মুহাম্মদ ছিলেন একজন নারীবাদী

এখনকার ইসলামী মৌলবাদীরা নারীদেরকে তাদের নিয়ন্ত্রনে রাখতে যা করছে তাতে নবী মুহাম্মদ নিশ্চয়ই শংকাবোধ করতেন। এ দমনমূলক কাজ করা হয় ইসলামী আইনের নামে, যা শরীয়াহ হিসাবে পরিচিত। কিন্তু বর্তমান নারীবিরোধী শোষণমূলক দৃষ্টিভংগীর পিছনে সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। এর কোরানিক ভিত্তি দুর্বল এবং মুহাম্মদ যা শিক্ষা দিয়ে গেছেন এবং যেভাবে নারীদের সঙ্গে আচরণ করেছেন বলে আমরা জানি, এটি তার সঙ্গে কোনোক্রমেই সঙ্গত নয়। বৌদ্ধ ধর্ম, খ্রীষ্ট ধর্ম, কনফুসিয়াস ধর্ম, ইসলাম ধর্ম ও ইহুদী ধর্মের ন্যায় মহান সব ধর্মের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে সন্দেহাতীতভাবেই মুহাম্মদই ছিলেন নারীদের ক্ষমতায়নের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি প্রগতিশীল। যুক্তিসংগত কারণেই তিনি ছিলেন ইতিহাসের প্রথম নারীবাদী। বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে হবে।

বিরাজমান সাংস্কৃতিক সংকট হতে উত্তরণের জন্য মুসলিমদের, বিশেষ করে আরবদের যদি কিছু করার থাকে তাহলে তাদের উচিত নারীদের স্বাধীনতা দেয়া। সারা বিশ্বের অনেক দেশের নারীরা যেসব অধিকার পাচ্ছে সেগুলোর মতো করে নারী অধিকার নিশ্চিত করা। আরব বসন্তের মূলমন্ত্র হল নারী সমতা।

ধর্ম প্রবর্তকদের নারী অধিকার সম্পর্কিত অবস্থানের আলোকে মুহাম্মদ –

বড় বড় ধর্মপ্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম কনফুসিয়াস নারীদের কথা একেবারে উল্লেখ করেননি বললেই চলে। তার সব শিক্ষায় নারীদেরকে পিতৃশাষিতভাবে ব্যবস্থার অধীন হিসাবে অভিহিত করেছেন। বুদ্ধ শিক্ষা দিয়েছেন যে, নারীরাও নির্বাণ লাভ করতে পাররব তবে এ জন্য তাদেরকে তিনগুণ বেশি প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এভাবেই একজন নারী ভিক্ষু হতে পারবে। তৎসত্বেও সর্বোচ্চ মানের মহিলা ভিক্ষুর মর্যাদা হবে সর্বনিম্ন পুরুষ ভিক্ষুর নিচে।  খ্রীষ্ট ধর্মবানী অনুসারে যীশু নারীদের মর্যাদা সম্পর্কে স্পষ্টভাবে কিছু বলেননি। তবে তিনি নারীদের নেতিবাচক দৃষ্টিভংগীতে দেখেছেন এবং তাদেরকে বিধর্মী হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। মূসা সম্পূর্নরূপে পিতৃতান্ত্রিকতার পক্ষেই ছিলেন এবং তাওরাতে বস্তুত এমন কিছুই নেই যা সুনির্দিষ্টভাবে নারীদের অধিকারের উপর গুরুত্বারোপ করে।

মুহাম্মদ ছিলেন একেবারেই ভিন্ন। সত্যিকার আধ্যাত্মিকতার মৌলিক দাবী হিসাবে তিনি স্পষ্টত নারী পুরুষের সমতার বৈপ্লবিক শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি তার জীবদ্দশাতেই আরব নারীদের অবস্থা ও ভূমিকার ব্যাপকতর উন্নয়নের লক্ষ্যে অনেক সুদৃঢ় পদক্ষেপ নিয়েছেন। নারীদের অবস্থার প্রতি মুহাম্মদ ছিলেন অতীব সংবেদনশীল। কারণ তিনি জন্মগ্রহন করেছিলেন গরীব হিসেবে এবং অতি অল্প বয়সেই অনাথ হন। এমনকি তিনি শিক্ষিতও ছিলেন না। দারিদ্র্যতা এবং সামাজিক বঞ্চনা বলে কী বুঝানো হয় তা অনেকেই না বুঝলেও তিনি তা উপলব্ধি করতেন।

কনফুসিয়াস জন্মগ্রহন করেছিলেন প্রাচীন চীনের সম্ভ্রান্ত বিদ্বান শ্রেণীভুক্ত পরিবারে। বুদ্ধ নেপালের বিত্তশালী রাজকুমার হয়ে জন্মগ্রহন করেছিলেন। যীশু জন্মগ্রহন করেন ফিলিস্তিনের একজন অভিজাত ইহুদী সম্প্রদায়ের একজন হিসাবে। তিনি ছিলেন রাজ পরিবারের সেবায় নিয়োজিত ছুতারমিস্ত্রীর পুত্র। মূসা এক হীব্রু পরিবারে জন্মগ্রহন করেন এবং প্রতিপালিত হন মিশরের ফারাউ রাজার রাজপ্রাসাদে। এ ধরনের কোন সুযোগ সুবিধাই মুহাম্মদের ছিল না। সে সময়ে অন্যান্য ধর্মের নেতারা যখন নারী নিপীড়নের বিষয়ে আশ্চর্যজনকভাবে নীরব ছিলেন মুহাম্মদ তখন ব্যাপকভাবে ধর্মীয় বিধি-বিধান ও রাষ্ট্রীয় রীতি-নীতির ক্ষেত্রে নারীদের অবস্থান ও মর্যাদার ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেন।

কিছু তাৎপর্যপূর্ণ দিক:

সপ্তম শতাব্দীতে আরবে কন্যা শিশুহত্যা ছিল খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। মুহাম্মদ এই প্রথা বাতিল করলেন। হাদীসে আছে, মুহাম্মদ বলেছেন,”কন্যা শিশুর জন্ম হল আশীর্বাদস্বরূপ।” সে সময়ে আরবে নারীদেরকে সম্পত্তিরূপে বিবেচনা করা হত। তাদের কোনরূপ নাগরিক অধিকার ছিল না। মুহাম্মদ তাদেরকে সম্পত্তি মালিকানার অধিকার দিলেন। এবং গুরুত্বপূর্ন সামরিক দায়িত্বপালনের অধিকার ও উত্তরাধিকার লাভের অধিকারও প্রদান করলেন।

মুহাম্মদের পূর্বে পুরুষেরা স্ত্রীদেরকে যে দেনমোহর পরিশোধ করত তা পরিশোধ করা হতো কনের পিতাকে। দৃশ্যত এটি ছিলো দু’জন পুরুষ মধ্যকার পারষ্পরিক চুক্তি। নারীদের এ ব্যাপারে কোন মতামত ছিল না। মুহাম্মদ ঘোষনা করলেন যে, বিবাহে অবশ্যই নারীর সম্মতি থাকতে হবে এবং দেনমোহর প্রদান করতে হবে নারীকে, তার পিতাকে নয়। এই অর্থ সংশ্লিষ্ট নারী বিবাহের পরও হাতে রাখতে পারবে। সাংসারিক ব্যয়ভারের জন্য তাকে এটি ব্যবহার করতে হবেনা। এটি হল পুরুষের দায়িত্ব। নারীদেরকে তাদের স্বামীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের অধিকারও প্রদান করা হল। এটি ছিল সে সময়ের জন্য নজীরবিহীন ব্যাপার। বিবাহবিচ্ছেদের নারীকে প্রাপ্ত দেনমোহর সঙ্গে নিয়ে যাবার মত ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছিল।

সেই সাথে নারীদের উত্তরাধিকার স্বত্বও দেয়া হয়েছিল। ভাইয়ের তুলনায় তাদেরকে অর্ধেক দেয়া হয়েছে।এর কারণ হলো, সাংসারিক ব্যয় সংক্রান্ত বিষয়ে পুরুষদের উপর অনেক অর্থনৈতিক দায়িত্ব ন্যস্ত থাকে। মুহাম্মদের হাতে প্রথমবারের মত আরব নারীরা সম্পত্তি ও পারিবারিক ধনসম্পদের উত্তরাধিকারী হল যা সে সময়ের তুলনায় বৈপ্লবিক হিসাবে বিবেচনা করা যায়।

মুহাম্মদকে প্রায়ই নারীদের গৃহকর্মে সহযোগিতা করতে দেখা যেত এবং তিনি তার পরিবারের প্রতি যথেষ্ট মনোযোগী ছিলেন। খাদীজা ছিলেন তার প্রথম ও পরবর্তী পনের বছর পর্যন্ত একমাত্র স্ত্রী। আরবে সে সময়ে যা ছিল বিরল। তারা পরষ্পরকে খুব ভালবাসতেন। খাদীজা ছিলেন প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী। তিনি মুহাম্মদকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন ফেরেশতা জিব্রাইলের সঙ্গে তার একেবারে প্রথম সাক্ষাৎ থেকে এবং প্রথম দিকের নাযিলকৃত অহীর ব্যাপারে যা পরবর্তীতে কুরআনে সংকলিত হয়।

খাদীজার মৃত্যুর পর মুহাম্মদ ১২ জন স্ত্রীকে বিবাহ করেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন আয়িশা, তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহযোগী আবু বকরের কন্যা। বাকিরা প্রায় সবাই ছিলেন বিধবা, তালাকপ্রাপ্ত নারী অথবা বন্দী নারী। তিনি দৃঢ়ভাবে প্রচার করে গেছেন যে, যেসব নারী দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছে তাদেরকে সুরক্ষা দেয়া পুরুষদেরই কর্তব্য। এটি ছিলো তার বহুবিবাহ সমর্থন করার অন্যতম কারণ। কন্যা শিশু হত্যা নিয়েও সপ্তম শতাব্দীর আরবে নারীরা পুরুষের তুলনায় সংখ্যায় ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কারণ তখন আন্তঃগোত্রীয় যুদ্ধবিগ্রহে বহু পুরুষ মারা যেত। মুহাম্মদের কতিপয় স্ত্রী ছিলেন গরীব ও নি:স্ব এবং তিনি তাদের সন্তানসহ তাদেরকে তার পরিবারে গ্রহন করে নেন।

৬৩২ সালে মৃত্যুর পূর্বে তার বিদায়ী বক্তব্যে সংক্ষেপে মুহাম্মদ পুরুষ ও নারীর পরষ্পরের উপর অধিকার সম্পর্কে বলেন, “তোমাদের যেমন নারীদের উপর কিছু সুনির্দিষ্ট অধিকার আছে, তেমনি নারীদেরও তোমাদের উপর কিছু সুনির্দিষ্ট অধিকার আছে। নারীরা তোমাদের সহযোগী ও সহকারী”। হাদীসে বর্ণিত আছে, মুহাম্মদ বলেছেন,”তারাই সর্বোৎকৃষ্ট পুরুষ যারা তাদের স্ত্রীদের কাছে সর্বোতকৃষ্ট”।

তার মৃত্যুর পর তার স্ত্রী আয়িশা সমস্ত হাদীসগুলোকে একত্রিত করার কাজে উদ্যোগ গ্রহণ করেন ও এ কাজে নেতৃত্ব দেন এবং তার অপর এক স্ত্রী সূরাসমূহের সংকলনে ভূমিকা পালন করেন। কুরআনে অন্তর্ভুক্ত ১৪৪ সূরার মধ্যে নবম সূরাটি ব্যতিত প্রত্যেকটি সূরা আরম্ভ হয় “বিসমিল্লাহ হীর রাহমানীর রাহীম” দিয়ে। এর সাধারনত যে অনুবাদ করা হয় তা হলো “পরম করুনাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে।” এই বাক্যটির গভীর অর্থ হল, তাঁর নামে যিনি মাতৃজরায়ু থেকে স্নেহ, মমতা ও দয়ার সৃষ্টি করেন। নারীদের ব্যাপারে আল্লাহর এই আহ্বানই হল ইসলামিক নবজাগরণের চাবিকাঠি

পরিশেষে, কুরআনে নারীদের নেক্বাব বা হিজাব পরিধানের ব্যাপারে কিছু উল্লেখ নেই। সেটি নিশ্চিতভাবে ছিল একটি আরবীয় প্রথা এবং মুহাম্মদের স্ত্রীরা হিজাব পরিধান করতেন ‘উম্মুল মু’মিনীন’ হিসেবে তাদের বিশেষ পদমর্যাদার পরিচয়। কিন্তু কুরআন সরাসরি শুধু একটি কথাই বলে তা হল নারীদের শালীন পোশাক পরিধান। মুহাম্মদ একই কথা পুরুষদেরও বলেছেন। তার মতে, পোশাকের শালীনতাই অন্তরের শালীনতা প্রকাশ করে। মুহাম্মদ নিজে এমন কি যখন তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা ছিলেন তখন ও অনাড়ম্বর সাদা পশম পোশাকের বেশি কখনো অন্য কোন পোশাক পরিধান করতেন না।

মুসলিম নারীদের উচ্চতর অবস্থান –

মুহাম্মদের পুনর্গঠন এতটাই আমূল সংস্কারমূলক ছিল যে ইসলামের গোড়ার দিকে আরবের নারীদের পদমর্যাদা ছিল পৃথিবীর যে কোন সমাজের চেয়ে সর্বোচ্চ। এক হাজার বছর পরেও আজকের পাশ্চাত্যেও অধিকাংশ নারীরা যে সব অধিকার লাভে সক্ষম হয় নাই, সপ্তম শতাব্দীর আরব নারীরা সে সব অধিকার ভোগ করতো।

এটি সত্য যে, অনেক সমকালীন আরব ও মুসলিম রাষ্ট্রে নারী অধিকারের অনেক বেশি অবনতি হয়েছে। এটি এমন একটা ট্র্যাজেডি। যেমন করে ৮ম হতে ১৩শত শতাব্দী ব্যাপী আব্বাসীয় খলিফাদের সময়ে বিশ্বের কাছে ইসলামী সভ্যতা ছিলো একটা উজ্জ্বল আলোক বর্তিকা স্বরূপ, তেমন পুনর্জাগরণ ঘটাতে হলে ইসলামী সংস্কৃতি ও সভ্যতার সংশোধন জরুরী।

মুসলমানদের করণীয় –

রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিল্পসাহিত্য ও ধর্মীয় বিষয়াদিতে নারী স্বাধীনতার ব্যাপক তাৎপর্য বিদ্যমান। আরব বসন্তকে এটি একটি নতুন দিগন্তে নিয়ে যাবে। আরব বসন্তের সূতিকাগার হিসাবে ভূমিকাপালন করেছে এমন সব দেশের জন্য এটি অত্যন্ত জরুরী। ইসলামের দিক থেকে এটি এ মুহুর্তেরই দাবী, নারীদের পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করা। এ বিষয়ে মুহাম্মদের আদর্শকে মেনে চলা। একই সাথে কুরআনের অথরিটিকেও মেনে চলা, যা মমতা ও দয়াকে মহান আল্লাহর প্রধান ও অগ্রগণ্য গুণ হিসাবে বর্ণনা করে।

[বিশেষ দ্রষ্টব্য: প্রবন্ধটি পাশ্চাত্যের ইসলামবিরোধী নারীবাদীদের উদ্দেশ্য করে ইসলাম ও নবী মুহাম্মদ (স.) সম্পর্কে একজন অমুসলিমের লেখা। এটি আমার এ ধরনের প্রথম অনুবাদ।

The Huffington Post-এর ব্লগে “Muhammad was a Feminist” শিরোনামে প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধটি লিখেছেন ইউবিকিউটি ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি জিম গেরিসন]

৪ Comments

    1. নি:সন্দেহে আলোচনা চমৎকার। যদিও আপনি অনুবাদ করেছেন। তবুও বলছি মুহাম্মদ (সা:) এর নাম উল্লেখের ক্ষেত্রে আপনার (সা:) ব্যবহার করা উচিত ছিল। প্রথম প্রথম খুবই বিরক্ত ও রাগান্বিত হয়েছিলাম। তবে অনুবাদকৃত ও একজন অমুসলিমের দ্বারা লেখা জেনে বিরক্তি ও রাগ দুইটাই কমেছে। বিষয়টির দিকে লক্ষ্য রাখতে অনুরোধ জানাচ্ছি।

  1. ৭ম শতাব্দীর হিসেবে মুহম্মদ কে নারীবাদী বলা যায় অবশ্যই। কিন্তু সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে যিনি নিজেকে দাবি করেছেন, তার জন্য বার টা অনেক উপরে। মুহম্মদ সেই বার থেকে বহু বহু দূরেই থাকবেন।
    রিসেন্টলি হাফিংটন পোস্ট এক ই ধরণের আরেকটি আর্টিকেল প্রকাশ করেছে। সেটার লাইট রিফিউটেশনের লিঙ্ক দিলাম যা এই আর্টিকেল টার জন্যও কাজ করবে

    https://youtu.be/zXQlcJ58TE0

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *