শরিয়া আইন নয়, আইনকে আরবিতে কানুন বলে

[এটি মুইজ অ্যাকাডেমির দি অকেশনাল পেপারস সিরিজ থেকে ড. জাসের আওদার নিবন্ধের অনুবাদ]

ফিকহ

ফিকহ শব্দটি আরবি। অর্থ উপলব্ধি, বোঝাপড়া। আর (ইসলামি) ফিকহ হলো শরিয়ার উপলব্ধি ও বোঝাপড়া।

পুনরায় ফিকহ মানে আইন নয়, ফিকহ হলো শরিয়া সম্পর্কে ফিকহবিদদের উপলব্ধি। তারা শরিয়াকে নীতিমালায় পরিণত করেন। ফিকহ হলো নীতিমালা; আপনি এসবকে নৈতিক নীতিমালা বলতে পারেন, কিন্তু এগুলো শরিয়ার নীতিমালা নয়।

শরিয়া ও ফিকহের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আর এই পার্থক্যটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ফিকহ হলো শরিয়া সম্পর্কে স্কলারদের উপলব্ধি, তারা যা বুঝেছিলেন।

মাযহাব

ইসলামের ইতিহাসে দেখা যায়, অনেক স্কলার স্বতন্ত্র পন্থায় শরিয়াকে উপলব্ধি করেছিলেন। পরিশেষে তাদের ছাত্ররা কিংবা ছাত্রের ছাত্ররা মাযহাব প্রতিষ্ঠা করেছেন। যেমন: হানাফি, শাফেয়ি ও হাম্বলি মাযহাব। এ ছাড়াও আরও অনেক স্কলার এ বিষয়ে কাজ করেছেন, কিন্তু তাদের ছাত্ররা সেভাবে প্রচার করেনি। কারণ, তাদের ছাত্ররা এই ফিল্ডে তেমন প্রসিদ্ধ হতে পারেননি। যদিও তাদের শায়েখরা অনেক বড়ো স্কলার ছিলেন, যেমন: আল আওযায়ী ও আত তাবারী।

আবার আরও কিছু মাযহাবও ছিল, যাদের অনুসারী সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। যেমন: জাহিরিয়া, মুতাজিলা। এগুলোও মাযহাব হিসেবে বিবেচিত ছিল। তা ছাড়া আরও ছিল জাফরিয়া ও ইবাদিয়া ইত্যাদি।

কেন অল্প কয়েকটি মাযহাব জনপ্রিয়

অতএব, ফিকহ হলো শরিয়ার উপলব্ধি। আর একে নীতিমালায় পরিণত কারার নাম মাযহাব; আমাদের অনেক মাযহাব রয়েছে। আমাদের নিকট কেবল চার-পাঁচটি মাযহাব জনপ্রিয় কেন? কারণ, মুসলিম সংখ্যাঘরিষ্ঠ দেশের কোর্টগুলোতে এই মাযহাবসমূহ আইনি মর্যাদা পেয়েছিল। আমাদের ছিল কোর্ট, আর জনগণ তাদের বিবাদ মিমাংসা ও বিভিন্ন ইস্যু সমাধানের জন্য কোর্টে আসতো। আধুনিক রাষ্ট্র যেভাবে ব্যক্তি জীবনের সবকিছু পরিচালনা করে, সে সময় রাষ্ট্র এরকম করতো না। সে সময় রাষ্ট্র কেবল সীমান্ত সুরক্ষা, সেনাবাহিনী পরিচালনা ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগদান করতো। রাষ্ট্রে অনেক বিচারক ছিল। জনগণ কোনো সমস্যায় পড়লে বিচারকের কাছে যেতেন। কোনো সমস্যা সৃষ্টি না হলে জীবন স্বাভাবিক ছন্দে চলতে থাকতো।

রাষ্ট্র তাদের উপর করারোপ করতো না এবং বলতো না, এটা পরিধান করো, এটা পান করো। অবশ্যই তখনকার রাষ্ট্রব্যবস্থা এখনকার রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে ভিন্ন ছিল। যাহোক, সেজন্য কোর্ট সিস্টেম গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সে সময় কোর্ট ছিল এমন স্থান, যেখানে মানুষ তাদের মতপার্থক্য নিরসন করত। কোটর্কে কিছু বই অনুসরণ করতে হতো। কারণ, সে সময় তাদের আইন (বর্তমান আইন বলতে যেমন বুঝায়) ছিল না। মুসলিম বিশ্বে বর্তমান আইন তথা সংবিধানের বিকাশ হয় উনবিংশ কিংবা বিংশ শতাব্দীতে। আমরা এর পূর্বে এর সাথে পরিচিত ছিলাম না। মূলত তার আগে আইন ছিল আদালত (কোর্ট), জনগণ আদালতে আসতো আর বিরোধ মিমাংসা করে চলে যেতো।

সে সময় খলিফা, কিংবা রাজা, অথবা প্রদেশের আমীর একজন কাজী (বিচারপতি) বাছাই করে নিতেন আর দেখা যেতো কাজী কোনো একটি মাযহাবের অনুসরণ করেন। এজন্য আদালত কোনো একটি সুনির্দিষ্ট মাযহাব গ্রহণ করেছিল। সে সময় কোথাও শাফেয়ী কোর্ট আবার কোথাও হানাফী কোর্ট ইত্যাদি প্রচলিত ছিল। পরিশেষে কোর্ট জনগণের পরিচয় (আইডেন্টিটি) সংজ্ঞায়ন করেছিল। লোকজন বলতো আমরা শাফেয়ী, আমরা মালেকী। অনেক মানুষ প্রথমে বুঝতো না শাফেয়ী হওয়া মানে কী, কিন্তু কোর্ট যা বলতো তারা তা অনুসরণ করতো। আর কে কোন মাযহাবের অনুসারী তা নির্ভর করতো তাদের কাজী, স্কলার ও মসজিদের ওপর।

কিছু মাযহাব গ্রহণ করা হয়েছিল রাজনৈতিক কারণে। উদাহরণস্বরূপ, অটোমানরা যখন ওসমানীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে তখন তাদের খলিফা কোরাইশ বংশোদ্ভূত ছিলেন না। সে সময় হানাফী মাযহাব ছাড়া সব মাযহাব এর সাথে দ্বিমত পোষণ করে। এর কারণ তাদের মতে রাসূলের সা. একটি হাদিস অনুসারে খলিফা আরবের কুরাইশ বংশদ্ভূত হতে হবে। তাই অটোমানরা তাদের কোর্টের জন্য হানাফী মাযহাব গ্রহণ করে। সেজন্য বিভিন্ন মাযহাব বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ার পেছনে অনেক রাজনৈতিক কারণ ছিল। এটা কখনো কখনো নির্ভর করতো প্রথম যিনি সে অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেছেন তিনি কোন মাযহাবের অনুসারী ছিলেন তার ওপর। যাহোক, এসব মাযহাব স্থানিকভাবে সজ্ঞায়িত ছিল না আর মাযহাবের সম্পৃক্ততা অপরিহার্যও ছিল না। এসব মাযহাব সম্পর্কে সম্পূর্ণ অচেতন থেকেও যে কেউ অবলীলায় জীবন-যাপন ও মৃত্যুবরণ করতে পারতো। এতে কোনো সমস্যা ছিল না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে একজন মুসলিম।

এটাই ফিকহ। ফিকহ হলো স্কলারদের কুরআনের উপলব্ধি। ভালো খারাপ, হালাল হারাম প্রশ্নে আমাদের স্কলাররা জ্ঞানের একটি ঐতিহাসিক কাঠামো নির্মাণ করেছেন। আজ আমাদের নিকট আছে ফিকহ, যার আলোকে আমরা পরিচালিত হই। সমকালীন বিষয়াবলির বৈধতা অবৈধতা সম্পর্কে ফকিহ সুচিন্তিত মতামত প্রদান করেন এবং একটি ফতোয়া ইস্যু করেন।

ফতোয়া

ফতোয়া হলো কোনো বিষয়ে একটি অভিমত। ফিকহ হলো শরিয়ার উপলব্ধি আর ফতোয়া হলো সুনির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে ফিকহের প্রয়োগ। ফতোয়া প্রত্যেক স্থান ও সময়ের জন্য প্রযোজ্য নয়, নয় প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য। ফতোয়া হলো ব্যক্তিকেন্দ্রিক উপদেশ।

يَسْتَفْتُونَكَ قُلِ اللَّهُ يُفْتِيكُمْ

অর্থ: “লোকেরা তোমার নিকট ফতোয়া জানতে চায়। বল, আল্লাহ তোমাদের ফতোয়া দিচ্ছেন।” (সূরা নিসা: ১৭৬)

ফতোয়া আইন নয়; এটা একটি উপদেশ। এটা পরে নীতি নির্ধারণের সময় গ্রহণ করা হতে পারে অথবা আইন প্রণয়নের সময় রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে, কিন্তু ফতোয়া কেবল একটি ব্যক্তিক উপদেশ।

এই উপদেশ ব্যক্তিভেদে পরিবর্তন হয়। ফিকহের প্রেক্ষাপটের বৈচিত্র্যতার ভিত্তিতে একটি বিষয়ে অনেকগুলো ফতোয়া ইস্যু হতে পারে। ফিকহের প্রয়োগ শিশু থেকে বৃদ্ধ, ধনী থেকে গরীব, নারী থেকে পুরুষ, দুর্বল থেকে শক্তিশালী-এর মধ্যে ব্যবধানের কারণে পরিবর্তন হয়ে যায়। সেজন্য, ফতোয়া হলো কারো পরিস্থিতি বিবেচনা করে প্রদত্ত একটি অভিমত। উলুম শরিয়াতে (শরিয়াবিষয়ক অধ্যয়ন) এটা গৃহীত যে- সময়, স্থান, পরিস্থিতির পরিবর্তনে, ব্যক্তিভেদে ও উদ্দেশ্যভেদে ফতোয়াও পরিবর্তন হয়ে যায়। যেমন: কেউ ইচ্ছাকৃত অপরাধ কিংবা পাপ করলো, আর আরেক ব্যক্তি অনিচ্ছাকৃত কিংবা বল প্রয়োগে বাধ্য হয়ে অপরাধ বা পাপ করলো- এ দুটি ক্ষেত্রে ফতোয়া একই হবে না।

পরিশেষে, সংক্ষেপে, শরিয়া হলো পথ, ফিকহ হলো কুরআনের অনুশাসনকে নীতিমালায় পরিবর্তন করার উপলব্ধি, ফতোয়া হলো সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে নীতিমালার প্রয়োগ, আর বাস্তবতা হলো এর কোনোটাই আইন নয়। আইনকে আরবীতে কানুন বলা হয়।

এ সংক্রান্ত পূর্ববর্তী পোস্টের লিংক: https://cscsbd.com/blog/archives/529

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *