ইসলামপন্থীদের রাষ্ট্রচিন্তার সীমাবদ্ধতা: উত্তরণের উপায়
এডিটর’স নোট: ২০১০ সালে Our Future as American Muslims শিরোনামে নোমান আলী খান একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেট্রয়টে। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় বক্তৃতাটির একটি বিশেষ অংশ সিএসসিএস-এর পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন আইয়ুব আলী।
***
গত এক দেড়শ বছর উম্মাহ একটি কঠিন ক্রান্তিকাল পার করেছে। আমরা চাইলেও সেই ইতিহাস থেকে নিজেদের আলাদা রাখতে পারি না। আমাদের চিন্তাভাবনা, ইসলাম সম্পর্কে আমাদের বুঝাপড়া, আমাদের বর্তমান অবস্থান– এসব কিছুই হলো ইতিহাসের সেই ক্রান্তিকালের ফলাফল। সেসব ঘটনা যদি আমরা বিশ্লেষণ করতে না পারি, বর্তমানে কেনইবা আমাদের এই অবস্থা তা যদি বুঝতে না পারি, তাহলে সামনে আগানোর পথটা আমাদের সামনে পরিষ্কার হবে না। আমি শুধু গত এক দেড়শ বছরের ইসলামী আন্দোলনগুলোর কথাই অত্যন্ত সংক্ষেপে বলবো।
ইসলামী খেলাফতের সর্বশেষ নিদর্শন ছিলো উসমানী সাম্রাজ্য। এর পতন ঘটে ১৯২৪ সালে। এর প্রতিক্রিয়ায় ভারত, আফ্রিকা ও আরব বিশ্বসহ সারা পৃথিবীতে বেশ কিছু আন্দোলন গড়ে ওঠে। ইসলামকে পুনরুজ্জীবিত করতে এই আন্দোলনগুলো কাজ করছিলো। ইসলামকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজে এসব আন্দোলন ও গ্রুপগুলোর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট লেখকরাও জোর দিয়েছেন। এভাবেই ‘ইসলামী রাষ্ট্র ধারণা’ গড়ে ওঠে।
তাই বলা যায়, গত দেড়শ বছরে গড়ে ওঠা উল্লেখযোগ্য সবগুলো আন্দোলনই খেলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা বলেছে। খেলাফত সংক্রান্ত হাদীসগুলোর উদ্ধৃতি দিয়েছে। সীরাত থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে– ‘দেখুন, মহানবী (সা) কী করেছেন! অতএব, আমাদেরও তাই করা উচিত।’ অর্থাৎ, নিজেদের সংগ্রামকে সরাসরি মহানবীর (সা) জীবনের সাথে সম্পর্কিত হিসেবে দাবি করা হয়েছে।
একদিক থেকে বিষয়টি খুবই ভালো। কারণ, মহানবীর (সা) সংগ্রামের সাথে আমাদের সংগ্রামকে সম্পৃক্ত করার দরকার আছে। আবার অন্যদিক থেকে ব্যাপারটি অতি সরলীকরণ মাত্র। সীরাত থেকে শিক্ষা নিতে গিয়ে আমরা তৎকালীন স্থান, কাল ও ঘটনাপ্রবাহকে উপেক্ষা করতে পারি না। কোনো শিক্ষাকেই আপনি কপি-পেস্ট করতে পারেন না। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে সেগুলো কাজে লাগাতে হবে। আর তাই বর্তমান সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে।
এ প্রসঙ্গে আমি একটা আর্টিকেলের কথা উল্লেখ করতে চাই। আর্টিকেলটির লেখক আমার অন্যতম প্রিয় একজন শিক্ষক ও সহকর্মী। আমার কাছে তিনি আসলে একজন ইন্টেলেকচুয়াল রোল মডেল। তিনি এই কমিউনিটিরই লোক। প্রিয় ভাই বশির আল-আনসারী ‘আল-ইসলামিয়্যুন বাইনাদ দাওলাতু ওয়াল্লাদাওলাহ’ শিরোনামে আল জাজিরায় একটি আর্টিকেল লিখেছেন। সত্যিই অসাধারণ একটা লেখা। ডেট্রয়েটে যখন গিয়েছিলাম, তখন আমি তাঁর সাথে বসে একসাথে আর্টিকেলটি পড়েছি।
ইসলামী আন্দোলন তথা ইসলামপন্থীদের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা থাকলে কী হয়, আর না থাকলে কী হয়, সেটি হলো এই আর্টিকেলের বিষয়বস্তু। রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়া সংক্রান্ত ইসলামপন্থীদের ধারণার মধ্যে দুটি স্বতন্ত্র ব্যাপারকে সমান মনে করা হয়:
দ্বীন প্রতিষ্ঠা = ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা
সব ইসলামী আন্দোলনেরই একটি কমন ধারণা হলো– দ্বীন প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে আপনাকে অবশ্যই একটি সরকার গঠন করতে হবে। এমনকি নিউ জার্সির মতো শুধু একটি অঙ্গরাজ্যের সরকার হলেই হবে না, একটি রাষ্ট্রের সরকার হতে হবে। দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা অপরিহার্য। ইসলামপন্থীদের এই ধারণাটি নিয়েই লেখক প্রশ্ন তুলেছেন। এই ধারণার গোড়া কোথায়, এর সমস্যাগুলো কী কী, এই আর্টিকেলে তিনি সেসব প্রসঙ্গ আলোচনা করেছেন।
প্রথম কথা হলো, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা ইসলামী আন্দোলনগুলোর বেশিরভাগেরই রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম সংক্রান্ত ধারণা কিংবা বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই। সরকার চালাতে গেলে একটি রোডম্যাপ থাকা লাগে। করব্যবস্থা, পুলিশ বিভাগ, স্যানিটেশনসহ নানা বিষয় থাকে। বিশাল আমলাতন্ত্র সামলাতে হয়। আপনি হয়তো বড় একটি কোম্পানিতে কাজ করেন, যেখানে কর্মচারীর সংখ্যা ধরুন পাঁচ শতাধিক। কিন্তু সরকার এরচেয়েও অনেক বড়। বিদ্যমান সংগঠনব্যবস্থাগুলোর মধ্যে সরকার হলো সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান। এখানে কর্মচারীর সংখ্যাও সবচেয়ে বেশি। একটি বিশাল আমলাতন্ত্র এর সাথে সম্পৃক্ত। তাই খেয়াল করলে দেখবেন, আপনার পরিচিত কোনো আন্দোলন হয়তো বলছে– আমাদের একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা দরকার, এটা করা দরকার, ওটা করা দরকার। কিন্তু এ ধরনের একটি জটিল রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হলে যে ধরনের রোডম্যাপ থাকা লাগে, তার ধারেকাছেও তারা নেই।
এর সাথে আপনি তৎকালীন মদীনার তুলনা করতে পারেন না। সে সময়টা ছিলো সহজ ও সাদামাটা। পানি ব্যবস্থাপনা, কর বিভাগ, পৌরব্যবস্থা সম্বলিত সরকারব্যবস্থার প্রয়োজন তাঁদের ছিলো না। তাঁরা একেবারে সাধারণ কুঁড়েঘরে বাস করতেন, গোত্রীয় জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। এটুকু শুধু বলা যায়, তারা অন্যদের তুলনায় কিছুটা সংগঠিত ছিলেন। মহানবী (সা) মদীনায় যে রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেটি ছিলো রাষ্ট্রব্যবস্থার একেবারে প্রাথমিক রূপ। তৎকালীন সমাজের তুলনায় সেটি অবশ্য বেশ অগ্রসর ছিলো। কিন্তু বর্তমানের তুলনায় তা নিতান্তই সাধারণ।
যারা বলে, ‘এই তো, আর কিছুদিনের মধ্যেই আমরা একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে ফেলবো…’; এসব আন্দোলনগুলোকে আপনি যদি বলেন, ‘ঠিক আছে, আমরা তাহলে আপনাদেরকে একটি রাষ্ট্র দিয়ে দিচ্ছি। ধরুন, পাকিস্তান রাষ্ট্রটা এখন আপনাদের।’ তারপর তারা কী করবে? তারা কীভাবে এই রাষ্ট্রটাকে চালাবে? রাষ্ট্রীয় বাজেট প্রণয়নের যোগ্যতা কি তাদের আছে? তারা কি বাজেটের অর্থসংস্থান করতে পারবে? রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বা এ জাতীয় আরো যতসব কাজ আছে, সেগুলো কি তারা সামলাতে পারবে? এগুলোর জবাব হলো– না, তারা এসব ব্যাপার সামলাতে পারবে না। এগুলো এমনসব কাজ, যে জন্য বিশেষ দক্ষতা থাকা আবশ্যক।
যা হোক, আর্টিকেলটিতে তিনি আরেকটি বিষয়ে আলোকপাত করেছেন, সে প্রসঙ্গে কিছু বলি। আমার কাছে পয়েন্টটা খুবই ভালো লেগেছে। এসব আন্দোলন সাধারণত বলে, ‘মুসলমানদেরকে জেগে ওঠতে হবে, আমাদেরকে রুখে দাঁড়াতে হবে, আমাদেরকে দ্বীন কায়েম করতে হবে’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এ জাতীয় কথাবার্তা বড়জোর খুতবায় বলা যায়। মুসল্লীরাও তখন হয়তো জোশের সাথে তাকবীর দিয়ে ওঠবে, ‘ইকামাতে দ্বীন’ শ্লোগান দিতে থাকবে। এসব করে আন্দোলনগুলো মানুষকে তেজোদ্দীপ্ত করতে পারে, সাহস যোগাতে পারে, উদ্বুদ্ধ করতে পারে। লোকেরা মাওলানা মওদূদী (রহ.), সাইয়েদ কুতুব (রহ.) কিংবা মাওলানা ইলিয়াসের (রহ.) বইপত্র পড়ে ‘ওয়াও! খুব ভালো জিনিস!’ বলে হয়তো মুগ্ধও হতে পারে।
এখন আমার একটা প্রশ্নের জবাব দিন। বর্তমানে দুনিয়ায় কোন দেশের নাগরিক তার সরকারকে অসাধারণ সরকার মনে করে? কেউ কি বলে, আমাদের সরকার খুব ভালো, আমি ক্ষমতাসীনদের ভালোবাসি? বরং ক্ষমতাসীন হলে একটা জিনিস আপনাতেই পাওয়া যায়। সেটা হলো ঘৃণা। এটা কেউ এড়াতে পারে না। সহজে অনুপ্রাণিত না হওয়া মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা। বিশেষ করে নিজেদের সরকারের বেলায় কথাটা আরো বেশি খাটে।
কোনো কোনো গ্রুপ বিষয়টি বুঝতে পেরেছে। উদাহরণ হিসেবে আমি হিজবুল্লাহর কথা বলতে পারি। তাদেরকে স্বীকৃতি দেয়া আমার উদ্দেশ্য নয়। রাজনৈতিক কৌশল বুঝতে এই উদাহরণটি আমাদের প্রয়োজন। সম্প্রতি লেবাননের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হিজবুল্লাহকে সম্পৃক্ত করার প্রচেষ্টা চলছে, আমরা জানি। কিন্তু হিজবুল্লাহর নেতৃবৃন্দ বলেছে, না, আমরা সরকারে যেতে চাই না, ধন্যবাদ।
কেন তারা সরকার গঠনে রাজি হয়নি? কারণ, সরকারের বাইরে থাকায় প্রচুর মানুষ এখনও তাদেরকে ভালোবাসে। কিন্তু তারা যদি সরকারের অংশীদার হয়, তাহলে মানুষের আস্থা হারাবে। অন্য যে কোনো ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদদের মতো তাদেরকেও দুর্নীতিপরায়ণ হিসেবে বিবেচনা করবে। ক্ষমতায় যাওয়ার পরিবর্তে সরকারের বাইরে থাকাতেই তারা বেশি ক্ষমতাবান, এ কথা হিজবুল্লাহ বুঝতে পেরেছে।
আচ্ছা, চলুন এবার আরব বিশ্বের বাইরের উদাহরণ দেখি। আমেরিকার কথাই ধরা যাক। আপনার দৈনন্দিন জীবনে সরকারের প্রভাব কতটুকু? আমি জানি, আপনি সরকারকে প্রতি বছর ট্যাক্স দিয়ে যাচ্ছেন। এ ব্যাপারটি আপাতত একপাশে রেখে যদি আপনার প্রাত্যাহিক জীবনের কথা ভাবেন, তাহলে আপনার উপর সরকারের প্রভাব কতটুকু? উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এই দেশে মানুষের মূল ভাবনা হলো ফ্যাশন সচেতনতা, জীবনের সাফল্য-ব্যর্থতা, মন-মানসিকতা ইত্যাদি। আপনারা জানেন, এসবের পেছনে সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। প্রাইভেট সেক্টরের প্রভাবেই এসব বিষয়ে মানুষ প্রভাবিত হচ্ছে। এগুলোর পেছনে আছে বিনোদন জগত, একাডেমিয়া এবং বড় বড় করপোরেশনগুলো, যারা আমাদের কাছে তাদের পণ্য বিক্রি করছে, বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। এমনকি মেডিক্যাল রিসার্চসহ বেসরকারী বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক অর্থায়নকৃত সকল ধরনের গবেষণা প্রকল্প ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করছে।
তাহলে বুঝা যাচ্ছে, আপনার দৈনন্দিন জীবনকে যেসব বিষয় প্রভাবিত করে তার বেশিরভাগই সরকারী নয়, বেসরকারী খাতের উদ্যোগ। এই ব্যাপারটি বুঝতে পারলে আমাদের এখন কী নিয়ে চিন্তা করার কথা? আমরা যদি সত্যিই এই সমাজকে আমাদের আদর্শে পরিচালনা করতে চাই, তাহলে আমাদেরকে কীসের নিয়ন্ত্রণ নিতে হবে? বেসরকারী খাতের। এটি একটি অবাধ ক্ষেত্র। অথচ মুসলমানরা এখনো এই সেক্টরে কাজ শুরুই করতে পারেনি।
মিডিয়াতে কয়জন মুসলমান আছে? বর্তমানে মিডিয়া সরকারের চেয়েও বেশি শক্তিশালী। নির্বাচনের গতিপ্রকৃতি পাল্টে দিতে পারে মিডিয়া। মিডিয়া প্রেসিডেন্টকে অভিশংসনের মুখে পর্যন্ত ঠেলে দিতে পারে। মিডিয়া জনমানসে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। ‘ওমাবা একজন মুসলিম’ – এ ধরনের চটকদার ও বিপজ্জনক গুজব মিডিয়াই ছড়াতে পারে। এসব করেও তারা পার পেয়ে যায়। কারণ, মিডিয়া অত্যন্ত শক্তিশালী।
তারপর একাডেমিয়ার কথা ধরুন। এই সমাজের যারা নেতা, তাদের চিন্তাভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে দেয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। একাডেমিয়া জগতে কয়জন মুসলমান আছে? কয়জন মুসলিম নৃবিজ্ঞানী, রাজনীতি বিজ্ঞানী কিংবা ইতিহাসবিদ রয়েছে? এসব ক্ষেত্রে আমাদের পদচারণা নেই বললেই চলে।
আমরা এ দেশে আসছি এবং ভাবছি, ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়াই বুঝি জীবনের সফলতা। তা না হলে প্রোগ্রামার বা আইটি প্রফেশনাল হওয়া চাই। এর কোনোটিই হতে না পারলে নিদেনপক্ষে গ্যাস স্টেশনে চাকরি করে টাকা-পয়সা কামানো হলো আমাদের জীবনের ‘সফলতা’। কারণ, ভালো টাকা-পয়সা কামাতে পারলে একটা সুন্দর বাড়ি কেনা যাবে, চমৎকার প্রতিবেশী পাওয়া যাবে। এগুলো একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত সফলতা হতে পারে। কিন্তু সমাজ? আমাদের কমিউনিটি?
ইহুদী কমিউনিটির দিকে তাকালে আমি তাজ্জব হয়ে যাই। এই দেশে এখন আমাদের সাথে যে ধরনের আচরণ করা হয়, তারা যখন এসেছিলো তাদের সাথেও তখন একই ধরনের আচরণ করা হতো। কিন্তু তারা এখন নিজেদেরকে কোথায় নিয়ে গেছে…! এটুকু শুনে আপনি হয়তো বলে ওঠবেন, অ! তারা তো ইহুদী ‘রাব্বি’। সে যাই হোক, আপনাকে কিন্তু জানতে হবে তারা আসলেই এখন কোন পর্যায়ে চলে গেছে। শুধু আর্থিক প্রতিষ্ঠানই নয়, বিনোদন, সাহিত্য, একাডেমিক জগতেও এখন তাদের আধিপত্য। দেশের প্রধান প্রধান প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষক এখন ইহুদী। এটি একটি স্বাভাবিক রীতিতে পরিণত হয়েছে। এভাবে তারা দেশের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। এ কারণে তারা ধরাছোঁয়ার ঊর্ধ্বে।
অন্যদিকে, আমরা বড়জোর নিজেদেরকে ‘দক্ষ শ্রমিক’ হিসেবে গড়ে তুলেছি। এর বেশি কিছু নয়। ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার, যাই হোন না কেন, দিনশেষে আপনি উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন একজন কর্মী মাত্র। আপনি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রভাবিত করা বা সমাজে আলোড়ন তোলার মতো কেউ নন। আপনি নিছক একজন ভালোমানের ভোক্তা। তুলনামূলক দামি একটি গাড়ি কিনে আপনি হয়তো অর্থনীতিতে সামান্য একটু অবদান রাখছেন, কিন্তু অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়ে দেয়া বা প্রভাবিত করার মতো ক্ষমতা আপনার নেই।
সারকথা হলো, আমরা যদি সমাজকে প্রভাবিত করতে চাই, তাহলে প্রাইভেট সেক্টরে প্রবেশের গুরুত্ব মুসলমানদের বুঝতে হবে। এ জন্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আমাদের ভালো অবস্থান গড়ে তোলা দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফান্ডিং করতে হবে। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের অর্থায়ন যে একটি ইহুদী গোষ্ঠী করে, সে কথা জানেন? এমতাবস্থায় সেখানে কোন ধরনের জ্ঞান-গবেষণা হবে, তা তো বুঝতেই পারছেন। পিএইচডি পর্যায়ে এমন কোনো ইসলামিক স্টাডিজ প্রোগ্রাম কি আছে, যার অর্থায়ন করছে কোনো মুসলিম সংস্থা? হ্যাঁ, ট্রয়ের (মিশিগান স্টেটের মেট্রো ডেট্রয়েট অঞ্চলে অবস্থিত একটি শহর) মুসলমানরা ফান্ডিংয়ের জন্য কয়েক মিলিয়ন ডলার অনুদান সংগ্রহের একটা উদ্যোগ নিয়েছে। তারা প্রাণপণ চেষ্টা করছে। তাদের এই প্রচেষ্টাকে আমি সাধুবাদ জানাই।
এটা তো আসলে একটা খেলা। এই খেলায় আপনাকে অংশগ্রহণ করতে হবে। আমরা জানি, মহানবী (সা) কবিদেরকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন। একাডেমিকরাই হলো আমাদের সময়ের কবি। তাই এই চ্যালেঞ্জটা আমাদের নিতে হবে। অথচ আমরা এর ধারেকাছেও এখন পর্যন্ত যেতে পারিনি। নিজেদের কল্পিত আকাশকুসুম স্বপ্নের মধ্য থেকে আমরা এখনো বেরুতে পারছি না। এই অবস্থায় সত্যিকারের খেলার মাঠে নামার চিন্তা করা নিশ্চয় দুঃসাহসী একটা কাজ। সৃজনশীল মুসলিম তরুণদেরকে মিডিয়া স্টাডিজ পড়তে হবে, ফিল্ম প্রোডাকশনে আসতে হবে। এটাই হলো আমাদের সময়ের এই ধরনের ডিজিটাল কবিতার ভাষা।
মহানবীর (সা) সময়ে কবিতা যে লোকজনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করতো, তা তো নিশ্চয় আপনারা জানেন। এখন সেই কাজটি করছে ইউটিউব। তাই এখন আমাদের দরকার ফিল্ম প্রডাকশনের জন্য যোগ্যতাসম্পন্ন লোক। আমাদের সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানী দরকার। এমনকি মুসলিম ইতিহাসবিদেরও খুব প্রয়োজন। এসব ফিল্ডে আমাদের তেমন কেউ নেই। অথচ এরাই হলো একটি সমাজের মানস গঠনের মূল কারিগর।
আমাদের আরো দরকার ওয়ালমার্টের মতো বিস্তৃত ও বৃহৎ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। একেকটা প্রজেক্টের সম্পূর্ণ ফান্ডিং করার মতো সক্ষমতা এ ধরনের বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর আছে, যা ব্যক্তিগতভাবে সম্ভব নয়। এর একটি সেক্যুলার উদাহরণ হলো ‘বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন’। তারা দেশজুড়ে বিভিন্ন স্কুলে অনুদান হিসেবে প্রচুর টাকাপয়সা দেয়, বিভিন্ন প্রজেক্টে অর্থায়ন করে। মুসলমানদেরও এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা প্রয়োজন, যারা শুধু মুসলিম প্রতিষ্ঠানগুলোই নয়, সবাইকে সহায়তা করবে এবং বৃহত্তর পরিসরে কাজ করবে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, আমরা কেন এসব করবো? করবো এ জন্যই যে, এতে করে আমরা এই সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠতে পারবো। ফলে তারা এখন আমাদের সম্পর্কে যেসব নেতিবাচক কথাবার্তা বলে, সেগুলো আর বলতে পারবে না। তারা আমাদের ব্যাপারে এমনভাবে কথা বলে যেন আমরা বেওয়ারিশ কুকুরের মতো এই সমাজে ঘুরে বেড়াচ্ছি। বাস্তবিক অর্থেই মিডিয়াতে আমাদেরকে নিয়ে এমনসব কথাবার্তা হয়। আমাদেরকে ন্যূনতম মানবিক মর্যাদা দেয়া হয় না। অথচ তারা যা বলে, আমরা তেমনটি নই।