মুসলিম প্রান্তিকতা: ড. ইউসুফ আল-কারাদাওয়ীর ইনসাইট

আমাদের মুসলিম চিন্তা ও অভ্যাসে প্রান্তিকতা নতুন কিছু নয়। এই প্রান্তিকতা দ্বিমাত্রিক। বর্তমান বিশ্বের অন্যতম একজন শ্রেষ্ঠ ইসলামিক স্কলার ড. ইউসুফ আল-কারাদাওয়ী (হাফি.) এই দ্বিমাত্রিক প্রান্তিকতার বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার ছিলেন। এই দ্বিমাত্রিক প্রান্তিকতাকে তার বিভিন্ন লেখায় তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন অসাধারণভাবে। ১৯৬০ সালে প্রকাশিত তার মাস্টারপিস বই “আল-হালাল ওয়াল হারাম ফীল ইসলাম” এর ভূমিকায় খুব সুন্দর করে তিনি একে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। সেই প্রাসঙ্গিক অংশটির অনুবাদ নিচে আপনাদের সাথে শেয়ার করা হলো:

ইসলাম নিয়ে যারা গবেষণা করেন এবং কথাবার্তা বলেন, তাদের অধিকাংশকেই আমি দু’টি দলে বিভক্ত হতে দেখেছি।

এপোলোজেটিক

পাশ্চাত্য উন্নতির চাকচিক্য একদলের চোখকে ধাঁধিয়ে দিয়েছে। “পাশ্চাত্য উন্নতি” নামের এই বিশাল প্রতিমায় মুগ্ধ হয়ে তারা পাশ্চাত্যের সেবাদাসে পরিণত হয়েছে। ফলে তারা নৈকট্য লাভের জন্য মূর্তিটির সামনে তাদের উৎসর্গমালা অর্পণ করে এবং বশ্যতা স্বীকার স্বরূপ তার সামনে চোখ নত করে বিনীত ভঙ্গিতে দাঁড়ায়। পাশ্চাত্যের আদর্শ ও ঐতিহ্যকে তারা একেবারে নিখুঁত বিষয় হিসেবে গ্রহণ করে। যেন এই আদর্শ ও ঐতিহ্যের কোন পর্যালোচনা ও বিরোধিতা করা যাবে না। ইসলামের কোন বিষয় যখন সেই পাশ্চাত্য আদর্শ ও ঐতিহ্যের সাথে মিলে যায়, তখন তারা আনন্দে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” ও “আল্লাহু আকবার” বলে ওঠে। যখন ইসলামের কোন বিষয় পাশ্চাত্য আদর্শ ও ঐতিহ্যের সাথে সাংঘর্ষিক হয়, তখন তারা একটু কষ্ট পায়। তারপর তারা চেষ্টা শুরু করে কিভাবে সেই সাংঘর্ষিক বিষয়ের সাথে পাশ্চাত্য আদর্শ ও ঐতিহ্যকে খাপ খাওয়ানো যায়, কিংবা নির্দোষ প্রমাণ করে কৈফিয়ত দেয়া যায় অথবা অপব্যাখ্যা দিয়ে পার পাওয়া যায়। অবস্থাটা এমন যেন পশ্চিমা উন্নতি, দর্শন আর ঐতিহ্যের সাথে মানিয়ে চলাটাই ইসলামের কর্তব্য!

ইসলাম যা হারাম করেছে সেসব ব্যাপারে তাদের কথাবার্তা থেকে এমনটাই আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়। যে বিষয়গুলোতে তাদের এরুপ আচরণ দেখতে পাওয়া যায় আমাদের জানামতে সেগুলো হলোঃ মূর্তি বা ভাস্কর্য, জুয়া বা লটারি, সুদ, গাইরে মাহরামের সাথে নির্জনে মিলিত হওয়া, নারীদের নারীসূলভ আচরণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া, পুরুষেরা স্বর্ণ ও রেশম ব্যবহার করা ইত্যাদি।

আবার ইসলাম যা হালাল করেছে সেসব বিষয়ে তাদের কথাবার্তা থেকেও এমনটা প্রতীয়মান হয়। যেমন: তালাক, পুরুষদের একাধিক বিয়ে ইত্যাদি।

ব্যাপারটা এমন যে পাশ্চাত্য যা হালাল করেছে সেটাই তাদের দৃষ্টিতে হালাল, আর পাশ্চাত্য যা হারাম করেছে সেটাই কেবল তাদের দৃষ্টিতে হারাম। অথচ তারা একটি বিষয় ভুলে বসে থাকে। সেটি হলোঃ ইসলাম হলো আল্লাহর কথা। আর আল্লাহর কথাই সবসময় চূড়ান্ত। আল্লাহর কথা কাওকে অনুসরণ করে না, উল্টো সেটিকেই অনুসরণ করতে হয়। এটি সবসময় সবার উপরে থাকে, এর উপরে কিছু থাকতে পারে না। রাব্ব বা প্রভূ তাঁর বান্দার অনুসরণ করবে কিংবা সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টির প্রবৃত্তির প্রতি বিনীত হবে— এটি কিভাবে সম্ভব হতে পারে?? এজন্য কুরআন বলছে:

وَلَوِ اتَّبَعَ الْحَقُّ أَهْوَاءَهُمْ لَفَسَدَتِ السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ وَمَنْ فِيهِنَّ

ভাবার্থঃ “আর আল-হক্ব বা মহাসত্য আল্লাহ যদি তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করতেন, তাহলে আকাশ, পৃথিবী এবং এর মাঝে যা কিছু আছে, সব ওলট পালট হয়ে যেতো।” [আল-মু’মিনুন: ৭১]

قُلْ هَلْ مِنْ شُرَكَائِكُمْ مَنْ يَهْدِي إِلَى الْحَقِّ قُلِ اللَّهُ يَهْدِي لِلْحَقِّ أَفَمَنْ يَهْدِي إِلَى الْحَقِّ أَحَقُّ أَنْ يُتَّبَعَ أَمَّنْ لَا يَهِدِّي إِلَّا أَنْ يُهْدَى فَمَا لَكُمْ كَيْفَ تَحْكُمُونَ

ভাবার্থঃ “তাদের জিজ্ঞেস করুন, তোমাদের তৈরি করা শরীকদের মধ্যে এমন কেউ আছে কি যে সত্যের দিকে পথ নির্দেশ করে? বলুন, একমাত্র আল্লাহই সত্যের দিকে পথনির্দেশ করেন, ফলে আনুগত্য লাভের জন্য তিনি বেশি উপযুক্ত নাকি যাকে সত্যের দিকে পথনির্দেশ না করলে পথ পায় না সে বেশি উপযুক্ত? তোমাদের আসলে কি হয়েছে যে তোমরা উলোট পালট সিদ্ধান্ত নিয়ে বসছো?” [ইউনুসঃ ৩৫]

এরা হলো একটা দল।

লিটারালিস্ট

অপরদিকে আরেক দল হালাল-হারামের বিষয়ে কোনো একটি বইয়ের কিছু উদ্ধৃতি বা বক্তব্যের উপর নির্ভর করে নির্দিষ্ট কিছু মতের উপর নিশ্চল হয়ে বসে থাকে। আর মনে করে যে বইয়ের সেই উদ্ধৃতি বা বক্তব্যটাই হলো ইসলাম। সে তার মত থেকে একচুল পরিমাণও নড়তে চায় না। আর তার মাযহাব বা মতের স্বপক্ষে কোন দলীল বা প্রমাণ আছে কিনা সে বিষয়ে কখনো নিরীক্ষা, অন্যদের দলীল-প্রমাণের সাথে তুলনা এবং পর্যবেক্ষণ ও তুলনার মাধ্যমে সত্যকে বের করে আনার চেষ্টাও করে না।

যখন তাকে মিউজিক, গান, দাবা, নারী শিক্ষা, নারীদের মুখ ও হাতের তালু খোলা রাখা অথবা এ ধরনের কোোন মাসয়ালা জিজ্ঞেস করা হয়, তখন তার জিহ্বার গোড়া ও কলমের আগা দিয়ে যে শব্দটি বের হয় সেটি হলো— হারাম। অথচ এই গ্রুপটি এই ক্ষেত্রে সৎকর্মশীল সালাফদের শিষ্টাচার ভুলে বসে থাকে। সালাফগণ কেবল সেসব বিষয়ের ক্ষেত্রে হারাম শব্দটি ব্যবহার করতেন, যেসব বিষয় অকাট্যভাবে হারাম হিসেবে সাব্যস্ত আছে। এছাড়া বাকি বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে তারা বলতেন: “আমরা অপছন্দ করি” বা “আমরা পছন্দ করি না” কিংবা এ ধরনের কোনো কথা।

আমি উপরে উল্লেখিত দু’টো প্রান্তিক দলের কোনোটিতে অন্তর্ভূক্ত না হতে চেষ্টা করেছি। একদিকে আমি আল্লাহকে রব্ব হিসেবে, ইসলামকে দ্বীন হিসেবে এবং মুহাম্মাদকে (সা) রাসূল হিসেবে মেনে নেয়ার পর দ্বীনের খাতিরেই পশ্চিমাদের দাসে পরিণত হওয়াকে মেনে নিতে পারিনি। অন্যদিকে ভুল ঠিক যাই করুক না কেন সব বিষয়ের ক্ষেত্রে কেবল একটি মাযহাবকে অন্ধ অনুসরণ করার বিষয়টি আমি আমার বিবেকের খাতিরে মেনে নিতে পারিনি। যেমনটা ইবনুল জাওযী বলেছেন যে, “একজন অন্ধ অনুসরণকারী যখন অগ্রহণযোগ্য কোন বিষয়ের অন্ধ অনুসরণ করে, তখন এই অন্ধ অনুসরণের অর্থ দাঁড়ায় যে সে তার বিবেকের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করছে। কারণ বিবেককে সৃষ্টি করা হয়েছে গভীর চিন্তা ও গবেষণার জন্য। আর এটি কত জঘন্য একটি কাজ যে, কাওকে যখন আলোকিত করার জন্য মোমবাতি দেয়া হয়, তখন সে সেটিকে নিভিয়ে দিয়ে অন্ধকারে পথ চলে।” [তালবীসু ইবলীস, পৃষ্ঠাঃ ৮১]

অবশ্যই, আমি নিজেকে কখনও ইসলামী বিশ্বে প্রচলিত কোন ফিকহী মাযহাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ করার চেষ্টা করিনি। কারণ সত্য কখনও একটি মাযহাবে অন্তর্ভূক্ত থাকে না। এছাড়া এসব মাযহাবের ঈমামগণ নিজেদেরকে কখনও নিষ্পাপ বলে দাবি করেননি। সত্যকে জানার ক্ষেত্রে তারা হলেন মুজতাহিদ গবেষক। যদি তারা ভুল করে থাকেন তাহলে তাদের জন্য একটি প্রতিদান, আর যদি তারা সঠিক হন তাহলে তাদের জন্য দু’টি প্রতিদান।

ঈমাম মালিক বলেছেন: “আল্লাহর নবী (সাঃ) ছাড়া বাকিদের সবার কথার কিছু গ্রহণ করা হবে আর কিছু বর্জন করা হবে।” আর ঈমাম শাফে’ঈ বলেছেন: “আমার মতটি সঠিক কিন্তু ভুল হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। আর অন্যের মতটি ভুল কিন্তু সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা রাখে।”

একজন মুসলিম স্কলারের জন্য এটি সমীচীন নয় যে, তার কাছে তুলনা ও প্রাধান্য দেয়ার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তিনি কেবল একটি মাযহাবে আটকে থাকবেন। বরং তার কর্তব্য হলো নিজেকে দলীল ও নির্ভরযোগ্য সূত্রের সাথে সংযুক্ত রাখা। কারণ তার দলীল বা প্রমাণ শক্তিশালী হলে, তার সূত্রও শক্তিশালী হবে। আর তার দলীল দূর্বল হলে, তার সূত্রও দূর্বল হবে। বেশ আগে ঈমাম মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছিলেন: “মানুষ দেখে তুমি সত্য চিনতে যেয়ো না। বরং সত্যকে চেনো। এতে করে তুমি আপনাতেই সত্যের ধারকদের চিনতে পারবে।”

তথ্যসূত্র: আল-হালাল ওয়া আল-হারাম ফীল ইসলাম, ড. ইউসুফ আল-কারাদাওয়ী, পৃষ্ঠাঃ ১০, ১২।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *