সমসাময়িক রাজনৈতিক ফিকাহর দিক-বিদিক: পর্ব-৩
গত দুই পর্বে সমসাময়িক রাজনৈতিক ফিকাহর যে অংশটি খেলাফতের পুনর্প্রবর্তনকে ঘিরে বিকশিত হয়েছে সে বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। চলতি পর্বে সমকালীন রাজনৈতিক ফিকাহর বিপ্লববাদী চিন্তাগোষ্ঠী বা মানব উদ্ভাবিত রাষ্ট্রব্যবস্থাকে চূড়ান্তভাবে অস্বীকারকারী চিন্তাগোষ্ঠীর তৎপরতা তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
সমকালীন ইতিহাসের একটি বিশেষ মুহূর্তে, এক বৈরি পরিবেশে এই চিন্তাগোষ্ঠীর বিকাশ ঘটেছিল। এদের রাজনৈতিক চিন্তা, রচনাবলি এবং এসব ঘিরে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক আন্দোলনগুলোর আলোচনার পাশাপাশি যে পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে এদের বিকাশ হয়েছিল, তা যদি আলোচনা না করা হয়, তবে পাঠকরা এ চিন্তাগোষ্ঠীর অনেক গভীরের বিভিন্ন বিষয় জানা থেকে বঞ্চিত হবেন। তাই আজকের আলোচনায় এ সংক্রান্ত আলোচনা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত পরিসরে তুলে ধরা হবে ।
২। বিপ্লববাদী রাজনৈতিক চিন্তাধারা:
এ ধারার রাজনৈতিক ফিকাহর মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, মানব উদ্ভাবিত বা মানবজাতির পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে অর্জিত রাজনৈতিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের পক্ষপাতি। মানব অভিজ্ঞতালব্ধ রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে তারা পরিপূর্ণ কুফরি ব্যবস্থা হিসেবেই মনে করেন। তাই যেকোনো পন্থায় এ ব্যবস্থার পরিবর্তন সাধন করে তদস্থলে ইসলামী ব্যবস্থার প্রবর্তনই এ চিন্তাগোষ্ঠীর মূল লক্ষ্য। যে মৌলিক বৈশিষ্ট্য এদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা কয়েছে তা হচ্ছে, রাজনীতির ক্ষেত্রে সার্বভৌমত্বের ধারণা। তাঁদের মতে, রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের মালিক একমাত্র আল্লাহ, মানুষের এ ক্ষেত্রে কোনো অধিকার নেই। আর এখান থেকেই জন্ম নেয় ধর্মরাষ্ট্রের ধারণা, ইসলামী জ্ঞানের ঐতিহ্যে যা الحاكمية الإلهية (ঐশী সার্বভৌমত্ব) নামে পরিচিত। যদিও এ সার্বভৌমত্বের ধারণার বিষয়ে লেখকভেদে পার্থক্য বিদ্যমান, এ ব্যাপারে যথাসময়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
সময়ের অন্যতম ইসলামী চিন্তাবিদ, মিশরীয় পণ্ডিত ড. মোহাম্মদ উমারা এ চিন্তাধারার অনুসারীদেরকেتيار الرفض الانقلابي (বর্জনবাদী বিপ্লবী চিন্তাগোষ্ঠী) নামে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর ভাষায়, এরাই হচ্ছে বর্তমানের বাস্তবতা, ইসলামী ঐতিহ্য এবং উম্মাহর সামাজিক ব্যবস্থার প্রত্যাখ্যানকারী; উম্মাহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সামাজিক এবং রাজনৈতিক অঙ্গসংগঠনের অধীনে কাজ করতে অস্বীকারকারী এবং উম্মাহর সকল প্রতিষ্ঠান তাদের দৃষ্টিতে জাহিলিয়্যাতের অংশ।
যে সামাজিক এবং রাজনৈতিক বাস্তবতায় এ চিন্তাধারার উৎপত্তি:
- উসমানী খেলাফত পতন পরবর্তী ইসলামী চিন্তা এবং ধর্মীয় ব্যবস্থার অবমাননা।
- ফ্রান্স, ব্রিটেনসহ অন্যন্য ইউরোপীয় দেশ কর্তৃক মুসলিম দেশসমূহে উপনিবেশ স্থাপন।
- মুসলিম দেশসমূহে নাস্তিক্যবাদী ও ধর্মবিরোধী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব।
- ইহুদী কর্তৃক বায়তুল মোকাদ্দাস দখল।
- মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর শরীয়া বাস্তবায়নে অস্বীকৃতি এবং তদস্থলে পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থার প্রতিস্থাপন।
- মুসলিম দেশসমূহে নানা রূপে স্বৈরাচারী শাসন এবং স্বৈরতন্ত্রের বিরোধীদের উপর সীমাহীন নির্যাতন, নিপীড়ন।
এ চিন্তাগোষ্ঠী যে সকল মৌলিক রচনা দ্বারা প্রভাবিত সেগুলো হচ্ছে-
- ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ)-এর রচনাসমূহ, তাঁর الفتاوي الكبرى (ফতওয়া কুবরি), বিশেষ করে তাতার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রদত্ত ফতওয়া।
- ইমাম শাওকানী (রহ)-এর [১১৭৩-১২৫০] রচনাসমূহ।
- হিজবুত তাহরীরের চিন্তা ও তাদের রচনাসমূহ।
- মাওলানা মওদূদী (রহ) এবং তাঁর রচনাসমূহ, বিশেষ করে তাঁর গ্রন্থ ‘ইসলামী রাষ্ট্র ও সংবিধান’।
- সাইয়্যেদ কুতুব শহীদ এবং তাঁর রচনাসমূহ, বিশেষ করে তাঁর বিশ্ববিখ্যাত রচনা معالم في الطريق (মা’লিম ফিত তারিক), বাংলায় এটি ‘ইসলামী সমাজ বিপ্লবের ধারা’ নামে অনুদিত হয়েছে।
এ ধারার রাজনৈতিক চিন্তার অনুসারীদের একটা অংশ পরবর্তীতে নানাবিধ সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সাথে জড়িয়ে পড়ে। সমসাময়িক তাকফিরি ফেরকার উৎপত্তিও এ ধারার চিন্তার উৎস থেকেই। যদিও এ ধারার ফিকাহর অধিকাংশ অনুসারীই এখনো শান্তিপূর্ণ বিপ্লবে বিশ্বাসী এবং নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই কাজ করে যাচ্ছে।
চলবে…