কীসের ভিত্তিতে নারীদেরকে মসজিদে যেতে বাধা দেওয়া হয়?
ইমাম তাবারানী বর্ণনা করেছেন,
“বেলাল ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা) আমার নিকট বলেছেন, একদিন তাঁর বাবা আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) তাঁকে বলেছেন, ‘আমি রাসূলকে (সা) বলতে শুনেছি— ‘তোমরা নারীদেরকে মসজিদে যেতে বাধা দিও না।’ বেলাল বললেন, ‘আমি অবশ্যই আমার ঘরের নারীদেরকে বাইরে যেতে বাধা দিবো। তবে কেউ যদি তাদের নারীদেরকে বাইরে যেতে বাধা না দেয়, তাহলে সেটা তার ব্যাপার।’ এ কথা শুনে আমার বাবা আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) আমার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন এবং আমাকে বললেন, ‘আল্লাহ তোমার অমঙ্গল করুক! আল্লাহ তোমার অমঙ্গল করুক! আল্লাহ তোমার অমঙ্গল করুক! তুমি আমার কাছ থেকে শুনলে যে নারীদেরকে বাধা না দিতে আল্লাহর রাসূল (সা) আদেশ করেছেন, আর তুমি কিনা বলছো অন্য কথা!’ আব্দুল্লাহ কাঁদতে লাগলেন এবং রাগ করে চলে গেলেন।” অন্য বর্ণনায় এসেছে, আব্দুল্লাহ (রা) হাত বাড়িয়ে বেলালকে চড় মারলেন।[1]
একই ধরনের বর্ণনা সুনানে তিরমিযীতেও রয়েছে,
“আমরা একবার ইবনে ওমরের (রা) সাথে ছিলাম। তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন— ‘তোমরা নারীদেরকে রাতে মসজিদে যাওয়ার অনুমতি দিও।’ তখন তাঁর ছেলে (বেলাল) বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আমরা নারীদেরকে রাত্রে বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেবো না। কারণ, এর ফলে তারা অপকর্ম করবে।’ ইবনে ওমর (রা) জবাব দিলেন, ‘আমি বললাম যে রাসূল (সা) বাধা দিতে নিষেধ করেছেন, আর তুমি কিনা বলছো তাদেরকে অনুমতি দেবে না!’”[2]
এখানে রাসূলের (সা) কথাটুকু যিনি উদ্ধৃত করেছেন, অর্থাৎ আব্দুল্লাহ ইবনে ওমরের (রা) প্রতিক্রিয়া থেকে সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায়, নারীদেরকে মসজিদে যেতে বাধা দেওয়া রাসূলের (সা) আদেশের পরিপন্থী। কিন্তু তাঁর ছেলে বেলাল সম্ভাব্য ‘অপকর্মের’ (দাগাল, ফেতনা) দোহাই দিয়ে এই আদেশ এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলেন। এটিই পরবর্তীতে ‘সাদ্দে জারাঈ’ (মন্দের দিকে ধাবিত করে, এমন পথ রুদ্ধ করে দেওয়া) হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে এবং তা প্রয়োগ করা হয়েছে। কোনো সম্ভাব্য মন্দ কাজ ঠেকাতে বৈধ কাজ নিষিদ্ধ করার এই যুক্তিকে বলা হয় পরিণতিমূলক যুক্তি (consequentialist logic)।
এ সংক্রান্ত বিভিন্ন মাযহাবের মতামতগুলো গভীরভাবে অধ্যয়ন করে আমি বুঝতে পেরেছি— যেসব স্কলার নারীদেরকে মসজিদে যেতে নিষেধ বা নিরুৎসাহিত করেন, তারা আসলে আব্দুল্লাহ ইবনে ওমরের (রা) বর্ণিত হাদীস ও তাঁর প্রতিক্রিয়াকে আমলে নেন না। বরং তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থনে নিম্নোক্ত হাদীস দুটো উল্লেখ করে থাকেন:
(১) আয়েশা (রা) বলেন, নারীরা যেসব আপত্তিজনক কর্মকাণ্ড শুরু করেছে, রাসূল (সা) যদি এসব দেখতেন তাহলে নিশ্চয় তাদের মসজিদে যাওয়া বন্ধ করে দিতেন, যেমনিভাবে বনী ইসরাইলের নারীদেরকে তাদের উপাসনালয়ে যেতে নিষেধ করে দেওয়া হয়েছিলো।[3]
(২) সাহাবী উম্মে হুমাইদ (রা) বর্ণনা করেছেন, রাসূল (সা) তাঁকে বলেছেন, “তোমার জন্য জামায়াতে নামায পড়ার চেয়ে তোমার ঘরে নামায পড়াই উত্তম।[4] তাঁর ভাতিজা বলেছেন, তারপর উম্মে হুমাইদ (রা) আদেশ করেছিলেন, তাঁর ঘরের একদম ভেতর দিকে, সবচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি জায়গায় যেন তাঁর জন্য নামাযের স্থান প্রস্তুত করে দেওয়া হয়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেখানেই তিনি নামায আদায় করতেন।[5]
আয়েশার (রা) মতামতের ব্যাপারে কথা হলো, এই বক্তব্য যে একটি বিশেষ প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে দেওয়া হয়েছিলো, তা স্পষ্ট। খুব সম্ভবত নারীদের কেউ কেউ মসজিদে অন্যায় কিছু করেছিলো বলে তিনি এমনটা বলেছিলেন। কিন্তু এর দ্বারা তিনি নারীদের মসজিদে যাওয়ার সাধারণ নিয়মের পরিবর্তন বা বাতিল চাননি। যদিও পরবর্তীতে কোনো কোনো ফকীহ এই বক্তব্যকে নারীদের মসজিদে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞার পক্ষের মতামত বলে বিবেচনা করেছেন। অথচ তৎকালীন মদীনার কোনো ফকীহই কিন্তু বলেননি, তাঁর এই বক্তব্য নারীদের মসজিদে যাওয়ার সাধারণ বৈধতা বাতিলের ইঙ্গিত। আয়েশার (রা) মৃত্যু পরবর্তীকালে মদীনার অধিবাসী ইমাম মালেকের (রা) কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিলো, নারীদেরকে মসজিদে যেতে বাধা দেওয়া যাবে কিনা? তিনি জবাব দিয়েছিলেন— “কখনোই নারীদেরকে মসজিদে যেতে বাধা দেওয়া উচিত হবে না।”[6]
এ প্রসঙ্গে ইবনে হাজার আসকালানী মন্তব্য করেছেন:
“কোনো কোনো স্কলার নারীদের মসজিদে যাতায়াত সংক্রান্ত আয়েশার (রা) নিষেধাজ্ঞামূলক কথাটিকে শর্তহীন বলে মনে করেছেন। অথচ এটি ছিলো শর্তসাপেক্ষ। আয়েশার (রা) বক্তব্য অনুসারেই নির্দিষ্ট শর্ত পাওয়া না গেলে বিদ্যমান সাধারণ বিধানের কোনো পরিবর্তন ঘটবে না। এখানে শর্তটি হলো, ‘রাসূল (সা) যদি এসব দেখতেন… তাহলে তিনি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতেন।’ কিন্তু রাসূল (সা) তেমন কিছু দেখেননি, তাই নিষেধও করেননি। তাছাড়া এ ধরনের বিদয়াতী কাজের সাথে অল্প কিছু নারীই শুধু সংশ্লিষ্ট ছিলো। নারীদের সবাই এমনটা করেনি। তাই নিষেধাজ্ঞা যদি দিতেই হয়, তাহলে শুধু সংশ্লিষ্ট নারীদের ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য হওয়া উচিত।”[7]
একই ধরনের যুক্তি দিয়েছেন ইমাম ইবনে হাযম:
“বিদয়াতী কাজগুলোর সাথে অল্প কিছু নারীই কেবল সংশ্লিষ্ট ছিলো, নারীদের সকলে নিশ্চয় নয়। অল্প কয়েকজনের মন্দ কাজের অযুহাতে অন্য সবার ভালো কাজের পথটি বন্ধ করে দেওয়া যায় না।”[8]
এছাড়া ইবনে কুদাইমা বলেছেন:
“রাসূলের (সা) সুন্নত অনুসরণের গুরুত্বই বেশি। আর আয়েশার (রা) বক্তব্যটি কেবল তাদের জন্য প্রযোজ্য, যারা অনভিপ্রেত ও প্রদর্শনীমূলক কাজের প্রচলন ঘটায়।”[9]
উল্লেখিত উদাহরণগুলোসহ অন্যান্য অনেক ব্যাখ্যা থেকে এটা স্পষ্ট, আয়েশার (রা) বক্তব্যটিকে সাধারণ বিধান হিসেবে বিবেচনা করা হলো এক ধরনের প্রান্তিক দৃষ্টিভঙ্গি, যা কোনো নির্ভরযোগ্য স্কলারই অনুমোদন করবেন না।
অন্যদিকে, বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নারীদের মসজিদে প্রবেশাধিকারের বিধিনিষেধ তুলে দেওয়া উচিত। ভিন্ন কিছু ভাবার সুযোগ নেই। বরং নারীদেরকে মসজিদে যেতে উৎসাহ দেওয়া উচিত। এটি নিছক নারীদের অধিকার মাত্র নয়, এর অনেক ভালো দিকও রয়েছে। যেমন— আল্লাহর স্মরণ, জ্ঞান অর্জন, অন্যান্য নারী মুসল্লীদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ এবং বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ, যা তার কমিউনিটি, পরিবার, ধর্ম, সর্বোপরি নিজের জন্য কল্যাণকর।
ইসলামী ফিকাহর দৃষ্টিকোণ হলো, হালাল কাজের উপায় ‘বন্ধ’ করার পরিবর্তে ‘উন্মুক্ত’ রাখতে হবে। এ ব্যাপারে ফকীহদের প্রস্তাবিত পরিভাষাটি হলো ‘ফাতহে জারাঈ’ (পথ খোলা রাখা)। এটি হলো পরিবর্তিত পরিস্থিতির জন্য পূর্বে উল্লেখিত ‘সাদ্দে জারাঈ’র (পথ বন্ধ রাখা) বিকল্প মেথডলজি।[10]
এ প্রসঙ্গে মালেকী মাযহাবের স্কলার আল-কারাফীর ব্যাখ্যাটির কথা বলা যায়। তিনি বলেছেন, যে পথ দিনশেষে হারাম কাজের দিকে নিয়ে যায়, তা বন্ধ করে দেওয়া উচিত এবং সে পথে চলার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা উচিত। আর যে পথ দিনশেষে হালাল কাজের দিকে নিয়ে যায়, তা খোলা রাখা উচিত এবং সে পথে চলার ব্যাপারে লোকদেরকে উৎসাহ দেওয়া উচিত।[11]
এছাড়া ইবনে ফারহুনের বিভিন্ন ফতোয়ায় ‘ফাতহে জারাঈ’ পদ্ধতি প্রয়োগের বিষয়টিও প্রাসঙ্গিক হিসেবে উল্লেখ যায়।[12]
এ সম্পর্কে শায়খ আব্দুল হালীম আবু শুক্কাহর মন্তব্যটি তুলে ধরা যেতে পারে। মসজিদে নারীদের যাতায়াত সংক্রান্ত আয়েশার (রা) মন্তব্যের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি ‘সাদ্দে জারাঈ’র পরিবর্তে ‘ফাতহে জারাঈ’ পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। তিনি লিখেছেন:
“বিনোদন ও ক্রীড়াজগতে বর্তমানে নারীদেরকে নিয়ে যেসব নতুন নতুন ফেতনার প্রচলন হয়েছে; নারীদের চিন্তাভাবনা ও মনমানসিকতার পরিবর্তনে বিভিন্ন মিডিয়া যে পরিমাণ নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে; সর্বোপরি, বর্তমানে নারীদেরকে কেবল একটি স্থানে (মসজিদে) যাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করায় যে ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে— সেইসব বাস্তবতা কি আয়েশা (রা) দেখার সুযোগ পেয়েছেন? তিনি যদি এসব দেখার সুযোগ পেতেন, তাহলেও কী এ ধরনের মতামত ব্যক্ত করতেন? উত্তর হলো— না। বরং এসব দেখে আয়েশা (রা) হয়তো বলতেন— বর্তমানে যা কিছু চলছে, রাসূল (সা) যদি এসব দেখতেন, তাহলে তিনি নারীদের জন্য মসজিদে যাওয়া বাধ্যতামূলক করে দিতেন। নারীদের মসজিদে যাওয়াকে তিনি যতটা উদ্দীপনার সাথে নিরুৎসাহিত করেছিলেন, ঠিক ততটা উদ্দীপনার সাথেই বরং তাদেরকে এখন মসজিদে যেতে উৎসাহ দিতেন। চলমান স্রোতে গা ভাসিয়ে না দিয়ে নারীরা যাতে সদাচারণে অভ্যস্ত হতে পারে, সে জন্য তিনি বরং নারীদেরকে মসজিদে যাওয়ার আহ্বান জানাতেন।”[13]
নারীদের মসজিদে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞার দলীল হিসেবে উম্মে হুমাইদ (রা) কর্তৃক বর্ণিত দ্বিতীয় যে হাদীসকে বিবেচনা করা হয়, সেটি নিয়ে পরবর্তী অধ্যায়ে আলোচনা করবো। সেখানে আমরা এই প্রশ্নটির জবাব দেওয়ার চেষ্টা করবো— ‘নারীদের জন্য মসজিদের চেয়ে ঘরে নামায পড়াই উত্তম’ কথাটি কি রাসূল (সা) বলেছেন?
[মূল: ড. জাসের আওদা, অনুবাদ: জোবায়ের আল মাহমুদ]
***
অন্যান্য পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রেফারেন্স ও নোট:
[1] ইমাম তাবারানী, মুজামুল কাবীর, ৩৬২/১২ ও ৩৯৯/১২।
[2] সুনানে তিরমিযী, ৭০৯/১; বুখারী, ৩০৫/১, রাতের বেলা নারীদের মসজিদে যাওয়ার অনুমতি সংক্রান্ত অধ্যায়।
[3] সহীহ বুখারী, নামায অধ্যায়, ১৭৩/১; সহীহ মুসলিম, নামায অধ্যায়, ৩২৮/১ এবং অন্যান্য গ্রন্থ।
[4] বায়হাকী, ৪৯৪৪।
[5] আহমদ, ২৬৫৫০।
[6] মুদাওয়ানাতুল কুবরা, ১০৬/১।
[7] ফাতহুল বারী, ৪৯৫/২।
[8] আল-মুহাল্লা, ১৬৩/৩।
[9] আল-মুগনী, ৩৭৫/২।
[10] আল-কারাফী, আদ-দাখীরাহ, ১/১৫৩। আল-কারাফী, আল-ফারুক (মা’আ হাওয়ামিশিহ) ২/৬০, বুরহানুদ্দীন ইবনে ফারহুন, তাবসিরাতুল হুকুম ফি উসুলুল আকদিয়্যাহ ওয়া মানহাজিল আহকাম, সম্পা. জামাল মারাশলী (বৈরুত: দারুল কুতুবুল ইলমিয়্যাহ, ১৯৯৫) ২/২৭০।
[11] আল-কারাফী, আদ-দাখীরাহ, ১/১৫৩। আল-কারাফী, আল-ফারুক (মা’আ হাওয়ামিশিহ) ২/৬০।
[12] ইবনে ফারহুন, তাবসিরাতুল হুকুম, ২/২৭০-।
[13] তাহরীরুল মারয়াতি ফি আসরির রিসালাহ (রসূলের স. যুগে নারী স্বাধীনতা), ৩৬/১।