মসজিদে ‘পুরুষদের প্রবেশপথ’ বলে কি কিছু আছে?
যদি রাসূলের (সা) দেখিয়ে যাওয়া পথই আমাদের জন্য অনুসরণীয় হয়, তাহলে এই প্রশ্নের উত্তর হলো— না। মসজিদে ‘নারীদের স্বতন্ত্র প্রবেশপথ’ যুক্ত হয়েছে রাসূলের (সা) পরবর্তী সময়ে। তবে নারীদের জন্য নিষিদ্ধ করে শুধু পুরুষদের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রবেশপথ থাকার কোনো দৃষ্টান্ত রাসূলের (সা) সুন্নত কিংবা সাহাবীদের জীবন থেকে পাওয়া যায় না।
আগের অধ্যায়ে উল্লেখিত চিত্রে দেখা যায়, রাসূল (সা) মসজিদে নববীতে তিনটি প্রবেশপথ নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন, যেগুলো নারী-পুরুষ উভয়ে ব্যবহার করতো। সেগুলো হলো:
১। বাবে রহমত বা রহমতের দরজা। এটিকে বাবে আতিকা বা আতিকার দরজাও বলা হয়। এটি পশ্চিম দিকে অবস্থিত।
২। বাবে উসমান বা উসমানের দরজা। বর্তমানে এটি জিবরাইলের দরজা হিসেবে পরিচিত। রাসূল (সা) সাধারণত এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতেন। কারণ, এটি ছিলো পূর্ব দিকে, রাসূলের (সা) হুজরার কাছাকাছি।
৩। তৃতীয় দরজাটি ছিলো দক্ষিণ দিকে। মসজিদে নববী নির্মাণের সময় কেবলা ছিলো জেরুসালেমের দিকে, অর্থাৎ উত্তর দিকে। কিন্তু দ্বিতীয় হিজরীতে কাবার দিকে কেবলা পরিবর্তন করা হয়। তারপর দক্ষিণের দরজাটি বন্ধ করে উত্তর দিকে দরজা খোলা হয়।[1]
রাসূলের (সা) যুগে এবং প্রথম খলিফা আবু বকরের (রা) আমল পর্যন্ত মসজিদের সকল দরজা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য উন্মুক্ত ছিলো। তারপর দ্বিতীয় খলিফা ওমরের (রা) সময় মসজিদে মুসল্লী বেড়ে যাওয়ায় তিনি শুধু নারীদের জন্য একটি দরজা নির্দিষ্ট করে দেন। এবং সেই দরজা দিয়ে পুরুষদেরকে মসজিদে প্রবেশ করতে নিষেধ করে দেন।
সুনানে আবুদ দাউদে বর্ণিত হয়েছে, নাফে ইবনে ওমর (রা) বর্ণনা করেছেন:
“ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা) বলেছেন, ‘এই দরজাটি আমরা নারীদের জন্য ছেড়ে দিলে বোধহয় ভালো হবে।’ অন্য একটি বর্ণনায় নাফে (রা) বলেছেন, ‘ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা) নারীদের দরজা দিয়ে পুরুষদের প্রবেশে বাধা দিতেন।’[2]
এখানে খেয়াল করার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মসজিদের মূল প্রবেশপথ দিয়ে প্রবেশের ক্ষেত্রে নারীদের জন্য কোনো বাধা যেমন ছিলো না, তেমনি ‘পুরুষদের প্রবেশপথ’ বলেও কিছু ছিলো না।
নারীদের জন্য একটি নির্দিষ্ট দরজা নির্ধারণ করে দেওয়াটা ছিলো ওমরের (রা) ইজতিহাদী সিদ্ধান্ত। তখন এর বাস্তবতাও বিদ্যমান ছিলো। কিন্তু এটি ইসলামের অপরিহার্য নির্দেশ নয়। আমরা জানি, স্থান-কালের প্রেক্ষিতে এ ধরনের প্রায়োগিক বিষয়ে গৃহীত সিদ্ধান্ত পরিবর্তনযোগ্য।
বর্তমানে, বিশেষত মুসলিম সংখ্যালঘু দেশগুলোতে, মসজিদের প্রধান দরজাটি নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য খোলা রাখাটাই সবচেয়ে সঠিক কাজ। এর পাশাপাশি, নারীদের সুবিধার জন্য একটি বিশেষ দরজাও থাকতে পারে। কিন্তু নারীদেরকে কেবল সেই দরজাটি দিয়েই প্রবেশ করতে হবে— এমন নিয়ম থাকা উচিত নয়। বর্তমানের মসজিদগুলোর কাঠামো এখনই সংশোধন করা উচিত, যদিও ইতোমধ্যে অনেক সময় গড়িয়ে গেছে।
এখনকার মসজিদগুলোতে দেখা যায়, কোনো নারী তথাকথিত ‘পুরুষদের দরজা’ দিয়ে মসজিদে ঢুকতে চাইলে তাকে কঠোর ভাষায় ভর্ৎসনা করা হয়। প্রায় সবখানেই এমনটা দেখা যায়। এটি লজ্জাজনক ও অনৈসলামিক একটি আচরণ। দ্বীনি বোনদের সাথে এ ধরনের অভদ্র আচরণ করা ইসলামে একেবারেই নিষিদ্ধ। অথচ, দুর্ভাগ্যক্রমে বর্তমান সমাজে এমনটাই আমরা ঘটতে দেখছি।
বাস্তবতা হচ্ছে, সমস্যায় জর্জরিত মুসলিম সমাজের আরো একটি মারাত্মক সমস্যা হলো মসজিদের ভেতরে ও বাইরে মুসলিম নারীদের সাথে বাজে আচরণ করা। এ ধরনের আচরণের ফলে ইসলাম ও মুসলমানদের ব্যাপারে নতুন প্রজন্মের মুসলিম তরুণরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। তদুপরি, অমুসলিমদের নিকট ইসলামের সুমহান শিক্ষা ভুলভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে।
[মূল: জাসের আওদা, অনুবাদ: জোবায়ের আল মাহমুদ]
অন্যান্য পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রেফারেন্স ও নোট:
[1] দেখুন ইবনে সাদ রচিত তাবাকাতুল কুবরা, ৩/৬০৯, এবং ওয়াফা আল-ওয়াফা: বি আখবার দারুল মোস্তফা, ১/৭৫-২৪৯।
[2] সুনানে আবু দাউদ, ১/৩৪৮। এই হাদীসটিকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করেছেন ইবনে হাযম আল-মুহাল্লা গ্রন্থে, ৩/১৩১; এবং এবং ইবনে আব্দুল বার আত-তাহমীদ গ্রন্থে, ২৩/৩৯৭। এছাড়া ইমাম তাবারানী আল-আওসাত গ্রন্থে, ১০১৮; এবং ইমাম বুখারী তারীখুল আকবর গ্রন্থে, ১/৬০। ওমরের কর্তৃত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি উল্লেখ করেছেন যে ওমর বলেছেন, “তোমরা নারীদের দরজা দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করো না।”