কেন আমি সর্বদা একজন মা ও গৃহিনী হতে চেয়েছি?

[এটি মাদিয়াহ রানা’র একটি ফেসবুক পোস্টের অনুবাদ।]

আমি সর্বদা একটি চিন্তা ও স্বপ্ন লালন করতাম, আর তা হলো— একজন মা হওয়ার। আমার বয়স যখন ১৬ বছর, তখন কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করতো— আমি কী কাজ করার কল্পনা করি ও স্বপ্ন দেখি? তখনই আমার মাথায় প্রথম যে চিন্তাটি আসতো তা হলো একজন গৃহকর্ত্রী (Homemaker) হওয়ার। এটা এমন ছিল যে যার জন্য আমি নিয়মিত দোয়া করতাম এবং এই অনুভূতি সত্যিই ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। এটি শুধু তারাই বুঝবে যারাই এরকম স্বপ্ন লালন করে।

এই স্বপ্নের কথা সর্বদা বিশেষত বান্ধবীদের বলতাম যাদের প্রত্যেকের স্বপ্ন ছিল ক্যারিয়ার ও পড়ালেখা এবং ভ্রমণ সংক্রান্ত। যদিও পড়ালেখা করতে আমারও ভালো লাগতো, বিশেষভাবে ‘সাইকোলজি ও ইসলাম’ নিয়ে। তথাপি ইন্টারেস্টিং তথ্য হচ্ছে— ১৭ বছর বয়সেই আমার প্রথম বই প্রকাশিত হয়। তবুও আমি সর্বদা অনুভব করতাম— আমার একটি মহৎ উদ্দেশ্য রয়েছে। আর তা হলো, আল্লাহর দ্বীন পরিপূর্ণভাবে পালন করা।

সত্যি বলতে কি, বর্তমানে মায়ের ভূমিকাকে ক্রমশ খাটো করে দেখানো হচ্ছে। আমি মনে করি, অনেক মুসলিম মহিলাকে এ ভূমিকায় আনতে জোর করানো হচ্ছে। তাদের বলা হচ্ছে, হয় তারা মা হবে অথবা অন্য কিছু হবে। ‘একজন গৃহকর্ত্রী হওয়া বা না হওয়া’ এরকম টপিক পছন্দের ক্ষেত্রে মেয়েরা এখন এতে প্রায়ই বিনোদনের মতো মজা খুঁজে।

বাস্তবতা হচ্ছে, মাতৃত্বের সুন্দরতম দিকগুলো হাইলাইট করা হয় না। বাস্তবে অনেক মহিলা মনে করে, বাড়িতে অবস্থান করার মানে হচ্ছে তাদের স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ হয়ে যাওয়া। কিন্তু আমি এরকম লাইফস্টাইল পছন্দ করি। কারণ, যেখানে আমার চোখে আমিই ঘরের রাণী। বাচ্চাদের বড় করা, শিক্ষিত করা, প্রতিপালন করা, খাবার রান্না করা, ঘরের ক্ষুধার্ত পেটগুলিতে খাবারের যোগান দেওয়া, বাচ্চাদের সাথে খেলা করা, গৃহস্থালি কোনো কাজে দক্ষ হওয়া এবং নিষ্পাপ বাচ্চার চোখে পৃথিবী দেখা— এসব কর্মকাণ্ড করতে যতই কঠিন হোক না কেন, এ সকল কাজ আমি করতে চাই এবং এসব কাজেই আমি নিজেকে খুঁজে পাব। এসবের জন্য আমাকে জোরজবরদস্তি করার কোনো দরকার নেই।

আমি এসব করতে পছন্দ করি কারণ আমি উপলব্ধি করেছি, এতে পরবর্তী জেনারেশনের নেতা গড়ে তোলার মতো প্রয়োজনীয় অথচ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। আর তা খুবই ভিন্ন একটি বিষয়, অন্তত যেভাবে আমরা বেড়ে উঠেছি তার থেকে। আমি বুঝি, এর অনেক প্রতিদান রয়েছে। এই সুন্দর অংশটি সত্যিই পরিশ্রমসাধ্য ও চ্যালেঞ্জিং। এটি অধিকতর গুরুত্বের দাবি রাখে। আমি আরও বুঝি, এই কাজটি সম্ভব করে তুলতে আমাকে অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়ের সাথে আমার পড়ালেখা, শিক্ষা ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগাতে হবে।

আমারা যারা গৃহকর্ত্রী তাদের উচিত এই অবস্থানে সীমাবদ্ধতা অনুভব না করা। এইজন্য আগে সীমাবদ্ধতার যে গল্পগুলো সমাজে প্রচলিত রয়েছে তা পরিবর্তন করা উচিত।

মাতৃত্বের জন্যই গৃহকর্ত্রীর গুরুত্ব দিতে হবে। একজন গৃহকর্ত্রী হওয়ার মজাদার ও এর পরিপূরক অংশগুলো নিয়ে কথা বলতে হবে। ঐসব মেয়েদের নিয়ে কথা না বলা, যারা পরিবারে ইনস্ট্যান্ট ভূমিকা রেখে ইনস্ট্যান্ট প্রতিদান চায়, একে সেকেলে মনে করে ও ভাবে— ঘরের কাজ করে সে তার অধিকার হারাচ্ছে ও ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। তাই যারা গৃহকর্ত্রী, তাদের সাপোর্ট করুন।

হয়তো আমার ভুল হতে পারে। কিন্তু আমি জানি, আপনার বাচ্চাদের ভালোবাসা, যত্ন নেওয়া, শিক্ষা দেওয়া, সৎপথে পরিচালিত করার মাধ্যমে আপনার পরবর্তী জেনারেশনকে গড়াটা খুব প্রয়োজনীয়। আর এসব একজন নারীকে পরিপূর্ণ অধিকার দিতে সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখে। ঘরের একজন রাণী হয়ে সে ভবিষ্যতের জন্য এমন বীজ বপন করবে যা থেকে সম্ভবত পরবর্তী নেতা, পরবর্তী লেখক ও পরবর্তী সর্বোচ্চ উদ্যোক্তা অথবা আলেম বের হয়ে আসবে।

না, এটি এত সহজ নয়। তবে হ্যাঁ, এটি অনেক মূল্যবান।

নিচে একটি কবিতা দিলাম, যা আমি ১৬ বছর বয়সে লিখেছিলাম।

যে মাতৃত্বের স্বপ্ন বুনি সুদীর্ঘকাল ধরে

ঐ দিনগুলির স্বপ্ন দেখি, যখন আমি আমার আদরের বাচ্চাকে জড়িয়ে ধরে আছি,
[স্বপ্নের কথা জেনে] লোকে হয়ত আমাকে রক্ষণশীল অথবা সেকেলে বলবে,
হয়ত এমনকি বলবে ‘আমি অবুঝ, আমার বয়স খুব কম’।

অথচ যখনি আমি শিখছি ও বেড়ে উঠছি,
তখনি আমার উপলব্ধি এসেছে যে বাচ্চা হলো রোপণ করা বীজের মতো,
যেখানে দিতে হবে অনেক ভালোবাসা, আন্তরিকতা এবং তাকে বিকশিত করা হবে দ্বীনের মধ্য দিয়ে।
আর করতে হবে প্রতিপালন এবং খাওয়াতে হবে ২ বছর বুকের দুধ।
দুধের বিধান তার স্রষ্টার অনুমতিতে
এতে যদি আন্তরিক উৎসাহ থাকে,
তাহলেই প্রভু তা কবুল করবেন।

পৃথিবীতে মায়ের কাজের মতো এত যথাযথ আর কোনো কাজ নেই।
এমন কোনো কাজ নেই যার প্রতিদান এত উচ্চমূল্যসম্পন্ন,
তাই তোমার বাচ্চার জন্য নিদ্রাহীন রাত ও ক্লান্তির দিন কাটিয়ে দাও,
তখনি তোমার বাচ্চা অন্যদের চেয়ে উত্তমরূপে বেড়ে উঠবে।

এটা জেনে রাখো, তোমার নিকট মূল্যবান একটি উপহার গচ্ছিত রাখা হয়েছে,
যে সত্তাকে তুমি দীর্ঘ নয় মাস ধারণ করবে,
অতঃপর তোমার কাঁধে তাকে শায়িত রাখবে, অতঃপর গান ধরবে—
প্রশংসা তার যিনি আমার বাচ্চাকে একটি গঠন দিয়েছেন,
তাকে অতিক্ষুদ্রাকায় ভ্রূণ থেকে মানুষে রুপান্তর করেছেন।

আমাদের আশা— সে চক্ষু শীতলকারী হবে।
বিশ্বের সবার নিকটেও সে তা-ই গণ্য হবে।

কারণ, আমি এমন মা হওয়ার দীর্ঘ প্রত্যাশা করি যারা আমার কাছে মা হিসেবে হিরো ছিলো,
আমার মা, মাম্মা, উম্মি এসব শব্দে তাদের প্রতি সঠিক মূল্যায়ন করা যাবে না।

উম্মে সুলাইম, যিনি আনাস ইবনে মালেকের মা,
তিনি আনাসকে কোনো কষ্ট ছাড়াই বড় করেন,
তিনি তাকে রাসূলের (সা.) তদারকিতে বেড়ে উঠান,
তাঁর উপর আল্লাহর রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক।

তাইমিয়্যাহ— যিনি ত্বকীউদ্দীনের মা,
যার প্রবল আকাঙ্খা ছিল বাচ্চাকে মুসলিমদের পরবর্তী নেতা, স্কলার হিসেবে গড়তে,
তার এই চূড়ান্ত লক্ষ্যের উপর আল্লাহ খুশি ছিলেন,
তিনি এমন বংশধর রেখে গেলেন যার দ্বারা তার রুহ কল্যাণমণ্ডিত হয়েছিল।

আমি এমন মা হওয়ার মহৎ প্রত্যাশা করি, যিনি মাতৃত্বের গুণে গুণাণ্বিত,
যার আকাঙ্খা থাকবে বাচ্চাকে পরবর্তী নেতা হিসেবে গড়ে তোলার, ও
পরবর্তী কোরআন বহনকারী,
যাতে করে মা-ছেলে একসাথে জান্নাতে হাতে হাত ধরে হাঁটতে পারি।

তাদের প্রতি, যারা আমাকে সেকেল বলে,
এখন তাদের জন্য আমার চিন্তা বলবো,
বাচ্চাকে গড়ে তুলুন বিশেষ অধিকার দিয়ে, দয়া দিয়ে, যা সম্পর্কে অনেকে অসচেতন।

তাই তোমার এই উপহারের সর্বাধিক ভালোবাসা ও যত্ন দিয়ে লালন-পালন করো,
ধাপে ধাপে তাকে পরিচালিত করো,
তার জন্য রাস্তা তৈরি করে দাও
যে রাস্তা সুখের ও শেষ অনন্তের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *