তাকদীর বা অদৃষ্টবাদের পক্ষে দার্শনিক যুক্তি: আলোচনার সারসংক্ষেপ

‌‘তাকদীর’ নিয়ে মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক স্যারের সাথে এক সন্ধ্যায় ঘরোয়া পরিবেশে আমরা একটা দীর্ঘ আলোচনা করেছিলাম বছর দুই আগে। তাকদীরের পক্ষে দার্শনিক যুক্তি আছে কিনা তাই তিনি তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। আমি এখানে আলোচনাটার সামারি করার চেষ্টা করেছি কয়েকটি পয়েন্টে:

১। আলোচনাটা ছিল মূলত তাকদীর বিশ্বাসকে নিয়ে। মানে একজন লোক আপাতদৃষ্টিতে আস্তিক হোক বা নাস্তিক হোক তার জন্য তাকদীর তথা ফিক্সেশন যে একটা অবশ্যম্ভাবী বিষয় সেটা প্রমাণ করা। আর সেটা করতে গিয়ে স্রষ্টা বা Transcendent তথা জগৎ অতিবর্তী কিছু আছে কিনা সেটা চলে এসেছে। এখন অতিবর্তী কিছু ছাড়া যে তাকদীর/লাক ডিস্ট্রিবিউশন ব্যাখা করা যায় না! কিন্তু লাক ডিস্ট্রিবিউশন ইজ অ্যা মাস্ট, সেটা আলোচনাতেই ভালো মতন বলা হয়েছে! তাহলে আমাদেরকে জগত অতিরিক্ত কোনো ধারণায় পৌঁছাতে হচ্ছে।

২। আমি, জগৎ ও জগৎ অতিবর্তী যে কোনো কিছু নিয়ে আমাদের আলোচনাটা শুরু হয় নিজেকে দিয়ে। আমার অস্তিত্ব নিয়ে। কিন্তু আমি আমার সত্তাগত (শারিরীক ও মানসিক) সীমাবদ্ধতার কারণে জগৎ অতিরিক্ত কিছু চিন্তা না করে নিজের অস্তিত্ব ও জগতের অস্তিত্বকে ব্যাখা করতে পারি না। তাই আমাকে আবার ঘুরে ফিরে জগতের বাইরে কিছুকে কল্পনা করতে হয়। এখন কেউ যদি বলে— ওহ, তুমি নিজের সীমাবদ্ধতার দোষ দিয়ে অহেতুক ঈশ্বরের ধারণা চাপিয়ে দিচ্ছ, আদতে ঈশ্বর বলতে কিছু নাই, তাহলে তো সে নিজেকেই অস্বীকার করার মতো ফ্যালাসির স্বীকার হলো। কারণ, এখানে তার নিজের সীমাবদ্ধতাই আসল কথা। সে চাইলেই তো নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না। তাই তাকে সুপার ন্যাচারাল কিছুকে মেনে নিতেই হয়।

৩। এখন ব্যক্তিসত্তা হিসেবে আমি যখন দেখছি, লাক ডিস্ট্রিবিউশন হচ্ছেই, আমি নিজেই সেটার প্রমাণ; তখন নৈতিকতার প্রশ্ন চলে আসে। সেটা হচ্ছে, লাক ডিস্ট্রিবিউশনের ক্ষেত্রে বৈষম্যের প্রশ্ন আসবে। কিন্তু এখানে আবার আমার সীমাবদ্ধতা চলে আসছে। আমি তো বৈষম্যহীন কোনো কিছু কল্পনা করতে পারি না। একটা ফ্ল্যাট ইউনিভার্স কল্পনা করতে পারি না। তাই আমি যেহেতু শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে সীমাবদ্ধ এবং আমি আমার জাগতিক অভিজ্ঞতার বাইরে কোনো কিছু কল্পনা করতে পারি না, তাই এখানে আমার সীমাবদ্ধতা আমার জন্য যে সীমাবদ্ধ ‌‘নৈতিকতা’ তৈরি করে তা দিয়ে অসীম তথা সুপার ন্যাচারাল কোনো কিছুর নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা অবান্তর। নিজের ক্যাটাগরিকে ছাড়িয়ে অসীমকে জাজ (judge) করতে যাওয়ার চেষ্টাই ক্যাটাগরি মিস্টেক। যা যৌক্তিকভাবেই অসম্ভব।

৪। এখানে আরেকটা মজার ব্যাপার ঘটে। ব্যক্তি যদি সুপার পাওয়ার হিসেবে ঈশ্বরের পরিবর্তে প্রকৃতিকে কল্পনা করতে চায়, তাহলে সে ‌‘এজেন্সি’র সংকটে পড়ে যায়। মানে, প্রথমত সে নিজের সীমাবদ্ধ নৈতিকতা দিয়ে লাক ডিস্ট্রিবিউশনের ক্ষেত্রে যে বৈষম্যের আওয়াজ তুলতে চায় সেটার জন্য তো কাউকে এই বৈষম্য সম্পাদনকারী হিসেবে দায়ী করতে হবে। এখন সেই এজেন্টই যদি না থাকে, তাহলে সে কাকে দায়ী করবে? ব্যক্তি তো তার জাগতিক অভিজ্ঞতা ও নৈতিকতা দ্বারা দেখতেই পাচ্ছে যে ‌‘বৈষম্য’ হচ্ছে! কিন্তু সে প্রকৃতিকে দায়ী করতে পারছে না। কারণ, জগতের অংশ হিসেবে ব্যক্তি নিজে যেমন নিজের লাক ডিস্ট্রিবিউশন করতে পারছে না, একইভাবে জগতের জন্য জগতেরই অংশ ‌‘প্রকৃতি’ জগতের লাক ডিস্ট্রিবিউশন করতে পারবে না। আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে, জগতের অংশ হিসেবে ব্যক্তি নিজেই প্রকৃতির অংশ! তাই ব্যক্তিকে জগতের মধ্যকার তথা প্রকৃতির মধ্যকার বিভিন্ন উপাদান/সত্তার লাক ব্যাখ্যা করার জন্য অবশ্যই জগতের বাইরের এবং জগতের চেয়ে শক্তিশালী কোনা কিছুর কাছে ফিরতে হচ্ছে।

আগ্রহীরা পুরো ভিডিও আলোচনাটি দেখতে পারেন এখান থেকে:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *