়ে মতদ্বৈততার ব্যাপারটি আরো জটিল। নির্বাসিত অবস্থায় যারা বড় হয়েছে কিংবা আন্দোলনের সংস্পর্শ যারা পায়নি, সেসব তরুণরা দলের নেতৃত্বে চলে আসায় তিনি উদ্বিগ্ন। তার মতে, এটাকে কৌশল হিসেবে নিলেও অচিরেই এর জন্য মূল্য দিতে হবে। আপনি যদি বার বার কোনো কিছু বলতে থাকেন, তাহলে এক পর্যায়ে আপনি তা বিশ্বাসও করতে শুরু করবেন। তবে দিন শেষে কেউই মনে করছে না যে, তারা ‘ডবল ডিসকোর্সে’ লিপ্ত আছে (আন নাহদার বিরোধীরা সবসময় এই অভিযোগই করে থাকে)। আপনি যা প্রকাশ্যে বলেন ও করেন এবং আপনি যা বিশ্বাস করেন– এ দুইয়ের মাঝখানে ব্যবধান কমিয়ে আনতে হলে আপনাকে সম্ভবত আপনার বিশ্বাসের দিকেই ফিরে যেতে হবে। এখন কেউ বলতে পারে, এটাই তো রাজনীতির মূলকথা। (আবার এটি বিপরীতভাবেও সত্য হতে পারে। অর্থাৎ, নির্বাচনী রাজনীতির সুবিধার জন্য ‘মধ্যপন্থীরা’ বেশি বেশি রক্ষণশীল ধ্যানধারণার কথা বলে থাকতে পারে এবং সময়ের ব্যবধানে, তাদের ব্যবহৃত এইসব রেটরিক তারা নিজেরাই বিশ্বাস করা শুরু করতে পারে।)
আন নাহদা যে ‘ব্যতিক্রমধর্মী’ এবং অত্যন্ত প্রগতিশীল একটি ইসলামপন্থী দল, এর একটি নিদর্শন হলো দলটি নানা মতের ব্যক্তিদেরকে নেতৃত্বে স্থান দিয়েছে। তাদের এই আত্ম-উপলব্ধি তাদেরকে সমাজের মূলধারায় পরিচালিত করেছে। এর ফলে তাদের রক্ষণশীল অংশ অসন্তুষ্ট হলেও যথেষ্ট নাড়া খেয়েছে। ‘আমরা গর্বিত’– এই কথাটা তাদের মুখে আমি অনেকবার শুনেছি। ‘ইসলাম ও গণতন্ত্রের মধ্যে সমন্বয় সম্ভব’– সন্দেহবাদী সেক্যুলারসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিকট এই বক্তব্য তুলে ধরে নিজেদের প্রতি আরোপিত অভিযোগকে ভুল প্রমাণ করার মধ্যে নিশ্চয় এক ধরনের ভালো লাগা কাজ করে।
এর পাশাপাশি ব্যক্তিও গুরুত্বপূর্ণ। অন্যান্য ইসলামপন্থী আন্দোলনে বড় মাপের চিন্তাবিদ বা তাত্ত্বিকের অভাব রয়েছে। গত কয়েক দশকে মিশরের ব্রাদারহুডে এমন কেউ নেই। অন্যদিকে, আন নাহদার ক্ষেত্রে রশিদ ঘানুশীর মতো বড় মাপের একজন তাত্ত্বিক রয়েছেন। যিনি দলটির জন্য একটি স্বতন্ত্র ভিশন দাঁড় করিয়েছেন। তুর্কি মডেলকে আন নাহদার অনুপ্রেরণার বড় উৎস মনে করা হলেও একেপির সাথে আন নাহদার স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। এই দুই পার্টির মতাদর্শিক মিলের জায়গাটি হলো– উভয় দলই ব্রাদারহুড ঘরানার নমনীয় এবং অধিক সেক্যুলারবান্ধব একটি ধারা। এরদোয়ান হচ্ছেন ইস্তাম্বুলের তৃণমূল থেকে উঠে আসা একজন দক্ষ রাজনীতিবিদ। তিনি তার ধর্মীয় পরিচয়ে ফিরে গেছেন। কারণ, কিছু ক্ষেত্রে এটি কাজ দিয়েছে। অন্যদিকে ঘানুশী হলেন একজন ইন্টেলেকচুয়াল। তাই নির্বাচনে জেতার চেয়েও তার কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো নিজের অবস্থানকে সঠিক প্রমাণ করা। কিন্তু অনুসারীরা ব্যাপারটির গুরুত্ব অনুধাবন করার আগেই হয়তো দলীয় প্রধান হিসেবে কয়েকটি নির্বাচনে তিনি হেরে যেতে পারেন। ঘানুশীর জীবনী লেখক আজ্জাম তামিমী (যিনি নিজেও হামাসের সাথে সংশ্লিষ্ট একজন সুপরিচিত ইসলামপন্থী) আমাকে এ ব্যাপারে বলেছেন, “ঘানুশী নিজেই বিভিন্ন সময় স্ববিরোধী কাজ করেছেন। কারণ, একজন ইসলামী চিন্তাবিদ হিসেবে তিনি একভাবে চিন্তা করেছেন, কিন্তু একই সময়ে রাজনীতিবিদ হিসেবে তাকে ভিন্নভাবে কাজ করতে হয়েছে। এই দুইয়ের মধ্যে সবসময়ই একটা টানাপড়েন রয়ে গেছে।”[34]
কিছু বিষয় বিবেচনায় ঘানুশীর ভিশন হয়তো স্বতন্ত্র একটা কিছু। তবে তিউনিশিয়ার রাজনীতির বাস্তবতায় তার পদক্ষেপের ফলাফল সবসময় সঙ্গতিপূর্ণ বা সুস্পষ্ট নয়। আন নাহদা কি একটি বিপ্লবী দল, নাকি সংস্কারপন্থী? উল্লেখ্য, আগের মতো দলটির বিপ্লবী চরিত্র অক্ষু্ন্ন নেই– এই অভিযোগ তুলে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন সুপরিচিত নেতা দল ত্যাগ করেছেন। দলটি মন্ত্রী পরিষদের একটি পদ গ্রহণ করায় তারা কি সরকারী দল, নাকি বিরোধী দল; নাকি একই সাথে উভয়ই? আন নাহদা কি একটি আন্দোলন, নাকি পার্টি; নাকি উভয়টিই? যদি উভয়টিই হয়, তাহলে তা কি টেকসই হবে? দলটি নিজেই যখন ধর্মীয় রেফারেন্সের গুরুত্ব কমিয়ে দিচ্ছে, সেখানে ‘এটি এমন একটি দল, ধর্মীয় রেফারেন্স যার ভিত্তি’ এ কথার মানে আসলে কী?
আন নাহদা এবং ইসলামিস্ট এক্সেপশনালিজমের সমস্যা
দশকের পর দশক ধরে চাপিয়ে দেয়া সেক্যুলারাইজেশনের অবসানের দ্বারপ্রান্তে এসে তুরস্কের মতো তিউনিশিয়াও পরীক্ষা-নিরীক্ষার একটি তাৎপর্যপূর্ণ ক্ষেত্র হয়ে ওঠেছে। দেশটির সেক্যুলার প্রেক্ষাপটে ইসলামের পুনর্জাগণের তৎপরতা কীভাবে সাধিত হচ্ছে? ঘানুশীর পরিকল্পনা ছিল ইসলামপন্থা, এমনকি সম্ভবত ‘ইসলামের’ মধ্যেও (ইসলাম ও ইসলামপন্থা– এ দুটিকে পরস্পর সম্পর্কিত ধরে নিয়ে) পরিবর্তন আনা। এটি করতে গিয়ে তিনি তার পুরো জীবনের অর্জনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছিলেন। তার চিন্তা ছিল ইসলাম ও ইসলামপন্থাকে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারলে মতাদর্শিক বিভাজন থেকে বেরিয়ে আসা যাবে। এটি খুবই দারুণ চিন্তা ছিল। বহুকাল পূর্বে ঐক্য ও সংহতির মূল সূত্র ছিল ইসলাম। কিন্তু ইসলামপন্থা এসে একে রাজনৈতিকীকরণ করেছে। এটা ইসলামপন্থার অন্যতম বড় ব্যর্থতা (কিংবা, সফলতা। এটি নির্ভর করে আপনার দৃষ্টিভঙ্গির উপর)।
ঘানুশীর বন্ধু ও সমমনা আব্দুল মোনায়েম আবুল ফুতুহ স্পষ্টত এই কারণেই মিশরের মুসলিম ব্রাদাহুড থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। ২০১২ সালে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে প্রচারণার সময় তিনি একটি সালাফী টিভি চ্যানেলের সাথে সাক্ষাৎকারে ঘোষণা করেছিলেন, ‘বর্তমানে যারা নিজেদেরকে লিবারেল কিংবা বামপন্থী হিসেবে দাবি করে, তাদের অধিকাংশই ইসলামী মূল্যবোধকে মেনে চলে ও সম্মান করে। এটা নিছক একটি রাজনৈতিক পরিচয় মাত্র। তারা শরীয়াহ সমর্থন করে এবং কখনোই এর বিরোধিতা করে না।”[35] আবুল ফুতুহর মতে, এক দৃষ্টিতে সকল মুসলমানই সালাফী। যেহেতু সবাই ইসলামের প্রাথমিক যুগের একনিষ্ঠ মুসলিম তথা সালাফদের অনুসরণ করে থাকেন। যেন তিনি বলতে চাচ্ছেন, কার্যত আমরা সকলেই তো ইসলামপন্থী, তাহলে কেন আমরা এ নিয়ে মতবিরোধে লিপ্ত?
মতবিরোধ হওয়ার যথেষ্ট কারণ নিশ্চয় ছিল। তাই একটি মধ্যপন্থী অবস্থানে যাওয়ার জন্য আন নাহদা যতই চেষ্টা করুক না কেন, দিন শেষে দলটির পরিচয় আন নাহদাই রয়ে গেছে। যদি আন নাহদা এই পরিচয় ত্যাগ করে একটি ‘লিবারেল’ দলে পরিণত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে কী ঘটবে? আপাতদৃষ্টিতে হয়তো মনে হবে, একটি ইসলামপন্থী দলের চেয়ে বিদ্যমান অন্যান্য লিবারেল দলগুলোই লিবারেল হিসেবে ভালো। যদিও ঘানুশী অনেক বেশি উদারতা দেখাতে রাজি।[36] আন নাহদা আগের পরিচয় থেকে সরেও আসলেও অন্য কেউ এসে সেই শূন্যস্থান ঠিকই পূরণ করে নেবে। যতদিন পর্যন্ত একটি পরিপূর্ণ ইসলামী রাজনীতির আবেদন থাকবে, ততদিন কেউ না কেউ তা পূরণ করে চলবে।
তবে এখানে আরেকটা সমস্যা আছে। কথা ও কাজে আন নাহদা সম্ভবত ঠিকই আছে, কিন্তু তারপরও সন্দেহ থেকেই যায়। আর ব্যাপারটা এমন কিছুও নয়, যার উপর দলের নেতাদের নিয়ন্ত্রণ আছে। অন্যদিকে, ইসলামপন্থীরা ইসলামপন্থী হওয়ার কারণেই সেক্যুলাররা ইসলামপন্থীদেরকে ঘৃণা বা অবিশ্বাস করে। ইসলামপন্থীরা বাস্তবে কী করে, সেটা তাদের বিবেচ্য বিষয় নয়। এটা সত্য যে, আন নাহদার সংস্পর্শে এসে লোকজন রক্ষণশীল প্র্যাকটিসিং মুসলিম হিসেবে গড়ে ওঠে। যেমন, কোনো মিটিংয়ের আগে বা পরে দলীয় নেতৃবৃন্দ সাধারণত জামায়াতের সাথে নামাজ আদায় করে। ইসলাম হলো তাদের শুরুর পয়েন্ট, এমনকি শেষ পয়েন্টও বটে। তবে এর মাঝখানে কোনো বিষয়ে তারা যা কিছু বলে, সেগুলো নিয়ে তাদের মাঝে বেশ মতদ্বৈততা রয়েছে।
ঘানুশীর সাথে সাক্ষাৎ শেষে তার সহকারী আমাকে খুব সম্মানের সাথে পরবর্তী মিটিংয়ে পৌঁছে দিয়েছিলেন। দেখেই মনে হয়েছে এই ব্যক্তি অত্যন্ত পরহেজগার। আন্দোলন ও শায়খের (আন নাহদার কর্মীরা ঘানুশীকে শ্রদ্ধার সাথে ‘শায়খ’ বলে সম্বোধন করে) নেতৃত্বের উপর স্থাপিত গভীর আস্থার উপর ভিত্তি করেই এই সহকারী জীবন সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলেছেন বলে মনে হলো। নীরবতার কারণে গাড়ির ভেতর একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। পরিবেশটাকে হালকা করতে আমি আলাপ শুরু করার চেষ্টা করলাম। শীঘ্রই আমরা আলাপে মগ্ন হয়ে পড়লাম। এক পর্যায়ে জানতে চাইলাম, মদ্যপায়ী কোনো ব্যক্তি আন নাহদায় যোগ দিতে পারে কিনা। এ ধরনের প্রশ্নের জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। যা হোক, তিনি দলের সদস্য হওয়ার শর্তগুলো বিস্তারিতভাবে জানালেন। সদস্যপ্রার্থীর নৈতিক চরিত্রের ব্যাপারে কাউকে সাক্ষ্য দিতে হয়। এই প্রক্রিয়াটি ‘তাজকিয়া’ হিসেবে পরিচিত। মদ পানকারী কোনো ব্যক্তি প্রথম সুযোগেই আন নাহদার সদস্য হয়ে যাবে, এমনটা অসম্ভব প্রায়। অবশ্য কেউ যদি মদ পান ছেড়ে দিয়ে ভালো মুসলমান হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে, তাহলে সম্ভবত তার পক্ষে দলে যোগদান করা সম্ভব।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বলা যায়, একটি আধুনিক দলের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য থাকা সত্ত্বেও আন নাহদা যথেষ্ট আধুনিক নয়। বরং অনেকটা পরিবারের মতো। আন নাহদার সাবেক নেতা রিয়াদ শাইবি আমার কাছে ব্যাপারটা বর্ণনা করেছেন এভাবে, “দল ত্যাগ করাকে অনেকটা ধর্মত্যাগের মতো ব্যাপার হিসেবে দেখা হয়।”[37] অধিকাংশ ইসলামপন্থী দলের মতো আন নাহদাও ‘শুমুলি’, অর্থাৎ সবার্ত্মকবাদী ধারার দল। ব্রাদারহুড ঘরানার সংগঠনগুলোর প্রাথমিক পরিচয় হলো, এরা দল নয়, মূলত আন্দোলন। এর মানে হলো, এটি জীবনের সকল দিককে পরিবেষ্টন করে আছে। এই সংগঠনগুলো ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করে এবং নানা ধরনের সাহায্য-সহায়তামূলক কাজকর্ম করে থাকে। সংগঠনের সদস্যরা যখন সমাজে একঘরে হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ভোগে, সংগঠন তখন তাদেরকে ভ্রাতৃত্ববোধ ও গোষ্ঠীবদ্ধতার চেতনায় আবদ্ধ করে। সম্ভবত এটাই এই সংগঠনগুলোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। রাষ্ট্র শক্তিশালী হয়ে ওঠলে এবং সমাজ দুর্বল হয়ে পড়লে যে ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়, তা পূরণে তারা এগিয়ে আসে। স্বৈরাচারী শাসনামলে তাদের কোনো কর্মী যখন অন্যায়ভাবে জেল খাটে, তখন ওই কর্মীর পরিবারকে তারা প্রয়োজনীয় আর্থিক, আইনগত ও নৈতিক সাপোর্ট দিয়ে থাকে।
একাডেমিকরা সঙ্গত কারণেই ইসলামপন্থীদের ময়দানের তৎপরতার দিকে মনোযোগী হয়েছেন। হ্যাঁ, দৃশ্যমান তৎপরতা পর্যবেক্ষণ করা সহজ। এটাকে আপনি মূল্যায়ন করতে পারেন। এটা বোধগম্য ব্যাপার। কিন্তু ইসলামপন্থীদের প্রকৃত পরিচয় কী, তার উপর ফোকাস করা বেশ কঠিন। কারণ, একজন ব্যক্তির মনের খবর কখনোই সত্যিকার অর্থে জানা যায় না। এর মানে হলো, ইসলামপন্থী সংগঠনগুলো যে ধরনের লোক তৈরি করছে, তার পরিবর্তে আমরা কেবল কিছু নির্দিষ্ট টার্ম বা রেটরিক বিশ্লেষণ করেই এসব সংগঠনকে বুঝার চেষ্টা করি। যদিও এসব সংগঠনের ব্যাপারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সমালোচনা রয়েছে, তারপরও তাদের ‘সর্বাত্মকবাদী’ বৈশিষ্ট্য (‘encompassing’ nature) অনালোচিত রয়ে গেছে। এই সংগঠনগুলোর ব্যাপারে যেসব উপসংহার টানা হয়, আসলে তারা এরচেয়েও বেশি কিছু। তারা একটি আন্দোলন। তাদের সদস্যপদ গ্রহণের গভীর তাৎপর্য রয়েছে। এই সংগঠনগুলোর সদস্যপদের কাঠামো সাধারণত ক্রমসোপনমূলক হয়ে থাকে। বিশেষত ব্রাদাহুড ঘরানার সংগঠনগুলোর ক্ষেত্রে এটি বিশেষভাবে সত্য। যা হোক, আন নাহদা হলো একের ভেতর দুই, অর্থাৎ একইসাথে দল ও আন্দোলন। তাই দলটিতে কেউ যোগ দিতে চাইলে তাকে আগে আন্দোলনের দৃষ্টিভঙ্গিকে মেনে নিতে হয়। আইনী বাধ্যবাধকতার কারণে সরকার অনুমোদিত দলগুলোতে যে কেউ যোগ দিতে পারে। সেদিক থেকে যে কেউ আন নাহদায়ও যোগ দিতে পারে। অন্তত তাত্ত্বিকভাবে এটি সত্য। কিন্তু আন নাহদা কিংবা অন্য যে কোনো বড় মাপের ইসলামপন্থী দলের বাস্তব অবস্থান এর থেকে ভিন্ন। আন নাহদার টিপিক্যাল সদস্যদের ব্যাপারে বলতে গিয়ে রিয়াদ শাইবি বলেছেন, “তারা নিজেদেরকে সমাজের অংশ মনে করে না। তারা মনে করে, তারা হলো উত্তম। এই ধারণা তাদেরকে আত্মতুষ্টির দিকে নিয়ে যায়। তারা তখন ভাবে, ‘আমরা নিছক জাতির সদস্য মাত্র নই… আমরাই হলাম জাতির বিবেক।’
এমনকি আন নাহদার সবচেয়ে প্রাগ্রসর ব্যক্তিরাও প্রচ্ছন্নভাবে মনে করেন, ব্যক্তি হিসেবে তারা অন্যদের চেয়ে আলাদা। তারা অনেক কিছু করেছে এ জন্য নয়, বরং নিজেদের সম্পর্কে তাদের যে ধারণা সে কারণেই তারা এমনটি ভাবে। এ ব্যাপারে ঘানুশীর ঘনিষ্ট সহযোগী নুরুদ্দীন আরবাউয়ীর সাথে আমার আরো কিছু ইন্টারেস্টিং কথাবার্তা হয়েছে। ধর্মের গুরুত্বকে কমিয়ে দেশের সবচেয়ে দক্ষ লোকদের নিয়ে আন নাহদাকে নতুন করে সংগঠিত করার মাধ্যমে দলটির যে নতুন পরিচয় দাঁড়িয়েছে, তিনি এর প্রবল সমর্থক। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থান প্রশ্নে অন্য যে কোনো সেক্যুলার দল থেকে আন নাহদাকে কেউ বেশি দক্ষ মনে করবে কেন, যেখানে সেক্যুলার দলগুলোতে আরো বড় বড় অর্থনীতিবিদ রয়েছে এবং সরকার পরিচালনার অভিজ্ঞতাও তাদের বেশি? তখন তিনি স্বীকার করেন, “আন নাহদা, নিদা তিউনেস কিংবা অন্যান্যদের কর্মসূচির মধ্যে মিল রয়েছে, এটা সত্য। তাহলে আমরা এমন কী করলাম, যার জন্য নাগরিকরা আন নাহদাকে ভোট দেবে? এরদোয়ানের মতো বলতে চাই, আমরা চুরি করি না।” বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি ২০০৬ সালের নির্বাচনে ফিলিস্তিনীরা ফাতাহর পরিবর্তে হামাসকে কেন ভোট দিয়েছিল, সেই উদাহরণ তুলে ধরেন:
হামাস যখনই কোনো কর্মসংস্থানমূলক প্রজেক্টের জন্য তহবিল সংগ্রহ করতে পেরেছে, তার শতকরা ৯০ টাকাই প্রাপ্য ব্যক্তিরা পেয়েছে। বড়জোর ১০ টাকার দুর্নীতি হয়তো হয়েছে। কিন্তু আপনি যদি একই প্রজেক্টের জন্য এই একশ টাকা ফাতাহকে দিতেন, তাহলে ৯০ টাকাই দুর্নীতির কারণে নষ্ট হয়ে যেত।[38]
আমার কাছে মনে হয়েছে, আরবাউয়ী পাশ্চাত্যের লোকদেরকে কথা বিবেচনায় রেখে এভাবে চিন্তা করেছেন। ইসলামপন্থীদের ব্যাপারে লোকদের মনে যদি কোনো ভীতি থেকে থাকে, তা যেন দূর হয়। যেন ইসলামপন্থীরা পুরোপুরি সেক্যুলারদের মতোই, বরং তাদের চেয়েও ভালো। কারণ তারা কম দুর্নীতিগ্রস্ত। নিছক সৎ থাকা এবং একটি চমৎকার অর্থনৈতিক কর্মসূচি হাজির করাই রাজনীতিবদদের জন্য যথেষ্ট, বাকি সবকিছু অন্যদের মতোই চলবে– তারা সত্যিই যদি এমনটি ভেবে থাকে, তাহলে তা নিছক সরলতা মাত্র। কিন্তু আরবাউয়ীর মন্তব্য শুনতে যত নির্দোষই মনে হোক না কেন, এটা ইসলামপন্থীদের ধর্মীয় কমিটমেন্টের পরিপন্থী। কারণ, ইসলামপন্থীরা শুধু ভালো মানুষই নয়, ভালো রাজনীতিবিদ হওয়ার ব্যাপারেও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এর মানে হলো, ইসলামপন্থী দলগুলো নিজেদেরকে যে ধরনের ‘স্বাভাবিক’ দল হিসেবে দাবি করে, শতভাগ আন্তরিকতা থাকা সত্ত্বেও তারা কখনোই তেমনটি হতে পারবে না।
যা হোক, স্বৈরাচারী শাসনামলে এই ধরনের প্রবণতা থাকাটা খুব একটা সমস্যাজনক নয়। কিন্তু ইসলামপন্থীদের কাঁধে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব এসে পড়ার পর এটা নিশ্চয় একটা ইস্যু। প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাধারণত সরকারী দলগুলোর পক্ষে প্রভাব বিস্তারসহ নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধার পথ খোলা থাকে। কিন্তু এর সুযোগ নিয়ে আপনি যদি ক্ষমতা কেন্দ্রে একটি বিশেষ ধর্মীয় কিংবা নৈতিক প্রাধান্য তৈরি করতে চান, তাহলে এক ধরনের গণবিচ্ছিন্নতা (perception of exclusion) তৈরি হতে পারে। তিউনিশিয়ায় আন নাহদা ও মিশরে ব্রাদারহুড অল্প যে কয়েকদিন ক্ষমতায় ছিল, সে সময় নন-ইসলামিস্ট শিবিরে এ রকম ধারণাই ছড়িয়ে পড়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে ‘ব্রাডারহুডকরণের’ অভিযোগ জোরালো হয়ে উঠেছিল। বিরোধীদের এই দাবি অনেক বেশি অতিরঞ্জিত হলেও তারা ছিল বরাবরই সক্রিয়। তাদের মধ্যে ভেতরে ভেতরে এমন ভীতি কাজ করেছে যে, ইসলামপন্থীরা অত্যন্ত গোঁড়া। তাদেরকে কিছু শোনানো যায় না। তারা অন্য যে কিছুর চেয়ে সাংগঠনিক স্বার্থকে বেশি গুরুত্ব দেয়। যে কোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলো দলের সদস্যদেরকে উচ্চ পদগুলোতে নিয়োগ দিয়ে থাকে। কিন্তু একটি রক্ষণশীল আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিষয়টি একটু অন্য রকম। কেননা, এ ধরনের আন্দোলন দলীয় ব্যবস্থাকে ছাড়িয়ে যায়। তারা নিজেদের এমন সদস্যদেরকেই নিয়োগ দান করে, যারা সামষ্ঠিকভাবে আনুগত্যের সুগভীর বন্ধনে আবদ্ধ।
* * *
উপরের এই সমস্যাগুলো আধুনিকীকরণের সাথে সম্পর্কিত। এই আধুনিকীকরণ ঠিক কেমন? আসলে এটা এক ধরনের জগাখিচুড়ি। একটি একক শক্তি হিসেবে ইসলামের যে প্রাক-আধুনিক ধারণা, তা রাজনৈতিক দল সংক্রান্ত আধুনিক ধারণার সাথে ঠিক খাপ খায় না। রাজনৈতিক দল এবং জাতিরাষ্ট্র এখন অবিচ্ছেদ্যভাবে পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। মোটকথা, এখন একটা রাষ্ট্র থাকে, যাকে একটা সরকার পরিচালনা করে এবং এই পরিচালনার সুযোগ লাভের জন্য রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিযোগিতা করে থাকে। রাষ্ট্র যত বেশি শক্তিশালী, ক্ষমতার জন্য লড়াইও তত বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। তবে আমলাতন্ত্র ও নিরাপত্তা খাতের উপর মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরতা, বিশাল সংখ্যক নির্ভরশীল নাগরিকদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান ও কর্মসংস্থানের বোঝা কাঁধে থাকলে শক্তিশালী কোনো রাষ্ট্রও চরম দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। যেমন আধুনিক আরব রাষ্ট্রগুলো।
আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের কোনো অতীত উদাহরণ নেই। ফলে ইসলাম ও রাষ্ট্রের মধ্যকার সমঝোতার জন্য অতীতের কোনো মডেলও সম্ভবত নেই। এটা এমন এক ডিলেমা, যার কোনো সমাধান নেই। তাই ইসলামী নৈতিক কাঠামোই (যা এক সময় মুসলমানদের মধ্যকার ঐক্যবদ্ধতার সূত্র ছিল) এখন অন্যতম প্রধান একটি ‘ইসলামী’ দলের ট্রেডমার্ক হয়ে ওঠেছে। এই দলটি শুধু ইসলামপন্থাই নয়, স্বয়ং ইসলামের সাথেও সংশ্লিষ্ট। দলটি স্বভাবতই প্রথমে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে চাইবে। তারপর রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক মেরুকরণকে প্রকট করে তুলতে পারে। এর ফলে মতাদর্শ, দল ও ক্ষমতা– একটি আরেকটির সাথে মারাত্মকভাবে জড়িয়ে গেছে। অবশ্য, এই ডিলেমা সম্পর্কে ইসলামপন্থীরা অসেচেতন নয়। আপনি যদি তাদেরকে প্রশ্ন করেন তারা সম্ভবত জবাব দেবে, স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়নকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আরো বিস্তৃত করা এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা দরকার। প্রকৃত পক্ষে, একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে ব্রাদারহুড ঘরানার সংগঠনগুলো তাদের নানা ধরনের রাজনৈতিক প্লাটফরম ও নির্বাচনী ইশতেহারগুলোতে ‘বিকেন্দ্রীকরণ’ ধারণাকে পছন্দ করতে শুরু করেছে।*[39] কিন্তু সবার আগে একটি শক্তিশালী, কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ ব্যতীত বিকেন্দ্রীকরণের মতো দুঃসাহসী কাজের বাস্তবায়ন কীভাবে সম্ভব, বিশেষ করে যখন এ ধরনের সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্র নিজেই নিজের ক্ষমতা খর্ব করার প্রসঙ্গ আসবে?
ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা ইসলামপন্থী ও সেক্যুলারদের মধ্যকার জটিলতাকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। অধিকাংশ আরব দেশেই শক্তিশালী ও সুশৃঙ্খল দলীয় কাঠামোর অভাব রয়েছে। যদিও সেখানে গণতন্ত্রের পথ উন্মোচিত হচ্ছে। তারপরও বাস্তবতা হলো, সেখানকার রাজনৈতিক দলগুলো হয় খুব দুর্বল, নয়তো জনগণকে নামমাত্র রাজনৈতিক কার্যক্রমের সুযোগ দেয়া হয়। নিজেদেরকে একদম গোড়া থেকে গড়ে তুলতে নতুন দলগুলোর কয়েক দশক না হলেও কয়েক বছর তো লাগবেই। যদিও একটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী আদর্শ ব্যবস্থা হিসেবে ‘গণতন্ত্র’, বিশেষ করে নির্বাচনকে মেনে নিতে কোনো কোনো গণতন্ত্রী আপত্তি করবেন। তাদের মতে, অন্তত জাতীয় পর্যায়ে নিছক নির্বাচনকেই অনির্দিষ্টকালের জন্য গণতন্ত্র মনে করা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। প্রচলিত অর্থে দল বলতে যা বুঝায়, মিশর ও তিউনিশিয়ার কোথাও ইসলামপন্থীদের সে ধরনের দল ছিল না। তবে আদর্শিকভাবে মজবুত আন্দোলন হওয়ায় তারা খুব সহজেই নিজেদেরকে দলে রূপান্তরিত করতে পারে। এক্ষেত্রে তারা হয় নতুন একটি সহযোগী দল গঠন করে (যেমনটা মিশরে হয়েছে), নয়তো এমন একটি নতুন ধারা তৈরি করে যেখানে দল ও আন্দোলন পরস্পর অবিচ্ছেদ্য (যেমনটা তিউনিশিয়ায় হয়েছে)। প্রথমবারের মতো অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত সংসদীয় নির্বাচনে সালাফী দলগুলোসহ ইসলামপন্থীরা সম্মিলিতভাবে মিশরে প্রায় ৭৫ শতাংশ এবং তিউনিশিয়ায় ৪১ শতাংশ আসনে জিতেছে। অন্যদিকে, বৃহত্তম সেক্যুলার দলগুলো মিলে যথাক্রমে ৭.৬ শতাংশ এবং ১৩ শতাংশ আসনে জয়লাভ করেছে। যে কোনো বিবেচনায়ই এটি বিশাল পরাজয়। এই ফলাফলের কারণে শুরুতেই নন-ইসলামিস্টদের জন্য গণতন্ত্র একটা অসুবিধাজনক ব্যাপার হয়ে ওঠার ভীতি তৈরি হয়েছে। সংবিধান, রাষ্ট্র এবং পার্লামেন্টে ইসলামপন্থীরা যখন এতটাই দৃঢ় অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে, যা ভবিষ্যতে পরিবর্তন করে ফেলা বেশ কঠিন, সেক্যুলার ও লিবারেলরা তখন এইসব নিয়ে বলতে গেলে উদাসীন।
লিবারেল ও সেক্যুলারদের আরেকটা সমস্যা আছে। সম্ভবত এটা আরো বেশি মৌলিক সমস্যা। সেটা হলো, মোটাদাগে ইসলামপন্থীদের অপছন্দ করা ছাড়া মিশর ও তিউনিশিয়ায় ‘লিবারেলিজম’ বলতে তারা আদতে কী বুঝে, তা পরিস্কার নয়। ব্যাপার যাই হোক না কেন, তারা মূলত সমাজের সংখ্যালঘু অংশ, শিক্ষাদীক্ষায় অগ্রগামী শহুরে এলিট। ইসলামপন্থীদের মতো লিবারেলদের শক্তিশালী সাংগঠনিক কাঠামো নেই। অন্যভাবে বললে, লিবারেলিজম কখনোই একটি জীবনব্যবস্থা হিসেবে কার্যকর ছিল না, কখনো হবেও না (লিবারেলিজম একজন ব্যক্তিকে তার নিজের মতো করে জীবনযাপন করার স্বাধীনতা দেয়। এর পরিণতি যাই হোক না কেন)। কারণ, লিবারেলিজম কী, অথবা কেন এটা গুরুত্বপূর্ণ– সে বিষয়ে সাধারণ মানুষের কাছে এটি কোনো ইতিবাচক ভিশন তুলে ধরতে পারে না। লিবারেলদের স্বাধীন চয়েস খুব সামান্যই। বরং ইসলামপন্থার তীব্র বিরোধিতাই তাদের সারকথা। নন-ইসলামিস্ট দলগুলো আরব বিশ্বে খুব ভালো করছে না। বিভিন্ন ব্যক্তি, সিভিল সোসাইটি গ্রুপ এবং ছোট দলগুলো মিলে তারা যে বৃহৎ কোয়ালিশন গড়ে তুলেছে, সেখানে তুলনামূলকভাবে খুব কমই ঐক্যমত্য রয়েছে। এই দৃষ্টিতে দেখলে বলা যায়, তাদের এই ঐক্যবদ্ধতার ভিত্তি হলো এমন এক শত্রুকে চিহ্নিত করা যার অস্তিত্বই তাদেরকে বাধ্য করেছে এই শত্রু থেকে নিজেদের পার্থক্য গড়ে তুলতে। যদিও তা সাময়িক।
এর পরিণতি হলো নিজেদেরকে প্রান্তিক অবস্থানের দিকে ঠেলে দেয়া। নিজেদের অস্তিত্বের বৈধতা দিতে এবং নিজেদের সুশৃঙ্খল কোনো মতাদর্শ না থাকায় অভ্যন্তরীণ ঐক্য বজায় রাখার স্বার্থে নন-ইসলামিস্ট দলগুলো ইসলামপন্থী ও সেক্যুলারদের মধ্যকার বিভাজনের উপর অনেক বেশি জোর দিয়েছে এবং ক্রমে এই বিভাজনকে আরো শক্তিশালী করে তুলেছে। তাই বলা যায়, একবার ধর্মীয় ও মতাদর্শিক বিভাজন গেড়ে বসলে তা থেকে বেরিয়ে আসা খুবই কঠিন। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত সিমুর লিপসেট এবং স্টেইন রোকেনের Party Systems and Voter Alignments শিরোনামের গবেষণামূলক বইয়ে তারা দাবি করেছেন, রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়া নাগরিকদের মধ্যে নানা ধরনের বিভাজন তৈরি করে, যা দীর্ঘস্থায়ী বিভাজনকে উসকে দেয়।[40] পাশ্চাত্যের অধিকাংশ গণতান্ত্রিক দেশে মতভেদের প্রধান ইস্যু যে অর্থনীতি। এটি কোনো আকস্মিক ব্যাপার নয়। আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় এটি হয়েছে। আর এখানেই রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। যদি বিশেষ কোনো দল লাইমলাইটে চলে আসে, তাহলে অন্যান্য দল থেকে তারা কীভাবে আলাদা, তা ব্যাখ্যা করার বিশাল একটা সুযোগ তারা পেয়ে যায়। রাজনৈতিক দলগুলোর অগ্রগতি নিয়ে বিদ্যমান একাডেমিক কাজগুলোর মূলকথা হলো, “দলগুলো নিজেরাই… দলের সিস্টেমের পরিবর্তন ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার মূল কারিগর।[41] কিংবা রাজনীতিবিজ্ঞানী নিক সিটারের ভাষায় বলা যায়, “দলগুলোর রয়েছে প্রভাবিত তৈরির ক্ষমতা।[42]
ইসলামপন্থী বনাম সেক্যুলার বিভাজন থেকে সেক্যুলারদের পাশাপাশি ইসলামপন্থীরাও লাভবান হয়েছে। এই বইয়ের আগের চ্যাপ্টারে আমরা দেখেছি, ইসলামপন্থা হচ্ছে ইসলামী আত্মপরিচয় সম্পর্কে কারো সচেতন দাবির উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা একটি আধুনিক ধারণা। ইসলামী আত্মপরিচয় নিয়ে সংকট তৈরি হলেই কেবল এই পরিচয়ের উপর জোর দেয়া হবে। যদি ইসলামের ভারসাম্যপূর্ণ ভূমিকা প্রতিষ্ঠিত হয় (ঘানুশী, আবদুল ফুতুহ এবং অন্যান্য ‘লিবারেল’ ইসলামপন্থীরা আশা করছেন, এমনটা ঘটবে), তাহলে ইসলামপন্থীরা তাদের লেজিটেমেসির আসল কারণটাই হারিয়ে ফেলবে। এটা একটা ইতিবাচক ব্যাপারই হবে হয়তোবা। কিন্তু ইসলামপন্থীরা সম্ভবত একে নেতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখবে। কারণ তারা মনে করে, ইসলাম এমন একটি ব্যাপার, যা ইসলামপন্থার গুরুত্ব ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলাকে নিশ্চিত করেছে। নির্বাচনী তৎপরতার দিক থেকে দেখলেও বলা যায়, সমর্থকদের সমর্থন করার পেছনে ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
খেলাফত পরবর্তী সময় থেকে শুরু হওয়া টানাপড়েনের গোড়াতেই যেসব সমস্যা রয়েছে, ইসলাম ভারসাম্যপূর্ণ হয়ে ওঠার আকাঙ্খা পূর্ণ হলে এসব সমস্যা আপনাতেই মিটে যাবে বলে আশা করা যায়। কোনো পরিস্থিতিতে মতাদর্শ যখন সংঘাতের মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তখন নাগরিকদের আদর্শিক বন্ধন শিথিল করাটা এক ধরনের সমাধান বটে। কিন্তু এটা কি বাস্তবসম্মত? প্রাক আধুনিক যুগে ইসলাম যেভাবে ঐক্যের সূত্র ছিল, আবারো তেমনটি হয়ে ওঠতে পারে– এ রকম মনে করাটা ইউটোপীয় চিন্তার কাছে নিজেকে আত্মসমর্পণ করারই নামান্তর। মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে সফল দুটি গণতান্ত্রিক দেশ তিউনিশিয়া ও তুরস্কে এ ধরনের উদ্ভট চিন্তার প্রতিফলন দেখা যায়। সেখানে সেক্যুলারাইজেশনের প্রভাব কিছুটা কমে গেলেও একে পুরোপুরি মুছে ফেলা যাবে না। উভয় দেশেই যথেষ্ট পরিমাণে সেক্যুলার এলিটরা রয়েছে। পাবলিক লাইফে ইসলামের ভূমিকা কতটুকু থাকবে, নিছক সেটি নিয়ে ইসলামপন্থীদের সাথে তাদের বিরোধ নয়। তারা বরং চায় ইসলামের কোনো ভূমিকা আদৌ না থাকুক। আমরা আগেই দেখেছি, যখন ইসলামী শক্তির পক্ষে বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং ‘সবকিছু কব্জা করার’ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হাতে পাওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তখন আদর্শগত ও ধর্মীয় মেরুকরণ সম্ভাব্যতার পর্যায় পেরিয়ে অনিবার্য হয়ে ওঠে।
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ইসলাম ও ইসলামপন্থীদের প্রভাবশালী ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গণতন্ত্রের সাথে সাংঘর্ষিক নয় (যদিও লিবারেল গণতন্ত্রের সাথে তা কিছুটা সাংঘর্ষিক)। দিন শেষে কোনো না কোনো গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই গণমানুষের মতামতের প্রতিফলন ঘটে। সমাজের নানা পক্ষের মতাদর্শিক চিন্তার সাথে আমরা একমত হই বা না হই, গণতন্ত্র তা প্রকাশের সুযোগ করে দেয়। মতাদর্শিক বিভাজন যতদিন পর্যন্ত সত্যিকার ও অর্থপূর্ণ না হবে, ততদিন পর্যন্ত তুর্কি, তিউনিশীয় বা মিশরীয়দের মতাদর্শ থেকে দূরে থাকা উচিত। সাময়িকভাবে মতাদর্শকে এক পাশে সরিয়ে রাখা কিংবা নিজেদের স্বার্থকে মুখ্য মনে না করা (আন নাহদা যেমনটি করার চেষ্টা করছে) তুলনামূলকভাবে ভালো। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের ক্ষেত্রে এটি বড় ধরনের প্রতিবন্ধক। যদি ‘গণতন্ত্র’ সফল হয়, তা হতে পারে ইসলামপন্থীদেরকে কোনঠাসা করার মাধ্যমে কিংবা ইসলামপন্থীরা নিজেরাই তাদের ইসলামপন্থার ব্যাপারে আপসকামী হওয়ার ফলে। এমনটা হলে নিশ্চিতভাবেই তা হবে একটি ভঙ্গুর গণতন্ত্র।
রেফারেন্স ও নোট:
[1] Alexander Christie-Miller, “Erdogan Launches Sunni Islamist Revival in Turkish Schools,” Newsweek, December 16, 2014,
[2] “Turks Divided on Erdogan and the Country’s Direction,” Pew Research Center, July 30, 2014,
http://www.pewglobal.org/2014/07/30/turks-divided-on-erdogan-and-the-countrys-direction/; “Turks Downbeat about Their Institutions,” Pew Research Center, September 7, 2010, http://www.pewresearch.org/2010/09/07/turks-downbeat-about-theirinstitutions/.
[3] “World Data Bank: World Development Indicators,” World Bank, http://databank.worldbank.org/data/views/reports/tableview.aspx.
[4] প্রকৃতপক্ষে ওয়ানিসির বয়স তখন ছিল ছয় বছর। লেখক সম্ভবত ভুলবশত নয় বছর উল্লেখ করেছেন। – অনুবাদক
[5] লেখকের সাথে আলাপচারিতা, সাইয়েদা ওয়ানিসি, ফেব্রুয়ারি ৬, ২০১৫।
[6] Monica Marks, “Tunisia Opts for an Inclusive New Government,” Washington Post, February 3, 2015,
[7] Nissaf Slama, “‘Irhal’ Campaign Attempts to Oust Ennahda Officials,” Tunisia Live, August 14, 2013, http://www.tunisialive.net/2013/08/14/erhal-campaignattempts-to-oust-enahdha-officials/.
[8] মিশরীয় সামরিক ক্যুর পর আন নাহদার প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আরো জানতে দেখুন Monica Marks, “Tunisia’s Ennahda: Rethinking Islamism in the Context of ISIS and the Egyptian Coup,” working paper, Brookings Institution, Rethinking Political Islam series, August 2015, http://www.brookings.edu/~/media/Research/Files/Reports/2015/07/rethinking-political-islam/Final-WorkingPapers/Tunisia_Marks_FINALv.pdf?la=en.
[9] লেখকের সাথে আলাপচারিতা, রশিদ ঘানুশী, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৫।
[10] লেখকের সাথে আলাপচারিতা, মেহেরজিয়া লাবিদী, ফেব্রুয়ারি ৬, ২০১৫।
[11] লেখকের সাথে আলাপচারিতা, ইমান বেন মোহাম্মদ, ফেব্রুয়ারি ৯, ২০১৫।
[12] দেখুন, Shadi Hamid, “Arab Islamist Parties: Losing on Purpose?” Journal of Democracy 22 (2011), pp. 68–80.
[13] লেখকের সাথে আলাপচারিতা, আন নাহদার একজন জেষ্ঠ্য কর্মকর্তা, ফেব্রুয়ারি ৭, ২০১৫।
[14] Anthony Shadid, “Islamists’ Ideas on Democracy and Faith Face Test in Tunisia,” New York Times, February 17, 2012, http://www.nytimes.com/2012/02/18/world/africa/tunisia-islamists-test-ideas-decades-in-the-making.html.
[15] Ibid.
[16] লেখকের সাথে আলাপচারিতা, সাঈদ ফারজানী, ফেব্রুয়ারি ৭, ২০১৫।
[17] লেখকের সাথে আলাপচারিতা, আন নাহদার একজন ক্যাম্পেইন অর্গানাইজার, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৫।
[18] Anne Wolf, “Can Secular Parties Lead the New Tunisia?” Carnegie Endowment for International Peace, April 30, 2014, http://carnegieendowment.org/2014/04/30/can-secular-parties-lead-new-tunisia.
[19] Pew Research Center, spring 2014 survey, topline results, http://www.pewglobal.org/files/2014/10/Pew-Research-Center-Tunisia-Report-TOPLINE-October-15-2014.pdf, p. 17.
[20] “Tunisian Confidence in Democracy Wanes,” Pew Research Center, October 15, 2014, http://www.pewglobal.org/2014/10/15/tunisian-confidence-in-democracy-wanes/.
[21] “The World’s Muslims: Religion, Politics and Society,” Pew Research Center, April 30, 2013.
[22] লেখকের সাথে আলাপচারিতা, নুরুদ্দীন আরবাউয়ী, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১৫।
[23] লেখকের সাথে আলাপচারিতা, রশিদ ঘানুশী, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৫।
[24] Ibid.
[25] Monica Marks, “Convince, Coerce, or Compromise? Ennahda’s Approach to Tunisia’s Constitution,” Brookings Doha Center Analysis Paper, February 10, 2014, http://www.brookings.edu/research/papers/2014/02/10-ennahda-tunisia-constitution-marks.
[26] Duncan Pickard, “The Current Status of Constitution Making in Tunisia,” Carnegie Endowment for International Peace, April 19, 2012, http://carnegieendowment.org/2012/04/19/current-status-of-constitution-making-in-tunisia.
[27] “Tunisian Confidence.”
[28] লেখকের সাথে আলাপচারিতা, রিয়াদ শাইবি, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৫।
[29] Human Rights Watch, “Tunisia: Sweeping Political Exclusion Law,” June 15, 2013, http://www.hrw.org/news/2013/06/15/tunisia-sweeping-political-exclusion-law.
[30] লেখকের সাথে আলাপচারিতা, একজন সিভিল সোসাইটি এক্টিভিস্ট, ফেব্রুয়ারি ৬, ২০১৫।
[31] Ursula Lindsey, “Tunisia’s Rachid Ghannouchi on Blasphemy, Homosexuality, Equality,” Arabist, April 6, 2015, http://arabist.net/blog/2015/4/6/tunisias-rachid-ghannouchi-on-blasphemy-homosexuality-equality.
[32] লেখকের সাথে আলাপচারিতা, হাবিব আল লাউজ, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৩।
[33] লেখকের সাথে আলাপচারিতা, হাবিব আল লাউজ, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৫।
[34] লেখকের সাথে আলাপচারিতা, আজ্জাম তামিমী, ফেব্রুয়ারি ২, ২০১৫।
[35] See Abdel Moneim Abul Futouh, interview, February 5, 2012, YouTube, http://www.youtube.com/watch?v=hgWJRuVOyDc&list=UUQpLme0GRI0L8MRC_d2aSrA&index=9&feature=plcp&fb_source=message.
[36] আন নাহদার অন্যান্য নেতৃবৃন্দের মতো রশিদ ঘানুশী নিজেকে ‘ইসলামপন্থা’ কিংবা ‘ইসলামপন্থী’ থেকে আলাদা করেননি। তিনি নিজেকে বৃহত্তর ‘ইসলামী আন্দোলনের’ একজন নেতা হিসেবেই বিবেচনা করেন।
[37] লেখকের সাথে আলাপচারিতা, রিয়াদ শাইবি, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৫।
[38] লেখকের সাথে আলাপচারিতা, নুরুদ্দীন আরবাউয়ী, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১৫।
[39] * (অনির্বাচিত) কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের বিপরীতে নির্বাচিত স্থানীয় প্রতিনিধিদেরকে ক্ষমতায়নের মাধ্যমে একটি ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করার উপর মিশরীয় ব্রাদারহুডের স্পষ্ট অবস্থানের বিস্তারিত ও সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হচ্ছে ২০০৫ সালের নির্বাচনী ইশতেহারের ‘অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ’ সেকশনটি। ব্রাদারহুডের পরিকল্পনা অনুযায়ী, জাতীয় মন্ত্রীসভার কাজ হবে বৃহত্তর পলিসি ও কৌশল ঠিক করা; আর এগুলো বাস্তবায়নের দায়িত্ব থাকবে স্থানীয় সরকারের উপর। কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো অনুমোদন ব্যতিরেকেই স্থানীয় কর্তৃপক্ষ নিজস্ব ভৌগোলিক সীমার মধ্যকার ট্যাক্স এবং বিভিন্ন ফি আদায়ের ক্ষমতা লাভ করবে। দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে জাকাত সংগ্রহের জন্যও তারা দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকবে। স্থানীয় সরকারের খরচের পর যদি কোনো উদ্বৃত্ত থাকে, তাহলেই কেবল তা রাজস্ব বিভাগে জমা করা হবে। ফাইনালি, মিউনিসিপ্যাল নেতৃবৃন্দের স্বাধীনতা যেন নিশ্চিত থাকে, সে জন্য বেসরকারী ফান্ডিং মেকানিজমের মাধ্যমে তাদের বেতন প্রদান করা হবে (আল-বারনামাজ আল-ইনতিখাবি লিল ইখওয়ান আল-মুসলিমিন ফিল ইনতাখাবাত আল-তাশরিয়্যাহ [সংসদীয় নির্বাচনে মুসলিম ব্রাদারহুডের নির্বাচনী ইশতেহার], কায়রো, নভেম্বর ২০০৫)।
[40] Seymour Lipset and Stein Rokkan, Party Systems and Voter Alignments: Cross-National Perspectives (London: Free Press, 1967).
[41] Nick Sitter, “Cleavages, Party Strategy and Party System Change in Europe, East and West,” Perspectives on European Politics and Society, volume 3 (2002), p. 448.
[42] Ibid.