শিল্পকলা ও নন্দনতত্ত্বের ব্যাপারে ইসলামের অবস্থান
বাড়াবাড়ি ও শিথিলতার প্রান্তিকতা
মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের সাথে ঘনিষ্ট ব্যাপারগুলোর মধ্যে বিনোদন ও শিল্পকলা সম্ভবত সবচেয়ে উপেক্ষিত বিষয়গুলোর একটি। যদিও বাস্তবে এটি আমরা মনে রাখি না।
ফলে লোকেরা এ বিষয়ে হয় অত্যধিক বাড়াবাড়ি করে, নয়তো খুব বেশি শিথিলতা প্রদর্শন করে। কারণ, এগুলো যতটা না মানুষের জ্ঞান ও বিবেচনাবোধের সাথে সম্পর্কিত, তারচেয়েও বেশি আবেগ-অনুভূতির সাথে সম্পৃক্ত। এ কারণে এগুলোর মাধ্যমে একদিকে যেমন বাড়াবাড়ি ও সীমালঙ্ঘন হয়, তেমনি অন্যদিকে কঠোরতা ও বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধেও এগুলোকে কাজে লাগানো যায়।
অনেকে মুসলিম সমাজের এমন একটি চিত্র তুলে ধরেন, যাতে মনে হয়– এখানে কেবল ইবাদত বন্দেগী এবং কাজ আর কাজ নিয়েই পড়ে থাকতে হয়। আনন্দ-বিনোদন, হাসি-উল্লাস, গানের কোনো স্থানই যেন এখানে নেই! এই সমাজে অট্টহাসি বা মুচকি হাসি, প্রফুল্ল মন বা হাসিখুশি চেহারা– এসবের কোনোটাই যেন জায়েজ নয়!
মুসলিম সমাজের এমন এক অদ্ভুত চিত্র গড়ে ওঠার পেছনে সম্ভবত কিছু ধার্মিক মানুষের আচরণই দায়ী। এসব ধর্মভীরু মানুষকে খেয়াল করলে দেখবেন– তারা সবসময় গোঁমড়ামুখো হয়ে থাকে। তাদের কপাল থাকে কোঁচকানো। তারা সবসময় দাঁত কিরমিরিয়ে থাকে। কঠোর স্বভাব, হতাশা, কিংবা কোনো ব্যক্তিগত মানসিক সমস্যার কারণে হয়তো তাদের চেহারার এমন দশা হয়ে থাকে। কিন্তু এসব অসৌজন্যমূলক আচরণকে তারা সাধারণত দ্বীনের নামে চালিয়ে দেয়। অথচ দ্বীনের ‘দোষ’ কেবল এতটুকুই যে, দ্বীনকে তারা ভুল বুঝে বসে আছে। এর কারণ হলো, তারা বিচ্ছিন্নভাবে এখান ওখান থেকে নস তথা কোরআনের আয়াত ও হাদীসগুলোকে গ্রহণ করে।
এভাবে শুধু নিজের উপর কাঠিন্য আরোপ করে তারা যদি তৃপ্ত থাকতো, তাহলে কারো কিছু বলার ছিল না। কিন্তু ভয়ংকর ব্যাপার হলো, এই কঠোরতার বোঝা তারা সমাজের সবার উপর চাপিয়ে দিতে চায়। তাদের পছন্দনীয় চিন্তাধারা সবাইকে গেলাতে চায়। এর ফলে জটিলতাই বাড়ে শুধু। এই জটিলতা সামগ্রিকভাবে মানুষের জীবনকে গ্রাস করে নেয়– হোক তা যাযাবর কিংবা সভ্য, গ্রামীণ কিংবা শহুরে, উত্তর মেরু কিংবা দক্ষিণ মেরু, প্রাচ্য কিংবা পাশ্চাত্যের জীবন।
এদের ঠিক বিপরীত ধরনের কিছু মানুষও রয়েছে, যারা নিজের কুপ্রবৃত্তির খায়েশ মেটাতে লাগামহীন জীবনযাপন করে। তারা তাদের পুরো জীবনটাকেই খেল-তামাশায় পরিণত করেছে। বৈধ-অবৈধ, আবশ্যিক-অবাঞ্ছিত, হালাল-হারামের মাঝে যত পার্থক্য রয়েছে, সবগুলোকে তারা ঘুচিয়ে দিয়েছে।
লক্ষ করলে দেখা যায়, বিনোদন ও শিল্পের নাম দিয়ে এরা চায় সবকিছু শিথিল হোক, নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ুক এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সব ধরনের অশ্লীলতার প্রসার ঘটুক। কোনো বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে, তা নাম-ধাম কিংবা বাহ্যিক পরিচয় নয়, বরং বিষয়বস্তু এবং উদ্দেশ্যের উপরই নির্ভর করে। এই মূলনীতি তারা ভুলে বসে আছে।
অতএব, প্রথম গ্রুপের বাড়াবাড়ি এবং শেষোক্ত গ্রুপের ছাড়াছাড়ি হতে মুক্ত থাকতে হবে। তদুপরি সহীহ হিসেবে প্রমাণিত সুস্পষ্ট নস (কোরআনের আয়াত ও হাদীস), শরীয়াহর মূল উদ্দেশ্য এবং ফিকাহর সুপ্রতিষ্ঠিত নিয়মকানুনের আলোকে বিষয়টিকে বিবেচনা করতে হবে।
এ বিষয়ে এখানে খুব বেশি আলোচনার সুযোগ নেই। সংক্ষেপে কিছু বলবো। তবে আমার অন্যান্য বইয়ে বিস্তারিত লিখেছি। এ প্রসঙ্গে ‘ইসলামে হালাল-হারামের বিধান’ এবং ‘সমসাময়িক ফতোয়া’ ১ম ও ২য় খণ্ডের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া ‘মুসলিম সমাজের কাঙ্খিত বৈশিষ্ট্য’ বইয়ের ‘সঙ্গীত ও শিল্পকলা’ অধ্যায়ে এ বিষয়ে বলেছি। পরে অধ্যায়টিকে কিছুটা পরিবর্ধিত করে ‘ইসলাম ও শিল্পকলা’ শিরোনামে আলাদা পুস্তিকাও বের করেছি।
শিল্পকলার ব্যাপারে মূলনীতি
এ সম্পর্কে নিচে একটা সারমর্ম তুলে ধরা হলো, যেখানে এর মূলনীতি ও প্রকৃত বাস্তবতা ফুটে উঠেছে।
মানবসত্তার সাথে ইসলামের সম্পর্কের স্বরূপ:
ইসলাম একটি বাস্তবধর্মী দ্বীন তথা জীবনব্যবস্থা। মানুষের শরীর, মন, আকল, অনুভূতি– এই সবকিছুর সাথেই ইসলামের সম্পর্ক রয়েছে। ইসলাম ভারসাম্যপূর্ণভাবে মানবসত্তার এই সবগুলো দিকের খোরাক মেটানোর কথা বলে, যা ‘রহমানের বান্দাদের’ বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
وَالَّذِينَ إِذَا أَنفَقُوا لَمْ يُسْرِفُوا وَلَمْ يَقْتُرُوا وَكَانَ بَيْنَ ذَٰلِكَ قَوَامًا
আর তারা যখন ব্যয় করে, তখন যেমন অপব্যয় করে না, তেমনি কার্পণ্যও করে না। বরং তাদের অবস্থান এ দুইয়ের মাঝামাঝি। (সূরা ফোরকান: ৬৭)
এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যটি স্রেফ ধনসম্পদ খরচের বেলায়ই সীমাবদ্ধ নয়। বরং যে কোনো কাজের ক্ষেত্রেই এটি একটি সাধারণ মৌলিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে গণ্য। এটাই হলো একটি মধ্যপন্থী জাতির মূল কথা।
খেলাধুলা যদি শরীরের খোরাক মেটায়, ইবাদত যদি আত্মার খোরাক মেটায়, জ্ঞান যদি আকলের খোরাক মেটায়, তাহলে শিল্পকলা নিশ্চয়ই আবেগ-অনুভূতির খোরাক মেটায়।
উল্লেখ্য, যেসব বিনোদন মানুষকে অধঃপতিত করে না, বরং উন্নত করে– শিল্পকলা বলতে আমরা সেসবকেই বিবেচনা করছি।
সৃষ্টিজগতের কল্যাণ ও সৌন্দর্যের ধারণার উপর কোরআনের গুরুত্বারোপ:
শিল্পকলার মূল কথা যদি হয় সৌন্দর্যকে হৃদয়ঙ্গম ও উপভোগ করা, তাহলে বলা যায় স্বয়ং কোরআনই আমাদেরকে এ ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করেছে। কোরআনের একাধিক আয়াতে এর গুরুত্বও তুলে ধরা হয়েছে।
আল্লাহর সৃষ্টির মাঝে লুকায়িত ‘সৌন্দর্যের’ উপর কোরআন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করেছে। পাশাপাশি এসব সৃষ্টির মাঝে যেসব ‘কল্যাণ’ বা ‘উপকার’ রয়েছে, তার উপরও জোর দিয়েছে।
আল কোরআন এভাবে সৃষ্টিজগত থেকে উপকার গ্রহণের পাশাপাশি আমাদেরকে এর সৌন্দর্য উপভোগ করতেও বলে দিয়েছে। যেমন, চতুষ্পদ পশুর উপকারিতা প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
وَالْأَنْعَامَ خَلَقَهَا لَكُمْ فِيهَا دِفْءٌ وَمَنَافِعُ وَمِنْهَا تَأْكُلُونَ
তিনি চতুষ্পদ প্রাণী সৃষ্টি করেছেন, তোমাদের জন্য ওতে শীত বস্ত্রের উপকরণসহ আরো অনেক ধরনের উপকার রয়েছে, এছাড়া তাদের কিছু তো তোমরা আহারও করে থাকো। (সূরা নাহল: ৫)
এই আয়াতটিতে উপকারিতার ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। ঠিক পরের আয়াতটিতে আল্লাহ বলেছেন,
وَلَكُمْ فِيهَا جَمَالٌ حِينَ تُرِيحُونَ وَحِينَ تَسْرَحُونَ
তোমরা যখন গোধূলী লগ্নে ওদেরকে ঘরে ফিরিয়ে আনো এবং প্রভাতে চারণভূমিতে নিয়ে যাও, তখন এর মাঝে তোমাদের জন্য রয়েছে সৌন্দর্য। (সূরা নাহল: ৬)
এই আয়াতটিতে সৌন্দর্য উপভোগ করার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। আয়াতটি আমাদেরকে স্রষ্টার এমন এক অসাধারণ শিল্পকর্মের দিকে মনোযোগ দিতে বলে, যা কোনো সৃষ্ট জীবের পক্ষে আঁকা সম্ভব নয়, মহামহিম স্রষ্টার পক্ষেই শুধু তা সম্ভব। একই সূরায় একটু পরে আল্লাহ তায়ালা আবার বলেছেন,
وَالْخَيْلَ وَالْبِغَالَ وَالْحَمِيرَ لِتَرْكَبُوهَا وَزِينَةً
তিনি ঘোড়া, খচ্চর ও গাধা সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা আরোহণ করতে পারো, এছাড়াও এতে সৌন্দর্য এবং নান্দনিকতাও রয়েছে। (সূরা নাহল: ৮)
আয়াতটিতে উল্লেখিত আরোহণ করার ব্যাপারটি একটি প্রয়োজনীয় বস্তুগত উপকারিতা। অন্যদিকে সৌন্দর্য হলো শিল্পকলার নান্দনিকতা উপভোগ করার ব্যাপার। বস্তুত, এ দুয়ের সম্মিলনেই প্রতিটি মানবিক প্রয়োজনীয়তা পরিপূর্ণতা লাভ করে।
সমুদ্রকে আল্লাহ আমাদের জন্য কীভাবে উপযোগী হিসেবে তৈরি করেছেন, একই সূরায় কয়েক আয়াত পরে তিনি সেটি আমাদেরকে বলেছেন:
وَهُوَ الَّذِي سَخَّرَ الْبَحْرَ لِتَأْكُلُوا مِنْهُ لَحْمًا طَرِيًّا وَتَسْتَخْرِجُوا مِنْهُ حِلْيَةً تَلْبَسُونَهَا
তিনিই সমুদ্রকে ব্যবহার উপযোগী করেছেন, যাতে তোমরা সেখান থেকে তাজা মাছ খেতে পারো এবং একই সাথে সেখান থেকে মণি-মুক্তা আহরণ করে গয়না হিসেবে পরিধানও করতে পারো। (সূরা নাহল: ১৪)
এই আয়াত অনুযায়ী, সমুদ্রের উপযোগিতা স্রেফ শরীরের জন্য উপকারী তাজা মাছ খাওয়ার মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। এর পাশাপাশি অলঙ্কারের কথাও বলা হয়েছে। অলঙ্কার ব্যবহারের উদ্দেশ্যই তো সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তোলা। যা পরিধান করলে চোখ ও অন্তর জুড়িয়ে আসে।
এই দৃষ্টিভঙ্গিটি আল্লাহ তায়ালা কোরআনে বার বার বলেছেন। বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদ, খেজুর, আঙুর, জলপাই ও আনার গাছ এবং এসব গাছের ফলের উদাহরণ দিতে গিয়েও এই দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হয়েছে। যেমন, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
كُلُوا مِن ثَمَرِهِ إِذَا أَثْمَرَ وَآتُوا حَقَّهُ يَوْمَ حَصَادِهِ وَلَا تُسْرِفُوا إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ
এগুলো যখন ফলবান হয় তখন তোমরা এসব ফল খাও, আর ফসল তোলার দিনে (যে বঞ্চিত) তার হক ঠিকঠাক মতো আদায় করো। আর অপচয় করো না। তিনি নিশ্চয় অপচয়কারীদের ভালোবাসেন না। (সূরা আনআম: ১৪১)
একই সূরার অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন ফসল, খেজুর ও আঙুর উদ্যানের কথা উল্লেখ করার পর বলেছেন,
انظُرُوا إِلَىٰ ثَمَرِهِ إِذَا أَثْمَرَ وَيَنْعِهِ إِنَّ فِي ذَٰلِكُمْ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ
যখন তা ফলবান হয় এবং ফলগুলো পাকতে শুরু করে, তখন তোমরা এই সৃষ্টি নৈপুণ্য দেখো। ঈমানদারদের জন্য নিশ্চয় এতে বহু নিদর্শন রয়েছে। (সূরা আনআম: ৯৯)
ফল খাওয়ার মাধ্যমে যেমন মানুষের দৈহিক চাহিদা পূরণ হয়, তেমনি পরিপক্ক ফলের সৃষ্টি নৈপুণ্য উপভোগ করাও এক ধরনের মনের খোরাক। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বুঝা যায়, স্রেফ উদরপূর্তিই মানুষের একমাত্র কাজ নয়।
একইভাবে আল্লাহ তায়ালা আরো বলেছেন,
يَا بَنِي آدَمَ خُذُوا زِينَتَكُمْ عِندَ كُلِّ مَسْجِدٍ وَكُلُوا وَاشْرَبُوا وَلَا تُسْرِفُوا إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ * قُلْ مَنْ حَرَّمَ زِينَةَ اللَّـهِ الَّتِي أَخْرَجَ لِعِبَادِهِ وَالطَّيِّبَاتِ مِنَ الرِّزْقِ
হে আদম সন্তানেরা! প্রত্যেক ইবাদতের সময় তোমরা সুন্দর সাজে সজ্জিত হও। তোমরা খাও এবং পান করো, কিন্তু অপচয় করো না। কারণ, আল্লাহ অপচয়কারীদের মোটেও ভালোবাসেন না। হে রাসূল! আপনি জিজ্ঞেস করুন– আল্লাহর অলংকার, যা তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য তৈরি করেছেন এবং পবিত্র রিজিককে কারা হারাম করে বসলো? (সূরা আরাফ: ৩১-৩২)
সাজসজ্জা মানুষের মনের খোরাক, আর খাওয়া-দাওয়া হলো দেহের খোরাক। দুটোই সমান গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ প্রদত্ত সৌন্দর্যের উপকরণ ও রিজিক হারাম গণ্য করাকে উপরে উল্লেখিত দ্বিতীয় আয়াতে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। ‘আল্লাহর অলংকার’ (যিনাতুল্লাহ) বলতে সৌন্দর্যের এমন উপকরণকে বুঝানো হয়েছে, যা তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য তৈরি করেছেন। ‘পবিত্র রিজিকের’ ক্ষেত্রেও একই কথা। এছাড়া আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়। সেটি হলো, ‘অলংকার’ শব্দটি ‘আল্লাহ’ শব্দের সাথে সম্পৃক্ত করে সাজসজ্জাকে মর্যাদা দেয়া হয়েছে।
উপর্যুক্ত আয়াত দুটির একটু আগে একই সূরায় পোশাক-পরিচ্ছদ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
يَا بَنِي آدَمَ قَدْ أَنزَلْنَا عَلَيْكُمْ لِبَاسًا يُوَارِي سَوْآتِكُمْ وَرِيشًا وَلِبَاسُ التَّقْوَىٰ ذَٰلِكَ خَيْرٌ
হে আদমের সন্তানেরা! আমি তোমাদেরকে পোশাক-পরিচ্ছদ প্রদান করেছি, যেন তোমরা তোমাদের লজ্জাস্থানগুলো ঢেকে রাখতে পারো এবং নিজেদের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে পারো। তবে তাকওয়ার পোশাকই উত্তম। (সূরা আরাফ: ২৬)
আল্লাহ তায়ালা অনুগ্রহ করে আমাদেরকে যে পোশাক-পরিচ্ছদ দিয়েছেন, আলোচ্য আয়াতে একে কয়েক ভাগে ভাগ করা হয়েছে। অথবা বলা যায়, আয়াতটিতে পোশাকের কিছু উদ্দেশ্য ঠিক করে দেয়া হয়েছে। আয়াতে ব্যবহৃত ‘যেন তোমরা লজ্জাস্থানগুলো ঢেকে রাখতে পারো’ বাক্যাংশ দ্বারা ‘সতর ঢাকার’ উদ্দেশ্য বুঝানো হয়েছে। আর ‘নিজেদের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে পারো’ বাক্যাংশ থেকে ‘সাজসজ্জার প্রয়োজনীয়তা’ বুঝা যায়। ‘তাকওয়ার পোশাক’[1] এই বাক্যাংশের ব্যবহার থেকে বুঝা যায়, গরম ও ঠাণ্ডা থেকে ‘বেঁচে থাকা’ পোশাকের আরেকটি উদ্দেশ্য।
প্রত্যেক মুমিন ব্যক্তিরই মানবিকতা, জীবন ও প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের গভীর উপলব্ধি থাকতে হবে:
কোরআন অধ্যয়নকারী মাত্রই জেনে থাকবেন– আকাশ, জমিন, পশুপাখি, মানুষ, এক কথায় মহাবিশ্বের সমস্ত কিছুর মাঝে যে সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে, কোরআন সে সম্পর্কে মুমিনের হৃদয়-মনে উপলব্ধি জাগ্রত করাতে চায়। যেমন আকাশের সৌন্দর্য সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
أَفَلَمْ يَنظُرُوا إِلَى السَّمَاءِ فَوْقَهُمْ كَيْفَ بَنَيْنَاهَا وَزَيَّنَّاهَا وَمَا لَهَا مِن فُرُوجٍ
তারা কি তাদের ওপরের আকাশটার দিকে একটু তাকিয়েও দেখে না যে, কীভাবে আমি একে তৈরি করেছি এবং সুশোভিত করেছি? এর কোথাও তো কোনো ফাটলও নেই। (সূরা ক্বাফ: ৬)
وَلَقَدْ جَعَلْنَا فِي السَّمَاءِ بُرُوجًا وَزَيَّنَّاهَا لِلنَّاظِرِينَ
আর আমি আকাশে তৈরি করে রেখেছি গম্বুজ এবং যারা দেখতে চায়, তাদের জন্য আকাশকে অপূর্ব সাজে সজ্জিত করেছি। (সূরা হিজর: ১৬)
তারপর পৃথিবী ও উদ্ভিদরাজি সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন,
وَالْأَرْضَ مَدَدْنَاهَا وَأَلْقَيْنَا فِيهَا رَوَاسِيَ وَأَنبَتْنَا فِيهَا مِن كُلِّ زَوْجٍ بَهِيجٍ
আর আমি জমিনকে বিছিয়ে দিয়েছি এবং এর মধ্যে স্থাপন করেছি অনড় পাহাড়সমূহ, আবার সেই জমিন থেকেই উদ্গত করেছি নয়নাভিরাম উদ্ভিদরাজি। (সূরা ক্বাফ: ৭)
أَنزَلَ لَكُم مِّنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَنبَتْنَا بِهِ حَدَائِقَ ذَاتَ بَهْجَةٍ
আর তিনি আকাশ থেকে তোমাদের জন্য পানি বর্ষণ করেন এবং তা দিয়ে মনোরম উদ্যান তৈরি করেন। (সূরা নামল: ৬০)
প্রাণীর সৌন্দর্য সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালার বক্তব্য একটু আগেই চতুষ্পদ প্রাণীর কথা প্রসংগে উল্লেখ করেছি। সেটি হলো,
وَلَكُمْ فِيهَا جَمَالٌ حِينَ تُرِيحُونَ وَحِينَ تَسْرَحُونَ
তোমরা যখন গোধূলী লগ্নে ওদেরকে ঘরে ফিরিয়ে আনো এবং প্রভাতে চারণভূমিতে নিয়ে যাও, তখন এর মাঝে তোমাদের জন্য রয়েছে সৌন্দর্য। (সূরা নাহল: ৬)
তারপর মানুষের সৌন্দর্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
وَصَوَّرَكُمْ فَأَحْسَنَ صُوَرَكُمْ
অতঃপর তিনি তোমাদের আকৃতি দিয়েছেন এবং আকৃতিকে করেছেন সৌন্দর্যমণ্ডিত। (সূরা তাগাবুন: ৩)
الَّذِي خَلَقَكَ فَسَوَّاكَ فَعَدَلَكَ* فِي أَيِّ صُورَةٍ مَّا شَاءَ رَكَّبَكَ
যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং পরিপূর্ণতা দিয়েছেন ও সুসামঞ্জস্য রূপে গড়ে তুলেছেন। তিনি যেমন চেয়েছেন, ঠিক সেভাবেই তোমাকে গঠন করেছেন। (সূরা ইনফিতার: ৭-৮)
একজন মুমিন এই সুবিশাল মহাবিশ্বের যেদিকেই তাকাবে, সেদিকেই আল্লাহর অপূর্ব সৃষ্টি নৈপুণ্য দেখতে পাবে। সৃষ্টির সৌন্দর্যের ভেতর দিয়ে সে আল্লাহর সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পারবে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
صُنْعَ اللَّـهِ الَّذِي أَتْقَنَ كُلَّ شَيْءٍ
এটি আল্লাহরই সৃষ্টি নৈপুণ্য, যিনি প্রতিটি জিনিসকে সুনিপুণভাবে তৈরি করেছেন। (সূরা নামল: ৮৮)
الَّذِي أَحْسَنَ كُلَّ شَيْءٍ خَلَقَهُ
যিনি তার প্রত্যেক সৃষ্টিকেই সর্বোত্তম রূপে তৈরি করেছেন। (সূরা সাজদাহ: ৭)
একজন মুমিন তার চারপাশের অস্তিত্বশীল সবকিছুর মধ্যকার সৌন্দর্যকে এ কারণেই ভালোবাসে, যেহেতু তা মহান আল্লাহ তায়ালার সৌন্দর্যেরই নিদর্শন।
একজন মুমিন এ কারণেই সৌন্দর্যকে ভালোবাসে, যেহেতু ‘আল-জামীল’ (চির সুন্দর) নামটি আল্লাহর সুন্দরতম নামসমূহ এবং সুমহান গুণাবলীসমূহের মধ্যে অন্যতম।
মুমিন ব্যক্তির সৌন্দর্যকে ভালোবাসার আরেকটি কারণ হলো স্বয়ং তার প্রভু। যেহেতু তিনি স্বয়ং সুন্দর এবং সৌন্দর্যকে ভালোবাসেন।
নিশ্চয় আল্লাহ সুন্দর এবং তিনি সৌন্দর্যকে ভালোবাসেন:
নিশ্চয়ই আল্লাহ সুন্দরতম এবং তিনি সৌন্দর্যকে ভালোবাসেন– এই শিক্ষাই মহানবী (সা) তাঁর সাহাবীদেরকে দিয়েছেন। অথচ অনেকে মনে করে সৌন্দর্যের প্রতি অনুরাগ থাকা বুঝি ঈমানের বিপরীত কিছু; কিংবা সৌন্দর্য চর্চাকারী ব্যক্তি আল্লাহ ও মানুষের কাছে অহংকারী হিসেবে সাব্যস্ত হন। এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা।
এ সম্পর্কে ইবনে মাসউদ (রা) বর্ণনা করেছেন: রাসূল (সা) বলেছেন, “যার অন্তরে অণু পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।” তখন এক ব্যক্তি বললো, প্রত্যেকেই তো চায় তার পোশাক-পরিচ্ছদ ও জুতো জোড়া সুন্দর দেখাক (অন্য অর্থে, এই সৌন্দর্য কামনা কি অহংকারের আওতায় পড়বে?– অনুবাদক)। প্রত্যুত্তরে আল্লাহর রাসূল (সা) বললেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ সুন্দরতম এবং তিনি সৌন্দর্যকে ভালোবাসেন। কিন্তু অহংকার হলো সত্যকে অস্বীকার করা এবং মানুষকে ছোট করে দেখা।”[2]
কোরআন একটি নান্দনিক মুজিযা
আল কোরআন হলো ইসলামের সবচেয়ে বড় নিদর্শন এবং আল্লাহর রাসূলের সুমহান মুজিযা। একে একটি নান্দনিক মুজিযা তথা বিস্ময়কর ব্যাপার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পাশাপাশি এটি বুদ্ধিবৃত্তিক মুজিযাও বটে। কোরআনের নান্দনিক প্রকাশভঙ্গির কারণে আরবরা ছিল বিস্মিত। এর চমৎকার ছন্দ ও রচনাশৈলী, অদ্বিতীয় বাচনভঙ্গি ও সুরে তারা ছিল মুগ্ধ। এমনকি কোরআন শোনার পর কেউ কেউ একে জাদু হিসেবে অভিহিত করেছিল।
কোরআনের বাচনভঙ্গির নান্দনিক মুজিযা নিয়ে অলংকারশাস্ত্রবিদ ও আরবী সাহিত্যিকগণ প্রচুর লেখালেখি করেছেন। আব্দুল কাহের থেকে শুরু করে সমসাময়িক কালের আল-রাফে, সাইয়েদ কুতুব, বিনতে শাতেয়ীসহ আরো অনেকে এ বিষয়ে লিখেছেন, লিখছেন।
তাছাড়া কাব্যিক ও সুরেলা কণ্ঠে তেলাওয়াত করার রীতিও কোরআনের চমৎকার বাচনভঙ্গি ও কাব্যিকতাকে নির্দেশ করে। এ কারণেই আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
وَرَتِّلِ الْقُرْآنَ تَرْتِيلًا
তুমি তারতীল সহকারে কোরআন তেলাওয়াত করো। (সূরা মুজ্জাম্মিল: ৪)
আর রাসূল (সা) বলেছেন, “তোমরা সুললিত কণ্ঠে কোরআন তেলাওয়াত করো।”[3] আরেকটি সূত্র অনুযায়ী তিনি বলেছেন, “সুললিত কণ্ঠ কোরআনের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তোলে।”[4]
তিনি আরো বলেছেন, “যে ব্যক্তি সুর করে কোরআন পড়ে না, সে আমাদের কেউ নয়।”[5] তবে সুর করে পড়ার মানে এই নয় যে, তেলাওয়াত করতে গিয়ে মশকরা কিংবা বিকৃতি করা যাবে।
আরেকটি হাদীস রয়েছে যেখানে রাসূল (সা) আবু মুসাকে (রা) বলছিলেন, “গতরাতে আমি তোমার তেলাওয়াত শুনছিলাম, তুমি যদি তা দেখতে পেতে (তাহলে নিশ্চয় খুশি হতে)। কী সৌভাগ্য তোমার, দাউদের (আ) মতো সুরেলা কণ্ঠ তোমাকে দেয়া হয়েছে!” এ কথা শুনে আবু মুসা বললেন, “আমি যদি জানতাম, আপনি আমার তেলাওয়ান শুনছিলেন, তাহলে আপনাকে খুশি করতে আমি আরো সুন্দর করে তেলাওয়াত করতাম।”[6] অর্থাৎ, তাজবীদ মেনে আরো শুদ্ধভাবে সুললিত কণ্ঠে তেলাওয়াত করতাম।
রাসূল (সা) আরো বলেছেন, “একজন নবীর উচ্চস্বরে সুললিত কণ্ঠের তেলাওয়াত আল্লাহ যেভাবে শুনেন, আর কোনো কিছু সেভাবে শুনেন না।[7]
শায়খ ড. মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ দারায ছিলেন একটি রেডিওর এক্সিকিউটিভ কমিটির সদস্য। কমিটির একটি বৈঠকের গল্প তিনি একবার আমাদেরকে শুনিয়েছিলেন। নিছক দ্বীনি কাজ হিসেবে প্রতিদিন রেডিও অনুষ্ঠান সম্প্রচারের শুরুতে ও শেষে এবং অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে কোরআন তেলাওয়াত সম্প্রচার করার ইচ্ছা ছিল তাদের। এ কথা শুনে তিনি তাদেরকে বললেন, নিছক কোরআন শোনাটাই যথেষ্ট নয়। কোরআনের শিল্প ও সৌন্দর্য উপভোগ করাও দ্বীনের অংশ। তাই তেলাওয়াত হতে হবে সুললিত কণ্ঠে।
শায়খের কথাটি একদম সত্য। কোরআন হলো একই সাথে দ্বীন, জ্ঞান, সাহিত্য ও শিল্পকলার সমন্বয়। এটি আত্মার রসদ যোগায়, মনকে তৃপ্ত করে, বিবেককে জাগ্রত রাখে, আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ ঘটায় ও ভাষাকে পরিশুদ্ধ করে।
সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ
ইসলাম যেহেতু সৌন্দর্যের কথা বলে, সৌন্দর্যকে উপভোগ করতে বলে, ভালোবাসতে বলে; তাহলে নিশ্চয় সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটানো, একে উপভোগ করা ও ভালোবাসা আরো বেশি সুন্দর কাজ।
সাহিত্য ও শিল্পকলা
গদ্য ও পদ্য ছাড়াও শিল্পকলার অনেক শাখা-প্রশাখা রয়েছে। মাকামাত (আরবী গদ্য সাহিত্যের একটি ধরন), কাসিদা, মহাকাব্য ইত্যাদি। মহানবী (সা) কবিতা শুনতেন। এগুলো তিনি পছন্দ করতেন। তিনি কাব বিন যুহায়িরের বিখ্যাত কাসিদা ‘বানাত সুয়াদ’ পর্যন্ত শুনেছেন। আমরা জানি, সেই কাসিদায় একটি প্রেমকাব্যও ছিল। এছাড়া তিনি নাবিগা আল-জুদীর কাসিদা শুনে তার জন্য দোয়া করেছিলেন। দাওয়াতী কাজকে বেগবান করতে তিনি কবিতাকে কাজে লাগিয়েছেন। হাসসান বিন সাবিতের (রা) বাগ্মিতার কথা এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে। রাসূল (সা) কথা বলার সময় কবিতার উদ্ধৃতিও দিতেন। যেমন তিনি বলেছেন, “সবচেয়ে বড় সত্য কথা হলো, যা লাবীদ বলেছে– আল্লাহ ছাড়া বাকি সবকিছুই বাতিল।”[8]
সাহাবীরাও কথাবার্তায় কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দিতেন। কোরআনের অর্থ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তাঁরা এটি করতেন। কেউ কেউ চমৎকার আবৃত্তি করতে পারতেন। উদাহরণ হিসেবে আলীর (রা) কথা বলা যেতে পারে। আসলে সাহাবীদের অনেকেই কবি ছিলেন।
ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনে মোবারক, ইমাম শাফেয়ীসহ আয়িম্মায়ে কেরামদেরও অনেকে কবি ছিলেন।
এ প্রসঙ্গে রাসূলের (সা) কয়েকটি হাদীস রয়েছে। যেমন–
“নিশ্চয় কিছু কবিতায় রয়েছে প্রজ্ঞা।”[9]
“নিশ্চয় কিছু কিছু কথায় রয়েছে মুগ্ধতা।”[10]
“নিশ্চয়ই কিছু কথায় রয়েছে মুগ্ধতা, আর কিছু কবিতায় রয়েছে প্রজ্ঞা।”[11]
উক্ত হাদীসগুলো থেকে পরোক্ষভাবে এটাও বোঝা যায়– কিছু কিছু কবিতায় হিকমাহ তথা প্রজ্ঞার মোটেও কোনো ছাপ থাকে না। এসব কবিতা সম্পূর্ণভাবে প্রজ্ঞার বিপরীত। অন্যায়ের পক্ষে স্তুতিমূলক কবিতা, মিথ্যা অহংবোধপূর্ণ কাব্য, বাড়াবাড়ি ধরনের ব্যঙ্গাত্মক কবিতা, অশ্লীল কবিতাসহ আমাদের নৈতিক মূল্যবোধের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ কবিতা এর উদাহরণ।
এ কারণেই কোরআন এমনসব ভ্রষ্ট কবিদের নিন্দা করেছে। কারণ যে কোনো মাত্রার লাগামহীন কথাবার্তা বলে ফেলতে এ ধরনের লোকেরা কোনো দ্বিধা করে না। এদের কথা ও কাজের মধ্যে কোনো মিল থাকে না। তাই আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
وَالشُّعَرَاءُ يَتَّبِعُهُمُ الْغَاوُونَ. أَلَمْ تَرَ أَنَّهُمْ فِي كُلِّ وَادٍ يَهِيمُونَ. وَأَنَّهُمْ يَقُولُونَ مَا لَا يَفْعَلُونَ. إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَذَكَرُوا اللَّـهَ كَثِيرًا وَانتَصَرُوا مِن بَعْدِ مَا ظُلِمُوا
কবিদের অনুসরণ করে বিভ্রান্ত ব্যক্তিরা। তুমি কি দেখনি যে, তারা (কবিরা) প্রত্যেক উপত্যকায় উদ্ভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায় (প্রত্যেক বিষয়ে সত্য-মিথ্যা কথা বলে)? এবং (দেখনি যে,) তারা তাই বলে যা নিজেরা করে না? তবে তাদের কথা ভিন্ন, যারা (সত্যে) বিশ্বাস করে, সৎকাজ করে, আল্লাহকে বেশি করে স্মরণ করে এবং অত্যাচারিত হলে প্রতিশোধ গ্রহণ করে। (আশ-শু’আরা: ২২৪-২২৭)
কবিতা বা সাধারণত সাহিত্য কিংবা আরেকটু এগিয়ে বললে শিল্পকলার নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ও প্রায়োগিক দিক রয়েছে। যেসব কবিতা, সাহিত্য বা শিল্পকলার দায়বদ্ধতা রয়েছে, এক্ষেত্রে শুধু তাদের কথাই বলা হচ্ছে। অন্যদের কথা আলাদা।
কবিতা বা সাহিত্যের উপরিকাঠামোর পরিবর্তন বা বিবর্তনে কিছু আসে যায় না। এমনকি অন্যদের কাছ থেকে আমাদের জন্য উপযোগী কোনো কিছু গ্রহণ করতেও সমস্যা নেই। এসবের উদ্দেশ্য, বিষয়বস্তু এবং প্রায়োগিক দিকের প্রতি খেয়াল রাখাই হলো গুরুত্বপূর্ণ।
অতীতে আরবরা আন্দালুসিয়ায় কবিতার ক্ষেত্রে ‘মুওয়াশশাহাত’সহ (স্তবকে স্তবকে বিন্যস্ত একাধিক অন্ত্যমিলবিশিষ্ট এক প্রকার আরবী কবিতা) বিভিন্ন কাঠামো আবিষ্কার করেছিল। তাই বর্তমানকালের আধুনিক কবিতার কাঠামো গ্রহণ করতেও আমাদের কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়। যেমন সাম্প্রতিক কালের ‘গদ্য কবিতা’র কথা বলা যায়। কবিতার বিষয়বস্তু শরীয়াহর আলোকে গ্রহণযোগ্য হলে এ ধরনের কাঠামো গ্রহণ করতে কোনো আপত্তি নেই।
একইভাবে আরবরা ইসলামী যুগে কবিতা ছাড়াও সাহিত্যের অন্যান্য ক্ষেত্রে বিভিন্ন কাঠামো আবিষ্কার করেছিল। উদাহরণ হিসেবে ‘মাকামাত’-এর কথা বলা যায়। ‘রিসালাতুল গোফরান’, ‘আলিফ লায়লা ওয়া লায়লা’ ইত্যাদি আরবদের রূপকথা সাহিত্যের নিদর্শন। এছাড়া ‘কালীলাতু ওয়া দিমনাহ’র মতো কাল্পনিক উপন্যাসের অনুবাদও তারা করেছে। পরবর্তীতে আরব সাহিত্যিকরা লোকমুখে জনপ্রিয় গল্পের আলোকে মহাকাব্য রচনা করেছে। যেমন ইসলামপূর্ব যুগের আরব বীর আন্তারা ইবনে শাদ্দাদের কাহিনী নিয়ে রচিত মহাকাব্য ‘আন্তারা’, এক আরব গোত্রের ইতিহাস নিয়ে রচিত মহাকাব্য ‘বনু হেলাল’। এছাড়াও আরবী সাহিত্যে আরো নতুন নতুন কাঠামো তারা তৈরি করেছে।
অতএব, আমাদের যুগের প্রয়োজনে আমরা সাহিত্যের নতুন নতুন কাঠামো তৈরি করতে পারি। পাশাপাশি অন্যদের থেকে আমাদের উপযোগী নাটক, উপনস্যা ও ছোটগল্প নিতে পারি।
আরেকটি বিষয় হলো, আরবীতে সাহিত্য চর্চায় আগ্রহীদের উচিত শুদ্ধ, সাবলীল ও প্রমিত আরবীতে সাহিত্য চর্চা করা। দ্ব্যর্থবোধক ও জগাখিচুড়ি মার্কা আঞ্চলিক আরবী ভাষা ব্যবহার করা থেকে তাদেরকে সতর্ক থাকতে বলবো। কারণ, এ ধরনের ভাষার ব্যবহার কোরআন-সুন্নাহ বোঝা থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে দেয়। এছাড়া আঞ্চলিক ভাষা চর্চা বিভক্তি ও বিচ্ছিন্নতাকে উসকে দেয়। এই আঞ্চলিকতা সর্বদাই ইসলাম ও আরব জাতীয়তার মাঝে বৈরীতা তৈরি এবং পোক্ত করতে ও জিইয়ে রাখতে চায়।
সাহিত্য চর্চার ভাষা সহজ ও সরল হওয়া বাঞ্ছনীয়, যা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে। কেননা, এই সহজ ভাষাতেই প্রতিদিন রেডিও-টেলিভিশনে খবর সম্প্রচারিত হয়। এই ভাষাতেই দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। মানুষ এই সহজ ভাষায় অভ্যস্ত।
তাছাড়া প্রমিত ও বিশুদ্ধ আরবী ভাষাই আরব ও অন্যান্য দেশের আরবী জানা মুসলমানদেরকে কাছাকাছি নিয়ে আসতে সক্ষম। কারণ, অন্য দেশের মুসলমানরা কেবল প্রমিত আরবীটাই শেখে। তাদের পক্ষে প্রমিত আরবী ছাড়া অন্যান্য আঞ্চলিক আরবী বুঝা সম্ভব নয়।
ইসলামী সাহিত্যের নানা ধরন নিয়ে আমার কাছে লোকজন বিভিন্ন সময় জানতে চেয়েছে। যেমন, গল্প ও নাটকের কথাই বলা যাক। গল্পকার ও নাট্যকারগণ সচরাচর এমনসব চরিত্র, বক্তব্য ও ঘটনা তুলে নিয়ে আসেন, বাস্তবে যেসবের ভিত্তি থাকে না। তাহলে কি এসব সেই মিথ্যার চক্রে পড়ে যাবে, শরীয়াহর মধ্যে যাকে হারাম করা হয়েছে?
আমার উত্তর ছিলো এসব বিষয় নিষিদ্ধ মিথ্যার অন্তর্ভুক্ত নয়। কারণ, পাঠক বা শ্রোতা ভালো করেই জানেন, বাস্তবে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনাকে এসব গল্প বা নাটকের মাধ্যমে উপস্থাপন করাটা উদ্দেশ্য নয়। এটি অনেকটা পশু-পাখির মুখ দিয়ে কথা বলানোর মতো ব্যাপার। এটি মূলত এক ধরনের শৈল্পিক চিত্রায়ণ। অর্থাৎ, কতগুলো চরিত্রের মাধ্যমে এমনসব সংলাপ বলানো, ওই ধরনের পরিস্থিতিতে সেই চরিত্রগুলো সাধারণত যা বলত বা বলতে বাধ্য হতো। পিঁপড়ার কথা বলা কিংবা সোলায়মানের (আ) সামনে হুদহুদের কথা বলার বিষয়টি কোরআন যেভাবে বর্ণনা করেছে, বিষয়টি অনেকটা সে ধরনের। পিঁপড়া বা হুদহুদ সুস্পষ্ট আরবী ভাষায় কথা বলেনি, এটা নিশ্চিত। ওই সময় ও পরিস্থিতিতে তাদের বলা সম্ভাব্য কথাকে কোরআন আরবীতে অনুবাদ করেছে মাত্র।
আমি নিজেও দুটি নাটক রচনা করেছিলাম। প্রথমটি ছিল ইউসুফকে (আ) নিয়ে রচিত একটি কাব্যনাট্য। আমি তখন মাধ্যমিক প্রথম বর্ষে পড়ি। আমার সাহিত্য জীবনের শুরুতে এটি রচিত। প্রখ্যাত নাট্যকার আহমদ শাওকীর নামডাক দেখে আমি তখন প্রভাবিত ছিলাম। আর দ্বিতীয়টি ছিল সাঈদ বিন জোবায়ের ও হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে কেন্দ্র করে লেখা একটি ইতিহাস আশ্রিত নাটক। এর নাম ছিল ‘আলিম ওয়া ত্বগিয়াহ’ (আলেম ও স্বৈরাচারী)। নাটকটি তখন বেশ সমাদৃত হয়। একাধিক দেশে এটি মঞ্চস্থ করা হয়েছিল। তবে প্রথম নাটকটির বেলায় তা হয়নি। কারণ, সেটি রচিত হয়েছিল একজন নবীর জীবনীকে ঘিরে। আর নবীদের চিত্র চরিত্রায়নের নিষিদ্ধতার ব্যাপারে সমসাময়িক আলেমগণ মোটামুটি একমত।
শ্রবণের নন্দনতত্ত্ব (গান ও বাদ্যযন্ত্র)
ইতোপূর্বে কোরআন ও হাদীসের বিভিন্ন দলীল উল্লেখ করে যে আলোচনা করেছি তাতে পরিষ্কার বুঝা যায়, সৌন্দর্যের ব্যাপারে ইসলাম বেশ মনোযোগী। সৌন্দর্য অনুভব ও উপভোগ করার জন্য ইসলাম মানুষকে নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করে।
আর এই সৌন্দর্যের উপকরণগুলোর কিছু উপাদান শোনার অনুভূতির সাথে সম্পৃক্ত, কিছু দেখার অনুভূতির সাথে সম্পৃক্ত, আর কিছু অন্যান্য অনুভূতির সাথে সম্পৃক্ত।
আমরা এখানে ‘শ্রবণের নন্দনতত্ত্ব তথা সৌন্দর্য’ নিয়ে আলোচনা করবো। অন্য কথায়, গান (বাদ্যযন্ত্র থাকুক বা না থাকুক) নিয়ে আলোচনা করবো। কারণ, সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্র সম্পর্কে ইসলামের বিধান কী?– এই বিশাল প্রশ্নটির একটা ফয়সালা করা আমাদের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে।
সঙ্গীতের শাব্দিক অর্থ
আরবী ভাষায় ‘আল-গিনা’ তথা সঙ্গীত বলতে কী বুঝায়, তার একটা ভাষাতাত্ত্বিক পর্যালোচনা করা যাক।
‘কামুসু ওয়া শরহাহ’ অভিধানে বলা হয়েছে, ‘কিসা’ (كِسَاء) তথা পোশাকের মাধ্যমে যেমন সৌন্দর্য প্রকাশ পায়, ‘আল-গিনা’ (الغِنَاء) তেমনি একটি ব্যাপার। অর্থাৎ, এর মাধ্যমে মনের উচ্ছাস প্রকাশিত হয়।
‘আস-সিহাহ’ অভিধানে বলা হয়েছে, ‘আল-গিনা’র (الغِنَاء) মূল শব্দরূপের প্রথম অক্ষরটি যের দিয়ে পড়তে হবে। শব্দটির অর্থ হলো, গান জাতীয় এমন কিছু যা শোনা হয়।
‘আন-নিহায়াহ’ অভিধানে বলা হয়েছে, ‘গিনা’ শব্দটির মানে হলো স্বরকে উঁচু করা এবং পর্যায়ক্রমিকভাবে তা অব্যাহত রাখা।
আবু সোলাইমান খাত্তাবী (রাহ.) বলেছেন, কেউ উচ্চস্বরে কোনো কিছু বার বার গাইতে থাকলে আরবে তাকে গান বলা হয়, যাতে নির্দিষ্ট বিরতিতে বাদ্য বাজানো হয়, কিংবা তাতে থাকে মোহনীয় ছন্দ ও সুর। এজন্য বলা হয়, কবুতর গান গেয়েছে বা পাখি গান গায়।
কবি মাজনুনের একটি কবিতার কিছু লাইন এ রকম:
এই সকালে আল্লাহ মারুন কইতরকে,
গাছের শাখে গান গেয়ে মোর মন জাগালো,
অবোধ স্বরে গান গেয়ে মোর প্রেম জাগালো,
বুকের পাঁজর কেঁদেই মরে যার গোমকে
ইবনুল কাওতিয়া তার গ্রন্থে হ্রস্বস্বর ও দীর্ঘস্বর সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন: যা দীর্ঘস্বরের, সেগুলো গান।
ফাররা গেয়েছেন:
গান গেয়ে যাও তোমার বলা পংক্তি মালায়,
এই চরণে গানের লিপি সুর মিলে যায়।[12]
‘আল-মুহ্কাম’ গ্রন্থে ‘গিনা’ (الغِنَاء) শব্দটির ব্যবহার গান হিসেবে এসেছে। যেমন: সে কবিতা দিয়ে গান বাঁধলো এবং গুনগুন করে গাইলো, কিংবা তারা সম্মিলিতভাবে গীত গাইলো।
ইসলামে সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্রের বিধান কী?
এই প্রশ্নটি যুগে যুগে দুনিয়ার অসংখ্য মানুষের। এই প্রশ্নটির জবাব নিয়ে মুসলমানরা এখন বিভক্ত হয়ে পড়েছে। ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাদের আচার-ব্যবহারেও পার্থক্য তৈরি হয়েছে।
একদল যে কোনো ধরনের গান শুনে থাকে। কোনো গানেই তাদের আপত্তি নেই। তাদের দাবি অনুযায়ী এগুলো জীবনযাপনের চমৎকার উপাদান, যা আল্লাহ তার বান্দাদের জন্য যা হালাল করেছেন।
আরেক দল রেডিও অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে সব ধরনের গান শোনা থেকে বিরত থাকে। তাদের মতে, গান হলো শয়তানের বাঁশি, অর্থহীন কাজ ও কথাবার্তা। কারণ, এটি মানুষকে আল্লাহর স্মরণ ও নামাজ থেকে বিরত রাখে। আর গানের শিল্পী যদি নারী হয়, তাহলে তো কথাই নেই। তাদের মতে, যেখানে নারীদের কণ্ঠস্বর পর্দার (আওরাহ) অন্তর্ভুক্ত, সেখানে নারী কণ্ঠে গান কীভাবে জায়েজ হতে পারে? তাদের এই অবস্থানের পক্ষে তারা কোরআন, হাদীস ও সাহাবী-তাবেয়ীদের উক্তিকে রেফারেন্স হিসেবে উল্লেখ করেন। তাদের মধ্যে আরেকটি উপদল রয়েছে, যারা যে কোনো ধরনের বাজনাকেই অবৈধ মনে করে। এমনকি খবরের শুরুতে যে মিউজিক বাজানো হয়, সেটিকেও তারা জায়েজ মনে করে না।
তৃতীয় আরেকটি পক্ষ রয়েছে, যারা মূলত উপরোল্লিখিত দল দুটির মাঝে পরে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। একবার তারা প্রথম দলের পক্ষ নেয়, আরেকবার দ্বিতীয় দলের পক্ষ নেয়। এখন ঘরে ঘরে রেডিও-টিভি চলে এসেছে। হাসিঠাট্টা বলুন কিংবা সিরিয়াস কাজ বলুন, রেডিও-টিভি এখন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে গেছে। ফলে ইচ্ছা-অনিচ্ছায় মানুষকে গান ও মিউজিক শুনতে হচ্ছে। তাই ঘরে রেডিও-টিভি রাখার ব্যাপারে আলেমদের কাছ থেকে তারা সোজাসাপ্টা জবাব পেতে চায়।
মিউজিক থাকুক বা না থাকুক– শুধু গান নিয়েই প্রাথমিক যুগের আলেমদের মধ্যে বিতর্ক ও মতভেদ ছিল। তারা কিছু বিষয়ে একমত হতে পেরেছিলেন, আবার কিছু বিষয়ে পারেননি।
যেসব গানে অশ্লীলতা, পাপাচার ও পাপাচারের সুড়সুড়ি থাকে, সেসব গান হারাম হওয়ার ব্যাপারে আলেমগণ একমত হয়েছেন। আসলে গান তো কিছু কথামালার সমষ্টি মাত্র। ফলে এর যা কিছু ভালো সেগুলোকে ভালো এবং যা কিছু মন্দ সেসবকে মন্দ হিসেবই নিতে হবে। তাই কোনো গানের কথায় হারাম উপাদান থাকলে স্বভাবতই তা হারাম বিবেচিত হবে। সে ধরনের গানে সুর ও মিউজিক যোগ করা হলো কি হলো না, তাতে কি আসে যায়?
মিউজিক, যৌনতা ও পাপাচারের সুড়সুড়িমুক্ত স্বাভাবিক গানের বৈধতার ব্যাপারে আলেমগণ একমত পোষণ করেছেন। যেমন: বিয়ে অনুষ্ঠান, বিশেষ কোনো অতিথির আগমন এবং দুই ঈদসহ শরীয়তসম্মত বিভিন্ন উপলক্ষ্য, যেখানে লোকেরা আনন্দ-ফুর্তি করে থাকে। তবে এখানেও তারা একটি শর্ত দিয়েছেন। সেটি হলো, এসব ক্ষেত্রে অপরিচিত মানুষের সামনে কোনো নারী গান গাইতে পারবে না।
এর স্বপক্ষে সুস্পষ্ট দলীল রয়েছে, যা আমরা পরবর্তীতে তুলে ধরবো।
যা হোক, এই ঐক্যমতের বাইরে বিষয়টি নিয়ে আলেমদের মধ্যে সুস্পষ্ট মতপার্থক্যও রয়েছে। মিউজিক থাকুক বা না থাকুক, সব ধরনের গানকেই কোনো কোনো আলেম বৈধ সাব্যস্ত করেছেন। কেউ কেউ একে মুস্তাহাব বলেও মনে করেন। আবার অনেকে মিউজিক গানকে নিষিদ্ধ মনে করেন, তবে মিউজিকবিহীন গানকে বৈধ মনে করেন। আলেমদের আরেকটি পক্ষ মিউজিক বা মিউজিকবিহীন সব ধরনের গানকে হারাম মনে করেন। তারা একে কবীরা গোনাহ হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন।
বিষয়টির গুরুত্বের কারণে সঙ্গীত নিয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করার একটা দায়িত্ববোধ আমি অনুভব করেছি। বিষয়টি আমি এতটা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরতে চাই, যাতে মুসলমানরা কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির মতের উপর নির্ভরশীল না থেকে সুস্পষ্ট দলীলের ভিত্তিতে সঙ্গীতের হালাল ও হারাম দিকগুলোর মধ্যে পার্থক্য করতে পারে। এতে করে মুসলমানরা বিষয়টি সম্পর্ক স্পষ্ট ধারণা লাভ করতে পারবে এবং এ ব্যাপারে ইসলামের অবস্থান সম্পর্কেও অবগত হতে পারবে।
মানুষ যখন নানান মত ও পথে ঘুরপাক খেতে খেতে সঠিক রাস্তা হারিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়; তখন সবুজ বাতি জ্বালিয়ে মানুষকে সঠিক পথ দেখিয়ে দেয়া কিংবা লাল বাতি জ্বালিয়ে ভুল পথ থেকে বিরত রাখাই হলো আলেমদের কাজ। আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রার্থনা, আমরা যেন সত্যকে সত্য হিসেবে চিনতে পারি এবং তা মেনে চলতে পারি। একই সাথে আমরা যেন মিথ্যাকে মিথ্যা হিসেবে চিনতে পারি এবং তা বর্জন করতে পারি। মহান আল্লাহ আমাদেরকে সেই তওফিক দান করুন।
সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্রকে যারা হারাম সাব্যস্ত করেছেন, তাদের উত্থাপিত দলীল ও যুক্তিগুলো আমরা প্রথমে বিশ্লেষণ করবো। তারপর যারা একে হালাল সাব্যস্ত করেছেন, তাদের উত্থাপিত দলীল ও যুক্তিগুলো বিশ্লেষণ করবো। সবশেষে দলীল-প্রমাণ ও শরীয়াহর আলোকে যে মতামতটি তুলনামূলক বেশি শক্তিশালী, আমরা তাকে প্রাধান্য দেবো।
[মূল: ইউসুফ আল-কারযাভী, অনুবাদ: শাইখুল আবরার]
বাকি পর্বগুলো পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রেফারেন্স ও নোট:
[1] আয়াতে ব্যবহৃতে আরবী বাক্যাংশ হলো ولباس التقوى (লিবাসুত তাকওয়া)। তাকওয়া শব্দের রুট হচ্ছে وقى (ওয়াকায়া), যার অর্থ বাঁচানো, রক্ষা করা ইত্যাদি। লেখক এখানে শাব্দিক অর্থকেই ইঙ্গিত করেছেন। – সম্পাদক
[2] সহীহ মুসলিম
[3] সহীহ মুসলিম।
[4] প্রথমে বর্ণনাটি ইমাম আহমদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, ইবনে হিব্বান এবং দারেমী তাঁদের গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। পরবর্তীতে দারেমী ও হাকিম বর্ণনাটি উল্লেখ করেছেন। প্রত্যেকেই আল-বারা’র বরাতে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। দেখুন, সহীহ জামে আস সগীর (হাদীস নং– ৩৫৮০ ও ৩৫৮১)।
[5] আবু হুরাইরার (রা) বরাতে ইমাম বুখারী হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। এছাড়া আরো অনেক গ্রন্থে বিভিন্ন সাহাবীর বরাতে হাদীসটির উল্লেখ রয়েছে।
[6] আবু মুসার (রা) বরাতে ইমাম মুসলিম হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। এছাড়া ইমাম বুখারীসহ আরো অনেকে ভিন্ন ভিন্ন সাহাবীর বরাতে বিভিন্ন আঙ্গিকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
[7] ইমাম আহমদ, বুখারী, মুসলিম, আবূ দাঊদ ও নাসাঈ আবু হুরাইরার (রা) বরাতে হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। দেখুন, সহীহ জামে আস সগীর (হাদীস নং– ৫৫২৫)।
[8] আবু হুরাইরার (রা) বরাতে সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত।
[9] উবাই ইবনে কাবের (রা) বর্ণনা অনুযায়ী সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত। এছাড়া একদল সাহাবীদের নিকট থেকেও অনুরূপ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। দেখুন, সহীহ জামে আস সাগীর (হাদীস নম্বর– ২২১৯)।
[10] ইবনে ওমরের (রা) বরাত দিয়ে ইমাম মালেক, আহমদ, বুখারী, আবু দাউদ এবং তিরমিযী তাঁদের স্ব স্ব গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। দেখুন, প্রাগুক্ত (হাদীস নং– ২২১৬)।
[11] ইবনে আব্বাসের (রা) বরাতে আহমদ ও আবু দাউদ তাঁদের নিজ নিজ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। দেখুন, প্রাগুক্ত (হাদীস নং– ২২১৫)।
[12] এই লাইন দুটি লেখকের নাম ছাড়াই লিসানুল আরবে উল্লেখ করা হয়েছে। দেখুন, ১৯তম খণ্ড, ৩৭৬ পৃ.।