নতুন আন নাহদা কি একটি সেক্যুলার দল?
এডিটর’স নোট: তিউনিশিয়ার রাজনৈতিক দল আন নাহদার সাম্প্রতিক পরিবর্তন নিয়ে তুরস্কভিত্তিক থিংকট্যাংক আল-শার্ক ফোরামের ট্রেনিং ডিরেক্টর মুহাম্মদ আফফান একটি বিশ্লেষণ করেছেন। আরব বসন্ত পরবর্তী তিউনিশিয়ার রাজনীতি, বিশেষত সেখানকার ইসলামপন্থীদের কর্মকৌশল বোঝাপড়ার সূত্র ধরে নিবন্ধটি সিএসসিএস-এর পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন আইয়ুব আলী।
*****
সারসংক্ষেপ
আন নাহদা আন্দোলন সম্প্রতি তাদের দশম কংগ্রেসে ঘোষণা দিয়েছে, তারা ‘রাজনৈতিক’ কর্মকাণ্ড থেকে ‘ধর্মীয়’ কাজকে পৃথক করবে। পাশাপাশি নিজেদেরকে একটি গণতান্ত্রিক দলে রূপান্তর করবে। আদর্শগত দিক থেকে এই সিদ্ধান্তের মানে দাঁড়ায়, আত্মপরিচয়ের রাজনীতি এবং প্যান-ইসলামিক এজেন্ডা থেকে আন্দোলনটি মূলত সরে আসছে। আর সাংগঠনিক দিক থেকে এর তাৎপর্য হলো, ইসলামী আন্দোলনের গতানুগতিক কম্প্রেহেনসিভ সংগঠনব্যবস্থাকে আন নাহদা পরিত্যাগ করেছে। এরইসাথে মুসলিম ব্রাডারহুডের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করাকেও তারা গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে না। এমনকি সম্পর্ক ছিন্ন করছে।
আন্দোলনটির এই ‘নতুন পরিচয়’ রাজনীতির মাঠে সম্ভবত ইতিবাচক ভূমিকাই রাখবে। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রেও এটি কাজে দেবে। তা সত্ত্বেও নতুন সদস্য সংগ্রহ ও গতিশীলতা বজায় রাখার সক্ষমতা এবং অভ্যন্তরীণ ঐক্য ও স্থিতিশীলতার প্রশ্নে আন্দোলনটি কিছু চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে পারে।
*****
‘ইসলামপন্থার দিন শেষ!’[1], ‘রাজনৈতিক ইসলাম থেকে বেরিয়ে আসলো আন নাহদা’[2], ‘রাজনৈতিক ইসলাম ছেড়ে মুসলিম ডেমোক্র্যাট হিসেবে যাত্রা’[3] – এমনসব নাটকীয় ও চটকদার শিরোনাম দিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম গত ২০ মে অনুষ্ঠিত আন নাহদার দশম জাতীয় কংগ্রেসের খবর তুলে ধরেছে। এই কংগ্রেসে ‘ধর্মীয় কাজ’ থেকে ‘রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের’ পৃথকীকরণ এবং আন নাহদাকে একটি নিছক জাতীয় পর্যায়ের গণতান্ত্রিক দল[4] হিসেবে রূপান্তরের ঘোষণা দেয়া হয়। এই ঘোষণাকে আন নাহদার আদর্শিক পরিবর্তন কিংবা আন্দোলনটির ‘নতুন পরিচয়’ (rebranding) হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
আন নাহদার প্রতিষ্ঠাতা, প্রধান তাত্ত্বিক ও বর্তমান সভাপতি রশীদ ঘানুশী মনে করছেন, এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত দলটির দূরদর্শিতারই[5] পরিচায়ক। অন্যদিকে, এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সমালোচনার তীব্র ঝড় বয়ে যাচ্ছে। দলটির নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তারা তাদের ইতিহাস ও মূল্যবোধের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। তিউনিশীয় সেক্যুলার এবং বৈশ্বিক মোড়লদের খুশি করতেই এ ধরনের লজ্জাজনক সমঝোতা করা হয়েছে।[6]
এই সিদ্ধান্তের প্রশংসা কিংবা সমালোচনা – কোনোটিই এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। আমরা বরং বুঝতে চেষ্টা করবো, সিদ্ধান্তটির প্রকৃত তাৎপর্য কী এবং আন নাহদার রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে এর সম্ভাব্য প্রভাবগুলো কী হতে পারে। তবে মূল আলোচনা শুরুর আগে সমসাময়িক ইসলামী আন্দোলনগুলোর রাজনীতি ও ধর্মের মধ্যকার উভয়সংকটের শেকড় চিহ্নিত করা গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্য আন নাহদা সর্বশেষ কংগ্রেসে এই উভয়সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে বলেই দাবি করছে।
কম্প্রেহেনসিভ ইসলাম, কম্প্রেহেনসিভ ইসলামী আন্দোলন
ইসলামের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যের আলোকে ইসলামী আন্দোলনের দিক থেকে রাজনীতি ও ধর্মের মধ্যকার সংকটপূর্ণ সম্পর্ক কিংবা রাজনীতি ও ধর্মের দ্বি-বিভাজনকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব – এমনটি কেউ বলতেই পারেন। সাধারণত বলা হয়ে থাকে, ইসলাম হলো ‘একটি রাজনৈতিক ধর্ম’, যেহেতু এটি একটি রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসেবেই উৎপত্তি লাভ করেছে। একইসাথে এটি একটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠী ও সমাজ হিসেবে বিকশিত হয়েছে।[7] তবে এই নিবন্ধে আমরা মনে করছি, ধর্ম ও রাজনীতির এই সংকটপূর্ণ সম্পর্ক একটি আধুনিক ব্যাপার, যা সমসাময়িক ইসলামী আন্দোলনগুলোর সাথে সম্পর্কিত। ইসলামের সামগ্রিকতা সম্পর্কে হাসান আল বান্নার একটি ক্লাসিক সংজ্ঞা থেকে এই সংকটের উৎপত্তি হয়েছে। তার বিখ্যাত উক্তিগুলোর মধ্যে এটি একটি, যেখানে তিনি বিস্তারিতভাবে বলেছেন,
“ইসলাম হলো একটি সামগ্রিক ব্যবস্থা, যা জীবনের সকল দিকের সাথেই সম্পর্কিত। এটি একইসাথে দেশ ও মাতৃভূমি এবং সরকার ও বিশ্বব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত। এটি একইসাথে নৈতিকতা ও ক্ষমতা এবং মহানুভবতা ও ন্যায়পরায়ণতার কথা বলে। এটি একইসাথে সংস্কৃতি ও আইন এবং প্রজ্ঞা ও বিচারব্যবস্থার ভিত্তি। এটি বস্তুগত উপাদান ও সম্পদ অর্জনকে অনুমোদন করে এবং উন্নতি ও অগ্রগতির কথাও বলে। এটি একইসাথে জিহাদ ও দাওয়াহ এবং সামরিক ও আদর্শিক ব্যবস্থা। ইসলামই হলো জীবনবোধ ও ইবাদতের সামগ্রিক ও সঠিক পদ্ধতি।”[8]
এই সংজ্ঞায় ধর্মের উপর স্পষ্টতই অতিরিক্ত গুরুত্বারোপ এবং স্বাভাবিক সমাজ কাঠামো ও রীতিনীতির উপর এক ধরনের ধর্মীয় পবিত্রীকরণের প্রচেষ্টা শুধু বিভ্রান্তিকরই নয়, বরং ইসলামের সামগ্রিক রূপকে হাসান আল বান্না যেভাবে একটি সামগ্রিক আন্দোলনের আদলে তুলে ধরেছেন, তাও যথেষ্ট বিভ্রান্তিকর।
‘কোরআনের পতাকাতলে মুসলিম ব্রাদারহুড’ শিরোনামের একটি বুকলেটে বান্না লিখেছেন, “আমরা কোনো রাজনৈতিক দল নই, যদিও ইসলামের মৌলিক শিক্ষার আলোকে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক ভাবনা আমাদের চিন্তাধারার কেন্দ্রবিন্দু। আমরা কোনো সমাজসেবামূলক সংস্থা নই, যদিও সেবামূলক কর্মকাণ্ড আমাদের অন্যতম বড় উদ্দেশ্য। আমরা কোনো ক্রীড়া দল নই, যদিও শারীরিক ও আধ্যাত্মিক ক্রীড়া আমাদের উদ্দেশ্য সাধনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। আমরা এসব সংগঠনের কোনোটিই নই।”[9] এর পরিবর্তে হাসান আল বান্না মুসলিম ব্রাদারহুডকে একইসাথে “একটি সালাফী দাওয়াতী ধারা, সুন্নী মাজহাব, সুফী বাস্তবতা, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, ক্রীড়া দল, সাংস্কৃতিক সংগঠন, অর্থনৈতিক কোম্পানি এবং একটি সামাজিক ধারণা” হিসেবে সংজ্ঞায়িত করতে চান।[10]
ইউটোপীয় রাজনৈতিক ভাবাদর্শ এবং সামাজিক সংগঠনের ক্ষেত্রে এই ভাবাদর্শের সর্বাত্মকবাদী মডেল দ্বারা হাসান আল বান্না স্পষ্টতই প্রভাবিত ছিলেন। ১৯৩০-৪০ এর দশকে এগুলো খুবই জনপ্রিয় ছিল। তবে সমাজসেবা ও ধর্মীয় দাওয়াতী কার্যক্রমের মাধ্যমে সামাজিক সংস্কার সাধনকে প্রাধান্য দিলেও চল্লিশের দশকের শুরুর দিকে হাসান আল বান্না দুইটি তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছেলেন –
এক) তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেলেন মুসলিম ব্রাদারহুড ‘দলীয় রাজনীতি’তে জড়িত হবে। এই সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতায় ব্রাদারহুড ১৯৪১ এবং ১৯৪৫ সালের সংসদীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে।
দুই) তিনি ব্রাদারহুডের স্বশস্ত্র শাখা প্রতিষ্ঠা করেন (যা Secret Apparatus নামে পরিচিত)। এটি শুধু উপনিবেশিক শক্তি ও ফিলিস্তিনের ইহুদীবাদীদের বিরুদ্ধেই নয়, মিশরে ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধেও সহিংসতায় জড়িয়ে পড়েছিল।[11]
তখন থেকেই ইসলামী আন্দোলনের মাঝে ‘রাজনৈতিক’ তথা পার্টিজান দৃষ্টিভঙ্গির সাথে ‘দাওয়াতী’ কাজের দৃষ্টিভঙ্গির এক ধরনের জটিল সম্পর্ক তৈরি হয়। কারণ, এই দুটি ধারার উভয়টিরই নিজস্ব বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত সংগঠন ব্যবস্থা, সদস্য সংগ্রহ ও সদস্যপদ প্রদানের পদ্ধতি, কার্যক্রম, বক্তব্য এবং উদ্দেশ্য রয়েছে। ইসলামী আন্দোলনগুলোর এ ধরনের হাইব্রিড বৈশিষ্ট্যের কারণে অনেক অসুবিধা তৈরি হয়েছে। যেমন – পেশাদারিত্বের অভাব, প্রশ্নবিদ্ধ ডিসকোর্স, অস্পষ্ট কৌশল গ্রহণ ইত্যাদি। অন্যদিকে, ইসলামী আন্দোলনের এই সর্বাত্মকবাদী ফর্মুলা সদস্য সংগ্রহ এবং রিসোর্সের গতিশীলতার মতো নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে খুব কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। এ ধরনের ইতিবাচক দিকগুলো ইসলামী আন্দোলনের হাইব্রিড বৈশিষ্ট্যের অসুবিধাগুলোকে আড়াল করে দিয়েছে। ফলত ইসলামী আন্দোলনগুলো সাফল্যের এক ধরনের মেকি অনুভূতি এবং আত্মতুষ্টিতে ভুগছে।
আরব বসন্তের পর স্বল্পকালীন ক্ষমতার অভিজ্ঞতা থেকে আন নাহদা একটি সামগ্রিক আন্দোলন হিসেবে চলার সীমাবদ্ধতাগুলো বুঝতে পেরেছে বলেই মনে হচ্ছে। তাই তারা আরো বেশি বিশেষায়িতকরণের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে তিউনিশিয়ার ইসলামী আন্দোলনের বিবর্তনের দীর্ঘ পরিক্রমার আপাত সমাপ্তি ঘটেছে।
আন নাহদার আদর্শিক ও সাংগঠনিক বিবর্তন
আন নাহদার দশম কংগ্রেসে রশিদ ঘানুশী তার মূল বক্তব্যে আন্দোলনটির বিবর্তনের তিনটি ধারাবাহিক পর্যায়ের কথা সংক্ষেপে উল্লেখ করেছেন:
“সত্তরের দশক থেকেই আন নাহদার বিবর্তন শুরু হয়। শুরুতে ছিল একটি আদর্শিক আন্দোলন হিসেবে আত্মপরিচয়ের সংগ্রাম, তারপর স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে একটি সর্বাত্মক প্রতিরোধ আন্দোলন এবং সর্বশেষ সংস্কার প্রচেষ্টায় আন্তরিক একটি জাতীয় গণতান্ত্রিক দল হিসেবে আবির্ভাব।”[12]
আর সাংগঠিক বিবর্তনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস হলো – ১৯৭২ সালে ‘ইসলামী দল’ (আল জামায়াহ আল ইসলামিয়্যাহ) নাম দিয়ে তিউনিশিয়ায় প্রথম ইসলামী আন্দোলন প্রতিষ্ঠিত হয়। তারপর ১৯৮১ সালে এটি ‘ইসলামী ধারার আন্দোলনে’ (হারাকাত আল ইতিজাহ আল ইসলামী) পরিণত হয়। সর্বশেষ, ১৯৮৯ সালে এটি ‘রেনেসাঁ আন্দোলনে’ (হারাকাত আন নাহদা) পরিণত হয়।[13]
মোটাদাগে, এই তিনটি সংগঠন ইসলামী আদর্শের তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ধরনকে ধারণ করে। প্রথম দলটি ছিল পুরোপুরি একটি ধর্মীয় আন্দোলন। তারা মসজিদগুলোতে ইসলামী আদর্শের প্রচার করতো। ‘আল মারিফা’ (জ্ঞান) নামে একটি ম্যাগাজিন প্রকাশ করতো। পরিবার ও শিক্ষা ইত্যাদি সামাজিক ও ধর্মীয় বিষয়গুলো ছিল এর বিষয়বস্তু। এছাড়া আন্দোলনটির তরুণদেরকে তারা ইসলামী নৈতিকতা শিক্ষা দিতো।[14]
১৯৮১ সালের ৬ জুন এটি ‘ইসলামী ধারার আন্দোলন’ হিসেবে যাত্রা শুরু করে। নতুন সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাকালীন দলিলপত্র অনুযায়ী এর মধ্যে রাজনৈতিক ইসলামী আন্দোলনগুলোর চারটি গতানুগতিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়:
১) সংগঠনটি ধর্ম ও রাজনীতিকে অবিচ্ছেদ্য দুটি সত্ত্বা হিসেবে বিবেচনা করে। ইসলামের সামগ্রিক রূপকে গ্রহণ করার ঘোষণা দেয়। সেক্যুলারিজম এবং প্রাগম্যাটিজম হতে মুক্ত থেকে রাজনীতি করার ব্যাপারে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকে। ধর্ম ও রাজনীতির পৃথকীকরণের চিন্তাকে তারা খ্রিস্টীয় ধারণার অনুপ্রবেশ এবং ‘আধুনিকতা’র নেতিবাচক প্রবণতা হিসেবে সাব্যস্ত করে।
২) এই সংগঠন আত্মপরিচয়ের রাজনীতির উপর গুরুত্বারোপ করে। এ জন্য তারা দুটি কাজকে প্রাধান্য দেয়: তিউনিশীয় ইসলামী ব্যক্তিত্বদের যথাযথ মূল্যায়ন এবং ইসলামী চিন্তার সংস্কার।
৩) ‘স্থানীয়, আঞ্চলিক, আরব বিশ্ব এবং আন্তর্জাতিক অর্থাৎ সকল পর্যায়ে ইসলামের রাজনৈতিক ও সামাজিক উপাদানগুলোকে ফিরিয়ে আনার তৎপরতা’য় অংশগ্রহণের মাধ্যমে তারা স্পষ্টতই প্যান-ইসলামী ভাবাদর্শকে গ্রহণ করেছে।
৪) লক্ষ্য অর্জনের জন্য সংগঠনটি ধর্ম ও রাজনীতির এক ধরনের মিশ্র পদ্ধতি ব্যবহার করে। এরমধ্যে রয়েছে ‘ইবাদত ও জনসমাগমের কেন্দ্র হিসেবে’ মসজিদের প্রকৃত ভূমিকা ফিরিয়ে আনা, ইসলামী ভাবধারাসম্পন্ন সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের সূচনা করা, স্বৈরতন্ত্রকে প্রতিরোধ করা, ইসলামী সরকারব্যবস্থার আধুনিক মডেল উপস্থাপন এবং এর উন্নয়ন সাধন করা, ইসলামের সামাজিক মূলনীতিগুলোর উন্নয়ন ও প্রয়োগ ইত্যাদি।[15]
‘ইসলামী ধারার আন্দোলন’টি ১৯৮৯ সালে ‘আন নাহদা মুভমেন্ট পার্টি’ নাম নিয়ে নতুনভাবে কাজ শুরু করে। এর পেছনে একটা প্রেক্ষাপট রয়েছে। ১৯৮৭ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হাবিব বুরগিবাকে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে হঠিয়ে ক্ষমতায় আসেন যাইন আল আবেদিন বেন আলী। তার সময়ের গণমুখী রাজনীতির সুযোগ গ্রহণ করা ছিল এই পরিবর্তনের উদ্দেশ্য। বেন আলী শুরুর দিকে গণতান্ত্রিক রূপান্তর এবং একটি বহুত্ববাদী রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল নিজের ক্ষমতার বৈধতাকে আরো শক্তপোক্ত করা। পরবর্তীতে তিনি এই প্রতিশ্রুতি আর রক্ষা করেননি। নয়া সরকারকে আশ্বস্ত রাখা এবং এবং রাজনৈতিক দল সংক্রান্ত তিউনিশিয়ার নতুন আইন অনুযায়ী (যে আইনে ধর্মীয় দলগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে) নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা তখন প্রয়োজনীয় ছিল। তাই ঘানুশী এবং ইসলামপন্থী অন্যান্য নেতৃবৃন্দ সংগঠনের নাম পরিবর্তন, নাম থেকে ‘ইসলামী’ শব্দটি বাদ দেয়া এবং সংগঠনের আদর্শের পুনর্মূল্যায়ন করার সিদ্ধান্ত নেন। ফলে নতুন নাম হয় ‘আন নাহদা মুভমেন্ট’। এই প্রেক্ষাপটে দাবি করা হয়েছিল, রাজনৈতিক ইসলাম সম্পর্কে ক্লাসিকাল ইসলামী আন্দোলনগুলোর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে তিউনিশিয়ার ইসলামী আন্দোলনের জন্য আন নাহদা নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দিয়েছে।[16]
বাস্তবতা হলো, মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে আন নাহদার সম্পর্ক কিছুটা জটিল। আন নাহদার প্রতিষ্ঠাতাদ্বয় (রশিদ ঘানুশী এবং আব্দুল ফাত্তাহ মুরো) যে মুসলিম ব্রাদারহুডের তাত্ত্বিকদের (হাসান আল বান্না এবং সাইয়েদ কুতুব) দ্বারা বেশ প্রভাবিত, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। তবে তারা ব্রাদারহুড মতাদর্শের একটি উদার ভার্শনকে গ্রহণ করেছেন এবং এর সাথে অন্যান্য বুদ্ধিবৃত্তিক ধারার সমন্বয় ঘটিয়েছেন। এসব ধারার মধ্যে রয়েছে তিউনিশিয়ার চিরাচরিত সংস্কারবাদী ধারা, শিয়া রাজনৈতিক ইসলামের তাত্ত্বিকগণ (খোমেনী, বাকের আল-সদর, আলী শরিয়তী প্রমুখ) এবং পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক মতাদর্শসমূহ।[17] মুসলিম ব্রাদারহুড এবং আন নাহদার মধ্যকার সাংগঠনিক সম্পর্কের ব্যাপারে বলতে হয়, আন নাহদা যে ব্রাদারহুডের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের একটি অংশ ছিল, তা প্রতিষ্ঠিত বাস্তবতা। সম্পর্ক যদিও বেশ শিথিল এবং ততটা কার্যকর ছিল না।[18]
নিছক ধর্মীয় একটি গ্রুপ থেকে প্রচলিত রাজনৈতিক ইসলামী আন্দোলন হিসেবে আত্মপ্রকাশ এবং পরবর্তীতে একটি উদার ইসলামপন্থী দল হিসেবে নিজেদের রূপান্তর – বিবর্তনের এই দুটি ঐতিহাসিক ধাপ পার হয়ে দলটি এখন নতুন আরেকটি ধাপে পা রাখতে যাচ্ছে। সর্বশেষ কংগ্রেসের গৃহীত সিদ্ধান্ত আলোকে দলটিকে এখন সম্ভবত এমন একটি ইসলামপন্থা-উত্তর আন্দোলন হিসেবে অভিহিত করা যায়, যারা ইসলামকে অতি মাত্রায় রাজনৈতিকীকরণ এবং ‘আদর্শিকীকরণ’কে এড়িয়ে চলে। একইসাথে যারা সমাজ জীবনের জন্য ধর্মকে একটি রেফারেন্স ও গাইডেন্স হিসেবে গ্রহণ করার মাধ্যমে ধর্মের সামাজিক ভূমিকাকে স্বীকার করে।
নতুন কাঠামো … নতুন চিন্তাধারা?
‘রাজনীতি’ ও ‘ধর্মীয় কাজের’ পৃথকীকরণ এবং নিজেদেরকে একটি জাতীয় গণতান্ত্রিক দলে রূপান্তর করার যে সিদ্ধান্ত আন নাহদা নিয়েছে, তা আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইয়ে দিয়েছে। কিছু বিশ্লেষক এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছেন। তারা মনে করছেন, রাজনৈতিক অগ্রগতি ও আরো বেশি পেশাদারিত্ব অর্জনের পথে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। অন্যরা একে উদ্দেশ্যমূলক কর্মকৌশল এবং এক ধরনের লজ্জাজনক সমঝোতা হিসেবে দাবি করে এর সমালোচনা করছেন। কেউ বলছেন, এটি একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। আবার কারো মতে, আসলে এটি তেমন তাৎপর্যপূর্ণ কিছু নয়। বরং বাস্তব অবস্থা, বিশেষত আরব বসন্ত উত্তর পরিস্থিতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আন্দোলনটি এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এই সমস্ত তর্ক-বিতর্কের মধ্য থেকে সিদ্ধান্তটির প্রকৃত মর্ম ও তাৎপর্য অনুধাবন করা সত্যিই অনেক কঠিন। তা সত্ত্বেও আন নাহদা নতুন কাঠামো ও নতুন চিন্তাধারার আলোকে নিজেদেরকে রিব্র্যান্ডিং করার চেষ্টা করছে বলেই মনে হচ্ছে।
আদর্শিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, আন নাহদা মূলত আত্মপরিচয়ের রাজনীতি পরিত্যাগ করে বাস্তব কর্মসূচিভিত্তিক রাজনীতি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সর্বশেষ কংগ্রেসে ঘানুশী তার বক্তব্যে বলেছেন, “নিছক মতাদর্শ, বড় বড় শ্লোগান আর রাজনৈতিক ঝগড়া-বিবাদ দিয়ে আধুনিক রাষ্ট্র চলে না। বাস্তব কর্মসূচির আলোকেই রাষ্ট্র চালাতে হয়।”[19] এর পাশাপাশি রাজনৈতিক ইসলামী আন্দোলনগুলোর প্রচলিত প্যান-ইসলামিক এজেন্ডা থেকে আন নাহদা সরে এসে শুধু জাতীয় এজেন্ডা অর্থাৎ তিউনিশিয়ার স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে নিয়োজিত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কাঠামোগত অর্থে এই সিদ্ধান্তের মানে হলো, আন্দোলনটি একটি গতানুগতিক দলে পরিণত হবে এবং ধর্মীয় দাওয়াতী কার্যক্রম থেকে নিজেদেরকে গুটিয়ে নেবে। এ বিষয়টি নিশ্চিত করে ঘানুশী বলেন, “আমরা ধর্মকে রাজনৈতিক বিবাদ থেকে দূরে রাখতে চাই। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব থেকে দূরত্ব বজায় রেখে, দলীয়করণ থেকে মুক্ত রেখে মসজিদগুলোর পূর্ণ নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য আমরা আহ্বান জানাই।”[20] এই সিদ্ধান্তের আরেকটি তাৎপর্য হলো, মুসলিম ব্রাদারহুডের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের অংশ হিসেবে আন নাহদার সাংগঠনিক সম্পর্ক পুরোপুরি বিছিন্ন না হলেও অন্তত আগের চেয়ে তা আরো বেশি দুর্বল হয়ে পড়বে।
তবে আমি মনে করি, এই সিদ্ধান্তটি নিয়ে অতিরঞ্জন করার ফলে অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। আন নাহদার বিবর্তনের ইতিহাসের দিকে খেয়াল রাখলে দলটির আদর্শিক ও কাঠামোগত এই পরিবর্তনকে কোনোভাবেই আকস্মিক, অপ্রত্যাশিত কিংবা চূড়ান্ত কোনো পরিবর্তন বলা যায় না। এমনকি, দলটির আদর্শ ও কাঠামো সেক্যুলার হয়ে গেলো, তাও নয়। কাঠামোগতভাবে, এটি নিছক ‘কাজের সুবিধার্থে বিশেষায়িতকরণ’, যেমনটি ঘানুশী ইতোমধ্যে স্পষ্টভাবেই বলেছেন। বরং আদর্শের প্রশ্নে ঘানুশী তিউনিশিয়ার সেক্যুলার চরমপন্থীদের সমালোচনা করে দাবি করেছেন, “উন্নয়ন, কর্মতৎপরতা, ত্যাগ ও সত্যবাদিতায় উৎসাহ প্রদানের ক্ষেত্রে ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ISIS-সহ অন্যান্য চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ধর্ম আমাদের পক্ষের শক্তি। দেশের উন্নয়নে রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টাকেও ধর্ম সমর্থন করে।”[21]
আন নাহদার রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্তের প্রভাব কী হবে, সেটাই হলো সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। কেউ হয়তো বলবেন, আন নাহদা আরো বেশি পেশাদারিত্বের সাথে রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করতে সমর্থ হবে এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরো বেশি গ্রহণযোগ্যতা লাভ করবে। যাই হোক, এসবের পাশাপাশি বেশকিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখিও যে হতে হবে, তা অনুমেয়। আত্মপরিচয়ের রাজনীতি এবং প্রচলিত রাজনৈতিক ইসলামপন্থী দলগুলোর সাংগঠনিক পদ্ধতি পরিত্যাগ করায় নতুন রিক্রুট ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে আন্দোলনটির সক্ষমতা এবং অভ্যন্তরীণ ঐক্য ও স্থিতিশীলতার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তাছাড়া ধর্মীয় দাওয়াতী কার্যক্রমের ব্যাপারটি আন নাহদা কীভাবে সুরাহা করবে, তাও একটা প্রশ্ন। আন্দোলনটি স্বয়ং এ জাতীয় কাজে আর সম্পৃক্ত হবে না, এটা পরিষ্কার। কিন্তু এর বিকল্প কী হবে? ধর্মীয় দাওয়াতী কাজের জন্য আন্দোলনটি কি ভিন্ন কোনো সংগঠন গড়ে তুলবে? কিংবা অন্ততপক্ষে এ জাতীয় সংগঠনকে সমর্থন করবে? নাকি এই ময়দান থেকে তারা নিজেদেরকে পুরোপুরি গুটিয়ে নেবে? যদি গুটিয়ে নেয়, তাহলে সৃষ্ট শূন্যতা কারা পূরণ করবে? কোনো ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা না হলে উগ্রধারার কোনো ইসলামী গ্রুপ এই সুযোগটা লুফে নিতে পারে এবং এই গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রটিতে নিজেদের বিস্তৃতি ঘটাতে পারে।[22]
আদর্শিক ও সাংগঠনিক গতিশীলতা ধরে রাখা এবং দলটির বিকাশ ও নতুন পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করতে পারার সক্ষমতার আন নাহদা নিশ্চয়ই কৃতিত্বের দাবিদার। তাছাড়া দলটির সর্বশেষ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে চূড়ান্ত কিছু বলা এবং অত্র অঞ্চলের রাজনৈতিক ইসলামী আন্দোলনগুলোর সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে এই সিদ্ধান্তের সম্ভাব্য ফলাফল বিচার করার সময় এখনো আসেনি।
রেফারেন্স
[1] http://www.nytimes.com/2016/06/03/opinion/tunisias-new-revolution.html (accessed: 5 Jun. 2016)
[2] http://www.ansamed.info/ansamed/en/news/sections/politics/2016/05/19/tunisia-gannouchi-ennhadha-out-of-political-islam_1186d693-0121-47bf-8211-886b50b9caf8.html (accessed: 6 Jun. 2016)
[3] https://www.foreignaffairs.com/articles/tunisia/2016-06-08/political-islam-muslim-democracy (accessed: 5 Jun. 2016)
[4] http://www.al-monitor.com/pulse/originals/2016/05/tunisia-ennahda-islamist-party-rebranding-congress.html (accessed: 5 Jun. 2016)
[5] Anadolu Agency http://goo.gl/QgrPpp (accessed:5 Jun. 2016)
[6] Azzam Tamimi, Article: Revisiting the separation between the political and the preaching, Arabi 21 (accessed: 5 Jun. 2016) http://goo.gl/x3c03p
[7] Olivier Roy (trans. by Carol Volk), The Failure of Political Islam (Cambridge, Massachusetts: Harvard University Press, 2001), 12.
[8] Ana Belén Soage, “Hasan al-Banna And Sayyid Qutb: Continuity or Rupture?” The Muslim World, 99 (2009): 296.
[9] Hassan al-Bannā, “Resālat al-ikhwān al-muslimoun tahat rāiat al-qur’ān” in Majmu‘at rasa’il al-shahid Hassan al-Bannā (Alexandria, dār alda‘wah lil-tebā‘ah wa al-tawzi‘wa al-nashr, 1990), 121.
[10] Nazih Ayub, Political Islam: Religion and Politics in the Arab World (London: Routledge, 1991), 100.
[11] Kristen Stilt, “Islam is the Solution: Constitutional Visions of the Egyptian Muslim Brotherhood”, Texas International Law Journal 46 (2010):77.
[12] http://www.aljazeera.com/news/2016/05/tunisia-ennahda-distances-political-islam-160520172957296.html (accessed: 6 Jun. 2016)
[13] Alaya Allani, “The Islamists in Tunisia between confrontation and participation: 1980–2008”, The Journal of North African Studies, 14:2 (2009): 258.
[14] Ibid, 259 – 260
[15] Rachid al-Ghannoshi, min tajrebat al-harakaal-islamiah fi tunis, (Maghreb centre for research & translation, London: 1999), 285 – 290.
[16] Azmi Beshara, al-thawrq al-tunisiah al-majedah (Arab Center For Research & Policy Studies, Doha: 2012), 173 – 174.
[17] Ibid, 173.
[18] Basheer Nafi, Article: Tunisia’s Ennahda can change its discourse, but not the reality of political Islam”, Middle East Eye http://www.middleeasteye.net/columns/tunisias-ennahda-can-change-its-discourse-not-reality-political-islam-1737542604 (accessed:6 Jun. 2016)
[19] Official International Ennahda Page on Facebook (accessed: 5 Jun. 2016) https://www.facebook.com/Nahdha.International/posts/700729823363612
[20] Ibid.
[21] Ibid.
[22] Basheer Nafi, Article: Tunisia’s Ennahda can change its discourse, but not the reality of political Islam”, Middle East Eye http://www.middleeasteye.net/columns/tunisias-ennahda-can-change-its-discourse-not-reality-political-islam-1737542604 (accessed:6 Jun. 2016)