সার্বজনীন ইসলাম এবং আমাদের একদেশদর্শী চোখ
‘ইসলাম একটি পূর্ণাংগ জীবন ব্যবস্থা— এই লাইনটা আমার জন্য একই সাথে পৃথিবীর সবচেয়ে সত্য এবং সুন্দর কথা। আমার জ্ঞানের সীমানা ছোট। সীরাত এবং অন্তত প্রথম চারজন খলিফার শাসনকাল মাথায় রেখে কুরআনের আয়াতে আয়াতে হেঁটে দেখেছি। যতদূর দেখেছি, ততই মুগ্ধ হয়েছি। কিভাবে পারিবারিক মানুষ হয়ে ওঠা যায়, আর সেভাবে সমাজকেও বদলে দেয়া যায়।
আবার এই লাইনটা আমার কাছে একটা ভয়ংকর সতর্কবাণীও। ইসলাম পরিপূর্ণ, এবং এজন্যই ইসলাম আধাআধিতে বিশ্বাস করে না। আল্লাহ স্পষ্ট ভাষায় সাবধান করেছেন,
‘তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশে বিশ্বাস করো আর কিছু অংশ প্রত্যাখ্যান করো? সুতরাং তোমাদের যারা এ রকম করে, তাদের একমাত্র পরিণাম পার্থিব জীবনে হীনতা এবং কিয়ামতের দিন তারা কঠিন শাস্তির দিকে নিক্ষিপ্ত হবে, তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আল্লাহ বেখবর নন।’ (সুরা বাকারাহ, আয়াত: ৮৫)
খেয়াল করেন, শুধু পরকালের শাস্তির কথা বলা হয় নাই। বলা হয়েছে, দুনিয়াতে অপমান করা হবে। এই আয়াতের আশেপাশে যদি খেয়াল করেন, এই আয়াতে আহলে কিতাব, অর্থাৎ যাদের কাছে আগে থেকে আসমানি কিতাব ছিলো তাদেরকে বলা হয়েছে। যারা নিজেদের কাছে থাকা কিতাবের শিক্ষাকে লুকিয়েছে, অপব্যবহার করেছে কিংবা আংশিক ব্যখ্যা দিয়েছিলো। এই সুষ্পষ্ট হুমকির পর এই পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থাকে অনেক যত্ন নিয়ে কাঁধে নেয়া প্রয়োজন।
এবার বাংলাদেশের দিকে তাকাই। এদেশে নারী পুরুষের সম্পর্ক এক অদ্ভুত তারে বাঁধা। ‘মানুষ কি মনে করবে’, ‘এমনই ত দেখে এসেছি এতোকাল ধরে’ আর ‘হাদীসে আছে’ (কুরআন না কিন্তু) এই দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা আমরা। মূল ভাষ্য একটাই, ‘মেয়েদের কন্ট্রোলে রাখতে হয়’। অথচ ইসলামের ধারণাটা একদম উলটো, ‘মেয়েদের দেখে রাখতে হয়’। কারণ, সভ্যতা তৈরিতে মেয়েদের অবদান এতোই বেশি যে, একটা দেশে পুরুষের চেয়ে মেয়েদের সংখ্যা বেশি হয়। কোন কারণে মেয়েদের সংখ্যা কমে গেলে সেখানে বিকৃত যৌনাচারও প্রচলিত হয়ে যায়।
শুরুর কথায় আসি। সভ্যতা তৈরিতে পুরুষ এবং নারীকে আলাদা আলাদা কাজ দেয়া হয়েছে। সফটওয়্যার এবং হার্ডওয়্যারের আলাদা আলাদা কাজের মতো। আবার পরস্পর পরস্পরের ওপর ভীষণ নির্ভরশীল। অথচ নারীকে একলাই মেনে নিতে হলো চরম কিছু অন্যায়।
(১) বাড়িতে থাকলে, ‘বাড়িতেই তো থাকো’। বাইরে গেলে, পসারিণী।
(২) পুরুষ মসজিদে যাবে। নারী? আহা বাচ্চাকাচ্চা পালতে পারলে আর হাতখরচের একশো টাকা গুনতে পারলেই হবে। পড়াশুনাই তো করতে দিইনি এজন্য।
(৩) নারী বাড়ির বাইরে যাবে, বাবাহ না না! বাইরে নিরাপদ না।
(৪) নারীর ঘরের কাজগুলো এক্কেবারে নারীরই, পুরুষ সেসবে চোখও দেবে না, কানও পাতবে না। তাতেই মহা ঝামেলা। অথচ ইসলামের শিক্ষা এর ধারেকাছেও নেই।
(৫) কুরআনে নাই, তবুও মা হাওয়ার ওপর এক অদৃশ্য দায়। তিনিই আদমকে ভুলিয়েছেন। সুতরাং, ‘যা কিছু হারায় গিন্নি বলেন কেষ্টা ব্যাটাই চোর’। খুঁজেপেতে হাদীসও বের করেছেন একটা, জাহান্নামে নারীর সংখ্যা বেশি। সুতরাং সকল পুরুষ ‘বাই ডিফল্ট’ অর্থাৎ আপছে আপ অনুমতি পেয়ে গেল, নারীকে নিয়ে ঢালাও মন্তব্য করার, দোষারোপ করার।
নম্বর দিলাম কথা বলার সুবিধার জন্য। মোটা দাগে, যে পাঁচটি মাত্র উদাহরণ বলেছি সে সবগুলোই অন্যায়। ইসলামের সার্বজনীনতাকে এক চোখ টিপে ধরে তাকিয়ে দেখা। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এইসব একচোখা আচরণের প্রতিদান আমরা পেয়েছি। কিভাবে?
এক নং এর প্রভাব কেমন? নারী বাড়িতে থেকে একই রকম কাজ রোজ করতে করতে একঘেঁয়ে হয়ে যায়। তার ওপর বিভিন্ন সিদ্ধান্তে সে অনুপস্থিত। কেন? কামাই করে না যে? অথচ নারীর মর্যাদা তার উপার্জন দিয়ে আসার কথাই ছিলো না, মাননীয়। এর সরাসরি প্রভাব আসলো কার ওপর? নারী কিন্তু এখন, অন্তত গত বিশ বছরে দেখিয়েছে কামাই রোজগার নারী করতেই পারে। এমনকি বাড়িতে বসেও পারে। এই অযথা চ্যলেঞ্জ মেয়েদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, তাদের যোগ্যতাকে দিনের পর দিন অস্বীকার করতে করতে।
দুই নম্বরের কথায় আসি। নারী জ্ঞান চর্চার জগত থেকে দূরে সরে গেল। আর সোনার হাতে সোনার কাঁকন দিয়ে বসে থাকলো? জি না, নারী এখন অপসংস্কৃতির সবচেয়ে বড় বাহক। কোন মফস্বলেও পাখি জামার জন্য মরে যাচ্ছে কেউ, কেউ মেক আপ কিনতে লক্ষ টাকা খসিয়ে ফেলছে। আপনার সন্তান এইসব হাতে বড় হচ্ছে। নারীর জন্য মসজিদ নিরাপদ না, তো নারী আজকাল মার্কেটেই দিনাতিপাত করছে। বাচ্চাকে স্কুলে ঢুকিয়ে পার্লারে যাচ্ছে। সময় থাকতে নারীকে সৃজনশীল কাজে লাগানোর উপায় বের করেন নি আপনারা। এখন প্রযুক্তি এসে তার ঘরের কাজ হালকা করেছে। মানুষের মস্তিষ্ক, তাই সে কাজ না পেয়ে অকাজে ব্যস্ত। এটা ইসলামের দেয়া বিধান আংশিক মানার শাস্তি।
তিন নং কী? নারীর জন্য গণপরিবহন নিরাপদ না, সুতরাং ঘরেই থাকুক। আজকে সে গণপরিবহন পুরুষের জন্যও নিরাপদ না। নারীর জন্য সন্ধ্যার পর রাস্তাঘাট নিরাপদ না। আজকাল পুরুষও আলো জ্বলা শহরে নির্মম ছিনতাই রাহাজানির শিকার হয়েছে। নিরাপদ নয়, বুঝার সঙ্গে সঙ্গে নারীরে আটকে না ফেলে সমস্যার গোড়ায় হাত দেয়ার যোগ্যতা নাই যে ধর্মবেত্তার, তার শহর আজ তাকেও চেনে না।
চার। সংসারের সব কাজ নারীর একার, সেসবে হাত লাগালে পৌরুষ হুড়মুড়িয়ে পালায়। সুতরাং, আলেম পিতার কন্যাকেও আজকাল গলায় ফাঁস দেয়া হচ্ছে, কাজ জানে না তাই। পুরুষ যেহেতু নিজের, একদম নিজেরই স্ত্রীর কাজে হাত লাগানোকে নিজের জন্য অপমানজনক ভেবে নিচ্ছে। সেহেতু নারীও সেসব কাজ করাকে দাসীবৃত্তি ভাবছে। ফলাফল? আসলেই ভাড়াটে মানুষ দিয়ে সংসার চলছে। যে কাজে মর্যাদা নাই, সে কাজের মানসিক দায়িত্বটুকুও নারী আর নিচ্ছে না। সামনে এ অবস্থা আরও খারাপ হবে।
পাঁচ নিয়ে তো বুঝতেই পারা যাচ্ছে। এই সমাজে পুরো পর্দা করা একটা মেয়ে ধর্ষিতা হলেও মেয়েটারই দোষ। সংসার না হলে, মেয়ের দোষ, নইলে তার মায়ের। স্বামীর ঘরে মন নাই, নেশা করে, নইলে পরকীয়া, বউয়েরই সব দোষ। এসব অভিমানের কথা নয়। সইতে না পেরে মেয়েটা যখন বিদায় নেয় দুনিয়া থেকে, তখনও তার দোষ এমনকি মামলাটা করতেও বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। সর্বগুণে গুণান্বিতা হয়েও নানান বিশেষণ শুনতে হয়। অপরের বেলায় অনেক অনেক ফতওয়া জারি করা কোন ভাই বা বাবার মুখে এখন বোন কিংবা মেয়ের সংসার ভাঙার আফসোস শুনি। আর শুনি, অবহেলায় অযত্নে তাদের হাতে বেড়ে ওঠা এক উদ্ভট ইসলাম এখন তাদেরই জন্য বোঝা। কেউ আর সে বোনটাকে বিয়ে করতে রাজি হয় না, কারণ আংশিক হাদীস সবাই জানে, ‘কুমারি বিয়ে করা সুন্নত’।
এখানে একটা স্বীকারোক্তি দিই। আমি নারী পুরুষের অধিকার কর্তব্য নিয়ে ভাবি, লিখি। কিন্তু সংশোধনের জন্য ধীরেসুস্থে বলি। জানি, খেপিয়ে দিয়ে তো কাউকে শুধরানো যায় না। কিন্তু এই লেখাটা খেপে গিয়ে লেখা, হয়ত অনেককে খেপিয়েই দিবে। আমি ইসলামকে কুরআনের পাতায় পাতায় দেখি সুবিশাল উদারতায় হাজারো রকম সকম আর ভিন্নতাকে জায়গা করে দিয়েছে। সে ইসলাম কথিত উপমহাদেশীয় ধারকদের হাতে পড়ে খোঁড়া হয়ে গেছে। অসংখ্য হাদীস, তাফসীর, বাংলায় অনুবাদই আনা হয় নি, ‘এই দেশের নারী সমাজ হাতছাড়া হয়ে যাবেন’ তাই। এর প্রতিশোধ বড় মারাত্নক হবে, হচ্ছে। হয়ত কোনও দিনই ইসলামের এই তথাকথিত ধারকেরা বুঝবেন না, সব দুর্ভাগ্যই ইহুদি নাসারাদের ষড়যন্ত্র নয়, কিছু তাঁদের হাতেরই কামাই।
এই সামান্য লেখায় সময়ের কাঁটায় এক আফসোস লিখে রেখে গেলাম।
ছবি সূত্র: abc.net.au