ফেতুল্লাহ গুলেন ও তাঁর আন্দোলন
এডিটর’স নোট: তুরস্কভিত্তিক সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলন গুলেন মুভমেন্টের পুরোধা ফেতুল্লাহ গুলেন। আধুনিক তুরস্ক নিয়ে পড়াশোনা করতে গেলে গুলেন ও তাঁর আন্দোলনকে পাশ কাটানোর সুযোগ নেই। তুরস্কে গুলেনের প্রচুর সমর্থক যেমন রয়েছে, তেমনি তাঁর বিরোধীও কম নয়। ক্ষমতাসীন একেপির সাথে গুলেনের সাম্প্রতিক বিরোধ প্রায়ই পত্রিকার শিরোনাম হয়। একেপিপন্থীদের অভিযোগ, গুলেন সেক্যুলারদের সহায়তা করছেন, তিনি ইহুদীদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন। এসব অভিযোগের বিপরীতে গুলেনপন্থীরা তাঁকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন, তাও জানা দরকার। গুলেন মুভমেন্টের উপর The Vision and Impact of Fethullah Gulen: A New Paradigm of Social Activism শিরোনামে নিরীক্ষাধর্মী একটি বই লিখেছেন ড. মাইমুল আহসান খান। বইটির ভূমিকায় লেখক সংক্ষেপে ফেতুল্লাহ গুলেন ও গুলেন মুভমেন্টের তৎপরতা তুলে ধরেছেন। সিএসসিএস-এর পাঠকদের জন্য ভূমিকাটুকু অনুবাদ করেছেন ইব্রাহিম হোসেন।
*****
বিগত কয়েক দশক যাবৎ আধুনিক তুরস্কে ফতেউল্লাহ গুলেন একটি পরিচিত নাম। আমেরিকান ম্যাগাজিন ‘ফরেন পলিসি’ ও ব্রিটেনের জনপ্রিয় ম্যাগাজিন ‘প্রসপেক্ট’ কর্তৃক পরিচালিত ২০০৮ সালের এক সিটিজেন জরিপ অনুযায়ী তিনি বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী বুদ্ধিজীবী হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। পূর্ব তুরস্কের কয়েকজন বিখ্যাত পণ্ডিত ও ধর্মগুরুর কাছে ধর্মবিজ্ঞানে প্রশিক্ষণ লাভের পাশাপাশি তিনি আধুনিক সমাজ ও ভৌতবিজ্ঞান অধ্যয়ন করেন। ১৯৫৯ সালে কৃতিত্বের সাথে পরীক্ষায় পাশের পর তিনি সরকার কর্তৃক নিয়োজিত ধর্ম প্রচারক হিসেবে আঙ্কারায় তাঁর পেশাগত জীবন শুরু করেন। যদিও তাকে তৎকালীন ক্ষমতাসীন কট্টর সেক্যুলার সরকারের সকল প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নির্দেশনা মেনে চলতে হতো। তা সত্বেও একজন মুসলিম ধর্মপ্রচারক ও সমাজবাদী হিসেবে তাঁর সকল আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক কার্যক্রমে, ধর্মীয় ও বুদ্ধিবৃত্তিক বক্তৃতাগুলোয় তিনি দৃঢ় ভূমিকা রেখে চলেন। দেশের সকল রাজনৈতিক বিতর্ক থেকে নিজেকে দূরে রাখার সাথে সাথে গুলেন সবসময় গঠনমূলক সংস্কার, জনকল্যাণ এবং বিশ্বমঞ্চে তুরস্কের কৃতিত্ব তুলে ধরতে দেশবাসীকে আহ্বান করতেন। শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে তার অভিনব ধারণাসমূহ ইতোমধ্যেই বিভিন্ন সমাজে, বিশেষ করে মুসলিম সমাজে, কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।
ধর্মীয় চিন্তার ক্ষেত্রে তিনি গতানুগতিকতা এবং সংকীর্ণতা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে সমর্থ হন। তিনি স্বগোত্রীয় লোক বা অন্য কারো দুর্দশার জন্য কোনো নিদির্ষ্ট সরকারকে কখনো দায়ী করেননি। তিনি নির্যাতিত ও উপেক্ষিত জনতার পক্ষে কথা বলেছেন এবং তাদের সাথে ধর্মীয় বক্তৃতা ও কার্যক্রমের ক্ষেত্রে নতুন উদাহরণ খুঁজেছেন। সুনির্দিষ্ট কোনো সামাজিক, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি মনোনিবেশের পরিবর্তে সংস্কারের ক্ষেত্রে তাঁর আহ্বান ছিল সমাজের সর্বস্তরের মানুষের প্রতি, যাদের মধ্যে রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক অভিজাতরাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। সকল ধরনের সাংঘর্ষিক কৌশল ও দলীয় রাজনীতি উপেক্ষা করে গুলেন নিরবচ্ছিন্নভাবে ঐক্য ও সংহতির আহ্বান করে যাচ্ছেন। স্পষ্টতই, তাত্ত্বিক পরিভাষায় ইসলামী ঐতিহ্যগত সুফীবাদ বা সুফী আন্দোলনে এটি নতুন কিছু নয়। গুলেন যে ধরনের আদর্শ প্রচার করেন তা অতীতের অনেক সুফী আন্দোলনগুলোর মতোই। এতদসত্ত্বেও, গুলেন প্রথাগত কোনো আধ্যাত্মিক গুরুও নন, সুফীও নন।
গুলেন ও তাঁর অনুসারীরা গভীর সক্রিয়বাদিতা ও আধ্যাত্মিকতার সংমিশ্রণে এক নতুন ধরনের ইসলামী বুদ্ধিবৃত্তিকতা ও পরার্থবাদিতা (altruism) উপস্থাপন করেন, যা সমসাময়িক অন্যান্য ইসলামী আন্দোলনে অনুপস্থিত। বিশ্বব্যাপী রাজনীতিভিত্তিক ইসলামী আন্দোলনগুলোর ব্যর্থতা গুলেনের ধর্মপ্রচার বা লেখনীতে প্রতিফলিত হয়নি। অন্যান্য ধর্মীয় দলের পুনরুত্থান অথবা অনৈসলামী ধর্মীয় প্রথা কোনোভাবেই গুলেনের মূল্যবোধভিত্তিক শিক্ষা বিস্তার, গণমুখী আধ্যাত্মিকতা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমকে নিরুৎসাহিত করেনি।
বিংশ শতাব্দীর শেষ কয়েক দশক থেকেই মানবজাতি তাদের রক্ষাকবচ ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক আদর্শের দিকে ব্যাপকহারে ঝুঁকে পড়েছে। এমতাবস্থায় গুলেন মনে করেন যেহেতু প্রকৃত ইসলামী ধর্মীয় আদর্শ অনেকাংশে হারিয়ে গেছে নয়তো বিকৃত হয়েছে সেহেতু ধর্মীয় মতবাদের প্রতি মানুষের নতুন এই ঝোঁক রাজনীতিতেও উগ্রপন্থার জন্ম দিয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোও এর থেকে ব্যতিক্রম নয়। প্রকৃতপক্ষে আধুনিক খ্রিষ্টীয় মৌলবাদের শুরুও বিংশ শতাব্দীর এই শেষ কয়েক দশকেই।
বিশ্ব মানচিত্রে বিভিন্ন মুসলিম জাতিরাষ্ট্রের উত্থানের সাথে সাথে বিভিন্ন ধরনের চরম ধর্মীয় অনুশাসনের উত্থান ঘটে, যা বিশ্বব্যাপী প্রকৃত ইসলামী মূল্যবোধের পুনর্জাগরণকে বাধাগ্রস্ত করে। গুলেনের ধর্ম প্রচার ও লেখনীতে দেখা যায়, কোরআনের শিক্ষা এবং ইসলামী ঐতিহ্যভিত্তিক নৈতিক মূল্যবোধ তুলে ধরার ক্ষেত্রে তাঁর অনেক পূর্বসুরীর বুদ্ধিবৃত্তিক সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল ছিলেন। জাতীয়তাবাদী আদর্শের উপর ভিত্তি করে বেশ কয়েকটি মুসলিম রাষ্ট্র সমৃদ্ধি লাভের চেষ্টা করে।
অনেক আরব ও পারস্য রাষ্ট্রের মতো তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের গোড়ার দিকে অনেক তুরস্কবাসীই জাতীয়তাবাদী আদর্শের উপর ভিত্তি করে একটি সমৃদ্ধশালী আধুনিক রাষ্ট্র গঠন করতে চায় এবং এর ফলে সকল ধরনের ধর্মীয় ঐতিহ্য ও ধর্মীয় বিশ্বাসভিত্তিক কার্যক্রমের প্রতি তারা এক ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ প্রদর্শন করেন। রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল ও ক্ষমতা ধরে রাখার রাজনীতিতে অনেক ধর্মীয় প্রতিনিধিত্বমূলক বিষয়সমূহকে নির্বিচারে অপব্যবহার বা আক্রমণ করা হয়। সমকালীন মুসলিম বিশ্বে বিভিন্ন অসহিঞ্চু শক্তির মাঝে মতাদর্শিক লড়াই, বিশেষ করে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দৃশ্যমান চরমপন্থী মনোভাবের ওপর গুলেনের মডারেট বক্তব্য ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করেছে। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের কল্যাণের লক্ষ্যে গুলেন সততা, সহমর্মিতা ও ধর্মীয় আচারের ক্ষেত্রে ভারসাম্যতার প্রচার করেন।
গুলেনের সমসাময়িক বিশ্বের অন্যান্য দেশের ধর্মীয় নেতা বা ইমামদের মতো গুলেন কখনোই সেক্যুলার সরকার উৎখাত করে তদস্থলে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে বসানোর চেষ্টা করেননি। রাজনীতিতে বা রাষ্ট্রে দুর্নীতি নির্মূলের নিমিত্তে সরকার উৎখাতের ধারণাকে তিনি ভাল বিকল্প মনে করেননি। এ ধরনের ধারণাকে তিনি ইসলামের মূলনীতির পরিপন্থী মনে করেন। তাঁর মতে, কোনো সমাজ বা রাষ্ট্র এ ধরনের দলীয় রাজনীতির মাধ্যমে পরিবর্তিত হতে পারে না। তাই গুলেন সবসময় তাঁর লেখনী ও বক্তব্যে নিবিড় শিক্ষা ও বিশ্বজনীন মূল্যবোধের ভিত্তিতে একটি শুদ্ধ সমাজ গঠনের আহ্বানের ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখার ব্যাপারে সদা সতর্ক ছিলেন।
অনেক লেখক ও বিশ্লেষক গুলেনকে আধুনিক তুরস্কের ‘রুমী’ অভিহিত করেছেন। প্রসঙ্গত, রুমী তুরস্কের কোনিয়া শহরে সমাহিত আছেন। রুমী তের শতকের একজন বিখ্যাত কবি, দার্শনিক ও মরমী ব্যক্তিত্ব। তিনি তুর্কি ও ইরানীদের কাছে সমান জনপ্রিয় ও প্রসিদ্ধ। তবে তাঁর জাতিগত পরিচয় নিয়ে দু’দেশের মধ্যেই মতানৈক্য রয়েছে।
যাহোক, রুমীর সুফীবাদী ধারা জাতিগত ও গোত্রীয় দলাদলির একেবারে বিপরীত। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, আটশত বছর আগে মুসলিম সভ্যতায় কারো অবদান বিবেচনার ক্ষেত্রে জাতিগত ও গোত্রীয় পরিচয় খুবই তুচ্ছ বিবেচিত হতো। বাস্তবে গুলেন আধুনিক তুরস্কের লাখো মানুষের মনে মুসলমানদের মহিমান্বিত এ ধারণা ফিরিয়ে আনেন।
প্রথাগত অর্থে গুলেন কবিও নন, মরমীও (Mystic) নন। সম্ভবত সুফীবাদের উপর তাঁর ধারাবাহিক লেখনী তাকে সুফীর খেতাব এনে দেয়। গুলেনের ধর্ম প্রচার সবার জন্য সহমর্মিতায় পূর্ণ। তাঁর লেখনী কারো বিরুদ্ধে হিংসার উদ্রেক করেনি। এসব কারণেই হয়তো গুলেনকে বাস্তবিকই একজন সুফী ভাবা হয়। তার অনাড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাপন ও খোদাভীরুতাও তাকে সুফী ভাবার দ্বিতীয় একটি কারণ।
হয়তো মুসলমানরা গুলেনকে তুরস্কের অথবা মুসলিম বিশ্বের মহাত্মা বলে সম্বোধন করবে না, তবে পশ্চিমারা ইতোমধ্যে তাঁকে গান্ধী বলা শুরু করেছে। ধর্ম প্রচার ও লেখনীতে গুলেনের সুর অনেকটা রুমী ও গান্ধীর মতোই। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে শান্তি ও মানবতার পতাকাতলে একত্রিত করার ক্ষেত্রে তিনি সবসময় সত্যানুসন্ধান করেছেন। রুমীর মতো গান্ধীও কখনই তাঁর ধর্মীয় প্রথাকে পরিত্যাগ করেননি। অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি অতিমাত্রায় সহনশীলতা প্রদর্শনের জন্য তাঁরা উভয়েই তাদের গোঁড়াসহ অনুরাগী কর্তৃক অপছন্দনীয় অথবা নিন্দিত হয়েছিলেন। এক মৌলবাদী হিন্দু ১৯৪৮ সালে গান্ধীকে হত্যা করে। অন্যান্য গোঁড়া হিন্দু মৌলবাদীদের মতো তার হত্যাকারীও বিশ্বাস করতো যে, গান্ধী ব্রিটিশ আমলে ভারতের মুসলিম বুদ্ধিজীবী ও দক্ষিণ আফ্রিকার সুফীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে হিন্দু ধর্মের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন।
তুরস্কে ধর্মীয় ঘৃণা বিস্তারে উস্কানি দেয়ার অপবাদের যন্ত্রণা থেকে দূরে থাকার জন্য তিনি মার্কিন মুলুকে বসবাস করেন। সেখানে তিনি আন্তঃধর্মীয় সংলাপের (Interfaith dialogue) মাধ্যমে বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের লোকদের একত্রিত করার ক্ষেত্রে অসামান্য কৃতিত্ব লাভ করেন।
অনেক মুসলিম লেখকই মনে করেন বস্তুবাদী পশ্চিমা সমাজ কখনোই ইসলামের বিশ্বজনীন আধ্যাত্মিক বাণীগুলো গ্রহণ করবে না। ফলে অনেক মুসলিম বিশ্লেষক পশ্চিমাদের কাছে ইসলাম ধর্ম প্রচারের কাজকে বৃথা চেষ্টা বলে মনে করেন। গুলেন এ ধরনের সরলীকরণে বিশ্বাস করেন না। তিনি মনে করেন পশ্চিমা বস্তুবাদ কখনো কুরআন ও সুন্নাহভিত্তিক একটি সহমর্মী সমাজ বিনির্মাণের পথে বাধা হতে পারে না। তিনি বিশ্বাস করেন ইসলামের মৌল উৎস হতে উৎসারিত আধ্যাত্মিকতা অনুধাবন ও গ্রহণের ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের কোনো অন্তর্নিহিত সমস্যা নেই। প্রকৃত সাম্যভিত্তিক একটি বিশ্বসমাজ বিনির্মাণে মুসলমানরা পশ্চিমাদের আকৃষ্ট করতে কতটা ভালোভাবে ইসলামী আধ্যাত্মিকতা ও ইসলামের সার্বজনীনতাকে তুলে ধরতে পারে, সেটাই তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
ধর্মীয় বিশ্বাসের উগ্র বহিঃপ্রকাশ ও জবরদস্তিমূলক প্রচারণার পরিবর্তে গুলেন গুরুত্ব দিতেন ব্যক্তির ভেতরের আধ্যাত্মিকতা, ইসলামের সহমর্মিতা ও গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোর প্রচারের দিকে। আধ্যাত্মিকতার এ নতুন ধারা প্রবর্তনের ক্ষেত্রে তিনি প্রাচ্য-প্রতীচ্য, উত্তর বা দক্ষিণের কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্যের প্রতি অতিগুরুত্ব দেয়ার বিষয়টি সুকৌশলে এড়িয়ে গেছেন। তিনি সকল ধরনের জাতীয়তাবাদী গোত্রীয় সংঘাতমূলক কর্মপন্থার সমালোচনা করেছেন। যে সব নীতি মানুষে মানুষে বিভাজন, বৈষম্যমূলক ও পক্ষপাতমূলক আচরণের জন্ম দেয়, তিনি তার সমালোচনা করেছেন।
জাতি সম্পর্কিত ধারণায় তিনি বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর প্রতি পক্ষপাত করেননি। যে আনাতোলিয়া সবসময় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিল, তা আজ এক ঐক্যবদ্ধ জাতি। সব ধরনের অন্ধ স্বদেশীকতামুক্ত হয়ে তিনি আনাতোলিয়াকে দেখেছেন ‘মেসোপটেমিয়া, বলকান ও মধ্য এশিয়ার মানুষের মহাপরীক্ষা’ হিসেবে। তাঁর এ ধারণা তাকে এ অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে, সমগ্র মানবজাতি আদম ও হাওয়ার ঔরসজাত। তিনি সকল ধর্মের, সকল মানুষের অন্তর্নিহিত ভালো গুণগুলো দেখার প্রতি গুরুত্ব দেন। তিনি আরো গুরুত্ব দেন মানুষের ভালো কাজের প্রতি এবং প্রত্যাখান করেন সে সকল ফাঁকা বুলি, যেগুলো মানুষকে হিংসা প্রচার করতে শেখায় ও মানুষের মাঝে ভীতি ছড়িয়ে দেয়।
গুলেন বিশ্বাস করেন পৃথিবীর সকল মানুষেরই আধ্যাত্মিক মুক্তির প্রতি এক ধরনের আকুতি রয়েছে। অন্য মানুষের স্বর্গীয় গুণাবলীগুলো উপলব্ধির মাধ্যমেই এ নশ্বর পৃথিবীতে মানুষ এ আধ্যাত্মিকতা অর্জন করতে পারে। এ বিশ্ব ও পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্বকে গুলেন একটি খোলা বই মনে করেন। আর কোরআনকে বিবেচনা করেন সর্বশক্তিমান আল্লাহর পক্ষ থেকে সমগ্র মানব জাতির জন্য পথ প্রদর্শক হিসেবে। গুলেনকে যারা পর্যবেক্ষণ করেন তারা গুলেনের বিভিন্ন লেখনী ও সরাসরি কথোপকথনে এ সকল ভাবনার প্রতিফলন দেখেন। তারা বিশ্বাস করেন গুলেন প্রকৃতপক্ষেই একজন সুফী। তারা এও মনে করেন, গুলেনের এ ধরনের শান্তিপূর্ণ আহ্বান সেক্যুলার তুরস্কের উগ্র তরুণ প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় হবে না। তাদের এ ধরনের আশংকা বাস্তবে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বাস্তবে দেখা গেছে, তরুণ প্রজন্মই তাঁর বেশি অনুসারী।
যদিও গুলেন ধর্মীয় ও সামাজিক কাজে খুবই সক্রিয়, তবে বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দল বা শক্তির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ভূমিকা রাখার ব্যাপারে তিনি অনিচ্ছুক। গুলেনের এই অরাজনৈতিক সত্ত্বার কারণে তিনি তুরস্কের সকল শ্রেণীর মানুষের আশার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছেন।
এজন্য, এমনকি সেক্যুলার রাজনৈতিক দলগুলোও ভোটারদের আনুকূল্য পেতে গুলেনের ধর্মপ্রচার ও যুক্তি প্রদর্শন শৈলী ব্যবহারের চেষ্টা করেছেন। তৎসত্ত্বেও তিনি তার সারা জীবন সকল ধরনের রাজনৈতিক কার্যক্রম থেকে দূরে থেকেছেন।
অনেক পশ্চিমাদের চোখে গুলেনের জীবনধারা প্রাচ্য ভঙ্গীর সন্ন্যাসজীবন। এমনকি তারা তাঁকে নির্বাণের (nirvana) খোঁজে জীবন উৎসর্গীকৃত একজন মুসলিম দালাইলামাও মনে করেন। যাহোক, মার্কিন মুলুকে তাঁর স্বেচ্ছা নির্বাসনে কখনোই তিনি মিডিয়াতে প্রচার বা জনপ্রিয়তার আকাঙ্ক্ষী হননি। একজন প্রকৃত মুসলমান হিসেবে তিনি তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই ব্যাপৃত রেখেছেন আন্তঃধর্মীয় কার্যক্রম, জনহিতকর ও ইসলামী দায়িত্ব পালনে।
যেখানে গুলেনের সমসাময়িক অন্যান্য মুসলিম পণ্ডিতগণ নিজেদেরকে বিভিন্ন মাজহাবী বিতর্কে জড়িয়েছেন; গুলেন সেখানে তাঁর লেখনী বা ধর্মপ্রচারে শিয়া-সুন্নী, হানাফী-হাম্বলী, মালিকী-শাফেয়ী এসব মাজহাব ব্যাখ্যায় মনোনিবেশ করেননি। মাজহাবী বিতর্কে জড়িত পণ্ডিতগণ মনে করেন, মুসলিম জাতিকে শিরক ও বিদয়াত মুক্ত করতে ও মুহাম্মদ (সা) প্রদর্শিত ‘সিরাতুল মুস্তাকিম’ বা সরল পথে প্রতিষ্ঠিত থাকতে মাজহাবগত পার্থক্য খোঁজাই সঠিক পথ।
কিন্তু গুলেনের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার গুণাবলীর সাথে মানব সত্ত্বার ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র স্থাপন। তাছাড়া মুসলিম সভ্যতার উদারতা ও বদান্যতার হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার আশা কেবল তখনই করতে পারবো যখন বিপুলসংখ্যক মানুষ নিঃস্বার্থভাবে শুধুমাত্র ইসলাম অনুমোদিত আধ্যাত্মিকতা অর্জনের জন্য এবং সমগ্র মানবতার কল্যাণ ও মানমর্যাদা সমুন্নত রাখতে নিজেদের উৎসর্গ করবে। গুলেন বিশ্বাস করেন, রাজনৈতিক বা সামরিক উপায়ে এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। যে কোনো বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে সকল পক্ষের সংলাপ ও কূটনীতি এ ক্ষেত্রে অধিকতর ভাল সমাধান। মুনাফার লোভ ও অর্থ উপার্জনের জন্য প্রতারণার আশ্রয় যারা নেন, তারা সমাজের অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ। তাদেরকে মোকাবিলার সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে কল্যাণমুখী শাসন ব্যবস্থা।
অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্রের মতো তুরস্ক কখনোই সরাসরি ঔপনিবেশিক শাসনাধীন ছিল না। এ বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে তুরস্কের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল ইসলামের সার্বজনীনতা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা। এটা তাদের আরো সমর্থ করেছিল শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও আন্তঃধর্মীয় সংলাপে। আমেরিকা ও তুরস্কে বিভিন্ন আন্তঃধর্মীয় ও মুসলিম সমাবেশে প্রদত্ত গুলেনের ধর্মোপদেশসমূহও এ ধরনের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের আহ্বানে পরিপূর্ণ। গুলেনের লিখিত অসংখ্য বইয়েও এ ধারণা সমুজ্জ্বল। সার্বজনীন মূল্যবোধ প্রচারের পাশাপাশি তুরস্কের জনগণের দুঃখ দুর্দশার বিষয়েও গুলেন মনোযোগী ছিলেন। যদিও তিনি জানতেন তুরস্কের শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারে তাঁর অতি উৎসাহ কাছের লোকদের সাথে তাঁর দূরত্বের সৃষ্টি করতে পারে, তবুও এ ব্যাপারে তিনি ক্ষান্ত হননি। এ কাজ করতে গিয়ে তিনি বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দল, উপদল বা গোত্রকে তাঁকে নিয়ে মাতামাতি করা বা সম্পূর্ণভাবে বর্জন করার সুযোগ করে দেননি। তাঁর কৌশল খুবই পরিষ্কার। তাঁর সোজা কথা হলো, “মুসলমান হিসেবে যে কোনো ভাল কাজের সাথে আমি আছি এবং যে কোনো খারাপ কাজকে আমি বর্জন করবো।”
উগ্র সেক্যুলার শক্তি তাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের ক্ষেত্রে গুলেনকে ব্যবহারের চেষ্টায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। তাদের এমন একটি চেষ্টা ছিল গুলেনকে এমন একজন ধর্মীয় সংস্কারক হিসেবে চিহ্নিত করা, যার সংস্কার চেষ্টা রাসূল (সা) এর ধর্ম প্রচারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এতে ব্যর্থ হয়ে ইসলাম বিরোধী কিছু শক্তি তুরস্কের ভিতর ও বাইরে তাঁকে ‘তুরস্কের হবু খোমেনী’ হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু খোমেনী যেমন বহু বছর তুরস্কের বুসরা শহরে বাস করেও এবং তুরস্ক ও ইরাকের সুন্নী সম্প্রদায়ের সাথে গভীর মেলামেশা করেও নিজেকে সুন্নী বানিয়ে ফেলেননি, তেমনী মার্কিন মুলুকে গুলেনের পরবাসী জীবনও গুলেনকে বিপ্লবী বা বস্তুবাদী ইসলামী ধর্মপ্রচারক করে তুলেনি।
গুলেনের দাড়িবিহীন মুখ বা তার আধুনিক বেশভুষা তাঁকে কোনো অংশেই অনৈসলামী করে তোলেনি। তিনি কোনো ধর্মান্ধ গোঁড়াও নন, আবার এমন তথাকথিত আধুনিকও নন যে, সর্বশক্তিমান আল্লাহর গুণাবলী উপলব্ধিতে অসমর্থ। কেউ যদি গুলেনের শিক্ষা ও সংস্কৃতি আন্দোলনের সাথে ইরানে খোমেনীর বিপ্লবের তুলনা করে, তা হবে এক ধরনের নির্বুদ্ধিতা। কেননা এতে একদিকে গুলেনের সমাজ সংস্কার ও ইসলামী মূল্যবোধ পুনর্জাগরণের নানা রকম কার্যক্রমকে অস্বীকার করা হবে; অপরপক্ষে তুরস্ক ও ইরানের মধ্যকার অমিলগুলো সম্পর্কে অজ্ঞানতা প্রকাশ করা হবে।
গুলেন তাঁর লেখনী, ধর্মোপদেশ ও বক্তৃতায় সবসময় চেষ্টা করেছেন ভালোর বিকাশ ও মন্দের বিনাশ করতে। তিনি বেছে নিয়েছেন গঠনমূলক কাজ এবং এক ধরনের সক্রিয় আধ্যাত্মিক জিহাদ যাতে করে তাঁর লেখনী ও বক্তৃতার মাধ্যমে মানুষের আধ্যাত্মিক উৎকর্ষতা সাধনের ক্ষেত্রে মানুষের মনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারেন। তাঁর জিহাদের ডাকে রয়েছে সহমর্মিতা ও সুফীবাদী ভালোবাসার আহ্বান। এমনকি ধর্মীয় বাণী প্রচারের ক্ষেত্রেও নেই কোনো আগ্রাসী মনোভাব।
“আমাদের আগ্রহ, আমাদের পরিবেশ ও মানুষের প্রতি আমাদের ভালবাসায়-সৃষ্টি আলিঙ্গনে, আমাদের সমতায়- যা নির্ভর করে আমাদের মৌল স্বভাব জানা, বুঝা ও সৃষ্টিকর্তার সাথে আমাদের সম্পর্ক অনুধাবনে। মানবতাবাদ হচ্ছে এমন একটি মতবাদ যা ভালবাসা ও মানবতার কথা বলে এবং যা বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। কোনো কোনো গোষ্ঠী মানবতাবাদের এক ধরনের বিমূর্ত ও ভারসাম্যহীন ব্যাখ্যা আরোপ করে। তারা মানুষের মনে ইসলামের জিহাদ সম্পর্কে ভ্রান্তিমূলক ব্যাখ্যা প্রদান করে। জিহাদ আত্মরক্ষামূলক হতে পারে অথবা সৃষ্টিকর্তা ও মানুষের মুক্তচিন্তার মাঝে বাধা হতে পারে।”
আজ অনেক বছর ধরেই পশ্চিম ভাষ্যকাররা প্রশ্ন তুলছে, কেন বিশ্বের খ্যাতিমান মুসলিম ও অমুসলিম লেখকগণ ইসলাম ও জিহাদের সাথে সম্পর্কিত জটিল বিষয়গুলোর কোনো সহজ ব্যাখ্যা দিতে পারছেন না। এ ব্যাপারে গুলেনের উপরিউক্ত বক্তব্য খুবই স্পষ্ট ও সঙ্গতিপূর্ণ। বিভিন্ন ইসলামী বিষয় ও মানবতাবাদের সাথে তার আন্তঃসম্পর্ক ব্যাখ্যায় তিনি স্পষ্ট ও সঙ্গতিপূর্ণ। এভাবে গুলেন মুসলিম বিশ্ব ও পশ্চিমাদের মধ্যে বিরাজমান বুদ্ধিবৃত্তিক শূন্যতা কিছুটা হলেও কমাতে সক্ষম হয়েছেন।
অপরপক্ষে, মানবাধিকার সম্পর্কে পশ্চিমাদের ধারণা প্রশ্নবিদ্ধ করা অথবা চ্যালেঞ্জ করা তুলনামূলক সহজ কাজ। যাহোক, মানবাধিকার বা মানবতার ব্যাপারে ফাঁকা বুলি কোনো জাতি বা মানবগোষ্ঠীর জন্য ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে না। এক্ষেত্রে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে সকল মুসলিম রাজনৈতিক দল বা আন্দোলন ইসলামী মূল্যবোধ প্রচারের কাজে ব্যাপৃত, তাদের প্রবক্তাদের চেয়ে গুলেন আলাদা।
ইসলামী শাসন ব্যবস্থার একটি সামগ্রিক মডেল হিসেবে গুলেন বিশেষ কোনো জাতিরাষ্ট্রকে উপস্থাপন করেননি। তার পরিবর্তে, গুলেন মুভমেন্ট বিভিন্ন ধর্ম ও জাতির মধ্যে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে পশ্চিমা ভোগবাদী সমাজের কাছে একটি পূর্ণাঙ্গ ভাল বিকল্প উপস্থাপন করার কঠিন কাজ শুরু করেছে।
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে সেতু বন্ধনের ক্ষেত্রে গুলেনের শান্তিপূর্ণ কৌশল তুরস্কের জনমানসে কী গভীর প্রভাব ফেলছে তা হয়তো গুলেন নিজেও ধারণা করতে সমর্থ্য নন।
সমগ্র মানবজাতির জন্য শান্তি ও মর্যাদা আনয়নের ক্ষেত্রে গুলেনের বিশ্বাসযোগ্য যুক্তি বুদ্ধিবৃত্তিকতা প্রসারে সত্যিই এক অনন্য উদাহরণ। গুলেন তার সমস্ত লেখনিতে কোনো বিশেষ মত দীক্ষাদানের পরিবর্তে একটি মূল্যবোধভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তার এই চেষ্টার অংশ হিসেবেই তুরস্কের শিক্ষাবিদ ও ব্যবসায়ীদের সহায়তায় সমগ্র পৃথিবী জুড়ে শত শত স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। সে সব স্কুলে শিক্ষকগণ মূল্যবোধভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার মহত্তম আদর্শগুলো বাস্তবায়নের চেষ্টা করছেন।
যেহেতু গুলেন মুভমেন্টের পুরোভাগে রয়েছেন তুর্কি বংশোদ্ভুত সুন্নী মুসলিমগণ সেহেতু গুলেন আন্দোলনের তুর্কী ও সুন্নী বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আরো অনেক কিছু বলা যায়। কারো মনে এ প্রশ্ন জাগা অস্বাভাবিক নয় যে, তুরস্কের মত চরম সেক্যুলার রাষ্ট্রে গুলেনের মত একজন শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারকের আবির্ভাব হলো কী করে? এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, ইসলাম ও মানবতার প্রতি গুলেনের জীবনব্যাপী নিষ্ঠাই সম্ভবত তাঁর আবির্ভাবের কারণ। গুলেনের আদর্শে যারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন তাঁরা কখনই ইসলামী মূল্যবোধ, শিক্ষাব্যবস্থা বা সংস্কৃতি প্রচারের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের দলীয় সংকীর্ণতা বা অন্ধ জাতীয়তাবাদে দুষ্ট হননি। গুলেন মুভমেন্টের সফলতার মূল রহস্য এখানেই। এটাই তাকে একজন জীবন্ত কিংবদন্তীতে পরিণত করেছে। এজন্যই তিনি ২০০৮ সালের সবচেয়ে প্রভাবশালী বুদ্ধিজীবী বিবেচিত হয়েছেন।