ইসলামে গণতন্ত্র কি বৈধ?

মূল: জাসের আওদা

প্রশ্ন করা হয়েছে, ইসলামে গণতন্ত্র বৈধ কিনা? ইসলামে রয়েছে আদালত (জাস্টিস) ও শুরা (পরামর্শ) ব্যবস্থা। জাস্টিস হলো সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সেন্স থেকে সুবিচার। এটা ইসলামের একটা শিক্ষা। শুরা হলো পরামর্শ করা। জনগণের সাথে তাদের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পরামর্শ করতে হবে এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থায় স্বচ্ছ রাজনীতি ও সুবিচার ইত্যাদি নিশ্চিত করতে হবে। শাসককে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে হবে, জনগণের সর্বোচ্চ স্বার্ধের অনুকূলে কাজ করতে হবে এবং রাষ্ট্র তার জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।

সুতরাং মূল্যবোধের দিক থেকে গণতন্ত্র ইসলামে বৈধ, কিন্তু অপরিহার্যভাবে এর সুনির্দিষ্ট বর্তমান কাঠামোর দিক থেকে নয়।

তবে, বিদ্যমান ব্যবস্থাসমূহের মাঝে গণতন্ত্রই সবচেয়ে ভালো রাজনৈতিক ব্যবস্থা। সেজন্য ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে গণতন্ত্র একটা ভালো ব্যবস্থা, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ব্যবস্থা নয়। এটা এ জন্য ভালো- কারণ, স্বৈরাচার ও একদলীয় শাসনের তুলনায় আমাদের কাছে এর থেকে ভালো কোনো অল্টারন্যাটিভ হাতে নেই। ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে বিদ্যমান ব্যবস্থাসমূহের মধ্যে গণতন্ত্রই অধিক সঙ্গতিশীল।

এটা আমাদের ইসলামের ইতিহাসে একটি বড়ো সমস্যার সমাধান করছে, তা হলো ক্ষমতার অটোম্যাশন। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে দুটো বড়ো দলের যুদ্ধের চেয়ে ইসলামের প্রথম দিককার নির্বাচন পদ্ধতি ভালো ছিল, তারা কেবল ভোট দিত এবং জীবন স্বাভাবিক ছন্দে চলত। কিন্তু আমরা তা করিনি। আমরা বড়ো যুদ্ধে জড়িয়েছিলাম এবং আমরা অনেক সাহাবায়ে কেরাম রা. কে হারিয়েছি। তারপর আবির্ভূত হয়েছে অত্যাচারী রাজতন্ত্র এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী অব্যাহত আছে। উমাইয়া শাসকদের মধে ন্যায়পরাপয়ণ শাসক খুব কমই ছিলেন।

আর ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে গণতন্ত্র ইতিহাসের শেষ কথা নয়। কিছু আমেরিকান ও পশ্চিমা মনে করে একবার যদি আপনি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রাজনীতি শুরু করেন, তবে আপনি ইতিহাসের যবনিকায় উপনীত হয়েছেন। না, বাস্তবতা এমন নয়; উত্থান পতনকে সঙ্গে নিয়ে অভিযাত্রা অনিশেষ।

কারণ, কোনো মানবিক ব্যবস্থাই চূড়ান্ত ব্যবস্থা নয়। তাই আপনি গণতন্ত্রের সমালোচনা দেখবেন, ভুল খুঁজে পাবেন, এমনকি এ সমালোচনা পশ্চিমা রাজনৈতিক দর্শনেও দেখতে পাবেন; তারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সংশোধন ও উন্নতি করার লক্ষ্যে সমালোচনা করছে।

এই সেন্স থেকে মুসলিমরাও এই ফিল্ডে অবদান রাখতে পারে। ইসলামি মূল্যবোধ ও ইসলামি নৈতিকতা সম্পর্কে পারদর্শীতা অর্জন করে আমরাও গণতন্ত্রের সংশোধনীর জন্য প্রস্তাবনা পেশ করতে পারি এবং নতুন চিন্তা যোগ করতে পারি। এই আশা জাগ্রত হয়েছিল আরব বসন্তের মাধ্যমে। কিন্তু আরব বসন্ত এখন কোমায় চলে গেছে। আমরা জানি না, এটা আর জাগবে কী জাগবে না। আবর বসন্ত আমাদের ধারণাতীত চ্যালেঞ্জের সম্মূখীন হয়েছে।

আমরা ভেবেছি আমরা স্বৈরশাসকদের উচ্ছেদ করেছি, আমরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারব এবং নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে আধুনকি রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দানা বেধেঁছিল : তিউনিশিয়ার সংবিধান, মিশর ও ইয়েমেনের সংবিধান, এমনকি সিরিয়ায়ও একটা সময় প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল।

অন্যান্য আরব কান্ট্রির ক্ষমতাসীন এলিটরা মরক্কো ও অন্যান্য দেশে চাপ প্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকতে চেয়েছিল। সুতরাং তারা সংস্কার শুরু করেছিল এবং ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখছিল।

সুতরাং আমরা গণতন্ত্রের থেকে ভালো কিছু বিনির্মাণের প্রত্যাশা করেছিলাম।

আর সিরিয়া ও মিশরে সংঘঠিত বেদনাদায়ক ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে আমরা উপলব্ধি করছি যে, আমরা কেবল স্বৈরাচারী দ্বারাই শাসিত হচ্ছি না, আমরা মাফিয়া চক্রের দ্বারা শাসিত হচ্ছি, যারা রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টরে বসে আছে।

সুতরাং রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তন করতে না পারা পর্যন্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থা পরিবর্তন করা সত্যি অনেক কঠিন। আর চলে আসা রাজনৈতিক সংস্কৃতি হলো স্বৈরাচারের সংস্কৃতি।

কেবল মুবারক, আসাদ ও তার মিত্ররা নয়, প্রত্যেক ট্রাফিক কন্ট্রোলারও তার ওয়েতে একজন স্বৈরাচারী। পরিবর্তন শুরু করতে হবে তৃণমূল থেকে। তাই আরব বসেন্তর পর আমার লেখাগুলোতে আমি বিনীতভাবে বলেছি, আরব বিশ্বের কালচার, মাইন্ডসেট ও অ্যাটিচিউড পরিবর্তন করা ছাড়া কোনো সত্যিকার রাজনৈতিক পরিবর্তন সম্ভব নয়।

আরব সংস্কৃতির অনেক গণতান্ত্রিকরণ প্রয়োজন। এই সংস্কৃতির উন্নয়নের জন্য অনেক কাজ করা দরকার, যাতে করে যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি হয়। রাসূল সা. বলেছেন, “জনগণ যেমন, শাসকও তেমন।”

যদি আপনারা নেতৃবৃন্দকে পরিবর্তন করতে চান, তবে আগে নিজেদের পরিবর্তন করুন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “নিশ্চয় আল্লাহ ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজের অবস্থা পরিবর্তন করে।” (সূরা আর রাদ :১১)

যদি আপনি আপনার বিষয়াবলি পরিবর্তন করতে চান, তবে আপনি নিজেকে পরিবর্তন করুন। আর প্রত্যেক দার্শনিক উপদেশ দিয়েছেন : “যে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন তুমি দেখতে চাও, তা আগে নিজের মধ্যে সমাবেশ করো।”

ইন শর্ট, আশা করি আরব বসন্ত কোমা থেকে জাগ্রত হবে এবং গণতন্ত্রের চেয়ে ভালো কোনো ব্যবস্থা প্রবর্তিত হবে, যদিও আজতক গণতন্ত্রও সুদূরপরাহত।

(মুইজ অ্যাকাডেমির দি অকেশনাল পেপারস সিরিজ থেকে অনুবাদ করেছি)

* জাসের আওদা ইসলামি আইন ও মাকাসিদে শরিয়ার উপর বিশ্বের একজন প্রসিদ্ধ স্কলার। পড়াশোনা করেছেন আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডার ওয়াটারলু ইউনিভার্সিটি ও যুক্তরাজ্যের ওয়েলস ইউনিভার্সিটি থেকে। অধ্যাপনা করেছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর লিখিত বইসমূহ বিশ্বের ২৫টিরও অধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তিনি মাকাসিদ ইন্সটিটিউট নামক একটি থিংকট্যাংকের বর্তমান প্রেসিডেন্ট।)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *