তাওহীদ, তাকদীর ও ইচ্ছার স্বাধীনতা

আামাদের সবারই তাকদীরের বিষয়ে মনে কম বেশি প্রশ্ন এসে থাকে। তাকদীরের উপর ঈমান আনা ঈমানের একটি অংশ বিধায় এই বিষয়ে পুরোপুরি স্বচ্ছ ধারণা না থাকায় কোনো প্রশ্ন মনে আসা স্বত্ত্বেও আমরা বিষয়টি নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করতে লজ্জাবোধ করি। আমরা মনে করি যদি তাকদীরের ব্যাপারে আমাদের  মনের সংশয় যদি প্রকাশ পায় তাহলে আমাদের নিজেদের ঈমানের দুর্বলতা প্রকাশ পায়। এতে আশংকা করা হতে পারে, আমরা ঈমান হারা হিসেবে অন্যের সামনে পরিচিত হবো। যার ফলে এই বিষয়ে প্রশ্ন থাকলেও আমরা সেসব বলতে নারাজ। আসলে বিষয়টি এই রকম নয়।

কোনো বিষয়ে প্রশ্ন থাকলে তা পুরো বিষয়টিকে নাকচ করে দেয় না। মনে প্রশ্ন বা সংশয় আসলে আমারা যে ঈমানহারা হয়ে পরবো, বিষয়টি এরকম নয়। এই ধরনের প্রশ্ন, জানার ইচ্ছা নবী-রাসূলদের মাঝেও ছিল। হযরত উযায়ের (আ.) একজন নবী ছিলেন। অথচ আল্লাহর সৃষ্টি-ক্ষমতা সম্পর্কে তাঁর মধ্যে কৌতুহলসুলভ প্রশ্ন ছিলো। পবিত্র কোরআনে এ ব্যাপারে বলা হয়েছে:

তুমি কি সে লোককে দেখনি যে এমন এক জনপদ দিয়ে যাচ্ছিল যার বাড়ীঘরগুলো ভেঙ্গে ছাদের উপর পড়ে ছিল? বলল, কেমন করে আল্লাহ মরনের পর একে জীবিত করবেন? অতঃপর আল্লাহ তাকে মৃত অবস্থায় রাখলেন একশ বছর। তারপর তাকে উঠালেন। বললেন, কত কাল এভাবে ছিলে? বলল আমি ছিলাম, একদিন কংবা একদিনের কিছু কম সময়। বললেন, তা নয়; বরং তুমি তো একশ বছর ছিলে। এবার চেয়ে দেখ নিজের খাবার ও পানীয়ের দিকে-সেগুলো পচে যায় নি এবং দেখ নিজের গাধাটির দিকে। আর আমি তোমাকে মানুষের জন্য দৃষ্টান্ত বানাতে চেয়েছি। আর হাড়গুলোর দিকে চেয়ে দেখ যে, আমি এগুলোকে কেমন করে জুড়ে দেই এবং সেগুলোর উপর মাংসের আবরণ পরিয়ে দেই। অতঃপর যখন তার উপর এ অবস্থা প্রকাশিত হল, তখন বলে উঠল-আমি জানি, নিঃসন্দেহে আল্লাহ সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাশীল।

(সূরা বাকারা: ২৫৯)

যেমন উদাহরণ স্বরূপ ইব্রাহিম (আ) এর ঘটনাকেও আমরা বলতে পারি। তার মনে একদিন জানার ইচ্ছা হলো যে আল্লাহ কিভাবে সবকিছু আবার দ্বিতীয়বারের মতো সৃষ্টি করবেন?  এই ঘটনাটি পবিত্র কোরআনের সূরা বাকারার ২৬০ নং আয়াতে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে: ‌

আর স্মরণ কর, যখন ইব্রাহীম বলল, হে আমার পালনকর্তা আমাকে দেখাও, কেমন করে তুমি মৃতকে জীবিত করবে। বললেন; তুমি কি বিশ্বাস কর না? বলল, অবশ্যই বিশ্বাস করি, কিন্তু দেখতে এজন্যে চাইছি যাতে অন্তরে প্রশান্তি লাভ করতে পারি। বললেন, তাহলে চারটি পাখী ধরে নাও। পরে সেগুলোকে নিজের পোষ মানিয়ে নাও, অতঃপর সেগুলোর দেহের একেকটি অংশ বিভিন্ন পাহাড়ের উপর রেখে দাও। তারপর সেগুলোকে ডাক; তোমার নিকট দৌড়ে চলে আসবে। আর জেনে রাখো, নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী, অতি জ্ঞান সম্পন্ন।

এই ঘটনাটি উল্লেখ করার একটিই উদ্দেশ্য তা হলো, আমাদের মনে থাকা প্রশ্নমাত্রই আমাদের ঈমানের দুর্বলতা প্রকাশ করে না। বরং তাকে জানার নতুন সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করা উচিত। যা হোক তাকদীরের বিষয়টি নিয়ে অনেক প্রশ্ন ও অস্পষ্ট ধারণা থাকায় আমাদের অনেকেরই এ বিষয়ে পুরোপুরি কোনো জ্ঞান নেই। আমরা কোনো সমাধানে আসতে পারব, এই লক্ষ্য নিয়ে প্রবন্ধটি লেখা।

ঈমানে মুফাসসালে বর্ণিত ঈমানের সাতটি মৌলিক বিষয় হলো:

امنت بالله وملئکته وکتبه ورسوله والیوم الاخر والقدر خیره وشره من الله تعالی والبعث بعد الموت

অর্থ: আমি ঈমান আনলাম (১) আল্লাহর প্রতি, (২) তাঁর ফিরিশতাগণের প্রতি, (৩) তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি, (৪) তাঁর নবী-রসূলগণের প্রতি, (৫) শেষ দিবসের প্রতি, (৬) তাক্বীদরের ভাল-মন্দের প্রতি যা আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে হয় ও (৭) পুনরুত্থানের প্রতি।

এই সাতটি বিষয়ের উপর বিশ্বাস আনা ঈমানের দাবি। কেউ কেউ ফেরেশতার উপর বিশ্বাসকে তুলনামূলকভাবে মৌলিক হিসাবে মনে করেন না। তার মানে এই নয় যে ফেরেশতা নেই। তাদের মতে ঈমান ছয়টি বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। তন্মধ্যে তাকদীর বিষয়টি তওহীদের উপর নির্ভরশীল। আল্লাহর উপর বিশ্বাস আনলে তাকদীরের উপর বিশ্বাস আনতে হবে। ফেরেশতাদের বিষয়টি উহ্য। অর্থাৎ এটি ততটা মৌলিক নয় যতটা তাওহীদ, রেসালাত ও আখিরাত বিষয়গুলো মৌলিক।

আল্লাহ মানুষের জন্য রাসূল পাঠিয়েছেন। আর বিধান হিসেবে কিতাব দিয়েছেন। আবার আখিরাত এর উপর বিশ্বাসের পরিণতি বা outcome হলো পুনরুত্থানের উপর বিশ্বাস।তাই পুনরুত্থানের দিবসের উপর বিশ্বাসের বিষয়টি আখিরাতের উপরে বিশ্বাসের পরিণতি বা এর উপর নির্ভরশীল। সুতরাং তাকদীর, কিতাব ও পুনরুত্থানের দিবসের উপর বিশ্বাসের বিষয়গুলো অপরাপর অধিকতর মৌলিক বিশ্বাসের পরিণতি স্বরূপ। বলা যায় Implied।

তাকদীরের উপর বিশ্বাস ছাড়া তাওহীদ হতে পারে না। কিন্তু অন্যান্য বিষয়ের উপর বিশ্বাস ছাড়া তাওহীদ হতে পারে। তার মানে হলো, কেউ রেসালত, আখিরাত ইত্যাদিতে বিশ্বাস না করেও একজন স্রষ্টায় বিশ্বাসী হতে পারে। যদিও একজন স্রষ্টা তথা তাওহীদের উপর বিশ্বাস না থাকলে রেসালত ও আখিরাতের মতো বিষয়গুলোতে বিশ্বাসী হওয়া সম্ভব নয়। মোট কথা, ঈমানের মৌলিক বিষয়গুলো হলো তাওহীদ, রেসালাত ও আখিরাত। এবং তাকদীর, কিতাব, ও পুনরুত্থান দিবসের উপর বিশ্বাস হলো এই মৌলিক বিশ্বাসত্রয়ের যৌক্তিক পরিণতি বা Logical implication।

তাওহীদ, রেসালাত ও আখিরাতের মাঝে সম্পর্ক

তাওহীদ, রেসালাত ও আখিরাতের মাঝে সম্পর্ক জানতে হলে প্রথমে “তাওহীদ” কি তা ভালোভাবে জানতে হবে। সামগ্রিকভাবে যদি আমরা ‘তাওহীদ’ এর বিষয়টি বুঝতে যাই তাহলে দুইভাবে ঈশ্বরকে ব্যাখ্যা করার সম্ভাব্যতাকে বুঝতে হবে:

১। দার্শনিক ঈশ্বর (Philosophical God) ও

২। ব্যক্তিগত ঈশ্বর (Personal God)

উল্লেখ্য, দার্শনিক ঈশ্বর মানে ঈশ্বর দর্শন চর্চা করেন এমন নয়। বরং যে ঈশ্বরে বিশ্বাস হলো তত্ত্ব বা সত্ত্বা সম্পর্কিত দার্শনিক আলোচনার যৌক্তিক পরিণতি মাত্র। জগত সৃষ্টির সূচনা করা ও জগতের অস্তিত্বের কারণ হিসাবে সামগ্রিকভাবে থাকা। অতএব, Philosophical God এর অনুসারে একজন ঈশ্বর আছেন যিনি Supreme Being। তিনি জগতকে সৃষ্টি করেছেন কিন্তু তার জগতের সাথে আর সম্পর্ক নেই। তিনি আছেন বা থাকতে পারেন – এই বিশ্বাস মূলত সংশয়ীদের মাঝে বিদ্যমান। এই দৃষ্টিতে তারা এই প্রকার তাওহীদে বিশ্বাসী

এই “philosophical God” এর সাথে আমাদের “Personal or Social God” এর ধারণার কোনো মিল নেই। কারণ, ঈশ্বর যদি জগতকে পরিচালিত না করেন তাহলে তিনি যে সর্বশক্তিমান বা Omnipotent তা প্রমাণ হবে না। personal God এর ধারণায় তাওহীদের ধারণার সাথে সাথে ফেরেশতাদের অস্তিত্বও বিশ্বাস করতে হবে। আবার রেসালাত বিশ্বাসের জন্যও তাওহীদের বিশ্বাস অপরিহার্য। কারণ যিনি জগত পরিচালনা করবেন তিনি একজন রাসূল পাঠিয়েছেন। সে রাসূল কোথায় থেকে এসেছেন, কে পাঠিয়েছেন তার মূল উৎস খুঁজতে গিয়ে আমরা তাওহীদের বিশ্বাসের দিকেই যাই।

আর এই রাসূলের guideline হিসেবে দেওয়া হয়েছে কিতাব। তাই কিতাব বিষয়টি রেসালাতের বিশ্বাসের অংশ এবং তাওহীদের বিশ্বাসের ও অংশ। তাকদীরের উপর বিশ্বাসও তাওহীদের উপর বিশ্বাসের অংশ। আমরা যদি মনে করি আল্লাহ সর্বশক্তিমান ও আমাদের কর্মকাণ্ডে আল্লাহর কোনো নিয়ন্ত্রন বা হস্তক্ষেপ নেই তাহলে তার সর্বশক্তিমান বা Omnipotent  নাম তথা গুণটিও আর কার্যকর থাকছে না। আমাদের কার্যাবলির প্রেক্ষিতে আল্লাহ যদি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করেন বা করতে না পারেন তাহলে তার Omnipotent বৈশিষ্ট্যটি ক্ষুন্ন হয়। এমতাবস্থায় তিনি সর্বশক্তিমান হন না।

তাই আমাদের কার্যাবলিতে তার নিয়ন্ত্রন থাকবে। এটাই স্বাভাবিক ও যুক্তিসংগত। আর এইটাই তাকদীরের ধারণা। তিনি আামাদের সৃষ্টি করেছেন, পরিচালিত করছেন, সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে। আমরা দুনিয়ার জীবন অতিবাহিত করব তারপর মৃত্যুবরণ করব আর সব শেষ হয়ে যাবে, তা নয়। সব কিছুর প্রতিদান দেওয়া হবে আর তার জন্য তৈরী করেছেন আখিরাত। পুনরুত্থান দিবসে বিচার হবে ন্যায়–অন্যায়ের। সুতরাং পুনরুত্থান দিবসটি আখিরাতের অংশ। তাহলে মূলবিষয় তাওহীদ, আখিরাত ও রেসালাত। তাওহীদ মানলে রেসালাত  মানতে হবে। রেসালাত মানলে আখিরাত মানতে হবে। কিন্তু মূল জিনিস  তাওহীদ। তাওহীদ ছাড়া রেসালাত, আখিরাত এসবের কোনো মানে হয় না।

সবকিছু আল্লাহর অধীনে নাকি মানুষের ইচ্ছার অধীনে?

আমাদের মনে একটা প্রশ্ন উঠতে পারে, আমাদের সব কিছুই আল্লাহ শুরু থেকে ঠিক করে রেখেছেন তাহলে আমরা কেন আমাদের কর্মফলের জন্য শাস্তি পাব?

১. আল্লাহ সর্বজ্ঞানী, তিনি সব  জানেন, তাহলে তিনি কি এটিও জানেন যে, আমি খারাপ কাজ করব এবং আমাকে শাস্তি দেওয়া হবে?

২. আমার নিয়ত বা অন্তরের Motivation–ও তো তিনিই পরিবর্তন করেন। তাহলে কেন আমাদের কর্মফলের জন্য আমাদেরকেই দায়ী করা হবে?

প্রথমত, আমরা যাকে ইলাহ বা God বলে স্বীকার করব তিনি কতটা Rational তা নিয়ে আলোচনা করা যাক। আমরা Rationally  অথবা Irrationally যেভাবেই ঈমান আনি না কেন একজন বিধর্মী অথবা সংশয়ীকে বুঝাতে হলে God বা Supreme Being কে rationally consistent বা যৌক্তিকভাবেই তুলে ধরতে হবে। প্রশ্ন হলো, আপনি কেন আল্লাহকে Absolute Being হিসেবে মানছেন বা মানবেন?

এমন একজন God যার মাঝে মানবিক দুর্বলতা বা মানুষের চাহিদাগুলো বিদ্যমান তিনি Absolute God হতে পারেন না। Supreme Being এমন একজন হবেন যিনি সবকিছুর উর্ধ্বে। তার মাঝে মানবীয় গুণাবলি বা চাহিদা থাকবে না। তিনি হবেন এমন যিনি সবকিছুর ব্যাপারে পারদর্শী। যিনি সবকিছু জানেন, পারেন ও করেন। আর এই সর্বশক্তিমান ও সর্বজ্ঞানী হওয়া, সব সদগুণাবলির আধার হওয়া একমাত্র আল্লাহর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

যদি আল্লাহ মানুষের ভবিষ্যত এবং তার কর্মফল সম্পর্কে না জানেন তাহলে তিনি সর্বজ্ঞানী হতেন না। তার ‘সর্বজ্ঞানী’ (Omniscience) হওয়ার গুণাবলি ক্ষুন্ন হত। তিনি Supreme Being হতেন না। তিনি যদি মানুষের তাকদীরের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করতেন তাহলে তার ‘Omnipotent’ গুণটি ও ক্ষুন্ন হত। আমাদের তাকদীরের ব্যাপারে তার Attribution করার ফলে আমাদের Freedom of choice এবং তার Omniscience হওয়া ও তার Attribution করার মাঝে দ্বন্দ্ব বেঁধে যায়। তা হলো, তিনি যদি সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন তাহলে আমাদের কি ইচ্ছা স্বাধীনতা নেই?

তাকদীরের ব্যাপারে কাদারিয়া, জাবারিয়া, মুতাজিলা ও আশারিয়া চিন্তাগোষ্ঠীর মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কাদারিয়ারা বলেন, “আল্লাহ কোনো কিছুই fixed করেন নি।”  জাবারিয়ারা বলেন, “আল্লাহ সব কিছু to the point এ fixed করেছেন।” আর মুতাজিলাদের মতে, “আল্লাহ সবকিছু Universally fix করেছেন। মানুষের ইচ্ছা স্বাধীনতা আছে। কিছু কিছু বিষয় আগে থেকেই fixed। Particularly fixed নয়”। আর আশারিয়রা সবকিছু মিলে সমন্বয় করার চেষ্টা করেছেন। তাদের মতে মানুষ তার ইচ্ছার ব্যাপারে স্বাধীন। যদিও কর্মটি আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতা বলেই সম্পন্ন করা হয়।

উপরের মতভেদ নিয়ে যদি আমরা চিন্তা করি, তাহলে আমরা নিজেদের মত করে একটি Solution এ পৌঁছাতে পারি। আল্লাহর ব্যাপারটি সম্পূর্ণ Unique।  আমাদের সাথে তাঁর বিষয়গুলো মিলবে না। আমাদের justice যেমন, তাঁর Justice তেমন নয়। তিনি Supreme, Incomparable। সুতরাং তাঁর ব্যাপারগুলো মানুষের perspective থেকে দেখলে চলবে না। তাঁকে তাঁর perspective থেকে দেখতে হবে। তাঁর গুণাবলি যে রকম Unique তেমনি তার কর্মকাণ্ডও সবকিছু থেকে আলাদা হবে। আমরা তাকে Last Authority হিসেবে মানি। তিনি যদি Final Authorityই হয়ে থাকেন তাহলে তিনি কেন আমাদের তাকদীরে, জীবনযাত্রায় , কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করবেন না? যেহেতু তার ব্যাপার ও মানুষের ব্যাপার সম্পূর্ণরূপে আলাদা, তাই তার প্রেক্ষাপট, দৃষ্টিভঙ্গিও ভিন্ন হবে এটাই স্বাভাবিক।

আমাদের তাকদীর আল্লাহর কাছে সুনিদির্ষ্ট থাকলেও আমাদের কাছে তা অনিশ্চিত। আমাদের perspective থেকে, দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমাদের ইচ্ছা স্বাধীনতা আছে। কিন্তু আল্লাহর দিক থেকে আমাদের সবকিছুই has to be fixed। এটিই যুক্তি-বুদ্ধির দাবী। না হলে তিনি সর্বশক্তিমান ও সর্বজ্ঞানী হন না। আমরা এটাকে এভাবে বলতে পারি–

১। আল্লাহর দিক থেকে জগত ও আমরা

২। জগত ও আমাদের দিক থেকে আল্লাহ

God to world = সবকিছু fixed

world to God = freedom of choice আছে।

ঈশ্বরের পক্ষ হতে আমাদের জন্য কী নির্ধারিত তা যেহেতু আগেভাগে আমরা জানি না বা জানতে পারি না, তাই আমাদের পক্ষ হতে ইচ্ছার স্বাধীনতা থাকার বিষয়টি অস্বীকার করাটা অযৌক্তিক। আমরা বাস্তবিকই (empirically) যা করতে চাই তার অনেক কিছুই করতে পারি। যেমন আমি এই যে লেখাটা লিখছি তা আমি লিখতে চাইছি বলেই লিখতে পারছি। আপনি যে এটি পড়ছেন সেজন্য আপনাকে বাধ্য করা হয় নাই। আপনি চাইলে এই ব্যাখ্যার সাথে একমত নাও হতে পারেন। এসবই আমাদের দিক থেকে ইচ্ছার স্বাধীনতা থাকার প্রমাণ।

অবশ্য, প্রথম ধরনের দৃষ্টিভঙ্গী (point of view) বা প্রেক্ষিত (context) অনুসারে সবকিছুই পূর্বনির্ধারিত বা Fixed। দ্বিতীয় ধরনের দৃষ্টিভঙ্গী বা প্রেক্ষিত হলো যাকে আমরা from World to God হিসাবে বলেছি। আমরা জানি, আল্লাহ কিছু সার্বিক নিয়মানুসারে (universal laws) জগতকে পরিচালনা করেন। এসবের অধীনে থেকে একটা নির্দিষ্ট মাত্রার ভিতরে আমরা স্বাধীন। বলাবাহুল্য, স্বাধীনতা মানেই কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্বাধীন। কোনো প্রকারের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা না থাকা অর্থাৎ পূর্ণ স্বাধীনতা শুধুমাত্র ঈশ্বর ছাড়া কারো থাকতে পারে না। ঈশ্বর ছাড়া সবাই যার যার মতো করে নিয়মের অধীন।

অতএব, freedom of Choice বিষয়টি দুইটি stageএ চিন্তা করতে হবে। Allahএর দিক থেকে world। ইসলামের point Of view থেকে, Allah ছাড়া কোনো কিছুরই কোনো স্বাধীন ও স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই, থাকতে পারে না। শুধুমাত্র Allah-ই আছেন। কোনো জগতেরই যেহেতু অস্তিত্ব নেই সেক্ষেত্রে কোন কিছু fixed বা unfixed এর প্রশ্ন আসে না। তবে তিনি বলেছেন সবকিছু পূর্ব থেকেই নির্ধারণ করা আছে। তাই আমরা fixed ধরে নিলাম। দ্বিতীয় stage এ from world to God এর দিক থেকে Allah আমাদের ইচ্ছার স্বাধীনতা দিয়েছেন। তাই আমাদের ইচ্ছার স্বাধীনতা আছে। Allah আমাদের Hypnotize করেন নি। আমরা যা করছি আমাদের ইচ্ছা স্বাধীনতা থাকার কারণেই করছি। কারো বলপ্রয়োগ বা কারো দ্বারা প্রভাবিত হয়ে করছি না। সুতরাং এক সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের অধীনে থাকা সত্বেও আমাদের position থেকে আমাদের Freedom of Choice আছে।

গঠন, সত্ত্বা, জ্ঞান ও ক্ষমতাসহ আমাদের সব কিছু থেকে মহান আল্লাহ সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকারের। তিনি অভাবনীয় ও অকল্পনীয়। আমাদের জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেচনা ও ক্ষমতার সাথে তার তুলনা চলে না। তিনি Supreme, Incomparable, perfect, complete। অথচ আমরা হলাম incomplete, imperfect। আমাদের ন্যায়বিচার ও জ্ঞান হলো তুল্য বিবেচনা প্রসূত। অর্থাৎ আমরা compare করেই ন্যায় ও সত্য সম্পর্কে জানতে পারি। অথচ আল্লাহর জ্ঞান ও ন্যায়বোধ কোনো কিছুর সাপেক্ষে নির্মিত নয়। তা end in itself হিসাবে স্বয়ং স্বয়ম্ভূ।

আমাদের limitation আছে। সুতরাং আমাদের ও তাঁর perspective আলাদা। তাঁর perspective থেকে সবকিছু Fixed। আমাদের perspective থেকে বিশেষ করে আমাদের ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনের নৈতিকতা সম্পর্কিত সবকিছু Unfixed। সুতরাং আমরা বলতে পারি তাকদীরের ব্যাপারে সব কিছু fixed ও পাশাপাশি আমাদের ইচ্ছা স্বাধীনতাও আছে তবে প্রেক্ষাপট ভিন্ন।

সর্বোপরি, আমরা যেহেতু দাস, আল্লাহ যেহেতু মালিক, সেহেতু দাসের ব্যাপারে মালিক যা বলবেন তাই হবে চূড়ান্ত। নতুবা, দাস ও মালিকের সম্পর্ক অক্ষুন্ন থাকে না। দাসের নৈতিক অবস্থান হলো মালিকের সব কিছুকে শেষ কথা ও সর্বদা সঠিক হিসাবে মনে করা। এই মালিক-দাস সম্পর্ক মানুষ মালিক বনাম মানুষ দাসের উদাহরণ দিয়ে সঠিকভাবে বুঝানো যাবে না। কেননা, এ ক্ষেত্রে উভয়েই মূলত মানুষ শ্রেণীভুক্ত। একই শ্রেণীর। একই ক্যাটাগরির। অথচ, আল্লাহ এবং জগতের সবকিছুর মধ্যকার সম্পর্ক, ইসলামের দৃষ্টিতে কোনোভাবেই সমতুল্য নয়। আল্লাহর মহান সত্ত্বার এই অনন্যতাকে আমরা সঠিকভাবে জানতে বা একে আমাদের সীমিত অভিজ্ঞতাভিত্তিক ও খণ্ডিত ন্যায়বোধ দিয়ে চ্যালেঞ্জ করতে পারি না। তাই, আমাদের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও ন্যায়বোধের দাবী হলো আল্লাহর মহান সত্ত্বাকে কোনো তুল্যবিবেচনা করা ছাড়াই Only Supreme হিসাবে মেনে নেয়া।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *