সমসাময়িক রাজনৈতিক ফিকাহর দিক-বিদিক: পর্ব-১
যদিও রাজনৈতিক ফিকাহর (ইসলামী রাজনৈতিক ইজতিহাদের ফল, একে ইসলামী রাজনৈতিক চিন্তাও বলা যেতে পারে) ক্ষেত্রে একটা নবজাগরণ সৃষ্টি হয় ওসমানী খেলাফতের পতনের কিছু সময় আগ থেকেই, কিন্তু ১৯২৪ সালে কামাল আতাতুর্কের হাতে সর্বশেষ খলিফার পতনের পর থেকেই এ বিষয়ে গবেষণার নতুন গতি লাভ করে।
কামাল পাশা মৃতপ্রায় ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘোষণা করে তদস্থলে ইউরোপীয় ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থার গোড়াপত্তন ঘটান। এরপর থেকে মুসলিম দেশগুলোতে ধর্মনিরপেক্ষতা নামের এই নতুন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা স্থায়ী রূপ লাভ করতে শুরু করে।
আর তখন থেকে মুসলিম উম্মাহর ফকিহ এবং চিন্তাবিদগণ নতুন করে ভাবতে শুরু করেন- কিভাবে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা পুনরায় প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে, যা আল-কোরআন এবং সুন্নাহর মূলনীতি অনুসারে পরিচালিত হবে।
ধর্মনিরপেক্ষতার এই প্লাবনের মোকাবেলায় ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ছিল তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। তবে একইসাথে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক চিন্তার বিপরীতে ইসলামী চিন্তার প্রতিরূপই বা কি? মুসলিম রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও বুদ্ধিজীবীরা নতুন এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এ প্রস্তুতির অংশ হিসেবেই গড়ে উঠে নতুন নতুন বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক সংগঠন। আর এ সকল ব্যক্তি এবং সংগঠনের প্রচেষ্টার ফলে নতুন ধারার রাজনৈতিক ইজতিহাদ প্রকাশ পেতে শুরু করে।
পাঠকদের বলে রাখি, এ ধরনের ইজতিহাদ যেহেতু প্রয়োগ পদ্ধতির দিক থেকে কোরআন-সুন্নাহর মূলনীতিকে উৎস ধরে কাজ শুরু করেছিল, তাই আমরা একে ইসলামের রাজনৈতিক ফিকাহ বলতে পারি। আর এ ফিকাহ যেহেতু ইসলামে ছাবেত (অর্থাৎ স্থায়ী, যার কোনো পরিবর্তন ইসলামসম্মত নয় ) কোনো বিষয় নয়, বরং মোতাগাইয়েরাত (যে ব্যাপারে ইসলাম কিছু মূলনীতি দিয়েছে এবং সময় ও স্থান বিবেচনায় যা পরিবর্তনশীল, অর্থাৎ ইজতিহাদের আওতাভুক্ত) এর বিষয়, তাই সকলের ইজতিহাদের সাথে ব্যক্তি একমত না হওয়ার ব্যাপারে স্বাধীন।
আর এই সমসাময়িক রাজনৈতিক ফিকাহর নানা দিক-বিদিক নিয়েই আজকের এই রচনা। তবে বলে নেয়া ভাল এ আলোচনায় শুধু মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার বুদ্ধিবৃত্তিক প্রয়াসগুলিই পর্যায়ক্রমে আসবে। আমাদের ভারত উপমহাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতা অন্য কোনো এক প্রবন্ধে আলোচনা করা হবে, ইনশাল্লাহ।
সমসাময়িক ইসলামী রাজনৈতিক ফিকাহর চিন্তাগোষ্ঠির দল-উপদলগুলোকে (মাজাহেব, একবচনে মাজহাব) কয়েক ভাগে ভাগ করা যায়:
১. খেলাফতের পুনঃপ্রতিষ্ঠার পক্ষের এবং বিপক্ষের চিন্তাগোষ্ঠী
১.১: খেলাফত পুনর্প্রবর্তন বিরোধী:
উনিশ শতকের গোঁড়ার দিকে যাত্রা শুরু করা এ চিন্তাগোষ্ঠির বাস্তব সফলতা আসে মোস্তফা কামাল পাশার হাত ধরে।কামাল আতাতুর্ক খিলাফতের অবসান এবং ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থার প্রবর্তনের মাধ্যমে এ ধারার ষোলকলা পূর্ণ করেন।
খেলাফত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া, ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত আলিমদের মাঝে এ কাজের সূচনা করেন মিশরীয় পণ্ডিত আলী আব্দুর রাযেক (১৮৮৮-১৯৬৬), যিনি আল-আযহার থেকে পাশ করা একজন আলেম । ১৯০৮ সালে তিনি তার বই ‘ইসলাম এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার মূলনীতি’ প্রকাশের মাধ্যমে এ আহবান শুরু করেন।
১৯২৫ সালে এ বইয়ের সাথে তিনি আরও তিনটি অধ্যায় যোগ করেন । প্রথম অধ্যায়ে খিলাফত ও খিলাফতের ইসলামী স্বরূপ নিয়ে আলোচনা করেন।দ্বিতীয় অধ্যায়ে আলোচনা করেন, ইসলাম আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূলের (সা) মাধ্যমে মানবজাতির জন্য একটি ‘রিসালাহ’ ( বার্তা, ম্যাসেজ), যা কোনো রাষ্ট্রব্যবস্থা নয়। বরং ইসলাম একটি ধর্ম, রাষ্ট্রব্যবস্থা এর অন্তর্ভুক্ত বিষয় নয়।
অন্যভাবে বলা যায়, খিলাফত ইসলাম ধর্মের অন্তর্ভুক্ত কোনো বিষয় নয় এবং বিচারব্যবস্থাও ইসলাম ধর্মের আওতার বাইরের বিষয়। রাষ্ট্র পরিচালনা, রাষ্ট্র সংক্রান্ত বিধিবিধান- সবকিছুই রাজনীতিবিদদের বিষয়, এর সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। ইসলাম রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিষয়ে কোনো বিধানও দেয় না, আবার এর অস্তিত্বও অস্বীকার করে না। রাজনীতিবিদ্যা সংক্রান্ত সকল বিষয় মানুষের বুদ্ধি এবং পর্যবেক্ষণগত জ্ঞানের সাথে সম্পর্কিত। তাঁর এ মতের পক্ষে বিভিন্ন ইসলামী উৎস থেকে তিনি যুক্তি উপস্থাপন করেন।
একই বিষয়ে আরো একটি গ্রন্থ ‘খিলাফত এবং উম্মাহর কর্তৃত্ব’ ১৯২৩ সালে আব্দুল গনি সানা নামে একজন আরব পণ্ডিত তুর্কি ভাষা থেকে আরবিতে অনুবাদ করেন, তবে এর মূল লেখক সম্পর্কে কিছু জানা যায় না।
১.২: খেলাফত ব্যবস্থা পুনর্প্রবর্তনের আহ্বানকারী ধারা:
ইসলামী খেলাফত বিরোধী এ চিন্তার বিপরীতে আল্লামা রশিদ রেদা (১৮৬৫-১৯৩৫) ‘খেলাফত এবং ইমামতের গুরুত্ব’ নামে ১৯২২ সালে একটি গ্রন্থ রচনা করেন, যার মাধ্যমে তিনি ইসলামী খেলাফতের পুনর্প্রবর্তনের আহবানকারীদের পক্ষে প্রতিনিধিত্বের ভূমিকা পালন করেন। এ গ্রন্থের প্রথম অংশে তিনি খেলাফতের এককেন্দ্রিকতা এবং তার একাধিক বিচ্ছিন্ন কেন্দ্র হওয়া, ইমামের একত্ব-উম্মাহর ঐক্য, খেলাফত ব্যবস্থা হতে মানুষের প্রত্যাশা, মুসলিম উম্মাহর সংস্কারে ইমামতের ভূমিকা- এসব নিয়ে আলোচনা করেন । অতঃপর তিনি মুসলিম উম্মাহর মাঝে রেনেসাঁ সৃষ্টির লক্ষে নতুন ইজতিহাদের ডাক দেন। তার ভাষায় ‘মুসলিম উম্মাহর রেনেসাঁ সৃষ্টির পূর্বশর্ত হচ্ছে ইসলামী শরিয়তের নতুন ইজতিহাদ’।
এ বইয়ের দ্বিতীয় অংশে রশিদ রেদা আরব এবং তুর্কী ঐক্যর মাধ্যমে খেলাফত ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার আহবান জানান এবং হিজাজে এ খেলাফতের কেন্দ্র স্থাপন করার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
এ বইয়ের তৃতীয় অংশে লেখক তৎকালীন মুসলমানদেরকে তিন ভাগে ভাগ করেন:
১। ফিরিঙ্গি (বিদেশি,পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী) সভ্যতার তল্পিবাহক সুবিধাভোগী শ্রেণী: এরা শুধু খেলাফতই নয়, ইসলামের নামে যে কোনো কিছুরই অস্তিত্বের ঘোর বিরোধী। আর এরাই ছিল শিক্ষা-দীক্ষা, সামরিক বাহিনী, ব্যবসা-বাণিজ্য সকল দিক থেকে ক্ষমতাশালী।
২। তাক্বলিদপন্থী গোঁড়া ধর্মীয় সম্প্রদায়: এরা যদিও ইসলামী খেলাফতের পক্ষে ছিল; কিন্তু তাদের দৃষ্টিতে খেলাফত মানে হাজার বছরের পুরানো ঘুঁণে ধরা রাজনৈতিক ব্যবস্থা। এ গোষ্ঠিই উম্মাহর পুনর্জারণ এবং খেলাফতকে যুগোপযোগী করার পথে সবচেয়ে বড় বাধা।
৩। ইসলাহী বা সংস্কারবাদী আলেম সমাজ: এ ধারাটি লেখকের দৃষ্টিতে ইজতিহাদী রাজনৈতিক চিন্তার কলমযোদ্ধা, যারা উম্মাহকে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য পৌঁছে দিতে সক্ষম।
চলবে…
অথচ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলা হচ্ছে। শত শত লোক এ পথে জীবন দিচ্ছে। ইতোমধ্যে হাজার হাজার শ্রমঘন্টা এ কাজে ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা সংক্রান্ত কিছু বই তো দূরের কথা, একটি মানসম্মত বইও আজ পর্যন্ত রচিত হয়নি।